শ্রীমদ্ভগবতগীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

ভগবান মধুসূদন কৃপাবিষ্ট, অশ্রুপূর্ণলোচন ও বিষন্নবদন অর্জুনকে বললেন, হে অর্জুন! এ বিষম সঙ্কটকালে অনার্যনোচিত, স্বর্গহানিকর, অকীর্তিকর চিত্তমলিনতা তোমার হৃদয়ে কোথা হতে আবির্ভূত হলো? হে কৌন্তেয়! এ সময়ে তোমার কাতর হওয়া উচিৎ নয়; ইহা তোমার মত বীরের উপযুক্ত নয়। হে পরন্তপ! তুমি হৃদয়ের ক্ষুদ্র ব্যক্তির উপযুক্ত এ দূর্বলতা পরিত্যাগ করে উত্থান কর।
অর্জুন বললেন, হে মধুসূধন! হে অরিসূধন! আমি কিভাবে পরম পূজনীয় ভীষ্ম ও দ্রোণের সহিত বাণের দ্বারা যুদ্ধ করব? মহাত্মা গুরুজনদিগকে বধ করা অপেক্ষা ভিক্ষালব্দ বস্তু ভোগ করা অনেক ভাল, যদি ইহলোকে ভিক্ষান্ন ভোজন করতে হয়, তাও শ্রেয়; গুরুজনগণকে বধ করলে ইহকালেই রক্তমাখা বিষয় বাসনা উপভোগ করতে হবে। বস্তুত, এ যুদ্ধে জয় লাভ বা পরাজয় কোনটি মঙ্গলকর আমি তা হৃদয়ঙ্গম করতে পারছিনা। যেহেতু যাদেরকে হত্যা করলে আমাদের আর জীবিত থাকতে ইচ্ছা করছে না, সেই ধৃতরাষ্ট্র তনয়গণ আজ সম্মুখে উপস্থিত হয়েছেন। কার্পন্যজনিত দুর্বলতার প্রভাবে আমার কর্তব্য সম্মন্ধে দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছি, তাই আপনাকে জিজ্ঞাসা করছি এখন আমার কি করা উচৎ যাতে আমার মঙ্গল হয়। আমি আপনার শিষ্য। আপনার শরণাগত। আমাকে আপনি উপদেশ দিন। যদি পৃথিবীতে অপ্রতিদ্বন্দ্ব সমৃদ্ধ রাজ্য লাভ হয় এমনি কি সুরলোকের আধিপত্য প্রাপ্ত হলেও আমার ইন্দ্রিগুলিকে পীড়া দিচ্ছে যে শোক তা দূর হবে না। সঞ্জয় বললেন- পরন্তপ গুড়াকেশ হৃষীকেশ গোবিন্দকে “আমি যুদ্ধ করব না” এ কথা বলে মৌনাবলম্বন করলেন। হে ভারত! তখন হৃষীকেশ সহাস্যবদনে উভয় সৈন্যদলের মধ্যবর্তীস্থানে বিষাদগ্রস্ত অর্জূনকে সম্মোধন করে বললেন“.হে অর্জুন! যাদের জন্য তোমার শোক করার কোন প্রয়োজন নেই , তুমি নিরর্থক তাদের জন্য শোক করে অবিবেকীর ন্যায় কাজ করছ। তুমি প্রাজ্ঞের মত কথা বলছ বস্তুত তোমাকে পন্ডিত বলে বোধ হচ্ছে না। কেননা পন্ডিতগণ মৃত বা জীবিত কারো জন্যেই শোক করে না। হে অর্জুন! ইহার পূর্বে কখনও যে আমি (স্বয়ং ভগবান) ছিলাম না তাও নহে, তুমিও যে ছিলে না তাও নহে, এ রাজাগণও যে ছিল না তাও নহে। বস্তুত: আমি, তুমি ও এ রাজন্যবর্গ সকলেই পূর্বে বিদ্যমান ছিলাম এবং ইহার পরে যে আমরা থাকব না তাও নহে; ফলত: আমরা সকলেই ভবিষ্যতে বিদ্যমান থাকব। জন্মের পর মানুষ যেমন কৌমার, যৌবন ও জরা প্রাপ্ত হয় সেরূপ দেহনাশ বা মৃত্যুর পর দেহান্তরপ্রাপ্তি হয় অর্থাৎ অপর দেহ লাভ করে। সে জন্য স্থিতপ্রজ্ঞ বা বুদ্ধিমান ব্যক্তি কারো মৃত্যুর জন্য কখনও মোহগ্রস্ত হন না বা শোক করেন না।
হে কৌন্তেয়! বিষয়ের সহিত ইন্দ্রিয়গণের সংযোগ ঘটিলে শীত, উষ্ণ ও সুখ দু:খের প্রভৃতির বোধ জন্মে, এ সকলের আরম্ভ ও শেষ আছে, সে কারণেই এ সকল অনুভূতি অনিত্য। হে ভারত! তুমি এ অনিত্য সম্বন্ধ সকল সহ্য করার চেষ্টা কর। হে পুরুষ শ্রেষ্ঠ! এ সম্বন্ধ সকল যাকে ব্যথিত করতে পারে না, সুখে-দু:খে যার সমানভাব, সে ধীর পুরুষ মোক্ষ লাভের যোগ্য। অনিত্য বস্তুর স্থায়িত্ব নেই অর্থাৎ আত্মাতে সত্তা নেই, নিত্য বস্তুর বিনাশ নেই; তত্ত্বদর্শি পুরুষগণ এরূপে সদসৎ (নিত্য ও অনিত্য) এ উভয়ের নিরূপণ করেছেন। যিনি (পরমাত্মা) এ দেহাদিতে ব্যাপ্ত হয়ে আছেন, তার কিছুতেই বিনাশ নেই; কোন ব্যক্তি সেই অব্যয় পুরুষকে (অক্ষয় পরমাত্মাকে) বিনাশ করতে সমর্থ হয় না। তত্ত্বদর্শী পন্ডিতগণ বলেছেন, আমাদের এ শরীর বা দেহ অনিত্য বা বিনাশীল কিন্ত দেহবাসী আত্মা নিত্য, অবিনাশী ও অপ্রমেয়। অতএব হে ভারত! তুমি যুদ্ধ কর। যিনি মনে করেন যে আত্মা কাউকে হত্যা করতে পারে, যিনি মনে করেন যে আত্মাকে কেউ হত্যা করতে পারে। তাঁরা উভয়েই অনভিজ্ঞ। কেননা জীবাত্মা কাউকে হত্যা করে না এবং জীবাত্মাকেও কেউ হত্যা করতে পারে না। আত্মার জন্ম নেই, মৃত্যু নেই, অথবা পুন: পুন: উৎপত্তি বা বৃদ্ধি হয় না। তিনি অজ (জন্মশূন্য), নিত্য (হ্রাসবৃদ্ধি হয় না), শাশ্বত (ক্ষয়হীন) ও পুরাণ (পরিণামশূন্য)। শরীর বিনষ্ট হলেও আত্মা কখনও বিনষ্ট হয় না। হে পার্থ! যিনি ইহাকে অবিনাশী, নিত্য,অজ ও অব্যয় বলে জানেন, তিনি কিভাবে কাউকে হত্যা করেন বা হত্যার আদেশ করতে পারেন? মানুষ যেমন বস্ত্র জীর্ণ বা পুরাতন হলে তা ছেড়ে নতুন বস্ত্র পরিধান করে সেরূপ আত্মা জীর্ণ শরীর ত্যাগ করে অন্য নতুন শরীর গ্রহণ করে। শস্ত্রসমূহ (অস্ত্রসমূহ) আত্মাকে ছেদন বা কাটতে পারে না, অগ্নি ইহাকে দগ্ধ করতে পারে না, জল ইহাকে আর্দ্র করতে পারে না ও বায়ু ইহাকে শুষ্ক করতে পারে না। আত্মা অচ্ছেদ্য, অদাহ্য, অক্লেদ্য, অশোষ্য, ইহা নিত্য, সর্বব্যাপী, শাখাহীনবৃক্ষের ন্যায় স্থির, অচল এবং সনাতন। আত্মা প্রকৃতই অব্যক্ত (চক্ষুরাদি জ্ঞানেন্দ্রিরে অবিষয়), অচিন্ত্য (মনের অগোচর), অবিকার্য (কর্মেন্দ্রিয়ের অবিষয়) ইহাই উক্ত হয়েছে। অতএব তুমি আত্মার এ স্বরূপ জেনে অনুশোচনা পরিত্যাগ কর। আর যদি তুমি জীবাত্মাকে জন্মরহিত ও অবিনাশী না মেনে আত্মা নিত্য জন্মগ্রহণ ও নিত্য মৃত্যুবরণ করে মনে কর তাহলেও হে মহাবাহো! ইহার জন্য তোমার শোক করা উচিৎ নয়। কারণ জন্ম হলে মৃত্যু অবশ্যই হবে এবং মৃত্যু হলে জীবদ্দশাকৃত কর্মফল অনুসারে আবার জন্ম হবেই হবে। অতএব অপরিহার্য্য বিষয়ে তোমার শোক করা উচৎ নয়। প্রাণীসমূহ জন্মের পূর্বে ও মৃত্যুর পরে অব্যক্ত অবস্থায় থাকে অর্থাৎ তারা কিভাবে থাকে তা প্রকাশ পায় না এবং কেহ তা জানে না, কেবল তাদের মধ্যাবস্থাই ব্যক্ত অর্থাৎ যতদিন তারা জীবিত থাকে ততদিনের বিষয়ই আমরা জানতে পারি। অতএব মৃত্যুর পরবর্তী অজ্ঞাত অবস্থার জন্য কিসের শোক? কেহ জীবাত্মাকে আশ্চর্যের সহিত দর্শন করেন, কেহ জীবাত্মাকে আশ্চর্যভাবে বর্ণনা করেন, অন্য কেহ আশ্চর্যের সহিত তা শ্রবণ করেন, কিন্তু আত্মার বর্ণনা শ্রবণ করেও কেহই তাকে জানতে পারে না। হে ভারত! এ নিত্য অবধ্য আত্মা যে কোন দেহেই থাকুন না কেন, তা সর্বকালেই অবধ্য বা অবিনাশীরূপে অবস্থান করে; অতএব পৃথিবীর যাবতীয় প্রাণির মধ্যে কারোও দেহনাশের জন্যেই তোমার শোক করা উচৎ নয়।
আর স্বধর্মের দিকে দৃষ্টিপাত করলেও তোমার বিচলিত হওয়া উচৎ নয়, কারণ তুমি ক্ষত্রিয়, ক্ষত্রিয়ের পক্ষে যে যুদ্ধে ধর্মলাভ হয় তার তুলনায় অন্য কিছুই অধিক মঙ্গলকর নয় এবং সেরূপ যুদ্ধই আজ স্বর্গদ্বার উন্মুক্ত করে আপনা হতেই উপস্থিত হয়েছে। হে অর্জুন! যে সকল ক্ষত্রিয় সৌভাগ্যবান তাঁরাই এ প্রকার যুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ পান। আর এখন যদি তুমি এ ধর্মযুদ্ধ না কর তবে স্বধর্মচ্যুত হবে, কীর্তি হারাবে এবং পাপভাগী হবে এবং লোকেরা (দেব,ঋষি ও মনুষ্যগণ) চিরকাল তোমার অকীর্তি ঘোষণা করবে। তোমার মত সম্মানিত ব্যক্তির পক্ষে অকীর্তি মরণ অপেক্ষাও অধিকতর দু:সহ। যে সকল মহারথীগণ তোমাকে বহু সম্মান করে থাকেন, তাঁরাও তোমাকে আর সম্মান করবে না, কেন না তুমি যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করলেই তাঁরা মনে করবে যে তুমি ভয় পেয়ে যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করেছ। আর এ সুযোগে তোমার শত্রুরা তোমার সামর্থ্যের নিন্দা করে বহু অকথ্য কথা বলবে, ইহা অপেক্ষা আর কি অধিকতর দু:খ হতে পারে? যদি এ যুদ্ধে তোমার মৃত্যু হয় তাহলে স্বর্গবাসী হবে আর যদি বিজয় লাভ করতে পার তাহলে সসাগরা (পৃথিবী) ভোগ করতে পারবে। অতএব হে কৌন্তেয়! যুদ্ধের জন্য মনস্থির করে উঠে দাঁড়াও। সুখু দু:খ, লাভ অলাভ এবং জয় পরাজয়কে সমান জ্ঞান করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও, এতে তোমার কোন পাপ হবে না।
হে পার্থ! যে বুদ্ধির (জ্ঞানদ্বারা) দ্বারা আত্মতত্ত্ব বা আত্মতত্ত্ববিষয়ক জ্ঞান সম্যকরূপে জানতে পারা যায় সে বুদ্ধির কথা এতক্ষণ তোমাকে বললাম কিন্তু এখন যোগমতে সেই বুদ্ধির কথা শ্রবণ কর, যে বুদ্ধি অবলম্বন করলে তুমি যুদ্ধ করেও কর্মবন্ধন হতে মুক্ত হতে পারবে। আমি এখন তোমাকে যে ধর্ম বা সাংসারিক জীবনযাত্রা বিধির কথা বলল তার কালক্রমে ফলক্ষয় হেতু বার বার আরম্ভের আবশ্যকতা নেই বা অনুষ্ঠানের দোষে সমুদয় ফলহানির কিংবা পাপের সম্ভাবনা নেই। যাগযজ্ঞাদির ফল ক্ষয় হলে স্বর্গ হতে পতন হয় ও অনুষ্ঠানের ক্রটিতে যাগযজ্ঞাদি সম্পূর্ণ বিফল হয় কিন্তু এ ধর্ম সেরূপ নয়। ইহার যৎকিঞ্চিৎ অনুষ্ঠানও অনুষ্ঠাতাকে মহাভয় হতে রক্ষা করে। হে কুরুনন্দন! এ নিষ্কাম কর্মযোগ মতে চললে বুদ্ধি ব্যবসায়াত্মিকা ও একমার্গী হয় অর্থাৎ কি করতে হবে তা নিশ্চিত ও দৃঢ়রূপে বুঝা যায় ও সেই এক উদ্দেশ্যেই সমস্ত চেষ্টা নিয়োজিত হয় কিন্তু অব্যবসায়ীদের (সকামকর্মীদের) বুদ্ধি বহুশাখাবিশিষ্ট ও অশেষ প্রকারের অর্থাৎ তা নানা পথে নিয়ে যায়। হে পার্থ! অবিবেকী পুরুষগণ বেদোক্ত কর্মের প্রশংসায় অনুরক্ত। স্বার্গাদিফলজনক কর্ম ব্যতীত অন্য কিছুই নেই -তারা এরূপ বিশ্বাস করেন। তারা কামনাযুক্ত ও স্বর্গকামী। তারা জন্মরূপ কর্মফলপ্রদানকারী এবং ভোগপ্রাপ্তি ও ঐশ্বর্যলাভের উপযোগী বহু ক্রিয়াকলাপের প্রংশসা করে থাকেন। যাদের চিত্ত সে সকল পুষ্পিত (আপতত: মনোরম) বাক্যে বিমুগ্ধ এবং ভোগ ও ঐশ্বর্যে, তাদের অন্ত:করণে পূর্বশ্লোকোক্ত নিশ্চয়াত্মিকা শুদ্ধা বুদ্ধি (বিবেকপ্রজ্ঞা) স্থির হয় না। বেদ ত্রিগুণবিষয়ক এবং যতক্ষণ ত্রিগুণ আছে ততক্ষণ শোক তাপের হাত হতে উদ্ধার নেই। অতএব তুমি বেদের কথা ছেড়ে দিয়ে ত্রিগুণাতীত হও। ত্রিগুণাতীত হতে হলে তুমি নির্দ্বন্দ্ব অর্থাৎ রাগদ্বেষ, সুখ-দু:খ ও শীতোষ্ণাদিরূপ যে দ্বন্দ্ব, নির্যোগক্ষেম অর্থাৎ অপ্রাপ্ত বস্তুর প্রাপ্তির ইচ্ছারূপ যে যোগ ও প্রাপ্ত বস্তুর রক্ষাকরণরূপ যে ক্ষেম, তার অতীত ও নিত্যসত্ত্বস্থ অর্থাৎ নিত্য সত্ত্বগুণে প্রতিষ্ঠিত ও আত্মজ্ঞানবান হও। যেমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলাশয়ে যে সমস্ত প্রয়োজন সাধিত হয়, সেগুলি মহাহ্রদ বা বিশাল জলাশয় থেকে আপনা হতেই সাধিত হয়ে যায়। তেমনি ভগবানের উপাসনার মাধ্যমে যিনি ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করে সব কিছুর উদ্দেশ্য উপলদ্ধি করতে পেরেছেন, সেই ব্রহ্মজ্ঞানলব্দ পুরুষের নিকট বেদের সমস্ত উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে। (সহজ ভাষায় বলতে গেলে সর্বত্র জলপ্লাবিত হলে কূপের যেমন আবশ্যকতা থাকে না তেমনি ভগবানের উপদেশ মত চলে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হলে বেদের আবশ্যকতা থাকে না।)
কর্মেই (নিষ্কাম কর্মেই) তোমার অধিকার আছে, কিন্ত কর্মফলে কোনও সময় তোমার অধিকার নেই। অতএব কর্ম কর। কিন্ত কর্মফলে যেন কখনও তোমার আসক্তি না হয়; কারণ কর্মফলের তৃষ্ণাই কর্মফল প্রাপ্তির হেতু হয়। সুতরাং কর্মফল প্রাপ্তির হেতু হয়ো না অর্থাৎ কর্মফলের আশায় কর্ম করো না। আবার কর্ম করিব না এমন আগ্রহও যেন তোমার না হয়। হে ধনঞ্জয়! যোগস্থ হয়ে তুমি ফলকামনা পরিত্যাগপূর্বক একান্ত ঈশ্বরপরায়ণ হয়ে সাফল্য ও অসাফল্যর দিকে নির্বিকার থেকে কর্মের অনুষ্ঠান কর। ফলাফলে চিত্তের সমত্ব বুদ্ধি বা নির্বিকার ভাবকেই যোগ বলা। হে ধনঞ্জয়! কাম্য কর্ম (সকাম কর্ম) নিষ্কাম কর্ম অপেক্ষা অত্যন্ত নিকৃষ্ট। অতএব তুমি কামনাশূন্য হয়ে সমত্ব-বুদ্ধিযোগে নিষ্কাম কর্মের আশ্রয় গ্রহণ কর। যারা ফলাকাঙ্খী হয়ে কর্ম করে তারা কৃপণ। বুদ্ধিযোগনিষ্ঠ ব্যক্তি ইহকালে পাপ ও পূণ্য উভয়ই থেকেই মুক্ত হন। সুতরাং তুমি নিষ্কাম কর্মযোগের অনুষ্ঠান কর। যোগ আর কিছুই নয় উপযুক্তভাবে কর্ম করার কৌশল মাত্র।
নিষ্কাম কর্মযোগী মনীষিগণ কর্মজাত ফল ত্যাগ করে জন্মরূপ বন্ধন হতে মুক্ত হন এবং সর্বপ্রকার উপদ্রবরহিত (সংসার স্পর্শশূন্য) ব্রহ্মপদ লাভ করেন। যখন তোমার বুদ্ধি মোহাত্মক অবিবেকরূপ কলুষ হতে মুক্ত হবে তখন তুমি যা কিছু শুনেছ বা যা কিছু শুনবে ( শ্রোতব্য ও শ্রুত) সকল বিষয়েই নির্বেদ (বৈরাগ্য) অর্থাৎ সুখদু:খ বোধহীন হবে। তোমার বুদ্ধি নানাপ্রকার বৈদিক ও লৌকিক বিষয় শ্রবণে সংশয়ান্বিত হয়েছে। যখন এ বুদ্ধি পরমাত্মাতে স্থির ও নিশ্চল হবে, তখন তুমি তত্ত্বজ্ঞান লাভ করবে।
অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন হে কেশব! স্থিতপ্রজ্ঞ অর্থাৎ অচলা বু্দ্ধিসম্পন্ন মানুষের লক্ষণ কি? তিনি কিভাবে কথা বলেন, কিভাবে অবস্থান করেন এবং কিভাবেই বা তিনি বিচরণ করেন? ভগবান বললেন- হে পার্থ! যার মনোগত সমস্ত কামনার বিষয় পরিত্যাগ হয়েছে এবং যার আত্মা আত্মাতেই সন্তষ্ট থাকে, সেই সময়েই তিনি স্থিতপ্রজ্ঞ নামে কথিত হন। ত্রিতাপ দু:খের মধ্যেও যার চিত্ত উদ্বিগ্ন হয় না, বিষয় সুখে নিস্পৃহ এবং যার রাগ, ভয় ও ক্রোধ নিবৃত্ত হয়েছে সেই মননশীল পুরুষ স্থিতপ্রজ্ঞ। যিনি সকল বস্তু ও ব্যক্তিতে স্নেহবর্জিত এবং প্রিয় বা অপ্রিয় বিষয় প্রাপ্তিতে যিনি প্রশংসা বা দ্বেষ করেন না, তিনি স্থিতপ্রজ্ঞ। কচ্ছপ যেমন নিজের অঙ্গ-প্রত্যাঙ্গাদি শরীরের মধ্যে গুটিয়ে রেখে শত্রুর হাত হতে নিজেকে রক্ষা করে তেমনি যিনি ইন্দ্রিয় সকলকে বিষয় হতে গুটিয়ে নিতে পারেন, সেই সময়ে তার প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত হয় অর্থাৎ তখন তিনি স্থিতপ্রজ্ঞ। বিষয় গ্রহণে আতুর ব্যক্তি বা বিষয়াসক্ত কঠোর তপস্বী ইন্দ্রিয় বিষয় হতে নিবৃত্ত হয় বটে, কিন্তু তবুও ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের আসক্তি থেকে যায়। আর পরমত্মার দর্শন হলে বিষয় ও বিষয়তৃষ্ণা উভয়েই চিরতরে চলে যায়। হে কৌন্তেয়! বলবান ইন্দ্রিয়গণ অতিযত্নশীল মেধাবী (শাস্ত্রজ্ঞ) পুরুষদের মনকেও বলপূর্বক বিষয়াভিমুখে আকর্ষণ করে। এ সকল ইন্দ্রিয়কে সংযত করে যে নিজবশে রাখতে পারে ও যোগযুক্ত ও মৎপরায়ণ হতে পারে, তারই প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অর্থাৎ তিনি স্থিতপ্রজ্ঞ। ইন্দ্রিয়জাত বিষয়সমূহ সম্মন্ধে চিন্তা করতে করতে মানুষের মনে আসক্তি জন্মে। আসক্তি হতে কামনা (তৃষ্ণা) উৎপন্ন হয় কামনা হতে (যদি কামনা বাঁধাগ্রস্থ হয় তবে) ক্রোধ জন্মে। আর ক্রোধ হতে সম্মোহ (স্মৃতিলোপ), সম্মোহ হতে স্মৃতিবিভ্রম (আত্মবিস্মৃতি), স্মৃতিবিভ্রম হতে বুদ্ধিনাশ হয় আর বুদ্ধিনাশ হওয়ার ফলে সর্বনাশ হয়। যিনি বিধেয়াত্মা (আত্মাকে বশীভূত করেছেন), তিনি রাগদ্বেষ হতে মুক্ত এবং ইন্দ্রিয়ের দ্বারা বিষয়ে বিচরণ করেও আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। এরূপ প্রসাদ লাভ করলে সমস্ত দু:খ দূর হয় ও বিশুদ্ধচিত্ত ব্যক্তির বুদ্ধি শ্রীঘ্রই আত্মাতে প্রতিষ্ঠিত হয়। অজিতেন্দ্রিয় ব্যক্তির আত্মবিষয়ণী বুদ্ধি নেই, তার চিন্তাও নেই। আর পারমার্থ চিন্তাশূন্য ব্যক্তির বিষয়তৃষ্ণার বিরতি নেই। এরূপ বিষয়তৃষ্ণা পুরুষের প্রকৃত সুখ কোথায়? জলের উপর ভাসমান নৌকাকে প্রতিকূল বায়ু যেমন বিচলিত করে তেমনি স্ব স্ব বিষয়ে ধাবমান ইন্দ্রিয়গণের যেটিকে মন অনুসরণ করে সেই ইন্দ্রিয়টিই অসংযত ব্যক্তির প্রজ্ঞা হরণ করে এবং তার মনকে বিষয়াভিমুখী করে। হে মহাবাহো! যাঁর সমস্ত ইন্দ্রিয় নিজ নিজ বিষয় হতে সর্বপ্রকার নিবৃত্ত হয়েছে, তিনিই স্থিরবুদ্ধি ও দৃঢ়প্রজ্ঞ। সর্বভূতের পক্ষে অর্থাৎ সাধারণ লোকের পক্ষে যা রাত্রিস্বরূপ সেই রাত্রিতে স্থিতপ্রজ্ঞ জাগ্রত থাকেন (সর্বদা ব্রহ্মদর্শন করেন)। কিন্তু আত্মা সাধারণ লোকের কাছে অন্ধকারে নিহিত থাকে। আর অজ্ঞানরূপ রাত্রিতে সাধারণগণ জাগ্রত থাকেন (সংসার দর্শন করেন) স্থিতপ্রজ্ঞের কাছে তা রাত্রিস্বরূপ অর্থাৎ তিনি সংসার দর্শন করেন না। যেমন শত শত নদ নদীর জল পরিপূর্ণ সমুদ্রে প্রবেশ করলেও সমুদ্র স্ফীত হয় না (উপচিয়ে পড়ে না) এবং বেলাভূমি অতিক্রম করে না, সেরূপ কামসমূহ অর্থাৎ ভোগ্যবস্তু অর্থাৎ তৎসংক্রান্ত প্রত্যয় যে ব্যক্তির মধ্যে প্রবেশ করে বিলীন হয় অর্থাৎ যাকে বিচলিত করতে পারে না।, তিনিই চিরশান্তি লাভ করেন। কিন্তু ভোগার্থ (কামাসক্ত) ব্যক্তি তা লাভ করতে পারে না। যিনি কামনাসমূহ পরিত্যাগপূর্বক নিস্পৃহ, নিরহঙ্কার ও মমতাহীন হয়ে সংসারে বিচরণ করেন, সেই স্থিতপ্রজ্ঞ পুরুষই শান্তি লাভ করেন। হে পার্থ! এ অবস্থাই “ব্রাহ্মী স্থিতি”(ব্রহ্মনিষ্ঠ অবস্থা) । এ অবস্থা লাভ করলে কেহ আর সংসার মায়ায় মোহগ্রস্ত হন না। মৃত্যুকালেও যিনি (ক্ষণকালের জন্য) এ অবস্থায় স্থিতি করেন, তিনি ব্রহ্মনির্বাণ লাভ করেন।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র