১২১. ভীম, অর্জ্জুন, নকুল ও সহদেবেরঅন্বেষেণে দ্রৌপদীর গমনঅনেক বিলম্ব দেখি ধর্ম্ম নরপতি।চিন্তাযুক্ত কহিলেন দ্রৌপদীর প্রতি।।শুনহ আমার বাক্য দ্রৌপদী সুন্দরী।শ্রীহরি স্মরণ করি আন গিয়া বারি।।পাইয়া পতির আজ্ঞা পতিব্রতা নারী।জলপাত্র লয়ে যায় আনিবারে বারি।।মহাঘোর বনমধ্যে প্রবেশিয়া সতী।ভয় পেয়ে শ্রীকৃষ্ণেরে ডাকে গুণবতী।।বনমধ্যে যান কৃষ্ণা সশঙ্কিতা মনে।কতক্ষণে উত্তরিল সরোবর স্থানে।।তৃষ্ণায় কাতর অতি শুঙ্ক কলেবর।জল পান করিবারে গেল সরোবর।।জলেতে নামিল যেই দ্রুপদকুমারী।হইল তাহার মৃত্যু স্পর্শি মায়াবারি।।মহাভারতের কথা অমৃত সমান।কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।১২২. ভ্রাতৃগণ ও দ্রৌপদীরঅন্বেষণে রাজা যুধিষ্ঠিরের গমনএখানে আশ্রমে বসি রাজা যুধিষ্ঠির।সবার বিলম্ব দেখি হলেন অস্থির।।কোথা ভীম ধনঞ্জয় মাদ্রীর তনয়।তোমা সবা না দেখিয়া প্রাণ বাহিরায়।।কোথা লক্ষ্মী গুণবতী দ্রুপদনন্দিনী।তোমার গুণেতে বশ ছিল যত মুনি।।আমার সঙ্গেতে প্রিয়ে বহু দুঃখ পেয়ে।হস্তিনায় গেলে বুঝি আমারে ছাড়িয়ে।।এই মত পরিতাপ পেয়ে নরপতি।বনে বনে বিচরণ করে দুঃখমতি।।অরণ্যের মধ্যে রাজা করি অন্বেষণ।ভীমের পাইয়া চিহ্ন করেন গমন।।যেই পথে গিয়াছেন বীর বৃকোদর।কত শত বৃক্ষ চূর্ণ, কত শিলাবর।।গমন করেন সেই পথে যুধিষ্ঠির।কতক্ষণে উপনীত সরোবর তীর।।সরোবর তীরে দেখিলেন রম্য বন।অপ্রমিত মৃগ পশু মহিষ বারণ।।দেখিয়া এ সব শোভা নাহি তাহে চান।উদ্বিগ্ন চিত্তেতে রাজা সরোবরে যান।।সরোবরে দৃষ্টি যেই করেন নৃপতি।দেখেন ভাসিছে জলে ভীম মহামতি।।তার পাশে ধনঞ্জয় ভাসিতেছে জলে।মাদ্রীপুত্র ভাসে দোঁহে পবন হিল্লোলে।।দ্রৌপদী সুন্দরী ভাসে জলের উপরে।শরীর ভেদিল যেন সহস্র তোমরে।।দেখি রাজা মূর্চ্ছা হৈয়া পড়েন ধরণী।অচেতন ছটফট করে নৃপমণি।।কতক্ষণে সংজ্ঞা পেয়ে রাজা যুধিষ্ঠির।দেখিয়া সবার মুখ হলেন অস্থির।।পুনর্ব্বার পড়িলেন ধরণী উপর।চেতন পাইয়া পুনঃ উঠেন সত্বর।।কাঁপিতে কাঁপিতে পুনঃ পড়ে ঘনে ঘন।হা কৃষ্ণ হা কৃষ্ণ বলি করেন রোদন।।মহাভারতের কথা অমৃত লহরী।কাশীরাম দাস কহে, ভবভয় তরি।।১২৩. রাজা যুধিষ্ঠিরের বিলাপএইরূপে নরপতি কান্দে উচ্চৈঃস্বরে।কোথা কৃষ্ণ রমানাথ রাখহ আমারে।।এমন বিপদে কেন ফেলিলে আমায়।কোন দোষে দোষী আমি নহি তব পায়।।পিতৃগণ মোরে বুঝি দিল অভিশাপ।এই জন্য জন্মাবধি পাই মনস্তাপ।।অত্যন্ত বালককালে হৈল মহাশোক।অজ্ঞানে পিতার হৈল গতি পরলোক।।অনন্তর অস্ত্রশিক্ষা করি যেই কালে।বিহার কারণে যাই জাহ্নবীর জলে।।তাহে দুঃখ দিল দুয্যোধন দুরাচার।প্রকারে করিতেছিল ভীমের সংহার।।উদ্ধার হইল ভীম পূর্ব্বকর্ম্মফলে।নতুবা জীবন পায়, কে কোথা মরিলে।।মাতার সহিত পরে ছিনু পঞ্চ জন।বিনাশে মন্ত্রণা করে যত শত্রুগণ।।নির্ম্মাণ করিয়া জতুগৃহে দুরাচার।প্রকারে করিতেছিল সকলে সংহার।।তাহে সুমন্ত্রণা দিল বিদুর সুমতি।তাঁহার কৃপায় তথা পাই অব্যাহতি।।ঘোর বনে প্রবেশিয়া ভ্রমি বহু দেশ।পাইলাম যত দুঃখ নাহি তার শেষ।।ভ্রমিতে ভ্রমিতে আসি পাঞ্চালনগরে।স্বয়ম্বর বার্ত্তা শুনি যাই সভাগৃহে।।লক্ষ্য বিন্ধি ধনঞ্জয় জিনে রাজগণে।দ্রৌপদী বরণ কৈল আমা পঞ্জ জনে।।বিবাহ করিয়া পুনঃ আসিলাম দেশে।করেছি যতেক কর্ম্ম কৃষ্ণের আদেশে।।বিদায় হইয়া কৃষ্ণ গেল দ্বারকায়।বিধির নিযুক্ত কর্ম্ম লঙ্ঘন না যায়।।কপট পাশায় দুষ্ট নিল রাজ্য ধন।তোমা সবে সঙ্গে নিয়া আসি ঘোর বন।।কাননে অনেক দুঃখ পেলে ভ্রাতৃগণ।অনেক প্রমাদ হৈতে হইল মোচন।।কাননে আসিবামাত্র রাক্ষস কির্ম্মীর।তোমা সবা বিনাশিতে করিলেক স্থির।।রাক্ষসী মায়াতে কৈল ঘোর অন্ধকার।মারিয়া রাক্ষসে ভীম করিল উদ্ধার।।অনন্তর জটাসুর এল কাম্যবনে।তারে মারি পরিত্রাণ কৈলে চারি জনে।।খেদ করি সরোবরে চাহে নৃপমণি।দেখিয়া সবার মুখ পড়েন ধরণী।।কতক্ষণে মূর্চ্ছা ত্যজি উঠেন নৃপতি।ধনঞ্জয় ভাই বলি কান্দেন সুমতি।।কেবা আর কুরুযুদ্ধে করিবে উদ্ধার।যুদ্ধ হেতু স্বর্গে অস্ত্র শিখিলে অপার।।যুদ্ধেতে হইয়া তুষ্ট দেব ত্রিলোচন।পাশুপাত অস্ত্র তোমা করেন অর্পণ।।মাতলিরে পাঠালেন দেব পুরন্দর।আদর করিয়া নিল স্বর্গের উপর।।শিখিরে যতেক বিদ্যা নাহিক অবধি।স্বর্গেতে আছিল বহু অমর বিবাদী।।ছলে পাঠাইলা ইন্দ্র নগর ভ্রমণে।করিলে দেবের কার্য্য মারি দৈত্যগণে।।দৈত্যবধে হৃষ্ট হয়ে যত দেবগণ।নিজ নিজ মায়া সবে করিল অর্পণ।।দেবের অসাধ্য কার্য্য করিলে সাধন।তুষ্ট হয়ে অস্ত্র দিল সহস্রলোচন।।কিরীট শোভন শিরে হাতে ধনুঃশর।এ সব স্মরিয়া ভাই দহে কলেবর।।রহিল প্রচণ্ড শত্রু রাজা দুর্য্যোধন।সহায় যাহার আছে সূতের নন্দন।।শেষ দুঃখ আছে মাত্র অজ্ঞাত বৎসর।চল ভাই বঞ্চি গিয়া পঞ্চ সহোদর।।এত বলি নরপতি চাহি মায়াজলে।মূর্চ্ছাগত হয়ে পুনঃ পড়ে ধরাতলে।।মূর্চ্ছা ত্যজি পুনর্ব্বার উঠেন সত্বর।চাহিয়া সবার মুখ রোদন তৎপর।।ধিক্ ধিক্ দুর্য্যোধন অতি কুলাঙ্গার।কপটেতে অতি দুঃখ দিল দুরাচার।।কাননে করিনু বাস ভাই পঞ্চ জন।অবশেষে সকলেতে হলেম নিধন।।দুর্য্যোধনে কি দূষিব, মম কর্ম্মফলে।জন্মাবধি বিধি লিখিল কপালে।।ভাবিয়া ভবিষ্য তত্ত্ব বুঝিয়া অসার।নিতান্ত দেখেন রাজা, নাহি প্রতিকার।।মনোদুঃখে নরপতি মরিবার যান।পাছে থাকি বকরূপী ধর্ম্মরাজ কন।।মৃত্যুপতি বলে, রাজা তুমি জ্ঞানবান।পৃথিবীতে নাহি দেখি তোমার সমান।।বুদ্ধিহ্রাস হৈল দেখি, তোমা হেন জনে।অগতি মরণ ইচ্ছা কর কি কারণে।।অপঘাতে প্রাণ নষ্ট করে যেই জন।অধোগতি হয় তার, বেদের বচন।।তোমার মহিমা শুনি দেব ঋষিমুখে।উপমার যোগ্য তব নাহি তিন লোকে।।আত্মঘাতী জনে ত্রাণ নাহি কদাচন।স্বর্গেতে তাহার স্থান নাহিক রাজন।।ধর্ম্মবাক্যে যুধিষ্ঠির কহে সবিনয়।আমার দুঃখের কথা শুন মহাশয়।।অল্পকালে পিতৃহীন, হৈল বড় শোক।মন্ত্রণা করিয়া দুঃখ দিল দুষ্ট লোক।।কপট পাশায় শেষে লৈয়া রাজ্যধন।বাকল পরায়ে সবে পাঠাইল বন।।বহু দুঃখে বঞ্চিলাম কানন ভিতর।এক আত্মা এই মোরা পঞ্চ সহোদর।।দুঃখের উপয়ে বিধি এত দুঃখ দিল।এবে সে জানিনু, কৃষ্ণ মো সবে ত্যজিল।।আমি ত শরীর ধরি, পঞ্চজন প্রাণ।সে প্রাণ হরিয়া যদি নিল ভগবান।।নিতান্ত যদ্যপি কৃষ্ণ ছাড়েন আমারে।আমিও ত্যজিব প্রাণ মৃত্যু সরোবরে।।আমার যতেক দুঃখ শুনিলে নিশ্চয়।তুমি কেন নিবারণ কর মহাশয়।।নিষেধ না কর মোরে, করহ প্রয়াণ।ভ্রাতৃগণ শোকে আমি ত্যজিব পরাণ।।এত বলি নরপতি অধৈর্য্য হইয়া।মরিবারে যান দ্রুত শ্রীকৃষ্ণ স্মরিয়া।।ধর্ম্মরাজ বলিলেন, কর অবধান।ধৈর্য্য ধর নরপতি, ত্যজ দুঃখজ্ঞান।।অসার সংসার মধ্যে সারমাত্র ধর্ম্ম।তাহা ছাড়ি কেন তুমি করহ অধর্ম্ম।।পিতা মাতা ভাই বন্ধু কেহ কার নয়।ভবিষ্য বৃত্তান্ত এই, শুন মহাশয়।।কালপ্রাপ্ত হয়ে তব ভাই চরি জন।আসিয়া এ সরোবরে ত্যজিল জীবন।।যুধিষ্ঠির বলিলেন, জানিনু কারণ।এত দিনে বিধি মোরে করিল বঞ্চন।।জীবন রাখিতে আর নাহি লয় মতি।এত বলি মরিবারে যান নরপতি।।বকরূপী ধর্ম্মরাজ ডাকে পুনরায়।না শুনিয়া যান রাজা মরণ আশায়।।অত্যন্ত কাতর দেখি কহে মৃত্যুপতি।শুন শুন যুধিষ্ঠির আমার ভারতী।।অতিশয় তৃষ্ণা যদি থাকয়ে তোমার।চারিটী প্রশ্নের দেহ উত্তর আমার।।না শুনিয়া অহঙ্কারে এই চারি জন।পানমাত্র এই জলে হইল মরণ।।রাজা কহে, মৃত্যুভয় নাহিক আমার।মৃত্যুই একমাত্র নাহিক আমার।।শমনের ভয় না দেখাও পক্ষীবর।বিজ্ঞপ্রাজ্ঞ যে জন সে দিবে প্রশ্নোত্তর।।এই নীতি বিধি হেতু দিব যে উত্তর।কিবা প্রশ্ন তব হয় প্রকাশ সত্বর।।পুত্রবাক্যে প্রীত হৈয়া ধর্ম্ম মহাশয়।প্রশ্ন তবে করিতে লাগিলেন রাজায়।।যুধিষ্ঠিরের প্রতি ধর্ম্মের চারি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা।‘‘কা চ বার্ত্তা কিমাশ্চর্য্যং কঃ পন্থাঃ কশ্চ মোদতে।মমৈতাংশ্চতুরঃ প্রশ্নান কথরিত্বা জলং পিব।’’কিবা বার্ত্তা, কি আশ্চর্য্য, পথ বলি কারে।কোন্ জন সুখী হয় এই চরাচরে।।পাণ্ডুপুত্র আমার যে এই প্রশ্ন চারি।উত্তর করিয়া তুমি পান কর বারি।।যুধিষ্ঠিরের প্রথম প্রশ্নের উত্তর।মাসত্তুদব্বীপরিঘট্টনেনসূর্য্যগ্নিনা রাত্রিদিনেন্ধনেন।অস্মিন্ মহামোহময়ে কটাহেভূতানি কালঃ পচতীতি বার্ত্তা।।অস্যার্থঃঘটন কারণ হৈল মাস ঋতু হাতা।রাত্রি দিবা কাষ্ঠ তাহে পাবক সবিতা।।মোহময় সংসার কটাহে কাল কর্ত্তা।ভূতগণে করে পাক, এই শুন বার্ত্তা।।দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর।অহন্যহনি ভূতানি গচ্ছন্তি যমমন্দিরম্শেষাঃ স্থিরত্বমিচ্ছন্তি কিমাশ্চর্য্যমতঃপরম।।অস্যার্থঃ।প্রতিদিন জীব জন্তু যায় যমঘরে।শেষে থাকে যারা, তারা ইহা মনে করে।।আপনারা চিরজীবী নাহি হৈব ক্ষয়।ইহা হৈতে কি আশ্চর্য্য আছে মহাশয়।।তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর।বেদা বিভিন্নাঃ স্মৃতয়ো বিভিন্নানাসৌ মুনিযর্স্যমতং না ভিন্নম।ধর্ম্মস্য তত্ত্বং নিহিতং গুহায়াংমহাজনো যেন গতঃ স পন্থাঃ।।অস্যার্থঃ।বেদ আর স্মৃতিশাস্ত্র একমত নয়।স্বেচ্ছামত নানা মুনি নানা মত কয়।।কে জানে নিগূঢ় ধর্ম্মতত্ত্ব নিরূপণ।সেই পথ গ্রাহ্য, যাহে যায় মহাজন।।চতুর্থ প্রশ্নের উত্তর।দিবসস্যাষ্টমে ভাগে শাকং পচতি যো নরঃ।অঋণী চাপ্রবাসী চ স বারিচর মোদতে।।অস্যার্থঃ।অপ্রবাসে ঋণ বিনা যার কাল যায়।যদ্যপি মধ্যাহ্নকালে শাক অন্ন খায়।।তথাপি সে জন সুখী সংসার ভিতর।বারিচর শুন চারি প্রশ্নের উত্তর।।১২৪. যুধিষ্ঠিরের প্রতি ধর্ম্মের ছলনাপ্রশ্নের উত্তর শুনি ধর্ম্ম মহাশয়।পুত্র প্রতি কন হৈয়া অন্তরে সদয়।।ছদ্মরূপী দেবতা আমি জেন পরিচয়।বুঝিনু তুমি যে হও অতি সদাশয়।।বর মাগ নরপতি হয়ে একমন।জীয়াইয়া লহ তব ভ্রাতা এক জন।।যুধিষ্ঠির শুনি তবে করে নিবেদন।কেবল সতত যেন ধর্ম্মে থাকে মন।।আর যদি অনুগ্রহ কর মহাশয়।প্রাণ দেহ সহদেবে বিমাতৃ তনয়।।ধম্মবলিলেন, রাজা তুমি জ্ঞানহীন।অত্যন্ত বালক তুমি, না হও প্রবীণ।।বিশেষে বৈমাত্র ভ্রাতা অনেক অন্তর।জীয়াইয়া লহ তব ভ্রাতা বৃকোদর।।নতুবা অর্জ্জুনে রাজা বাচাঁইয়া লহ।পরপুত্রে কি কারণে জীয়াইতে চাহ।।লক্ষ্মী-স্বরূপিণী যিনি কৃষ্ণা গুণবতী।অথবা ইহার প্রাণ চাহ নরপতি।।আছয়ে প্রবল রিপূ দুষ্ট দুর্য্যোধন।ভীমার্জ্জুন বিনা তারে কে করে নিধন।।কুরুযুদ্ধে শক্তমাত্র পার্থ বৃকোদর।কি কার্য্য হইবে তব জীয়াইলে পর।।রাজা বলে, পর নহে বিমাতৃ নন্দন।নকুল ও সহদেব মোর প্রাণধন।।ভীমার্জ্জুন হৈতে স্নেহ করি অতিশয়।বর দেহ, প্রাণ পায় বিমাতৃ তনয়।।বিশেষ আমার এক শুন নিবেদন।আমা হতে পিশু পাবে মম পিতৃগণ।।মম মাতামহ গণ তারা পিণ্ড পাবে।নকুলের মাতামহে কেবা পিণ্ড দিবে।।সহদেব প্রাণ পেলে ধর্ম্ম রক্ষা পায়।নতুবা পরম ধর্ম্ম একেবারে যায়।।পরম ধর্ম্মেতে প্রভু যদি করি হেলা।ভবসিন্ধু তরিবারে নাহি আর ভেলা।।হেন ধর্ম্ম লঙ্ঘিবারে মোর মন নয়।নিতান্ত আমার কথা এই কৃপাময়।।মহাভারতের কথা অমৃত লহরী।কাশীরাম দাস কহে, ভবভয়ে তরি।।। ১২৫. ধর্ম্মের নিকট যুধিষ্ঠিরের বরলাভও কৃষ্ণাসহ চারি ভ্রাতার পুনর্জ্জীবন প্রাপ্তি
শুনিয়া রাজার বাণী ধর্ম্ম মহাশয়।
আমি তব পিতা, বলি দেন পরিচয়।।
তব ধর্ম্ম জানিবারে করিয়া মনন।
এই সরোবর আমি করেছি সৃজন।।
এত বলি ধর্ম্মরাজ পুত্র নিয়া কোলে।
লক্ষ লক্ষ চুম্ব দেন বদন মণ্ডলে।।
ধন্য কুন্তী, তোমা পুত্র গর্ভে ধরেছিল।
তোমার ধর্ম্মেতে বিশ্ব পবিত্র হইল।।
আমার বচন শুন পুত্র যুধিষ্ঠির।
শেষ দুঃখ সম্বরহ, মন কর স্থির।।
ধর্ম্মেতে ধার্ম্মিক তুমি হও মতিমন্ত।
অচিরে হইবে তব যাতনার অন্ত।।
দয়াশীল ধর্ম্মবান্ ক্ষমাবান ধীর।
জানিলাম তুমি সর্ব্বগুণেতে গভীর।।
অল্পদিনে নষ্ট হবে কৌরব দুরন্ত।
কহিনু তোমারে আমি ভবিষ্য-বৃত্তান্ত।।
ধর্ম্ম না ছাড়িহ কভু, ধর্ম্ম কর সার।
দুঃখের সাগরে হবে অনায়াসে পার।।
এত বলি আশ্বাসিয়া মধুর বচনে।
কৃষ্ণা সহ বাঁচাইল ভাই চরি জনে।।
প্রণাম করিয়া কহিলেন নৃপমণি।
সহায় সম্পদ তব চরণ দুখানি।।
আশীর্ব্বাদ করি ধর্ম্ম গেলেন স্বস্থানে।
প্রাণ পেয়ে পঞ্চ জন ভাবিছেন মনে।।
কি হেতু এখানে মোরা আছি পঞ্চজন।
ভাবিয়া না পাই কিছু ইহার কারণ।।
হেনকালে দেখি তথা ধর্ম্মের নন্দনে।
শীঘ্রগতি তথা আসি ভেটে পঞ্চ জনে।।
জিজ্ঞাসেন যুধিষ্ঠিরে কহ বিবরণ।
এখানে আমরা আসিলাম কি কারণ।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন, শুনহ কারণ।
মৃত্যু-সরোবর এই ধর্ম্মের সৃজন।।
তৃষ্ণায় আকুল হয়ে ধর্ম্ম-মায়াবলে।
আসিয়া মরিলে সবে এই মৃত্যুজলে।।
আমিও আসিয়া মৃত্যু করিলাম পণ।
তবে ধর্ম্ম বকরূপে দিলেন দর্শন।।
ছলনা করিয়া আগে অনেক প্রকারে।
শেষে দয়া করি বর দিলেন আমারে।।
সেই বরে বাঁচাইয়া তোমা পঞ্চ জনে।
আশীর্ব্বাদ করি ধর্ম্ম গেলেন স্বস্থানে।।
কহিলাম ভ্রাতৃগণ এই ত কারণ।
অতঃপর এই জলে কর সবে স্নান।।
এত বলি যুধিষ্ঠির ভ্রাতৃগণ সঙ্গে।
স্নান করিলেন সেই জলে মনোরঙ্গে।।
সেই দিন রহিলেন তথা ছয় জন।
পরদিনে জন্মেজয় শুন বিবরণ।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।
১২৬. ব্যাসদেবের আগমন এবং
পাণ্ডবগণের অজ্ঞাতবাসের পরামর্শ
পরদিন প্রাতঃকালে উঠি ছয় জন।
কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলি সবে ডাকে ঘনে ঘন।।
হেনকালে আসিলেন ব্যাস তপোধন।
প্রণমিয়া নরপতি করে নিবেদন।।
শুন প্রভু গত দিবসের এক ভাষা।
এই সরোবরে আমা সবার দুর্দ্দশা।।
পথিশ্রমে পিপাসায় হইয়া কাতর।
নিকটেতে জল নাই, দূরে সরোবর।।
জল অন্বেষণে ভীমে দিয়া অনুমতি।
তাহার বিলম্বে পার্থে দিলাম আরতি।।
দ্রৌপদী সহিত এই ভারি চারি জন।
এই জল পরশিয়া ত্যজিল জীবন।।
পশ্চাতে আসিয়া আমি দেখি সরোবরে।
শবরূপে ভাসে সবে জলের উপরে।।
দেখি মূর্চ্ছাগত হয়ে পড়িলাম ভূমে।
চৈতন্য পাইয়া পুনঃ উঠিলাম ক্রমে।।
আমিহ মরিতে যাই সরোবর-নীরে।
বকরূপী ধর্ম্ম ডাকি বলিলেন ধীরে।।
ওহে ধর্ম্ম হেন কর্ম্ম উচিত না হয়।
আত্মহত্যা কি কারণে কর মহাশয়।।
যদি বড় তৃষ্ণাযুক্ত হও মতিমান।
চারি প্রশ্ন বলি পরে কর জলপান।।
প্রণাম করিয়া আমি কহিলাম তাঁরে।
কিবা প্রশ্ন আছে তব, বলহ আমারে।।
প্রশ্ন চারি বলিলেন ধর্ম্ম মহাশয়।
উত্তর দিলাম, মোর জ্ঞানে যাহা হয়।।
প্রশ্নের উত্তর শুনি সন্তুষ্ট হইয়া।
কহিলেন, এক ভাই লহ বাঁচাইয়া।।
ভাবিয়া চাহিনু, দেহ সহদেব ভাই।
বিমাতার পিতৃবংশে জলপিণ্ড নাই।।
কপটেতে প্রতারণা অনেক করিয়া।
জীয়ায়ে দিলেন সবে ইষ্ট বর দিয়া।।
ইহা মুনি কহিলেন ব্যাস মহামুনি।
যথা ধর্ম্ম তথা জয়, বেদবাক্য শুনি।।
বিদায় হইয়া মুনি গেলেন স্বস্থানে।
সেই রাত্রি বঞ্চে তথা ভাই পঞ্চ জনে।।
পর দিন প্রাতঃকালে উঠি সর্ব্বজনে।
যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসেন মাদ্রীর নন্দনে।।
কহ ভাই সহদেব বিচারে প্রবীণ।
দ্বাদশ বৎসর গত, শেষ কত দিন।।
আজ্ঞামাত্র সহদেব সাবধান হয়ে।
গণিতে লাগিল শীঘ্র হাতে খড়ি লয়ে।।
কহিল রাজার আগে করিয়া নির্ণয়।
দ্বাদশ বৎসর শেষ আছে দিন ছয়।।
এত শুনি যুধিষ্ঠির ভাবে মনে মনে।
অজ্ঞাত বাসের হেতু কহে সর্ব্বজনে।।
সবে জান পূর্ব্বে যাহা নির্ণয়।
উপস্থিত হৈল আসি অজ্ঞাত সময়।।
কোন্ দেশে কিবা বেশে বঞ্চি বৎসরেক।
নিকটে বেষ্টিত আছে নগর অনেক।।
সবে মিলি পরামর্শ কর এইবার।
কিরূপে দুঃখের হ্রদে সবে হৈব পার।।
এত শুনি কহে তবে ভাই চারি জনে।
সুযুক্তি ইহার সবে করি মনে মনে।।
দোষ গুণ বুঝি দেশ করিব নির্ণয়।
অকারণে চিন্তা কেন কর মহাশয়।।
কি হেতু চিন্তিব প্রভু, মোরা সর্ব্বজন।
অবশ্য হইবে যাহা বিধির লিখন।।
এই সব চিন্তা করি ধর্ম্ম-অধিকারী।
নির্ণয় করিতে আর গেল দিন চারি।।
মুনি বলে, শুন পরীক্ষিতের নন্দন।
এরূপে দ্বাদশ বর্ষ যাপিল কানন।।
নানা ক্লেশে বিচরণ করে বহু বন।
সংক্ষেপে কহিনু আমি বনের ভ্রমণ।।
অশ্বমেধ ফল পায় যে শুনে এ কথা।
ব্যাসের বচন, এই নাহিক অন্যথা।।
ভক্তিতে শুনিলে এই বনপর্ব্ব কথা।
নাহি থাকে তার কভু পাপ তাপ ব্যথা।।
লক্ষ শ্লোকে বিরচিল কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন।
এত দূরে বনপর্ব্ব হৈল সমাপন।।
।। বনপর্ব্ব সমাপ্ত।।
ConversionConversion EmoticonEmoticon