মহামহিম ভীষ্ম

মহামহিম ভীষ্ম : রাজা শান্তুনুর ঔরসে ও গঙ্গার গর্ভে তাঁর জন্ম হয়। এ জন্য তাঁর নাম হয় গাঙ্গেয় ও নদীজ। এর অন্য নাম দেবব্রত। বশিষ্ঠের শাপে গঙ্গার গর্ভজাত অন্যতম অষ্টবসু । তিনি রাজা শান্তুনুর একমাত্র উত্তরাধিকারী। সত্যবতীর সহিত শান্তুনুর বিবাহ এবং সিংহাসন ত্যাগ ও আমরণ ব্রহ্মচর্য গ্রহণ- এ দুই ভীষণ প্রতিজ্ঞার কারণে তিনি ভীষ্ম নামে খ্যাত হন এবং পিতার নিকট স্বেচ্ছায় মরণ বর প্রাপ্ত হন। রাজা শান্তুনু  একদিন গঙ্গাতীরে এক পরামসুন্দরী নারীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিবাহ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সে নারী (গঙ্গা) বলেন, রাজা যদি তার কোন কাজে কারণ জানতে না চান এবং কোন কাজে বাঁধা দান বা ভৎসনা না করেন, তবেই তিনি শান্তুনুর স্ত্রী হতে সম্মত আছেন। আর প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করলেই তিনি তাকে ত্যাগ করে চলে যাবেন। শান্তুনু গঙ্গাদেবীর শর্ত মেনে নিয়ে তাকে বিবাহ করেন। ক্রমে ক্রমে গঙ্গার গর্ভে সাতটি পুত্র জন্মগ্রহণ করে। প্রতিটি শিশুকে গঙ্গা তাদের জলে নিক্ষেপ করেন। প্রতিজ্ঞা এবং গঙ্গাকে হারাবার ভয়ে এ ব্যাপারে শান্তুনু অসন্তষ্ট হলেও বাঁধা দিতে পারেননি। অষ্টম পু্ত্রের জন্মের পর শান্তুনু আর নিজে সামলাতে পারেননি। এ পুত্রকে হত্যা না করার জন্য গঙ্গাকে মিনতি জানান। তখন গঙ্গা সে পুত্রের জীবনদান করেন এবং শান্তুনুকে আত্মপরিচয় ও তার এ বিচিত্র ব্যবহারের কারণ জানিয়ে তাকে ত্যাগ করে চলে যান। গঙ্গা শান্তুনুকে বলেন, তার এ পুত্ররা মহাতেজা অষ্টবসু। একবার সস্ত্রীক অষ্টবসুরা বশিষ্ঠের আশ্রমে বিহার করতে যান। দ্যু নামক বসুর স্ত্রীর অনুরোধে এরা বশিষ্ঠের কামধেনু নন্দিনীকে হরণ করেন। বশিষ্ঠ জানতে পেরে অভিশাপ দেন যে, কামধেনু অপহরণকারীরা মানুষ্যলোকে জন্মগ্রহণ করবে। বসুগণের সদয় কাতরে বশিষ্ঠ বলেন, অন্যান্য বসুগণ এক বৎসর পরে শাপমুক্ত হবেন, কিন্তু যে বসু গাভী হরণ করেছে, সে দীর্ঘকাল মনুষ্যলোকে বাস করতে হবে। একবার ব্রহ্মার সভায় দেবগণের উপস্থিতে গঙ্গা সূক্ষ্ম বস্ত্র পরিধান করেন। তখন সকল দেবগণ অধোমুখে থাকেন; কিন্তু ইক্ষাকুবংশীয় রাজা মহাভিষ প্রায় বস্ত্রহীনা গঙ্গাকে নি:সঙ্কোচে দেখতে থাকেন। মহাভিষ বহু যজ্ঞ করার ফলে স্বর্গলাভ করলেও এ আচরণের জন্য ব্রহ্মা তাকে মর্ত্যলোকে জন্ম গ্রহণ করার অভিশাপ দেন। মহাভীষ প্রতীপের পুত্র শান্তুনুরুপে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন।

এদিকে মহাভিষের চিন্তা করতে করতে মর্ত্যে আসবার পথে বসুগণকে মুর্ছিত দেখে গঙ্গা তার কারণ জিজ্ঞাসা করলে, বসুগণ তাদের শাপের বিবরণ বলে গঙ্গার গর্ভে জন্মগ্রহণের বাসনা প্রকাশ করেন এবং জন্মের পরেই তাদের জলে বিসর্জন দিতে অনুরোধ করেন। যাতে শান্তুনু সংগে তার সংগম ব্যর্থ না হয় তার জন্যে গঙ্গা একটি পুত্রকে জীবিত রাখতে বলেন। বসুগণ তাতে সম্মত হন, কিন্তু বলেন যে, সে পুত্র বীর্যবান হলেও বিবাহ করবে না এবং ধর্মাত্মা, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও সর্বশাস্ত্র-বিশারদ হবে। গঙ্গাতীরে জপ-নিরত প্রতীপের নিকট সুন্দরী নারীদের বেশে গঙ্গা জল হতে উঠে তার দক্ষিণ উরুতে বসেন। প্রতীপ তার প্রার্থনা জানতে চাহিলে গঙ্গা তাকেই প্রার্থনা করেন। প্রতীপ বলেন যেহেতু গঙ্গা কন্যা ও পুত্রবধূর স্থান দক্ষিণ উরুতে বসেছেন, সেজন্যে তিনি প্রতীপের পুত্রবধূ হবেন। গঙ্গা তাতে সম্মত হয়ে রাজাকে শর্ত দেন যে, তার পুত্র গঙ্গার কোন কার্যে বাঁধা দিতে পারবে না। শান্তুনু যৌবনলাভ করলে প্রতীপ তাকে রাজ্যাভিষেক করেন। শান্তুনুকে ত্যাগ করার সময় গঙ্গা অষ্টম গর্ভজাত সন্তানকে নিয়ে যান।

ছত্রিশ বছর পর শান্তুনু একদা মৃগয়াকালে গঙ্গাতীরে উপস্থিত হয়ে এক সুন্দর বালককে শর নিক্ষেপ করতে দেখে মুগ্ধ হতেই সে বালক অন্তর্হিত হয়। শান্তুনু তাকে নিজ পুত্র অনুমান করে গঙ্গাকে স্মরণ করলে গঙ্গা পুত্রসহ অবির্ভূতা হয়ে শান্তুনু-পুত্রকে সমর্পণ করেন এবং বলেন তাকে তিনিই পালন করেছেন। এ পুত্র বশিষ্ঠের কাছে বেদ অধ্যয়ন এবং পরশুরামের নিকট অস্ত্র চালনা শিক্ষা করেছে। শান্তুনু ‘দেবব্রত’ নামধারী এ পুত্রকে গৃহে নিয়ে গিয়ে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করেন। এর কিছুদিন পর যমুনাতীরস্থ বনে ভ্রমণ করতে করতে শান্তুনু দাসরাজ কন্যা সত্যবতীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে দাসরাজের নিকট তার কন্যাকে বিয়ে করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। দাসরাজ বলেন, যদি শান্তুনু তার কন্যাকে ধর্মপত্নী করতে চান তবে এ কন্যার গর্ভজাত পুত্রকে রাজার মর্যাদা দিতে হবে। এ শর্তে তিনি রাজাকে কন্যাদান করতে রাজী আছেন। রাজা তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিশ্রুতি দিতে অসমর্থ হয়ে চিন্তাযুক্ত মনে রাজধানীতে ফিরে আসেন। তাকে চিন্তান্বিত দেখে দেবব্রত বৃদ্ধ অমাত্যকে জিজ্ঞসা করে প্রকৃত কারণ জানতে পারেন এবং দাসরাজের নিকট গিয়ে পিতার জন্য কন্যা প্রার্থনা করেন। তখন দাসরাজ বলেন, বৈমাত্র ভ্রাতারুপে ভীষ্ম সত্যবতীর পুত্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন, সেজন্য তিনি চিন্তিত। তখন দেবব্রত দাসরাজের নিকট রাজা না হওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন। দাসরাজ বলেন, দেবব্রত রাজ্যস্বত্ব ত্যাগ করলেও তার পুত্রগণ সিংহাসন দাবী করতে পারেন। তখন দেবব্রত বলেন যে, তিনি পূর্বেই রাজ্য ত্যাগ করেছেন; এখন ব্রহ্মচারীরুপে থাকবার প্রতিজ্ঞাও করলেন। নি:সন্তান হলেও তিনি অক্ষয় স্বর্গের অধিকারী হবেন। দাসরাজ শান্তুনুর হাতে সত্যবতীকে সমর্পণ করলেন। দেবব্রতের ভীষণ প্রতিজ্ঞা শুনে আকাশ হতে দেব অপ্সরাগণ পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগলেন এবং এ কঠিন প্রতিজ্ঞার জন্য তাকে ‘ভীষ্ম’ নামে অভিহিত করলেন। তখন ভীষ্ম সত্যবতীকে নিয়ে হস্তিনাপুরে আসেন এবং পিতাকে সমস্ত বিষয় বলেন। শান্তুনু দেবব্রতের উপর সন্তুষ্ট হন এবং ইচ্ছা-মৃত্যু বর দেন।

সত্যবতীর গর্ভে শান্তুনুর চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য নামে দুই পুত্র হয়। কনিষ্ঠ বিচিত্রবীর্যের যৌবন লাভের পূর্বেই শান্তুনুর মুত্যু হলে ভীষ্ম চিত্রাঙ্গদকে রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেন। অতিশয় যুদ্ধপ্রিয় চিত্রাঙ্গদ তারই নাধারী এক গন্ধর্বের হাতে দ্বৈরথযুদ্ধে অকালে নিহত হন। অপ্রাপ্ত বিচিত্রবীর্যকে ভীষ্ম হস্তীনাপুরের রাজা ঘোষণা করেন এবং রাজ কার্য চালনার বিষয়ে বিচিত্রবীর্যকে পরামর্শ দেন। বিচিত্রবীর্য যৌবনপ্রাপ্ত হলে ভীষ্ম তার বিবাহ দানের জন্য কাশী নরেশের তিন সুন্দরী কন্যা অম্ব, অম্বিকা ও অম্বালিকার স্বয়ংবর-সভায় উপস্থিত হন এবং তিন কন্যাকে ভ্রাতার জন্য হরণ করেন। সমবেত রাজারা ভীষ্মকে বাঁধা দিয়েও ব্যর্থ হন। হস্তিনাপুরে এসে বিবাহের উদ্যোগ গ্রহণ করলে জ্যেষ্ঠ কন্যা অম্বা বলেন, তিনি শাল্যরাজকে গোপনে পরস্পরকে বরণ করেছেন। তখন ভীষ্ম অম্বাকে শাল্বরাজের নিকট প্রেরণ করে অম্বিকা ও অম্বালিকার সাথে বিচিত্রবীর্যের বিবাহ দেন। অম্বা শাল্বরাজের নিকট উপস্থিত হলে, ভীষ্ম কর্তৃক অপহৃতা বলে অম্বাকে তিনি প্রত্যাখান করেন। অম্বার বহু অনুনয়-বিনয়েও শাল্বরাজ তাকে গ্রহণ করতে সম্মত হননি। এভাবে শাল্বরাজ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাতা হয়ে অম্বা ভীষ্মকেই তার এ অবস্থার জন্য দায়ী মনে করেন ও ভীষ্মের শাস্তি বিধানের জন্য ভীষ্মের গুরু পরশুরামের শরণাপন্ন হন। পরশুরাম দূত মুখে ভীষ্মকে আহ্বান করে অম্বাকে গ্রহণ করার জন্য তাকে আদেশ দেন। ভীষ্ম গুরুর আদেশে নিজের পূর্ব-প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে অসম্মত হলে, পরশুরাম তাকে বধ করার জন্য তার সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হন। কিন্তু উভয়েই উভয়কে পরাস্ত করতে অসমর্থ হন। তেইশ দিন যুদ্ধের পর ভীষ্ম প্রশ্বাপন অস্ত্র-প্রয়োগ করতে উদ্যত হলে, নারদ ও পরশুরামের পিতৃগণ উভয়কে নিরস্ত করেন। পরশুরাম অম্বাকে সাহায্য করতে অসমর্থ বলে চলে যান। অম্বা ভীষ্মকে বধ করার জন্য যমুনতীরে কঠোর তপস্যা করে মহাদেবের নিকট বর লাভ করেন যে, পরজন্মে দ্রুপদ রাজার নপূংসক সন্তান শিখন্ডীরুপে জন্ম লাভ করে ভীষ্মবধের কারণ হবেন। তখন নবজন্ম লাভের আশায় অম্বা অগ্নিতে প্রবেশ করে প্রাণ ত্যাগ করেন।

বিয়ের সাত বৎসরের মধ্যে যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়ে বিচিত্রবীর্য দেহত্যাগ করেন। সত্যবতী ভীষ্মকে অম্বিকা ও অম্বালিকার গর্ভে পুত্রের জন্মদান করে বংশরক্ষা করতে অনুরোধ করলে, ভীষ্ম নিজের প্রতিজ্ঞা স্মারণ করে এ কাজে অস্বীকৃতি জানান এবং কোন সৎ-ব্রাহ্মণ নিয়োগ করে অম্বিকা ও অম্বালিকাতে ক্ষেত্রজ সন্তান উৎপাদন করতে বলেন। তখন সত্যবতী তার কানীন পুত্র কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসেকে বিবরণ জানিয়ে তাকে স্মরণ করেন। ব্যাস উপস্থিত হয়ে মাতার প্রস্তাব অনুযায়ী বংশ রক্ষার্থে অম্বিকার গর্ভে ধৃতরাষ্ট্র ও অম্বালিকার গর্ভে পান্ডুর জন্ম দেন। অম্বিকার এক সুন্দর দাসীর গর্ভেও ব্যাস বিদুরের জন্ম দেন। ভীষ্ম এদের তিন জনকেই পুত্রবৎ পালন করেন। তিনি গান্ধাররাজ সুবলের কন্যা গান্ধারীর সহিত ধৃতরাষ্ট্রের ও কুন্তিভোজের পালিতা কন্যা কুন্তী এবং মাদ্ররাজ শল্যের ভগিনী মাদ্রীর সহিত পান্ডুর বিবাহ দেন। ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ হওয়ায় পান্ডুই হস্তিনাপুরের রাজ হন। তারা সকলেই কুরুবংশীয় হলেও ধৃতরাষ্ট্রের সন্তানরা কৌরব ও পান্ডুর সন্তানরা পান্ডব নামে অভিহিত হন। কুর-পান্ডবদের অস্ত্রশিক্ষার জন্য ভীষ্ম প্রথমে কৃপাচার্য ও পরে দ্রোণাচার্যকে গুরুরূপে নিযুক্ত করেন। কালক্রমে কুরু-পান্ডবদের মধ্যে রাজ্য নিয়ে বৈরিতা আরম্ভ হলে ভীষ্ম ও বিদুর তা নিবারণ করতে চেষ্টা করেন, কিন্তু বিফল হন। দ্যূত সভায় পাঞ্চালীর অপমান ভীষ্মকে ভিতরে ভিতরে ক্ষত-বিক্ষত করলেও তিনি মৌন থাকেন। কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধের উদ্যোগকালে ভীষ্ম ও বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে যুদ্ধ হতে নিবৃত্ত হতে পরামর্শ দেন। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র তা অগ্রাহ্য করেন। যুদ্ধকালে দুর্যোধন প্রথমে ভীষ্মকে সেনাপতি করেন। ভীষ্ম পান্ডুপুত্রদের বিনষ্ট করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন এবং শিখন্ডী যুদ্ধেক্ষেত্রে এসে তার সঙ্গে যুদ্ধ করবেন না বলেন। কিন্তু তিনি প্রতিদিন পান্ডবপক্ষের দশ সহস্র সৈন্য ও সহ্স্র রথীকে বধ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। যুদ্ধের প্রারম্ভে ভীষ্ম যুদ্ধ সম্বন্ধে কতকগুলি নিয়ম বিধিবদ্ধ করেন। তিনি স্বয়ং অর্জুনের সঙ্হে যুদ্ধ করবেন না বলে স্থির করেন। কিন্তু ঘটনা-চক্রের যুদ্ধের দশম দিনে দুর্যোধন কর্তৃক ক্রমাগত বাক্যবাণে জর্জরিত হয়ে তিনি অর্জুনকে আক্রমণ করেন। যুদ্ধের প্রারম্ভে ভীষ্মকে অগ্রমুখে রেখে কৌরবসেনা অগ্রসর হয়। প্রথম দিন বিরাটপুত্র ‍উত্তর ও শ্বেত ভীষ্মের হাতে নিহত হয়। তৃতীয় দিনের যুদ্ধে ভীষ্ম অর্জুন ও পান্ডবসেনাদের এরূপ পর্যুদস্ত করেন যে, এ যুদ্ধে অস্ত্রধারণ না করার প্রতিজ্ঞা সত্ত্বেও কৃষ্ণ ক্রুদ্ধ হয়ে সুদর্শন চক্রের দ্বারা ভীষ্মকে বধ করতে উদ্যত হন। নবম দিনের যুদ্ধে ভীষ্ম যখন পান্ডবসেনা বিধ্বস্ত করেন, তখন পান্ডবেরা নিরুপায় হয়ে রাত্রে ভীষ্মের নিকট গিয়ে তার বধের উপায় জানতে চান। ভীষ্ম বলেন যে, নিরস্ত্র, ভূপতিত, বর্ম ও ধ্বজহীন, স্ত্রী, স্ত্রী-নামধারী ও বিকলেন্দ্রিয় ইত্যাদির সাথে যুদ্ধ করেন না। দ্রুপদপুত্র শিখন্ডী পূর্ব-জন্মের স্ত্রী ছিলেন। তাকে অগ্রবর্তী করে যদি অর্জুন ভীষ্মে সহিত যুদ্ধ করেন, তবেই ভীষ্মের বিনাশ হবে। দশম দিনের যুদ্ধে ভীষ্ম প্রাণত্যাগের সঙ্কল্প করে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং শিখন্ডীর সহিত যুদ্ধে বিরত থাকেন। অর্জুনের বাণে তার ভীষ্মে সর্ব অঙ্গ শর বিদ্ধ ছিল। এ দিনের যুদ্ধে ভীষ্ম বিরাটের ভ্রাতা শতানীক, সাতজন মাহরথী, পাঁচ হাজার রথী, চৌদ্দ হাজার পদাতিক, গজারোহী, অশ্বারোহী ইত্যাদি বধ করে সূর্যাস্তের কিছু পূর্বে পূর্ব দিকে মাথা রেখে ভূপতিত হন। সর্বাঙ্গ শরবিদ্ধ হওয়ায় তার দেহ ভূমিস্পর্শ করেনি। তখন দক্ষিণায়ন বলে ভীষ্ম মৃত্যুর জন্য উত্তরায়ণের জন্য প্রতিক্ষায় থাকেন। শর শয্যায় শয়ন করলে উভয় পক্ষের বীরগণ ভীষ্মের নিকট উপস্থিত হন। ভীষ্ম সকলকে বলেন যে, উপাধান না থাকায় তার মস্তক ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে। রাজারা উপাধান নিয়ে উপস্থিত হলে ভীষ্ম অর্জুনকে বীরশয্যার উপযুক্ত উপাধান দিতে বলেন। অর্জুন তিনটি বাণ নিক্ষেপ করে ভীষ্মের শির উর্ধ্বে স্থাপন করেন। পর দিবস ভীষ্ম তৃষ্ণার্ত হয়ে জল চাহিলে সকলে জলের কলস ও খাদ্যদ্রব্য নিয়ে উপস্থিত হয়, কিন্তু ভীষ্ম মনুষ্যে ভোগবস্তু প্রত্যাখান করে অর্জুনকে জল দিতে বলেন। অর্জুন পর্জন্যাস্ত্রে ভীষ্মের দক্ষিণ পার্শ্বের ভূমি বিদ্ধ করে নির্মল জলধারা তুলে ভীষ্মকে পান করতে দেন। কর্ণ একাকী ভীষ্মের নিকট আশীর্বাদ ভিক্ষু হয়ে এলে ভীষ্ম তাকে আর্শীর্বাদ করেন। যুদ্ধের শেষে পান্ডবগণ জয়লাভ ও রাজ্যলাভ করার পর উত্তরায়ণের প্রারম্ভে যুধিষ্ঠির ভীষ্মের নিকট উপস্থিত হন।

ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে রাজধর্ম, সমাজধর্ম, নীতি ইত্যাদি বহু বিষয়ে উপদেশ প্রদান করেন। আটান্ন রাত্রি শরশয্যায় থাকার পর মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে দেহ রাখেন। শৌর্যে, বীর্যে, জ্ঞানে, রাজনীতিতে, দৃঢ়তায়, ধর্মে ও সংযমে ভীষ্মের মত মহাপুরুষ জগতে দুর্লভ।

মহাভারতে ভীষ্মের চরিত্র আমাদেরকে অভিভূত করে তার মহত্ত্বের জন্য। আমরা কষ্টও পাই পাঞ্চালীকে যখন দু:শাসন চুলের মুঠি ধরে টেনে হিঁচড়ে দ্যূত সভায় নিয়ে এলো তখন দ্রৌপদী কাতর স্বরে বললেন,“ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর আর মাহরাজ ধৃতরাষ্ট্রের কি প্রাণ নেই? কুরুবৃদ্ধগন কি এ অধর্মাচার দেখতে পাচ্ছে না?” দ্রৌপদী অনেকবার প্রশ্ন করলেন,“আমি ধর্মানুসারে বিজিত হয়েছি কিনা, আপনারা বলুন? তখন ভীষ্ম বললেন,“ধর্মের তত্ত্ব অতি সূক্ষ্ম, আমি তোমার প্রশ্নের যথার্থ উত্তর দিতে পারছি না।” কৃপাচার্য ও দ্রোণাচার্যও ভীষ্মে পথ অবলম্বন করেন। তার এ নীরবতা, ‍যুদ্ধে দুর্যোধনের পক্ষাবলম্বন আবার শেষদিকে পান্ডবদের বিজয় নিশ্চিত করার জন্য নিজেকে বলীদান। সবই তার চরিত্রের অনন্য বৈশিষ্ট। তিনি মনে করতেন যা করছেন তার কর্তব্যবোধেই করছেন। তখনকার সময়ের রীতিনীতিই হয়তো তাকে এ কাজে বাধ্য করেছে। কিন্তু আহত করেছে আমাদেরকে। তার পিতার মনপীড়া দূর করতে গিয়েই কুরুরাজ্যের উত্তরাধিকার পরিত্যাগ করে চিরকুমারব্রত পালন করেন। বৈমাত্রেয় ভ্রাতাদের অভিভাবক হয়ে রাজ কার্যে নিষ্কামভাবে নিজেকে নিয়োজিত করেন। পিতৃভক্তির জন্য ভীষ্ম আমাদের কাছে নমস্য। কিন্তু যে কারণের জন্য ভীষ্ম চিরকুমার রয়ে গেলেন সে কারণটি যথার্থ ছিল! যদি আমরা এভাবে চিন্তা করি ভীষ্ম যদি এমন প্রতিজ্ঞা না করতেন তবে মহাভারতের ইতিহাস হয়তো অন্যভাবে লেখা হতো। হয়তো মহাভারতের যুদ্ধই হতো না।
সূত্র: মহাভারত ও বিভিন্ন পৌরানিক কাহিনী অবলম্বনে।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র