শ্রীমদ্ভগবতগীতার নবম অধ্যায়ের সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

পরমেশ্বর ভগবান বললেন-হে অর্জুন! তুমি অসূয়াশূন্য (পরের দোষ না ধরা) বলে তোমাকে আমি পরম বিজ্ঞান সমন্বিত সবচেয়ে গোপনীয় জ্ঞান উপদেশ করছি। সেই জ্ঞান প্রাপ্ত হয়ে তুমি দু:খময় সংসার বন্ধন থেকে মুক্ত হও। এই আত্মজ্ঞান সমস্ত বিদ্যার রাজা, সমস্ত গুহ্যতত্ত্ব থেকেও গুহ্যতর, পরম পবিত্র, সর্বোৎকৃষ্ট এবং প্রত্যক্ষ অনুভূতির দ্বারা আত্ম-উপলব্দি প্রদান করে বলে ইহা সর্ব ধর্মের ফলস্বরূপ ও সুখসাধ্য এবং অক্ষয়ফলপ্রদ। হে পরন্তপ! এ আত্মজ্ঞানরূপ ধর্মের প্রতি যাদের শ্রদ্ধা উদিত হয়নি, তারা আমাকে লাভ করতে পারে না। তাই তারা এ মৃত্যুময় সংসারে বার বার ফিরে আসে। আমি ইন্দ্রিয়ের অগোচর ও অব্যক্তমূর্তি; আমার দ্বারা এ সমগ্র বিশ্ব পরিব্যাপ্ত। ব্রহ্মাদি স্থাবর পর্যন্ত সমস্ত ভূত আমাতে অবস্থিত, কিন্তু আমি তাতে অবস্থিত নই। যদিও সব কিছুই আমার সৃষ্ট, তবুও তারা আমাতে অবস্থিত নয়।আমার যোগৈশ্বর্য দর্শন কর। যদিও আমি সমস্ত জীবের ধারক এবং যদিও আমি সর্বব্যাপ্ত, তবু্ও আমি এই জড় সৃষ্টির অন্তর্গত নই, কেন না আমি নিজেই সমস্ত সৃষ্টির উৎস। ইহা জানিও যে, যেমন নির্লিপ্ত আকাশের আশ্রয়ে অবস্থান করে মহান বায়ু সর্বত্র বিচরণ করে সেইরূপ মহাভূতসমূহ ও প্রাণিগণ নির্লিপ্ত আমাতে স্থিত হয়ে অবস্থান করে আছে। কৌন্তেয়, কল্পক্ষয়ে অর্থাৎ অর্থাৎ ব্রহ্মার দিবার অবসান হলে ভূতসমূহ আমার শক্তিরূপিনী ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতিতে বিলীন হয়। পনরায় কল্প আরম্ভ হলে অর্থাৎ ব্রহ্মার দিবারম্ভে আমি তাহাদের সৃষ্টি করি। আমি নিজে মায়ারূপ প্রকৃতিকে আশ্রয় করে প্রকৃতির বশে অবশ অর্থাৎ প্রকৃতির দ্বারা চালিত সেই ভূতসমূহ পুন: পুন: সৃষ্টি করি এবং আমারই ইচ্ছায় অন্তকালে বিনষ্ট হয়। অথচ ধনঞ্জয়, আমি প্রকৃতি এ সকল কর্মে অনাসক্ত ও উদাসীনের ন্যায় অবস্থিত বলে সেই সমস্ত কর্ম আমাকে আবদ্ধ করতে পারে না। হে কৌন্তেয়! আমার অধ্যক্ষতার দ্বারা ত্রিগুণাত্মিকা মায়া এ চরাচর বিশ্ব সৃষ্টি করে। আমি এ সকলের স্রষ্টা, সত্তা ও সাক্ষিরূপে অধিষ্ঠিত বলে এ জগৎ পুন: পুন: সৃষ্টি হয় ও ধ্বংস হয়। আমি সকল ভূতসমূহের মহেশ্বর, আমি মনুষ্য শরীর পরিগ্রহ করে যখন অবতীর্ণ হই মূঢ় ব্যক্তিরা আমার পরম তত্ত্ব না জেনে আমাকে অবজ্ঞা করে থাকে। এভাবেই যারা মোহাচ্ছন্ন হয়েছে, তারা মোহকারী রাক্ষুসী ও আসুরী প্রকৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয়। ফলে তাদের আশা, কর্ম ও জ্ঞান বৃথা হয় এবং তারা বিভ্রান্তচিত্ত হয়ে থাকে। কিন্ত হে পার্থ! যাঁরা দৈব প্রকৃতিকে আশ্রয় করে আমার প্রতি অনন্যচিত্ত হন, সেই মহাত্ম পুরুষগণ আমাকে সর্বভূতের কারণ এবং অবিনাশী জেনে আমার ভজনা করেন। তাঁরা সর্বক্ষণ আমার মহিমা কীর্তন অর্থাৎ স্মরণ ও বর্ণন করে এবং দৃঢ়নিষ্ঠা ও যত্নশীল হয়ে আমাকে নমস্কার করে এবংভক্তিসহকারে নিত্যযুক্ত হয়ে আমার উপাসনা করে। কোন কোন মহাত্মা জ্ঞানরূপ যজ্ঞ করে আমার পূজা করেন। কেহ কেহ আমার সহিত আপনাকে অভেদ চিন্তা করেন, কেহ কেহ আমাকে স্বতন্ত্র ভাবে চিন্তা করেন এবং অন্য কেহ কেহ আমাকে বিশ্বমূর্তি ভগবান ভেবে বহু প্রকারের উপাসনা করেন। আমিই ক্রতু অর্থাৎ বেদবিহিত অশ্বমেধাদি যজ্ঞ, আমিই যজ্ঞ অর্থাৎ স্মৃতিবিহিত ব্রতদানাদি কর্ম, আমিই স্বধা অর্থাৎ পিতৃগণের উদ্দেশ্যে অর্পিত অন্নাদি, আমিই ঔষধ অর্থাৎ ব্রীহিযবাদি যার দ্বারা যজ্ঞ নিষ্পত্তি হয়, আমিই মন্ত্র অর্থাৎ বিবিধ যজ্ঞমন্ত্র গায়ত্রী ও বীজমন্ত্রাদি, আমিই আজ্য অর্থাৎ হোমের ঘৃত, আমিই অগ্নি এবং আমিই হোমক্রিয়া। আমিই এ জগতের পিতা, মাতা, বিধাতা ও পিতামহ, আমিই একমাত্র জ্ঞাতব্য ও পবিত্রবস্তু। আমিই ওঙ্কার এবং অমিই ঋকবেদ, সামবেদ ও যজুর্বেদ স্বরূপ। আমিই এ জগতে গতি অর্থাৎ চরম গন্তব্য স্থান বা আশ্রয়, ভর্তা, প্রভূ, সাক্ষী বা নির্লিপ্ত দ্রষ্টা, নিবাস বা ভোগস্থান, শরণ বা রক্ষক, সুহৃদ বা অন্তরঙ্গ, উৎপত্তিস্থান ও হেতু অর্থাৎ প্রভব, প্রলয় বা বিনাশকারণ, স্থান বা অধিষ্ঠান, নিধান বা অব্যক্ত কর্মফলরূপূ অদৃষ্টের ভান্ডার এবং অক্ষয় বীজ। অর্জুন, আমিই আদিত্যরূপে তাপ প্রদান করি, আমিউ জল আকর্ষণ করি, আমিই পুনর্বার ভূমিতে জল বর্ষণ করি; আমিই অমরগণের অমৃত ও মর্ত্যগণের মৃত্যু এবং আমিই সৎ ও অসৎ। ত্রিবেদজ্ঞগণ যজ্ঞানুষ্ঠান দ্বারা আমাকে আরাধনা করে যজ্ঞাবশিষ্ট সোমরস পান করে পাপমুক্ত হন এবং স্বর্গে গমন করেন। তাঁরা পূণ্যকর্মের ফলস্বরুপ ইন্দ্রলোক লাভ করে অপ্রাকৃত দেবভোগ উপভোগ করেন। তাঁরা সেই বিপুল স্বর্গসুখ উপভোগ করে পূণ্য ক্ষয় হলে মর্ত্যলোকে ফিরে আসেন। এভাবেই স্বর্গ কামনায় ত্রিবেদোক্ত ধর্মের অনুষ্ঠান করে ভোগকামী মানুষেরা সংসারে বারংবার জন্ম-মৃত্যু লাভ করে থাকেন। অপর পক্ষে অনন্যমনা হয়ে যাঁরা আমার উপাসনা করেন সেই নিত্যযুক্ত পুরুষদের যোগক্ষেম অর্থাৎ ফল অর্জন ও ফল রক্ষার ভার বহন করি। কৌন্তেয়, যে সকল ভক্ত শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে ভিন্ন বুদ্ধিতে অন্য দেবতার উপাসনা করে তারাও অবিধিপূর্বক অর্থাৎ প্রকৃত তত্ত্ব না জেনে আমারই উপাসনা করে এ কথা সত্য কারণ আমি সর্বপ্রকার যজ্ঞের অর্থাৎ কর্মের ভোক্তা এবং প্রভু কিন্তু তারা তত্ত্বত আমাকে না জেনে অর্থাৎ আমিই বাস্তবিক তাদের পূজার ভোক্তা ও প্রভু ইহা না জেনে শ্রেয় লাভ হতে চ্যুত হয় অর্থাৎ পূজার দ্বারা যতটা ফল পাওয়া যেতো তা লাভ করতে পারে না। দেবপূজকগণ দেবতালোক প্রাপ্ত হন, পিতৃপূজকগণ পিতৃলোক প্রাপ্ত হন আর আমার পূজকগণ আমাকেই লাভ করেন। যে বিশুদ্ধচিত্ত নিষ্কাম ভক্ত ভক্তি সহকারে আমাকে পত্র, পুষ্প, ফল ও জল অর্পণ করেন আমি সেই বিশুদ্ধচিত্ত ব্যক্তির ভক্তিপূত উপহার প্রীতিপূর্বক গ্রহণ করি। অতএব কৌন্তেয় যে কাজ তুমি কর, যে দ্রব্য আহার কর, যা কিছু উৎসর্গ কর, যা দান কর, যে তপস্যা বা কৃচ্ছ্রসাধন কর সে সমস্তই আমাকে অর্পণ কর অর্থাৎ সকর দৈনন্দিন কাজ এবং পূঝা অর্চনা প্রভৃতি সমস্তই ব্রহ্মবুদ্ধিতে অনুষ্ঠান কর। এরূপ ভাবে চলিলে শুভ ও অশুভ কর্মের যে বন্ধন ফল আছে তা হতে মুক্তি লাভ করবে এবং সন্ন্যাসযোগযুক্ত হয়ে অর্থাৎ কর্মফল ত্যাগরূপ সন্ন্যাসযোগের দ্বারা বন্ধনমুক্ত হয়ে আমাকে প্রাপ্ত হবে। আমি সর্বজীবের পক্ষেই একরূপ। কেহ আমার প্রিয়ও নয় আবার কেহ আমার অপ্রিয়ও নয় কিন্তু যে কেহ আমাকে ভক্তিসহকারে ভজনা করে সে আমাতেই অবস্থান করে এবং আমিও তার অন্তরে বাস করি। অত্যন্ত দূরাচার ব্যক্তিও যদি অনন্য ভক্তি সহকারে আমাকে ভজনা করে তাকে সাধু বলেই মনে করবে কারণ তার ব্যবসায় বা নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি উপযুক্ত পথাবলম্বী হয়েছে অর্থাৎ কোন্ পথ ধরতে হবে সে স্থির করেছে , সে শ্রীঘ্রই ধর্মাত্মা হয় অর্থাৎ পাপাচরণ পরিত্যাগ করে ধর্মপথ অবলম্বন করে এবং চিরস্থায়ী শান্তিলাভ করে। কৌন্তেয়, ইহা নিশ্চিত জানিও যে, আমার ভক্ত কখনও বিনষ্ট হয় না। হে পার্থ! আমার আশ্রয় গ্রহণ করলে পাপযোনিসম্ভূত জীবগণ, স্ত্রী, বৈশ্য ও শূদ্র সকলেই পরম গতি লাভ করেন, পূণ্যজন্মা ব্রাহ্মণ, ভক্ত এবং ক্ষত্রিয়গণের আর কি কথা? তাঁরা আমাকে আশ্রয় করলে নিশ্চয়ই পরা গতি (পরম মুক্তি) লভি করবেন। অতএব, যখন এ অনিত্য সুখহীন মর্ত্যলোকে মুনষ্যদেহ ধারণ করেছ, তখন অন্যান্য সকল কর্তব্য ত্যাগ করে আমাকেই ভজনা কর। আমাতেই মন অর্পণ কর, আমার প্রতি ভক্তিপরায়ন হও, সর্বদা আমাকেই পূজা কর, আমাকে নমস্কার কর। এভাবে মৎপরায়ণ হয়ে আমাতে মন ও বুদ্ধি সমাহিত করলে নি:সন্দেহে তুমি আমাকে লাভ করবে। ইতি: শ্রীমদ্ভগবতগীতার নবম অধ্যায়ের সম্পূর্ণ বঙ্গানুবাদ সমাপ্ত।

ConversionConversion EmoticonEmoticon

:)
:(
=(
^_^
:D
=D
=)D
|o|
@@,
;)
:-bd
:-d
:p
:ng

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র