মহাভারত:আদিপর্ব ১৩২-১৩৬

১৩২. দুর্য্যোধনের কন্যা লক্ষ্মণার স্বয়ন্বর
মুনি বলে, অবধান কর নরবর।
দুর্য্যোধন নৃপতির কন্যা-স্বয়ম্বর।।
ভানুমতি-গর্ভে জন্ম একই দুহিতা।
রূপে গুণে অনুপমা সর্ব্ব গুণযুতা।।
ভুবনমোহিনী সুলক্ষণা-বিভূষণা।
সে কারণে নাম তার রাখিল লক্ষ্মণা।।
যুবতী হইল কন্যা, দেখি নরবর।
হৃদয়ে চিন্তিয়া তবে কৈল স্বয়ম্বর।।
নিমন্ত্রিয়া আনাইল যত রাজগণে।
পৃথিবীতে নিবাস আছিল যে যে স্থানে।।
আইল যতেক রাজা, কত লব নাম।
রূপবন্ত গুণবন্ত কুলে অনুপাম।।
রথ গজ অশ্ব দেখি না হয় গণনে।
বিবিধ বাদ্যের শব্দে না শুনি শ্রবণে।।
ধ্বজ ছত্র পতাকায় ঢাকিল মেদিনী।
চরণধূলিতে আচ্ছাদিল দিনমণি।।
সবাকারে দুর্য্যোধন করিল সম্মান।
বসিল নৃপতিগণ যার যেই স্থান।।
নারদের মুখে বার্ত্তা পেয়ে শাম্ব বীর।
শুনিয়া কন্যার রূপ হইল অস্থির।।
একেশ্বর রথে চড়ি করিল গমন।
কিমতে পাইব কন্যা, চিন্তে মনে মন।।
অলক্ষিতে একান্তে রহিল রথোপরে।
হেনকালে বাহির করিল লক্ষ্মণারে।।
অনুপম রূপ তার জিনি শরদিন্দু।
ঝলমল কুণ্ডল কমল-প্রিয়-বন্ধু।।
সম্পূর্ণ মিহির জিনি অধর রঙ্গিমা।
ভ্রূতঙ্গ-অনঙ্গ চাপ জিনিয়া ভঙ্গিমা।।
খঞ্জন গঞ্জন চক্ষু অঞ্জনে রঞ্জিত।
শুকচক্ষু নাসা, শ্রুতি গৃধিনী নিন্দিত।।
বিপুল নিতম্ব, গতি জিনিয়া মরাল।
চরণে কিঙ্গিণী আর নূপুর রসাল।।
নির্ধূমাগ্নি-শিখা যেন রচিলা বিদ্যুতে।
বালসূর্য্য উদয় হিইল পূর্ব্বভিতে।।
দৃষ্টিমাত্রে রাজগণ হারায় চেতন।
দেখি জাম্ববতী-সুতে পীড়িল মদন।।
শীঘ্রগতি ধরি হাতে তুলিলেন রথে।
চালাইয়া দিল রথ দ্বারকার পথে।।
ধর ধর বলিয়া ধাইল সেনা সব।
নানা অস্ত্র লৈয়া ধায় যতেক কৌরব।।
কৃষ্ণের নন্দন শাম্ব কৃষ্ণের সমান।
টঙ্কারিয়া ধনুর্গুণ এড়ে দিব্য বাণ।।
কাটিল অনেক সৈন্য চক্ষুর নিমিষে।
নাহিক ভ্রূক্ষেপ, বীর যুঝে অনায়াসে।।
হস্তী অশ্ব রথ রথী পড়ে সারি সারি।
যতেক মারিল যুদ্ধে বলিতে না পারি।।
ভয়েতে সম্মুখে তার কেহ নাহি রয়।
ক্রোধে আগু হৈয়া বলে সূর্য্যের তনয়।।
বালক হইয়া তোর এত অহঙ্কার।
কন্যা হরি লৈয়া যাস্ অগ্রেতে আমার।।
প্রতিফল ইহার পাইবি এইক্ষণে।
এত বলি কর্ণ বীর এড়ে অস্ত্রগণে।।
ইন্দ্রজাল অস্ত্রে এড়ে সূর্য্যের নন্দন।
নিবারিতে নারে শাম্ব পড়িল বন্ধন।।
ধরিল ধরিল চোর বলি শব্দ হৈল।
কাট লৈয়া, বলিয়া নৃপতি আজ্ঞা দিল।।
আমা লঙ্ঘে এই চোর আমার অগ্রেতে।
দক্ষিণ মশানে লৈয়া কাট মূঢ়-সুতে।।
নৃপতির আজ্ঞা পেয়ে ধায় দুঃশাসন।
অনেক মারিয়া তবে করিল বন্ধন।।
কর্ণ প্রতি জিজ্ঞাসিল রাজা দুর্য্যোধন।
চিনিলা কি এই চোর, কাহার নন্দন।।
কর্ণ বলে, মহারাজ এত গর্ব্ব কার।
চোর-পুত্র বিনা চুরি কে করিবে আর।।
শুনি দুর্য্যোধনের কাঁপিছে কলেবর।
কড়মড় দশনে কচালে করে কর।।
গোকুলেতে বাড়িল গোপের অন্ন খাইয়া।
ক্ষত্রকুলে কেহ কন্যা নাহি দেয় বিয়া।।
চুরি করি সব ঠাঁই এত মত লয়।
সহজে চোরের জাতি, কিবা লাজ ভয়।।
সর্ব্বত্র করিয়া চুরি বাড়িয়াছে মন।
নাহি জানে দুরন্ত এ যমের সদন।।
সভাতে এমত লজ্জা দিলেক আমায়।
কাট লৈয়া চোরেরে বিলম্ব না যুয়ায়।।
এতেক বলিল যদি রাজা দুর্য্যোধন।
কে চোর বলিয়া বলে ধর্ম্মের নন্দন।।
দুর্য্যোধন বলে, যুধিষ্ঠির মহারাজ।
তোমার কি অগোচর সেই চোর-রাজ।।
ভাই ভাই বলি যারে বলহ আপনি।
গোকুলে করিল চুরি গোকুল-কামিনী।।
বিদর্ভে করিল চুরি ভীষ্মক-দুহিতা।
পুত্র কাম কৈল চুরি বজ্রনাভ-সুতা।।
পৌত্র করিলেক চুরি বাণের নন্দিনী।
এ তিন পুরুষে চোর বিখ্যাত ধরণী।।
শুনিয়া বিষণ্ন মুখ হৈল ধর্ম্মরাজ।
কৃষ্ণ-নিন্দা শুনিয়া দুঃখিত হৃদিমাঝ।।
ধর্ম্ম বলিলেন, ভাই না হয় উচিত।
গোবিন্দের নিন্দা করা সবার বিদিত।।
যে পারে করিতে চুরি সেই করে চুরি।
কাহার শক্তিতে কৃষ্ণে কি করিতে পারি।।
দুর্য্যোধন বলে, ভাল বল ধর্ম্মরাজ।
যাহা হৈতে আমার ভুবনে হৈল লাজ।।
মোর কন্যা চুরি করি লয় দুরাচার।
তারে নিন্দা করিতে এ উত্তর তোমার।।
যুধিষ্ঠির কহে, কন্যা কে করিল চুরি।
আন যদি তাহারে চিনিতে যদি পারি।।
দুর্য্যোধন বলেষ চোরে, কোন্ কার্য্য হেথা।
যে কেহ হউক শীগ্র কাট তার মাথা।।
যুধিষ্ঠির বলে, যদি কৃষ্ণের নন্দন।
তার বধে ভাল কি হইবে দুর্য্যোধন।।
কৃষ্ণ বৈরী হৈলে ভাই, রক্ষা আছে কার।
কুরুকুলে বাতি দিতে না রাখিবে আর।।
ইন্দ্র যম বরুণ কুবের পঞ্চানন।
কৃষ্ণ ক্রোধ করিলে রাখিবে কোন্ জন।।
দুর্য্যোধন বলে, যদি তুমি ডরাইলে।
ইন্দ্রপ্রস্থে যাহ প্রাণ লৈয়া এই কালে।।
এখনি শরণ গিয়া লহ কৃষ্ণ ঠাঁই।
মারিব দুষ্টেরে আমি কারে না ডরাই।।
দুর্য্যোধন-বাক্য যে শুনিয়া বৃকোদর।
পাইয়া জ্যেষ্ঠের আজ্ঞা ধাইল সত্বর।।
মশানেতে দুঃশাসন ধরি শাম্ব-চুলে।
কাটিবারে হস্তেবীর খড়্গ চর্ম্ম তোলে।।
বায়ুবেগে বৃকোদর উত্তরিল গিয়া।
হাত হৈতে খড়গ চর্ম্ম লইল কাড়িয়া।।
তাহারে বলিল, তোর কিমত বিচার।
কাটিবারে আনিয়াছ কৃষ্ণের কুমার।।
ধর্ম্মরাজ আজ্ঞা কৈল লইতে বাহুড়ি।
এত বলি ছিঁড়িল সে বন্ধনের দড়ি।।
হাতে ধরি কোলে করি লইল শাম্বেরে।
শাম্বে দেখি যুধিষ্ঠির কহেন সাদরে।।
জাম্ববতী-নন্দন হে বৎসল আমার।
চুম্বিয়া নিলেন কোলে ধর্ম্মের কুমার।।
দেখি ক্রোধে দুর্য্যোধন কাঁপে থর থরে।
দেখ দেখ বলিয়া বলয়ে সবাকারে।।
দেখ ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ আপন বিদিত।
নিরন্তর কহ যে পাণ্ডব তব হিত।।
কুলের কলঙ্ক যে অধম দুরাচার।
হেন জনে মারিতে সহায় হৈল তার।।
যুধিষ্ঠির বলে, ভাই দেখ দুর্য্যোধন।
এ রূপ এ সভামধ্যে আছে কোন্ জন।।
যদু মহাকুলে জন্ম কৃষ্ণের কুমার।
কৃষ্ণ-পুত্রে দিব কন্যা কুলের আমার।।
ইহারে না দিয়া কন্যা আর কারে দিবে।
বরপূর্ব্বা হৈল কন্যা কলঙ্ক হইবে।।
কে আর করিবে বিভা পৃথিবী-মণ্ডলে।
সভাতে দেখিল, শাম্বে করিলেন কোলে।।
দুর্য্যোধন, বলিল, তোমার নাহি দায়।
এইমত গৃহে পাছে রাখিব কন্যায়।।
মারিব দুষ্টেরে, তুমি ছাড় শীঘ্রগতি।
ভীম বলে, দুর্য্যোধন হৈলে ছন্ন-মতি।।
কি দেখিয়া এত গর্ব্ব হইল তোমার।
কৃষ্ণ-পুত্রে মারিবা যে অগ্রেতে আমার।।
কে আসে আসুক দেখি তাহার বদন।
গদাঘাতে পাঠাইব যমের সদন।।
এত বলি গদা লৈয়া বীর বৃকোদর।
চক্র-চক্রী প্রায় ফিরে মস্তক উপর।।
ভীমের বচন শুনি দুর্য্যোধন ক্রোধে।
কাড়ি লহ বলি আজ্ঞা দিল সব যোধে।।
দুর্য্যোধন-আজ্ঞাতে যতেক সহোদর।
হাতে গদা করি সবে ধাইল সত্বর।।
ব্যাঘ্রের সম্মুখে যেতে ছাগে যেন শঙ্কা।
দেখি ধায় বৃকোদর সদা রণরঙ্গা।।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ কহে থাকি মধ্যস্থানে।
আপনা আপনি তাত দ্বন্দ্ব কর কোনে।।
বন্দি করি রাখ শাম্বে আমার গৃহেতে।
বুঝিয়া ইহার দণ্ড করিহ পশ্চাতে।।
দুর্য্যোধনে বলে তাত কৃষ্ণের এ সুত।
শ্রুত মাত্র যদুবলে আসিবে অচ্যুত।।
ইহারে এক্ষণে যদি প্রাণেতে মারিবে।
গোবিন্দ করিলে ক্রোধ অনর্থ হইবে।।
যুদ্ধ করি গোবিন্দে করিব পরাজয়।
তবেত মারিবে এরে, ঘরেতে আছয়।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন, ভাল ভাল বলি।
দুর্য্যোধন বলে, দেহ চরণে শিকলি।।
চরণে নিগড় দিয়া নিল গঙ্গা-সুত।
নিজ নিজ গৃহে সবে যাইল ত্বরিত।।
মহাভারতের কথা ভুবনে অতুল।
কাশী কহে, ব্যাসের এ কীর্ত্তি নাহি তুল।।
১৩৩. শাম্বের বন্ধন সংবাদ লইয়া নারদের গমন
বন্ধনে রহিল শাম্ব কৃষ্ণের নন্দন।
বার্ত্তা দিতে চলেন নারদ তপোধন।।
কহেন গোবিন্দ প্রতি গদ গদ কথা।
শুনহ গোবিন্দ, শাম্ব পুত্রের বারতা।।
দুর্য্যোধন-দুহিতার স্বয়ম্বর-কালে।
স্বয়ম্বর-স্থানে তার শাম্ব হরি নিলে।।
যুদ্ধ করি বন্দী তারে কৈল ইন্দ্রজালে।
কতেক কহিব দেব যতেক মারিলে।।
কাটিতে লইয়া গেল দক্ষিণ মশানে।
যুধিষ্ঠির রাখিলেন দিয়া ভীমসেনে।।
অনেক করিল দ্বন্দ্ব তাহার সহিতে।
বদ্ধ করি রাখিয়াছে ভীষ্মের গৃহেতে।।
ক্ষুধায় আকুল শাম্ব আর নানা ক্লেশ।
অস্ত্রাঘাতে আছে প্রাণমাত্র অবশেষ।।
তোমারে যতেক গালি দিল দুর্য্যোধন।
আমি কি কহিব, সব করিবা শ্রবণ।।
শুনি কৃষ্ণ হইলেন ক্রোধেতে অস্থির।
সেইক্ষণে যদু-সৈন্য হইল বাহির।।
এত সব বৃত্তান্ত শুনিয়া হলধর।
দুর্য্যোধন হেতু তাপ করেন বিস্তর।।
ক্রোধে যাইতেছে কৃষ্ণ সাজি সেনাগণে।
সবংশেতে মারিবেন আজি দুর্য্যোধনে।।
এত চিন্তি আপনি রেবতী-পতি গিয়া।
শ্রীপতিরে কহিছেন বিনয় করিয়া।।
তুমি তথাকারে যাবে কিসের কারণ।
আমি গিয়া পুত্রবধূ আনিব এক্ষণ।।
ইত্যাদি অনেকবিধ কৃষ্ণে বুঝাইয়া।
আপনি গেলেন রাম কৃষ্ণেরে রাখিয়া।।
হস্তিনা নগরে রাম হৈয়া উপনীত।
দুর্য্যোধনে দূত পাঠাইলেন ত্বরিত।।
না বুঝিয়া দুর্য্যোধন এ কর্ম্ম তোমার।
বদ্ধ করি রাখ গৃহে কৃষ্ণের কুমার।।
যে হইল দোষ, ক্ষমিলাম সে তোমারে।
পুত্রবধূ আনি দেহ আমার গোচরে।।
এত বলি দুর্য্যোদন দূতের বচন।
ক্রোধে কলেবর কম্পে, করয়ে গর্জ্জন।।
যে বাক্য বলিল, আমি গুরু বলি মানি।
অন্য জন হৈলে সেই দেখিত এখনি।।
পাঠাইল পুত্রে বলি চুরি কর গিয়া।
এবে বলে পুত্রবধূ দেহ পাঠাইয়া।।
কেবা তার পুত্রবধূ তার দিব লৈয়া।
লজ্জা নাই তেঁই হেন পাঠায় কহিয়া।।
যাত দূত কহ দিয়া এ বাক্য আমার।
ভালে ভালে নিজ গৃহে যাহ আপনার।।
দূত গিয়া কহিল সকল বিবরণ।
শুনি ক্রোধে হলধর আরক্ত নয়ন।।
ক্রোধে হলী মুষল নিলেন তুলি হাতে।
লাফ দিয়া রথ হৈতে পড়েন ভূমিতে।।
ক্রোধে থরথর অঙ্গ পদ নাহি চলে।
ধরণীতে লাঙ্গল দিলেন সেই স্থলে।।
রাজা প্রজা পাত্র মিত্র সহিত সকলে।
নগর সহিত যেন পড়ে গঙ্গাজলে।।
হস্তিনানগর পঞ্চ যোজন বিস্তার।
রামের লাঙ্গলে উঠে হইয়া বিদার।।
দেখি হাহাকার শব্দ হইল নগরে।
ঊর্দ্ধশ্বাসে ধায় সবে রামের গোচরে।।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ আর বিদুর সংহতি।
শত ভাই দুর্য্যোধন পাণ্ডব প্রভৃতি।।
করযোড়ে করুণ-বচনে করে স্তুতি।
রক্ষা কর বলদেব রেবতীর পতি।।
তুমি ব্রহ্মা তুমি বিষ্ণু তুমি মহেশ্বর।
অনাদি নিদান তুমি ব্যাপ্ত চরাচর।।
তুমি ক্রোধ কৈলে ভস্ম হইবে সংসার।
তব ক্রোধে হইবে হস্তিনা ছারখার।।
যুবা বৃদ্ধ নারী গো ব্রাহ্মণ শিশুগণা।
বিশেষে তোমার বধূ আছয়ে লক্ষ্মণা।।
ক্ষমা কর কৃপাময়, পড়ি যে চরণে।
এইবার রাখ প্রভু দয়া করি মনে।।
এতেক সবার স্তুতি শুনি বলরাম।
রাখিলেন লাঙ্গল, হইল ক্রোধ সম।।
ততক্ষণ দুয্যোধন শাম্বেরে লইয়া।
নানা অলঙ্কার অঙ্গে ভূষণ করিয়া।।
লক্ষ্মণা সহিত নিল দোঁহা করি রথে।
বিবিধ যৌতুক দিল রামের অগ্রেতে।।
দেখিয়া সানন্দ হৈল রেবতীরমণ।
পুত্রবধূ লয়ে শীঘ্র করেন গমন।।
ভারতের পুণ্যকথা শুনে যেইজন।
কাশীরাম কহে, লভে সেই কৃষ্ণধন।।
১৩৪. সুভদ্রার বিবাহ-কারণ সত্যভামার মহাচিন্তা ও হস্তিনায় দূত প্রেরণ
মুনি বলে, অবধান করহ নৃপতি।
রাম-বাক্য শুনি দোঁহে হৈল দুঃখমতি।।
অধোমুখে বসিলেন দৈবকী রোহিণী।
সতী বলে সর্ব্বনাশ হৈল ঠাকুরাণী।।
না দিলে মারিবে পার্থ যুঝিবেক ক্রোধে।
আর যত মরিবেক তা সহ বিরোধে।।
মরিবে অনেক লোক সুভদ্রা-কারণ।
এক্ষণে না হয় কেন সুভদ্রা মরণ।।
গরল খাউক কিংবা প্রবেশুক জলে।
সকল অরিষ্ট খণ্ডে সুভদ্রা মরিলে।।
আমি তার সহ করি জলেতে প্রবেশ।
সংসারেতে লোকলজ্জা স্ত্রীবধ বিশেষ।।
এতেক ভাবিয়া দেবী ব্যাকুল-পরাণ।
পুনঃ উঠি যান সতী গোবিন্দের স্থান।।
দৈবকী রোহিণী দেবী কহিলেন যত।
গোবিন্দে করান সতী তাহা অবগত।।
গোবিন্দ বলেন, প্রিয়ে কি ভয় তোমার।
উপায় করিব, ইথে সে ভার আমার।।
দূত পাঠাইয়া তুমি আন ধনঞ্জয়।
সতী বলে, আমি যাই, দূত-কর্ম্ম নয়।।
একাকিনী যান সতী পার্থের সদন।
দেখিলা সুভদ্রা সহ আছেন অর্জ্জুন।।
সত্যভামা বলেন, কি নিশ্চিন্ত আছহ।
এতেক প্রমাদ পার্থ কিছু না জানহ।।
পার্থ বলিলেন, দেবি কিসের প্রমাদ।
যাহার সহায় দেবি তব যুগ্মপাদ।।
পার্থেরে লইয়া সতী যান কৃষ্ণস্থান।
হস্তে ধরি পালঙ্কে বসান ভগবান।।
গোবিন্দ বলেন, সখা কর অবধান।
পিতৃ-আজ্ঞা তোমারে সুভদ্রা দিতে দান।।
লাঙ্গলী বলেন, সখা কর অবধান।
পিতৃ-আজ্ঞা তোমারে সুভদ্রা দিতে দান।।
লাঙ্গলী বলেন, আমি দিব দুর্য্যোধনে।
এত বলি দূত পাঠাইলেন সেখানে।।
কি হইবে কহ সখা উপায় ইহার।
শুনি হাসি বলিলেন কুন্তীর কুমার।।
এই কথা হেতু সখা চিন্তা কেন মনে।
তোমার প্রসাদে আমি জিনি ত্রিভুবনে।।
মৃত্যুপতি মৃত্যুঞ্জয় ইন্দ্রে নাহি ডরি।
কামপাল যত শক্তি ধরেন শ্রীহরি।।
দাণ্ডাইয়া আপনি দেখুন হলধর।
সুভদ্রা লইয়া যাব সবার গোচর।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, দ্বন্দ্বে নাহি প্রয়োজন।
লুকাইয়া ভদ্রা লয়ে করহ গমন।।
মম রথে চড়ি যাহ মৃগয়ার ছলে।
সুভদ্রা পাঠাব আমি স্নানহেতু জলে।।
সেইকালে লয়ে তুমি করিবে গমন।
পশ্চাতে করিব শান্ত রেবতীরমণ।।
এতেক বলিল যদি দৈবকীকুমার।
অর্জ্জুন বলেন, দেব যে আজ্ঞা তোমার।।
হেনমতে বিচার করিয়া দুইজন।
নিজগৃহে চলিলেন করিতে শয়ন।।
প্রভাতে উঠিয়া পার্থ করি স্নান দান।
কি করিব বসিয়া করেন অনুমান।।
এতেক অনর্থ হৈবে রাম সহ রণ।
কিছু না জানেন রাজা ধর্ম্মের নন্দন।।
এত চিন্তি ইন্দ্রপ্রস্থে দূত পাঠাইয়া।
লিখিলেন সমস্ত বৃত্তান্ত বিবরিয়া।।
আমাকে সুভদ্রা দিতে কৃষ্ণের মানস।
কামপাল হইলেন তাহাতে বিরস।।
তাহে কৃষ্ণ বলিলেন লহ লুকাইয়া।
উহার বিহিত আজ্ঞা দেহ পাঠাইয়া।।
শুনিয়া বলেন তবে ধর্ম্মের নন্দন।
পাণ্ডবের সখা বল বুদ্ধির নারায়ণ।।
তিনি কহিবেন যাহা করিবে সে কাজ।
শুনি পার্থ সানন্দ হৈলেন হৃদিমাঝ।।
হেনমতে সপ্ত নিশি গত হয় তথা।
হেথা দুর্য্যোধন রাজা শুনিল বারতা।।
ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারী হরিষ সর্ব্বজন।
কৃষ্ণের ভগিনীপতি হৈবে দুর্য্যোধন।।
দেশান্তর হইতে আনায় বন্ধুগণ।
বিবাহ-সামগ্রী হেতু করে নিয়োজন।।
স্থানে স্থানে বসি সবে করেন বিচার।
দুর্য্যোধনে পাণ্ডবের ভয় নাহি আর।।
এই কথা অহনির্শি চিন্তে মনে মন।
আজি হৈতে নির্ভয় হইল দুর্য্যোধন।।
পাণ্ডবের সহায় কেবল নারায়ণ।
দুর্য্যোধনের আত্মবন্ধু হইল এক্ষণ।।
দ্রোণ বলে, কৃষ্ণের কুটুম্বে নাহি প্রীত।
তাঁর নাহি পরাপর ভক্তজন হিত।।
বিদুর কহেন, কথা আশ্চর্য্য লাগয়।
কৃপাচার্য্য বলে, ইহা কদাচিত নয়।।
দুর্য্যোধনে অপ্রীত গোবিন্দ মহাশয়।
এমত হইবে কর্ম্ম মনে নাহি লয়।।
দূতস্থানে জিজ্ঞাসিল সব বিবরণ।
সকল বৃত্তান্ত দূত কহিল তখন।।
দ্বারকাতে আছেন অর্জ্জুন কুন্তী-সুত।
তাহাকে সুভদ্রা দিব বলেন অচ্যুত।।
পাণ্ডবে অপ্রীত রাম না করে স্বীকার।
দুর্য্যোধনে দিব বলে রোহিণী-কুমার।।
গোবিন্দের চিত্ত নহে দুর্য্যোধনে দিতে।
না হয় নির্ণয় কিছু কি হয় পশ্চাতে।।
ভীষ্ম বলে দুর্য্যোধন পাবে লজ্জা মাত্র।
যে কেহ করুক বিভা মোরা বরযাত্র।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশী কহে, পাপী শুনে হয় পুণ্যবান।।
১৩৫. দুর্য্যোধনের বরবেশে দ্বারকায় গমন 
দুর্য্যোধন দূত পাঠাইল ধর্ম্মস্থানে।
সদলে আসিবা মম বিবাহ কারণে।।
শুনিয়া ধর্ম্মের পুত্র বিস্ময় অন্তর।
সহদেবে ডাকি জিজ্ঞাসেন নরবর।।
অর্জ্জুন লিখিল পূর্ব্বে ভদ্রা বিবরণ।
দুর্য্যোধন নিমন্ত্রণ করিল এক্ষণ।।
অনর্থের প্রায় কথা লয় মম মনে।
কহ সহদেব ইহা হইবে কেমনে।।
সহদেব বলেন, শুনহ নরনাথ।
সুভদ্রার বিবাহ হইল দিন সাত।।
সত্যভামা দিলেন বিবাহ লুকাইয়া।
কৃষ্ণের আজ্ঞায় বলরামে না কহিয়া।।
রামের বাসনা ভদ্রা দিতে দুর্য্যোধনে।
দুর্য্যোধন যাইতেছে রামের বচন।।
ইহার উচিত কৃষ্ণ করিবা আপনি।
তার হেতু চিন্তিত না হও নৃপমণি।।
যুধিষ্ঠির বলেন, এ লজ্জার বিষয়।
মোদের যাইতে তথা উচিত না হয়।।
না গেলে হইবে দুঃখী রাজা দুর্য্যোধন।
আপনি সসৈন্যে ভীম করহ গমন।।
পাইয়া রাজার আজ্ঞা বীর বৃকোদর।
পাঁচ অক্ষৌহিণী বলে চলেন সত্বর।।
আনন্দেতে দুর্য্যোধন বরবেশ ধরে।
রত্নময় চতুর্দ্দোলে আরোহণ করে।।
নানা শব্দে বাদ্য বাজে না হয় বর্ণনা।
হয় হস্তী রথ যত কে করে গণনা।।
দুর্য্যোধন-বেশ দেখি ভীমে হৈল ক্রোধ।
ডাকিয়া বলেন, তোরা সবাই অবোধ।।
হেথা হৈতে দ্বারকা আছয়ে দূরবেশ।
এইখানে কি হেতু করিলা বরবেশ।।
দুঃশাসন বলে কহ কি দোষ ইহাতে।
দেখিতে না পার যদি আইস পশ্চাতে।।
ভীম বলে, ভাল মন্দ বুঝিবা হে শেষে।
কোন্ কন্যা বিবাহিতে যাও বরবেশে।।
আমার নিকটে দূত পরশ্ব আইল।
সুভদ্রা বিবাহ আজি সপ্তাহ হইল।।
অকারণে সভামধ্যে গিয়া পাব লাজ।
সেই হেতু বলি বরবেশে নাহি কাজ।।
পাছু কেন যাব আমি যাই তব আগে।
এত বলি সসৈন্যে চলিল বীর বেগে।।
বিস্মিত হইল সবে ভীম-বাক্য শুনি।
ভীষ্ম দ্রোণ বিদুর করেন কানাকানি।।
দুঃশাসন বলে, সে বলিল বৃকোদর।
সত্য হেন লাগে প্রায় সবার অন্তর।।
না জান কি ভীমের যেমত বুদ্ধি খল।
বরবেশ দেখি আত্মা হইল বিকল।।
বাতুলের প্রায় বলে যে আইসে মুখে।
চল শীঘ্র দেখি প্রায় শেল বাজে বুকে।।
কর্ণ দুর্য্যোধন বলে সত্য এই কথা।
এ বৈভব দেখিতে কেমনে রহে হেথা।।
এত বিচারিয়া সবে করিল গমন।
তিন দিনে গেল পথ শতেক যোজন।।
দুর্য্যোধন রাজা তবে করিয়া যুকতি।
পত্র লিখি দূত পাঠাইল দ্বারাবতী।।
রোহিণীণক্ষত্র মেষ অক্ষয় তৃতীয়া।
দ্বিতীয় প্রহরে কল্য উত্তরিব গিয়া।।
করহ কন্যার অধিবাস আজি রাতি।
কালি রাত্রি বিবাহের শ্রেষ্ঠ লগ্ন তিথি।।
দূত গিয়া দিল পথ মূষলীর হাতে।
পত্র পড়ি বলরাম কহেন সভাতে।।
করহ ভদ্রার গন্ধ-অধিবাস আজি।
নিকটে আইল রাজা দুর্য্যোধন সাজি।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম কহে, সদা শুনে পুণ্যবান।।
১৩৬. অর্জ্জুনের সুভদ্রা হরণ 
বলভদ্র আজ্ঞা পেয়ে যত নারীগণ।
পিঠালি হরিদ্রা লৈয়া কৈলা উদ্বর্ত্তন।।
তৈল আমলকী গন্ধ মাখিল কুন্তলে।
স্নান করিবারে গেল সরস্বতী-জলে।।
কৃষ্ণের ইঙ্গিত পেয়ে দেবী সত্যবতী।
ভদ্রা লৈয়া গেল সহ অনেক যুবতী।।
অর্জ্জুনে ডাকিয়া তবে বলে নারায়ণ।
শুনিলে কি অর্জ্জুন আইল দুর্য্যোধন।।
আজি অধিবাস হেতু রাম আজ্ঞা দিল।
স্নান হেতু তারে সরস্বতী পাঠাইল।।
মৃগয়ার ছলে চড়ি যাহ মম রথে।
সুভদ্রা লইয়া তুমি যাহ সেই পথে।।
দারুকে ডাকিয়া কৃষ্ণ কহেন ইঙ্গিতে।
অর্জ্জুনে লইয়া তুমি যাহ মম রথে।।
যে কিছু কহিবে পার্থ না কর অন্যথা।
যথায় বলিবে রথ লৈয়া যাবে তথা।।
পাইয়া কৃষ্ণের আজ্ঞা দারুক সত্বর।
সাজাইয়া আনে রথ অর্জ্জুন গোচর।।
সুসজ্জ হইয়া পার্থ লৈয়া ধনুঃশরে।
খড়্গ ছুরী গদা শূল চক্র লৈয়া করে।।
কৃষ্ণরথে আরোহণ করি মহাবীর।
চালাইয়া দেন রথ সরস্বতী-তীর।।
যথা ভদ্রা করে স্নান নারীগণ মাঝে।
ধীরে ধীরে পার্থ তথা গেল পদব্রজে।।
ধরিয়া ভদ্রারে তুলি চড়াইয়া রথে।
চালাইয়া দেন রথ ইন্দ্রপ্রস্থ-পথে।।
হাহাকারে ডাকিল যতেক কন্যাগণে।
সুভদ্রা হরিয়া লয় কুন্তীর নন্দন।।
শব্দ শুনি বেগে ধায় সভাপাল সব।
ধর ধর বলি ডাকে আরে রে পাণ্ডব।।
আরে পার্থ মতিচ্ছন্ন হইল তোমারি।
কেমন সাহস তোর হেন গৃহে চুরি।।
না পলাহ বলি তার পাছেতে ডাকিল।
শৃগালের শব্দে যেন সিংহ নেউটিল।।
ধনুর্গুণ টঙ্কারিয়া করি শরজাল।
নিমিষে কাটেন তিন লক্ষ সভাপাল।।
সভাপালে মারিয়া চালাইলেন রথ।
নিমিষে গেলেন পার্থ দশক্রোশ পথ।।
সুভদ্রা হরিল বার্ত্তা শুনিয়া শ্রবণে ।
চতুর্দ্দিকে ধাইয়া আইল সর্ব্বজনে।।
কেহ স্নানে কহে দানে ভোজনে শয়নে।
যে যথা আছিল ত্যজি ধায় সর্ব্বজনে।।
চড়িতে তুরগে রথে না পাইল কাল।
ক্রোধভরে বাহির হইল কামপাল।।
ক্রোধে বলভদ্রের কাঁপয়ে কর পদ।
যুগল নয়ন যেন স্ফুট কোকনদ।।
ধর ধর বিনা শব্দ নাহি কারো মুখে।
ধর গিয়া ধর, বলে যারে আগে দেখে।।
কামদেব যাইয়া চড়িল মীনধ্বজে।
সাত কোটি রথ সঙ্গে নব কোটি গজে।।
ধর গিয়া বলি আজ্ঞা দিল বলরাম।
সবার অগ্রেতে গিয়া উত্তরিল কাম।।
সারণ আইল সঙ্গে রথ কোটি সাত।
গজ অশ্ব পদাতিক নানা অস্ত্র হাত।।
কৃপ বৃন্দ উপগদ কৃতবর্ম্মা ধীর।
যে যাহার সৈন্য লৈয়া ধায় যদুবীর।।
গদ শাম্ব আইল লইয়া বহু সেনা।
পাইয়া রামের আজ্ঞা ধায় সর্ব্বজনা।।
ধর গিয়া বলি আজ্ঞা দেন হলধর।
সসৈন্যে সারণ বীর চলিল সত্বর।।
উগ্রসেন বসুদেব সাত্যকি উদ্ধব।
রামের নিকটে এল যতেক যাদব।।
ক্রোধে বলভদ্র-তনু কাঁপে থরথর।
ফুলিয়া হইল তনু যেমন মন্দর।।
প্রলয় মেঘের শব্দে ডাকে যেন গলা।
অঙ্গ হৈতে ছিঁড়িয়া পড়িল বনমালা।।
রাম বলে, পাণ্ডবের এত গর্ব্ব হৈল।
শ্বাপদ যজ্ঞের হবি খাইতে ইচ্ছিল।।
চণ্ডাল হইয়া ইচ্ছা হরিল ব্রাহ্মণী।
গারুড়ি অজ্ঞাতে যেন ধরে কাল ফণী।।
যে পুরে সূর্য্যেন্দু বায়ু তেজ মন্দ বয়।
যে পুরে আসিতে শক্তি শমনের নয়।।
দেখ হের মতিচ্ছন্ন হৈল দুরাচার।
চুরি করি লয়ে যায় ভগিনী আমার।।
এই দোষে তারে আজি মারিব সমূলে।
বাতি দিতে না রাখিব পাণ্ডবের কুলে।।
তাহাকে মারিব যে হেইবে তার বংশে।
পৃথিবী খুঁজিয়া আজি মারিব সবংশে।।
ইন্দ্রপ্রস্থ মাটি আজি তাড়িয়া লাঙ্গলে।
ফেলাইয়া দিব আজি সমুদ্রের জলে।।
ইন্দ্র যম কুবের বরুণ পঞ্চানন।
কার শক্তি মম শত্রু করিবে রক্ষণ।।
জানি আমি পাণ্ডবের অতি মন্দ রীতি।
না জানিয়া করে কৃষ্ণ তার সহ প্রীতি।।
অন্তঃপুরে দেয় তারে রহিবারে স্থান।
নহে কেন এতেক হইবে অপমান।।
যত স্নেহ করিনু শুধিল তার গুণ।
ভগিনী হরিয়া মুখে দিল কালি চুণ।।
প্রতিফল ইহার পাইবে দুষ্ট আজি।
এত বলি বাহির হইল রাম সাজি।।
বামেতে লাঙ্গল ধরি দক্ষিণে মুষল।
বজ্রহস্তে শোভা যেন পায় আখণ্ডল।।
কৃষ্ণে ডাক বলি দূতে দিল পাঠাইয়া।
সে প্রিয় সখার কর্ম্ম দেখুক আসিয়া।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশী কহে, সাধুজন সদা করে পান।।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র