গঙ্গা নদীর উৎপত্তি ও মহাত্ম

গঙ্গা নদীর উৎপত্তি ও মহাত্ম্য একদা বিষ্ণু জানলেন যে, ব্রহ্মলোকে ব্রহ্মাদি দেবতারা মহোৎসব করে গঙ্গার বিবাহ দিয়েছেন। তখন বিষ্ণু গঙ্গার সহিত শঙ্কর দেখবার ইচ্ছায় বৈকুন্ঠে আনায়ন করলেন। যুগলরুপ দেখে বিষ্ণু অত্যন্ত প্রীত হলেন। ব্রহ্মাদি দেবগণ মহাদেবকে এবং জগৎপ্রভু নারায়ণকে দর্শন করার অভিলাষে তথায় আগমন করলেন। ব্রহ্মলোকবাসী মরীচি আদি মহর্ষিগণও আগমন করলেন। বিষ্ণু একটি মনোহর সভা নির্মাণ করে সভামধ্যে রত্নসিংহাসনে মহেশ্বরকে বসালেন।জগন্নাথ মহাদেবকে বললেন,’’ দেবদেব! আপনি কিছু সময় গান করুন। আমরা পূর্ণ আনন্দ লাভ করি। আপনি সতীর বিরহে কারত ছিলেন। এখন সুস্থচেতা হয়েছেন। সেই সতী ইনি, অংশ দ্বারা আপনাকে প্রাপ্ত হয়েছেন। গঙ্গার সহিত আপনাকে দেখে হৃষ্ট মনে হচ্ছে। হে শিতিকন্ঠ! আপনার কন্ঠে আমরা সুমধুর গান শ্রবণ করব। অমিততেজস্বী বিষ্ণুর এ বাক্য শ্রবণ করে শম্ভু তার সুললিত কন্ঠে গান আরম্ভ করলেন। প্রথমত:ই গান শ্রবণ করে ব্রহ্মাদি দেবতারা পরিতৃপ্ত হলেন। বিষ্ণু দ্রবীভূত জলময় হলেন, বৈকন্ঠপুর জলমগ্ন হল। ব্রহ্মাদি দেবতা চেতন হলে দেখতে পেলেন যে, বৈকন্ঠের ভিতর ও বাহির জলমগ্ন হয়েছে। মহেশ্বরের আসনে দেখলেন কেশবের দেহ সকলই দ্রব হয়েছে। তখন ব্রহ্মাদি দেবতা অত্যন্ত বিস্মিত হলেন। শিবগানসমুদ্ভুত যে হরির দ্রবত্ব সেই দ্রবত্ব পবিত্র জলকে ব্রহ্মা তার নিজ কমন্ডলুতে ধারণ করলেন। সেই জল প্রাপ্তি মাত্রে ব্রহ্মার কমন্ডলুগতা যে একটি গঙ্গার মূর্তি ছিল তাও দ্রবময়ী হল। সেই কমন্ডুল নিয়ে ব্রহ্মা স্বধামে যাত্রা করলেন এবং বিষ্ণুবিচ্ছেদে বিরহকারত লক্ষ্মী ও সরস্বতীকে আশ্বাস দিলেন অতিশ্রীঘ্রই প্রিয়ের দর্শন পাবেন। মহাদেবও গঙ্গার সহিত কৈলাস ধামে যাত্রা করলেন। অপর দেবতাগণ, দেবর্ষিগণ সকলেই স্বর্গধামে গমন করলেন। এ প্রকারে ত্রৈলোক্যপাবনী গঙ্গা দেবী দ্রবময়ী হয়ে ব্রহ্মার কমন্ডলুতে ছিলেন। বিরোচনপুত্র বলিরাজা। তিনি দৈত্যদের অধিপতি, মহাবলপরাক্রান্ত। তিনি অতিশয় ধর্মজ্ঞানী। তিনি বাহুবলে ইন্দ্রের ত্রৈলোক্যরাজ্য হরণ করেছিলেন। দেবমাতা অদিতি পুত্র ইন্দ্রের রাজ্য হরণে তিনি অত্যন্ত দু:খ পেয়েছিলেন। তাই তিনি পুত্রের রাজ্য ফিরে পাবার জন্য বহুকাল বিষ্ণুর তপস্যা করেন। বিষ্ণু তার উগ্র তপস্যায় সন্তষ্ট হয়ে বর প্রার্থনার জন্য বললেন। তখন মাতা অদিতি কৃতাঞ্জলিপুটে বলতে লাগলেন,’’ হে ভগবান! আপনি যদি আমার তপস্যায় প্রসন্ন হয়ে থাকেন তবে আমার পুত্র ইন্দ্রকে বলিরাজা কর্তৃক হরণকৃত রাজ্য ফিরিয়ে দিন।” তখন ভগবান বললেন,” দেবমাতা! সে বিরোচন পুত্র আমার বধ্য নয়, যেহেতু সে প্রহ্লাদ বংশোদ্ভূত। সে ধর্মনিষ্ঠ, যশস্বী, লোকবিখ্যাত, আমার পরমভক্ত, আমি তাকে বধ করতে পারি না। তবে তোমার গর্ভে বামন হয়ে জন্মগ্রহণ করে বলিরাজার কাছ থেকে চাওয়ার ছলে ত্রৈলোক্যরাজ্য ভিক্ষা নিয়ে তোমার পুত্র বাসবকে ফিরিয়ে দেব।” এ বলে সর্বলোকেশ্বর হরি অন্তর্ধান হলেন। অচিরেই অদিতির গর্ভ সঞ্চার হল। ক্রমশ: পূর্ণকালে তিনি অপূর্ব একটি সন্তান জন্ম দিলেন। সে পুত্রটি দেখতে অতি সুন্দর। সর্ব লক্ষ্মণ সম্পন্ন। বয়:প্রাপ্ত হয়ে সে পিতা কশ্যপের নিকট উপনীত হয়ে উপনয়নের পর একদা অন্যান্য দ্বিজগণের সহিত বলিরাজার যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হলেন। স্বকীয় মনোহর মূর্তি প্রদর্শন দ্বারা তিনি বলিরাজার মন হরণ করলেন এবং ত্রিপাদ ভূমি চাইলেন। তখন বলিরাজ বললেন,” হে দ্বিজরাজ! তুমি মাত্র ত্রিপাদ ভুমি চাইলে। আমি তোমাকে দ্বীপ, কিংবা নগর কিংবা গ্রাম অথবা যা তুমি চাও তাই আমি তোমাকে দেব। তোমাকে অতি অল্প দান করে তৃপ্তি পাচ্ছি না। আমি তোমাকে আরও অনেক বেশী দান করতে চাই।” তখন বামন বলল,” আকাঙ্খা মতেই আপনি দান করবেন, তাতে আপনার কিছু পরিমান যশ কমবে না। আপনি আমাকে ত্রিপাদ ভূমি দান করে যে প্রকার পূণ্যকীর্তি লাভ করবেন, অন্য কারোও কখনও হয় না, হবেও না।” সভাস্থল হতে অনেক পন্ডিতই বলাবলি করতে লাগল গ্রহীতা তুষ্ঠ হলেই দান সফল হয়। এ কথা শ্রবণ করে রাজা দান করার নিমিত্ত কুশ তিল গ্রহণ করলেন। এমন সময় দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য্য দূর হতে তা নিরীক্ষণ করে বলতে লাগলেন,” ক্ষান্ত হও ক্ষান্ত হও! আমার কথা শোন। আমি নিশ্চিত বলছি এ সামান্য দ্বিজ সন্তান নয়। তিনি দ্বিজরুপী জনার্দন। মায়াতে বামন হয়ে তোমার নিকট হতে ত্রৈলোক্যরাজ্য গ্রহণ করে ইন্দ্রকে প্রত্যর্পণ করবেন।” তখন বলিরাজা বললেন,” গুরু! আমার কুলদেবতা বিষ্ণু, তিনি আমার রাজ্যে এ ত্রিলোক কি জন্যেই ইন্দ্রকে দিবেন? তখন শুক্রাচার্য্য বলল,” দেবকার্য্যের নিমিত্ত বিষ্ণুর অসাধ্য কিছু নেই। যদি তোমার ত্রৈলোক্যরাজ্য রক্ষা করতে চাও তবে এ কপট দ্বিজকে কিঞ্চিৎ পরিমান ভুমিও দান করিও না।” বলিরাজা বলল,” গুরু! আমি দান করিব বলেই বা কেমন করে দান না করিব। আর যদি ছলগ্রাহী হন, তবেই কেমন করে দান করব।” এ রকম বাক্য শ্রবণ করে গুরুদেব শুক্রাচার্য্য বলিরাজাকে বার বার ত্রিপাদ ভূমি দান না করার জন্য বারণ করতে লাগল। বলিরাজা কিছু সময় মৌন হলেন। তারপর দান করাই কতর্ব্য মনে করে নিশ্চিত হয়ে গুরুকে বললেন,” গুরুদেব! যদি স্বয়ং বিষ্ণু বামনরুপে ধারণ করেছেন, আর তিনিই আমার নিকটে ত্রৈলোক্যরাজ্য চাচ্ছেন; তবে এর থেকে আর কি ভাগ্য হতে পারে। বামনরুপধারী সে সাক্ষাত নারয়ণকে আমি দান করব। এর চেয়ে অধিক আমার ভাগ্যে আর কি আছে? গুরু! বিষ্ণুর প্রীতি সম্পাদন না করে যে কর্ম করে সে মূঢ়। আমি বামনদ্বিজরুপী বিষ্ণুকে ত্রিপাদ ভূমি দান করব।” গুরুকে এ কথা বলে বিষ্ণুর প্রীতির জন্য তিনি ত্রিপাদ ভূমি দান করলেন। তখন বামন স্বস্তী বাক্য বলে বিষ্ণু বিশ্বরুপ ধারণ করলেন। পাদপদ্ম তিনটি হল। ত্রিপাদের একপাদ ব্রহ্মান্ড ছেদন করে ঊর্ধ্বমুখী গমন করল। সেই পাদপদ্মে ব্রহ্মা কমন্ডলুস্থিত হতে জল দ্বারা পাদ্য জল প্রদান করেন। আর গঙ্গা তখন বিষ্ণুর পরম পদ প্রাপ্ত হয়ে অবস্থান করছেন। বিষ্ণুর এক চরণের দ্বারা স্বর্গ মর্ত্য সকলই ব্যাপ্ত হল। অপর এক চরণ বলিরাজার মস্তকে দিয়ে বিষ্ণু বললেন,” বৎস! তোমার ত্রিলোকরাজ্য ইন্দ্রর নিকট সমর্পিত হল। এখন তুমি তোমার সভ্যসহ পাতালপুরী প্রস্থান কর। অষ্টম মন্বন্তরে তুমি দেবরাজত্ব প্রাপ্ত হবে। সে সাথে তুমি সকল সভ্যও প্রাপ্ত হবে এ বিষয়ে কোন সংশয় নেই। তখন বলিরাজা বিষ্ণুকে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে পাতালে প্রস্থান করলেন। ত্রিলোক নাথ বিষ্ণুও বৈকন্ঠধামে গমন করলেন। লোকপাবনী গঙ্গা তাঁর চরণকমলেই থাকলেন। এদিকে গঙ্গাদেবীকে হরিপদপ্রাপ্তা জেনে এবং নিজের কমন্ডলুকে শূন্য দেখে বিধাতা মনে মনে চিন্তা করতে লাগলেন দ্রবময়ী গঙ্গা ত্রিলোক দুলর্ভা; তিনি পবিত্র হতেও পবিত্রতমা। তিনি আমার কমন্ডুলতে বাস করতেন। এখন তিনি বিষ্ণুপাদপদ্ম হয়ে একেবাবে নিশ্চলা হয়েছেন। নিশ্চয় তিনি নদী মূর্তি ধারণ করে স্বর্গ মর্ত্য পাতাল ত্রিলোক পবিত্র করবেন। মহাসমুদ্রের সাথে মিলিত হয়ে সেও একটি পবিত্র তীর্থ হবে। কিন্তু এ কার্য কি প্রকারে সংগঠিত হবে। আমি গঙ্গাদেবীর কঠোর তপস্যা করব। নিশ্চয় তিনি বিষ্ণুপাদপদ্ম হতে নি:সৃত হয়ে ত্রিলোক পবিত্র করবেন। তারপর তিনি বৈকন্ঠধামে প্রস্থান করলেন। সেখানে তিনি বহুকাল গঙ্গার তপস্যা করলেন। গঙ্গা প্রসন্ন হয়ে ব্রহ্মাকে সাক্ষাৎ দিয়ে বললেন,” হে ব্রহ্মন! আমি বিষ্ণু তনুতে আরও কিছুদিন অবস্থান করব। পরে ত্রিলোকে প্রবাহমান হব ইহাতে কোন সংশয় নেই। অমিততেজস্বী রাজা ভগীরথ কর্তৃত সংস্তুতা হয়ে ভাগীরথী নাম ধারণ করে আমি ধরণীতলে প্রবেশ করব এবং ভাগীরথের পিতৃলোক উদ্ধার করে পাতালে প্রবেশ করব। তখন ব্রহ্মা কৃতাঞ্জপিপটে বলতে লাগলেন,” হে জননি! আপনি যে সুরবন্দিতে ভগীরথের ইচ্ছা পূরণ করবেন তা আমি জানি। তাই আমিও প্রার্থনা করি আপনি ত্বরায় ধরনীতে অবর্তীন হন। কপিল মুনি কর্তৃক অভিশপ্ত হয়ে ভস্মীভূত সগবরংশ উদ্ধারের জন্য ভগীরথ দেবী গঙ্গাকে ধরণীতলে আবাহন করার জন্য পরমাত্মা বিষ্ণুর আরাধনা করতে লাগলেন। কেন সগরবংশ কপিলমুনি কর্তৃক ভস্মীভূত হয়েছিল তার উপাখ্যান এ রকম- পুরাকালে সগর নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি একটি অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। কিন্তু দেবরাজ ইন্দ্র অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া চুরি করলেন। যার ফলে রাজা সগর অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পন্ন করতে পারলেন না। এদিকে যজ্ঞের ঘোড়া খুঁজে বের করার জন্য সগরের প্রথমা স্ত্রীর ষাট হাজার পুত্র সন্তান পৃথিবী চষে বেড়াচ্ছেন। অবশেষে কপিল মুনির আশ্রমে যজ্ঞের ঘোড়া খুঁজে পেলেন। কপিল মুনি যজ্ঞের ঘোড়া অপরণ করেছে এমন দুর্বদ্ধিুতার জন্য কপিল মুনির অভিশাপে সগরের ষাট হাজার পুত্র সন্তান ভস্মীভূত হল। মহারাজ সগরের আরেক পত্নী সন্তানের নাম ছিল অসমঞ্জস। তার পুত্রের নাম ছিল অংশুমান। তিনি তার পিতামহের নির্দেশে যজ্ঞের ঘোড়া খুঁজতে গিয়ে কপিল মুনির আশ্রমে তা দেখতে পান এবং সেই সাথে পিতৃব্যদের ভস্মরাশিও দেখতে পান। তিনি তখন কপিল মুনির স্তবস্তুতি করে তাকে সন্তষ্ট করেন। মুনি সন্তষ্ট হয়ে যজ্ঞের ঘোড়া নিয়ে যাওয়ার জন্য বলেন এবং সাথে সাথে এও বলেন তার পিতৃব্যরা গঙ্গার জল স্পর্শ মাত্রই উদ্ধার পাবে। অংশুমান ঘোড়া নিয়ে ফিরে আসেন। তখন মহারাজ সগর তার অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পন্ন করেন এবং কিয়ৎকাল পর তিনি চিন্ময় ধামে প্রস্থান করেন। অংশুমান অনেক স্তবস্তুতি করে গঙ্গাকে মর্ত্যলোকে আননে ব্যর্থ হন। তার সন্তান দীলিপও অনেক স্তবস্তুতি করেও গঙ্গাকে মর্ত্যলোকে আনতে পারেননি। পরিশেষে উভয়ের মৃত্যু হলে দীলিপের সন্তান ভাগীরথ বহুকাল পরমাত্মা বিষ্ণুর আরাধন করেন। বিষ্ণু ভাগীরথের আরাধনায় সন্তষ্ট হয়ে তাকে স্বাক্ষাৎ দেন। ভগীরথ ভগবান বিষ্ণুর অনেক স্তবস্তুতি করেন। পরম পুরুষোত্তম ভগবান বিষ্ণু ভগীরথের আরাধনায় সন্তষ্ট হয়ে বললেন,” হে রাজন! আমি তোমার তপস্যায় সন্তষ্ট হয়েছি। এখন তুমি তোমার প্রার্থনা মত বর চাও।” তখন ভগীরথ বললেন,” হে বিভো! আমার পিতৃপুরুষগণ ব্রহ্মশাপে ভস্মীভূত হয়েছেন। তাদের উদ্ধারের জন্য গঙ্গাদেবীকে আমি ধরণীতলে নিয়ে যেতে চাই। যিনি বর্তমানে ব্রহ্মার কমন্ডলুতে বাস করতেন। সেই গঙ্গা এখন আপনার তনুতে অনুগতা রয়েছেন। হে প্রভো! আপনি যদি কৃপা করে দ্রব্যময়ী গঙ্গাদেবীকে তনু হতে বহি:প্রকাশ করেন তবেই আমার পিতৃপুরুষগণ মুক্তি লাভ করবে। হে জগন্নাথ! হে কৃপাময়! আপনি এ বর দান করলেই আমি কৃতার্থ হই।” তখন বিষ্ণু বললেন,” হে বৎস! গঙ্গাদেবী ধরায় অবতীর্ণ হওয়ার এবং তোমার পিতৃপুরুষগণ উদ্ধার হওয়ার উপায় বলছি। তুমি গঙ্গাদেবী ও দেবাদিদেব মহাদেবের আরাধন কর। এ কার্য করলেই তোমার মনের অভিলাষ পূর্ণ হবে।” এ বলে ভগবান ‍বিষ্ণু অন্তর্হিত হলেন। তারপর ভগীরথ হিমালয় পর্বতে গমনপূর্বক সহস্র বৎসর কঠোর তপস্যা করলে গঙ্গাদেবী সন্তষ্ট হয়ে দর্শন দেন এবং তার অভিলষিত বর প্রার্থনা করার জন্য বলেন। তখন ভগীরথ দেবীকে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে বললেন,” হে জননি! হে শিবমোহিনি! যদি আমার প্রতি তুমি প্রসন্ন হও, তবে তুমি ভগবান বিষ্ণুর চরণারবিন্দু হতে প্রকাশ হয়ে ধরাতলে আগমন কর। ধরণীতলের বিবরপথ দ্বারা গমন করে ব্রহ্মকোপানলে ভম্মীভূত আমার পিতৃপুরুষগণকে উদ্ধার কর।” তখন গঙ্গা বললেন,” হে বৎস! আমি বিষ্ণুপাদপদ্ম হতে নি:সৃত হয়ে তোমার পিতৃপুরুষগণকে উদ্ধার করব। যেহেতু তোমার প্রার্থনায় আমি সন্তষ্ট হয়ে বিষ্ণুপাদপদ্ম হতে নি:সৃত হয়ে ধরণীতলে প্রকাশিত হবো সেহেতু আমি তোমার কন্যার রুপ পরিগ্রহ করব এবং ভাগীরথা নামে আমি লোকসমাজে প্রখ্যাতা হব। কিন্তু তারপূর্বে তোমাকে শম্ভূকে প্রসন্ন করতে হবে। তার আজ্ঞা ব্যতীত আমি ধরণীতলে গমন করতে পারব না।” তিনি প্রসন্ন হলেই তুমি এ গিরিশিখরে দাঁড়িয়ে মেঘগর্জনের মত শঙ্খনিনাদ করলেই আমি বৈকন্ঠ ধাম হতে বেগবতী হয়ে ব্রহ্মান্ড ভেদ করে ধরণীতলে অবতরণ করব। তোমার পিতৃপুরুষগণকে উদ্ধার করে পাতাল পুরীতে প্রবেশ করব।” এ কথা বলে গঙ্গা অন্তর্ধান হলেন।
ভগীরথের শিবের আরাধনা : ভগীরথ আনন্দমনা হয়ে মনে করলেন যে তার মনোবাসনা পূর্ণ হবে। তারপর গঙ্গার দর্শনে সে ততোধিক পবিত্র আত্মা হয়ে গঙ্গাদেবীর আজ্ঞানুসারে হিমালয় পর্বতে মহাদেবের তপস্যা করতে লাগলেন। আহারহীনভাবে তিনি শতবর্ষ মহাদেবের তপস্যা করলেন। মহাদেব সন্তষ্ট হয়ে ভগীরথকে দর্শন দিলেন। ভগীরথ মহাদেবকে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করলেন এবং স্তবস্তুতি করতে লাগলেন। ভগীরথের তপস্যা দেবাদিদেব মহাদেব প্রসন্ন হলেন। ভগীরথ আনন্দে নৃত্য করতে লাগল এবং বলতে লাগল,” হে পরমেশ্বর! আজ আমার জন্ম, জীবিত, যজ্ঞ, জপ,তপস্যা সকলই সফল হল। কারণ তোমাকে আমি নয়ন দ্বারা দর্শন করলাম। ত্রিভূবনে আমার মত ভাগ্য আর কার আছে।” তখন মহাদেব ভগীরথকে বললেন,” হে পুত্র! তুমি তোমার আকিঞ্চন প্রকাশ কর। আমি তোমাকে বাঞ্ছানুরুপ বর প্রদান করব।” তখন ভগীরথ গদগদ হয়ে বললেন,” দয়াময়! কপিল মুনির অভিশাশে আমার পিতৃপুরুষগণ ভ্স্মীভূত হয়ে নকরযন্ত্রনা ভোগ করছেন। তাদের উদ্ধারের জন্য আমি গঙ্গাদেবীকে ধরণীতলে আনায়নের চেষ্টা করছি। কিন্তু তিনি আপনার আজ্ঞা ব্যতীরেকে ধরণীতলে অবতীর্ণ হবেন না। হে কান্ত! হে ভব! আপনি আজ্ঞা করুন যাতে ত্রিলোকতারিণী গঙ্গা মহাবেগবতী হয়ে নদীরুপে ধরণীতল পবিত্র করত: আমার পিতৃপুরুষগণকে উদ্ধার করে পাতালে প্রবেশ করেন।” তখন মহাদেব বললেন,” হে বৎস! আমার প্রসাদে অচিরেই তোমার মনোকামনা পূর্ণ হবে। আর মনে রেখে যে কোন ভক্ত আমার স্তব পাঠ করে আমার ধ্যান করলে আমার প্রসাদে তারও মনোরথ পরিপূর্ণ হবে।” ভগীরথ মহাদেবকে দন্ডবৎ প্রণাম করে বললেন,” হে দয়াময়! আপনার কৃপায় আমি কৃতার্থ হলাম।” তারপর মহাদেব অন্তর্হিত হলেন।
বিষ্ণুপাদপদ্ম হতে গঙ্গার উৎপত্তি : ভগীরথ মহেশ্বরের আজ্ঞাপ্রাপ্ত হয়ে জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষে দশমী তিথিতে দিব্যরথে চড়ে হিমালয় পর্বতে গমন করতে লাগলেন। ইত:মধ্যে ধরণীদেবী জানলেন যে, ভগীরথ গঙ্গা আনায়নে হিমালয় পর্বতশৃঙ্গে গমন করছে। তিনি তখন মূর্তি ধারণ করে ভগীরথের নিকট উপস্থিত হয়ে প্রণাম করে বললেন,” আপনি মহাত্মা! আপনার পূর্বপুরুষগণকে নরক হতে উদ্ধারের জন্য গঙ্গাদেবীকে আনার জন্য গমন করছেন তা আমি জানি। আমার প্রার্থনা এই যে, সেই দ্রবময়ী গঙ্গা যেন আমার চারিদিক পবিত্র করেন।” তখন ভগীরথ বললেন,” হে বসুমতী! যখন দ্রবরূপিণী গঙ্গা বিষ্ণপাদপদ্ম হতে বিনির্গতা হয়ে সুমেরুশৃঙ্গ প্রাপ্ত হবেন, সে সময় তুমি তাঁর প্রার্থনা কর। আমি তোমার জন্য বিশেষ করে গঙ্গাদেবীর স্তব করব; নিশ্চয় তিনি কৃপা করবেন। এখন সুমেরুশৃঙ্গ পথে আরোহণ পূর্বক স্বর্গপুর গমন করছি; তুমিও আগমন কর, সেই স্থান পর্যন্ত তাঁর অনুমাগিনী হয়ে আসবে।” ভাগীরথ সুমেরুশৃঙ্গে পৃষ্ঠদেশে সুরম্য স্বর্গপুরীতে উপস্থিত হলেন। রথ হতে নেমে জলদগর্জনের ন্যায় শঙ্খনিনাদ করতে লাগলেন। শঙ্খনিনাদের শব্দ শ্রবণ করা মাত্রই ত্রৈলোক্যতারিণী দ্রবময়ী গঙ্গা বিষ্ণুপাদপদ্ম হতে নি:সৃতা হয়ে কলকল শব্দে মেরুপৃষ্ঠে নিপতিত হতে লাগলেন। চিরবাঞ্চিত ঘটনা অবলোকন করে ভগীরথ শঙ্খনিনাদ বন্ধ করে দুহাত উপরে তুলে নৃত্য করতে লাগলেন। শঙ্খনিনাদ বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে গঙ্গাও বেগ নিবৃত্ত করে সেই শৃঙ্গে কিছু সময় বিশ্রাম করতে লাগলেন। ইতি:মধ্যে ধরণী মূর্তি পরিগ্রহ করে গঙ্গাদেবীর স্তবস্তুতি করতে লাগলেন। গঙ্গাদেবী ধরণীকে জিজ্ঞাসা করলেন,” হে ধরণী! তুমি কিসের জন্য স্তবস্তুতি করছ? কিই বা তোমার অভিলায়? আমার নিকটে তা প্রার্থনা কর।” তখন ধরণী করপুটে বলতে লাগল,” হে জননী দ্রবময়ী! আপনি পৃথিবীর বিবরপথে গমন করে মহারাজ ভগীরথের পিতৃপুরুষদের উদ্ধার করবেন। আমার প্রার্থনা এই যে, আপনি আসমুদ্র বিস্তার করে আমার পৃষ্ঠে বিহার করুন। আমার সুবিস্তৃত তনু চারিদক হতে পবিত্র করুন।” এ কথা শুনে গঙ্গা বললেন,” হে ধরণী! মহাত্মা ভগীরথ তপস্যার দ্বারা প্রথমে বিষ্ণুকে সন্তষ্ট করেছেন। বিষ্ণুর ইচ্ছায় আমি বিষ্ণুপাদপদ্ম হতে নি:সৃতা হয়ে এসেছি; তাই মহারাজ ভগীরথের অনুমতি ব্যতীত অন্য কোন কার্য করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।” এ কথা শুনে তখন মহারাজ ভগীরথ বললেন,” হে গঙ্গে! হে মহাভাগে! হে পবিত্ররূপিণী! আপনি ধরণীর প্রতি কৃপা করুন।” গঙ্গা মহারাজ ভগীরথে মনোভাব অনুধাবন করে পশ্চিম, উত্তর ও পূর্ব এ তিন দিকে তিনটি ধারাকে বেগবতী করলেন। অন্য একটি মহতী ধারা দক্ষিণ দিকে বেগবতী হয়ে ভগীরথের অনুগামি হলেন। তখন স্বর্গের দেবগণ ও কিন্নরগণ গঙ্গাদেবীর পূজা করতে লাগলেন। দেবরাজ ইন্দ্র দেবতাসমেত বিনয় বচনে মহারাজ ভগীরথকে বললেন,” হে ক্ষত্রিয়কুলতিলক! হে পূর্ণ্যকীর্ত্তি ভগীরথ! আপনি গঙ্গদেবীকে ধরণীতলে নিয়ে ‍যাচ্ছেন। অনুগ্রহ করে আমাদের কথা শুনুন। দেবরাজ ইন্দ্রের বাক্য শুনামাত্রই ভগীরথ চমকিত হয়ে রথ থামিয়ে অবতরণ করলেন এবং বললেন,” হে অমরনাথ! আপনি আমার প্রতি আজ্ঞা করুন। প্রভো আমি অবশ্যই আপনার আজ্ঞানুবর্তী।” দেবরাজ ইন্দ্র বললেন,” হে রাজন! তপোবলে তুমি গঙ্গাকে প্রাপ্ত হয়েছে; তবে কি সমগ্রই ধরাতলে নিয়ে যাবে? আমারদের বাসনা যে গঙ্গাদেবীর সুললিতা একটি ধারা স্বর্গপুরীতেও অবস্থান করুক; মর্ত্ত্যলোকে যেমন তোমার কীর্তি চিরবিরজমান থাকবে, তেমনি স্বর্গলোকেও সেরুপ হোক।” অমরপতির বাক্য শ্রবণ করে ভগীরথ বললেন,” হে গঙ্গে! হে মহাভাগে! দেবদেবীদের বাসনা পূরনার্থে আপনার একটি সুললিত ধারা স্বর্গপুরীতে অবস্থান করলেই দেবরাজ ইন্দ্রের আজ্ঞা পালন করে প্রীত হই ।” ভগীরথের প্রার্থনামতে দেবীগঙ্গা নিজাঙ্গ হতে আর একটি মহতী ধারা সৃজন করলেন। সে ধারা নিরুপমা পূণ্যতমা, উত্তরাভিমুখে গমন করতে লাগল। সে ধারার নাম হলো মন্দাকিনী। এ মন্দাকিনীতে দেবতা, গন্ধর্ব, দেবর্ষি প্রভৃতি সকলে প্রত্যহ স্নান করেন। তারপর ভগীরথ ইন্দ্রাদি দেবতার নিকট হতে বিদায় নিয়ে গঙ্গাকে নিয়ে দক্ষিণাভিমুখে চললেন। সুমেরু পর্বতের দক্ষিণ শৃঙ্গে ভগীরথ দেখলেন সে শৃঙ্গ অত্যন্ত উঁচু এব মোটা। ভগীরথ কাতর হয়ে গঙ্গাকে জিজ্ঞাসা করলেন,” হে গঙ্গে! এ শৃঙ্গকে কিভাবে ভেদ করে আপনাকে আমি ধরণীতলে নিয়ে যাব? তখন গঙ্গাদেবী বললেন,” হে বৎস! আমি এ শৃঙ্গে কিছু সময় অবস্থান করি। তুমি এ শৃঙ্গে আরোহণ করে দক্ষিণ পার্শ্বে অবস্থান কর। সেখান হতে শঙ্খধ্বনি শ্রবণ মাত্রই আমি এ শৃঙ্গ ভেদ করে তোমার রথের অনুসন্ধান করে নিব।” গঙ্গাদেবীর উপদেশ মতে ভগীরথ শৃঙ্গের দক্ষিণ পার্শ্বে উপস্থিত হয়ে শঙ্খনিনাদ করতে লাগলেন। গো-বৎসের চিৎকারে গোমহিষীগণ যেমন দুগ্ধদানের নিমিত্ত বেগে ধাবমান হয় তেমনই ভগীরথের শঙ্খধ্বনির শব্দে গঙ্গাও পরমবেগিনী হয়ে ক্ষণমাত্রেই গিরিশৃঙ্গ ভেদ করে ভগীরথের নিকটে উপস্থিত হলেন।
গঙ্গার হিমালয়ে অবতরণ : মহারাজ ভগীরথের রথানুগামিনী হয়ে মহাবেগবতী গঙ্গা ক্রমশ: দক্ষিণ দিকে গমন করতে লাগলেন। পথিমধ্যে দেবতা, গন্ধর্ব দেবর্ষি ব্রহ্মর্ষি প্রভৃতি সকলে নানাবিধ পূষ্পমালা ও বিল্লদল, বিচিত্র পূষ্প চন্দন দুর্বা ও অক্ষতাদি লয়ে ভক্তিভাবে গঙ্গার পূজা করতে লাগলেন। এতে গঙ্গাশুভ্রফেণনিকর দ্বারা ততোধিক শোভমানা হয়ে সুতুঙ্গ তরঙ্গ বিস্তার করে দুর্ভেদ্য পর্বতদূর্গ সকল ভেদ করে নিষধ নামক মহা পর্বতে উপস্থিত হলেন। সে পর্বত অতিক্রম করে হেমকূট পর্বতে উপস্থিত হলেন। হেমকূট পর্বত অতিক্রম করে যখন হিমালয় পর্বতের নিকট উপস্থিত হলেন। মহাদেব দেখলেন যে সুশোভনা গঙ্গাদেবী তাঁর দিকে অগ্রসরমান। তখন তিনি গঙ্গাকে ধৃত করবার জন্য কিছূ সময় নিস্তদ্ধভাবে থাকলেন। কিছুক্ষণ পর বৈশাখী পূর্ণমাসী দিবসে মধ্যাহ্ন সময়ে দ্রবময়ী গঙ্গা শম্ভূর মস্তকোপরি সমাগতা হলেন। তখন গঙ্গাধর গঙ্গার সহিত জটাভার বন্ধ করে নৃত্য করতে লাগলেন। হঠাৎ ভগীরথ পিছনে ফিরে দেখেন গঙ্গা নেই। নিকটেই গঙ্গাধর নৃত্য করছেন। তখন মহাদের মস্তকোপরি তরঙ্গ কল্লোল শ্রবণ করে জানতে পারলেন গঙ্গা গঙ্গাধরের মস্তকস্থিতা হয়েছেন। তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলেন। অবশেষে চিন্তা করলেন ভোলানাথে সঙ্গ পেয়ে যদি আমাকে ভুলে থাকেন; তাই ভগীরথ শঙ্খনিনাদ করতে লাগলেন। শঙ্খনিনাদ শ্রবণ করা মাত্রই গঙ্গা শিবের মস্তক হতে বাহির হওয়ার জন্য চেষ্টা করতে লাগলেন কিন্তু তিনি বাহির হওয়ার কোন পথ পেলেন না। এভাবে এক বৎসর অতিবাহিত হল। তখন ভগীরথ মহাদের স্মরনাপন্ন হয়ে বললেন,” হে দেবদেব! আপনি আমার প্রতি কৃপা করুন। আপনিই বর প্রদান করেছিলেন যে গঙ্গা বিবরপথে গমন করে আমার পিতৃপুরুষগণকে উদ্ধার করেবেন। বিষ্ণুপাদপদ্ম হতে আপনিই আনয়ন করলেন আবার আপনিই হরণ করলেন। হে গঙ্গাধর! তবে আমার পিতৃপুরুষগণ কিভাবে উদ্ধার পাবে? গঙ্গাকে আপনার মস্তক হতে পরিত্যাগ করে, আপনার প্রদত্ত বর আপনি রক্ষা করুন।” তখন মহাদেব বললেন,” হে রাজন! আমি গঙ্গাকে অবশ্যই পথ প্রদান করব। নিশ্চয় তিনি তোমার পিতৃপুরুষগণকে উদ্ধার করবেন। কিন্তু জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্ল দশমীতে মঙ্গলবার এবং হস্তানক্ষত্রের যোগ হবে সেদিন গঙ্গা আমার মস্তক হতে বিনি:সৃত হবেন। সে সময় পর্যন্ত তুমি অপেক্ষা করে থাক।” যথাসময়ে তিথি উপস্থিত হল। ভগীরথ শঙ্খধ্বনি করতে লাগলেন। কিন্তু গঙ্গাদেবী মহাদেবের মস্তক হতে বের হচ্ছেন না। গঙ্গা মহাবেগে মহাদেবের জটামন্ডলীর মধ্যে ভ্রমণ করতে লাগলেন। কিন্তু নি:সরণ হওয়ার কোন পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। তখন গঙ্গা কাতরস্বরে বললেন,” প্রভূ! আমি শরণাগতা, ভগীরথের আহ্বানে আমি অস্থির হয়েছি। আমাকে নি:সরণের পথ প্রদর্শন করুন।” তখন মহাদের বাম হস্ত দ্বারা জটাগ্রন্থি কিঞ্চিৎ শিথিল করে দক্ষিণদিকে পথ প্রদান করলেন। নির্গমের পথ পেয়ে গঙ্গা মহাবেগে ভগীরথের রথের অনুগামিনী হলেন। গঙ্গা হিমালয় পর্বতে তুঙ্গ তরঙ্গ বিস্তার করে পর্বতীয় ভূমি সকল জলবেগে প্লাবিত করতে লাগলেন। এতে অনেক সিংহ, শার্দুল, বানর জলমগ্ন হল। গঙ্গা ক্রমশ নিম্নদিকে নিপতিত হতে লাগল। গঙ্গার জননী মেনকা ও পিতা গিরীন্দ্র উভয়ে গঙ্গাকে দর্শন করলেন। পিতা মাতার সহিত গঙ্গা চিরবিযুক্ত ছিলেন। গঙ্গাদেবী অবনত মস্তকে পিতামাতার চরণ বন্দনা করলেন। গঙ্গা ক্রমশ: হিমালয় শৃঙ্গ হতে নিম্নাভিমুখী হয়ে ভূতলে অবতীর্ণ হলেন। ভূতলস্থ মহর্ষিগণ ব্রহ্মার দুর্লভ ধন গঙ্গাকে প্রাপ্ত হয়ে আনন্দিত হলেন। ধরণীতলে অবতীর্ণ হয়ে গঙ্গার বেগ চতুর্গুন বৃদ্ধি পেল। ধরণীতল গঙ্গাকে লাভ করে কৃতার্থ হলেন। গঙ্গাও বেগবতী হয়ে গিরি-গহ্বর, কানন, উপবন, গ্রাম নগর সরোবর পলল প্রভৃতিকে জলপ্লাবিত করে ক্রমশ: দক্ষিণাভিমুখী চলিলেন। রাজষিবর্গ ও ব্রহ্মষিবর্গ সকলে স্তব করতে লাগলেন। এভাবে গঙ্গা হাজার হাজার যোজন অতিক্রম করে হরিদ্বার উপস্থিত হলেন। হরিদ্বার অতি পবিত্র ভূমি। এ পবিত্র ভূমিতে মরীচি প্রমুখ সপ্তর্ষিমন্ডল বাস করেন। তাঁরা সকলে গঙ্গাকে দর্শন করে পাদ্য অর্ঘ্য দিয়ে পূজা করলেন। শঙ্খশব্দে দেবীর আনন্দ দেখে সপ্তর্ষিগণ সপ্তদিকে শঙ্খনিনাদ করতে লাগলেন। পবিত্র ঋষিগণের শঙ্খনিনাদ শ্রবণ করে গঙ্গাদেবী সপ্তদিকে সপ্তধারা হলেন; অপর একটি ধারা প্রবাহিত হয়ে ভগীরথের নিকটে রইলেন। সেই সকল ধারা অগ্নিকোণমুখে চলিল। কিছুদূর গিয়ে গঙ্গা প্রয়াগ নামক স্থানে আগমনপূর্বক যমুনা-সরস্বতীর সহিত মিলিত হলেন। এ মিলন স্থান প্রয়াগ তীর্থ নামে খ্যাত। অতিশয় পবিত্র স্থান। এ তীর্থে স্নান, তপস্যা, দান সকলই পূণ্যতম হয়। ব্রহ্মাদি দেবতাও এ তীর্থে স্নান করে কৃতার্থ হন। অত:পর গঙ্গা পূর্বমুখী হয়ে কিছুদূর গিয়ে কাশীপুরের পার্শ্বদিয়ে বিশ্বেশ্বরের দর্শনার্থে উত্তর অভিমুখে যাত্রা করেন। কাশীতলস্থিত গঙ্গা বিশেষ পূণ্যস্থান। বারাণসী যেমন নির্বাণপদ তেমনি বারাণসীপার্শ্বস্থ গঙ্গাও তনুত্যাগীর সম্বন্ধে নির্বাণপদ প্রদান করে। অত:পর দ্রবময়ী গঙ্গা কাশীপুর উপস্থিত হলে গণাধিপতি কালভৈরব গঙ্গাদেবীকে বাধা দেয়ার জন্য গঙ্গাভিমুখে ধাবমান হলেন। নিকটে এসে কালভৈরবী বললেন,” কে ‍তুমি এ শিবপুরী প্লাবিত করতে এসেছ। তুমি জান না এ পুরী দেবাদিদেবের। আমি পুরীর রক্ষক। তখন গঙ্গাদেবী নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন,” আমি দ্রবময়ী গঙ্গা শঙ্করগেহিনী, শিব মস্তক হতে আমি নি:সৃতা হয়ে কাশীপুরকে প্লাবিত করতে আসিনি; আমি এসেছি বিশ্বেশ্বরের দর্শনাভিলাষে। গঙ্গার তেজস্বিনী কথায় কালভৈরবী আস্বস্থ হলেন। তারপর গঙ্গাদেবী কামাক্ষা দর্শনের অভিপ্রায়ে পূর্বাভিমুখী হলেন। ভগীরথ গঙ্গাদেবীর অভিপ্রায় বুঝতে পেরে মনে মনে চিন্তা করলেন তবে আমার পিতৃপুরুষগণের উদ্ধার কাজ কঠিন মনে হচ্ছে। এ মনে করে ভগীরথ সারথিকে অশ্বচালনা করতে নিষেধ দিলেন এবং শঙ্খধ্বনিও বন্ধ করলেন। ঠিক এ সময়ে জহ্নুমুনি তার আশ্রম হতে শঙ্খধ্বনি করতে লাগলেন। ঐ শঙ্খধ্বনি শ্রবণ করে গঙ্গা মহাবেগে মুনির আশ্রমের দিকে ধাবিত হলেন। তা দর্শন করে ভগীরথ পুনরায় শঙ্খধ্বনি করতে লাগলেন। ভগীরথের শঙ্খধ্বনি শ্রবণ করে গঙ্গাদেবী জানলেন যে জহ্নুমুনি প্রতারণা করে শঙ্খধ্বনি করেছেন। তিনি ক্রুদ্ধ হলেন এবং মুনির আশ্রম জলমগ্ন করতে উদ্যত হলেন। সেই মুনি তপোবলে সব জানতে পারলেন। আশ্রমে আগতা দ্রবময়ী গঙ্গাদেবীকে আদরে গন্ডুষ গ্রহণে অমৃততুল্য পান করলেন।ঋষির কি আশ্চর্য তপোবল। বিশালকল্লোলময়ীকে গন্ডুষ মাত্রে নি:শেষ পান করলেন। কোনস্থলে বিন্দুমাত্রও থাকল না। স্বর্গলোক হতে হাহাকার শব্দ হল, ধরণীতলে মহাত্মা মানব ছিলেন তারও মূর্ছিত হলেন। রাজা ভগীরথ উচ্চস্বরে রোদন করতে লাগলেন। পৃথিবী পরমদু:খিতা হলেন। দিবাকরের প্রভা ম্লান হল। রাজা ভগীরথের রোদন শব্দে গঙ্গা বললেন,” বৎস তুমি রোদন করো না। পুনরায় তুমি শঙ্খধ্বনি কর। তোমার শঙ্খধ্বনি আমি হৃষ্টমনা হয়ে বেগবতী হব। সে বেগ ধারণ করতে কেবল মহাদেবই পারেন; আর কেহ নহে। তারপর ভগীরথ ধরণীতলকে সংক্ষুব্ধ করত পুনরায় শঙ্খনিনাদ করতে লাগলেন। সেই শঙ্খধ্বনি শ্রবণ করে গঙ্গা মহাবেগ প্রবাহে মুনিবরের জানুদেশ ভেদ করে নি:সরণ করতে থাকলেন এবং তরঙ্গ বিস্তার করে চলতে লাগলেন। মুনিবর ধ্যানমগ্ন হয়ে জানতে পারলেন যে এ নদী সামান্যা নদী নয়; ব্রহ্মলোকনিবাসিনী গঙ্গা। তার উপর আমি তেজ প্রকাশ করেছি- অপরাধ করেছি। এ ভেবে গঙ্গাকে পাদঅর্ঘ্য প্রভৃতি উপাচারে পূজা করলেন এবং স্তবস্তুতি করতে লাগলেন। স্তবস্তুতি করতে করতে মুনিবর নয়ন জলে ভাসলেন। তখন দ্রবময়ী গঙ্গা আপন মূর্তি ধারণ করে বললেন,” হে মুনিবর যখন আমি আপনার দেহ হতে নির্গত হয়েছি তখনই আপনি আমার পিতা হয়েছেন। আপনার প্রতি আমার বিন্দুমাত্র অপরাধ নেই। হে পিত! আমি জাহ্নবী নামে জগত সংসারে বিখ্যাত হব; এ নাম তোমার কীর্ত্তিকর হল। যে ব্যক্তি জাহ্নবী নাম স্মরণ করবে তার পাপতাপ দূরীভূত হবে। তোমার স্তব দ্বারা আমি সন্তষ্ট হয়েছি। তুমি আমার পরম ভক্ত। পরম ভক্তের যে প্রকার গতি হয় তোমার সেই গতিই হবে। আর অন্য কেহ যদি ভক্তিভাবে স্তব করে সেও পরম গতি প্রাপ্ত হবে। তারপর গঙ্গাদেবী পূর্বাভিমুখী গমন করার প্রাক্কালে ভগীরথকে বললেন,” হে বৎস! তোমার তপস্যায় আমি বাধিত হয়ে বিষ্ণুপাদপদ্ম হতে নি:সৃত হয়ে ধরণীতলে আগমন করেছি; এ পর্যন্ত তোমার বশবর্তী হয়েই আসছি। কিন্ত কামাখ্যা দর্শনাভিলাষে পূর্বাভিমুখী হয়েছিলাম তাতেই প্রথমে মুনিবরের সাথে বিরোধ হল। এখন তুমি যা অভিলাষ করবে আমি তথায় গমন করব।” ভগীরথ বললেন,” জননি! আপনি দক্ষিণাভিমুখী চলুন; যেখানে আমার পিতৃপুরুষগণ ব্রহ্মশাপে ভস্মীভূত হয়ে আছেন। হে জননী! এ কার্য করে আপনি আমাকে কৃতার্থ করুন।” এভাবে বহু শত পথ অতিক্রান্ত করে ভগীরথ ক্লান্ত হয়ে সামান্য সময়ের জন্য শঙ্খনিনাদ বন্ধ করলেন। সারথিও পরিশ্রান্ত হয়ে বিশ্রাম নিলেন। জহ্নু মুনির কন্যা পদ্মা। তিনি একজন তপস্বিনী ছিলেন। তিনি প্রভাবে বা তপোবলে জানতে পেরেছিলেন ত্রিলোকতারিনী গঙ্গা তার কনিষ্ট ভগ্নি হয়েছেন। সে গঙ্গাকে নিকটে দেখে শঙ্খনিনাদ করতে লাগলেন। আর গঙ্গাও সে দিকে গমন করতে উদ্যত হলে দৈব বশত: ভগীরথও সে সময় শঙ্খধ্বনি করতে লাগলেন। ভগীরথের শঙ্ধ্বনি শ্রবণ করা মাত্রই ভগীরথের পশ্চাতে ধাবমান হলেন। ইহা দর্শন করে পদ্মা ক্রোধান্বিত হলেন এবং নিজেই প্রবল বেগবতী এক নারীমূর্তি ধারণ করলেন। সমুদ্রজলে শায়িনী হবে দূরভিসন্ধি করে দুকূলকে ভঙ্গভয়ে ব্যাকুল করতে লাগলেন। আর এদিকে গঙ্গাদেবী সগর রাজার বংশকে অন্বেষণ করতে করতে পরম বেগ ধারণ করে দক্ষিণ দিকে গমন করতে লাগলেন। সমুদ্র নিকট উপস্থিত হয়েও যখন সগর বংশের কোন ভস্মীভূত দেখতে পেলেন না তখন গঙ্গা শত ধারায় বিস্তৃর্ণ হয়ে শতদিকে গমন করতে লাগলেন। জল শব্দের মহাকল্লোল বহুদিক ছড়িয়ে পড়ল। সেই শব্দ শ্রবণ করে সমুদ্র উদ্বেলিত হয়ে গঙ্গাকে দর্শন করতে আগমন করল এবং বিবিধ প্রকার উপাচারে গঙ্গাদেবীর পূজা করলেন। সমুদ্রের সহিত মিলত হয়ে গঙ্গা পাতালতলে প্রবেশ করলেন। কপিলমুনির আশ্রমে উপস্থিত হয়ে মহর্ষি গঙ্গাদেবীকে পূজা করলেন। তখন জাহ্নবী জিজ্ঞাসা করলেন,” মহর্ষি! সগর সন্তানগণ কোন স্থানে ভস্মীভূত হয়েছেন? তখন মুনিবর বললেন,” জননী! দেখুন ভস্মরাশি স্থানে স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। গঙ্গা সে ভস্মরাশি দেখা মাত্রই তা জলপ্লাবিত করলেন। ভ্স্ম সকল গঙ্গার জল স্পর্শমাত্রই চারুচতুর্ভুজধারী হয়ে দিব্যরথে আরোহণ করে ব্রহ্মলোকে গমন করতে লাগলেন। পিতৃপুরুষগণের মুক্তি লাভ দর্শন করে আনন্দে নৃত্য করলে লাগলেন। আর গঙ্গার জয় হোক জয় হোক বলে ধ্বনি দিতে লাগলেন। ভগীরথ রোমাঞ্চিত হয়ে পুনরায় শঙ্খধ্বনি করলে লাগলেন; সেই শঙ্খধ্বনি শ্রবণ করে গঙ্গা পাতাল বিবর হতে ধরণীতলে আগমন করলেন। আর একটি ধারা পাতালপুরীতে রয়ে গেল। সে ধারাটি ভোগবতী নামে বিখ্যাত হলেন। গঙ্গাদেবী ক্রমশ: নিম্নাভিমুখী হয়ে কারণ সাগরে পতিত হলেন; যে কারণ সাগরে কোটি কোটি ব্রহ্মান্ড জলবিম্বপ্রায় ভাসিতেছে। তারপর ভগীরথ গঙ্গাদেবীর পূজা অর্চনা করে প্রসন্ন বদনে নিজ সদনে গমন করলেন। এভাবে গঙ্গাদেবী যিনি বিষ্ণুপাদপদ্মে বাস করতে; তিনিই সর্বলোকের হিতার্থে পৃথিবীতে আগমন করেন। (সূত্র: মহাভাগবত পুরান)
গঙ্গার মহাত্ম্য : পুরাকালে সর্বান্তক নামে এক ব্যাধ ছিল। সে শুধু পাপ কার্যই করত। প্রাণি হত্যা করত। প্রাণি হিংসা করেই জীবনযাপন করত। সে সর্বদাই অপরের দ্রব্য অপহরণ করত। পরলোভে মত্ত থাকত। সে ব্যাধ কোন ধর্মকর্ম করত না। একদিন এ ব্যাধ বনে প্রবেশ করে বিভিন্ন ধরণের পশুপাখী শিকার করে অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং বনের পাশেই একটি স্রোতস্বীনি নদীতে স্নান করত শিকার সামগ্রী লয়ে রওনা দিল। ঠিক এ সময় চিত্রসেন নামক একজন মহাবলপরাক্রান্ত রাজা হরিণ শিকারের জন্য বনে প্রবেশ করলেন। রাজা বনে ইতস্ত:ত ভ্রমণ করতে করতে হঠাৎ একটি হরিণের সন্ধান পেলেন এবং যথারীতি শর নিক্ষেপ করলেন। শর নিক্ষেপের সাথে সাথে হরিণটিও পলায়নোদ্যত হল। কিন্তু শর তার শরীরে বিদ্ধ হল। তথাপি জীবন বাঁচানের জন্য হরিণটি প্রাণপণে ছুটতে লাগল। রাজাও হরিণের পিছু পিছু ছুটতে লাগল। যন্ত্রনাকাতর হওয়াতে হরিণটি দ্রুতবেগে রাজার চেয়ে অধিক দূরত্ব অতিক্রম করে ব্যাধ সর্বান্তক যে স্থান দিয়ে পশুপাখী সামগ্রী নিয়ে আসছিল সেখানে এসে পড়ল। ব্যাধ সর্বান্তক মনে করল কোন পুরুষ হয়ত তাকে আহত করেছে এবং দূরবর্তী কোন স্থানে কাউকে না দেখতে পেয়ে মাংশ পাবার লোভে হরিণকে পাশবদ্ধ করে তার শরীর থেকে মাংশ ছড়াতে লাগল। কিন্তু রাজা চিত্রসেন দূর হতে ব্যাধের সমস্ত কার্যকলা দর্শন করলেন এবং ক্রোধান্বিত হয়ে অতিদ্রুত ঘোড়া চালিয়ে ব্যাধের নিকট উপস্থিত হলেন। ব্যাধের পাশ দ্বারাই ব্যাধকে আবদ্ধ করলেন। তারপর রাজা চিত্রসেন দলবলসহ নৌকাযান দ্বারা গঙ্গা নদী পাড় হয়ে রাজধানীর দিকে রওনা হলেন। পাপী ব্যাধ এ সময় গঙ্গা নদী দর্শন করলেন। পরদিন প্রাত:কালে প্রাত:কৃত্যাদি সমাপন করে রাজা বিচার আসনে বসলেন। পাশ আবদ্ধ ব্যাধকে রাজার নিকট হাজির করা হল। তারপর রাজা কিছুদিনের জন্য ঐ ব্যাধকে করাদন্ড দিলেন। অল্পদিনের মধ্যেই কারাগারে ব্যাধ মৃত্যুবরণ করল। মৃত্যুর পর যমদূত ব্যাধের আত্মাকে নিয়ে যমালয়ে রওনা হলেন। কিন্তু এ সময় শিবদূতগণ সেখানে উপস্থিত হলেন। তারা সকলেই ত্রিশূলধারী, বিশালজটামন্ডিতমস্তক, ব্যাঘ্র-চর্ম পরিহিত, মহাবলপরাক্রান্ত অথচ প্রশান্তমূর্তি। যমদূতকে বললেন”, তোমরা দুষ্কর্ম করেছ। এ ব্যক্তিকে নিয়ে যাওয়ার কোন অধিকার তোমাদের নেই। তোমরা বিশেষ তত্ত্ব না জেনে ইহাকে নিতে এসেছ। শ্রীঘ্র তোমরা তাকে পাশ মুক্ত করে এ স্থান ত্যাগ কর। নতুনা আমরা তোমাদিগকে তাড়িত করব।” এ কথা শ্রবণ করে যমদূতগণ যমালয়ে উপস্থিত হয়ে যমকে সবিস্তারের বলল। তখন যমরাজ চিত্রগুপ্তকে বলল”, চিত্রগুপ্ত, একবার অনুসন্ধান করে দেখ দেখি সর্বান্তক ব্যার্ধে কিঞ্চিৎমাত্রও পূণ্যযোগ আছে কিনা? এ ব্যক্তি তো সারাজীবন পাপ কার্যই করেছ। চিত্রগুপ্ত অনেক অনুসন্ধান করেও তার কোন পূণ্য কার্য দেখতে না পেয়ে মৌন হয়ে রইলেন। তখন যমরাজ বলল”, চিত্রগুপ্ত, ব্যার্ধের কোন পূণ্য কর্ম দেখতে পাচ্ছ না। তুমি ব্যাধের কর্ম সকল আমাকে শুনাও দেখি।” তখন চিত্রগুপ্ত ব্যার্ধের কর্ম সকল পর্যায়ক্রমে রাজাকে শ্রবণ করাতে লাগলেন। যমরাজ মনোযোগসহকারে তার শ্রবণ করতে লাগলেন। যমরাজ যখনই শুনলেন বন্ধন অবস্থায় নৌকাযোগে গঙ্গা নদী পার হয়েছে, তখনই রাজার নয়ন বেয়ে অশ্রু ঝরলে লাগল। চিত্রগুপ্তের দিকে চেয়ে যম বললেন,” মন্ত্রী! স্বীয় যত্নে বা পরকীয় যত্নে যে কোন সর্ম্পকেও গঙ্গার দর্শন হলে সে ব্যক্তিতে আমার আধিকার থাকে না, একথা আমি পরম যোগী পঞ্চবদনের মুখে শুনেছি। তাই চিরদিন পাপাসক্ত থাকা সত্ত্বেও গঙ্গা দর্শন মাত্রই ব্যাধের মুক্তি লাভ ঘটেছে। যম তখন দূতগণকে ডেকে বলল,” অজ্ঞানবশত: এ কাজ করেছ। আমি তোমাদিগকে আজ ক্ষমা করলাম। কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য সাবধান থাকবে। পুরাকালে ধনাধিপতি নামে একজন বৈশ্য ছিল।
বনের মধ্যে দস্যুবৃত্তি করত। এতে ব্রহ্মহত্যা, নরহত্যা, স্ত্রীহত্যা করত। হঠাৎ সে ব্যধিগ্রস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করল। যামরাজ তাকে অসিপত্র নামক নরকে নিপতিত করার জন্য দূতগণকে নির্দেশ দিলেন। বৈশ্য সে অসিপত্র নামক নরকে কঠোরযন্ত্রনায় চিৎকার করছে। তার দেহ গলিত হয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। শৃগালসকল তার গলিত দেহ ভক্ষণ করতে লাগল। তারপর শকুন এসে শৃগালদের বিতাড়িত করে ঐ বৈশ্যে গলিত দেহ ভক্ষণ করতে লাগল। সেই মাংশ ভোজী শৃগালের মধ্যে একটি শৃগাল দৈবাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে দ্রুত গমন করতে লাগল। দ্রুত গমন করতে করতে তার জল পিপাসা পেল। দূরেই গঙ্গা নদী প্রবহমান ছিল। জল দেখতে পেয়ে দ্রুত বেগে গঙ্গার নিকটে এসে উদর পূরণ করে জল পান করল। সে সময় মৃত বৈশ্যের গলিত মাংশ শৃগালের উদরে বর্তমান ছিল। গঙ্গা জল উদরে প্রবেশ করে সেই মাংশ কণিকাতে স্পর্শ করা মাত্রই ধনাধিপতি বৈশ্য শিবদেহ প্রাপ্ত হয়ে দিব্যরথে আরোহণ করে শিবলোকে গমন করলেন। এ অদ্ভুদ ঘটনা দেখে অসিপত্র নরকের রক্ষিগণ দ্রুত যম সভায় উপস্থিত হয়ে সবিস্তারের বর্ণনা করল। ঘটনা শুনে যমরাজ চকিত হলেন। তিনি ধ্যান করে ঘটনা জানতে পেরে দূতগণকে বললেন,” বনের মধ্যে যেখানে বৈশ্যের মৃত দেহ পড়েছিল সেখানে কতকগুলি শৃগাল তার মাংশ ভক্ষণ করে। তারমধ্যে একটি শৃগাল গঙ্গার জল পান করেছিল। শৃগালের উদরে বৈশ্যের গলিত মাংশ কণিকার সাথে গঙ্গার জল স্পর্শ হওয়া মাত্রই সেই পাপাত্মা ধনাধিপতি পাপ মুক্ত হয়ে শিবলোকে গমন করেছে।
গঙ্গার দেবীর শতনাম গঙ্গা, ত্রিপথগা, দেবী, শম্ভুমৌলিবিহারিণী, জাহ্নবী, পাপহন্ত্রী চ, মহাপাতকনাশিনী, পতিতোদ্ধারিণী, শ্রোতস্বতী, পরমবেগিনী, বিষ্ণুপাদার্ঘসম্ভূতা, বিষ্ণুদেহকৃতালয়া, স্বর্গাধিনিলয়, সাধ্বী, স্বর্ণদী, সুরনিম্নগা, মন্দাকিনী, মহাবেগা, স্বর্ণশৃঙ্গপ্রভেদিনী, দেবপূজ্যতমা, দিব্যা, দিব্যস্থাননিবাসিনী, সুচারুনীররুচিরা, মহাপর্ব্বতভেদিনী, ভাগীরথী, ভগবতী, মহামোক্ষপ্রদায়িনী, সিন্ধুসঙ্গগতা, শুদ্ধা, রসাতলনিবাসিনী, ভোগবতী, মহাভোগা, সুভগা, আনন্দদায়িনী, মহাপাপহরা, পারা, পরমহ্লাদদায়িনী, পার্ব্বতী, শিবপত্নী চ, শিবশীর্ষকৃতালয়া, শম্ভো--, নির্মল, নির্মলাননা, মহাকলুষহন্ত্রীচ, জহ্নুপুত্রী, জগৎপ্রিয়া, ত্রৈলোক্যপাবনী, পূর্ণা, পূর্ণব্রহ্মস্বরুপিনী, জগৎপূজ্যতমা, চারুরুপিণী, জগদম্বিকা, লোকানুগ্রহকর্ত্রীচ, সর্ব্বলোকদয়াপরা, যাম্যভীতিহরা, তারা, পরা, সংসারতারিণী, ব্রহ্মান্ডভেদিনী, ব্রহ্মকমন্ডলুকৃতালয়া, সৌভাগ্যদায়িনী, পুংসাংনির্বাণপদদায়িণী, অচিন্ত্যচরিতা, চারুরুচিরা, শিবমনোহরা, মর্ত্তস্থা, মৃত্যুভয়হা, মহামৃত্যুপ্রদায়িনী, পাপাপহারিণী, দূরচারিণী, বীচিধারিণী, কারুণ্যপূর্ণা, করুণাময়ী, দুরিতনাশিনী, গিরিরাজসুতা, গৌরিভগিনী, গিরিশপ্রিয়া, আদ্যা, ত্রিলোকজননী, ত্রৈলোক্যপরিপালিনী, তীর্থশ্রেষ্ঠতমা, সর্বাতীর্থময়ী, শুভা, চতুবের্দময়ী, সর্বা, পিতৃসংপ্তিদায়িনী, শিবদা, শিবসাযুজ্যদায়িনী, শিববল্লভা, তেজস্বিনী, ত্রিনয়না, ত্রিলোচনা, মনোরমা, সপ্তধারা, শতমুখী, সগরান্বয়তারিণী, মুনিসেব্যা, মুনিসুতা, জহ্নুজানুপ্রভেদিনী, মকরস্থা, সর্বগতা, সর্বাশুবনিবারিণী, সুদৃশ্যা, চক্ষুষা, সুপ্তিদায়িনী, সর্বদেবাধিদেববৈশ্চ, পরিপূজ্যপদাম্বুজা গঙ্গা স্তবস্তুতিতে পূণ্যি লাভ : গঙ্গাদেবীর গঙ্গাবতরণ উপাখ্যান যে পাঠ করে বা পাঠ করায় নির্বান মুক্তি তার করাত্ব হয; আয়ুবৃদ্ধি হয়; যশোবৃদ্ধি হয়; এককাদশী দিনে যিনি পাঠ করেন, তাঁর সকল সিদ্ধি হয়;
Previous
Next Post »

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র