শ্রীমদ্ভগবত গীতা সপ্তদশ অধ্যায়

সপ্তদশ অধ্যায় - শ্রদ্ধাত্রয় যোগ

| অর্জুন উবাচ |
যে শাস্ত্রবিধিমুৎসৃজ্য যজন্তে শ্রদ্ধয়ান্বিতাঃ |
তেষাং নিষ্ঠা তু কা কৃষ্ণ সত্ত্বমাহো রজস্তমঃ || ১ ||
অর্থ: অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন- হে কৃষ্ণ! যারা শাস্ত্রীয় বিধান পরিত্যাগ করে শ্রদ্ধা সহকারে দেব-দেবীর পূজা করে, তাদের সেই নিষ্ঠা কি সাত্ত্বিক, রাজসিক না তামসিক?
| শ্রীভগবানুবাচ |
ত্রিবিধা ভবতি শ্রদ্ধা দেহিনাং সা স্বভাবজা |
সাত্ত্বিকী রাজসী চৈব তামসী চেতি তাং শৃণু || ২||
অর্থ: শ্রীভগবান বললেন- দেহীদের স্বভাব-জনিত শ্রদ্ধা তিন প্রকার-সাত্ত্বিকী, রাজসীক ও তামসী। এখন সেই সম্পন্ধে শ্রবণ কর।
সত্ত্বানুরূপা সর্বস্য শ্রদ্ধা ভবতি ভারত |
শ্রদ্ধাময়ো্হয়ং পুরুষো যো যচ্ছ্রদ্ধঃ স এব সঃ || ৩ ||
অর্থ: হে ভারত! সকলের শ্রদ্ধা নিজ নিজ অন্ত:করণের হয়। যে যেই রকম গুণের প্রতি শ্রদ্ধাযুক্ত, সে সেই রকম শ্রদ্ধাবান।
যজন্তে সাত্ত্বিকা দেবান্ যক্ষরক্ষাংসি রাজসা:।
প্রেতান্ভূতগণাংশ্চন্যে যজন্তে তামসা জনাঃ || ৪ ||
অর্থ: সাত্ত্বিক ব্যক্তিরা দেবতাদের পূজা করে। রাজসিক ব্যক্তিরা যক্ষ ও রাক্ষসদের পূজা করে এবং তামসিক ব্যক্তিরা ভূত ও প্রেতাত্মাদের পূজা করে।
অশাস্ত্রবিহিতং ঘোরং তপ্যন্তে যে তপো জনাঃ |
দম্ভাহংকারসংয়ুক্তাঃ কামরাগবলান্বিতাঃ || ৫ ||
কর্ষয়ন্তঃ শরীরস্থং ভূতগ্রামমচেতসঃ |
মাং চৈবান্তঃশরীরস্থং তান্ বিদ্ধ্যাসুরনিশ্চয়ান্ || ৬ ||
অর্থ: দম্ভ ও অহঙ্কারযুক্ত এবং কামনা ও আসক্তির প্রভাবে বলান্বিত হয়ে যে সমস্ত অবিবেকী ব্যক্তি তাদের দেহস্থ ভূতসমুহকে এবং অন্তরস্থ পরমাত্মাকে ক্লেশ প্রদান করে শাস্ত্রবিরুদ্ধ ঘোর তপস্যার অনুষ্ঠান করে, তাদেরকে নিশ্চিতভাবে আসুরিক বলে জানবে।
আহারস্ত্বপি সর্বস্য ত্রিবিধো ভবতি প্রিয়ঃ |
যজ্ঞস্তপস্তথা দানং তেষাং ভেদমিমং শৃণু || ৭ ||
অর্থ: সকল মানুষের আহারও তিন প্রকার প্রীতিকর হয়ে থাকে। তেমনই যজ্ঞ, তপস্যা এবং দানও ত্রিবিধ। এখন তাদের এই প্রভেদ প্রবণ কর।
আয়ুঃসত্ত্ববলারোগ্যসুখপ্রীতিবিবর্ধনাঃ |
রস্যা স্নিগ্ধাঃ স্থিরা হৃদ্যা আহারাঃ সাত্ত্বিকপ্রিয়াঃ || ৮||
অর্থ: যে সমস্ত আহার আয়ু, সত্ত্ব, বল, আরোগ্য, সুখ ও প্রীতি বর্ধনকারী এবং রসযুক্ত, স্নিগ্ধ, স্থায়ী ও মনোরম, সেগুলি সাত্ত্বিক লোকদের প্রিয়।
কট্বম্ললবণাত্যুষ্ণতীক্ষ্ণরূক্ষবিদাহিনঃ |
আহারা রাজসস্যেষ্টা দুঃখশোকাময়প্রদাঃ ||৯||
অর্থ: যে সমস্ত আহার অতি তিক্ত, অতি অম্ল, অতি লবণাক্ত, অতি উষ্ণ, অতি তীক্ষ্ম, অতি শুষ্ক, অতি প্রদাহকর এবং দু:খ, শোক ও রোগপ্রদ, সেগুলি রাজসিক ব্যক্তিদের প্রিয়।
যাতযামং গতরসং পূতি পর্য়ুষিতং চ যৎ |
উচ্ছিষ্টমপি চামেধ্যং ভোজনং তামসপ্রিয়ম্ || ১০ ||
অর্থ: আহারের এক প্রহরের অধিক পূর্বে রান্না করা খাদ্য, যা নীরস, দুর্গন্ধযুক্ত, বাসী এবং অপরের উচ্ছিষ্ট দ্রব্য ও অমেধ্য দ্রব্য, সেই সমস্ত তামসিক লোকদের প্রিয়
অফলাকাঙ্ক্ষিভির্যজ্ঞো বিধিদিষ্টো য ইজ্যতে |
যষ্টব্যমেবেতি মনঃ সমাধায় স সাত্ত্বিকঃ || ১১ ||
অর্থ: ফলের আকাঙক্ষা রহিত ব্যক্তিগণ কর্তৃক শাস্ত্রের বিধি অনুসারে, অনুষ্ঠান করা কর্তব্য এভাবেই মনকে একাগ্র করে যে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়, তা সাত্ত্বিক।
অভিসন্ধায় তু ফলং দম্ভার্থমপি চৈব যৎ |
ইজ্যতে ভরতশ্রেষ্ঠ তং যজ্ঞং বিদ্ধি রাজসম্ || ১২ ||
অর্থ: হে ভরতশ্রেষ্ঠ! কিন্তু ফল কামনা করে দম্ভ প্রকাশের জন্য যে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয, তাকে রাজসিক যজ্ঞ বলে জানবে।
বিধিহীনমসৃষ্টান্নং মন্ত্রহীনমদক্ষিণম্ |
শ্রদ্ধাবিরহিতং যজ্ঞং তামসং পরিচক্ষতে || ১৩ ||
অর্থ: শাস্ত্রবিধি বর্জিত প্রসাদান্ন বিতরণহীন, মন্ত্রহীন, দক্ষিণাহীন ও শ্রদ্ধারহিত যজ্ঞকে তামসিক যজ্ঞ বলা হয়।
দেবদ্বিজগুরুপ্রাজ্ঞপূজনং শৌচমার্জবম্ |
ব্রহ্মচর্যমহিংসা চ শারীরং তপ উচ্যতে || ১৪ ||
অর্থ: পরমেশ্বর ভগবান, ব্রাহ্মণ, গুরু ও প্রাজ্ঞগণের পূজা এবং শৌচ, সরলতা, ব্রহ্মচর্য ও অহিংসা- এগুলিকে কায়িক তপস্যা বলা হয়।
অনুদ্বেগকরং বাক্যং সত্যং প্রিয়হিতং চ যৎ |
স্বাধ্যায়াভ্যসনং চৈব বাঙ্ময়ং তপ উচ্যতে || ১৫ ||
অর্থ: অনুদ্বেগকর, সত্য, প্রিয়, অথচ হিতকর বাক্য এবং বৈদিক শাস্ত্র পাঠ করাকে বাচিক তপস্যা বলা হয়।
মনঃ প্রসাদঃ সৌম্যত্বং মৌনমাত্মবিনিগ্রহঃ |
ভাবসংশুদ্ধিরিত্যেতৎ তপো মানসমুচ্যতে || ১৬ ||
অর্থ: চিত্তের প্রসন্নতা, সরলতা, মৌন, আত্মনিগ্রহ ও ব্যবহারে নিষ্কপটতা- এগুলিকে মানসিক তপস্যা বলে।
শ্রদ্ধয়া পরয়া তপ্তং তপস্তৎ ত্রিবিধং নরৈঃ |
অফলাকাঙ্ক্ষিভির্যুক্তৈঃ সাত্ত্বিকং পরিচক্ষতে || ১৭ ||
অর্থ: ফলাকাঙ্খা রহিত মানুষের দ্বারা পরম শ্রদ্ধা সহকারে অনুষ্ঠিত ত্রিবিধ তপস্যাকে সাত্ত্বিক তপস্যা বলা হয়।
সৎকারমানপূজার্থং তপো দম্ভেন চৈব যৎ |
ক্রিয়তে তদিহ প্রোক্তং রাজসং চলমধ্রুবম্ || ১৮ ||
অর্থ: শ্রদ্ধা, সম্মান ও পূজা লাভের আশায় দম্ভ সহকারে যে তপস্যা করা হয়, তাকেই এই জগতে অনিত্য ও অনিশ্চিত রাজসিক তপস্যা বলা হয়।
মূঢ়গ্রাহেণাত্মনো যৎ পীড়য়া ক্রিয়তে তপঃ |
পরস্যেৎসাদনার্থং বা তত্তামসমুদাহৃতম্ || ১৯ ||
অর্থ: মুঢ়োচিত্ত আগ্রহের দ্বারা নিজেকে পীড়া দিয়ে অথবা অপরের বিনাশের জন্য যে তপস্যা করা হয় তাকে তামসিক তপস্যা বলা হয়।
দাতব্যমিতি যদ্দানং দীয়তেহনুপকারিণে |
দেশে কালে চ পাত্রে চ তদ্দানং সাত্ত্বিকং স্মৃতম || ২০ |
অর্থ: দান করা কর্তব্য বলে মনে করে প্রত্যুপকারের আশা না করে উপযুক্ত স্থানে, উপযুক্ত সময়ে এবং উপযুক্ত পাত্রে যে দান করা হয়, তাকে সাত্ত্বিক দান বলা হয়।
যত্তু প্রত্যুপকারার্থং ফলমুদ্দিশ্য বা পুনঃ |
দীয়তে চ পরিক্লিষ্টং তদ্দানং রাজসং স্মৃতম্ || ২১ ||
অদেশকালে যদ্দানমপাত্রেভ্যশ্চ দীয়তে |
অসৎকৃতমবজ্ঞাতং তত্তামসমুদাহৃতম্ || ২২ ||
অর্থ: যে দান প্রত্যুপকারের আশা করে অথবা ফল লাভের উদ্দেশ্যে এবং অনুতাপ সহকারে করা হয়, সেই দানকে রাজসিক বলা হয়।
ওঁ তৎসদিতি নির্দেশো ব্রহ্মণস্ত্রিবিধঃ স্মৃতঃ |
ব্রাহ্মণাস্তেন বেদাশ্চ য়জ্ঞাশ্চ বিহিতাঃ পুরা || ২৩ ||
অর্থ: ওঁ তৎ সৎ- এই তিন প্রকার ব্রহ্ম-নির্দেশক নাম শাস্ত্রে কথিত আছে। পুরাকালে সেই নাম দ্বারা ব্রাহ্মণগণ, বেদসমুহ ও যজ্ঞসমুহ বিহিত হয়েছে।
তস্মাদ্ ওঁ ইত্যুদাহৃত্য যজ্ঞদানতপঃক্রিয়াঃ |
প্রবর্তন্তে বিধানোক্তাঃ সততং ব্রহ্মবাদিনাম্ || ২৪ ||
অর্থ: সেই হেতু ব্রহ্মবাদীদের যজ্ঞ, দান, তপস্যা ও ক্রিয়াসমুহ সর্বদাই ওঁ এই শব্দ উচ্চারণ করে শাস্ত্রের বিধান অনুসারে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
তদিত্যনভিসন্ধায় ফলং যজ্ঞতপঃক্রিয়াঃ |
দানক্রিয়াশ্চ বিবিধাঃ ক্রিয়ন্তে মোক্ষকাঙ্ক্ষিভিঃ || ২৫ ||
অর্থ: মুক্তিকামীরা ফলের আকাঙ্খা না করে "তৎ" এই শব্দ উচ্চারণ-পূর্বক নানা প্রকার যজ্ঞ, তপস্যা দান আদি কর্মের অনুষ্ঠান করেন।
সদ্ভাবে সাধুভাবে চ সদিত্যেতৎ প্রযুজ্যতে |
প্রশস্তে কর্মণি তথা সচ্ছব্দঃ পার্থ যুজ্যতে || ২৬ ||
যজ্ঞে তপসি দানে চ স্থিতিঃ সদিতি চোচ্যতে |
কর্ম চৈব তদর্থীয়ং সদিত্যেবাভিধীয়তে || ২৭ ||
অর্থ: হে পার্থ! সৎভাবে ও সাধুভাবে "সৎ" এই শব্দ প্রযুক্ত হয়। তেমনই শুভ কর্মসমুহে "সৎ" শব্দ ব্যবহৃত হয়। যজ্ঞে তপস্যায় ও দানে "সৎ" শব্দ উচ্চারিত হয়। যেহেতু ঐ সকল কর্ম ব্রহ্মোদ্দেশক হলেই "সৎ" শব্দে অভিহিত হয়।
অশ্রদ্ধয়া হুতং দত্তং তপস্তপ্তং কৃতং চ যৎ |
অসদিত্যুচ্যতে পার্থ ন চ তৎ প্রেত্য নো ইহ || ২৮ ||
অর্থ: হে পার্থ! অশ্রদ্ধা সহকারে হোম, দান বা তপস্যা যা কিছু অনুষ্ঠিত হয়, তাকে বলা হয় "অসৎ"। সেই সমস্ত ক্রিয়া ইহলোকে ও পরলোকে ফলদায়ক হয় না।
ইতি- "শ্রদ্ধাত্রয় যোগ" নামক শ্রীমদ্ভগবত গীতার সপ্তদশ অধ্যায়ের ভক্তিবেদান্ত তাৎপর্য সমাপ্ত

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র