ল্যরাজ : মদ্ররাজ অর্তায়নের পুত্র। তিনি পূর্বজন্মে হিরণ্যকশিপুর পুত্র সংহ্লাদ ছিলেন। দুর্যোধনের সাথে আগে সাক্ষাত হওয়ায় তিনি কৌরব পক্ষে যোগ দেন। অথচ তিনি পান্ডবদের মাতুল। ষোঢ়শ দিনে যুদ্ধের শেষে কর্ণ প্রভাতে দুর্যোধনের কাছে গিয়ে নি:সংকোচে অর্জুন বধে তার দূর্বলতার দিকগুলি তুলে ধরলেন। তিনি শল্যের প্রশংসা করে বলেন শল্য শুধু একজন বীর যোদ্ধাই না তিনি কৃষ্ণের সমকক্ষ একজন সারথি। তখনকার সময়ে শল্যের মত অশ্বতত্ত্বজ্ঞ কেহ ছিলেন না। তাই সারথি হিসেবে শল্যকে পেলে তিনি ইন্দ্রকেও পরাজিত করতে পারবেন। দুর্যোধন কর্ণের প্রস্তাবে সায় দিয়ে বললেন তাই হবে। দুর্যোধন শল্যের কাছে গিয়ে বিনীত সুরে নিবেদন করে বললেন,“মদ্ররাজ, আপনি সত্যব্রত, শত্রুতাপন! মহাবীর কর্ণ প্রধান প্রধান ভূপালগণের মধ্যে আপনাকেই সারথি হিসেবে পেতে চাইছে। ব্রহ্মা যেমন সারথি হয়ে মহাদেবরে রক্ষা করেছিলেন, কৃষ্ণ যেমন সারথি হয়ে অর্জুনকে রক্ষা করছে তেমনি আপনি কর্ণের সারথি হয়ে কর্ণকে রক্ষা করুন। আমরা ইতোমধ্যেই ভীষ্ম, দ্রোণকে হারিয়েছি। অনেক রথি-মহারথি হারিয়েছি। পান্ডবরা যথার্থ বলশালী। আমাদের অবশিষ্ট সেনা যাতে আর ক্ষয় না হয় সে জন্যে আপনার সদয় হস্তক্ষেপ কামনা করছি। এখন আমাদের একমাত্র ভরসা কর্ণ ও আপনি। কর্ণের উপর আমার আস্থা আছে। আপনি সাহায্য করলে নিশ্চয় আমার জয়ী হব। আপনি কর্ণের সারথি পদ অলংকৃত করুন। সূর্যের আগমনে যেমন অন্ধকার বিনষ্ট হয় তেমনি আপনি কর্ণের সহিত মিলিত হয়ে অর্জুনেকে বিনষ্ট করুন।”

দুর্যোধনের প্রস্তাব শ্রবণ করে শল্য ক্রুদ্ধ হলেন। তিনি হাত নেড়ে, ললাটে ত্রিশিখা ভ্রুকুটি বিস্তার করে, চক্ষুদ্বয় রক্তবর্ণ ধারণ করে বললেন,“ হে কুরুরাজ! তুমি আমাকে কর্ণের সারথ্য স্বীকার করে নেয়ার জন্য আমার স্পষ্টতই মনে হচ্ছে, তুমি আমাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে অপমান করছ। আমার থেকে কর্ণ অধিক বলশালী বলে কর্ণের প্রশংসা করছ। কিন্তু আমি তো কর্ণকে আমার সমকক্ষ মনে করি না। মহারাজ! তুমি আমাকে এমন কর্মে নিযুক্ত করতে পার না, উচ্চ জাতি নীচু জাতির দাসত্ব করে না। আমাকে এ কার্যে নিয়োগ করা তোমার কর্তব্য নয়। ক্ষত্রিয় কখনও সূতজাতির আজ্ঞাবহ হতে পারে না। আমি রাজর্ষিকুলজাত, আমি মূর্ধাভিষিক্ত, মহারথ, বলে খ্যাত, বন্দিগণের সেবনীয় ও স্তুতিভাজন। সুতরাং আমি সূতপুত্রের সারথ্য করতে পারি না। হে রাজন! অপমান সহ্য করে কখনও যুদ্ধ করতে পারি না, অতএব আমাকে ক্ষমা করে বিদায় দাও।” এ কথা বলে শল্যরাজ আসন থেকে উঠে গমন করতে উদ্যত হলেন। তখন দুর্যোধন শল্যকে ধরে অতিব মিষ্টবাক্যে বললেন,“ হে মদ্রেশ্বর! আপনি যা যা বললেন তা সবই যথার্থ, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু মদ্ররাজ, আমি যে চিন্তা করে আপনাকে সারথ্য হতে অনুরোধ করেছি তা শ্রবণ করুন। কর্ণ বা অন্য রাজন্যবর্গ আপনার থেকে শ্রেষ্ঠ নয়। আপনি যুদ্ধে শত্রুদের শল্যস্বরূপ। সেজন্যে আপনার নাম শল্য বলে খ্যাত। আমি বা কর্ণ আপনার থেকে শ্রেষ্ঠ নই। তথাপি আপনাকে যুদ্ধে কর্ণের সারথ্য বলে স্বীকার করেছি কারণ আমি কর্ণকে অর্জুন অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী এবং আপনাকে দেবকীপুত্র অপেক্ষা সমধিক গুণশালী জ্ঞান করে থাকি।” তখন শল্য দুর্যোধনের বাক্য শ্রবণ করে নিজেকে খুবই গর্বিত বোধ করলেন এবং বললেন,“ কুরুরাজ! তুমি আমাকে দেবকীনন্দন কৃষ্ণের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলেছ, সেজন্যে আমি অতিশয় প্রীত হয়েছি। আমি তোমার অভিলাষ পূর্ণ করব। তবে একটি শর্ত আমি কর্ণকে আমার ইচ্ছানুসারে বাক্য প্রয়োগ করব।” কর্ণ ও দুর্যোধন শল্যের প্রস্তাব মেনে নিলেন।

সপ্তদশ দিবসের যুদ্ধে শর্তানুযায়ী শল্য কর্ণকে নানাবিধ বিষয়ে অর্থ বা অনর্থভাবে প্রশ্ন করতে লাগলেন।কখনও কখনও পান্ডবদের প্রশংসা করতে লাগলেন। কখনও বা অর্জুনকে কর্ণ অপেক্ষা মহাধনুর্ধর বলে প্রশংসা করতে লাগলেন। এতে কর্ণ ও শল্যের মধ্যে বাক বিতন্ডার সৃষ্টি হয়। এর একটিই উদ্দেশ্য ছিল কর্ণকে যুদ্ধে অমনযোগী করে তুলা। কিন্তু যুদ্ধের পূর্বেই যুধিষ্ঠির মাতুল শল্যকে বলেছিলেন তিনি অর্জুন ও কর্ণের দ্বৈরথ যুদ্ধে যদি কর্ণের সারথি হন তাহলে তিনি যেন কর্ণের তেজ ও সাহসকে তিরস্কার করেন যাতে কর্ণ যুদ্ধক্ষেত্রে হতাশাগ্রস্থ হন।

সপ্তদিবস যুদ্ধে অর্জুন কর্তৃক কর্ণ নিহত হওয়ায় কৌরবদের শিবিরে হতাশার সৃষ্টি হলো। দুর্যোধন ভেঙ্গে পড়লেন। কৌরবপক্ষীয় বীরগণ দুর্যোধনকে সেনাপতি নিয়োগ করার জন্য অনুরোধ করেন যাতে তারা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারেন। অশ্বত্থামার পরামর্শে দুর্যোধন শল্যকে সেনাপতি নিযুক্ত করেন।

অষ্টাদশ দিবসের যুদ্ধ শুরু। শল্য অতি সমৃদ্ধশালী সর্বতোভদ্র ব্যুহ রচনা করলেন। শল্য মদ্রদেশীয় বীরগণ ও কর্ণপুত্রদের সংগে ব্যুহের সম্মুখে অবস্থান করলেন। কৃতবর্মা ত্রিগর্তসৈন্যসহ ব্যুহের বামে, শক ও যবন সৈন্যসহ কৃপাচার্য ব্যুহের দক্ষিণে, কাম্বোজ সৈন্যসহ অশ্বত্থামা ব্যুহের পৃষ্ঠদেশে এবং কৌরববীরগণসহ দুর্যোধন ব্যুহের মধ্যদেশে অবস্থান করলেন। এদিকে পান্ডবগণও ব্যুহ রচনা করে তিনভাবে বিভক্ত হয়ে অগ্রসর হতে লাগলেন। দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হলো। শল্যের বাণের আঘাতে পান্ডব পক্ষের হাতি, ঘোড়া, রথী ও পদাতিক সেনাগণ

বিপর্যস্ত হয়ে ছুটাছুটি করতে লাগল। ভীমের গদাঘাতে শল্যের চারটি অশ্ব মারা যাওয়ায় শল্য ভীমের উপর তোমর প্রয়োগ করে তার বুক বিদ্ধ করল। ভীমও সেই তোমর বুক থেকে টেনে বেড় করে শল্যের সারথিকে হত্যা করল। উভয়ই আহত হলে কৃপাচার্য তখন শল্যকে রথে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করলেন। কিছুক্ষণ পর যুধিষ্ঠির ও শল্যের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হলো। শল্যের চার বাণের আঘাতে যুধিষ্ঠিরের চার অশ্ব নিহত হলো। তখন ভীমও শল্যের চার অশ্ব ও সারথিকে হত্যা করল। তখন শল্য রথ থেকে নেমে খড়গ ও চর্ম নিয়ে যুধিষ্ঠিরকে আক্রমন করল। কিন্তু ভীমসেন শরাঘাতে শল্যের চর্ম ও ভল্ল দ্বারা তার খড়গের মুষ্টি ছেদন করলেন। ইতোসময়ে যুধিষ্ঠির শল্য বধের জন্য প্রস্তুত হলেন। যুধিষ্ঠির অশ্বসারথিহীন রথে অবস্থান করে স্বর্ণের ন্যায় উজ্জ্বল মন্ত্রসিদ্ধ শক্তি অস্ত্র শল্যের প্রতি নিক্ষেপ করলেন। উল্কার মত সেই শক্তি অস্ত্র স্ফুলিঙ্গ ছড়াতে ছড়াতে মহাবেগে শল্যের বুক বির্দীণ করল। বজ্রাহত পর্বতশৃঙ্গের মত শল্য বাহু প্রসারিত করে ভূমিতে লুটিয়ে পড়লেন।
সূত্র : মহাভারত ও বিভিন্ন পৌরানিক গ্রন্থ

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র