০৬. জরাসন্ধের জন্মবৃত্তান্তধর্ম্মরাজ বলেন, বলহ নারায়ণ।জরাসন্ধ নাম তার কিসের কারণ।।কত বল ধরে সে, কাহার পাইল বর।তোমা হিংসি রক্ষা পাইল, বিস্ময় অন্তর।।গোবিন্দ বলেন, রাজা কর অবধান।জরাসন্ধ-বিবরণ কহি তব স্থান।।মগধ দেশের রাজা নাম বৃহদ্রথ।অগণিত সৈন্যগণ গজ বাজী রথ।।তেজে সূর্য্য, ক্রোধে যম, ধনে যক্ষপতি।রূপে কামদেব রাজা ক্ষমাগুণে ক্ষিতি।।নিরন্তর যজ্ঞ করে, অন্যে নাহি মন।দুই কন্যা দিল তারে কাশীর রাজন।।পুত্রার্থী পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করে মহীপাল।না হইল বংশ তার গেল যুবাকাল।।আপনারে ধিক্কার করিয়া নরপতি।রাজ্য ত্যজি বনে গেল ভার্য্যার সংহতি।।গৌতম-নন্দন চণ্ডকৌশিক যে ঋষি।পরম তপস্বী তিনি সদা বনবাসী।।বহু দেশ ভ্রমিয়া মগধে উপনীত।বৃক্ষতলে রাজা তাঁরে দেখে আচম্বিত।।ভার্য্যা সহ প্রণমিল মুনির চরণ।মুনি জিজ্ঞাসিল রাজা কোথায় গমন।।করযোড়ে বলে রাজা বিনয় বচন।মম দুঃখ অবধান কর তপোধন।।বহু কর্ম্ম করিলাম রাজ্যে হৈয়া রাজা।সমুচিত বিধানেতে পালিলাম প্রজা।।ধনে জনে প্রয়োজন নাহি তপোধন।সর্ব্ব শূন্য দেখি মুনি বিনা পুত্রধন।।এই হেতু রাজ্য ত্যজি যাই বনবাস।তপস্যা করিব গিয়া লইয়া সন্ন্যাস।।রাজার বিনয় শুনি গৌতম নন্দন।ধ্যানেতে বসিয়া মুনি চিন্তে ততক্ষণ।।হেনকালে দৈবে সেই আম্রবৃক্ষ হৈতে।আচম্বিতে এক আম্র পড়িল ভূমিতে।।আম্র লয়ে মুনিবর হৃদে লাগাইল।হরিষে রাজার করে অর্পিয়া কহিল।।এ ফল খাইতে দেহ প্রধান ভার্য্যারে।গুণবান পুত্র হবে তাহার উদরে।।বাঞ্ছাপূর্ণ হৈল রাজা, যাহ নিজ ঘর।এত শুনি আনন্দিত হৈল নরবর।।মুনি প্রণমিয়া রাজা নিজালয়ে গেল।দুই ভার্য্যা সমান দোঁহারে বাঁটি দিল।।দুই ভাগ করি দোঁহে করিল ভক্ষণ।এককালে গর্ভবতী হৈল দুই জন।।একই সময়ে দুই রাণী প্রসবিল।বিস্ময়ে এককালে দোঁহে নিরখিল।।এক চক্ষু নাসা কর্ণ এক পদ কর।অর্দ্ধ অর্দ্ধ অঙ্গ দেখি বিস্ময় অন্তর।।হৃদয়ে হানিয়া কর বিষাদে বলিল।দশ মাস গর্ভব্যথা বৃথা বহি গেল।।নিরাশ হইয়া দোঁহে ঘৃণা করি মনে।ফেলাইয়া দিতে আজ্ঞা কৈলা দাসীগণে।।চতুষ্পথে ফেলাইয়া দিল ততক্ষণে।জরা নামে রাক্ষসী আইল সেইস্থানে ।।সদাই শোণিত মাংস আহার তাহার।সংসারের গর্ভপাতে তার অধিকার।।রাজগৃহে গর্ভপাত শুনিয়া ধাইল।অর্দ্ধ অর্দ্ধ অঙ্গ দেখি বিস্ময় মানিল।।আপন নয়নে ইহা কখন না দেখে।দুই হাতে দুই খান ধরিয়া নিরখে।।রহস্য দেখিয়া দুই সংযোগ করিল।আচম্বিতে দুই অঙ্গ একত্র হইল।।উঙা উঙা করি কান্দে মুখে হাত ভরি।আশ্চর্য্য দেখিয়া চিত্তে ভাবে নিশাচরী।।না হবে উদর পূর্ণে ইহারে খাইলে।নৃপতি হইবে তুষ্ট এ পুত্র পাইলে।।এত চিন্তি কোলে করি লইল নন্দন।মেঘের গর্জ্জন জিনি শিশুর নিঃস্বন।।মুনষ্যের মূর্ত্তি ধরি জরা নিশাচরী।রাজার সম্মুখে গেল পুত্রে কোলে করি।।নৃপতিরে কহিল সকল বিবরণ।হের নৃপ, নহ এই আপন নন্দন।।পুত্র পেয়ে উল্লাসিত হইল নৃপতি।তবে জিজ্ঞাসিল রাজা রাক্ষসীর প্রতি।।কে তুমি, কোথায় বাস, কি তোমার নাম।কার কন্যা, কার ভার্য্যা, কোথা তম ধাম।।এত স্নেহ মম প্রতি কিসের কারণে।আমারে এমত করে নাহি ত্রিভুবনে।।রাজার বচন শুনি বলে নিশাচরী।গৃহদেবী দিলা নাম সৃষ্টি-অধিকারী।।দানব বিনাশে মোর হইল সৃজন।সর্ব্ব গৃহে থাকি রাজা করহ শ্রবণ।।আমারে সপুত্রা নবযৌবনা করিয়া।যে জন রাখিবে গৃহ ভিত্তিতে আঁকিয়া।।জায়া সুত ধন ধান্যে সদা তার ঘর।পরিপূর্ণ থাকিবেক, শুন রাজ্যেশ্বর।।তব গৃহে পূজা রাজা পাই অনূক্ষণ।তেঁই রক্ষা করিলাম তোমার নন্দন।।সমুদ্র শোষয় রাজা মোর এই পেটে।সুমেরু সদৃশ মাংস খাইলে না আঁটে।।তব গৃহে পূজা লভি সন্তোষ আমার।এই হেতু রাখিলাম তোমার কুমার।।এই বলি রাক্ষসী চলিল নিজ স্থান।পুত্র পেয়ে নরপতি মহা হর্ষবান।।জাত কর্ম্ম বিধিমত করিল রাজন।অনুমান করি নাম দিল দ্বিজগণ।।জরায় সন্ধিত হেতু নাম জরাসন্ধু।দিনে দিনে বাড়ে যেন শুক্লপক্ষ-চন্দ্র।।কতদিনে বৃহদ্রথ পুত্রে রাজ্য দিয়া।ভার্য্যা সহ বনে গেল ব্রহ্মচারী হৈয়া।।জরাসন্ধ রাজা হৈল, বলে মহাবল।নিজ ভুজ-পরাক্রমে শাসে ভূমণ্ডল।।দুই সেনাপতি হংস ডিম্ভক তাহার।সর্ব্বত্র বিজয়ী অস্ত্রে, অভেদ আকার।।তিন জন মহাবীর, অজেয় সংসারে।চতুর্থ জামাতা কংস মহাবল ধরে।।আমা হৈতে ভোজপতি যবে হৈল হত।তথা হৈতে গদা প্রহারিল বার্হদ্রথ।।শতেক যোজন গদা এল আচম্বিতে।মথুরা কম্পিত যেন গিরি বজ্রাঘাতে।।সংগ্রামে সাজিয়া এল অষ্টাদশ বার।এয়োদ্শ অক্ষৌহিণী সহ পরিবার।।হংস নামে এক রাজা ছিল সঙ্গ তার।বলভদ্র হাতে সেই হইল সংহার।।মরিল মরিল হংস, হৈল এই শব্দ।শুনি মগধের লোক হইলেক স্তব্ধ।।ডিম্ভক করিত সেই রাজ্যের রক্ষণ।শুনিল সংগ্রামে হৈল ভ্রাতার মরণ।।সহিতে নারিল শোক হইল অস্থির।ডুবিয়া যমুনা জলে ত্যজিল শরীর।।জরাসন্ধ সহ তবে হংস গেল ঘর।শুনিল, মরিল শোকে ডুবিয়া সোদর।।ভ্রাতৃশোকে হংস আর ক্ষণে না রহিল।যমুনার জলে সেও ডুবিয়া মরিল।।হেনমতে ডুবিয়া মরিল দুই জন।একমাত্র জরাসন্ধ আছয়ে দুর্জ্জন।।সংগ্রামে জিনিতে তারে নাহিক ভুবনে।উপায় আছয়ে এক চিন্তিয়াছি মনে।।মল্লযুদ্ধ বিনা তার না হয় নিধন।বৃকোদর বাহুবলে করিবে সাধন।।আমার হৃদয় যদি জান মহাশয়।আমার বচনে যদি থাকয়ে প্রত্যয়।।পৌরুষ বৈভব যদি বাঞ্ছ নরপতি।ভীমার্জ্জুনে দেহ রাজা আমার সংহতি।।কৃষ্ণের বচন শুনি ধর্ম্মের নন্দন।একদৃষ্টে চান ভীমার্জ্জুনের বদন।।হৃষ্টমুখ দুই ভাই দেখি নরপতি।কহেন মধুর বাক্যে গোবিন্দের প্রতি।।কি কারণে এমত বলিলা যদুরায়।তোমা বিনা পাণ্ডবের কি আছে উপায়।।লক্ষ্মী পরাঙ্মুখ যারে, সে তোমা না জানে।সহজে পাণ্ডব-বন্ধু খ্যাত ত্রিভুবনে।।তব নাম নিলে ভয় নাহি ত্রিজগতে।তার কি আপদ যার থাকিবা সঙ্গেতে।।এত বলি নরপতি দুই ভাই লয়ে।গোবিন্দের হাতেতে দিলেন সমর্পিয়ে।।মহাভারতের কথা অমৃতের ধার।কাশীরাম দাস কহে, রচিয়া পয়ার।।০৭. ভীমার্জ্জুকে লইয়ে শ্রীকৃষ্ণেরগিরিব্রজে প্রবেশশুভক্ষণ করিয়া চলেন তিন জন।স্নাতক-বিপ্রের বেশ করিয়া ধারণ।।পদ্মসর লঙ্ঘিল পর্ব্বত কালকূট।গণ্ডকী শর্করাবর্ত্ত বিষম সঙ্কট।।সরযূ অযোধ্যা আর নগর মিথিলা।ভাগীরথী সরস্বতী যমুনা আইলা।।পার হৈয়া পূর্ব্বমুখে যান তিন জনে।মগধ রাজ্যেতে উত্তরিলা কত দিনে।।চৈত্যরথ আদি করি পঞ্চ গোটা গিরি।তাহার মধ্যেতে বৈসে গিরিব্রজ-পুরী।।অনুপম দেশ সেই দেখিতে সুন্দর।গো মহিষ ধন ধান্যে শোভিত নগর।।ভীমার্জ্জুনে বলেন গোবিন্দ মহামতি।এই পঞ্চ গিরি মধ্যে নগর বসতি।।পঞ্চ পর্ব্বতের কথা শুন দুই জন।শত্রু দেখি দ্বার রুদ্ধ হয় ততক্ষণ।।আর এক আশ্চর্য্য আছয়ে দুয়ারেতে।তিনগোটা ভেরী শব্দ করে আচম্বিতে।।শত্রু দেখি ভেরী শব্দ করয়ে যখন।সজাগ হইয়া সেনা করয়ে সাজন।।দ্বারে আছে দুই নাগ শত্রু দেখি দংশে।যার ভয়ে রিপু নাহি নগরে প্রবেশে।।মহারথিগণ সব রক্ষা করে দ্বার।ইহার উপায় এক করহ বিচার।।অর্জ্জুন বলেন, ভৈরী রৈল মোর ভাগে।শ্রীকৃষ্ণ বলেন, নিবারিল দুই নাগে।।ভীম বলিলেন, মোর পর্ব্বতের ভার।অন্য পথে যাব পুরে, না যাইব দ্বার।।এইরূপ বিচারিয়া তবে তিন জন।দ্বার ত্যাজি করিলেন গিরি আরোহণ।।নাগের কারণে দেব কৃষ্ণ মহামতি।খগপতি স্মরণ করেন শীঘ্রগতি।।আইল ভুজঙ্গ-রিপু কৃষ্ণের স্মরণে।এ তিন ভুবন কাঁপে যাহার গর্জ্জনে।।ভয়েতে ভুজঙ্গ দুই প্রবেশে পাতালে।কৃষ্ণেরে মেলানি মাগি খগপতি চলে।।ভেরী হেতু অর্জ্জুন এড়িল শব্দভেদী।এক অস্ত্রে তিন ভেরী ফেলিলেন ছেদি।।চৈত্যগিরি পৃষ্ঠে ভীম কৈল আরোহণ।রিপু দেখি গিরিবর করয়ে গর্জ্জন।।গিরিশৃঙ্গ ধরি ভীম উপাড়িল করে।আচল হইল গিরি মুষ্টির প্রহারে।।পর্ব্বত লঙ্ঘিয়া কৈল নগরে প্রবেশ।সুরপুর সম দেখি জরাসন্ধ-দেশ।।হাট বাট নগর চত্বর মনোহরা।নগর ভিতরে বৈসে বিবিধ পসরা।।সুগন্ধি কুসুম মাল্য দেখি সুশোভন।বলে লয়ে তিন জন করেন ভূষণ।।পূর্ব্ব দ্বার লঙ্ঘিয়া গেলেন তিন জনা।অন্তঃপুরে যাইতে ব্রাহ্মণে নাহি মানা।।তিন দ্বার লঙ্ঘি তবে যান অন্তঃপুর।যথা আছে মহীপাল জরাসন্ধ শূর।।যজ্ঞ দীক্ষা লইয়াছে, যজ্ঞেতে তৎপর।উপবাস-ব্রতী হয়ে আচে একেশ্বর।।কেবল ব্রাহ্মণগণ আছে তথাকারে।বিনা নিমন্ত্রণে অন্যে যাইতে না পারে।।তিন দ্বিজ দেখি রাজা উঠি যোড় হাতে।আগুসারি অভ্যর্থনা করে কত পথে।।বসিবারে দিল দিব্য কনক আসন।স্বস্তি স্বস্তি বলিয়া বৈসেন তিন জন।।তিন জন মূর্ত্তি রাজা করে নিরীক্ষণ।শাল বৃক্ষ কোঁড়া যেন অঙ্গের বরণ।।আজানুলম্বিত ভুজ ভুজঙ্গ-আকার।অস্ত্রচিহ্ন-লেখা আছে অঙ্গে সবাকার।।ভূষণ বিবিধ মাল্য দেখিয়া রাজন।নিন্দা করি বলিতে লাগিল ততক্ষণ।।ব্রতী বিপ্র হৈয়া কেন হেন অনাচার।সুগন্ধি চন্দন মাল্য অঙ্গে সবাকার।।মুনিগণ কহে আর আমি জানি ভালে।ব্রাহ্মণ কখন মাল্য নাহি পরে গলে।।পরিধান বহুবিধ বিচিত্র বসন।বিপ্রদেহে অস্ত্রচিহ্ন কিসের কারণ।।সত্য কহ তোমরা, কে হও কোন্ জাতি।কি হেতু আইলা বল আমার বসতি।।দ্বিজ বিনা আসে হেথা নাহি অন্য জন।চোর রূপে আসিয়াছ লয় মোর মন।।চৈত্যগিরি শৃঙ্খ ভাঙ্গি বুঝি এলে প্রায়।রাজদ্রোহ পাপ ভয় নাহিক তোমায়।।কি হেতু আইলা কোন্ ভিক্ষা অনুসারে।কোন্ বিধিমতে পূজা করি সবাকারে।।এত শুনি বাসুদেব বলেন বচন।গভীর নিনাদ যেন জলদ গর্জ্জন।।পুস্পমাল্য সদা রাজা লক্ষ্মীর আশ্রয়।লক্ষ্মীপ্রিয় কর্ম্মে বল কার বাঞ্জা নয়।।দ্বারে না আইলে হেন বলিলে বচন।শত্রুগৃহ-দ্বারে মোরা না যাই কখন।।কোনরূপে শত্রুগৃহে পশি মহারাজ।যেই হেতু আসিয়াছি করিব সে কাজ।।জরাসন্ধ বলে, মম না হয় স্মরণ।কবে শত্রু আমার তোমরা তিন জন।।না হিংসিতে যেই জন হিংসা আসি করে।তার সম পাপী নাহি সংসার ভিতরে।।কারো হিংসা নাহি করি, আমি মনে জানি।কিমতে তোমরা শত্রু, কহ দেখি শুনি।।গোবিন্দ বলেন, তুমি কহ বিপরীত।তোমার যতেক হিংসা জগতে বিদিত।।পৃথিবীর রাজা সব বান্ধি আনি বলে।পশুবৎ করি রাখিয়াছ বন্দিশালে।।মহাদেব বলি দিবা শুনিনু শ্রবণে।বল দেখি হেন কর্ম্ম করে কোন্ জনে।।নাহি দেখি, নাহি শুনি হেন বিপরীত।জ্ঞাতিগণে বলি দিবা, অধর্ম্ম চরিত।।আপদভঞ্জন আদি ধর্ম্মের রক্ষণ।জ্ঞাতি-হিংসা দেখিতে না পারি কদাচন।।সেই হেতু আসিয়াছি দুষ্টের দমনে।কতবার দেখিয়াছ, নাহি চিন কেনে।।ত্রয়োবিংশ অক্ষৌহিণী অষ্টাদশ বার।হারি পলাইলা সব করিলা সংহার।।সেই কৃষ্ণ আমি বসুদেবের নন্দন।পাণ্ডুপুত্র ভীমার্জ্জুন এই দুই জন।।আপনার হিত যদি বাঞ্ছয় রাজন।আমার বচনে রাজা ছাড় রাজগণ।।নহে, যুদ্ধ কর রাজা আমার সংহতি।দুই কর্ম্মে যেবা ইচ্ছা, হয় তব মতি।।শ্রীকৃষ্ণের বচনে জ্বলিল জরাসন্ধ।অমেষ বিশেষে গোবিন্দেরে বলে মন্দ।।পূর্ব্বকথা বিস্মরণ হইল তোমার।যুদ্ধে পলাইয়া গেলে শৃগাল আকার।।পৃথিবী ছাড়িয়া গেলে সমুদ্র ভিতরে।কভু নাহি শুনি পুনঃ এসেছ নগরে।।এখন তোমাকে দেখি আপনার দেশে।করিলে অদ্ভুত কর্ম্ম কেমন সাহসে।।দর্প করি কহিলে ছাড়িতে রাজগণ।কাহার শরীরে সহে এমত বচন।।ভুজবলে বান্ধি আনিলাম রাজগণে।সঙ্কল্প করেছি বলি দিব ত্রিলোচনে।।পূর্ব্বকথা তব বুঝি নাহিক স্মরণ।যাহ গোপসূত, লজ্জা নাহি কি কারণ।।সংগ্রাম মাগিলা তার না বুঝি কারণ।তোমা ছার সহিত যুঝিবে কোন্ জন।।যেবা ভীমার্জ্জুন, দেখি অত্যল্প বয়স।ইহাদের সহ যুদ্ধে হইবে অযশ।।মারিলে পৌরুষ নাহি হারিলে অযশ।পলাও বালকদ্বয়, না কর সাহস।।গোপালের বলে বুঝি করিলা উদ্যম।না জানহ জরাসন্ধ কৃতান্তের যম।।এতেক বলিল যদি জরাসন্ধ কোপে।ক্রোধে বৃকোদরের অধরোষ্ঠ কাঁপে।।গোবিন্দ বলেন, মিথ্যা না কর বড়াই।তোমার বিচারে তোমা সব কেহ নাই।।সে কারণে হীনবল দেখি রাজগণে।বলে ধরি মারিবারে চাহ অকারণে।।তার অনুরূপ ফল পাইবা নিকটে।দূর কর দর্প, আজি পড়িলা সঙ্কটে।।না করিবা ইচ্ছা যদি আমা সনে রণ।এ দোঁহার মধ্যে তব যারে লয় মন।।বালক বলিয়া চিত্তে না করিহ তুমি।ক্ষণেকে জানিবা আগে যাহ যুদ্ধভূমি।।জরাসন্ধ বলে, যদি ইচ্ছিলে মরণ।রণ-বাঞ্ছা করিলে, করিব আমি রণ।।কিরূপে করিবা রণ, কহ দেখি শুনি।এত শুনি তাহারে কহেন চক্রপাণি।।বিধির নিয়ম এই ক্ষত্রধর্ম্মে লিখে।সৈন্যে সৈন্যে রথে রথে অথবা এককে।।সেমত করহ যুদ্ধ ইচ্ছা যার সনে।যদাযুদ্ধ মল্লযুদ্ধ যাহা লয় মনে।।শুনিয়া বলিছে বৃহদ্রথের কুমার।ভুজবলে মহামত্ত করি অহঙ্কার।।সহজে বালক এই বিশেষে অর্জ্জুন।হীনবল সহ যুদ্ধ না করে নিপুণ।।কোমল বালক প্রায় দেখি যে নয়নে।কিছুমাত্র বৃকোদর, লয় মনে মনে।।ভীমের সহিত আজি করিব সমর।এত বলি উঠিল মগধ-দণ্ডধর।।দুই গোটা গদা রাজা আনিল তখনি।ভীমে দিল এক, এক লইল আপনি।।নগর বাহিরে গেল রঙ্গভূমি যথা।ধাইল নগর-লোক শুনি যুদ্ধকথা।।কৌতুক দেখেন কৃষ্ণ থাকিয়া অন্তরে।নৃপতি যুঝায় যেন মল্ল যুগলেরে।।অপূর্ব্ব সংগ্রাম করে ভীম জরাসন্ধ।বিস্তারে রচিয়া কহি যমকের ছন্দ।।পুণ্যকথা ভারতের শুনিলে পবিত্র।গোবিন্দের লীলারস পাণ্ডব-চরিত্র।।০৮. জরাসন্ধের সহিত ভীমের যুদ্ধঅপূর্ব্ব সংগ্রাম, না হয় বিরাম,হৈল জরাসন্ধ ভীমে।গজরাজ নক্রে, বৃত্রাসুর শক্রে,যেমত রাবণ-রামে।।কেশ-বাস সারি, করে গদা ধরি,দুই জন হৈল আগে।কর্কশ বচন, করিছে ভৎসন,দুই জন মত্ত রাগে।।আরে রে পাণ্ডব, কোথা রে খাণ্ডব,আইলা মগধ-দেশে।নিকট মরণ, এই যে কারণ,দৈবে বান্ধি আনে পাশে।।শুনিয়া তর্জ্জন, করিয়া গর্জ্জন,বলিছে কুন্তীর সুত।তোমারে শমন, করিল স্মরণ,আমি হয়ে এলাম দূত।।ক্রোধে বৃকোদর, কম্পে কলেবর,যেমন কদলীপাত।মণ্ডলী করিয়া, ত্বরিত ফিরিয়া,দোঁহে করে করাঘাত।।বিপরীত নাদ, পড়িল প্রমাদ,শ্রবণে লাগিল তালা।দন্ত কড়মড়, শ্বাসে বহে ঝড়,উড়ি যায় মেঘমালা।।করে করে ছাঁদি, পদে পদে বাঁধি,দুইজনে দোঁহা টানে।ক্ষণে দোঁহা ছাড়ি, শিরে শিরে তাড়ি,হৃদয়ে হৃদয় হানে।।লোহিত নয়ন, লোহিত বদন,নেহারে সকোপ দৃষ্টি।দন্ত কড়মড়, মারিছে চাপড়,বজ্র সম চড় মুষ্টি।।ঊরুতে জঘনে, ছান্দিল সঘনে,ভূমে গড়াগড়ি যায়।শ্রম-জল অঙ্গে, রণ-ধূলি সঙ্গে,ঢাকিল দোঁহার গায়।।রুধিরে জর্জ্জর, দুই কলেবর,অন্তর হইয়া ক্ষণে।ক্রোধে কায় কম্পে, পুনঃ পুনঃ ঝম্পে,দোঁহা’পর দুই জনে।।ঘোর নাদ চট, দোঁহে বাহুস্ফোট,গভীর গর্জ্জনে গর্জ্জে।পদে ভূ বিদরে, চাপিয়া অধরে,তর্জ্জনী তুলিয়া তর্জ্জে।।সে দোঁহে দোঁহারে, গদার প্রহারে,হৃদে ভুজ-শির-পিঠে।ঘোরতর রণ, দেখি সর্ব্বজন,গদাঘাতে অগ্নি উঠে।।কেন নহে ঊন, ধরি পুনঃ পুনঃ,হৃদয়ে হৃদয় চাপে।ভুজে ভুজে তাড়ি, ভুমিতলে পাড়ি,পুনঃ দোঁহে উঠে লাফে।।যেন দ্বি-বারণ, বারণী কারণ,যুঝয়ে পর্ব্বত মাঝে।যেন দ্বি-বৃষভে, সুরভির লোভে,গোষ্ঠের ভিতর যুঝে।।কার্ত্তিক প্রথমে, প্রতিপদ-ক্রমে,অহর্নিশি মত্ত রণে।হৈল চতুর্দ্দশী, কহে দাস কাশী,বিশ্রাম না পায় ক্ষণে।।০৯. জরাসন্ধ বধ ও রাজগণের কারামোচনঅহর্নিশি চতুর্দ্দশ দিবস সংগ্রাম।নিশ্বাস ছাড়িতে দোঁহে না পায় বিশ্রাম।।অনাহারে পীড়িত দোঁহার কলেবর।নিস্তেজ হইল বৃহদ্রথের কোঙর।।অচল হইল অঙ্গ, হরিলেক জ্ঞান।তথাপিহ দাণ্ডাইয়া আছে বিদ্যমান।।পবন-নন্দন ভীম মহাপরাক্রম।এত যুদ্ধে শরীরে তিলেক নাহি শ্রম।।ডাকিয়া বলেন কৃষ্ণ, কি দেখহ আর।এইকালে শত্রু কেন না কর সংহার।।কৃষ্ণের বচনে ক্রোধ করি বৃকোদর।দুই পায়ে ধরি ফেলে ভূমির উপর।।পুনরপি ধরে তারে কুন্তীর কুমার।দুই পায়ে ধরিয়া ভ্রমায় চক্রাকার।।শতবার ভ্রমাইয়া ফেলে ভূমিতলে।বক্ষঃস্থল চাপিয়া বসিল মহাবলে।।কণ্ঠে জানু দিয়া বুকে বজ্র-মুষ্টি মারে।গুরুতর গর্জ্জনে কম্পয়ে ধরাধরে।।রাজ্যের যতেক লোক হৈল মূর্চ্ছা প্রায়।কাহার বচন কেহ শুনিতে না পায়।।গর্ভবতী স্ত্রী গর্ভ পড়িল খসিয়া।হস্তী অশ্ব আদি পশু যায় পলাইয়া।।যথাশক্তি বৃকোদর করেন প্রহার।তথাপি না হয় জরাসন্ধের সংহার।।আর্শ্চর্য্য দেখিয়া ভীম বলেন কৃষ্ণেরে।যথাশক্তি করিলাম প্রহার ইহারে।।ইহার মরণে আমি, না দেখি উপায়।এত শুনি ডাকিয়া বলেন যদুরায়।।পূর্ব্বে সন্ধি কহিয়াছি কেন বিস্মরণ।সেইরূপে জরাসন্ধ হইবে নিধন।।বৃকোদরে দেখাইয়া দিলেন শ্রীনাথ।দুই করে ধরি চিরিলেন বেণাপাত।।দেখিয়া হৈলেন হৃষ্ট কুন্তীর নন্দন।পুনরপি ধেয়ে যান করিয়া গর্জ্জন।।বজ্রমুষ্টি প্রহারিয়া ফেলেন ভূতলে।সিংহ যেন মৃগ ধরি ফেলে অবহেলে।।একপদ পদে চাপি আর পদে কর।হুঙ্কারিয়া টানিলেন বীর বৃকোদর।।মধ্যখানে চিরিয়া করেন দুইখান।জন্মকাল অঙ্গ প্রাপ্তে হারাইল প্রাণ।।জরাসন্ধ পড়িল, সহর্ষ নারায়ণ।আনন্দেতে তিন জনে কৈল আলিঙ্গন।।রাজ্যের যতেক লোক প্রমাদ গণিল।জরাসন্ধ-সুত সহদেব নামে ছিল।।ভয়েতে কম্পিত তনু পাত্র মিত্র লয়ে।গোবিন্দের চরণেতে পড়িল আসিয়ে।।তবে কর যুড়ি কহু করিল স্তবন।তোমার মহিমা প্রভু জানে কোন্ জন।।তুমি ব্রহ্মা, তুমি বিষ্ণু, তুমি পুরন্দর।তুমি আদ্যা, তুমি শক্তি, তুমি বৈশ্বানর।।তুমি চন্দ্র, তুমি সূর্য্য, তুমি জলেশ্বর।তুমি বায়ু, তুমি বল, তুমি চরাচর।।আমি অতি মূঢ়মতি, নাহি জানি তোমা।চারি বেদে নাহি জানে তোমার তুলনা।।এইরূপে বহু স্তুতি করিল কুমার।ঈষৎ হাসিল তবে দেব গদাধর।।আশ্বাসিয়া গোবিন্দ অভয় তারে দিল।মগধ-রাজ্যেতে তারে দণ্ড ধরাইল।।বন্দিশালে আছিল যতেক রাজগণ।একে একে ঘুচাইল সবার বন্ধন।।নানা রত্নে সবাকারে করিল ভূষণ।করযোড়ে স্তুতি করি কহে রাজগণ।।সদয়-হৃদয় তুমি সেবক-রঞ্জন।দুর্ব্বলের বল, গর্ব্বীর গর্ব্ব-ভঞ্জন।।অনাথের নাথ তুমি, হিংস্রকের অরি।ধর্ম্মের পালন হেতু মর্ত্ত্যে অবতরি।।কে বর্ণিতে পারে গুণ, বেদে অগোচর।সদা যোগে ধ্যানে যারে না পায় শঙ্কর।।যুত দুঃখ দিল জরাষন্ধ নৃপবরে।সকল সফল হৈল ভাবি যে অন্তরে।।অভয় পঙ্কজ-পদ দেখিনু নয়নে।বদনে অমৃত ভাষা, শুনিনু শ্রবণে।।বলে জরাসন্ধ প্রভু করিল বন্ধন।এত দিনে বলি দিত সব রাজগণ।।কৃপায় সবারে প্রভু করিলা উদ্ধার।এ কর্ম্ম তোমার প্রভু কিছু নহে ভার।।আজ্ঞা কর আমরা করিব কিবা কার্য্য।গোবিন্দ বলেন, সবে যাহ নিজ রাজ্য।।রাজসূয় করিবেন ধর্ম্মের নন্দন।সেই যজ্ঞে সহায় হইবে সর্ব্বজন।।এত শুনি রাজগণ করে অঙ্গীকার।প্রণমিয়া দেশে সবে গেল যে যাহার।।তবে জরাসন্ধ-রথ আনি নারায়ণ।তিন জনে আরোহণ করেন তখন।।অপূর্ব্ব সুন্দর রথ লোকে অগোচর।সেই রথে চড়ি পূর্ব্বে দেব পুরন্দর।।দলিল দানবগণ ঊনশত বার।যোজন পর্য্যন্ত দৃষ্টি হয় ধ্বজা যার।।ঈন্দ্র হৈতে পাইল বসু মগধ-ঈশ্বরে।বসু হৈতে বৃহদ্রথ, সে দিল কুমারে।।সেই রথে আরোহিয়া যান তিন জন।গোবিন্দ গরুড়ে তবে করিলা স্মরণ।।আজ্ঞা করিলেন বসিবারে ধ্বজোপরে।খগপতি-ধ্বজ-রথ ঘোষে চরাচরে।।শঙ্খনাদ করিয়া চলিল শীঘ্রগতি।ইন্দ্রপ্রস্থে উপনীত তিন মহামতি।।যুধিষ্ঠির-চরণে করিয়া নমস্কার।একে একে কহেন সকল সমাচার।।আনন্দেতে যুধিষ্ঠির করি আলিঙ্গন।গোবিন্দে অনেক পূজা করেন তখন।।জরাসন্ধ-রথ আর অমূল্য রতন।কৃষ্ণেরে দিলেন রাজা হৈয়া হৃষ্টমন।।সেই রথে আরোহিয়া দেব দামোদর।মেলানি মাগিয়া যান দ্বারকা-নগর।।পুণ্যকথা ভারতের শুনিলে পবিত্র।গোবিন্দের লীলা-রস পাণ্ডব-চরিত্র।।সভাপর্ব্বে সুধারস জরাসন্ধ বধে।কাশীরাম দাস কহে গোবিন্দের পদে।।১০.অর্জ্জুনের দিগ্বিজয় যাত্রাকরি কেশ গুটি, বান্ধা ঊর্দ্ধ ঝুঁটি,বেষ্টিত বৃক্ষের লতা।পরম হরিষে, ধাইল রণে সে,শুনিয়া সংগ্রাম-কথা।।ঘোর ডাক পাড়ে, নানা অস্ত্র ছাড়ে,হইল উভয়ে রণ।ভগদত্ত-রাজ, পুরন্দরাত্মজ,মুখামুখি দুইজন।।দোঁহে ধনুর্দ্ধর, ফেলে নানা শর,যাহার যতেক শিক্ষা।মারুত অনল, সূর্য্য বসু জল,বিবিধ মন্ত্রেতে দীক্ষা।।অষ্ট অহর্নিশি, দোঁহে উপবাসী,বিশ্রাম না করে ক্ষণে।দেখি ভগদত্ত, বলে মহামত্ত,হাসিয়া বলে অর্জ্জুনে।।নিবর্ত্তহ রণ, ইন্দ্রের নন্দন,তুমি হও সখা-সুত।তোমার জনক, ত্রিদশ পালক,সখা মম পুরুহূত।।মনে ছিল ভ্রম, তোমার বিক্রম,জানিলাম এতদিনে।কিসের কারণ, কর তুমি রণ,হেথা সে আইলা কেনে।।বলে ধনঞ্জয়, ধর্ম্মের তনয়,কুরুকুলে হন রাজা।করিলেন ক্রতু, চাহি এই হেতু,দিবা তাঁরে কিছু পূজা।।যদি মোর প্রতি, হইয়াছ প্রীতি,তবে নিবেদন করি।ক্ষম মম দোষ, দেহ কিছু কোষ,প্রাগজ্যোতিষ-অধিকারী।।হরিষে রাজন, দিল বহু ধন,পার্থেরে পূজি বিশেষে।লয়ে তাঁর পূজা, পার্থ মহাতেজা,চলিলেন অন্য দেশে।।বিবিধ পর্ব্বতে, নৃপ শতে শতে,কতেক লইব নাম।দিয়া ধনচয়, কেহ মিলে তায়,কেহ না করে সংগ্রাম।।উলুকের পতি, বৃহন্ত নৃপতি,করিল অনেক রণ।মোদাপুর ধাম, দেবক সুদাম,তিনে দিল বহুধন।।রাজা সেনাবিন্দু, দিল রত্নসিন্ধু,পৌরব পর্ব্বত-রাজা।লোহিত মণ্ডল, রাজা মহাবল,করিল অনেক পূজা।।ত্রিগর্ত্ত-মণ্ডলে, জিনি বীর হেলে,সিংহপুরে সিংহরাজ।বাহ্লীক দরদ, রাজা যে কামদ,বৈসে কামগিরি-মাঝ।।অপূর্ব্ব সে দেশে, নানা বর্ণ অশ্বে,শুক-ময়ুরের রঙ্গে।কৌতুকে অর্জ্জুন, নিল অশ্বগণ,বিবিধ রতন সঙ্গে।।নৃপতি যবন, কৈল মহারণ,হারিয়া ভজিল আসি।ভুবনে অপূর্ব্ব, দিল বহুদ্রব্য,নানা বর্ণে রাশি রাশি।।তবে একে একে, জিনিয়া সবাকে,উঠিল হেমন্ত-গিরি।তাহে যত ছিল, হেলায় জিনিল,গন্ধর্ব্ব-দানব পুরী।।পর্ব্বত কৈলাস, কুবেরের বাস,যক্ষ রক্ষ কোটি কোটি।মানুষ কিন্নর, হইল সমর,হৈল বিজয়ী কিরীটী।।ইন্দ্রের কোঙর, ইন্দ্র সম শর,মারিলেক বহু যক্ষ।পলাইল ডরে, কহিল কুবেরে,পুরে পশিল বিপক্ষ।।শুনি বৈশ্রবণ, লয়ে বহু ধন,পূজিল পাণ্ডুর সুতে।স্নেহভাষে তায়, করিল বিদায়,পার্থ যান তথা হৈতে।।নগর হাটক, নিবাসী গুহ্যক,জিনি পাইলেন ধন।লয়ে রত্ন ধন, চলেন অর্জ্জুন,হৈয়ে আনিন্দত মন।।মান সরোবর, তথা বীরবর,দেখি হইলেন সুখী।অমর-নগরী, অপ্সর কিন্নরী,কোটি কোটি শশিমুখী।।জিতেন্দ্রিয় ধীর, পার্থ মহাবীর,নাহি চান কারো পানে।সেই সরোবাসী, ছিল বহু ঋষি,আশিস্ করে অর্জ্জুনে।।তথা হৈতে চলে, মহা কুতূহলে,অতিশয় শীঘ্রগামী।সংগ্রামে প্রচণ্ড, তেজেতে মার্ত্তণ্ড,জিনিয়া ভারত-ভূমি।।তাহার উত্তর, যান বীরবর,হরিবর্ষ-নামে খণ্ড।দেখি দ্বারপাল, ধায় পালে পাল,হাতে করি লৌহদণ্ড।।দেখিয়া মানুষে, সর্ব্বজন হাসে,অতি অপরূপ বাসি।বিস্ময়-অন্তরে, কহে অর্জ্জুনেরে,তুমি যে বড় সাহসী।।মানব-শরীরে, আসিলে এধারে,কভু নাহি দেখি শুনি।নিবর্ত্তহ তুমি, অগম্য এ ভূমি,কাহার শকতি জিনি।।ভারত দিগন্ত, আইলা মতিমন্ত,তুমি কি ভ্রান্ত হইলে।এ পুর উত্তর, কুরুর নগর,হেথায় কি হেতু আইলে।।দেখিতে না পাবে, কি যুদ্ধ করিবে,নাহি নরলোক-গতি।কুন্তীর নন্দন, শুনিয়া বচন,বলেন দ্বারীর প্রতি।।ধর্ম্ম-নরবর, ক্ষত্রিয় ঈশ্বর,তাঁহার আমি কিঙ্কর।তোমা না লঙ্ঘিব, পুরে না পশিব,দেহ কিচু মোরে কর।।শুনি ততক্ষণ, দ্বারপালগণ,অনেক রতন দিল।লয়ে ধনঞ্জয়, সানন্দ হৃদয়,দক্ষিণ মুখে চলিল।।আসিবার কালে, বহু মহীপালে,জিনিয়া নিলেন কর।বাদ্য কোলাহলে, চতুরঙ্গ-দলে,চলিল নিজ নগর।।মণি মরকত, কনক রজত,মুকুতা-প্রবাল-রাশি।বিবিধ বসন, গো আদি বাহন,লয়ে কত দাস-দাসী।।জয় জয় শব্দে, শঙ্খের নিনাদে,প্রবেশি ইন্দ্রপ্রস্থতে।ইন্দ্রের আত্মজ, ত্যজিয়া সে সাজ,গেলেন ধর্ম্ম-অগ্রেতে।।ভূমিতলে পড়ি, দুই কর যুড়ি,দাণ্ডাইয়া কত দূরে।করিয়া কোমল, কহেন সকল,ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরে।।তোমার প্রতাপে, উত্তরের নৃপে,সবে আনিলাম বশে।সবে দিল কর, দেখ নৃপবর,পাইলাম যে যে দেশে।।হরিষে রাজন, করি আলিঙ্গন,তুষিলেন মৃদু-ভাষে।আনিলেন যাহা, কোষে রাখি তাহা,পার্থ গেলেন নিবাসে।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon