মহাভারত:বনপর্ব-০২৬-০৩০

২৬. পাণ্ডবগণে দ্বৈতবনে গমন
ও মার্কণ্ডেয় মুনির আগমন
দ্বারকা নগরে চলিলেন যদুপতি।
যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসেন ভ্রাতৃগণ প্রতি।।
দ্বাদশ বৎসর আমি নিবসিব বনে।
যোগ্যবান দেখ যথা বঞ্চি হৃষ্টমনে।।
বহু মৃগ পক্ষী থাকে ফল পুষ্পরাশি।
সজল সুস্থল যথা আছে সিদ্ধ ঋষি।।
অর্জ্জুন বলেন, সব তোমাতে গোচর।
মুনিগণ হৈতে তুমি জ্ঞাত চরাচর।।
দ্বৈতনামে মহাবন অতি মনোরম।
সাধু সিদ্ধ ঋষি আদি মুনির আশ্রম।।
তথায় চলহ সবে যদি লয় মন।
এত শুনি আজ্ঞা দেন ধর্ম্মের নন্দন।।
নিজ নিজ যানারোহে চলেন পাণ্ডব।
সঙ্গেতে চলিল যত দ্বিজ মুনি সব।।
দ্বৈত কাননের গুণ না যায় বর্ণন।
গন্ধর্ব্ব চারণ থাকে মুনি অগণন।।
তমাল কদম্ব তাল শিরীষ পিয়াল।
অর্জ্জুন খর্জ্জুর জম্বূ আম্র সুরসাল।।
পারিজাত বকুল চম্পক কুরুবক।
নানা জাতি পশু হস্তিগণ মরূবক।।
ময়ূর কোকিল আদি পক্ষী সদা ভ্রমে।
ষড়ঋতুযুক্ত বন লোক মনোরমে।।
দেখিয়া উল্লাসযুক্ত পাণ্ডবের মন।
আশ্রম করিল তথা সব মুনিগণ।।
সেই বনে যত ছিল তাপস ব্রাহ্মণ।
যুধিষ্ঠিরে আসি সবে করে সম্ভাষণ।।
হেনকালে আসে মার্কণ্ডেয় মুনিবর।
জমদগ্নি সম তেজ দিব্য জটাধর।।
প্রণমিয়া যুধিষ্ঠির দিলেন আসন।
যুধিষ্ঠিরে দেখিয়া হাসিল তপোধন।।
দেখিয়া বিস্ময়চিত্ত কহেন ভূপতি।
কি হেতু হাসিলা, কহ মুনি মহামতি।।
সব ঋষিগণ দুঃখী দেখিয়া আমারে।
তোমার কি হেতু হাস্য, না বুঝি অন্তরে।।
মৃদু হাস্য করি মুনি বলেন তখন।
যে হেতু হাস্য, শুনহ রাজন।।
যেমতি রাজন তুমি ভার্য্যার সংহতি।
সর্ব্বভোগ ত্যজি বনে করিলে বসতি।।
এইরূপে পূর্ব্বে রাম রঘুর নন্দন।
সহিত জানকী আর অনুজ লক্ষ্মণ।।
পিতৃসত্য পালিবারে করি বনবাস।
অবহেলে দশস্কন্ধে করিলেন নাশ।।
অপ্রমেয় বল রাম অপ্রমেয় গুণ।
সত্যে বিচলিত নাহি হন কদাচন।।
তিন লোক জিনিবারে ইঙ্গিতেতে পারে।
সত্যের কারণ শিরে জটাভার ধরে।।
তাদৃশ দেখি যে রাজা তুমি সত্যবাদী।
মহাবল ধর্ম্মবন্ত সর্ব্বগুণনিধি।।
তথাপি বনেতে বাস সত্যের কারণ।
বিধির নিয়ম নাহি খণ্ডে মহাজন।।
যখন যে ধাতা আনি করয়ে সংযোগ।
ধর্ম্ম বুঝি সাধুজন তাহা করে ভোগ।।
বলে শক্ত হলে, সত্য নাহিক ত্যজিবে।
বিধির নির্ব্বন্ধ কর্ম্ম কভু না লঙ্ঘিবে।।
বড় বড় মত্ত হস্তী পর্ব্বত আকার।
পরাক্রমে দলিবারে পারয়ে সংসার।।
তথাপিহ পশু হয়ে বিধিবশ থাকে।
কিমতে খণ্ডিতে পারে তোমা হেন লোকে।।
ধন্য মহারাজ তুমি পাণ্ডুর নন্দন।
তোমার গুনেতে পূর্ণ হৈল ত্রিভুবন।।
এত বলি মুনিরাজ আশিস্ করিয়া।
আপন আশ্রম প্রতি গেলেন চলিয়া।।
মহাভারতের কথা অমৃত লহরী।
কাশী কহে, শুনিলে তরয়ে ভাববারি।।
২৭. দ্রৌপদীর খেদোক্তি
দ্বৈতবন মধ্যে পঞ্চ পাণ্ডুর নন্দন।
ফলমূলাহার জটা বাকল ভূষণ।।
একদিন কৃষ্ণা বসি যুধিষ্ঠির পাশে।
কহিতে লাগিল দুঃখ সকরুণ ভাষে।।
এ হেন নির্দ্দয় দুরাচার দুর্য্যোধন।
কপট করিয়া তোমা পাঠাইল বন।।
কিছুমাত্র তব দোষ নাহি তার স্থানে।
এ হেন দারুণ কর্ম্ম করিল কেমনে।।
কঠিন হৃদয় তার, লোহাতে গঠিল।
তিল মাত্র তার মনে দয়া না জন্মিল।।
তোমার এ গতি বনে দেখি নরপতি।
সহনে না যায়, মোর সন্তাপিত মতি।।
রতনে ভূষিত শয্যা, নিদ্রা না আইসে।
এখন শয়ন রাজা তীক্ষ্মধার কুশে।।
কস্তুরী চন্দনেতে লেপিত কলেবর।
এখন হইল ধনু ধূলায় ধূসর।।
মহারাজগণ যার বসিত চৌপাশে।
তপস্বী সহিত থাক তপস্বীর বেশে।।
লক্ষ লক্ষ দ্বিজ যার স্বর্ণপাত্রে ভুঞ্জে।
এবে ফলমূল ভক্ষ্য অরণ্যের মাঝে।।
এই সব ভ্রাতৃগণ ইন্দ্রের সমান।
ইহা সবা প্রতি নাহি কর অবধান।।
মলিন বদন ক্লিষ্ট দুঃখেতে দুর্ব্বল।
হেঁটমুখে সদা থাকে ভীম মহাবল।।
ইহা দেখি রাজা তব নাহি জন্মে দুখ।
সহনে না যায় মম, ভাসিতেছে বুক।।
ভীম সম পরাক্রমে নাহি ত্রিভুবনে।
ক্ষণমাত্রে সংহারিতে পারে কুরুগণে।।
সকলি ত্যজিল রাজা তোমার কারণ।
কিমতে এ সব দুঃখ দেখহ রাজন।।
এই যে অর্জ্জুন কার্ত্তবীর্য্যের সমান।
যাহার প্রতাতে সুরাসুর কম্পমান।।
পৃথিবীতে বসে যত রাজরাজেশ্বর।
রাজসূয়ে খাটাইল করিয়া কিঙ্কর।।
মলিন বসন রহে মলিন বদনে।
ইহা দেখি রাজা তব দুঃখ নাহি মনে।।
সুকুমার মাদ্রীসুত দুঃখী অধোমুখ।
ইহা দেখি রাজা তব নাহি জন্মে দুখ।।
ধৃষ্টদ্যুন্ন স্বসা আমি দ্রুপদ নন্দিনী।
তুমি হেন মহারাজ, আমি হই রাণী।।
মম দুঃখ দেখি রাজা ‍তাপ না জন্ময়।
ক্রোধ নাহি তব মনে, জানিনু নিশ্চয়।।
ক্ষত্র হয়ে ক্রোধ নাহি, নাহি হেন জন।
তোমাতে নাহিক রাজা ক্ষত্রিয় লক্ষণ।।
সময়েতে যেই বীর তেজ নাহি করে।
হীন জন বলি কহে সকলে তাহারে।।
এই অর্থে পূর্ব্বে রাজা আছয়ে সম্বাদ।
দৈত্যপতি বলি প্রতি বলিছে প্রহ্লাদ।।
করযোড়ে বলি জিজ্ঞাসিল পিতামহে।
ক্ষমা তেজ উভয়ের ভাল কারে কহে।।
সর্ব্বধর্ম্ম অভিজ্ঞ প্রহ্লাদ মহামতি।
কহিতে লাগিল শাস্ত্রমত পৌত্র প্রতি।।
সদা ক্ষম না হইবে, সদা তেজোবন্ত।
সদা ক্ষমা করে, তার দুঃখে নাহি অন্ত।।
শত্রুর আছুক কার্য্য মিত্র নাহি মানে।
অবজ্ঞা করিয়া কেহ, বাক্য নাহি শুনে।।
কার্য্যে অবহেলা করে, নাহি কিছু ভয়।
যথা স্থানে যাহা করে, ক্রমে হয় লয়।।
পুত্র কন্যা আর যত আত্ম পরিজন।
অতি ক্ষমাশীল দেখি করয়ে হেলন।।
অতি ক্ষমাশীল দেখি ভার্য্যা নাহি মানে।
সে কারণে সদা ক্ষমা ত্যজে বুধগণে।।
দোষমত দণ্ড দিবে শাস্ত্র অনুসারে।
মহাক্লেশ পায়, যেই সদা ক্ষমা করে।।
ক্ষমার কারণ তবে শুন নরপতি।
একবার করে ক্ষমা মূর্খ জন প্রতি।।
অবোধ অজ্ঞানে ক্ষমা করি একবার।
দুইবার দোষ কৈলে দণ্ড দিবে তার।।
দুইবার ক্ষমা কেহ না করে রাজন।
কত দোষ তোমার না কৈল দুর্য্যোধন।।
সে কারণে ক্ষমা রাজা না কর তাহারে।
তেজকালে কর তেজ, ক্ষমা ফেল দূরে।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীদাস কহে, ইহা বিনা নাহি আন।।
২৮. যুধিষ্ঠির-দ্রৌপদী সংবাদ
দ্রৌপদীর বাক্য শুনি ধর্ম্ম নরপতি।
করেন উত্তর তার ধর্ম্মশাস্ত্র নীতি।।
ক্রোধ সম ‍পাপ দেবী নাহিক সংসারে।
প্রত্যক্ষে শুনহ, ক্রোধ যত পাপ ধরে।।
গুরু লঘু জ্ঞান নাহি থাকে ক্রোধকালে।
অকথ্য কথন দেবী ক্রোধ হৈলে বলে।।
আছুক অন্যের কার্য্য আত্মা হয় বৈরী।
বিষ ‍খায়, ডুবে মরে, অঙ্গে অস্ত্র মারি।।
সে কারণে বুধগণ সদা ক্রোধ ত্যজে।
অক্রোধ যে লোক, তাকে সর্ব্বলোকে পূজে।।
ক্রোধে পাপ, ক্রোধে তাপ, ক্রোধে কুলক্ষয়।
ক্রোধে সর্ব্বনাশ হয়, ক্রোধে অপচয়।।
জপ তপ সন্ন্যাস ক্রোধীর অকারণ।
রজোগুণে ক্রোধী বিধি করিল সৃজন।।
হেন ক্রোধ যেই জন জিনিবারে পারে।
ইহলোক পরলোক অবহেলে তরে।।
সময়েতে তেজ দেখাইবে সমুচিত।
ক্রোধে মহাপাপ না করিবে কদাচিত।।
ক্ষমা সম ধর্ম্ম দেবী অন্য ধর্ম্ম নয়।
পূর্ব্বেতে কশ্যপ মুনি করিল নির্ণয়।।
অষ্টাঙ্গ বেদাঙ্গ যজ্ঞ মহাদান ধ্যান।
ক্ষমাশীল জনে সর্ব্বদা দীপ্যমান।।
পৃথিবীকে ধরিয়াছে ক্ষমাবন্ত জনে।
আমা সম জন ক্ষমা ত্যজিবে কেমনে।।
সেই হেতু দ্রৌপদী ত্যজহ ক্রোধ মন।
শত অশ্বমেধ ফর অক্রোধী যে জন।।
দুর্য্যোধন না ক্ষমিল, আমি না ক্ষমিব।
এইক্ষণে কুরুবংশ সকল মজাব।।
কুরুবংশ দেখ দেবী মম পুণ্যভার।
মোর ক্রোধ হৈলে বংশ হইবে সংহার।।
ভীষ্ম দ্রোণ বিদুরাদি বুঝাইবে সবে।
সবাকারে দুর্য্যোধন তিরস্কৃবে যবে।।
আপনার দোষে তারা হইবে সংহার।
পূর্ব্বে করিয়াছি আমি এমন বিচার।।
কৃষ্ণা বলে, সেই বিধাতারে নমস্কার।
যেই জন হেনরূপ করিল সংসার।।
সেইজন যাহা করে, সেইমত হয়।
মনুষ্যের শক্তিবলে কিছু সাধ্য নয়।।
যজ্ঞ দান তপ ব্রহ বহু আচরিলে।
দ্বিজসেবা দেবপূজা কতই করিলে।।
ধিক্ ধিক্ বিধি তার কৈল হেন গতি।
ধর্ম্ম হেতু পঞ্চ ভাই পাইলে দুর্গতি।।
ধর্ম্ম হেতু সব ত্যজি আইলে বনেতে।
চারি ভাই আমাকেও পারহ ত্যজিতে।।
তথাপিহ ধর্ম্ম নাহি ত্যজিলে রাজন।
কায়ার সহিত যেন ছায়ার গমন।।
যেই জন ধর্ম্ম রাখে , তারে ধর্ম্ম রাখে।
নাহিক সন্দেহ, শুনিয়াছি ব্যাস মুখে।।
তোমারে না রাখে ধর্ম্ম কিসের কারণে।
এই ত বিস্ময় ব হয় মম মনে।।
তোমার যতেক ধর্ম্ম বিখ্যাত সংসার।
সর্ব্ব ক্ষিতীশ্বর হয়ে নাহি অহঙ্কার।।
শ্রেষ্ঠ জন, হীন জন, দেখহ সমান।
সহাস্যবদনে সদা কর নানা দান।।
লক্ষ লক্ষ বিপ্রগণ স্বর্ণপাত্রে ভুঞ্জে।
আমি করি পরিচর্য্যা সেবা হেতু দ্বিজে।।
দিতাম সুবর্ণপাত্র দ্বিজে আজ্ঞামাত্রে।
এখন বনের ফল ভুঞ্জ বনপত্রে।।
রাজসূত্র অশ্বমেধ সুবর্ণ গো সব।
আর সব বহু যজ্ঞ দান মহোৎসব।।
সে সব করিতে বুদ্ধি হইল তোমায়।
সর্ব্বস্ব হারিলে রাজা কপট পাশায়।।
যে বনের মধ্যে রাজা চোর নাহি থাকে।
তথায় নিযুক্ত বিধি করিল তোমাকে।।
এখন সে ধর্ম্ম তুমি করিবে কেমনে।
রাজ্যহীন ধনহীন বসতি কাননে।।
ধিক্ বিধাতারে এই, করে হেন কর্ম্ম।
দুষ্টাচার দুর্য্যোধন করিল অধর্ম্ম।।
তাহারে নিযুক্ত কেন পৃথিবীর ভোগ।
তোমারে করিল বিধি এমন সংযোগ।।
যুধিষ্ঠির কহে, কৃষ্ণা উত্তম কহিলে।
কেবল করিলে দোষ, ধর্ম্মেরে নিন্দিলে।।
আমি যত কর্ম্ম করি, ফলাকাঙ্ক্ষা নাই।
যাহা করি সমর্পি যে ঈশ্বরের ঠাঁই।।
কর্ম্ম করি যেই জন ফলাকাঙ্ক্ষা নাই।
বণিকের মত সেই বাণিজ্য করয়।।
ফললোভে ধর্ম্ম করে লুব্ধ বলি তারে।
লোভে পুনঃ পুনঃ পড়ে নরক দুস্তরে।।
এই ত সংসার সিন্ধু উর্ম্মি কত তায়।
হেলে তরে সাধুজন ধর্ম্মের নৌকায়।।
ধর্ম্মকর্ম্ম করি ফলাকাঙ্ক্ষা নাহি করে।
ঈশ্বরেতে সমর্পিলে অবহেলে তরে।।
ধর্ম্মফল বাঞ্ছা করি ধর্ম্মগর্ব্ব করে।
ধর্ম্মেরে করিয়া নিন্দা অধর্ম্ম আচরে।।
এই সব জনগণে পশুমধ্যে গণি।
বৃথা জন্ম যায় তার পেয়ে নরযোনি।।
ধর্ম্মশাস্ত্র বেদনিন্দা করে যেই জন।
তির্য্যগের মধ্যে তারে করয়ে গণন।।
পুনঃ পুনঃ তির্য্যক্ যোনিতে জন্ম হয়।
নরক হইতে তার কভু পার নয়।।
শিশু হয়ে ধর্ম্মচর্য্যা করে যেইজন।
বৃদ্ধের ভিতর তারে করয়ে গণন।।
প্রত্যক্ষে দেখহ কৃষ্ণা, ধর্ম্ম যাহা কৈল।
সপ্ত বৎসরের আয়ু মার্কণ্ডের ছিল।।
ধর্ম্মবলে সপ্ত কল্প জীয়ে মুনিরাজ।
আর যত দেখ মুনি ঋষির সমাজ।।
মুখে যাহা কহে, তাহা হয় সেইক্ষণে।
ধর্ম্মবলে ভ্রমিবারে পারে ত্রিভুবনে।।
ইন্দ্র চন্দ্র নক্ষত্রাদি যত স্বর্গবাসী।
ধর্ম্ম আচরিয়া সবে স্বর্গমধ্যে বসি।।
তপ জপ যজ্ঞ দান ব্রত শ্রেষ্ঠাচার।
বাঞ্ছা না করিলে নাহি ফল পায় তার।।
আমারে বলিলে তুমি সদা কর ধর্ম্ম।
আজন্ম আমার দেবি সহজ এ কর্ম্ম।।
পূর্ব্বে সাধুগণ সব গেল যেই পথে।
মম চিত্ত বিচলিত না হয় তাহাতে।।
তুমি বল, বনে ধর্ম্ম করিবে কেমনে।
যথাশক্তি তত আমি করিব কাননে।।
অন্য পাপ কৈলে প্রায়শ্চিত্ত আছে তার।
ধর্ম্মনিন্দা কৈলে প্রায়শ্চিত্ত নাহি আর।।
হর্ত্তা কর্ত্তা ধাতা যেই সবার ঈশ্বর।
যাঁহার সৃজন এই যত চরাচর।।
আমি ‍কোন্ জন তারে অমান্য করিতে।
ভ্রম নাহি আমার ইহাতে কোন মতে।।
মহাভারতের কথা সুধার সাগর।
কাশীদাস কহে, সদা শুনে সাধুর নর।।
২৯. যুধিষ্ঠিরের প্রতি দ্রৌপদীর উক্তি
দ্রৌপদী বলেন, রাজা কর অবধান।
আর কিছু নিবেদন আছে তব স্থান।।
পূর্ব্বে শুনিয়াছি আমি জনকের গৃহে।
দ্বিজ এক বৈল ইন্দ্র গুরু যাহা কহে।।
সংসারেতে যত লোক কর্ম্মভোগ করে।
কর্ম্ম অনুসারে ধাতা ফল দেয় তারে।।
সে কারণে কর্ম্ম রাজা অবশ্য কর্ত্তব্য।
কর্ম্ম না করিলে কোথা হতে হয় লভ্য।।
কর্ম্ম নাহি করিলে স্থাবর মধ্যে গণি।
স্থাবরের শক্তি কর্ম্ম নাহি নৃপমণি।।
পশু পক্ষী আদি যত কৃতকর্ম্ম ভুঞ্জে।
কর্ম্মে বাধ্য সবে তবু বিধাতারে গঞ্জে।।
মাতৃ স্তন্যপান হতে কর্ম্মেতে প্রবেশে।
ফলে বা না ফলে কর্ম্ম, করে ফল আশে।।
কর্ম্ম নাহি করে, আর গৃহে বসি খায়।
সমুদ্র প্রমাণ দ্রব্য থাকিলে যে যায়।।
কোন কোন জন দ্রব্য পায় আচম্বিতে।
বিনাকর্ম্মে নহে সেই পূর্ব্ব কর্ম্মার্জ্জিতে।।
যে জন যেমত করে শুভাশুভ কর্ম্ম।
বিধাতা তাহার ফল দেন জন্ম জন্ম।।
বান্ধিয়া ভুঞ্জায় ধাতা কর্ম্মেতে থাকিলে।
কাষ্ঠ হেতে অগ্নি যেন, তৈল হয় তিলে।।
বিবিধ প্রকার কর্ম্ম করয়ে সংসারে।
কর্ম্ম অনুসারে ফল না হয় তাহারে।।
পূর্ব্বে লোক যে করিল অবশ্য করিবে।
ভক্ষ্য পান শয়নাদি আলস্য ত্যজিবে।।
এত যে নৃপতি কর্ম্ম করিলে এখন।
ইথে কোন ফলসিদ্ধি করিবে রাজন।।
এই চারি ভাই তব কর্ম্মে ন্যূন নয়।
এই সবাকারে কর্ম্ম করিলে কি হয়।।
তোমার কর্ম্মেতে চারি ভাই অনুগত।
এ সব কৃষক, তুমি জলধর মত।।
চষিয়া কৃষক যেন বীজ তায় ফেলে।
জল বিনা শস্য তায় কিছু নাহি ফলে।।
বিধির সৃজন আর কহে মুনিগণ।
যার যেবা ধর্ম্ম তাহা করিবে পালন।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।
৩০. যুধিষ্ঠিরের প্রতি ভীমের উক্তি
দ্রৌপদীর বাক্য শুনি ভীম ক্রুদ্ধতর।
করেন ধর্ম্মের প্রতি কর্কশ উত্তর।।
শুন মহারাজ আমি করি নিবেদন।
বীর পুরুষের ধর্ম্ম ত্যজ কি কারণ।।
ক্ষত্রিয় প্রধান ধর্ম্ম তেজ দেখাইবে।
ভুজবলে রিপু জিনি পৃথিবী ভুঞ্জিবে।।
পর রাজ্যে আছ তুমি নিজ রাজ্য ত্যজি।
কি কর্ম্ম করিবে বনে তরুগণ ভজি।।
তুমি ত স্থাপিলে রাজ্য, লইল সে জিনি।
কোন্ ধর্ম্মবলে নিল, কহ দেখি শুনি।।
দ্যূতপণে নিল কিবা বলিষ্ঠ তোমায়।
অধর্ম্মে নিলেক রাজ্য কপট পাশায়।।
লেশমাত্র ধর্ম্মে তব ছন্ন হৈল জ্ঞান।
শ্রেষ্ঠ ধর্ম্মে নৃপতি না কর অবধান।।
আমি জীত তোমার বিভবর অন্যে লয়।
সিংহ ভক্ষ্য মাংস যেন শৃগালেতে খায়।।
মম দ্রব্য লয়ে কেবা বাঁচয়ে মানুষে।
দিকপাল সহায় করিয়া যদি আইসে।।
কহ দেখি কোন রাজা করিছে সন্ন্যাস।
কেবা করে এই হীনকর্ম্ম বনবাস।।
তুমি যে করিলে ক্ষমা সেই দুষ্টজনে।
হীনশক্তি সে যে ভাবে তাই এলে বনে।।
ইহা হতে মৃত্যু শ্রেষ্ঠ হয় শতগুণে।
শত্রুগণ হাসে রাজা নাহি সহে প্রাণে।।
ধর্ম্ম হেন বুঝ রাজ তব আচরণ।
ধর্ম্ম নহে, ইহা বড় অধর্ম্ম গণন।।
ভার্য্যা অনুগত ভ্রাতৃ যাহে দুঃখী হয়।
হেন কর্ম্ম আচরণ কভু ভাল নয়।।
কুটুম্ব আত্নীয় জনে না করি পালন।
অনুব্রত কর্ম্ম করে সংসারী যে জন।।
পিতৃগণ নিন্দা করে, সেই পায় তাপ।
সেই দোষে হয় তার ব্রহ্মহত্যা পাপ।।
প্রথমে কামনা ধন, দ্বিতীয়ে অর্জ্জন।
তৃতীয়ে সঞ্চয় ধন, কহে মুনিগণ।।
ধন হতে ধর্ম্ম হয় যজ্ঞ দান পূজা।
তীর্থসেবি ভিজ্ঞায় কি ধর্ম্ম হবে রাজা।।
কহ রাজা এই কর্ম্ম সম্মত কাহার।
গোবিন্দের মত, কিংবা দ্রুপদরাজার।।
অর্জ্জুন সম্মতি কিবা করিল নৃপতি।
আমা আদি করি ইথে কাহার পীরিতি।।
ক্ষত্রধর্ম্ম নহে এই দ্বিজ আচরণ।
ক্ষত্রধর্ম্মে যুদ্ধে অরি করিবে নিধন।।
দুষ্টকর্ম্মা দুষ্টবুদ্ধি রাজা দুর্য্যোধন।
তাহারে মারিলে পাপ নাহিক রাজন।।
তাহারে মারিলে যদি কিছু পাপ হয়।
যজ্ঞ দান করিয়া খণ্ডাব মহাশয়।।
আজ্ঞা কর নরপতি প্রসন্ন হইয়া।
এক্ষণে পৃথিবী দিব শত্রুকে মারিয়া।।
ভারতের পুণ্যকথা শুনে পুণ্যবান।
কাশী কহে, সুখ নাহি ইহার সমান।।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র