১১.দুর্য্যোধনের নিমন্ত্রণে রাজগণেরআগমন ও যুদ্ধসজ্জারাজা জন্মজয় মুনিবরে জিজ্ঞাসিল।পরে কহ মুনি আর কি প্রসঙ্গ হৈল।।পাণ্ডবের রণে আসে কত বীরগণ।কত সৈন্য সহ সাজে নিজে দুর্য্যোধন।।মহা মহা বীরগণ কৌরব সহায়।অল্প সৈন্য বলহীন পাণ্ডুর তনয়।।কেবল সহায় মাত্র দেব নারায়ণ।ব্রহ্মার সহায় যথা অদিতি নন্দন।।পাণ্ডবের পক্ষমাত্র কৃষ্ণচন্দ্র দেখি।ইন্দ্রের আশ্রয়ে যথা দেবগণ সুখী।।উভয় কুলের হিত দেব নারায়ণ।সহায় হলেন পাণ্ডবের কি কারণ।।গোবিন্দেরে কেন নাহি বলে দুর্য্যোধন।কহ কহ মুনিবর ইহার কারণ।।মুনি বলে, শুন নৃপ শ্রীজনমেজয়।দুষ্টবুদ্ধি দুর্য্যোধন পাপিষ্ঠ দুর্জ্জয়।।সে হেতু কল্পনা করি জগৎ নিবাস।দুর্য্যোধনে ছাড়িলেন করিয়া নিরাশ।।চেদিবংশে ছিল যত যত রাজগণ।যুদ্ধ হেতু দুর্য্যোধন লিখিল লিখন।।পাইয়া রাজার আজ্ঞা চেদি-বংশপতি।নব কোটি গজে সাজে, সাত কোটি রথী।।সহস্র শতেক কোটি সাজে অশ্ববর।পঞ্চ কোটি মল্ল সাজে, পদাতি বিস্তর।।বিবিধ বাদ্যের শব্দে পূরিল ধরণী।সৈন্য কোলাহল শব্দ কর্ণে নাহি শুনি।।ধ্বজ ছত্র পতাকায় সূর্য্য আচ্ছাদিল।কৌরবের সৈন্যসহ মিলিত হইল।।ভগদত্ত রাজা আসে পেয়ে নিমন্ত্রণ।অর্ব্বুদ অর্ব্বুদ সৈন্য করিয়া সাজন।।সহস্র শতেক কোটি অশ্ব আসোয়ার।ষষ্টি কোটি মহারথী তার পরিবার।।ছত্রিশ সহস্র কোটি সঙ্গে মত্ত হাতী।চতুরঙ্গ দল সহ আসে নরপতি।।বিবিধ বাদ্যের শব্দে কাঁপে মহীধর।মিলিত হইল কুরুসৈন্যের ভিতর।।বৃহদ্বল রাজা আসে পাইয়া লিখন।যতেক সাজিল সৈন্য কে করে গণন।।পঞ্চষষ্টি সহস্র সঙ্গেতে মহারথী।ষষ্টি শত সহস্র যে সঙ্গে মত্ত হাতী।।পঞ্চদশ সহস্র যে সঙ্গে আসোয়ার।তবকী তুরকী মল্ল পদাতি অপার।।নানা বাদ্য কোলাহলে কুরুদলে গেল।শ্রুতমাত্র তদন্তরে কলিঙ্গ সাজিল।।শত ভাই সহ আসে কলিঙ্গ নৃপতি।সাজিল অসংখ্য সৈন্য রথী মহারথী।।সহস্র শতেক কোটি কিরাত যবন।ষষ্টি কোটি রথ সাজে, পত্তি অগণন।।পঞ্চাশ সহস্র কোটি সাজে অশ্ববল।নৃপতি কলিঙ্গ চলে চতুরঙ্গ দল।।কৌরব-সৈন্যেতে আসি করিল মিলন।নীলধ্বজ নৃপ তবে পেয়ে নিমন্ত্রণ।।অর্ব্বুদ অর্ব্বুদ সৈন্য ত্বরিতে আসিল।সুশর্ম্মা নৃপতি তবে সংবাদ পাইল।।চতুরঙ্গ দলে রাজা করিল সাজন।পঞ্চকোটি রথী সাজে, পত্তি অগণন।।দুই লক্ষ মত্ত গজ, তুরঙ্গ অপার।চলিল সুশর্ম্মা রাজা সহ পরিবার।।কৌরবের সঙ্গে আসি করিল মিলন।আসিল ত্রিগর্ত্ত সঙ্গে সৈন্য আগণন।।পঞ্চ ভাই সহ অসে ত্রিগর্ত্ত নৃপতি।সাত কোটি রথী সঙ্গে, পঞ্চ কোটি হাতী।।একাদশ কোটি তুরঙ্গম আসোয়ার।চতুরঙ্গ দল সহ করে আগুসার।।ক্ষেমবর্ত্তী রাজা আর রাজা অনুবিন্দ।সুমন্ত্র নৃপতি আর রাজা জলসন্ধ।।এইরূপে পঞ্চষষ্টি শত নরপতি।রথ রথী গজ বাজি অসংখ্য পদাতি।।কৌরবের দলে আসে পেয়ে নিমন্ত্রণ।সৈন্য-কোলাহল শব্দে পূরিল গগন।।একাদশ অক্ষৌহিণী একত্র মিলিল।দেখি দুর্য্যোধন চিত্তে সানন্দ হইল।।অনুচরে আজ্ঞা দিল কৌরব তনয়।কুরুক্ষেত্রে কর গিয়া বিচিত্র আলয়।।বিচিত্র মন্দির পুর করিবে অপার।ধান্য যব তণ্ডুলাদি রাখ উপহার।।অশ্বশালা সারি সারি করিবে অপার।কুরুক্ষেত্র মধ্যে সবে কর আগুসার।।একাদশ অক্ষৌহিণী রহিবার স্থান।শীঘ্রগতি কুরুক্ষেত্রে করহ নির্ম্মাণ।।রাজার আদেশ পেয়ে অনুচরগণ।সেইক্ষণে কুরুক্ষেত্রে করিল গমন।।লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি খনক আনিল।গড়খাই নির্ম্মাইতে সবাকে কহিল।।আজ্ঞা পেয়ে খনিবারে লাগে সেইক্ষণে।যতেক রচিল গৃহ, না যায় লিখনে।।নানা অস্ত্র-শস্ত্রে পূর্ণ কৈল গৃহগণ।যতেক সঞ্চিল দ্রব্য, না হয় লিখন।।নির্ম্মাইয়া গড়খাই যত অনুচরে।নিবেদন কৈল আসি কৌরব কুমারে।।মহাভারতের কথা অমৃত-লহরী।শুনিলে অধর্ম্ম খণ্ডে, তরে ভবতরি।।১২. কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধসজ্জা করিতেযুধিষ্ঠিরের অনুমতি দান ওকুরুক্ষেত্রের উৎপত্তির কথাজন্মেজয় কহে, কহ শুনি তপোধন।অতঃপর কি করিল ভাই পঞ্চ জন।।হেথা দুর্য্যোধন রাজা করিল সাজন।তবে কিবা করিলেন পাণ্ডুর নন্দন।।কোন্ কোন্ রাজা হৈল সহায় তাঁহার।কহ শুনি মুনিবর করিয়া বিস্তার।।মুনি বলে, শুন নৃপবর জন্মেজয়।হৃদয়ে চিন্তিলা তবে ধর্ম্মের তনয়।।নিশ্চয় হইবে যুদ্ধ, না হবে খণ্ডন।ভ্রাতৃগণে ডাক দিয়া কহেন বচন।।শুনিলে কি ভ্রাতৃগণ কৌরব কাহিনী।সাজিল পাপিষ্ঠ একাদশ অক্ষৌহিণী।।আমার আছয়ে যত সৃহৃদ সুজন।যুদ্ধ হেতু সবাকারে কর আমন্ত্রণ।।ভোজবংশে অন্ধবংশে যতেক নন্দন।যদুবংশে উগ্রসেন আদি রাজগণ।।যথাযোগ্য সবাকারে লিখহ লিখন।অনুচরগণে আজ্ঞা কর শীঘ্রতরে।।কুরুক্ষেত্রে গড়খাই কহ রচিবারে।ভক্ষ্য ভোজ্য দ্রব্য আদি করহ সঞ্চার।।নানা অস্ত্র শস্ত্র নানাবিধ উপহার।।নৃপতির আজ্ঞা পেয়ে ইন্দ্রের নন্দন।ধৃষ্টদ্যুন্নে ডাকি তবে কহে সেইক্ষণ।।আপনিও যাহ তথা, বিলম্ব না সয়।কুরুক্ষেত্রে কর গিয়া বিচিত্র আলয়।।সহস্র সহস্র সঙ্গে লহ অনুচর।দিব্য গড়খাই রচ, আগার বিস্তর।।কুরুক্ষেত্র মহাতীর্থ পুরাণে বাখানি।যাহাতে পড়িলে যুদ্ধে পায় দেবযোনি।।পূর্ব্ব-পিতামহ মম কুরু নৃপমণি।ব্যাসমুখে শুনিলাম তাঁহার কাহিনী।।একচ্ছত্র মহারাজ ছিলা ভূমণ্ডলে।কুরুক্ষেত্র কৈল রাজা নিজ পুণ্যবলে।।শুনি কহে ধৃষ্টদ্যুন্ন করিয়া বিনয়।ইহার বৃত্তান্ত কহ, শুনি ধনঞ্জয়।।কোন্ পুণ্যবলে রাজা কুরুক্ষেত্র কৈল।কোন্ দেব আরাধিয়া এ বর পাইল।।অর্জ্জুন বলেন, শুন পূর্ব্বের কাহিনী।মহাধর্ম্মশীল ছিলা কুরু নৃপমণি।।বাহুবলে শাসিলেন সর্ব্ব ভূমণ্ডল।একচ্ছত্র রাজা হৈল বলে মহাবল।।নানা দান, নানা যজ্ঞ করিল রাজন।কুরুর মহিমা গুণ বিখ্যাত ভুবন।।এক দিন পিতৃগণ কহিল তাঁহারে।মাংস-শ্রাদ্ধে তৃপ্ত কর আমা সবাকারে।।পিতৃগণ আজ্ঞাকারী কুরু নরপতি।মৃগয়া কারণে বনে গেলা শীঘ্রগতি।।মারিল অনেক মৃগ বনের ভিতর।আগুবাড়ি পাঠাইল মৃগ বহুতর।।মৃগয়ান্তে শ্রান্ত বড় হইয়া রাজন।জল অন্বেষণে রাজা ভ্রমে বনে বন।।জল নাহি পায় রাজা, তৃষ্ণায় পীড়িত।দণ্ডক কাননে রাজা হৈল উপনীত।।মুনির আশ্রম সেই অপূর্ব্ব কানন।মনুষ্য অগম্য স্থল, অতি সুশোভন।।দিব্য সরোবর আছে বনের ভিতরে।দেবকন্যাগণ তাহে নিত্য ক্রীড়া করে।।সেই সরোবরে রাজা হৈল উপনীত।পরমা সুন্দরী কন্যা দেখি চমকিত।।বহুরূপা নামে কন্যা দেবের নর্ত্তনী।রূপেতে কনকলতা খঞ্জন-নয়নী।।মুখরুচি শত শশী করিয়াছে শোভা।ওষ্ঠস্থল অতুল বন্ধুক পুষ্প-আভা।।শুকচঞ্চু জিনি নাসা, জিনি তিলফুল।বঙ্কিম যুগল ভুরূ, কিবা দিব তুল।।দেখিয়া কন্যার রূপ মোহিত রাজন।ক্ষুধা তৃষ্ণা পাসরিল কামে অচেতন।।নিকটেতে গিয়া রাজা জিজ্ঞাসে কন্যারে।নিজ পরিচয় তুমি কহিবে আমারে।।তোমার রূপের সীমা না যায় বর্ণনে।তোমা সম রূপ গুণ না দেখি নয়নে।।কিবা লক্ষ্মী, সরস্বতী হবে হরপ্রিয়া।সাবিত্রী রুক্নিণী কিবা হবে সর্ব্বজয়া।।কিবা নাগকন্যা হবে, তিলোত্তমা প্রায়।নিজ পরিচয় কন্যা কহিবে আমায়।।কন্যা বলে, শুন মম পূর্ব্বের কাহিনী।বহুরূপা নাম মম পূর্ব্বের কাহিনী।।বহুরূপা নাম মম ইন্দ্রের নর্ত্তনী।পূর্ব্বজন্মে আমি রাজা ছিনু পক্ষিযোনি।প্রভাসে বসতি ছিল, নাম সারঙ্গিণী।।প্রমাথিক নামে বট প্রভাসের তীরে।অদ্যাপি সে বৃক্ষ আছে বৃষ্টির গোচরে।।তথা অবস্থিতি আমি করি বহুকাল।কত দিনে বৃদ্ধকাল হইল জঞ্জাল।।জরাতে আতুর তনু, ব্যাধিতে পীড়িল।সেই বৃক্ষ উপরেতে মম মৃত্যু হৈল।।মরিয়া শুকায়ে ছিনু বাসার ভিতরে।বহুকাল ছিল বাসা বৃক্ষের উপরে।।দৈবের নির্ব্বন্ধ কর্ম্ম না হয় খণ্ডন।কত দিনে ঘোরতর বহিল পবন।।বাসার সহিত মম শুষ্ক কলেবরে।উড়াইয়া ফেলিলেক প্রভাসের নীরে।।পরশ করিতে অঙ্গ প্রভাসের পানি।সর্ব্বপাপে মুক্ত হইলাম নৃপমণি।।দিব্যমূর্ত্তি ধরিলাম রূপেতে পদ্মিনী।সেই পুণ্যে হইলাম ইন্দ্রের নর্ত্তনী।।ইন্দ্রের সাক্ষাতে নৃত্য করি বারংবার।একদিন পাপবুদ্ধি হইল আমার।।সূর্য্যবংশে মহারাজ খট্টাঙ্গ আছিল।যুদ্ধ হেতু ইন্দ্র তারে বরিয়া আনিল।।অসুরগণের সহ কৈল মহারণ।সবাকারে পরাজিল খট্টাঙ্গ রাজন।।তুষ্ট হয়ে সভাতলে নিল ইন্দ্র তারে।যত্নে করাইল নৃত্য আমা সবাকারে।।খট্টাঙ্গ নৃপতি রূপে পরম সুন্দর।তাঁরে দেখি হৃদে মম বিন্ধে কামশর।।পুনঃ পুনঃ চাহিলাম তাঁহার বদন।দেহি ইন্দ্র ক্রোধে শাপ দিল সেইক্ষণ।।দেবলোক পেয়ে কর মনুষ্য আচার।কিছুকাল কর নরলোকে ব্যবহার।।সে কারণে নরপতি হেথায় বসতি।বিরহিণী আছি সে, না মিলে যোগ্য পতি।।ইহা শুনি হাসি হাসি বলে নৃপমণি।আমারে বরহ যদি আছ বিরহিণী।।চন্দ্রবংশে মম জন্ম, কুরু নাম ধরি।সংসার মধ্যেতে হই আমি অধিকারী।।তোমারে দেখিয়া মম মজিল আমার।কামানলে দহে তনু করহ নিস্তার।।শ্রেষ্ঠ পাটেশ্বরী আমি করিব তোমারে।এত শুনি কন্যা পুনঃ কহিল রাজারে।।নিশ্চয় নৃপতি আমি করিব বরণ।এক সত্য মম আগে করহ রাজন।।আপন ইচ্ছায় আমি করিব যে কাজ।আমারে বারণ নাহি কর মহারাজ।।কুবচন বল যদি ত্যজিব তোমারে।কন্যার বচনে রাজা অঙ্গীকার করে।।কন্যারে লইয়া রাজা গেল নিজ দেশে।নিরবধি কেলি করে অশেষ বিশেষে।।একদিন পরপতি কহিল কন্যারে।জল আনি শীঘ্রগতি দেহ ত আমারে।।কন্যা বলে, এবে মম আছে প্রয়োজন।মুহূর্ত্তেক রহ জল দিবত এখন।।রাজা বলে, পিপাসাতে দহে কলেবর।আমারে আনিয়া জল দেহ ত সত্বর।।নৃপতির বাক্য কন্যা না করে শ্রবণ।ক্রুদ্ধ হয়ে রাজা বলে বহু কুবচন।।ক্রোধেতে করিল নিন্দা বিবিধ প্রকারে।গণিকার জাতি তুই, কি বলিব তোরে।।পুনঃ পুনঃ স্বামীবাক্য করিস হেলন।স্ত্রীজাতি নহিলে তোর নিতাম জীবন।।ইহা শুনি কন্যা হাসি বলিল রাজারে।পূর্ব্ব সত্য পাসরিলে, ছাড়িনু তোমারে।।এইক্ষণে ত্যাগ করি যাব নিজস্থান।এতেক বলিয়া কন্যা হৈল অন্তর্ধান।।কন্যারে না দেখি রাজা আকুল জীবন।কন্যার ভাবনা বিনা অন্যে নাহি মন।।রাজপদে নাহি মতি, সচিন্তিত মন।বিবাহ না করে রাজা, নবীন যৌবন।।বৃদ্ধ মন্ত্রিগণ সব বুঝায় রাজারে।কি হেতু ভূপাল চিন্তা করিছ অন্তরে।।বহুরূপা কন্যা সে ইন্দ্রের নাচনী।ইন্দ্রশাপে হয়েছিল তোমার রমণী।।শাপে মুক্ত হয়ে সেই গেল সুরপুরে।তার হেতু শোক কেন করহ অন্তরে।।যদি তুমি সেই কন্যা ইচ্ছ নৃপবর।ইন্দ্র দেবরাজ হয় সবার ঈশ্বর।।নিয়ম করিয়া কর ইন্দ্র আরাধন।তবে সেই কন্যা প্রাপ্ত হইবে রাজন।।হস্তিনার উত্তরেতে সরস্বতী-তীরে।উপবন আছে তথা তাহার উত্তরে।।নিত্য আসি সুরধেনু চরে সেই বনে।ইন্দ্র-আরাধনা কর সুরভি সেবনে।।তবে পুনর্ব্বার তুমি পাইবে কন্যারে।তত্ত্ব উপদেশ রাজা কহিনু তোমারে।।এত শুনি আনন্দিত হইয়া অন্তরে।বিধিমতে নরপতি ইন্দ্রে স্তুতি করে।।করিল কঠোর তপ শাস্ত্রের বিহিত।সুরভির সেবা রাজা কৈল যথোচিত।।তুষ্টা হয়ে সুরধেনু বলে নৃপতিরে।অভিমত বর রাজা মাগহ আমারে।।তব প্রতি তুষ্ট রাজা হইলাম আমি।মনোনীত বর যাহা, মাগি লহ তুমি।।ইহা শুনি করযোড়ে কহে নৃপমণি।যদি বর দিবে তুমি শুন গো জননি।।বহুরূপা নামে কন্যা আছে সুরপুরে।সেই কন্যা প্রাপ্তি যেন হয় ত আমারে।।স্বস্তি বলি বর তবে দিলেক সুরভি।পাইবে সে কন্যা তুমি দেবরাজে সেবি।।ইন্দ্রমন্ত্র পঞ্চাক্ষর দেই, রাজা লহ।ইন্দ্রমন্ত্র জপি তুমি ইন্দ্রে আবাধহ।।ত্রিরাত্রি জপিলে ইন্দ্র দিবে দরশন।যে বাঞ্ছা করিবে রাজা পাইবে তখন।।এত বলি দিল মন্ত্র প্রসন্ন হইয়ে।হৃষ্টচিত্ত হৈল তবে রাজা মন্ত্র পেয়ে।।ত্রিরাত্র জপিল মন্ত্র বসি একাসন।প্রসন্ন হইল তবে সহস্রলোচন।।সাক্ষাতে দেখিয়া ইন্দ্রে কুরু-নরপতি।দণ্ডবৎ প্রণমিয়াকরে বহু স্তুতি।।তুষ্ট হয়ে ইন্দ্র বলিলেন মাগ বর।এত শুনি বলে রাজা যুড়ি দুই কর।।বহুরূপা নামে যেই তোমার নর্ত্তনী।সেই কন্যা দেহ কৃপা করি সুরমণি।।ইন্দ্র বলে, যাহা ইচ্ছ, দিলাম তোমারে।আর বর মাগ যদি বাঞ্ছহ অন্তরে।।রাজা বলে, যদি আজ্ঞা কর পুরন্দর।এই স্থান হয় যেন পুণ্য ক্ষেত্রবর।।কুরুক্ষেত্র নাম হয়, পুণ্যক্ষেত্র সার।ইথে যুদ্ধ করি যেই হইবে সংহার।।ভূঞ্জিবে অক্ষয় স্বর্গ সহিতে তোমার।এই বর আজ্ঞা কর দেব গুণাধার।।ইন্দ্র বলিলেন, পূর্ণ তব মনস্কাম।পুণ্যক্ষেত্র হৈল এই, কুরুক্ষেত্র নাম।।এত বলি ইন্দ্র আজ্ঞা দিল মাতলিরে।বহুরূপা কন্যা তুমি আনি দেহ এরে।।ইন্দ্রের আজ্ঞায় কন্যা তথায় আনিল।সেইক্ষণে নৃপ তারে বিবাহ করিল।।অনেক যৌতুক তারে দিল সুরপতি।অন্তর্ধান হয়ে ইন্দ্র গেলেন বসতি।।ইন্দ্রের বরেতে সেই পুণ্যক্ষেত্র হৈল।কুরুক্ষেত্র বলি নাম জগতে ব্যাপিল।।তবে কন্যা লভি তথা হৈতে নরপতি।হৃষ্ট চিত্ত গেল পরে আপন বসতি।।মদগর্ব্বে সুরভিরে সম্ভাষ না কৈল।সেই হেতু সুরধেনু নৃপে শাপ দিল।।এই অহঙ্কারে পুত্র না হইবে তোর।এত বলি প্রবেশিল পাতাল ভিতর।।এ সকল বৃত্তান্ত না শুনিল রাজন।ইন্দুমতী লয়ে কেলি করে অনুক্ষণ।।পুত্র না হইল তার যুবাকাল গেল।এত ভাবি রাজা তবে সচিন্তিত হৈল।।বহু দান যজ্ঞ তবে করিল নৃপতি।পুত্র না হইল, রাজ চিন্তাকুল মতি।।কুল-পুরোহিত যে বশিষ্ঠ তপোধন।ভার্য্যা সহ তাঁর কাছে করে নিবেদন ।।দণ্ডবৎ প্রণমিয়া করে বহু স্তুতি।হৃষ্ট হয়ে দোঁহে আশ্বাসিল মহামতি।।মনোনীত বর মাগি লহ দুই জনে।যেই বর ইচ্ছা কর মাগ মম স্থানে।।ইহা শুনি রাণী সহ কহে নরপতি।পুত্রবর আজ্ঞা মোরে কর মহামতি।।তব বরদান মোরা হই পুত্রবান।ইহা বিনা তোমারে না মাগি বর আন।।এত শুনি ধ্যানস্থিত হয়ে মুনিবর।সুরভির শাপে অপুত্রক নৃপবর।।জানিয়া কারণ তার কহিল রাজারে।হইবে অবশ্য পুত্রবান মম বরে।।কিন্তু সুরভির শাপ আছয়ে তোমায়।সে কারণে রাজা তব না হয় তনয়।।অভিমানে পাতালেতে গেলেন জননী।মম গৃহে আছে রাজা তাঁহার নন্দিনী।।নিয়ম করিয়া সেবা করহ তাঁহার।অচিরেতে পুত্র রাজা হইবে তোমার।।সম্বৎসর সেবা তাঁর কর নৃপমণি।ভজুক দাসীর মত তোমার রমণী।।তবে সে নৃপতি তুমি হবে পুত্রবান।অমনি নন্দিনী ধেনু আসে বিদ্যমান।।নন্দিনীরে কহি মুনি কহিল রাজারে।হইবে তোমার কার্য্যসিদ্ধি মম বরে।।এই নন্দিনীরে তুমি সেবহ রাজন।এক সম্বৎসর রাজা করিয়া নিয়ম।।মুনির বচনে রাজা সেবিল তাঁহারে।নিয়ম করিয়া রাজা এক সম্বৎসরে।।রাজার সেবনে গবী সন্তুষ্টা হইল।জননীরে সাধি তার শাপান্ত করিল।।শাপে মুক্ত হয়ে রাজা হৈল পুত্রবান।দুই পুত্র জনমিল মহামতিমান।।প্রথম পুত্রের নাম স্বয়ম্বর রাখে।তাহা হৈতে কুরুবংশ বাড়িবারে লাগে।।অবশেষে পুত্রে রাজ্য দিয়া নরবর।ইন্দুমতী সহ গেল বনের ভিতর।।সাধিয়া পরম যোগ পায় দিব্যগতি।কহিনু তোমারে এই পূর্ব্বের ভারতী।।শীঘ্রগতি যাহ তুমি না কর বিলম্ব।কুরুক্ষেত্রে কর গিয়া গড়ের আরম্ভ।।হইবে দারুণ যুদ্ধ না হৈবে খণ্ডন।কুলক্ষয় হেতু বাঞ্ছা কৈল দুর্য্যোধন।।ইহা শুনি ধৃষ্টদ্যুন্ন হৈল হৃষ্টমতি।বহু অনুচরগণ লইল সংহতি।।দুই অক্ষৌহিণী বলে চলিল ত্বরিত।কুরুক্ষেত্র মধ্যে গিয়া হৈল উপনীত।।খনকগণেরে আজ্ঞা দিল সেইক্ষণ।রচিল অদ্ভূত গড়খাই বিচক্ষণ।।স্থানে স্থানে বিরচিল দিব্য দিব্য ঘর।রাজগণ রহিবারে আবাস বিস্তর।।অশ্বশালা বিরচিল আর গজাগার।নানা অস্ত্র শস্ত্রে পূর্ণ করিল ভাণ্ডার।।ভক্ষ্য ভোজ্য দ্রব্য আনাইলেন বিস্তর।দুলক্ষ প্রহরী রাখে করি থরে থর।।নির্ম্মাইয়া গড়খাই আসিল সত্বর।নিবেদন করিলেন রাজার গোচর।।শুনি হৃষ্টমন হৈল ভাই পঞ্চ জন।যুদ্ধ হেতু রাজগণে লিখিল লিখন।।কারস্কর রাজা আর রাজা জয়সেন।শিশুপাল পুত্র সহদেব সুলক্ষণ।।কাশীরাজ সুষেণ ও সুমিত্র নৃপতি।অঙ্গরাজ কারক্ষর সুধর্ম্মা প্রভৃতি।।বাহলীক নৃপতি আর যতেক রাজন।দূতমুখে শুনি পাণ্ডবের নিমন্ত্রণ।।চতুরঙ্গ দলে সাজি কুরুক্ষেত্রে এল।যুদ্ধের সামগ্রী দ্রব্য অনেক আনিল।।সাত অক্ষৌহিণী সেনা আসিয়া মিলিল।নানা বাদ্য-কোলাহলে পৃথিবী পূরিল।।সাত অক্ষৌহিণীপতি হৈল পঞ্চ জন।একাদশ অক্ষৌহিণীপতি দুর্য্যোধন।।অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী হৈল সৈন্যগণে।কোলাহলে মহাশব্দে, না শুনি শ্রবণে।।কুরুক্ষেত্রে দুই দল সমানে রহিল।নানা অস্ত্র শস্ত্র সবে সঞ্চয় করিল।।মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।১৩. শ্রীকৃষ্ণের নিকট দুর্য্যোধন কর্ত্তৃকউলূককে দূতরূপে প্রেরণের মন্ত্রণামুনি বলে, শুন শুন রাজা জন্মেজয়।তবে দুর্য্যোধন রাজা চিন্তিল হৃদয়।।দ্বারকা গেলেন কৃষ্ণ, পেয়ে সমাচার।বরিবারে দূত পাঠাইল আগুসার।।গোবিন্দেরে লিখিলেন সব বিবরণ।কৌরব পাণ্ডবে হবে ঘোরতর রণ।।উভয় কুলের হিত কুটুম্ব আপনি।সে কারণে অগ্রে তোমা বরিলাম আমি।।মহারণে হবে তুমি আমার সারথি।এত বলি দূত পাঠাইল শীঘ্রগতি।।তবে মন্ত্রিগণ লয়ে কৌরবের পতি।নিভৃতে বসিয়া যুক্তি করে মহামতি।।ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ আর সুবল-নন্দন।দুঃশাসন কর্ণ আদি যত মন্ত্রিগণ।।রাজা বলে, একমনে শুন সভাজন।দুই কুল হিত হন দেব নারায়ণ।।হইবে ভারত যুদ্ধ, না হবে খণ্ডন।সম্বন্ধে সমান হন দেব জনার্দ্দন।।দূত পাঠাইনু আমি বুঝিতে রহস্য।দুই কুল হিত কৃষ্ণ করিবে অবশ্য।।সে হেতু বুঝিব আমি কৃষ্ণ বলাবল।পাণ্ডবের প্রিয় কিবা জানিব সকল।।মম হিতাহিত কৃষ্ণ করে বা না করে।পাঠাইনু দূত তাহা বুঝিবার তরে।।ইহা শুনি কহে ভীষ্ম গঙ্গার নন্দন।না বুঝিয়া দুত পাঠাইলে অকারণ।।ত্রিভুবন জ্ঞাত, কৃষ্ণ পাণ্ডবের হিত।তোমার স্বপক্ষ নাহি হবে কদাচিত।।কর্ণ বলে, মম চিত্তে না লয় এ কথা।পাণ্ডবের হিত কৃষ্ণ, জানি যে সর্ব্বথা।।তোমার অহিত কৃষ্ণ, জানি নিজ মনে।কি বুঝিয়া দূত পাঠাইলে তার স্থানে।।যদি বা স্বপক্ষ তব হয় কদাচন।কপট করিয়া নাশিবেক সর্ব্বজন।।মুখেতে সুতৃপ্ত ভাষা, অন্তরেতে আন।তোমার পরম শত্রু দেব ভগবান।।কিন্তু বলভদ্র হয় তব প্রতি প্রীত।তাঁহারে বরিতে যুদ্ধে হয়সমুচিত।।তীর্থ যাত্রা করি ভ্রমে সেই বলরাম।দূত পাঠাইয়া রাজা দেহ তাঁর স্থান।।তোমার সহায় হবে দেব সঙ্কর্ষণ।হেন মম চিত্তে লয় শুনহ রাজন।।শকুনি বলিল, ভাল বলিলে যুকতি।তোমার সহায় হবে রেবতীর পতি।।মহাবলবন্ত রাম সংগ্রামে প্রচণ্ড।দৃষ্টিমাত্রে পাণ্ডবের করিবেক খণ্ড।।রাজা বলে, যা কহিলে সখে সারোদ্ধার।মম হিতকারী সেই রোহিণী-কুমার।।কিন্তু তীর্থযাত্রা হেতু গেলা সঙ্কর্ষণ।গোবিন্দেরে দূত পাঠাইনু সে কারণ।।সম্বন্ধে বেহাই হয় দেব জগৎপতি।মনে লয়, মম সঙ্গে করিবেন প্রীতি।।দুঃশাসন বলে, মম মনে নাহি লয়।পাণ্ডবের বড় প্রিয় দেবকী তনয়।।তোমার সহায় নাহি হবে কদাচন।না বুঝিয়া দূত পাঠাইলে কি কারণ।।ইহা শুনি কহিল, শকুনি দুরাশয়।উভয় কুলের হিত দেবকী-তনয়।।আপনি সহায় যদি না হন তোমার।নারায়ণী সেনা তাঁর আছয়ে অপার।।সেই সৈন্য হয় যদি তোমার স্বপক্ষ।চিত্তে হেন লয়, জয় হইবে প্রত্যক্ষ।।নারায়ণী সেনা তাঁর মহাবলবান।সমরে অজেয় তারা দেবের সমান।।সেই সৈন্য হয় যদি তোমার স্বপক্ষ।চিত্তে হেন লয়ম জয় হইবে প্রত্যক্ষ।।নারায়ণী সেনা তাঁর মহাবলবান।সমরে অজেয় তারা দেবের সমান।।সেই সৈন্য দেন যদি দেবকী কুমার।কিবা প্রয়োজন কৃষ্ণে আছয়ে তোমার।।এতেক সহায় হৈলে কি করিবে রণে।জগতে বিখ্যাত আছে তার বীরপণে।।জরাসন্ধ-ভয়ে যান মথুরা ত্যজিয়া।সমুদ্রের কূলে গিয়া রহে লুকাইয়া।।তারে রবি কোন্ কর্ম্ম হইবে তোমার।তারে বারিবারে যুক্তি নহে মো সবার।।রণে পলাইয়া যায় শৃগালের প্রায়।হেন জনে বরিবারে মনে নাহি লয়।।যেই জরাসন্ধ ভয়ে পলাইয়া গেল।কর্ণ মহাবীর তারে সমরে জিনিল।।কর্ণের সমান বীর নাহি ত্রিভুবনে।মুহূর্ত্তেকে সংহারিবে পাণ্ডুর নন্দনে।।ইন্দ্র আদি সখা যদি করিবে পাণ্ডব।তথাপি কর্ণের হাতে পাবে পরাভব।।প্রতাপেতে কার্ত্তবীর্য্যার্জ্জুনের সমান।ইন্দ্র আদি দেব করে যাহার বাখান।।ধনুর্দ্ধরগণে গণি ভৃগু-বংশপতি।জগতে বিখ্যাত আর কর্ণ মহামতি।।কর্ণের শতাংশ নাহি গণি নারায়ণে।তারে তবে যুদ্ধে বরি কোন্ প্রয়োজনে।।রাজা বলে, যুদ্ধ হেতু না বরিনু তারে।আমার সারথি যেন হয় যে সমরে।।সারথির যোগ্য হয় দেব নারায়ণ।সারথি করিয়া তবে করিব বরণ।।এত শুনি দ্রোণ কৃপ বলেন হাসিয়া।হেন বাক্য মুখে রাজা আন কি বুঝিয়া।।তোমার সারথি হবে দেব নারায়ণ।অসম্ভব কথা এই নাহি লয় মন।।পাণ্ডব-সহায় সেই দেব জগৎপতি।কিমতে হবেন কৃষ্ণ তোমার সারথি।।ধৃতরাষ্ট্র বলে, ইহা দূতকর্ম্ম নয়।আপনি বরহ গিয়া দেবকী তনয়।।সসৈন্যে দ্বারকাপুরী যাহ দুর্য্যোধন।সাক্ষাতে বরিলে সেই মানিবে বচন।।দুর্য্যোধন বলে, আগে শুনি দূতস্থানে।কি বলয়ে আগে শুনি দেব নারায়ণে।।হয় বা না হয় কৃষ্ণ আমার সারথি।দূতমুখে পাইব যে ইহার ভারতী।।বলাবল বুঝি কার্য্য করিব তখন।নহে বা আপনি গিয়া করিব বরণ।।ধৃতরাষ্ট্র বলে, ভাল কৈলে যুক্তি সার।আপনি বরহ গিয়া দেবকী-কুমার।।যাবৎ না বরে পঞ্চ পাণ্ডুর কুমার।সসৈন্যে দ্বারকা তুমি হও আগুসার।।উভয় কুলের হিত দেব জগৎপতি।সম্প্রীতি করিবে কৃষ্ণ বুঝি কার্য্যগতি।।পিতার বচনে ক্রোধে বলে দুর্য্যোধন।সম্প্রীতি করিতে চাহ কোন্ প্রয়োজন।।জীবন্তে পাণ্ডব সহ নাহি মোর প্রীত।উচিত যে হয় তাহা, করহ বিহিত।।বিদুর এতেক শুনি কহেন তখন।বিপদ সময় জ্ঞান হারায় সুজন।।আরে দুর্য্যোধন তোর হেন লয় মন।তোমার সারথি হইবেন নারায়ণ।।ব্রহ্মা শিব ইন্দ্র আদি দেব যত জন।উদ্দেশে যাঁহার করে চরণ সেবন।।বার বার অবতার হয়ে জগন্নাথ।করিলেন কোটি কোটি অসুর নিপাত।।মৎস্য কলেবর ধরি দেব নারায়ণ।দৈত্য মারি করিলেন বেদ উদ্ধারণ।।কূর্ম্ম অবতার হয়ে শ্রীমধুসূদন।করিলেন পৃষ্ঠদেশে ধরণী ধারণ।।অনন্তর ধরি কৃষ্ণ বরাহ আকৃতি।হিরণ্যাক্ষে বধি উদ্ধারিলা বসুমতী।।ধরিয়া নৃসিংহরূপ হইয়া প্রকাশ।হিরণ্যকশিপু দৈত্য করিলা বিনাশ।।ধরিয়া বামনরূপ দেব নারায়ণ।পাতালে নিলেন বলি করিয়া ছলন।।ভৃগুবংশে রামরূপে হয়ে অবতার।নিঃক্ষত্রা করেন ক্ষিতি তিন সপ্ত বার।।রামরূপে বধিলেন লঙ্কার রাবণ।হলধর বেশধারী আছেন এখন।।পূর্ণব্রহ্ম অবতার কৃষ্ণ যদুমণি।আগম পুরাণে যাঁর মহিমা বাখানি।।হেন কৃষ্ণ সূতবৃত্তি করিবে তোমার।হেন বাক্য না বুঝিয়া বল বারে বার।।কিন্তু ভক্তিবশ হন দেব হৃষীকেশ।ভক্তের কামনা পূর্ণ করেন অশেষ।।অভক্ত গোবিন্দে তুমি, বিখ্যাত জগতে।তোমার সারথি কৃষ্ণ হবেন কিমতে।।এইরূপে কহিলেন বিদুর সুমতি।শুনি কিছু উত্তর না দিল কুরুপতি।।সভা হৈতে উঠি রাজা গেল অন্তঃপুরে।সব কুরুগণ গেল যে যাহার ঘরে।।১৪. দ্বারকায় শ্রীকৃষ্ণের নিকট উলূকের গমনজন্মেজয় জিজ্ঞাসিল, কহ তপোধন।অতঃপর কি করিল কুরুর নন্দন।।তবে দ্বারকায় দূত গেল কোন্ জন।দূত মুখে শুনি কিবা নহে নারায়ণ।।বিবরিয়া আমারে বলহ মুনিবর।শুনিয়া তোমার মুখে জুড়াক অন্তর।।মুনি বলে, শুন শুন নৃপ জন্মেজয়।উলূকেরে পাঠাইল কুরু মহাশয়।।দুর্য্যোধন আদেশেতে যায় অনুচর।শীঘ্রগতি চলি গেল দ্বারকা নগর।।কৃষ্ণের সাক্ষাতে গিয়া হৈল উপনীত।দণ্ডবৎ করি পত্র দিলেন ত্বরিত।।পড়িলেন পত্র কৃষ্ণ ঈষৎ হাসিয়া।পঠনান্তে কহিছেন দূতেরে চাহিয়া।।দুই কুল হিত আমি বিখ্যাত ভুবন।উভয় কুলের হিত চিন্তি অনুক্ষণ।।দুর্য্যোধনে কহিবে যে বচন আমার।ভাই ভাই বিরোধিয়া কি কার্য্য তোমার।।তোমাতে অপ্রীত নহে পাণ্ডুর নন্দন।গন্ধর্ব্বের হাতে তোমা রাখিল অর্জ্জুন।।সভামধ্যে পূর্ব্বে যেই করিলে নির্ণয়।তাহাতে হইল মুক্ত পাণ্ডুর তনয়।।আপনি কহিলে তুমি সভা বিদ্যমান।সত্য হৈতে মুক্ত হৈলে পাণ্ডুর সন্তান।।পুনর্ব্বার আপনার পাবে রাজ্যধন।তবে কেন কলহেতে করিতেছ মন।।সমুচিত পাণ্ডবের বিভাগ যে হয়।তাহা দিয়া প্রীত কর, পাণ্ডুর তনয়।।এইরূপে দুর্য্যোধনে কহিবে আপনে।পশ্চাতে যাইব আমি সবা বিদ্যমানে।।সারথির হেতু যাহা কহিলে আমারে।করিব সারথিপণ তাঁহার গোচরে।।কিন্তু আগে মোর পাশে বলে ধনঞ্জয়।অঙ্গীকার করিয়াছি, শুন মহাশয়।।তথাপি তোমার বাক্য না পারি খণ্ডিতে।আপনি আসিবে হেথা আমারে বরিতে।।আসিবে আমারে পার্থ করিতে বরণ।পঞ্চম দিবসে হবে পার্থ আগমন।।আমারে আসিয়া অগ্রে যে জন বরিবে।তাহারি সারথ্য মম করিতে হইবে।।এইরূপে দুর্য্যোধনে কহিবে বচন।এত বলি দূতে পাঠাইল নারায়ণ।।তবে যদুবল লয়ে দেব জগৎপতি।গুপ্তভাবে পরামর্শ করে মহামতি।।কৌরব পাণ্ডবে দোঁহে হবে মহারণ।সে কারণে দুর্য্যোধন পাঠায় লিখন।।পাণ্ডব আমারে পূর্ব্বে করিল বরণ।দুই কুল হিত আমি, জানে জগজ্জন।।কাহার স্বপক্ষ হৈব, করিব কেমন।ইহার সুযুক্তি যাহা কহ সর্ব্বজন।।ইহা শুনি কহিলেন যত যদুগণ।কপটী কুবুদ্ধি খল রাজা দুর্য্যোধন।।তাহার স্বপক্ষ হৈতে উচিত না হয়।বিশেষে তোমার প্রিয় পাণ্ডুর তনয়।।যদি বা বরিতে তোমা আসে দুর্য্যোধন।তাহার সহায়ে দেহ কিছু সৈন্যগণ।।কপট করিয়া তার কর উপকার।আমা সবা চিত্তে লয়, এই ত বিচার।।যদুগণ-বাক্য শুনি দেব নারায়ণ।শিল্পকারগণে আজ্ঞা দিলেন তখন।।দিব্য সিংহাসন এক করহ নির্ম্মাণ।ইন্দ্রের আসন জিনি তাহার বাখান।।নানারত্ন মাণিক্যেতে সুবর্ণ জড়িত।প্রবাল মাণিক্য গজদন্তে বিরচিত।।সত্বরে রচিয়া দেহ আমার অগ্রেতে।আজ্ঞামাত্র শিল্পিগণ লাগিল গঠিতে।।তিন দিবসের মধ্যে গঠি সিংহাসন।গোবিন্দের অগ্রে আনি দিল ততক্ষণ।।পঞ্চম দিবস পরে দেব নারায়ণ।বাহির মন্দিরে গিয়া করেন শয়ন।।সংকীর্ণ রহিল স্থান শিতানের পানে।রত্ন-সিংহাসন রাখিলেন সেই স্থানে।।পাছে রাখিলেন স্থান বুঝিয়া বিস্তার।অচেতনে নিদ্রা যান দেবকী-কুমার।।মহাভারতের কথা সুধা সম হয়।পয়ার প্রবন্ধে কাশীরাম দাস কয়।।১৫. উলূকের প্রত্যাবর্ত্তন ওদুর্য্যোধনের দ্বারকা গমনদূত গিয়া দুর্য্যোধনে কহিল বারতা।আপনি বরিতে কৃষ্ণে যাহ তুমি তথা।।আপনি অর্জ্জুন আসি বরিবে কৃষ্ণেরে।সে কারণে নারায়ণ কহিলা আমারে।।প্রথমে আমারে আসি যে জন বরিবে।তার পক্ষ অবশ্যই মোরে হতে হবে।।সমান সম্বন্ধ মম কুরু পাণ্ডুগণ।দুই কুল হিত আমি চিন্তি অনুক্ষণ।।আর যে কহিল, তাহা শুন কুরুপতি।পাণ্ডবের সহ তোমা করিতে পীরিতি।।পাণ্ডবের সহ বিরোধিতে নিষেধিল।সব যদুগণে তাহে অনুমতি দিল।।অল্পকার্য্যে কুলক্ষয় নাহি প্রয়োজন।চিত্তে যাহা লয়, তাহা করহ রাজন।।এতেক দূতের বাক্য শুনি মহারাজ।মুহূর্ত্তেকে যাত্রা কৈল না করিল ব্যাজ।।অল্প সৈন্য সঙ্গে নিল শীঘ্র যাইবার।দ্বারকা নগরে রাজা হইল আগুসার।।দুর্য্যোধন উত্তরিল দ্বারকা নগরে।সৈন্য সব রাখি গেল পুরের বাহিরে।।একেশ্বর পুরে প্রবেশিল কুরুনাথ।যেই গৃহে নিদ্রাগত আছে জগন্নাথ।।তথা গিয়া উত্তরিল রাজা দুর্য্যোধন।অচেতনে নিদ্রা যান দেব নারায়ণ।।দিব্য সিংহাসন দেখে কৃষ্ণের শিয়রে।ভৃঙ্গারেতে জল আছে, দেখিল শিয়রে।।বিস্ময় মানিয়া রাজা ভাবে মনে মন।আমার মর্য্যাদা বেশ জানে নারায়ণ।।না আসিতে আমি হেথা দিব্য সিংহাসন।আপন শিয়রে কৃষ্ণ করেছে স্থাপন।।পাদ্য অর্ঘ্য রাখিয়াছে দিব্য জলাধার।আমার সম্ভ্রম হেতু নানা উপচার।।নিশ্চয় হইবে কৃষ্ণ আমার সারথি।এত বলি সিংহাসনে বসে কুরুপতি।।পরে ধনঞ্জয় আসিলেন ভক্তি করি।একাকী প্রবেশ করিলেন অন্তঃপুরী।।বসুদেব উগ্রসেন আদি যদুগণে।একে একে প্রণমিল যথাযোগ্য জনে।।মাতুলগণেরে পার্থ করিয়া সম্ভাষ।তথা হৈতে চলিলেন যথা শ্রীনিবাস।।অচেতনে নিদ্রাগত আছে নারায়ণ।শিয়রে বসিয়া তাঁর রাজা দুর্য্যোধন।।সিংহাসনে বসিয়াছে বাসবের প্রায়।দেখি চিত্তে চিন্তা করিলেন ধনঞ্জয়।।ভাবিয়া চিন্তিয়া পার্থ যুক্তি করি মনে।বসিলেন গিয়া কৃষ্ণ-পাদপদ্মাসনে।।কৃষ্ণের চরণপদ্ম চাপে ধীরে ধীরে।দেখি দুর্য্যোধন ক্রুদ্ধ হইল অন্তরে।।বলিতে না পারে কিছু ভাবে মনে মন।কুরুবংশে জন্মি করে হেন আচরণ।।বংশের অধম এই কুলের অঙ্গার।কোন্ বা বড়াই এই দেবকী-কুমার।।আমারে নাহিক ভয় নাহি লাজ মনে।ব্যর্থ নাম পার্থ বলি ধরে অকারণে।।অন্য হৈলে করিতাম এখনি সংহার।বিশেষ আমার শত্রু জ্ঞাতি পাপাচার।।এইরূপে মনে মনে নিন্দিছে রাজন।সব জানিলেন অন্তর্য্যামী নারায়ণ।।তথাপি উত্তর কিছু না দিলেন হরি।নিদ্রায় অলস যেন সিংহাসনোপরি।।কতক্ষণে নিদ্রাভঙ্গ হইল তাঁহার।উঠিয়া সম্মূখে দেখে কুন্তীর কুমার।।আলিঙ্গন দিয়া জিজ্ঞাসিলেন কুশল।একে একে ধনঞ্জয় কহেন সকল।।অবশেষে শ্রীগোবিন্দে কহে ধনঞ্জয়।কৌরব পাণ্ডবে যুদ্ধ হইবে নিশ্চয়।।তেঁই যুধিষ্ঠির পাঠাইলেন আমারে।সারথি করিয়া যুদ্ধে তোমা বরিবারে।।রথের সারথি তুমি হইবে আমার।এত শুনি শ্রীগোবিন্দ করে অঙ্গীকার।।শুনিয়া অর্জ্জুন হইলেন হৃষ্টমন।পরে দেখিলেন কৃষ্ণ রাজা দুর্য্যোধন।।মান্য করি সম্ভাষেন উঠি নারায়ণ।কি আনন্দ, আজি দেখি কৌরব-নন্দন।।কোন প্রয়োজনে হেথা কৈলে আগমন।কি কার্য্য তোমার কহ, করিব সাধন।।যদি বা দুষ্কর কর্ম্ম হয় অতিশয়।আমা হৈতে হয় যদি করিব নিশ্চয়।।তব কার্য্যে প্রীত আমি, তব আজ্ঞাকারী।যে আজ্ঞা করিবে, তাহা সাধিবারে পারি।।সমান সম্বন্ধ মম কুরু পাণ্ডুগণ।উভয় কুলের হিত বাঞ্ছি অনুক্ষণ।।চন্দ্র সূর্য্য তেজে যথা নাহি ভিন্ন জ্ঞান।সেইরূপে দুইকুল রাখিব সমান।।উভয় কুলের হিত করি প্রাণপণ।যে আজ্ঞা করিবে তাহা করিব সাধন।।ইহা শুনি বলে তবে রাজা দুর্য্যোধন।আগে দূতমুখে তোমা করিনু বরণ।।তাহাতে করিলে অঙ্গীকার নারায়ণ।যে জন আমারে আগে করিবে বরণ।।তাহার স্বপক্ষ আমি হইব নিশ্চয়।সে কারণে আসিলাম তোমার আলয়।।বহুক্ষণ হৈল, আমি আসিয়াছি হেথা।পশ্চাৎ আসিল হেথা পার্থ মহারথা।।তোমার সারথ্যগুণ বিখ্যাত ভুবনে।ইন্দ্রের মাতলি সম শুনিনু শ্রবণে।।মহাযুদ্ধে হবে তুমি আমার সারথি।সে কারণে এই স্থানে আসি যদুপতি।।ইথে মান অপমান নাহি যদুমণি।অবধান কর কহি পূর্ব্বের কাহিনী।।ত্রিপুর জিনিতে যবে যান শূলপাণি।ব্রহ্মারে সারথি কৈল পরাক্রম জানি।।ত্রিপুর-বিজয়ী শিব সারথির গুণে।বৃহ্স্পতি সারথি যে ইন্দ্র-দৈত্যরণে।।দেবের পরম গুরু অঙ্গিরানন্দন।স্বধর্ম্ম জানিয়া তবু করে সূতপণ।।বৃহস্পতিরে সারথি করি বজ্রপাণি।বৃত্রাসুরে মারিলেন, বিখ্যাত ধরণী।।গোবিন্দ বলেন, তুমি কহিলে প্রমাণ।আগে মোরে বরিয়াছে অর্জ্জুন ধীমান।।আগে তুমি আসিয়াছ জানিব কেমনে।আগে আমি অর্জ্জুনেরে দেখেছি নয়নে।।সারথি করিয়া মোরে করিল বরণ।ইহার উপায় কিবা কহ দুর্য্যোধন।।ব্যতিক্রম করি যদি দুই কুল হিতে।আমার কুযশ বহু ঘুষিবে জগতে।।দশ দিন করি যদি পার্থের সারথ্য।দশ দিন করি যদি তোমার সূতত্ব।।এমত নিয়ম হলে উপহাস লোকে।সে কারণে দুয্যোধন কহি যে তোমাকে।।তুমি কুরুপতি রাজা জগতে বিদিত।তোমার মর্য্যাদা গুণ ঘোষে অপ্রমিত।।কুরুবংশে যদুবংশে চেদি ভোজবংশে।রবিবংশোদ্ভব যত রাজা অবতংশে।।তব কার্য্যে হিত সবে তোমার শাসিতে।তোমার অপ্রিয় কেহ নহে পৃথিবীতে।।তোমারে করিবে মান্য যত রাজগণ।অগ্রেতে করিল পার্থ আমাকে বরণ।।তীর্থযাত্রা হেতু যবে যান হলপাণি।কুরু পাণ্ডবের দ্বন্দ্ব চরমুখে শুনি।।যুদ্ধ করিবারে করিলেন নিবারণ।খণ্ডিতে না পারি আমি তাঁহার বচন।।আমা আদি করি সবে যত যদুগণ।যুদ্ধ করিবারে মানা করিল তখন।।উভয় কুলের কোন পক্ষ না হইব।রামের বচন কেহ লঙ্ঘিতে নারিব।।করিব কেবল আমি মাত্র সূতপণ।সে কারণে কহি আমি রাজা দুর্য্যোধন।।নারায়ণী সেনা মম আছে কোটি সাত।মম সম তেজবন্ত জগতে বিখ্যাত।।মহাবলবান সবে বিক্রমে অপার।এক এক জন হয় সান আমার।।প্রতাপেতে কার্ত্তবীর্য্য সম জনে জন।মহারথি মধ্যে গণি বিপক্ষে শমন।।আমাকে ইচ্ছহ কিম্বা সেনা নারায়ণী।নিশ্ছয় আমাকে কহ নৃপ-চূড়ামণি।।ইহা শুনি দুর্য্যোধন ভাবিল অন্তরে।কোন্ কার্য্য সিদ্ধ হবে নিলে গোবিন্দেরে।।নারায়ণী সেনা যদি পাই কোটি সাত।করিব তুমুল যুদ্ধ পাণ্ডবের সাথ।।একাকী ইহারে নিলে হবে কোন্ কাজ।এতেক ভাবিয়া চিত্তে কহে কুরুরাজ।।আমার সহায় দেহ সেনা নারায়ণী।আমারে সাহায্য এই কর চক্রপাণি।।গোবিন্দ বলেন, রাজা যে ইচ্ছা তোমার।শুনি হৃষ্টচিত্ত হৈল কৌরব-কুমার।।নারায়ণী সেনা লয়ে গেল দুর্য্যোধন।দেখিয়া অর্জ্জুন হৈল বিষণ্ন বদন।।জয় প্রভু জগন্নাথ, জয় চক্রধারী।তোমার মহিমাগুণ কি বর্ণিতে পারি।।শিষ্ট জনে পাল তুমি, দুষ্টেরে সংহার।এই হেতু জগনআথ নাম যে তোমার।।দারুরূপে পূর্ণব্রহ্ম নীলাচলে বাস।জগজ্জন হিতে তব অতুল প্রকাশ।।অনুক্ষণ তোমার চরণে রহু নতি।কাশীরাম দাস কহে মধুর ভারতী।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon