মহাভারত:সভাপর্ব-০০১-০০৫

০১.ময়দানব কর্ত্তৃক ইন্দ্রপ্রস্থে
সভাগৃহ নির্মাণ
জন্মেজয় বলে, মুনি কর অবধান।
কৃষ্ণসহ পিতামহ দানব প্রধান।।
খাণ্ডব দহিয়া ইন্দ্রপস্থে উত্তরিয়া।
কি কি কর্ম্ম করিলেন কহ বিস্তারিয়া।।
শুনিতে আমার চিত্তে পরম আনন্দ।
তব মুখে শুনিয়া ঘুচুক মনোধন্ধ।।
বৈশম্পায়ন বলেন, শুন নৃপবর।
অগ্নি সত্যে পার হৈয়া পার্থ ধনুর্দ্ধর।।
ধর্ম্মরাজে কহিলেন সব বিবরণ।
পরম আনন্দে রাজা কৈলা আলিঙ্গন।।
লক্ষ লক্ষ ধেনু স্বর্ণ দ্বিজে দিল দান।
ময়দানবের বহু করিল সম্মান।।
পাণ্ডবের মহাকীর্ত্তি ব্যাপিল সংসার।
রিপুগণে শুনি লাগে অতি চমৎকার।।
হেনমতে নানাসুখে থাকেন পাণ্ডব।
সদা যাগ যজ্ঞ দান মহোৎসব।।
মুনি বলে, শুন পরীক্ষিতের নন্দন।
ভারতের সভাপর্ব্ব বিচিত্র কথন।।
শ্রীকৃষ্ণ পার্থের অগ্রে করি যোড়কর।
বিনয় করিয়া বলে দানব-ঈশ্বর।।
সুদর্শন-চক্রে ভয় করে তিনলোকে।
হেন চক্র হৈতে উদ্ধারিলে হে আমাকে।।
প্রচণ্ড অনল মুখে কৈলে পরিত্রাণ।
আজি হৈতে তোমাতে বিক্রীত মম প্রাণ।।
কি করিব আজ্ঞা মোরে কর মহাশয়।
তব প্রীতি হেতু আমি ব্যাকুল হৃদয়।।
অর্জ্জুন বলেন, যাহ দানব-ঈশ্বর।
রাখিও আমাতে প্রীতি তুমি নিরন্তর।।
ময় বলে, যাবৎ না করি তব কর্ম্ম।
তাবৎ রহিবে মম মানবে অধর্ম্ম।।
দানবকুলের শ্রেষ্ট বিশ্বকর্ম্মা আমি।
করিব অবশ্য যাহা আজ্ঞা কর তুমি।।
পার্থ বলে, কিছু আমি না চাহি তোমারে।
যা পারহ করহ প্রীত দেব দামোদরে।।
করযোড়ে বলে ময় কৃষ্ণের গোচর।
কি করিব, আজ্ঞা কর দেব দামোদর।।
হৃদয়ে চিন্তিয়া কৃষ্ণ বলেন বচন।
দিব্য চিন্তিয়া কৃষ্ণ বলেন বচন।।
হেন সভা কর যাহা কেহ নাহি দেখে।
অদ্ভুত হইবে সুরাসুর তিনলোকে।।
কৃষ্ণের আদেশে ময় আনন্দিত হৈল।
নির্ম্মিতে সুন্দর সভা শীঘ্রগতি গেল।।
কনক-রচিত চিত্র বিচিত্র নিম্মার্ণ।
নানাগুণযুত যেন দেবতার স্থান।।
চৌদিকে সহস্র-দশ ক্রোশ পরিসর।
সুরাসুর নাগ নর সব অগোচর।।
রচিয়া বিচিত্র সভা দানব-প্রধান।
সবিনয়ে জানাইলে কৃষ্ণ-বিদ্যমান।।
যুধিষ্ঠির ‍কৃষ্ণ পার্থ প্রশংসি দানবে।
দেখিতে গেলেন সভা মহানন্দে সবে।।
দ্বিজগণে পায়সান্ন করান ভোজন।
নানা রত্ন দান দেন রজত কাঞ্চন।।
শুভক্ষণে করিলেন প্রবেশ সভায়।
পাণ্ডব সপরিবারে রহেন তথায়।।
বহুদিন রহি কৃষ্ণ পাণ্ডবের প্রীতে।
পিতৃ-দরশনে যাব ভাবিলেন চিতে।।
পিতৃষ্বাসা কুন্তীর বন্দিলা দুই পাদ।
আলিঙ্গনে ভোজসুতা করেন প্রসাদ।।
সুভদ্রা ভগিনী স্থানে করিয়া গমন।
গদগদ মৃদুবাক্য সজল নয়ন।।
কহেন রুক্মিণীকান্ত ভদ্রা প্রবোধিয়া।
স্নেহেতে চক্ষুর জল পড়িছে বহিয়া।।
সেবিবে শাশুড়ী কুন্তীদেবীর চরণে।
সমভাবে সর্ব্বদা বঞ্চিবে কৃষ্ণা সনে।।
তত্ত্বকথা কহিয়া চলেন গদাধর।
প্রণমিয়া ভদ্রা দেবী কান্দে উচ্চৈঃস্বর।।
ভদ্রা প্রবোধিয়া কৃষ্ণ গিয়া কৃষ্ণা-পাশে।
বিনয়ে কহেন তাঁকে মৃদুমন্দ-ভাষে।।
প্রাণের অধিক মম সুভদ্রা ভগিনী।
সদাকাল স্নেহ তারে করিবে আপনি।।
দ্রৌপদীরে সম্ভাষিয়া যান নারায়ণ।
ধৌম্য পুরোহিত সহ করি সম্ভাষণ।।
যুধিষ্ঠিরে কহিলেন করি নমস্কার।
আজ্ঞা কর গৃহে আমি যাব আপনার।।
শুনিয়া ধর্ম্মের পুত্র বিষণ্ন বদন।
কৃষ্ণে আলিঙ্গন করি সজল লোচন।।
ভীমার্জ্জুন সহ কৃষ্ণ কৈল কোলাকুলি।
কৃষ্ণে প্রণমিল মাদ্রীপুত্র মহাবলী।।
শুভ তিথি নক্ষত্র গণক জানাইল।
বেদবিধি মঙ্গল ব্রাহ্মণ উচ্চারিল।।
দারুক গরুড়ধ্বজ করিয়া সাজন।
গোবিন্দের অগ্রে লয়ে দিল ততক্ষণ।।
যাত্রা শুভ, যাঁর নাম করিলে স্মরণ।
তিনি যাত্রা করিলেন করি শুভক্ষণ।।
স্নেহেতে কৃষ্ণের সহ ধর্ম্মের নন্দন।
খড়পতিধ্বজে আরোহেন ছয় জন।।
রথ চালাইয়া দিল দারুক সারথি।
যোজনান্তে গিয়া ধর্ম্মে কহিলা শ্রীপতি।।
নিবর্ত্তহ মহারাজ, যাহ নিজালয়।
আমাতে রাখিহ সদা সদয় হৃদয়।।
আলিঙ্গন করি পার্থ সজল নয়ন।
বহুকষ্টে নিবৃত্ত হইল পঞ্চজন।।
আত্মা যেন পাণ্ডবের কৃষ্ণ সহ গেল।
কেবল শরীর লৈয়ে পাণ্ডব রহিল।।
বিরস বদনে ফিরিলেন পঞ্চ জন।
গেলেন দ্বারকাপুরে দ্বারকা-রমণ।।
তবে ময় বলে ধনঞ্জয়-বিদ্যমান।
মম মনোমত সভা নহিল নির্ম্মাণ।।
আজ্ঞা কর, যাব আমি মৈনাক-পর্ব্বতে।
কৈলাস উত্তরে হিমালয় সন্নিহিতে।।
বৃষপর্ব্বা নামে ছিল দানবের পতি।
চৌদিকে শাসিয়া তথা করিল বসতি।।
করিলাম তার সভা পূর্ব্বেতে নির্ম্মাণ।
নানা রত্ন-মণিময় আছে সেই স্থান।।
এ তিন লোকেতে যত দিব্য রত্ন ছিল।
নানা রত্নে নানা শস্ত্রে গৃহ পূর্ণ কৈল।।
কৌমোদকী গদা তুল্য আছে গদাবর।
সে গদার যোগ্য হয় বীর বৃকোদর।।
তব হস্তে যেমন গাণ্ডীব ধনু সাজে।
হেন গদাবর আছে বিন্দু-সরো-মাঝে।।
বরুণে জিনিয়া বৃষপর্ব্বা দৈত্যেস্বর।
দেবদত্ত শঙ্খ সে পাইল মনোহর।।
যার শব্দ শুনি দর্প ত্যজে রিপুগণ।
সে শঙ্খ তোমারে হয় বিশেষ শোভন।।
এই সব দ্রব্য আছে বিন্দু সরোবরে।
আজ্ঞা কর, গিয়া আমি আনিব সত্বরে।।
অর্জ্জুন বলেন, যদি করিয়াছ মনে।
যাহা চিত্তে লয়, তাহা করহ আপনে।।
ইহা শুনি চলিল দানবরাজ ময়।
কৈলাসের উত্তরেতে মৈনাক যথা রয়।।
ভাগীরথী হেতু যথা রাজা ভগীরথ।
বহুকাল পর্য্যন্ত করিয়াছিল ব্রত।।
নর নারায়ণ শিব যম পুরন্দর।
যথা করিলেক যজ্ঞ অনেক বৎসর।।
যথা স্রষ্টা করিলেন সৃষ্টির কল্পনা।
বহু গুণবন্ত স্থান, না হয় বর্ণনা।।
ময় গিয়া সব দ্রব্য বাহির করিল।
রাক্ষস কিন্নরগণ শিরে করি নিল।।
দেবদত্ত শঙ্খ নিল গদা অনুপাম।
যত রত্ন নিল, তার কত লব নাম।।
ভীমে গদা দিল, শঙ্খ দিল অর্জ্জুনেরে।
দেখি আনন্দিত হৈল দুই সহোদরে।।
কনক বৈদূর্যমণি মুকুতা প্রবাল।
মরকত স্ফটিক রজত চিত্র ঢাল।।
স্ফটিকের স্তম্ভ সব, চিত্র মণিহীরা।
সর্ব্ব গৃহে লম্বে মণি মুকুতার ঝারা।।
বসিবার স্থান সব কৈল রত্নছেদি।
বিচিত্র রচন কৈল নানামত বেদী।।
নানা জাতি বৃক্ষে সব ফল ফুল শোভে।
ভ্রময়ে ভ্রমরগ মকরন্দ লোভে।।
ভানু বৃহদ্ভানু জিনি পূর্ণ চন্দ্রপ্রভা।
সুরাসুর অপূর্ব্ব করিল ময় সভা।।
উচ্চ নীচ বুঝিবারে ভ্রম হয় লোকে।
বিশেষে বিপক্ষগণ চক্ষে নাহি দেখে।।
একমাসে সভা ময় করিয়া রচন।
কুন্তী-পুত্র প্রতি করিলেন নিবেদন।।
সভা দেখি আনন্দিত ধর্ম্মের নন্দন।
আনিলেন দেখাইতে ধর্ম্মের নন্দন।।
আনিলেন দেখাইতে পরিবারগণ।।
দশ লক্ষ ব্রাহ্মণেরে করান ভোজন।
আনন্দ-সাগরে মগ্ন ভাই পঞ্চ জন।।
ঘৃত দুগ্ধ অন্ন ফল মূল যত ভক্ষ্য।
হরিণ বরাহ মেষ কটি লক্ষ লক্ষ।।
যে জন যে ভক্ষ্যে তৃপ্ত তাহা সে পাইল।
ভোজনান্তে দ্বিজগণ স্বস্তি উচ্চারিল।।
দ্বিজগণ স্বস্তি শব্দে পরম উল্লাসে।
নানা রত্ন দান পেয়ে চলিল সন্তোষে।।
কত মুনিগণ তবে ধর্ম্মপুত্র-প্রীতে।
আশ্রম করিয়া রহিলেন সভাতে।।
অসিত দেবল সত্য সর্পমালী ঋষি।
মহাশিরা অর্ব্বাবসু সুমিত্র তপস্বী।।
মৈত্রেয় শুনক বলি সুমন্ত জৈমিনি।
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন পৈল চারি শিষ্য গণি।।
জাতুকর্ণ শিখাবান পৈঙ্গ অপ্সু হৌম্য।
কৌশিক মাণ্ডব্য মার্কণ্ডেয় বক ধৌম্য।।
জঙ্ঘাবন্ধু রৈভ্য কোপবেগ পরাশয়।
পারিজাত সত্যপাল শাণ্ডিল্য প্রবর।।
গালব কৌণ্ডিন্য সনাতন বভ্রুমালী।
বরাহ সাবর্ণ ভৃগু কালাপ ত্রৈবলি।।
ইত্যাদি অনেক ঋষি না যায় গণন।
সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয় প্রতি তপোধন।।
যুধিষ্টির সভাতে থাকেন অহর্নিশি।
পুরাণ প্রসঙ্গ ধর্ম্ম নানা কথা ভাষি।।
পৃথিবীতে বৈসে যত মুখ্য ক্ষত্রগণ।
যুধিষ্টির সভায় থাকেন অনুক্ষণ।।
মুঞ্জকেতু বির্বন্ধন কুন্তি উগ্রসেন।
সুধর্ম্মা সুকর্ম্মা কৃতবর্ম্মা জয়সেন।।
অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ মগধ-অধিপতি।
সুমিত্র সুমনা ভোজ সুশর্ম্মা প্রভৃতি।।
বসুদান চেকিতান মালবাধিকারী।
কেতুমান জয়ন্ত সুষেণ দণ্ডধারী।।
মৎস্যরাজ ভীষ্মক কৈকেয় শিশুপাল।
সুমিত্র যবনপতি শল্য মহাশাল।।
বৃষ্ণি ভোজ যদুবংশে যতেক কুমার।
ইত্যাদি অনেক রাজা গণিতে অপার।।
অর্জ্জুনের স্থানে অস্ত্র শিক্ষার কারণ।
জিতেন্দ্রিয় বৃত্তি হৈয়া থাকে সর্ব্বক্ষণ।।
চিত্রসেন তুম্বুরু-গন্ধর্ব্ব-অধিপতি।
অপ্সর কিন্নর নিজ অমাত্য সংহতি।।
নৃত্য গীত বাদ্যরসে পাণ্ডবেরে সেবে।
বিবিঞ্চি সেবে যেন ইন্দ্র আদি দেবে।।
না হইল না হইবে আর সভান্তর।
হেনমতে বঞ্চে সুখে পঞ্চ সহোদর।।
নৃত্য গীত বাদ্যরসে পাণ্ডবেরে সেবে।
বিরিঞ্চিকে সেবে যেন ইন্দ্র আদি দেবে।।
না হইল না হইবে আর সভান্তর।
হেনমতে বঞ্চে সুখে পঞ্চ সহোদর।।
পভাপর্ব্বে উত্তম সভার অনুবদ্ধ।
কাশীরাম দেব কহে, পাঁচালীর ছন্দ।।
০২.যুধিষ্টিরের সভায় নারদের আগমন
ও প্রশ্নচ্ছলে উপদেশ প্রদান
মুনি বলে মহাশয়, শুন শ্রীজনমেজয়,
হেন মতে নিবসে পাণ্ডব।
এক দিন আচম্বিত, রীনারদ উপনীত,
সর্ব্বত্র গমন মনোজব।।
ধ্যান জ্ঞান যোগপূজ্য, অমর অসুর পূজ্য,
চতুর্ব্বেদ জিহবাগ্রেতে বৈসে।
ব্রহ্মার অঙ্গেতে জন্ম, জ্ঞাত যত ব্রহ্মকর্ম্ম,
ব্রহ্মাণ্ড ভ্রমেন অনায়াসে।।
পরমার্থ অনুবন্ধী, বিজ্ঞেয় বিগ্রহ সন্ধি,
কলহ গায়নে বড় প্রীত।
শিরেতে পিঙ্গল জটা, ললাটে উজ্জ্বল ফোঁটা,
শ্রবণে কুণ্ডল সুশোভিত।।
মুখে হরিরস স্রবে, মধুর বীণার রবে,
গতি মন্দ জিনিয়া মাতঙ্গ।
বারিজ নয়ন যুগে, বহে বারি যেন মেঘে,
পুলকে কদম্ব পুষ্প-অঙ্গ।।
শরদিন্দু মুখাম্বুজ, আজানুলম্বিত ভুজ,
প্রোজ্জ্বল অমল দীপ্ত কায়।
পরিধান কৃষ্ণাজিন, সঙ্গে মুনি কত জন,
উপনীত পাণ্ডব-সভায়।।
দেখিয়া নারদ ঋষি, যে ছিল সভায় বসি,
সম্ভ্রমে উঠিল ততক্ষণে।
আস্তে ব্যস্তে ধর্ম্মসুত, সহোদরগণযুত,
প্রণাম করেন সে চরণে।।
সুগন্ধি উদক দিয়া, পদযুগ প্রক্ষালিয়া,
বসিতে দিলেন সিংহাসন।
যথা শিষ্ট ব্যবহার, পাদ্য অর্ঘ্য দিয়া তাঁর,
ভক্তিভাবে করেন পূজন।।
তবে মুনি স্নেহবশে, জিজ্ঞাসেন মৃদুভাষে,
কহ রাজা শুভ আপনার।
কুলের কৌলিক কর্ম্ম, ধন উপার্জ্জন ধর্ম্ম,
নির্ব্বিঘ্নেতে হয় কি তোমার।।
সাধু বিজ্ঞ যত জন, অনুরক্ত মন্ত্রিগণ,
এ সবার রাখ কি বচন।
একক বা বহু সহ, মন্ত্রণা ত না করহ,
কার্য্যে কি রাখহ মুখ্যগণ।।
ভক্ষ্যদ্রব্য যথাযথ, ন্যায় মুল্য কিন তত,
না রাখহ দ্বিজের দক্ষিণা।
তব অনুরক্ত যত, ভয়ে কি শরণাগত,
দুঃখ তো না পায় কোন জনা।।
বিজ্ঞ যোগ্য পুরোহিত, দৈবজ্ঞ-জ্যোতিষবিৎ,
আছয়ে কি বৈদ্য চিকিৎসক।
অনাথ অতিথি লোকে, ভুঞ্জাইয়া বহু সুখে,
সদা গেত ঘৃত অন্নোদক।।
রাজ্যের যতেক প্রজা, করয়ে তোমার পূজা,
সবে অনুগত কি তোমার।
ধন ধান্য বহুমত, উদক আয়ুধ যত,
পূর্ণ করিয়াছ তো ভাণ্ডার।।
প্রাতঃকালে নিদ্রাবশ, বৈকালেতে ক্রীড়ারস,
আলস্য ইন্দ্রিয় নিবারণ।
ধর্ম্ম কর্ম্মে ধনব্যয় কর নিত্য উপচয়,
পুত্রবৎপাল প্রজাগণ।।
বিবিধ অনেক নীতি, জিজ্ঞাসিল মহামতি,
পুনঃ পুনঃ ব্রহ্মার নন্দন।
শুনি ধর্ম্ম-অধিকারী, কহেন বিনয় করি,
প্রণমিয়া মুনির চরণ।।
যে কিছু কহিলা তুমি, যথাশক্তি করি আমি,
যাহা জ্ঞাত ছিলাম পূর্ব্বেতে।
শুনিয়া তোমার স্থান, বিশেষ জন্মিল জ্ঞান,
যত্নেতে করিব আজি হৈতে।।
অবধান তপোধন, করি এক নিবেদন,
চরাচর তোমাতে গোচর।
এই সভা মনোহর, অনুরূপ মুনিবর,
দেখেছ কি ব্রহ্মাণ্ড ভিতর।।
যুধিষ্ঠির বাক্য শুনি, ঈষৎ হাসিয়া মুনি,
কহেন সকল বিবরণ।
তোমার সভায় প্রায়, মনষ্য লোকেতে রায়,
নাহি দেখি, শুনহ রাজন।।
ব্রহ্মার বিচিত্র সভা, কৈলাস দেখিনু যেবা,
ইন্দ্র যম বরুণের পুরী।
দেখিয়াছি যথা তথা, মনুষ্যে অদ্ভুত কথা,
শুন কিছু কহি ধর্ম্মচারী।।
রাজা বলে সবিনয়, কহ মুনি মহাশয়,
সে সকল সভার বিধান।
প্রসার বিস্তার কত, বর্ণ গুণ ধরে যত,
প্রত্যক্ষে শুনিব তব স্থান।।
দিব্য সভাপর্ব্ব কথা, বিচিত্র ভারত-গাথা,
শুনিলে অধর্ম্ম হয় নাশ।
গোবিন্দ চরণে মন, সমর্পিয়া অনুক্ষণ,
বিরচিল কাশীরাম দাস।।
০৩. নারদ কর্ত্তৃক লোকপালগণের
সভা বর্ণন
নারদ বলেন, রাজা কর অবধান।
ইন্দ্রের সভার কথা কহি তব স্থান।।
দেবশিল্পী পটু বিশ্বকর্ম্মার দ্বারায়।
নির্ম্মাণ করান নিজ মহতী সভায়।।
বিবিধ বিধান চিত্র কোটিচন্দ্র প্রভা।
দেবঋষি ব্রহ্মঋষি ধার্ম্মিকের সভা।।
উচ্চ পঞ্চ যোজনেক শতেক বিস্তার।
শচী হস ইন্দ্র সদা করেন বিহার।।
সেই সভা শূন্যপথে পারয়ে থাকিতে।
যথা ইচ্ছা পারে তাহা যাইতে আসিতে।।
জরা শোক ভয় নাহি সতত আনন্দ।
ইন্দ্রের আশ্রমে সদা থাকে সুরবৃন্দ।।
মরুত কুবের আদি সিন্ধ সাধ্যগণ।
অম্লান কুসুম বস্ত্র সবার ভূষণ।।
অষ্টবসু নবগ্রহ ধর্ম্ম কাম অর্থ।
তড়িৎ বিদ্যুৎ সপ্তবিংশ কৃষ্ণবর্ত্ম।।
যজ্ঞ মন্ত্র দক্ষিণা আছয়ে মূর্ত্তিমন্ত।
দেব ঋষি পুণ্য জন লিখিতে অনন্ত।।
দেবতা তেত্রিশ কোটি সেবে পুরন্দরে।
বর্ণিতে না পারি সভা গুণ যত ধরে।।
হরিশচন্দ্র নরপতি আছয়ে তথায়।
আর যত পুণ্যজন লিখনে না যায়।।
নারদ বলেন, শুন সভার প্রধান।
শমন রাজার সভা কর অবধান।।
দীর্ঘ প্রস্থ শত শত যোজন বিস্তার।
আদিত্য-সমান প্রভা, গতি কামাচার।।
নহে শীত, নহে উষ্ণ, নাহি ‍দুঃখ লোকে।
প্রেমময়, নাহি হিংসা, সদাকাল সুখে।।
কতেক কহিব কথা যতেক বিষয়।
কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ কহি শুন মহাশয়।।
যযাতি নহুষ পুরু মান্ধাতা ভরত।
কৃতবীর্য্য কার্ত্তবীর্য্য সুনীত সুরথ।।
শিবি মৎস্য বৃহদ্রথ নল বহীনর।
শ্রুতশ্রবা পৃথুলাশ্ব ও উপরিচর।।
দিবোদাস অম্বরীষ রঘু প্রতর্দ্দন।
পৃষদশ্ব সদশ্ব মরুত্ত বসুমান।।
শরভ সঞ্জয় বেণ ঐল উশীনর।
পুরু কুৎস প্রদ্যুন্ন বাহ্লীক নৃপবর।।
শশবিন্দু কক্ষসেন সগর কৈকয়।
জনক ত্রিগর্ত্ত বার্ত্ত জয় জন্মেজয়।।
অজ ভগীরথ দিলীপ লক্ষ্মণ রাম।
ভীমজানু পৃথু পৃথুবেগ করন্দম।।
শত ধৃতরাষ্ট্র আছে, ভীষ্ম দুই শত।
শত ভীম, কৃষ্ণার্জ্জুন শত, আর কত।।
প্রতীপ শান্তনু পাণ্ডু জনক তোমার।
কতেক কহিব তথা, যত আছে আর।।
অশ্বমেধ যজ্ঞ আদি বহু দান ফলে।
তথায় যে পুণ্যবান বৈসেন সকলে।।
বরুণের সভা কহি, কর অবধান।
অপূর্ব্ব সভার শোভা বিচিত্র বাখান।।
বিশ্বকর্ম্মা বিরচিল সভা অনুপাম।
জলের ভিতর সে পুষ্করমালী নাম।।
শত শত যোজন বিস্তার দৈর্ঘ্য তার।
নানা রত্ন বহুবর্ণ কহিতে বিস্তার।।
নিবসে বরুণ তথা বারুণী সহিত।
পুত্র পৌত্র পাত্র মিত্র সহ পুরোহিত।।
দ্বাদশ আদিত্য আর নাগগণ যত।
বাসুকি তক্ষক কর্কোটক ঐরাবত।।
সংহ্লাদ প্রহ্লাদ বলি নমুচি দানব।
বিপ্রচিত্তি কালকেয় দুর্ম্মুখ সরভ।।
মূর্ত্তিমন্ত চারি সিন্ধু আরো নদীগণ।
জাহ্নবী যমুনা সিন্ধু সরস্বতী শোণ।।
চন্দ্রভাগা বিপাশা বিতস্তা ইরাবতী।
শতদ্রু সরযূ আরো নদী চর্ম্মণ্বতী।।
কিম্পুনা বিদিশা কৃষ্ণবেণা গোদাবরী।
নর্ম্মদা বিশল্যা বেণ্বা লাঙ্গলী কাবেরী।।
দেবনদী মহানদী ভারবী ভৈরবী।
ক্ষীরবতী দুগ্ধবতী লোহিতা সুরভি।।
করতোয়া গণ্ডকী আত্রেয়ী শ্রীগোমতী।
ঝুম্ঝুমি স্বর্ণরেখা নদী পদ্মবতী।।
মূর্ত্তিমতী হইয়া তথায় আছে সবে।
তড়াগ পুষ্করিণ্যাদি বরুণেরে সেবে।।
চারি মেঘ বৈসে তথা সহ পরিবার।
কহিতে না পারি কত, যত বৈসে আর।।
কুবেরের সভা রাজা কর অবধান।
কৈলাস-শিখরে বিশ্বকর্ম্মার নির্ম্মাণ।।
শতেক যোজন দীর্ঘ বিস্তার সত্তরি।
নিবসে গুহ্যক যক্ষ কিন্নর কিন্নরী।।
চিত্রসেন রম্ভা চিত্রা ঘৃতাচী মেনকা।
চারুনেত্রা ঊর্ব্বশী বুদ্ধুদা চিত্ররেখা।।
মিশ্রকেশী অলম্বুষা কত মহাদেবী।
নৃত্য গীত বাদ্যে সদা কুবেরেরে সেবি।।
পুত্র নলকূবর আরো যে মন্ত্রিগণ।
মণিভদ্র শ্বেতভদ্র ভদ্র সুলোচন।।
গন্ধর্ব্ব কিন্নর যক্ষ আছে লক্ষ লক্ষ।
ভূত প্রেত পিশাচ রাক্ষস দৈত্য রক্ষ।।
ফলকর্ণ ফলোদক তুম্বুরু প্রভৃতি।
হাহা হূহূ বিশ্বাবসু চিত্রসেন কৃতী।।
চিত্ররথ মহেন্দ্র মাতঙ্গ বিদ্যাধর।
বিভীষণ থাকে সদা সহ সহোদর।।
আছয়ে পর্ব্বতগণ মুর্ত্তিমন্ত হৈয়া।
হিমাদ্রি মৈনাক গন্ধমাদন মলয়া।।
আমিও থাকি যে আমা তুল্য বহু আছে।
উমাসহ সদানন্দ সবাই বিরাজে।।
নন্দী ভৃঙ্গী গণপতি কার্ত্তিক বৃষভ।
পিশাচ খেচর ‍দানা শিবাগণ সব।।
আর যত আছে, তাহা কহিতে কে পারে।
কহিব ব্রহ্মার সভা শুন অতঃপরে।।
পূর্ব্বে দেবযুগে দিব্য নামে দিবাকর।
ভ্রমেন মনুষ্যলোকে হয়ে দেহধর।।
আচম্বিতে আমারে দেখিলা মহাশয়।
দিব্যচক্ষে জানিয়া নিলেন পরিচয়।।
ব্রহ্মার সভার গুণ কহিল আমারে।
শুনিয়া হইল ইচ্ছা সভা দেখিবারে।।
তাঁরে জিজ্ঞাসিলাম করিয়া সবিনয়।
কিমতে ব্রহ্মার সভা মম দৃশ্য হয়।।
সূর্য্য বৈল সহস্র বৎসর ব্রতী হৈয়া।
করহ কঠোর তপ হিমালয়ে গিয়া।।
শুনি করিলাম তপ সহস্র বৎসর।
পরে পুনঃ আইলেন দেব দিবাকর।।
আমা সঙ্গে করিয়া গেলেন ব্রহ্মপুরী।
দেখিলাম যাহা তাহা কহিতে না পারি।।
তার অন্ত নাহিক, নাহিক পরিমাণ।
অতুলন সেই সভা ব্রহ্মার নির্ম্মাণ।।
চন্দ্র সূর্য্য নিন্দিয়া সে সভার কিরণ।
শূন্যেতে শোভিছে সভা না যায় নয়ন।।
তথায় থাকিয়া বিধি করেন বিধান।
প্রজাপতিগণ থাকে তাঁর সন্নিধান।।
প্রচেতা মরীচি দক্ষ পুলহ গৌতম।
অঙ্গিরা বশিষ্ঠ ভৃগু সনক কর্দ্দম।।
কশ্যপ বলিষ্ঠ ত্রুতু পুলস্ত্য প্রহ্লাদ।
বালখিল্য অগস্ত্য মাণ্ডব্য ভরদ্বাজ।।
বিদ্যমান অন্তরীক্ষে আত্মা অক্ষগণ।
বায়ু তেজে পৃথ্বী জল শব্দ পরশন।।
গন্ধর্ব্ব সকল আছে মূর্ত্তিমন্ত হৈয়া।
আয়ুর্ব্বেদ চন্দ্র তারা সূর্য্য সন্ধ্যা ছায়া।।
ধর্ম্ম অর্থ কাম মোক্ষ কান্তি শান্তি ক্ষমা।
অষ্টবসু নবগ্রহ শিব সহ উমা।।
চতুর্ব্বেদ ষটশাস্ত্র তন্ত্র শ্রুতি স্মৃতি।
চারি যুগ বর্ষ ‍মাস দিবা সহ রাতি।।
সাবিত্রী ভারতী লক্ষ্মী অদিতি বিনতা।
ভদ্রা ষষ্ঠী অরুন্ধতী কদ্রু নাগমাতা।।
মূর্ত্তিমন্ত হইয়া আছেন নারায়ণ।
ইন্দ্র যম কুবের বরুণ হুতাশন।।
আমার কি শক্তি তাহা বর্ণিবারে পারি।
নিত্য আসি সেবে সবে সৃষ্টি অধিকারী।।
এত সভা দেখিয়াছি আমি এ নয়নে।
তব সভা তুল্য নাহি মনুষ্য-ভুবনে।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন, তুমি মনোজব।
তোমার প্রসাদে শুনিলাম এই সব।।
এক কথা শুনিয়া বিস্ময় জন্মে মনে।
যতেক নৃপতি সব যমের ভবনে।।
একা হরিশচন্দ্র কেন ইন্দ্রের আলয়।
কোন্ পুণ্য দানফলে কহ মহাশয়।।
যমালয়ে যবে দেখিলাম মম পিতা।
আমার বারতা কিছু কহিলেন তথা।।
নারদ বলেন, শুন পাণ্ড প্রধান।
সূর্য্যবংশে শ্রেষ্ঠ হরিশচন্দ্রের আখ্যান।।
এক রথে চড়িয়া জিনিল মর্ত্ত্যপুর।
বাহুবলে হৈল সপ্তদ্বীপের ঠাকুর।।
রাজসূয়-যজ্ঞ সে করিল হরিশচন্দ্র।
আজ্ঞায় আইল যত ছিল রাজবৃন্দ।।
অনেক ব্রাহ্মণ আইল যজ্ঞের সদন।
প্রতি দ্বিজে সেই রাজা করিল সেবন।।
শাস্ত্রমত দক্ষিণা যে বলিলা ব্রাহ্মণ।
পঞ্চগুণ করি তারে দিলেন রাজন।।
সব রাজা হৈতে সে করিল বড় কর্ম্ম।
ইন্দ্রলোকে তাই রহে করি মহা ধর্ম্ম।।
আর যত রাজা রাজসূয়-যজ্ঞ কৈল।
সম্মুখ সংগ্রাম করি যাহারা মরিল।।
যোগিগণ যোগে নিজ দেহত্যাগ করে।
সেই সব লোক বৈসে ইন্দ্রের নগরে।।
কহি শুন তোমার পিতার সমাচার।
যমালয়ে দেখা হৈল সহিত তাঁহার।।
বহু কথা কহিলেন করিয়া বিনয়।
যুধিষ্ঠির ধর্ম্মরাজ আমার তনয়।।
অনুগত তাঁর বীর্য্যবন্ত ভ্রাতৃগণ।
যাঁহার সহায় কৃষ্ণ কমল-লোচন।।
পৃথিবীতে তাঁহার অসাধ্য কিছু নয়।
রাজসূয় যজ্ঞ তাঁর অবহেলে হয়।।
এই রাজসূয় যদি করে ধর্ম্মরাজ।
হরিশচন্দ্র সহ বৈসে ইন্দ্রের সমাজ।।
তোমার জনক ইহা কহিল আমারে।
যে হয় উচিত রাজা করহ বিচারে।।
সর্ব্ব যজ্ঞ হৈতে শ্রেষ্ঠ রাজসূয় গণি।
বহু বিঘ্ন হয় ইথে, আমি ভাল জানি।।
ছিদ্র পেয়ে যজ্ঞ নাশ যক্ষ রক্ষ করে।
যজ্ঞ হেতু রাজগণ যুদ্ধ করি মরে।।
যেমতে মঙ্গল হয়, কর নরপতি।
আমারে বিদায় কর যাব দ্বারাবতী।।
এত বলি প্রস্থান করেন মুনিবর।
শ্রীকৃষ্ণ দর্শন হেতু দ্বারকা-নগর।।
সভাপর্ব্বে অনুপম সভার বর্ণন।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে সাধুজন।।
৪. শ্রীকৃষ্ণকে আনয়নার্থ যুধিষ্ঠিরের দূত প্রেরণ
মুনিমুখে বার্ত্তা শুনি, তবে ধর্ম্ম নৃপমণি,
মনে মনে করেন চিন্তন।
অন্য নাহি লয় মনে, কহিলেন ভ্রাতৃগণে,
কি করিব বলহ এক্ষণ।।
নারদ বলেন যত, পিতৃ-আজ্ঞা যেই মত,
শুনি হন পুলকিত মন।
এ যজ্ঞ কর্ত্তব্য কিনা, ভেবে দেখ সর্ব্বজনা,
কিসে হয় পূর্ণ আকিঞ্চন।।
শুনি যত মন্ত্রিগণ, কহে তবে সর্ব্বজন,
কেন বৃথা চিন্তিত রাজন।
চিন্তা কর কোন হেতু, কর রাজসূয় ক্রতু,
তুমি হও সর্ব্ব গুণবাণ।।
কি কার্য্য অসাধ্যআছে, কেবা বিরোধিবে পাছে,
নাহি হেরি আছে ত্রিভুবনে।
মন্ত্রিগণ-বাক্য শুনি, বিচারেন নৃপমণি,
কি কার্য্য করিব এইক্ষণে।।
যে কর্ম্ম যাহে না শোভে, সে কর্ম্ম করিলে তবে,
সভামাঝে হইবে নিন্দন।
পাছে হয় বিড়ম্বনা, অযশ যোষে সর্ব্বজনা,
চিন্তাতে হয়েন নিমগণ।।
বিশেষে বিষম যজ্ঞ, সব লোক নহে যোগ্য,
কিরূপেতে হইবে সাধন।
ইহা আগেনা প্রকাশি, গোবিন্দে অগ্রে জিজ্ঞাসি,
কি কহেন শুনি জনার্দ্দন।।
কর্ত্তব্য কি অকর্ত্তব্য, হরির হইলে শ্রব্য,
করিব এ ব্রত আচরণ।
যদি দেন অনুমতি, এ যজ্ঞে হইব ব্রতী,
নতুবা এ বৃথা আকিঞ্চন।।
ইহা চিন্তি নরপতে, তবে ইন্দ্রসেন দূতে,
প্রেরিলেন কৃষ্ণ সন্নিধান।
সে দূত সত্বর হয়ে, দ্বারকা প্রবেশে গিয়ে,
দাঁড়াইল বন্দিয়া চরণ।।
কৃষ্ণে করি নমস্কার, কহে ধর্ম্ম-সমাচার,
জানাইল হরিষে তখন।
কয় সে বিনয় করি, চল তথা তুমি হরি,
তোমা লাগি চিন্তিত রাজন।।
তোমার দর্শন বিনে, কুন্তী-পুত্র দুঃখী মনে,
রহিয়াছে বিরস বদন।
এ কথা শুনিবামাত্র, শ্রীকৃষ্ণ তোলেন গাত্র,
যাইবারে করেন মনন।।
বৈনতেয় আরোহণে, যান ইন্দ্রসেন সনে,
ধর্ম্মপুত্রে দিতে দরশন।
দিবাকর যায় অস্তে, উপনীত ইন্দ্রপ্রস্থে,
হইলেন দেব নারায়ণ।।
কৃষ্ণ আইলেন পুরে, শুনি হর্ষ নৃপবরে,
আগুবাড়ি লইতে তখন।
ভ্রাতৃ মন্ত্রী পাঠাইল, অগ্র হৈয়া কৃষ্ণে নিল,
মহাসুখে ভাসে সর্ব্বজন।।
ধর্ম্মে নমস্কার করি, সম্ভাষেন তবে হরি,
মিষ্ট ভাষে তুষি ভগবান।
ধর্ম্ম-নরপতি তবে, কৃষ্ণে পূজে ভক্তিভাবে,
বসিবারে দিল সিংহাসন।।
বসিলেন সবে তথা, চন্দ্রের মণ্ডলী যথা,
সে রূপের না হয় তুলন।
শ্রীহরি-চরণদ্বয়, যে ভাবে সদা হৃদয়ে,
দুঃখ নাহি পায় সেই জন।।
০৫. শ্রীকৃষ্ণ-যুধিষ্ঠির সংবাদ
বলেন গোবিন্দ প্রতি ধর্ম্মের কুমার।
নারদেরে কহিলেন জনক আমার।।
রাজসূয় মহাযজ্ঞ, দুর্ল্লভ সংসারে।
যুধিষ্ঠিরে কহ রাজসূয় করিবারে।।
এই হেতু যজ্ঞ-বাঞ্ছা হইলে আমার।
শুন এই কথা কৃষ্ণ, কহি সারোদ্ধার।।
পরস্পর আমারে সুহৃদ বলে সবে।
কেহ প্রীতে কেহ নিতে কেহ ধনলোভে।।
যে যত বলেন, নাহি লয় মম মনে।
যতক্ষণ নাহি শুনি তোমার বদনে।।
বুঝিয়া সন্দেহ প্রভু ভাঙ্গহ আমার।
কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্য যুক্তি তোমার বিচার।।
পাণ্ডবের গতি তুমি, পাণ্ডবের পতি।
তোমা বিনা পাণ্ডবের নাহি অব্যাহতি।।
গোবিন্দ বলেন, তুমি সর্ব্ব গুণবাণ।
পৃথিবীর মধ্যে রাজা কে তব সমান।।
যোগ্য হও রাজা তুমি যজ্ঞ করিবারে।
এক নিবেদন আমি করিব তোমারে।।
আমি যাহা কহি, তাহা জান ভালমতে।
এক লক্ষ রাজা চাহি এ মহা যজ্ঞেতে।।
মগধ-ঈশ্বর জরাসন্ধ শ্রেষ্ঠ রাজা।
পৃথিবীর যত রাজা করে তার পূজা।।
তাহারে না মানে হেন, নাহি ক্ষিতিমাঝে।
বলেতে বান্ধিয়া আনে যে জন না ভজে।।
তাহার সহায় বহু দুষ্ট রাজগণ।
শিশুপাল দন্তবক্র নৃপতি যবন।।
পুণ্ডরীক বাসুদেব কোশল-ঈশ্বর।
রুক্মী ভগদত্ত রাজা মহাবলধর।।
এমত অনেক যত দুষ্ট নরপতি।
সদাকাল থাকে সবে তাহার সংহতি।।
ইক্ষবাকু ইলার বংশে যত যত জন।।
তার ভয়ে নিজ দেশে রহিতে নারিয়া।
উত্তর দেশেতে সবে গেল পলাইয়া।।
জরাসন্ধের দুই কন্যা অস্তি প্রাপ্তি বলি।
কংসের বনিতা দোঁহে আমার মাতুলী।।
স্বামীর কারণে বাপে গোহারী করিল।
সসৈন্য মগধপতি মথুরা বেড়িল।।
অসংখ্য তাহার সৈন্য, কে গণিতে পারে।
ক্ষয় নাহি, মারিলেক শতেক বৎসরে।।
রাম আমি দুই ভাই করিনু সংহার।
সে হেতু আইল সাজি অষ্টাদশবার।।
তবে চিত্তে বিচার করিনু সর্ব্বজন।
মথুরা বসতি আর নহে সুশোভন।।
নিরন্তর দুই কন্যা কহিবেক বাপে।
পুনঃ পুনঃ জরাসন্ধ আসিবেক কোপে।।
এমত বিচারি সবে মথুরা ত্যজিয়া।
দূরস্থান দ্বারকিয় রহিলাম গিয়া।।
তার পক্ষে না যুঝে যে সব রাজগণে।
বন্দী করি রাখিয়াছে আপন ভবনে।।
পশুবৎ করি সব রাখিয়াছে রাজা।
সবাকারে বলি দিবে করি রুদ্র পূজা।।
ছিয়াশী হাজার ভূপ আছে বন্দিশালে।
তব যজ্ঞ হয় রাজা সব মুক্ত হৈলে।।
জরাসন্ধে বিনাশিলে সর্ব্ব সিদ্ধ হয়।
নিষ্কণ্টকে যজ্ঞ তবে কর মহাশয়।।
জরাসন্ধ জীয়ন্তে না হয় কোন কাজ।
তারে মারি বশ কর রাজার সমাজ।।
হইবে অতুল যশ সংসার ভিতরে।
আমার যুকতি এই কহিনু তোমারে।।
এতেক বলিলা যদি কমললোচন।
কৃষ্ণের কহেন রাজা ধর্ম্মের নন্দন।।
সমুচিত যতেক কহিলা মহাশয়।
ইহা না করিলে যজ্ঞ কি প্রকারে হয়।।
শান্তি আচরণ আমি করি যে প্রথমে।
পৃথিবীর রাজা বাধ্য করি ক্রমে ক্রমে।।
পশ্চাতে করিব জরাসন্ধের উপায়।
মম মত এই, কহিলাম যে তোমায়।।
ভীমসেন বলে, না লয় মম মনে।
প্রথমে মারিব বৃহদ্রথের নন্দনে।।
তারে মারি মুক্ত যদি করি রাজগণ।
যজ্ঞে বিঘ্ন করে তবে, নাহি হেন জন।।
রাজা হৈয়া শান্তি ভজে, লক্ষ্মী নাহি পায়।
পূর্ব্ব-রাজগণ কর্ম্ম কহি শুন রায়।।
বাহুবলে ভারত শাসিল ভূমণ্ডল।
মান্ধাতা নৃপতি কর ত্যাজিল সকল।।
প্রতাপেতে কার্ত্তবীর্য্য ঘোষে জগজ্জন।
ভগীরথ খ্যাত করি প্রজার পালন।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, রাজা কর অবগতি।
যেমতে হইবে হত মগধের পতি।।
সৈন্যে সাজি তাহারে নারিবে কদাচিত।
অসংখ্য দুর্দ্দান্ত সৈন্য যাহার রক্ষিত।।
ভীমার্জ্জুন দেহ রাজা আমার সংহতি।
উপায়ে করিব হত মগধের পতি।।
শুনিয়া বলেন তবে ধর্ম্মের তনয়।
যতেক কহিলা মম চিত্তে নাহি লয়।।
মহারাজ জরাসন্ধ রাজচক্রবর্ত্তী।
যাহারে করেন ভয় ইন্দ্র সুরপতি।।
যার ভয়ে জগন্নাথ মথুরা ত্যজিয়া।
পশ্চিম সমুদ্রতীরে রহিলেন গিয়া।।
ভীমার্জ্জুন চক্ষু মম, কৃষ্ণ ‍তুমি প্রাণ।
সঙ্কটেতে পাঠাইব, না হয় বিধান।।
হেন যজ্ঞে প্রয়োজন নাহিক আমার।
সন্ন্যাসী হইয়া পাছে ভ্রমিব সংসার।।
এত শুনি তখন কহেন ধনঞ্জয়।
কেন হেন না বুঝিয়া বল মহাশয়।।
চিরজীবী নহে কেহ সংসার ভিতর।
যুদ্ধ না করিয়া কেবা আছয়ে অমর।।
বিনা দুঃখে সঙ্কটেতে নহে কোন কর্ম্ম।
সুকম্ম বিহীন রাজা, বৃথা তার জন্ম।।
এ উপায়ে কর্ম্ম যদি না হয় সাধন।
পশ্চাৎ করিব তাহা, যাহা লয় মন।।
এতেক বলেন যদি ইন্দ্রের নন্দন।
সাধু বলি প্রশংসা করেন নারায়ণ।।
সভাপর্ব্ব সুধারস জরাসন্ধ-বধে।
কাশীরাম দাস কহে, গোবিন্দের পদে।।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র