মহাভারত:উদ্যোগপর্ব-০১৬-০২০

১৬. নারায়ণী সেনা লইয়া দুর্য্যোধনের
হস্তিনায় প্রত্যাগমন
নারায়ণী সেনা লয়ে গেল দুর্য্যোধন।
নানাবাদ্য কোলাহলে মহা হৃষ্টমন।।
পথে শল্যরাজা সহ হৈল দরশন।
তাঁহার সহিত গিয়া করিল মিলন।।
শল্যেরে সম্ভাষ করি কহে দুর্য্যোধন।
যুদ্ধ হেতু তোমা আমি করিনু বরণ।।
শল্য বলে, যেই আজ্ঞা তব মহাশয়।
তোমার স্বপক্ষ আমি হইব নিশ্চয়।।
কিন্তু পাণ্ডুপুত্রগণ ভাগিনা আমার।
যাই আমি, তাহা সহ দেখা করিবার।।
দিবস অতীত বহু নাহিক মিলন।
দেকিয়া আসিব আমি পাণ্ডুপুত্রগণ।।
দুর্য্যোধন বলে, তথা কি কাজ তোমার।
নিকটে দেখিবে হেথা পাণ্ডুর কুমার।।
আমার স্বপক্ষ হৈলে কেন যাবে তথা।
দেখিলে ‍না ছাড়ি দিবে ভীম মহারথা।।
সত্যবাদীগণ মধ্যে গণি যে তোমায়।
সত্যভ্রষ্ট হৈতে চাহ, বুঝি অভিপ্রায়।।
ইহা শুনি শল্য স্থির করিলেন মন।
সসৈন্যে সাজিয়া গেল সহ দুর্য্যোধন।।
আর যত রাজগণ মধ্যদেশে ছিল।
যুদ্ধ হেতু দুর্য্যোধন সবারে বলিল।।
একাদশ অক্ষৌহিণী করি সমাবেশ।
আপনার উপায় না গণিল বিশেষ।।
মদগর্ব্বে দুর্য্যোধন আশা করে হেন।
পাণ্ডবে জিনিয়া ত্বরা লবে রাজ্যধন।।
ক্ষত্রধর্ম্ম শাস্ত্রনীতি করি কুরুপতি।
মাত্র মিত্র ভৃত্যগণ অমাত্য সংহতি।।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ শল্য রাধার তনয়।
সোমদত্ত বীর ভূরিশ্রবা মহাশয়।।
দুঃশাসন দুর্ম্মুখ শকুনি সৌবল।
নৃপতি সুশর্ম্মা ভগদত্ত মহাবল।।
ধৃতরাষ্ট্র নরপতি বিদুর সুমতি।
সভা করি বসি আছে কৌরবের পতি।।
সবারে চাহিয়া বলে রাজা দুর্য্যোধন।
মম মনস্কাম পূর্ণ হইল এখন।।
একাদশ অক্ষৌহিণী হইল সঙ্গতি।
সত কোটী মহারথী আমার সংহতি।।
আমারে জিনিতে পারে, কে আছে সংসারে।
অবহেলে পরাজিব পাণ্ডুর কুমারে।।
কর্ণের প্রতাপ সহে আছে কোন জনে।
একশ্বর পরাজিবে পাণ্ডুর নন্দনে।।
যত যত বীর আছে আমার অধীনে।
পাণ্ডবে জিনিতে পারে এক এক জনে।।
পাণ্ডবেরে ভয় কিবা আছয়ে আমার।
একাদশ অক্ষৌহিণী মম পরিবার।।
শুন পিতামহ ভীষ্ম মাতুল আচার্য্য ।
প্রাণপণে কর সবে আমার সাহায্য।।
ক্ষত্রধর্ম্ম শাস্ত্রমত জানহ আপনে।
পাণ্ডবের উপোধ না করিহ মনে।।
উপরোধে পাণ্ডবেরা কভু না ক্ষমিবে।
কদাচিৎ উপরোধ তারে না করিবে।।
রাজার বচন শুনি কহে কুরুগণ।
না বুঝিয়া হেন বাক্য কহ দুর্য্যোধন।।
কখন তোমার শত্রু না হয় পাণ্ডব।
কি কারণে দুর্য্যোধন কহ এত সব।।
মো সবার শক্তি যত করিব সর্ব্বদা।
না পারিব জিনিতে পাণ্ডব মহারথা।।
দেবের অবধ্য বীর পাণ্ডুর নন্দন।
মহাযুদ্ধে বিশারদ, প্রতাপে তপন।।
তাহারে জিনিবে হেন আছে কোন্ বীর।
বিশেষতঃ ধর্ম্ম-আত্মা রাজা ‍যুধিষ্ঠির।।
ধর্ম্ম-অনুগত পার্থ ভীম মহাশয়।
দুই ভাই ধর্ম্মপ্রিয় মাদ্রীর তনয়।।
ধর্ম্মবলে বাহুবলে কেহ নহে ন্যূন।
কত বা তোমারে বুঝাইব পুনঃ পুনঃ।।
তাহার পৈতৃক রাজ্য যে হয় উচিত।
তাহা দিয়া সবা সহ করহ পীরিত।।
ভাই ভাই বিরোধিয়া কিবা প্রয়োজন।
ইথে ক্ষত্রধর্ম্ম রাজা না করি গণন।।
হারিলে অখ্যাতি, নাহি জিনিলে পৌরুষ।
কুলক্ষয় হবে আর অধর্ম্ম অযশ।।
ধার্ম্মিক পুরুষ তুমি, এ কর্ম্ম না কর।
কদাচিৎ ভাই ভাই না কর সমর।।
ভাই সহ প্রীতিভাবে বঞ্চ নানা সুখ।
বিরোধ করিলে মনে পাবে বড় দুখ।।
বিপদ হইলে তব নাহি পরিত্রাণ।
পূর্ব্বের কাহিনী কহি, কর অবধান।।
আছিল রাবণ রাজা ব্রহ্মবংশে জন্ম।
জ্ঞাতি বন্ধু ভাই সহ করিল অধর্ম্ম।।
কত দিনান্তরে রাম রঘুর নন্দন।
পিতৃসত্য পালিবারে প্রবেশেন বন।।
অনুজ লক্ষ্মণ আর জানকী সহিতে।
বহু দিন রঘুনাথ থাকেন বনেতে।।
কালেতে কুবুদ্ধি হৈল রাবণ রাজার।
সীতারে হরিয়া নিল দুষ্ট দুরাচার।।
সেইকালে রঘুনাথ বীর-অবতরি।
সুগ্রীবে সহায় করি বেড়ে লঙ্কাপুরী।।
রাবণের ছোট ভাই সুবুদ্ধি সুমতি।
মহাধর্ম্ম আত্মা বিভীষণ মহামতি।।
ধর্ম্ম-উপদেশ বহু বুঝাইল বাণী।
রাবণ না শুনে কথা অহঙ্কার মানি।।
অহঙ্কার কার কথা মনে না ধরিল।
ভ্রাতাকে নিন্দিয়া কতশত গালি দিল।।
কুবাক্য বলিয়া করে চরণ-প্রহার।
সেই হেতু চিত্তে দুঃখ হইল অপার।।
শ্রীরামের সহ আসি করিল মিলন।
শ্রীরাম অভয় তারে দিলেন তখন।।
রাবণে সবংশে মারি বীর রঘুমণি।
করিলেন উদ্ধার সে জনক-নন্দিনী।।
বিভীষণে রাজা করি আসিলেন দেশে।
পূর্ব্বের কাহিনী এই কহিনু বিশেষে।।
সে কারণে ভাই ভাই দ্বন্দ্বে নাহি কাজ।
সমুচিত ভাগ তারে দেহ মহারাজ।।
এইরূপ কহি তারে সব পরিবার।
মৌনভাবে রহে মন বুঝিবারে তার।।
দুর্য্যোধন বলে, করিয়াছে আমি সত্য।
অকারণে কেন এত বল নিত্য নিত্য।।
জীয়ন্তে পান্ডব সহ নাহি মম প্রীত।
বিধান করহ সবে ইহার বিহিত।।
এতেক বলিল যদি রাজ দুর্য্যোধন।
কেহ আর উত্তর না দিল মন্ত্রিগণ।।
অদৃষ্ট মানিয়া সবে গেল নিজ স্থান।
অনুচরগণে রাজা করে আজ্ঞা দান।।
যুদ্ধ হেতু আয়োজন কর বহুতর।
রাজার আজ্ঞায় চর ধাইল বিস্তর।।
নানা অস্ত্রে পূর্ণ করে সকল ভাণ্ডার।
গদা খড়গ ধনুর্গুণ দিব্য অস্ত্র আর।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পূণ্যবান।।
১৭. অর্জ্জুনের মনোদুঃখ
শ্রীকৃষ্ণের প্রবোধবাক্য
নারায়ণী সেনা কৃষ্ণ দিল দুর্য্যোধনে।
দেখিয়া হইল দুঃখ অর্জ্জুনের মনে।।
অর্জ্জুনের মন বুঝি কহেন শ্রীপতি।
কি হেতু হইলে সখা তুমি দুঃখমতি।।
নারায়ণী সেনা যত দিলাম উহারে।
সবে হত হইবেক তোমার প্রহারে।।
পূর্ব্বের কাহিনী কহি শুন দিয়া মন।
এক দিন মোর পাশে কহে পিতৃগণ।।
বংশের তিলক তুমি পূর্ণ ব্রহ্মরূপে।
সকল সংসার এই তব লোমকূপে।।
তুমি বিষ্ণু, মহারূপ নর-অবতার।
আমা সবাকারে প্রভু করহ উদ্ধার।।
মগধ রাজ্যেতে জাত বরাহ আছয়।
তার মাংস আনি শ্রাদ্ধ কর মহাশয়।।
তবে তৃপ্ত হয় আমা সবাকার মন।
এইমত কহে মোরে যত পিতৃগণ।।
পিতৃগণ বাক্যে করিলাম অঙ্গীকার।
পুনরপি মোরে তাঁরা কহে আরবার।।
একাকী যাইবে তুমি বরাহ মারিতে।
এক জন সঙ্গে নাহি লবে কদাচিতে।।
যদি সেই দুষ্ট মাংস আনিবে নিশ্চয়।
আমা সবাকার তবে নহে পাপক্ষয়।।
পিতৃগণ-বাক্য শুনি অশ্বে আরোহিয়া।
মগধ রাজ্যেতে আমি প্রবেশিনু গিয়া।।
জরাসন্ধ নৃপতির রক্ষী বনে ছিল।
অনুমানে চিহ্ন দেখি আমারে চিনিল।।
জরাসন্ধে আসি তারা কহে সমাচার।
সসৈন্যে সাজিয়া সেই আসে দুরাচর।।
একেশ্বর বেড়িলেক করি শত পুর।
সৈন্য কোলাহল শব্দ গেল বহুদূর।।
উপায় না দেখি আমি ভাবিনু তখন।
একেশ্বর বলে পরাজিব কত জন।।
দুরন্ত দুষ্কর সেই মগধের সেনা।
যত মরে, তত জীয়ে, না হয় গণনা।।
ভাবিয়া চিন্তিয়া আমি যুক্তি করি সার।
অঙ্গ বাড়াইনু যেন পর্ব্বত আকার।।
অঙ্গ হৈতে সেইক্ষণে হইল সৃজন।
দেখিতে দেখিতে নারায়ণী সেনাগণ।।
দশ সহস্র মহারথী অঙ্গেতে জন্মিল।
জরাসন্ধ সঙ্গে তারা সমর করিল।।
যুদ্ধে পরাভূত হৈল মগধ-রাজন।
ভঙ্গ দিয়া পলাইল যত সৈন্যগণ।।
তবে সেই বরাহেরে চক্রেতে প্রহারি।
আসিলাম নারায়ণী সেনা সঙ্গে করি।।
তুষ্ট হয়ে বলিলাম সেই সেনাগণে।
যেই বর ইচ্ছা কর, মাগ মম স্থানে।।
এত শুনি বলে নারায়ণী সেনাগণ।
যদি বর দিবে তবে দেহ নারায়ণ।।
ইতরের হাতে ‍মৃত্যু মো সবার নয়।
তোমার সমান রূপে গুণে যেবা হয়।।
তার হাতে মৃত্যু যেন হয় সবাকার।
এই বর আজ্ঞা কর দেবকী কুমার।।
তা সবার বাক্য শুনি দিনু বরদান।
তবে আমি মনোমধ্যে করি অনুমান।।
মম সম রূপে গুণে কে আছে সংসারে।
বিনা ধনঞ্জয় বীর না দেখি কাহারে।।
অর্জ্জুনের হাতে হবে তোমা সবা ক্ষয়।
হইবে ভারত-যুদ্ধ, না হয় সংশয়।।
সে কারণে নারায়ণী সৈন্য যত জন।
দুর্য্যোধন প্রতি করিলাম সমর্পণ।।
তব হস্তে হত হবে যত সৈন্যগণ।
এত বলি মায়া দেখাইল নারায়ণ।।
কাহার মস্তক নাহি কবন্ধের প্রায়।
দেখিয়া অর্জ্জুন চিত্তে মানেন বিস্ময়।।
তবে কৃষ্ণে ধনঞ্জয় কহে যোড়করে।
তোমার বিষম মায়া কে বুঝিতে পারে।।
মায়ার পুত্তলী তুমি কত মায়া জান।
আদি নিরঞ্জন তুমি পূর্ণ ভগবান।।
তোমার সহায়ে কিবা মম আছে ভয়।
মারিব কৌরবগণে, নাহিক সংশয়।।
জানিলাম এখন যে ‍যুদ্ধে হবে জয়।
যখন হইলে তুমি আমার সহায়।।
তোমার সহায়ে ইন্দ্র জয়ী ত্রিভুবনে।
তোমার সহায়ে দণ্ড ধরয়ে শমনে।।
তোমার সহায়ে সৃষ্টি করে প্রজাপতি।
তোমার সহায়ে শিব সংহার-মূরতি।।
সেই প্রভু হলে তুমি আমারে সদয়।
ত্রিভুবন মধ্যে মম আর কারে ভয়।।
অর্জ্জুনের বাক্যে হাসি কন নারায়ণ।
না বুঝিয়া পার্থ আমা করিলে বরণ।।
আমি যুদ্ধ না করিব, নিবারিল রাম।
কার শক্তি রামের বচন করে আন।।
কৌরবের পক্ষে আছে বহু যোদ্ধাপতি।
একেশ্বর কি করিতে আমার শকতি।।
এত শুনি হাসি হাসি কহে ধনঞ্জয়।
না বুঝিয়া হেন বাক্য কহ মহাশয়।।
এ তিন ভুবনে ব্যাপ্ত তোমার বিভূতি।
তুমি আদি, তুমি অন্ত, তুমি জগৎপতি।।
তুমি সৃষ্টি পাল, তুমি করহ সংহার।
তোমার বিভূতি বুঝে সামর্থ্য কাহার।।
বিঞ্চৎ জানেন মাত্র দেব পঞ্চানন।
মৃত্যু বলি একরূপ ধর নারায়ণ।।
কোন অল্পমতি হয় কৌরব-তনয়।
সহস্র কৌরবে মম আর নাহি ভয়।।
এক্ষণে যে কহি, তাহা শুন দিয়া মন।
যুধিষ্ঠির-আজ্ঞা তথা যাইতে আপন।।
পাইয়া রাজার আজ্ঞা বিলম্ব না করি।
সেইক্ষণে রথে চড়ি চলিলেন হরি।।
বিরাট নগরে যান অর্জ্জুন সহিত।
কৃষ্ণেরে দেখিয়া যুধিষ্ঠির মহাপ্রীত।।
যদ্যপি গোবিন্দ বন্ধ পাণ্ডবের মনে।
তথাপি বসিতে দেন রত্ন-সিংহাসনে।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
ব্যাসের রচিত দিব্য ভারত-আখ্যান।।
যে বা পড়ে, যে বা শুনে, করায় শ্রবণ।
তাহারে প্রসন্ন হন দেব নারায়ণ।।
এই কথা কহি আমি রচিয়া পয়ার।
অবহেলে শুনে যেন সকল সংসার।।
মস্তকে বন্দিয়া ব্রাহ্মণের পদরজ।
কহে কাশীদাস গদাধর দাসাগ্রজ।।
১৮. শ্রীকৃষ্ণ ও যুধিষ্ঠিরের যুক্তি
ও নমুচি দানবের উপাখ্যান
তবে জন্মেজয় রাজা জিজ্ঞাসে মুনিরে।
কহ শুনি, কি প্রসঙ্গ হৈল তদন্তরে।।
পাণ্ডবের দূত হয়ে দেব জগৎপতি।
কিরূপে বুঝাইলেন কৌরবের প্রতি।।
কৃষ্ণের বচন নাহি শুনে দুর্য্যোধন।
কিরূপে ভারতযুদ্ধ হৈল আরম্ভণ।।
কহিবে সে সব কথা করিয়া বিস্তার।
মুনি বলে, শুন পরীক্ষিতের কুমার।।
পাণ্ডব-সভায় আসিলেন নারায়ণ।
দেখি ‍আনন্দিত পঞ্চ পাণ্ডুর নন্দন।।
গোবিন্দে দেখিয়া ধর্ম্ম মহাহৃষ্ট মনে।
নিভৃতে করেন যুক্তি শ্রীকৃষ্ণের সনে।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন, শুন নারায়ণ।
হইবে ভারত-যুদ্ধ, না হবে খণ্ডন।।
দুর্য্যোধন দুর্ম্মতি সে করিবে প্রলয়।
যুদ্ধ হেতু হইবেক জ্ঞাতিগণ ক্ষয়।।
ক্ষত্রগণ অস্ত যাবে, পৃথ্বী হহস্বামী।
সে কারণে মনে যুক্তি করিয়াছি আমি।।
জ্ঞাতিগণ বধ মম প্রাণে নাহি সহে।
কুলক্ষয় চক্ষে দেখা কভু যোগ্য নহে।।
দূতমুখে দুর্য্যোধনে কহি পুনঃ পুনঃ।
কদাচিৎ ছাড়িয়া না দিবে রাজ্যধন।।
পূর্ব্বে যে নিয়ম করিলাম পঞ্চ জনে।
ধর্ম্ম হৈতে মুক্ত হইলাম এইক্ষণে।।
তাপস বেশেতে ভ্রমি কাননে কাননে।
তথাপিহ দয়া নাহি জন্মে দুর্য্যোধনে।।
অজ্ঞাত বৎসর এক থাকি পরবশে।
রাজপুত্র হয়ে ‍পার্থ ভ্রমে ক্লীববেশে।।
এত দুঃখ দিয়া ক্ষান্ত না করিল মন।
সমুচিত রাজ্য নাহি দেয় দুর্য্যোধন।।
যাবৎ শরীরে প্রাণ থাকিবে তাহার।
তাবৎ ছাড়িয়া রাজ্য না দিবে আমার।।
বহু কষ্টে পারি যদি করিতে সংহার।
তবে রাজ্য ধন সেই লব পুনর্ব্বার।।
হেন রাজ্য ধনে মম নাহি প্রয়োজন।
কিবা কাজ হবে বল মারি জ্ঞাতিগণ।।
এই হেতু চিত্তে আমি সব ক্ষমা দিব।
তব আজ্ঞা হৈলে পুনঃ বনবাসে যাব।।
তীর্থযাত্রা করি আমি ভ্রমি বনে বন।
ভুঞ্জুক সকল রাজ্য রাজা দুর্য্যোধন।।
পিতৃতুল্য পিতামহ আচার্য্য মাতুল।
আপ্ত বন্ধু সব আর যত জ্ঞাতিকুল।।
এ সকল সংহারির রাজ্যের নিমিত্তে।
হেন রাজপদে সুখ না করিব চিত্তে।।
না যুঝি প্রবৃত্ত হব বীর্য্য অহঙ্কারে।
যদি বা না পারি কৌরবেরে জিনিবারে।।
সংসার যুড়িয়া লজ্জা হবে অতিশয়।
এই হেতু মম চিত্তে হইতেছে ভয়।।
যে বা ভীম ধনঞ্জয় মাদ্রীর নন্দন।
আজন্ম দুঃখেতে গেল, কি করিবে রণ।।
বলহীন দেহ, শুধু আছে আত্মমাত্র।
কৌরব সম্মূখে হবে নাহি মানে চিত্ত।।
বিরাট দ্রুপদ ধৃষ্টদ্যুন্ন শিখণ্ড্যাদি।
দ্রৌপদীর পঞ্চ পুত্র আর সত্যবাদী।।
এই সব বীর আছে আমার সহায়।
ইহারা বা কি করিবে কৌরব দুর্জ্জয়।।
কৌরবের পক্ষে আছে বহু বীরগণ।
এক এক জন হয় দ্বিতীয় শমন।।
ভীষ্ম দ্রোণ অশ্বথামা কৃপ মহামতি।
সোমদত্ত ভূরিশ্রবা সুশর্ম্মা নৃপতি।।
মহারথ মহামতি সবে মহাবল।
শত ভাই দুর্য্যোধন আর বৃহদ্বল।।
শল্য মহাবীর আর রাধার নন্দন।
এ সকল বীর হয় দ্বিতীয় শমন।।
যুদ্ধে কাজ নাহি মম, না পারিব জানি।
বনবাসে যাব, আজ্ঞা কর চক্রপাণি।।
ইহা শুনি হাস্যমুখে কহে নারায়ণ।
না বুঝিয়া হেন বাক্য বলহ রাজন।।
চিরজীবী নাহি কেহ সংসার ভিতরে।
জন্মিলে অবশ্য যায় শমনের ঘরে।।
ক্ষত্রধর্ম্ম নীতি তব নাহিক ‍রাজন।
সন্ন্যাস ধর্ম্মের মত তব আচরণ।।
রাজধর্ম্ম নীতি কিছু কহিব তোমারে।
পূর্ব্বেতে নিষ্পন্ন যাহা হইল বিচারে।।
রাজা হয়ে ক্ষমাবন্ত না হবে কখন।
অতি উগ্র না হইবে, সদা শান্তমন।।
ক্ষত্রমধ্যে যেই জন হয় বলবান।
অহঙ্কারে জ্ঞাতি বন্ধু করে তৃণজ্ঞান।।
ক্ষত্রমধ্যে শত্রু আমি গণি যে তাহারে।
তাহারে করিবে নষ্ট যে কোন প্রকারে।।
বলে ছলে যুদ্ধে তারে যেরূপে পারিবে।
অবশ্য তাহারে রাজা সংহার করিবে।।
ইহাতে অধর্ম্ম নাহি শুন নরবর।
সেই সব দুর্য্যোধন করিল পামর।।
তাহারে মারিলে নাহি পাপের উদয়।
জ্ঞাতিমধ্যে শত্রু সেই মহা দুরাশয়।।
পূর্ব্বের কাহিনী কহি, শুন দিয়া মন।
নমুচি দানব সেই কশ্যপ নন্দন।।
এক পিতা হৈতে হৈল দোঁহার জনম।
ইন্দ্রের বৈমাত্র ভাই বিখ্যাত ভুবন।।
তপোবলে দেবরাজে করে পরাজয়।
ইন্দ্রের ইন্দ্রত্ব জিনি নিল দুরাশয়।।
ইন্দ্রের অমরাবতী বলেতে হরিল।
উপায় না দেখি ইন্দ্র চিন্তিত হইল।।
নমুচির সঙ্গে যুদ্ধে হইয়া পরাস্ত।
পলাইল দেবসেনা হয়ে ব্যতিব্যস্ত।।
পরাজয় মানি ইন্দ্র আদি দেবগণ।
সন্ন্যাসী হইয়া ভ্রমে সকল ভুবন।।
পুত্রগণ কষ্ট দেখি দেবের জননী।
ক্ষীরোদের কূলে আরাধিল পদ্মযোনি।।
প্রত্যক্ষ হইয়া ব্রহ্মা বর দিল তাঁরে।
অচিরেতে পাবে রাজ্য তোমার কুমারে।।
এত বলি অন্তর্দ্ধান হৈল পদ্মাসন।
পুত্রগণে দেবমাতা বলেন তখন।।
জননীর বাক্যে ইন্দ্র আদি দেবগণ।
ব্রহ্মারে কহিল গিয়া সব বিবরণ।।
বিষম সঙ্কটে দেব করহ মোচন।
নমুচির ভয় হৈতে করহ তারণ।।
পিতামহ সুপ্রসন্ন হয়ে দেবগণে।
সান্ত্বনা করেন সবে প্রবোধ বচনে।।
অসময়ে কার্য্যাসিদ্ধি কভু নাহি হয়।
শাস্ত্রেতে বিচার হেন করিল নির্ণয়।।
জ্ঞাতিমধ্যে রিপু শ্রেষ্ঠ যেই মহাবলী।
তাহার সংহার হেতু হৃদয়ে আকুলি।।
বলে ছলে নমুচিরে করিবে নিধন।
ইহাতে অধর্ম্ম নাহি হইবে কখন।।
ব্রহ্মার বচন শুনি দেব সুরপতি।
নমুচির সঙ্গে আসি করিল পীরিতি।।
হীন জন প্রায় হয়ে তাহারে সেবিলি।
নমুচির সহ ইন্দ্র মিত্রতা করিল।।
এইরূপে কত দিন আছে সুরনাথ।
করিল সুদূঢ় প্রীতি নমুচির সাথ।।
কত দিনে শুভকাল ইন্দ্র তবে পায়।
মারিতে দৈত্যেরে ইন্দ্র করিল উপায়।।
কৌশল করিয়া ইন্দ্র নমুচি মারিল।
আপন ইন্দ্রত্ব পদ পুনরপি নিল।।
ক্ষত্রধর্ম্মে এইমত আছয়ে নিয়ম।
পূর্ব্বাপর আছে ইহা না কর সম্ভ্রম।।
দুর্য্যোধন কুলাঙ্গার বড় দুরাচার।
তাহারে মারিলে পাপ নাহিক তোমার।।
নমুচিরে মারি ইন্দ্র সুখে রাজ্য করে।
কৌরব মারিতে কেন পড়িলে বিচারে।।
কৌরবে মারিয়া তুমি সুখে রাজ্য কর।
দ্রৌপদীর মনঃশল্য উদ্ধার সত্বর।।
কহিলাম হিতবাক্য তোমারে রাজন।
এত বলি প্রবোধিলা দেব নারায়ণ।।
ধর্ম্মের ঘুচিল ভয়, আনন্দিত মন।
তবে ভীম ধনঞ্জয় আর মন্ত্রিগণ।।
একে একে নৃপতিরে কহে বিবরণ।
উদেযাগ করহ রাজা করিবারে রণ।।
কৃষ্ণের বচনে রাজা না কর সংশয়।
কৌরবে মারিয়া রাজ্য কর মহাশয়।।
বিনা দ্বন্দ্বে রাজ্য নাহি দিবে দুর্য্যোধন।
তাহারে মারিলে নহে পাপের কারণ।।
আমরা সহায় সব, কারে কর ভয়।
আজ্ঞা কৈলে সংহারির কৌরব তনয়।।
সহায় সর্ব্বস্ব তব দেব জগৎপতি।
ইহার প্রসাদে জয় হবে নরপতি।।
রাজা বলে, যে কহিলে কভু নহে আন।
সহায় সর্ব্বস্ব মম দেব ভগবান।।
শ্রীকৃষ্ণ প্রসাদে ভয় নাহি ত্রিজগতে।
তথাপিহ চাহে লোক ধর্ম্মেতে তরিতে।।
অন্য দূত-কর্ম্ম নহে, কহি সে কারণ।
কুরুসভা মধ্যে যাও দেবকী নন্দন।।
নীতি ধর্ম্ম কহি জ্ঞান দেহ দুর্য্যোধনে।
জ্যেষ্ঠতাত ধৃতরাষ্ট্র গঙ্গার নন্দনে।।
প্রথমে কহিবে অর্দ্ধ ‍রাজ্য ছাড়ি দিতে।
ধন জন রত্ন যেই ছিল ইন্দ্রপ্রস্থে।।
পূর্ব্বাপর অধিকার ছিল মম যত।
তাহা দিয়া প্রীতি কর পাণ্ডব সহিত।।
যে নিয়ম হয়েছিল, তাহে হৈল পার।
তবে কেন রাজ্য ছাড়ি না দেহ আমার।।
নাহি দিলে ধর্ম্মে বল কেমনে তরিবে।
ভাই ভাই যুদ্ধ হৈলে, কিবা ফল হবে।।
জ্ঞাতিগণ মরিবেক আর বন্ধুগণ।
মহাযুদ্ধ হবে সর্ব্ব কুল বিনাশন।।
সে কারণে এই কার্য্যে নাহি প্রয়োজন।
অর্দ্ধরাজ্য দিয়া তোষ পাণ্ডবের মন।।
এরূপে কহিবে আগে কথা বহুতর।
তবে যদি কদাচ না শুনে কুরুবর।।
তবে সে কহিবে তারে করিয়া বিনয়।
বড় ক্ষমাশীল রাজা পাণ্ডুর তনয়।।
রাজ্য দেশ বৃত্তি যত অশ্ব ধন জন।
সকল ছাড়িয়া দিল তোমার কারণ।।
পঞ্চ ভাই পাণ্ডবেরে পঞ্চ গ্রাম দেহ।
সাগর অবধি রাজ্য সকল ভুঞ্জহ।।
ইন্দ্রপ্রস্থ কুশস্থল বারণানগর।
হস্তিনার উত্তরে সুকান্তি গ্রামবর।।
পাণ্ডব নগর গ্রাম তাহার দক্ষিণে।
এই পঞ্চ গ্রাম দিয়া তোষ পঞ্চ জনে।।
এইরূপে বুঝাইবে রাজা দুর্য্যোধনে।
তোমার বচন যদি না শুনে শ্রবণে।।
আপনার দোষ দুষ্ট হইবে নিধন।
ইথে পাপ কলঙ্ক না হয় নারায়ণ।।
অধর্ম্ম করিলে পাপ হইবে আমার।
লোকে ধর্ম্ম ভাল মন্দ নহিবে বিচার।।
তার পাপে হইবেক জ্ঞাতিগণ ক্ষয়।
শীঘ্রগতি যাহ তুমি কৌরব-আলয়।।
গোবিন্দ বলেন, রাজা যে আজ্ঞা তোমার।
হয়ত উচিত একবার জানিবার।।
যদ্যপি সম্প্রীতে রাজ্য দেয় দুর্য্যোধন।
দুই কুল রক্ষা হয়, জীয়ে জ্ঞাতিগণ।।
ভীমার্জ্জুন বলেন, না লয় ইহা মন।
সম্প্রীতে যে রাজ্য দিবে দুষ্ট দুর্য্যোধন।।
তাহাতে রাধেয় কর্ণ মন্ত্রী দুরাচার।
গান্ধার নন্দন দুঃশাসন দুষ্ট আর।।
এ তিন জনের বুদ্ধি লয়ে দুর্য্যোধন।
আমা সবা সঙ্গে নাহি করিবে মিলন।।
তথাপিহ যাহ তুমি ধর্ম্মের আজ্ঞায়।
সাবধান হয়ে দেব যাবে হস্তিনায়।।
কুবুদ্ধি কুমন্ত্রী খল রাজা দুর্য্যোধন।
একেশ্বর পেয়ে পাছে করে বিড়ম্বন।।
সে কারণে লহ সঙ্গে মহারথিগণ।
এক অক্ষৌহিণী সঙ্গে করুক গমন।।
গোবিন্দ বলেন, মম ভয় আছে কারে।
শত ‍দুর্য্যোধন মম কি করিতে পারে।।
তবে যদি প্রবর্দ্ধিত হয় অহঙ্কারে।
মুহূর্ত্তেকে চক্রে সংহারিব সবাকারে।।
বাতি দিতে না রাখিব কৌরবের গণে।
সবংশে মারিব সেই দুষ্ট দুর্য্যোধনে।।
এত বলি গোবিন্দ করিলেন প্রস্থান।
রথী দশ সহস্র লইয়া ধনুর্ব্বাণ।।
সাত্যকি চলিল সঙ্গে আর চেকিতান।
দুই লক্ষ পদাতিক সঙ্গে বলবান।।
বলেন শ্রীকৃষ্ণ প্রতি ভাই পঞ্চ জন।
বিষম সঙ্কটে ভ্রমিলাম বনে বন।।
তোমার প্রসাদে দুঃখ হইল মোচন।
সান্ত্বাইবে মায়ে, যেন নহে দুঃখমন।।
শুনিয়া গোবিন্দ করিলেন অঙ্গীকার।
দ্রৌপদী কৃষ্ণেরে চাহি বলিছে আবার।।
শুনহ দুঃখের কথা কমললোচন।
বড়ই নিষ্ঠুর শত্রু পাপী দুর্য্যোধন।।
এত কষ্ট দিয়া নহে শান্ত তার মন।
কদাচ না রাজ্য ছাড়ি দিবে দুর্য্যোধন।।
যত দুঃখ দিলেনক সে, জানহ বিশেষ।
সভামধ্যে ধরি দুষ্ট আনে মোর কেশ।।
বিবস্ত্র করিতে ইচ্ছা কৈল দুষ্টগণ।
ধর্ম্ম রক্ষা করিল যে, তেই সে মোচন।।
হেন জন মুখ প্রভু চাহ দেখিবারে।
তব বাক্য কদাচ না রাখিবে পামরে।।
তার সঙ্গে প্রীতি করি কিবা হবে হিত।
সবংশে মারিতে তারে হয়ত উচিত।।
তোমার আশ্রয়ে দেব কেবা বীর্য্যহত।
সবাই যুঝিবে দেব তোমার সম্মতি।।
পিতা মম যুঝিবেন দ্রুপদ সুধীর।
যুঝিবেন সহোদর ধৃষ্টদ্যুন্ন বীর।।
শিখণ্ডী করিবে যুদ্ধ মহাবলবান।
পঞ্চ ভাই যুঝিবেন রণে সাবধান।।
মম পঞ্চ পুত্র আছে সংগ্রামে সুধীর।
দ্বিতীয় বাসব যুদ্ধে অভিমন্যু বীর।।
ভোজবংশে মৎস্যবংশে যত বীরগণ।
এক এক জন হয় দ্বিতীয় শমন।।
কৌরবেরে পরাজয় করিবে সমরে।
কোন প্রয়োজনে প্রভু যাহ তথাকারে।।
স্বপ্নে আজি দেখিলাম শুন মহাশয়।
রথেতে চড়িয়া রণে পাণ্ডুর তনয়।।
রাক্ষস মূরতি ধরি বীর বৃকোদর।
দুঃশাসনে ধরি রণে চিরিল উদর।।
রক্তপান করি বুলে, দেখিনু নয়নে।
ধবল কুঞ্জর চড়ি মাদ্রীর নন্দনে।।
কৌরবের সহ যেন হৈল মহারণ।
ধবল পুষ্পের মালা পরে পঞ্চ জন।।
শ্বেত কৃষ্ণ আরো যত বর্ণ ছত্র বাণ।
কৌরবের সেনা করে রক্ত জলে স্নান।।
স্রোতোধারে মহাবেগে রক্তনদী বয়।
সাক্ষাতে দেখিনু এই স্বপ্ন মহাশয়।।
কৌরবের পরাজয়, পাণ্ডবের জয়।
গোবিন্দ বলেন, দেবি যে বল সে হয়।।
শত্রুমধ্যে যাইবারে উচিত না হয়।
তথাপি যাইব আমি রাজার আজ্ঞায়।।
বুঝাইব নীতিধর্ম্ম দুষ্ট দুর্য্যোধনে।
মৃত্যুকালে ঔষধ না খায় রোগীজনে।।
কদাচিৎ মম বাক্য না শুনিবে কানে।
সবংশে যাইবে দুষ্ট শমনের স্থানে।।
অচিরেতে হবে তব দুঃখ বিমোচন।
হস্তিনায় রাজধানী হইবে এখন।।
এত বলি সান্ত্বাইল দ্রুপদ কন্যায়।
শুভযাত্রা করি হরি যান হস্তিনায়।।
মহাভারতের কথা অমৃত-লহরী।
কাশী কহে, সাধুজন প্রিয় কর্ণ ভরি।।
কাশী কহে, শ্রবণে ভবেতে হয় পার।।
১৯. শ্রীকৃষ্ণের হস্তিনায় আগমণ
সংবাদে কৌরবগণের পরামর্শ
মুনি বলে, শুন কুরুবংশ চূড়ামণি।
বিদুর আসিয়া অন্ধে কহেন কাহিনী।।
হস্তিনায় আসিবেন আপনি শ্রীপতি।
দুর্য্যোধনে বুঝাইতে ধর্মশাস্ত্র নীতি।।
সকল মঙ্গল রাজা হইবে তোমার।
সে কারণে শ্রীগোবিন্দ করে আগুসার।।
তোমার পূর্ব্বের ধর্ম্ম হইল উদয়।
সম্প্রীতি করিল কৃষ্ণ, হেন মনে লয়।।
সাবধানে মহারাজ পূজিবে কৃষ্ণেরে।
ত্যজিয়া কাপট্য শাঠ্য না করি অন্তরে।।
ভক্তের অধীন কৃষ্ণ, জানহ আপনে।
ভক্তিভাবে কৃষ্ণপূজা করহ যতনে।।
উভয় কুলের হিত চিন্তে নারায়ণ।
তোমার সভায় আসিবেন সে কারণ।।
সুমেরু সমান রত্ন অসংখ্য কাঞ্চন।
অশ্রদ্ধায় যদি কৃষ্ণে কর নিবেদন।।
তাহাতে নহেন প্রীত দেব দামোদর।
শ্রদ্ধায় অত্যল্প দিলে মানেন বিস্তর।।
শ্রদ্ধান্বিত হয়ে যেবা কৃষ্ণপূজা করে।
বিষম সঙ্কটে কৃষ্ণ উদ্ধারেন তারে।।
নররূপে পূর্ণব্রহ্ম আদি নারায়ণ।
সাবধান হয়ে তাঁরে পূজিবে রাজন।।
ইহা শুনি ধৃতরাষ্ট্র সানন্দ হৃদয়।
পুলকে পূর্ণিত তনু হৈল অতিশয়।।
বিদুরে চাহিয়া তবে বলিল বচন।
মনোবাঞ্ছা পূর্ণ মম হইল এখন।।
কুলক্ষয় হবে বলি জানি জগন্নাথ।
সে কারণে আসিবেন আমার সাক্ষাৎ।।
আমার ভাগ্যের কথা বলিতে না পারি।
প্রীতি করিবারে হেথা আসিবেন হরি।।
শ্রীকৃষ্ণের মতি হয় কুমতি নাশিনী।
দুর্য্যোধনে শান্তি বুঝাইবেন আপনি।।
ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ কৃপ আর দুর্য্যোধনে।
ডাক দিয়া আন শীঘ্র আমার সদনে।।
দেখি তারা কিবা বলে করিয়া বিচার।
কিরূপে পূজিতে যুক্তি দেয় সে আবার।।
শুনিয়া বিদুর তবে গেল সেইক্ষণ।
ডাক দিয়া আনাইল যত বিজ্ঞজন।।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ কর্ণ সুবল-নন্দন।
আজ্ঞামাত্রে আনাইল যত সভাজন।।
সভাতে বসিল সবে সিংহ অবতার।
কহিতে লাগিল তবে অম্বিকা-কুমার।।
মম মনস্কাম পূর্ণ হৈল এতদিনে।
উভয় কুলের হিত চিন্তা করি মনে।।
রাজা দুর্য্যোধনে ধর্ম্মনীতি বুঝাইতে।
কৃষ্ণ আসিছেন এই হস্তিনা পুরীতে।।
কিরূপে পূজিব কৃষ্ণে, বলহ আমারে।
ইহার বিধান কিবা বলহ বিস্তারে।।
ইহা শুনি কহে ভীষ্ম গঙ্গার তনয়।
তোমার পূন্যের বলে হইল উদয়।।
অকপটে পূজা কর আনন্দে তাঁহারে।
বিভব বিস্তর দিয়া রাজ ব্যবহারে।।
যাহে প্রীত হন কৃষ্ণ, কহি শুন নীত।
বিচিত্র মন্দির এক করহ রচিত।।
ইন্দ্রের নগর তুল্য নগর প্রধান।
নানা রত্ন মাণিক্যেতে করহ নির্ম্মাণ।।
পথে পথে দেহ রাজা জলচ্ছত্র দান।
স্থানে স্থানে রত্নবেদী করহ নির্ম্মাণ।।
অগুরু চন্দন ছড়া দেহ ত নগরে।
করুক মঙ্গল বাদ্য প্রতি ঘরে ঘরে।।
গুবাক কদলী আনি রোপ সারি সারি।
স্থানে স্থানে নানা যজ্ঞ মহোৎসব করি।।
নটনটীগণ আর নর্ত্তকী গায়ন।
গোবিন্দ গুণানুবাদ করুক কীর্ত্তন।।
চারি জাতি প্রজা বন্দিবারে হৃষীকেশ।
দিব্য বস্ত্র অলঙ্কারে করুক সুবেশ।।
আগুসরি আন গিয়া দেবকী নন্দনে।
পূজা কর গোবিন্দেরে এমত বিধানে।।
তবে সুখ নরপতি হইবে তোমার।
মম চিত্তে লয় রাজা এইত বিচার।।
এতেক বলিল যদি ভীষ্ম মহামতি।
দ্রোণ কৃপ আদি সবে দিল অনুমতি।।
এইরূপে পূজা কৃষ্ণে হয় ত উচিত।
ধৃতরাষ্ট্র বলে, মম এই লয় চিত।।
দুর্য্যোধন বলে, মম নাহি রুচে মন।
এইরূপে কৃষ্ণপূজা কোন প্রয়োজন।।
ক্ষত্রমধ্যে পৃথিবীতে কে করে বাখান।
কোন রাজগণ কৃষ্ণে করিল সম্মান।।
শিশুপাল রাজা ছিল বিখ্যাত ভুবনে।
কদাচিৎ মান্য নাহি করে নারায়ণে।।
কপট করিয়া কৃষ্ণ সংহারিল তারে।
জরাসন্ধ রাজা নিন্দা কলি তাহারে।।
গোবিন্দেরে সে বলিল গোয়ালা নন্দন।
ক্ষত্রিয় অধম বলি করিত গণন।।
ক্ষত্রসভা মধ্যে কভু বসিতে না দিল।
তেঁই সে ভীমের হাতে তাহারে মারিল।।
বড়ই কপট ক্রূর রুক্মিণীর পতি।
তারে মান্য কদাচ না করি নরপতি।।
মান্য কৈলে উপহাস করিবে সংসার।
ক্ষত্র রাজগণ যত, কৃষ্ণ মান্য কার।।
উপহাস হৈতে মৃত্যু বরং শ্রেষ্ঠ কর্ম্ম।
মান্য না করিল কেহ দেখি তার ধর্ম্ম।।
ইতর জনের প্রায় পূজি নারায়ণে।
যত বুঝাইবে, তাহা না শুনিব কানে।।
মোর মনে লয় রাজা এইত যুকতি।
ইহা শুনি কহে তবে ভীষ্ম মহামতি।।
ভাবে বুঝি, দুর্য্যোধন হারাইলে জ্ঞান।
না জানহ নারায়ণ পুরুষ-প্রধান।।
অমান্য করিতে তাঁরে চাহ অহঙ্কারে।
নারায়ণ মুহূর্ত্তেকে মারিবে সবারে।।
বাতি দিতে না রাখিবে কৌরব বংশেতে।
এত বলি ভীষ্ম বীর উঠে সভা হৈতে।।
আপন মন্দিরে গেল হয়ে ক্রুদ্ধমন।
যার যে শিবিরে গেল যত সভাজন।।
তবে দুর্য্যোধনে অন্ধ বলিল বচন।
যা বলিল ভীষ্ম, তাহা না কর হেলন।।
মান্য করি পূজ কৃষ্ণে, সবার নমস্য।
দুই কুল হিত কৃষ্ণ করিবে অবশ্য।।
তোমারে ভেটিতে আসে দেবকী কুমার।
তোমার ভাগ্যের সীমা কিবা আছে আর।।
শ্রদ্ধান্বিত হয়ে বৎস পূজ নারায়ণ।
শ্রদ্ধায় সকল কার্য্য হইবে সাধন।।
অল্প বা বিস্তর দেয় শ্রদ্ধা সহকারে।
অকপট হয়ে যেবা কৃষ্ণপূজা করে।।
আপনাকে দিয়া তাঁর বশ হন হরি।
সে কারণে কহি শুন কুরু অধিকারী।।
অকপট হয়ে তুমি পূজ নারায়ণ।
মম বাক্য কদাচিৎ না কর হেলন।।
দুর্য্যোধন বলে, তাত কহিলে যেমত।
তব আজ্ঞা হেতু আমি করিব সেমত।।
শিল্পকারগণে ডাকি বলে দুর্য্যোধন।
দিব্য রত্ন সিংহাসন করহ রচন।।
রত্নের মন্দির কর বিচিত্র আবাস।
বসিবে তাহাতে আসি দেব শ্রীনিবাস।।
নগরে নগরে কর পুষ্পের মন্দির।
পথে পথে স্থানে স্থানে রচহ শিবির।।
উৎসব করুক সদা সুখে সর্ব্বজনে।
নট নটী নৃত্য যেন করে স্থানে স্থানে।।
রাজ আজ্ঞা পেয়ে যত অনুচরগণ।
যে কহিল ততোধিক করিল গঠন।।
নগরে নগরে কবে রত্ন বাস ঘর।
স্থানে স্থানে যজ্ঞারম্ভ করিল বিস্তর।।
নানাবিধ বৃক্ষ রোপিলেক সারি সারি।
বিচিত্র শোভন যেন ইন্দ্রের নগরী।।
নগরেতে চারি জাতি যত প্রজাগণ।
সবাকারে চরগণ বলিল তখন।।
আসিবেন কৃষ্ণ আজি নৃপে ভেটিবারে।
আগু হৈয়া সবে গিয়া আনিবে তাঁহারে।।
শুনিয়া আনন্দে মগ্ন নগরের জন।
সুসজ্জ হইল ভেটিবারে নারায়ণ।।
মহাভারতের কথা অমৃতের ধার।
২০. হস্তিনা যাইতে পথে প্রজাগণ
কর্ত্তৃক শ্রীকৃষ্ণের স্তব
সুসজ্জ হইয়া হরি, রথে আরোহণ করি,
হস্তিনায় করেন গমন।
নানাবিধ বাদ্য বাজে, কেহ অশ্বে কেহ গজে,
সঙ্গ চতুরঙ্গ সৈন্যগণ।।
বিরাট নগর হরি, তরিলা সে কান্তিপুরী,
বামে করি মগধের দেশ।
কাঞ্চন নগর দিয়া, কাশীরাজ্য এড়াইয়া,
বৃকদেশে আসে হৃষীকেশ।।
অবসান হৈল বেলা, বনমালী উত্তরিলা,
বিশ্রাম করেন কতক্ষণ।
শুনি কৃষ্ণ আগমন, বৃকবাসী প্রজাগণ,
ভেটিতে আসিল সর্ব্বজন।।
নানা ভক্ষ্য উপহার, দিয়া নারা অলঙ্কার,
শকটে পূরিয়া রত্ন ধন।
দণ্ডবৎ প্রণতি করি, ষড়ঙ্গে পূজিয়া হরি,
নানাবিধ করিল স্তবন।।
নমো নমো জয় জয়, নমস্তে করুণাময়,
পূর্ণব্রহ্মা আদি গদাধর।
নমো হয়গ্রীব কায়, নমো বেদ উদ্ধারায়,
নমো নমো মীন- কলেবর।।
নমো কুর্ম্মরূপধারী, সমুদ্র মথনকারী,
জয় জয় নমস্তে শ্রীধর।
নমস্তে বামনরূপ, মোহহারী বলি ভূপ,
নমো নমো দেব দামোদর।।
নমস্তে বরাহকায়, হিরণ্যাক্ষ বিনাশায়,
নমস্তে মোহিনী কলেবর।
দেবাসুর মোহ যায়, রুদ্র তত্ত্ব নাহি পায়,
নমো নমো অখিল ঈশ্বর।।
নমো নমো নারায়ণ, মহাদৈত্য বিনাশন,
নমস্তে নৃসিংহ রূপধারী।
নমো রাম ভৃগুকায়, ক্ষত্রবংশ বিনাশায়,
জয় জয় নমস্তে মুরারি।।
নমো রবিবংশধারী, নমস্তে বামন-হরি,
দুষ্ট শিশুপাল বিনাশন।
নমো রামকৃষ্ণতনু, বসুদেব অঙ্গজনু,
জয় প্রভু জয় নারায়ণ।।
জয় জয় জনার্দ্দন, কেশী কংস বিনাশন,
নমো ব্রজগোপীর মোহন।
অঘ বক তৃণাবর্ত্ত, দৈত্যবংশ করি অন্ত,
জয় জয় ব্রহ্মা সনাতন।।
তুমি আদি, তুমি অন্ত, তুমি সূক্ষ্ম স্থূলতন্ত্র,
আত্মরূপে সর্ব্বত্র বিহারী।
কীট পক্ষী মৎস্য আদি, জীবজন্তু নিরবধি,
কেহ ভিন্ন না হয়ে তোমারি।।
তোমার চরণ সেবি, নারদাদি মহাকবি,
মৃত্যুঞ্জয় কৈল মৃত্যু জয়।
সেবিয়া তোমার পায়, ব্রহ্মা ব্রহ্মপদ পায়,
ব্রহ্মপদ দেহ মহাশয়।।
নমো বুদ্ধদেহধর, ভবিষ্যতি কলেবর,
নমো কল্কি ম্লেচ্ছ বিনাশায়।
নাহি তার কোন ভয়, সদা সে নির্ভয় হয়,
তব গুণকথ যেই গায়।।
মোরা সব অল্পমতি, কি জানি তোমার স্তুতি,
না জানেন ব্রহ্মা মহেশ্বর।
পাণ্ডবেরা ইন্দ্রপ্রস্থে, চিরকাল মনঃস্বাস্থ্যে,
বাস কৈল নির্ভয় অন্তর।।
দুর্য্যোধন কুরুমণি, পাশায় সর্ব্বস্ব জিনি,
সবারে পাঠায় বনবাসে।
দেখি দুষ্ট দুরাচার, মানি সবে পরিহার,
নিবাস করিনু এই দেশে।।
চিরকাল আছি আশে, পাণ্ডব আসিবে দেশে,
পুনরপি যাইব তথায়।
হা হা ধর্ম্ম যুধিষ্ঠির, ভীম পার্থ ধীর স্থির,
না দেখিয়া তোমা সবাকায়।।
তোমা বিনা সব কায়, দেখিবারে না যুয়ায়,
পুত্রবৎ করিতে পালন।
স্মরি পাণ্ডুপুত্রগণ, বৃকবাসী প্রজাগণ,
মহাশোকে হৈল অচেতন।।
তুষ্ট হয়ে নারায়ণ, আশ্বাসিয়া প্রজাগণ,
কহিতে লাগিলেন তখন।
শোক না করিহ আর, যাহ সবে নিজাগার,
শীঘ্র হবে পাণ্ডব দর্শন।।
হইয়া পাণ্ডবদূত, বুঝাইতে কুরুসুত,
যাই আমি হস্তিতা ভবনে।
পাণ্ডবের রাজ্য বাড়ী, যদি নাহি দেয় ছাড়ি,
দুর্য্যোধন আমার বচনে।।
রুষিবে পাণ্ডবগণ, বলে লবে রাজ্য ধন,
কুরুবংশ করিয়া বিনাশ।
এত বলি নারায়ণ, আশ্বাসিয়া প্রজাগণ,
সেই দিন তথা করে বাস।।
বিচিত্র ভারত কথা, ব্যাস বিরচিত গাথা,
শুনিলে অধর্ম্ম হয় নাশ।
কমলাকান্তের সুত, হেতু সুজনের প্রীত,
বিরচিল কাশীরাম দাস।।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র