মহাভারত:গদাপর্ব-০০১-০০৬

দধীচির অস্থিতে বজ্র নির্ম্মাণ
মুনি বলে শুন পরীক্ষিতের নন্দন।
দ্বৈপায়ন হ্রদে লুকাইল দুর্য্যোধন।।
পাণ্ডবের সৈন্যগণ খুঁজিয়া বেড়ায়।
দুর্য্যোধন রাজারে দেখিতে নাহি পায়।।
আপন শিবিরে যান ধর্ম্ম নরবর।
দুর্য্যোধন খুঁজিতে পাঠান নিজ চর।।
এত শুনি জিজ্ঞাসিল শ্রীজনমেজয়।
কহিলা অপূর্ব্ব কথা মুনি মহাশয়।।
কুরুকুলপতি মহারাজ দুর্য্যোধন।
হ্রদ মধ্যে কি প্রকারে রহিল তখন।।
কি উপায় করিলেন পিতামহগণ।
শুনিবার বাঞ্ছা বড় কহ তপোধন।।
মুনি বলে অবধান কর নরপতি।
যেইমতে হত দুর্য্যোধন দুষ্টমতি।।
গদাপর্ব্ব কথা কহি শুন নৃপবর।
যেইমতে পুনরপি হইল সমর।।
শত্রুজয়ী লোক অপমানে কোপ মন।
দ্বৈপায়ন হ্রদে প্রবেশিল দুর্য্যোধন।।
গদার প্রহারে বীর সলিল বিদারি।
তাহাতে পশিল রাজা হাতে গদা করি।।
ভ্রাতৃ বন্ধু সহিত নৃপতি যুধিষ্ঠির।
দুর্য্যোধন অন্বেষিতে যান বহু বার।।
বন উপবন খুঁজিলেন নানা দেশ।
না পাইয়া দুর্য্যোধনে ভাবেন বিশেষ।।
মারিয়া বিপক্ষ করিলাম কোন্ কার্য্য।
পুনর্ব্বার দুর্য্যোধন লইবেক রাজ্য।।
পুনর্ব্বার আসিয়া করিবে মহারণ।
পলাইয়া আছে কোথা রাজা দুর্য্যোধন।।
এত কহি বসিয়া আছেন ধর্ম্মরায়।
হেথা তিন বীর দুর্য্যোধন কাছে যায়।।
অশ্বন্থামা কৃতবর্ম্মা কৃপ সুপন্ডিত।
হ্রদের নিকটে গিয়া হৈল উপনীত।।
জলস্তম্ভে দুর্য্যোধন আছেন নির্জ্জনে।
হ্রদের উপরে থাকি ডাকে তিনজনে।।
উঠ উঠ ‍রাজা যুদ্ধে না হও বিমুখ।
যুধিষ্ঠিরে জিনিয়া ভুঞ্জহ রাজ্যসুখ।।
পলাইয়া কেন তুমি পাও অধোগতি।
রণেতে কাতর নহে ক্ষত্রিয় এ মতি।।
পাণ্ডবের সৈন্য সব করিব সংহার।
রাখিতে নারিবে কৃষ্ণ সহায় তাহার।।
তা সবার বাক্য শুনি বলে দুর্য্যোধন।
বড় ভাগ্যে সংগ্রামে তরিলা তিনজন।।
যে বলিলে সে সম্ভবে তোমা সবাকায়।
যুদ্ধে জয়ী হব তোমা সবার কৃপায়।।
পড়িল আমার সৈন্য নাহি একজন।
পাণ্ডবের সৈন্য সব করে মহারণ।।
একেশ্বর সমর না হয় সমুচিত।
বলবন্ত সহিত সংগ্রাম নহে হিত।।
তবে অম্বন্থামা বহু দর্পের আগার।
প্রতিজ্ঞা করিল করি মহা অহঙ্কার।।
এই আমি মারিব সকল পরদল।
উঠ দুর্য্যোধন না হইও হীন বল।।
পাঞ্চালক সোমবংশ করিব সংহার।
আমার প্রতিজ্ঞা এই শুন সারোদ্ধার।।
পাঞ্চালক সোমবংশ করিব সংহার।
আমার প্রতিজ্ঞা এই শুন সারোদ্ধার।।
পঞ্চালে না মারি যদি কবচ এড়িব।
ধিক্ অকারণ ব্যর্থ শরীর ধরিব।।
এ নহে ক্ষত্রিয়ধর্ম্ম শুন মহারাজ।
প্রাণপণ চেষ্টায় সাধিব নিজকাজ।।
শুন মহারাজ তুমি নাহি কর ভয়।
চারি বীরে মারিব বিপক্ষ দুরাশয়।।
এই তিন থাকিতে তোমার কেন ডর।
পুনরপি চারি বীর করিব সমর।।
হয় ধনঞ্জয়ে জিনি পুনঃ রাজ্য পাব।
নহে বা সমরে পড়ি সদ্য স্বর্গে যাব।।
হেন জানি দুর্য্যোধন রণে দেহ মন।
চারি মহাবীরেতে করিব মহারণ।।
হেন কথা শুনি বলে রাজা দুর্য্যোধন।
শুন মহারথী সব আমার বচন।।
প্রাণেতে পীড়িত আমি শুন চারি বীর।
অস্ত্রাঘাতে ভগ্ন মম সকল শরীর।।
রণ জিনিবারে যদি করিয়াছ মন।
আজি নিশি বঞ্চিয়া করিব কালি রণ।।
এই কথা আলাপে আছেন চারিজন।
পক্ষী মারিবারে ব্যাধ গেল সেই বন।।
ভীমের তোষণ লাগি মৃগয়া করিয়া।
সেই হ্রদে জলপানে গেল মৃগ লৈয়া।।
সেই ব্যাধ শুনিল সকল সমাচার।
ব্যাধ বলে বড় কর্ম্ম হইল আমার।।
যাহারে খোঁজেন সদা রাজা যুধিষ্ঠির।
হ্রদে পলাইয়া আছে সেই কুরুবীর।।
যুধিষ্ঠিরে কহিলে এ সব বিবরণ।
আনন্দিত হইবেন পাণ্ডুর নন্দন।।
এত ভাবি ব্যাধগণ হরষিত মনে।
দ্রুতগতি নিবেদিল ভীমের চরণে।।
ভীমসেন শুনি হল হরষিত মন।
ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরে কহিল তখন।।
জলমধ্যে আশ্রয় করিল দুর্য্যোধন।
কুলের কলঙ্ক পাপ বড়ই দুর্জ্জন।।
ভীমের বচন শুনি রাজা যুধিষ্ঠির।
ভ্রাতৃবন্ধু সহ রাজা আনন্দে অস্থির।।
যথা আছে জলমধ্যে রাজা দুর্য্যোধন।
তথাকারে সর্ব্ব বীর করিল গমন।।
কৃষ্ণে আগু করি সবে তথা গেল চলি।
পাণ্ডুর নন্দন সব বলে মহাবলী।।
সৈন্য সহ চলিলেন রাজা যুধিষ্ঠির।
যথা জলমধ্যে আছে দুর্য্যোধন বীর।।
কটকের নিনাদ হইল বিপরীত।
শব্দ শুনি চারি বীর হৈল বড় ভীত।।
কৃপ কৃতবর্ম্মা বলে হইল অকাজ।
সৈন্য সহ আইলেন যুধিষ্ঠির রাজ।।
কি করিব মহারাজ বলহ উপায়।
কোন আজ্ঞা হয় দুর্য্যোধন কুরুরায়।।
দুর্য্যোধন বলে হও তোমরা অন্তর।
আমি মায়া করি থাকি জলের ভিতর।।
রাত্রি অনুসারে সবে হবে এক স্থানে।
যুধিষ্ঠিরে মারি পুনঃ সাধিব সম্মানে।।
রাজার বচনে চলি গেল তিনবীর।
নরপতি ডুবাইল সলিলে শরীর।।
তিনজন বনমধ্যে করিল নিবাস।
রাজারে স্মরিয়া ঘন ছাড়িল নিশ্বাস।।
নানা শোকে সন্তাপ করয়ে তিন বীর।
হেনকালে তথা আইলেন যুধিষ্ঠির।।
হ্রদতীরে যুধিষ্ঠির কৃষ্ণে জিজ্ঞাসেন।
জল মধ্যে দুর্য্যোধন কিমতে আছেন।।
ধর্ম্মরাজ-বাক্য শুনি বলেন শ্রীহরি।
মায়াবন্ত দুর্য্যোধন আছে মায়া করি।।
মন্ত্রের প্রভাবে আছে সেই দুরাচার।
উপায়েতে রাজা দেখা পাইবে তাহার।।
মায়া করি ইন্দ্র সব দানবে দলিল।
বামন হইয়া হরি বলিরে ছলিল।।
উপায়েতে কার্য্য সিদ্ধ করে বিজ্ঞজনে।
চিন্তহ উপায় রাজা আমার বচনে।।
তোমা হৈতে অভিমানী বড় দুর্য্যোধন।
সহিতে না পারে কভু নিন্দার বচন।।
মহাভারতের কথা সমান পীযূষ।
যাহায় শ্রবণে নর হয় নিষ্কলুষ।।
০২. বলদেবের তীর্থযাত্রা বিবরণ
জন্মেজয় বলিলেন কহ মুনিবর।
তীর্থযাত্রা করিলেন কেন হলধর।।
কহেন বৈশম্পায়ন শুনহ রাজন।
তীর্থযাত্রা কথা কহি ইথে দেহ মন।।
নৈমিষকাননে শৌনকাদি মুনিগণ।
বসিয়া করেন মহাভারত শ্রবণ।।
শ্রীসূত গোস্বামী গ্রন্থ করেন পঠন।
মুনি ষাটি সহস্রেক করেন শ্রবণ।।
ব্যাসাসনে বসিয়া কথক সূত মুনি।
কহেন ভারত কথা বিজ্ঞ চূড়ামণি।।
এই কালে সেখানে গেলেন বলরাম।
মুনিগণ সাদরেতে করেন প্রণাম।।
মুনিগণ দিল তারে দিব্য কুশাসন।
পরস্পর হইল কুশল জিজ্ঞাসন।।
সূত মুনি বসিয়াছে আসন উপর।
রামে অভ্যর্থনা না করিল মুনিবর।।
মনে করে সর্ব্ব মুনি নিত্য মোরে সেবে।
সবায় প্রণাম করে আসি বলদেবে।।
বিশেষ আছি যে ব্যাস আসন উপর।
মম সমাদর যোগ্য নহে হলধর।।
এই বিবেচনা করি রহিল আসনে।
সমাদর না করিল রেবতীরমণে।।
বলরাম জানিয়া সূতের অহঙ্কার।
মনে মনে করিলেন এমত বিচার।।
কোন্ ছার সূত না করিল সন্বর্দ্ধনা।
মারিব উহারে দেখি রাখে কোনজনা।।
ওরে সূত নরাধম অতি নীচ জাতি।
এবে জানিলাম আমি তোমার প্রকৃতি।।
সমাদর আমারে না কর অহঙ্কারে।
মনে কর বসিয়াছ আসন উপরে।।
এখনি মারিব তোরে সবার সাক্ষাতে।
নিজ কর্ম্ম দোষেতে ঠেকিলি মম হাতে।।
সূত বলে শুন প্রভু বচন আমার।
অপরাধ করিনু কি অগ্রেতে তোমার।।
ব্যাসের আসনে আমি আছি যে বসিয়া।
কিমতে উঠিব আমি তোমারে দেখিয়া।।
ব্যাসাসনে থাকিয়া উঠিলে হয় দোষ।
এই হেতু মোরে নাথ না কর আক্রোশ।।
সূত যদি এতেক কহিলা হলধরে।
কম্পমান হইয়া উঠেন ক্রোধভরে।।
কাদন্বরী পানেতে পূর্নিত দুলোচন।
প্রভাতের ভানু যেন লোহিত বরণ।।
যুগল অধর কোপে কাঁপে থর থর।
কদম্ব কুসুম যেন হৈল কলেবর।।
বসিয়া ছিলেন রাম দেন এক লম্ফ।
দেখিয়া রামের কার্য্য সবাকার কম্প।।
প্রলয়ের মেঘ জিনি দারুণ গর্জ্জন।
ক্ষিতি টলমল করে কাপে নাগগণ।।
দিগ্ গজ কাতর হৈল সমুদ্র উথলে।
সকল পর্ব্বত নড়ে রাম কোপাললে।।
হলে আকর্ষিয়া সূতে আনিয়া নিকটে।
খড়গ দিয়া কাটেন মস্তক এক চোটে।।
দেখি হাহাকার করে যত দেবগণ।
কি হল বলিয়া সবে করয়ে রোদন।।
হায় হায় করিলেন তপস্বী সমাজ।
সবে বলে রাম না করিলে ভাল কাজ।।
ব্রক্ষ্মবধ তোমারে হইল মহাশয়।
করিলে দারুণ কর্ম্ম পাপে নাহি ভয়।।
পরম পন্ডিত সূত ধর্ম্মেতে তৎপর।
সকল পুরাণ পাঠে ব্যাসের সোসর।।
ব্যাক্ষ্মণ্য দিলেন ব্যাস দেখি জ্ঞানবান।
হেনজনে বধ কর অদ্ভূত বিধান।।
তোমারে না শোভে হেন কর্ম্ম দুরাচার।
ব্রক্ষ্মবধ কর রাম কি বলিব আর।।
সূতের কারণে মুনিগণ মনে দুঃখ।
লজ্জাতে মলিন রাম হন অধোমুখ।।
অন্তর্য্যামী ব্যাস পরাশরের নন্দন।
অকস্মাৎ আইলেন নৈমিষ কানন।।
তাঁরে দেখি শৌনকাদি মুনির সমাজ।
পাদ্য অর্ঘ্য আসনে পূজিল মুনিরাজ।।
রাম আসি প্রণমেন মুনির চরণে।
আশীর্ব্বাদ করিলেন মুনি শান্তমনে।।
দেখিয়া রামের কার্য্য ব্যাস তপোধন।
লাগিলেন কহিবারে করুণ বচন।।
সূত বধ করি রাম কি ‍কার্য্য করিলা।
সূতের নিধনে রাম ব্রক্ষবধী হৈলা।।
অষ্টাদশ পুরাণ করিয়া আমি সার।
দিলাম সে সকলের পাঠে অধিকার।।
চৌদ্দ শাস্ত্র চারি বেদ আর যত শাখা।
ব্রাক্ষ্মণ সূতেরে আমি করিলাম দীক্ষা।।
আগম প্রভূতি আর আছে তন্ত্র যত।
আমার বরেতে সূত ছিল অবগত।।
অকারণে বধ ‍রামকরিলা তাহারে।
ব্রক্ষ্মহত্যা মহাপাপ হইল তোমারে।।
রাম কন না জানিয়া হৈল দুষ্টাচার।
এ পাপ হইতে মোরে করহ উদ্ধার।।
ব্যাস কহিলেন যত তীর্থ পৃথিবীতে।
অনুক্রমে পার যদি ভ্রমণ করিতে।।
যতি হয়ে ব্রক্ষচর্য্য আরম্ভ করিয়া।
চান্দ্রায়ণ করি তীর্থ আইস ভ্রমিয়া।।
কর যজ্ঞ হোম আর ব্রাক্ষ্মণ-ভোজন।
নানা দান দিবে দ্বিজে অতিথি সেবন।।
ইত্যাদি কহিয়া ব্যাস গেলেন স্বস্থান।
তীর্থযাত্রা হেতু রাম করেন বিধান।।
সূতের তনয় ছিল নাম তার সৌতি।
ডাকিয়া আনেন তার রেবতীর পতি।।
কহিলেন কর পিতৃশ্রাদ্ধাদি তর্পণ।
শ্রাদ্ধ করি করাইল ব্রাক্ষণ-ভোজন।।
পুনঃ তারে বলদেব করিয়া আহববান।
পুরাণ পাঠের হেতু করেন বরণ।।
ব্যাসাসনে সৌতিরে বসান হলধর।
দেখি মুনিগণ হন সহর্ষ অন্তর।।
মুনিগণে বিদায় হইয়া হলপাণি।
চলিলেন তীর্থযাত্রা করিতে আপনি।।
বলেন বৈশাম্পায়ন শুনহ রাজন।
কহিব অপূর্ব্ব কথা অতি পুরাতন।।
কৌরব পান্ডবে পাশা খেলাইল যবে।
বলরাম তীর্থ হেতু চলিলেন তবে।।
জন্মেজয় কহিলেন কহ বিবরিয়া।
কোন কোন তীর্থে রাম গেলেন ভ্রমিয়া।।
মনেতে ভাবিয়া ব্যাসদেবের চরণ।
কাশীরাম দাসের পয়ার বিরচন।।
০৩. বশিষ্ঠ তীর্থের বিবরণ কথন
বলেন বৈশম্পায়ন শুন নরপতি।
যেই যেই তীর্থে রাম করিলেন গতি।।
একমন হইয়া শুনহ নরবর।
ইহার শ্রবণেতে নিষ্পাপ হয় নর।।
গেলেন বশিষ্ঠ তীর্থে সরস্বতী তীরে।
স্নান করি দান করিলেন ধনাথীরে।।
ব্রাহ্মণ-ভোজন করাইয়া বলরাম।
অতিথি সেবিয়া পূর্ণ করিলেন কাম।।
রাজা বলে সেই তীর্থ হৈল কি কারণ।
বশিষ্ঠ তীর্থের কথা কহ তপোধন।।
মুনি বলে অবগতি কর মহারাজ।
যে হেতু বশিষ্ঠ তীর্থ শুন তার কার্য।।
বিশ্বামিত্র বশিষ্ঠে বিবাদ অনুক্ষণ।
পূর্ব্বে কহিয়াছি আমি এ সব বচন।।
বড়ই তেজস্বী ক্রোধী মুনি বিশ্বামিত্র।
যুক্তিতে মারিল বশিষ্ঠের শত পুত্র।।
সৌদাস রাজারে ব্রক্ষ্মরাক্ষস করিয়া।
বশিষ্ঠের পুত্র মুনি দেখাইল নিয়া।।
শক্তিরে ধরিয়া রাজা করিল ভক্ষণ।
গর্ভ মধ্যে আছিলেন শক্তির নন্দন।।
পরাশর হইলেন বংশের রক্ষণ।
তাঁর পুত্র হইলেন ব্যাস তপোধন।।
এই বিসন্বাদে দোহে রাত্রি দিবা আছে।
বশিষ্ঠ করেন স্থিতি সরস্বতী কাছে।।
পূর্ব্বকূলে বশিষ্ঠের আশ্রম সুন্দর।
তথা রহি তপস্যা করেন মুনিবর।।
শিষ্ঠের সঙ্গে দ্বন্দ্ব সতত করিতে।
বিশ্বামিত্র রহিলেন পশ্চিম কূলেতে।।
কিছুকাল উভয়ে থাকেন দুই পারে।
বশিষ্ঠের ইচ্ছা নাহি দ্বন্দ্ব করিবারে।।
কলহে আসক্ত বড় বিশ্বামিত্র মুনি।
নিরন্তর বশিষ্ঠের ছিদ্র অনুমানি।।
অগাধ সলিল বহে নাহি পারপার।
দুজনে দেখিতে পান আশ্রয় দোঁহার।।
বশিষ্ঠের মনে নাহি কলহ বিবাদ।
বিশ্বামিত্র চাহে বশিষ্ঠের অপরাধ।।
একদিন বিশ্বামিত্র আশ্রমে বসিয়া।
সরস্বতী নদীরে ডাকিল আশ্বাসিয়া।।
বিশ্বামিত্র ভয়ে ভীতা সদা সরস্বতী।
সাক্ষাৎ করিল গিয়া ধরিয়া আকৃতি।।
বিশ্বামিত্র কহে শুন নদী সরস্বতী।
এক কথা কহি আমি কর অবগতি।।
বশিষ্ঠে আমাতে দ্বন্দ্ব আছে পূর্ব্বাপর।
বিশেষ জানহ তুমি সব কথান্তর।।
বশিষ্ঠ আছেন যোগে বসিয়া আসনে।
অন্তর্ব্বাহ্য জ্ঞান তার নাহিক কথনে।।
জলে একাকার করি ভাসায়ে মুনিরে।
অবিলম্বে বশিষ্ঠেরে আনহ এ পারে।।
শুনি সরস্বতী ভয়ে করিল স্বীকার।
কি জানি শাপিতে পারে মুনি দুরাচার।।
আপনার স্থানে যান নদী সরস্বতী।
নিশা মধ্যে জলপূর্ণা হইলেন অতি।।
বশিষ্ঠের আশ্রম ভাঙ্গিয়া স্রোতজলে।
ভাসাইয়া বশিষ্ঠে আনিল পরকূল।।
বশিষ্ঠ আছেন ধ্যানে কিছু নাহি জ্ঞান।
উপনীত করিলেন বিশ্বামিত্র স্থান।।
দেখি বিশ্বামিত্র বড় ‍আনন্দ হৈয়া।
সরস্বতী প্রতি কহে আশ্বাস করিয়া।।
বশিষ্ঠেরে আপনি রাখহ এই খানে।
খড়গ আনি গিয়া আমি ইহার নিধনে।।
ভয়ে সরস্বতী বড় হইল ফাঁপর।
অঙ্গীকার করিল করিয়া যোড়কর।।
বিশ্বামিত্র খড়গ আনিবারে গেল যদি।
ভয়েতে ভাবিতে লাগিলেন পুন্যনদী।।
বড়ই দুর্ব্বার বিশ্বামিত্র মুনিরাজ।
বশিষ্ঠেরে আনিয়া নহিল ভাল কাজ।।
আপন আশ্রয়ে মুনি আছিল বসিয়া।
এ পারে আনিনু আমি জলে ভাসাইয়া।।
আমা হৈতে মুনিবর ত্যজিলেন প্রাণ।
ব্রক্ষ্মবধি হৈব আমি জানিনু বিধান।।
ব্রক্ষ্মবধ পাপ নাহি খন্ডে কদাচন।
এ অসৎ কর্ম্ম করিলাম কি কারণ।।
বিশ্বামিত্র শাপভয়ে হইয়া আকুল।
আপন কর্ম্মের দোষে হারানু দুকূল।।
বিশ্বামিত্র যেবা করে শাপিয়া আমার।
কৃপাবশে কোন দেব করিবে উদ্ধার।।
ব্রক্ষ্মহত্যা পাপভয়ে কম্পিত অন্তর।
মুনিরে বাঁচাই আমি যা করে ঈশ্বর।।
এত ভাবি বশিষ্ঠেরে পুনঃ ভাসাইয়া।
নিজাশ্রমে পুনর্ব্বার স্থাপিল লইয়া।।
মুনিরে রাখিয়া সরস্বতী লুকাইলা।
খড়গ লয়ে বিশ্বামিত্র সে স্থানে আইলা।।
দেখিল বশিষ্ঠ গেল আপন আশ্রমে।
সরস্বতী নদী আর নাহি সেইখানে।।
ক্রোধমন হয়ে বলে বিশ্বামিত্র মুনি।
আমারে হেলন তুই করিলি পাপিনি।।
ইহার উচিত ফল দিব তোর তরে।
তোরে শাপ দিব কেহ খন্ডাইতে নারে।।
রজঃস্বলা হও তুমি দিলাম এ শাপ।
শোণিত হউক সদা তব সব অপ।।
প্রেত ভুত পিশাচ আনন্দ সবাকার।
অনায়াসে রক্তপান করে অনিবার।।
রক্ত-মাংসহারী সব পৃথিবী ভ্রমিয়া।
থাকিত শোণিত বিনা উপোষ করিয়া।।
বিশ্বামিত্র প্রসাদে আহলাদ সবাকার।
শোণিত করয়ে পান নাহিক নিবার।।
বিশ্বামিত্রে প্রশংসা করয়ে সর্ব্বজন।
ধন্য ধন্য বিশ্বামিত্র মহা তপোধন।।
যাহার প্রসাদে মোরা করি রক্তপান।
সকল মুনির মধ্যে তুমি ভাগ্যবান।।
রাক্ষস আদির বড় হইল আনন্দ।
রাজঋষি দেবঋষি সদা নিরানন্দ।।
সরস্বতী স্নান নাহি করে মুনিগণ।
হাহাকার করিয়া কহেন সর্ব্বজন।।
ধর্ম্মপথ বিনাশিল বিশ্বামিত্র মুনি।
সংসারে হইল হেন কুযশ কাহিনী।।
নারাদাদি মুনি গিয়া ব্রহ্মারে কহিল।
সরস্বতী নদী বিশ্বামিত্র বিনাশিল।।
রজঃস্বলা হও বলি অভিশাপ দিল।
আদ্যোপান্ত পর্য্যন্ত শোণিত জল হৈল।।
স্নান তর্পণাদি নাহি হৈল সবাকার।
শোণিত হইল জল রাক্ষস-আহার।।
ইহার উপায় প্রভু করহ আপনি।
নারদের বাক্যেতে কহিল পদ্মযোনি।।
মহেশের সেবা সব কর মুনিগণ।
উপায় না দেখি কিছু বিনা ত্রিলোচন।।
ত্রিলোচন তুষ্ট হৈলে সকল মঙ্গল।
রক্তজল দূর হয়েহবে পূর্ব্বজল।।
এতেক ‍শুনিয়া মুনি ব্রহ্মার বচন।
সরস্বতী তীরে গেল যথা মুনিগণ।।
ব্রহ্মার বচন সবে কহিল সাদরে।
আজ্ঞা করিলেন ব্রহ্মা শিব সেবিবারে।।
মহেশ সদয় হৈলে হইবেক জল।
আরাধনা কর সবে সেবক বৎসল।।
ইহা কহি দেবঋষি করেন গমন।
ব্রাক্ষ্মণরা করিলেন শিব আরাধন।।
নিরাহারে একমনে হরের চরণ।
করিয়া মৃন্ময় লিঙ্গ করয়ে পূজন।।
শর্করা তন্ডুল ‍ঘৃত মধুপুষ্প দিয়া।
শিবশিব বলি কেহ বেড়ায় নাচিয়া।।
হর মহেশ্বর শিব অনাথের গতি।
শূলপাণি শঙ্কর পিনাকী পশুপতি।।
নীলকন্ঠ উমাকান্ত ত্রিপুরনাশন।
পার্ব্বতীর প্রাণনাথ মদনমোহন।।
অনাদি নিধন জ্ঞানযোগের ঈশ্বর।
ধুস্তর কুসুম প্রিয় দেব জটাধর।।
প্রথম ঈশ্বর হর প্রেত ভূত সঙ্গ।
হরিহর একতনু গৌরী অর্দ্ব অঙ্গ।।
বৃষভ বাহন ত্রিনয়ন ভূতনাথ।
সত্ত্বরজস্তমোগুনে তুমি অবিদিত।।
ইত্যাদি অনেক স্তব করে মুনিগণ।
হইল প্রসন্ন তবে দেব পঞ্চানন।।
বলদবাহন হাতে ‍ত্রিশূল ডমরু।
বিল্বপত্র ত্রিপত্র শিরেতে শোভে চারু।।
রজত পর্ব্বত জিনি শুভ্র কলেবর।
জটা বিভূষণ শোভে চারু শশধর।।
শুভ্র পদ্ম জিনি আভা বেষ্টিত অমর।
ব্যাঘ্রচর্ম্ম পরিধান ভস্ম অঙ্গোপর।।
এইরূপে সাক্ষাৎ হৈলেন কৃত্তিবাস।
দেখি মুনিগণে বড় হইল কৃত্তিবাস।।
দেখি মুনিগণে বড় হইল উল্লাস।
মহেশ কহেন বর মাগ মুনিগণ।।
ধর্ম্ম অর্থ কাম মোক্ষ যেবা লয় মন।
মুনিগণ বলে প্রভু যদি কর দয়া।।
ইষ্টবর মাগি দেহ ছাড়ি নিজ মায়া।
রক্তজল হইয়াছে সরস্বতী নদী।।
পূর্ব্বমত জল হোক আজ্ঞা কর যদি।
তথাস্তু বলিয়া হর কহিলেন কথা।।
তেমন হইল জল পূর্ব্বে ছিল যথা।
আদ্যোপান্ত হইল সলিল মনোহর।।
কহিলেন তীর্থের মহিমা মহেশ্বর।।
হইল বশিষ্ঠ তীর্থ ইহার আখ্যান।
এই পুন্যজলে যেই করে স্নানদান।।
ব্রক্ষ্মহত্যা সুরাপান করে যেই জন।
মিত্রদ্রোহ করে যেই স্থাপিত হরণ।।
গুরুদারা হরে যেই পাপিষ্ঠ দুর্ম্মতি।
কোনকালে নাহি তার পরলোকে গতি।।
ইত্যাদি পাতকী যদি এত করে স্নান।
সর্ব্বপাপ নষ্ট হয় ইথে নাহি আন।।
কোটি কোটি জন্মপাপ খন্ডয়ে প্রসঙ্গে।
ইহা কহি গেলেন স্বস্থানে হর রঙ্গে।।
শুনিয়া নিরক্ত হৈল সরস্বতী জল।
হাহাকার করি এল রাক্ষস সকল।।
মুনিগণে আসিয়া কৈল ক্রোধবাণী।
আমাদের ভক্ষ্য কেন করিয়া হানি।।
দুঃখ পাব মোরা সব আহার লাগিয়া।
তপোবনে তোমা সবে খাইব ধরিয়া।।
নতুবা আমার ভক্ষ্য করি দেহ মুনি।
অকার্য্য হইবে পাছে বলি হিতবাণী।।
রাক্ষস সকল শুন কহে মুণিগণ।
আজি হৈতে ভক্ষ্য তব হৈল নিরূপণ।।
যজ্ঞশেষ দ্রব্য যত উদ্বৃত হইবে।
সে সকল দ্রব্য সব তোমরা খাইবে।।
পর্য্যূষিত অন্ন, হাঁড়ি মধ্যে যাহা রাখে।
সেই সব ভক্ষ্য হৈল খাও গিয়া সুখে।।
এত বলি মুনিগণ হৈল অন্তর্দ্বান।
রাক্ষস সকল গেল নিজ নিজ স্থান।।
তথা উত্তরিয়া রাম করিলেক স্নান।
দ্বিজগণে ভুঞ্জাইয়া দিল বহু দান।।
নানারূপে দ্বিজেরে করেন পরিতোষ।
ভারতের পুন্যকথা সমান পীযূষ।।
কাশীরাম কহে নর হয় নিষ্কলুষ।
০৪. সোমতীর্থ প্রস্তাবে কার্ত্তিকের জন্মকথা
কহেন বৈশম্পায়ন শুন একমনে।
সোমতীর্থে রাম চলিলেন পর্য্যটনে।।
তথা গিয়া স্নানদান করে বহুতর।
বসন কাঞ্চন গাভী দিলেন বিস্তর।।
জিজ্ঞাসেন জন্মেজয় কহ তপোধন।
সোমতীর্থ নাম হৈল কিসের কারণ।।
মুনি বলে কহিব পুরাণ ইতিহাস।
একমনে শুন রাজা করিয়া বিশ্বাস।।
পূর্ব্বকালে শিবদুর্গা কৈলাস শিখরে।
অত্যন্ত আকুল-চিত্ত শয়ন-মন্দিরে।।
বহুকাল দুইজনে হয় রতিরঙ্গ।
বিপরীত প্রেম বাড়ে নাহি হয় ভঙ্গ।।
মহেশের বীর্য্য যে পড়িল হেনকালে।
অসহ্য দেখিয়া গৌরী ফেলে গঙ্গাজলে।।
সহিতে নারিল গঙ্গা শিববীর্য্য তাপ।
অকস্মাৎ তাহার হৃদয়ে হৈল কাঁপ।।
গঙ্গা ভাসাইয়া লয়ে শরমুলে ফেলে।
ষড়্মুখ কুমার তাহে জন্মিল সুকালে।।
রোহিণী প্রভৃতি যে চন্দ্রের ছয় নারী।
উত্তম কুমার দেখি নিল কোরে করি।।
সমান ধারাতে স্তন দিল ছয় মুখে।
কার্ত্তিক বলিয়া নাম রাখিলেন সুখে।।
কৃত্তিকা তাহারে অগ্রে কোলে করেছিল।
এই হেতু কার্ত্তিক তাহার নাম হৈল।।
হমাবলবান শিশু শিবের কুমার।
দেবগণ আসিলেন তাঁরে দেখিবার।।
দেখিয়া সন্তুষ্ট হৈল যত দেবগণ।
হেনকালে শিবে কহে সহস্রলোচন।।
দেবসেনা কন্যা আছে পরমা সুন্দরী।
কার্ত্তিকে বিবাহ দিব কহ ত্রিপুরারি।।
দেবসেনাপতি নাম হইবে ইহার।
তারকাদি অসুরেরে করিনে সংহার।।
অনুমতি দেন হয় হ’য়ে হৃষ্টমনা।
কার্ত্তিকের অধীন হইল দেবসনা।।
দেবসেনাপতি করি করিল বরণ।
নানা অস্ত্র আনি তারে দিল দেবগণ।।
কার্ত্তিক হইল যদি দেব সেনাপতি।
হইলেন দেবগণ আনন্দিত মতি।।
তারকের যুদ্ধে ইন্দ্র হারিয়া আপনি।
কার্ত্তিকের শরণাগত হৈল বজ্রপাণি।।
কার্ত্তিকে বিনয়ে কহে দেব সহস্রাক্ষ।
আপনি নিধন কর দৈত্য তারকাখ্য।।
ইন্দ্রবাক্যে কার্ত্তিক করেন অঙ্গীকার।
সমরে তারকা আমি করিব সংহার।।
এতেক কহিল যদি দেব ষড়ানন।
তার পরাক্রম সব জানি দেবগণ।।
সবে মেলি অস্ত্র আনি দিল কার্ত্তিকেরে।
সহস্রলোচন বজ্র দিল তার করে।।
শঙ্কর দিলেন শূল বিষ্ণু চক্রবাণ।
যাহার প্রতাপে দৈত্য নাহি ধরে টান।।
উৎক্রান্তি শক্তি দান করিল শমন।
বরুণ দিলেন পাশ লোকে অনুপম।।
সর্ব্ব বলে যুক্ত হৈয়া যত দেবগণ।
কার্ত্তিকের সঙ্গে রণে করেন গমন।।
নানাবাদ্য বাজাইছে যত দেবগণ।
শুনিয়া তারকাসুর কোপাবিষ্ট মন।।
আপনার সেনাগণে সাজন করিয়া।
যুদ্ধ করিবার হেতু আইল ধাইয়া।।
মহা কোলাহল হৈল নাহিক অবধি।
দেবতাগণের হৈল অসুর বিবাদী।।
যুঝেন কার্ত্তিক একা মনে নাহি ভয়।
চারিদিকে দৈত্যগণ নিঃশঙ্কহৃদয়।।
আগে বাকযুদ্ধ শেষে করে অস্ত্রাঘাত।
সংগ্রামে তারকাসুর যুঝে দৈত্যনাথ।।
অস্ত্রে অস্ত্রে নিবারয়ে যার যত শিক্ষা।
গুরুস্থানে যত অস্ত্র পাইলেন দীক্ষা।।
কার্ত্তিকের বাণে কার নাহিক নিস্তার।
দৈত্যের সকল সৈন্য করিল সংহার।।
মন্ত্রপত করি শক্তি লইলেন হাতে।
কার্ত্তিক মারেন তাহা তারকের মাথে।।
শক্তির আঘাতে দৈত্য চূর্ণ হৈল কায়।
শেষ সেনাপতি যত সকলে পলায়।।
বাণ নামে সেনাপতি তারকার ছিল।
ভয়ে পলাইয়া ক্রৌঞ্চ পর্ব্বতে রহিল।।
বাণ না মরিল দেবতাগণের হুতাশ।
অঞ্জলি করিয়া কহে কার্ত্তিকের পাশ।।
বাণ যদি না মরিল নহে ভাল কার্য্য।
কোন দিনে দেবে মারি লবে দেবরাজ্য।।
এতেক কহিল যদি সব দেবগণ।
বাণেরে মারিতে চলিলেন ষড়ানন।।
বাণ ছিল ক্রৌঞ্চ গিরিগহবরে পশিয়া।
শরে শক্তিধর গিরি ফেলেন ভেদিয়া।।
ব্রক্ষ্মার বচনে সেই স্থান তীর্থ হয়।
স্নানদানে সেখানে অসংখ্য পাপক্ষয়।।
মুনি বলে শুনিয়া কার্ত্তিক জন্মকথা।
হলধর হইলেন উপনীত তথা।।
স্নান যজ্ঞ করিলেন দান বহুতর।
ব্রাক্ষ্মন ভোজন করাইলেন বিস্তর।।
দধীচির তীর্থে তবে গেলেন লাঙ্গলী।
স্নানদান করিলেন হয়ে কুতূহলী।।
শুনিয়া জন্মেজয় বলে তপোধন।
দধীচি তীর্থের কথা কহ বিবরণ।।
ভারতের পুন্যকথা সমান পীযূষ।
যাহার শ্রবণে হয় নর নিষ্কলুষ।।
০৫. দধীচি তীর্থের বিবরণ
বলেন বৈশম্পয়ান শুন কুরুরায়।
দধীচি তীর্থের কথা জানাই তোমায়।।
ত্বষ্টা নামে মুনি এক বিরিঞ্চি-নন্দন।
মহাতেজোময় ছিল মহাতপোধন।।
অসুরের কন্যা এক বিবাহ করিল।
ত্রিশিরা নামেতে পুত্র তাহাতে জন্মিল।।
তিন মুন্ড হৈল তার দেখিতে সুন্দর।
একমুখে বেদপাঠ করে নিরন্তর।।
আর মুখে রামনাম করে অহর্নিশি।
অন্য মুখে মদ্যপান করে মহাঋষি।।
মুনিপুত্র যজ্ঞ করে যখন যেখানে।
লুকাইয়া যজ্ঞভাগ দেয় দৈত্যগণে।।
মাতামহকুলে তার বড়ই আদর।
দেবগণ জানিল সকল সমাচার।।
ইন্দ্রকে কহিল শুন দেবতার পতি।
দেখ ত্বষ্টামুনি পুত্র করিছে অনীতি।।
লুকাইয়া যজ্ঞভাগ দেয় মাতামহে।
এতেক বচন ইন্দ্রে দেবগণ কহে।।
শুনিয়া কুপিল ইন্দ্র অগ্নির সমান।
দেবগণে সাম্যবাক্যে কৈল সমাধান।।
খড়গ দিয়া ত্রিশারার কাটিলেন মাথা।
শুনিয়া সন্তুষ্ট হৈল সকল দেবতা।।
তৃষ্টা মুনি পাইল সকল সমাচার।
শচীপতি প্রতি রোষ করিল অপার।।
যজ্ঞ করে ত্বষ্টা মুনি ইন্দ্রে কোপ করি।
সঘনে অমরগণ কম্পে থরহরি।।
যজ্ঞে পূর্ণাহুতি দিতে জন্মিল নন্দন।
বৃত্রাসুর নাম তার অতি সুলক্ষণ।।
পরম তেজস্বী সেই বৃত্র মহাশয়।
ত্রিভুবনে কোন জনে নাহি করে ভয়।।
বিষ্ণুপরায়ণ হৈল পরম বৈষ্ণব।
তার কর্ম্ম দেখি ভয়ে কাঁপয়ে বাসব।।
মিলিল অনেক সৈন্য বৃত্রের সংহতি।
ইন্দ্রত্ব লইল খেদাড়িয়া সুরপতি।।
সকল অমরগণে লন্ডভন্ড কৈল।
স্বর্গের দেবতাগণ ভয়ে লুকাইল।।
পলাইয়া গেল সব ব্রক্ষ্মার সদন।
ব্রক্ষ্মারে কহিল গিয়া সব বিবরণ।।
বৃত্রাসুর লইল সকল অধিকার।
আপনি ইহার প্রভু কর প্রতিকার।।
প্রজাপতি বলিলেন শুন দেবগণ।
দেবের অবধ্য ত্বষ্টা মুনির নন্দন।।
নারায়ণ স্থানে সবে করহ গমন।
নিজ নিজ দুঃখ কথা কর নিবেদন।।
এত বলি দেবগণে লইয়া সংহতি।
নারায়ণ সমীপে গেলেন প্রজাপতি।।
গোলোকধামেতে যথা দেব নারায়ণ।
উপনীত হইলেন সহ দেবগণ।।
প্রণাম করিল গিয়া অমর নিকর।
বসিতে আদেশ করিলেন বিশ্বম্ভর।।
আদেশ পাইয়া সবে বসে সন্নিধানে।
কহেন চতুরানন বিনয় বচনে।।
শুন প্রভু নারায়ণ আমার বচন।
তোমার চরণে কিছু করি নিবেদন।।
মহাভারতের কথা সমান পীযূষ।
যাহার শ্রবণে হয় নর নিষ্কলুষ।।
গদাপর্ব্ব ভারতের অপূর্ব্ব কথন।
কাশীরাম দাসের পয়ার বিরচন।।
০৬. দেবগণ কর্ত্তৃক বিষ্ণুর স্তব
ব্রহ্মা ব্রহ্মা আদি সুরগণ, একান্ত একা গ্রমন,
স্তুতি করি হরির চরণে।
শুন প্রভু নারায়ণ, যতেক দেবতাগণ,
নিবেদন করে এক মনে।।
হে মধুকৈটভ অরি, আমরা ভয়েতে মরি,
বৃত্রাসুর নিল অধিকার।
বৈসে ইন্দ্র সিংহাসনে, খেদাড়িল দেবগণে,
অমরের নাহিক নিস্তার।।
ইন্দ্রের ইন্দ্রত্ব নিল, ভয়ে ইন্দ্র পলাইল,
অমরের নিল রাজদন্ড।
দেবতা ছাড়িল ধর্ম্ম, লইল অগ্নির কর্ম্ম,
বরুণে করিল লন্ডভন্ড।।
পবনের অধিকার, লইলেক দুরাচার,
চন্দ্রার্কের কি কব দুর্গতি।
বৃত্র করে পরাভব, ইন্দ্রাদি দেবতা সব,
মনুষ্য সমান ভ্রমে ক্ষিতি।।
দারুণ দৈত্যের ভয়, প্রাণ নাহি স্থির হয়,
দেবতার নাহিকনিস্তার
তুমি ত্রিলোকের পতি, সকল দেবের গতি,
চিন্তহ ইহার প্রতিকার।।
রজোগুণে দিয়া বৃষ্টি, আপনি করিলা সৃষ্টি,
সত্ত্বগুণে করহ পালন।
সৃজন পালন নাশ, তব কর্ম্ম সুপ্রকাশ,
তমোগুণে কর সংহরণ।।
ইত্যাদি অনেক স্তব, করিল দেবতা সব,
শুনিয়া দুঃখিত ভগবান।
সন্বোধিয়া দেবগণে, কহিল সরল মনে,
দেবগণ কর অবধান।।
ভারত মঙ্গল কথা, শুনিতে খন্ডয়ে ব্যথা,
সকলের কলুষ বিনাশ।
গদাপর্ব্ব সুধাধার, ব্যাসের বচন সার,
পাঁচালী রচিল কাশীদাস।।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র