১৬. কুরুসৈন্যের সহিত যুদ্ধে অর্জ্জুন সহ উত্তরের গমনউত্তর কহেন তবে ধনঞ্জয় প্রতি।রথ চালাইয়া তুমি দেহ শীঘ্রগতি।।যথায় কৌরব-সৈন্য, করহ গমন।সাক্ষাতে দেখহ আজি তাদের মরণ।।এত গর্ব্বী হৈল সবে, হরে মম গরু।তার সমুচিত ফল পাবে আজি কুরু।।পুনঃ পুনঃ প্রতিশ্রুতি করি বীর কয়।হাসি রথ চালালেন বীর ধনঞ্জয়।।আকাশে উঠিল রথ চক্ষুর নিমিষে।মুহূর্ত্তেকে উত্তরিল কুরুসৈন্য পাশে।।ব্যস্ত হয়ে রাজসুত অর্জ্জুনেরে বলে।কেমন চালাহ রথ, কোথায় আনিলে।।তথায় লইবে রথ, যথায় গোধন।আনিলে সাগর মধ্যে বল কি কারণ।।পর্ব্বত প্রমাণ উঠে লহরী হিল্লোল।কর্ণেতে না শুনি কিছু পূরিল কল্লোল।।নৌকাবৃন্দ দেখি মম আকুলিত চিত্ত।জলজন্তু কলরব করে অপ্রমিত।।হাসিয়া অর্জ্জুন তবে বলিবলেন তায়।সমুদ্র প্রমাণ বটে, জলনিধি প্রায়।।ধবল আকার যত দেখহ কুমার।জল নহে, এই সব গোধন তোমার।।নৌকাবৃন্দ নহে, সব মাতঙ্গ-মণ্ডল।না হয় লহরী, রথ পতাকা সকল।।সৈন্য কোলাহল-শব্দ সিন্ধু-শব্দ প্রায়।কৌরবের সৈন্য এই, জানাই তোমায়।।উত্তর বলিল, মোর মন নাহি লয়।না জানহ বৃহন্নলা, সমুদ্র নিশ্চয়।।সমুদ্র না হয় যদি হবে সৈন্যগণ।এ সৈন্য সহিত তবে কে করিবে রণ।।দেবের দুস্তর এই সৈন্য সিন্ধুমত।মানুষে কি শক্তি ধরে তাহার অগ্রতঃ।।এত সৈন্য বলি মোর নাহি ছিল জ্ঞান।জন কত লোক বলি ছিল অনুমান।।মহা মহা রথিগণ দেখি হৈল ভয়।পৃথিবীর ক্ষত্র যার নামে কম্প হয়।।দেবতা তেত্রিশ কোটি লয়ে পুরন্দর।না পারিলে যার সহ করিতে সমর।।যথা ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ অশ্বত্থামা কৃপ।বিবিংশতি দুঃশাসন দুর্য্যোধন নৃপ।।কুবুদ্ধি লাগিল মোরে হইনু অজ্ঞান।তেঁই কুরু-সৈন্য মধ্যে করিনু প্রয়াণ।।থাকুক যুদ্ধের কাজ, দেখি ছন্ন হৈনু।শরীর ছাড়িল প্রাণ, তোমারে কহিনু।।ত্রিগর্ত্তের সহ রণে পিতা মোর গেল।এক গোটা পদাতিক পুরে না রাখিল।।এক মোরে রাখি গেল রাজ্যের রক্ষণে।মোর কিবা শক্তি কুরুরাজ সহ রণে।।কহ বৃহন্নলা, তব কিবা মনে আসে।তবু রথ রাখিয়াছ কেমন সাহসে।।শীঘ্র রথ বাহুড়াহ পাছে কুরু দেখে।ধেনু হেতু মিথ্যা কেন মরিব বিপাকে।।উত্তর-বচনে হাসি কন ধনঞ্জয়।শত্রু দেখি কিবা হেতু এত তব ভয়।।কৃষ্ণবর্ণ হৈল মুখ শীর্ণ হৈল অঙ্গ।জিহ্বাতে উড়িল ধূলি, কম্পে কর জঙ্ঘ।।না করিয়া যুদ্ধ তব দেখি হৈল ডর।কোন্ মুখে বাহুড়িয়া পুনঃ যাবে ঘর।।কহিলে যে রথ বাহুড়াহ শীঘ্রগতি।চিত্তেনা করিহ, আমি এমন সারথি।।না করিয়া কার্য্যসিদ্ধি বাহুড়াব কেনে।পূর্ব্বে কহিয়াছি, তাহা ভুলিলে এক্ষণে।।কিসের কারণে আমি রথ বাহুড়িব।সর্ব্বসৈন্য মধ্যে রথ এখনি লইব।।স্ত্রীগণের মধ্যে যত প্রতিজ্ঞা করিলে।কি কহিবে, তারা সবে এ কথা শুনিলে।।যুদ্ধ-ভয় ত্যজ এবে, ধর বীরপণ।ধনু ধরি নিজ বলে জিন কুরুগণ।।কুরু জিনি গোধনেরে নাহি লয়ে গেলে।মহা লজ্জা হবে তবে পৃথিবী মণ্ডলে।।হাসিবেক যত লোক সর্ব্ব ক্ষত্রগণ।হাসিবেক নারীলোক আর যত জন।।আমার সারথ্য-গুণ সৈরন্ধ্রী কহিল।তব সঙ্গে আসি মোর সব নষ্ট হৈল।।তোমার এ কর্ম্ম যদি পূর্ব্বেতে জানিব।তবে কেন তব সঙ্গে সংগ্রামে আসিব।।হাসিবেক অন্তঃপুরে নারী পুনঃ পুনঃ।কহিল সৈরন্ধ্রী মিথ্যা বৃহন্নলা গুণ।।যে জনের কর্ম্মে লোকে করে উপহাস।নিন্দিত জীবনে তার কিবা হেতু আশ।।উপহাস হৈতে মৃত্যু বরং শ্রেষ্ঠ কর্ম্ম।বিশেষ ক্ষত্রিয়ে যুদ্ধে মৃত্যু বড় ধর্ম্ম।।ইহা না করিয়া আমি বাহুড়িব কেনে।ধৈর্য্য ধরি যুদ্ধ কর, ভয় ত্যজ মনে।।উত্তর বলিল, কিবা কহ বৃহন্নলা।মহাসিন্ধু পার হৈতে বান্ধ তৃণভেলা।।অগ্নির কি করিবেক পতঙ্গ-শকতি।মত্তগজ আগে কোথা শশকের গতি।।মৃত্যু সহ বিবাদেতে বাঁচে কোন্ জন।দেখি ফণিমুখে হস্ত দিব কি কারণ।।জীবন থাকিলে সব পাব পুনর্ব্বার।গবী-রত্ন নিক মোর, হাসুক সংসার।।হাসুক রমণীগণ, আর বীরগণ।ঘরে যাব, যুদ্ধে মোর নাহি প্রয়োজন।।দৈবে নপুংসক তুমি, হীন সর্ব্বসুখে।তেঁই মৃত্যু শ্রেয়ঃ বলি কহ নিজমুখে।।জীবন মরণ তব একই সমান।তব বোলে কি কারণে হারাব পরাণ।।সমানের সহ ক্ষত্র করিবেক রণ।লজ্জা নাহি বলবানে দেখি পলায়ন।।মোর বোলে যদি তুমি না ফিরাও রথ।পদব্রজে চলি আমি যাব এই পথ।।এত বলি ফেলাইয়া দিল শরচাপ।রথ হৈতে ভূমিতলে পড়ে দিয়া লাফ।।শীঘ্রগতি চলি যায় নিজ রাজ্যমুখে।রহ রহ বলি ডাকে ধনঞ্জয় তাকে।।হেন অপকীর্ত্তি করি জীয়ে কোন্ ফল।এত বলি নিজে পার্থ নামে ভূমিতল।।ভরত-পঙ্কজ-রবি মহামুনি ব্যাস।বিরচিল পাঁচালি প্রবন্ধে কাশীদাস।।১৭. অর্জ্জুন সম্বন্ধে কৌরবদিগের অনুমানপাছে ধায় রড়ে, দীর্ঘ বেণী নড়ে,পৃষ্ঠোপরি শোভে চারু।লোহিত বসন, অঙ্গে বিভূষণ,যেন করিবর ঊরু।।আজানুলম্বিত অঙ্গম-মণ্ডিত,দ্বিভুজ ভুজঙ্গ সম।দেখিয়া কৌরব, বিচারয়ে সব,মনেতে পাইয়া ভ্রম।।একজন আগে, পলাইছে বেগে,আর জন পাছে ধায়।এ কি বিপরীত, না বুঝি চরিত,কেবা যে আগে পলায়।।পাছুতে যে জন, নহে সাধারণ,ছদ্মবেশী প্রায় লাগে।যেন ভস্মমাঝে, অগ্নি হীনতেজে,সিংহ যেন ধায় মৃগে।।পুরুষ কি নারী, বুঝহ বিচারি,ছদ্ম করিয়াছে তনু।শুনি সেইক্ষণ, কহে বিচক্ষণ,ভরদ্বাজ-অঙ্গজনু।।আগে যেই যায়, ভয়েতে পলায়,কেবা সে, তারে না চিনি।পাছু গোড়াইয়া, যায় যে ধাইয়া,তারে হেন অনুমানি।।নরসিংহ প্রায়, দেখি তায় কায়,সম তার অবয়ব।।স্বর্গে সুরমণি, মর্ত্ত্যেতে ফাল্গুনি,বিনা এ যুগল জনে।অন্য কার প্রাণে, কুরুসৈন্য সনে,আসিবে একাকী রণে।।এত শুনি কর্ণ, চক্ষু রক্তবর্ণ,কহিতে লাগিল ক্রোধে।কি-শক্তি অর্জ্জুনে, একা আসি রণে,কৌরব সহ বিরোধে।।আগে যে সত্বর, হইবে উত্তর,বিরাট রাজার সুত।গোধন কারণে, এসেছিল রণে,দেখিল সৈন্য বহুত।।পাছু যেই যায়, নপুংসক প্রায়,আছিল সারথি রথে।পলাইল রথী, কি করে সারথি,সেই পলায় ভয়েতে।।শুনি মহামতি, বুদ্ধে বৃহস্পতি,গৌতম-বংশজ কয়।পাছু যেই যায়, ভয়েতে পলায়,এমত চিত্তে না লয়।।যদি পলাইত, রথেতে রহিত,যাইত রথী লইয়া।হেন লয় মন, করিবেক রণ,আপনি রথী হইয়া।।কহিছ যে আগে, পলাইছে বেগে,উত্তর সেই প্রমাণ।পাছুতে যে লোক, ছদ্ম পনুংসক,পার্থ বিনা নহে আন।।কৃপের বচন, শুনি দুর্য্যোধন,কহিতে লাগিল তবে।এ তিন ভুবনে, কাহার পরাণে,আমা সহ বিরোধিবে।।হউক অর্জ্জুন, কিবা নারায়ণ,কাম কামপাল আদি।কি শক্তি কাহার, সহিত আমার,একা রণে হবে বাদী।।ভারত-চন্দ্রিমা, রসের অসীমা,শ্রবণে পাপ বিনাশে।কৃষ্ণদাস দ্বিজ, কৃষ্ণ পদাম্বুজ,বন্দি কহে কাশীদাসে।।১৮. উত্তরকে অর্জ্জুনের অভয় ও আশ্বাস প্রদানএমত বিচার করে কুরু সৈন্যগণ।নির্ণয় করিতে নাহ পারে কোন জন।।পলায় উত্তর, ধনঞ্জয় ধায় পাছে।শত পদ অন্তরে ধরিল গিয়া কাছে।।আর্ত্ত হয়ে রাজসুত বলে গদ গদ।না মারিহ বৃহন্নলা, ধরি তব পদ।।এবার লইয়া যদি যাহ মোরে ঘর।নানা রত্ন তোমা আমি দিব বহুতর।।দিব্য হেম মণি মুক্ত গজ হয় রথ।এক লক্ষ গবী দিব স্বর্ণ-অলঙ্কৃত।।বহু দেশ গ্রাম দিব, দাসদাসীগণ।আর যাহা চাহ, তাহা দিব সেইক্ষণ।।না মারিহ বৃহন্নলা, দেহ মোরে ছাড়ি।এত বলি কান্দেকত ধরাতলে পড়ি।।অচেতন হৈল বীর, যেন নাহি প্রাণ।হরিল মুখের বাক্য, যেন হতজ্ঞান।।আশ্বাসিয়া পার্থ কহে করি সচেতন।না করিহ ভয়, শুন আমার বচন।।যুদ্ধ করিবারে যদি ভয় হয় মনে।সারথি হইয়া রথে বৈস মম সনে।।রথী হয়ে দেখ আমি করিব সমর।যত যোদ্ধাগণে পাঠাইব যমঘর।।তোমার গোধন সব লইব ছাড়ায়ে।কেবল থাকহ তুমি সারথি হইয়ে।।ক্ষত্র হয়ে কেন তব রণে মৃত্যুভয়।না করিহ রণভয়, ত্যজহ সংশয়।।এত বলি ধরি তারে তুলে রথোপরে।তথাপি বিরাট পুত্র কান্দে উচ্চৈঃস্বরে।।১৯. কৌরবগণের অর্জ্জুন বিষয়ক পরস্পর তর্ক বিতর্করথ চালালেন তবে ধীমান অর্জ্জুন।শমীবৃক্ষ যথা আছে অস্ত্র ধনুর্গুণ।।উত্তরেরে রথে লয়ে করেন গমন।দেখিয়া হাসিয়া বলে কর্ণ দুর্য্যোধন।।হে গুরু, হে কৃপাচার্য্য, কোথা ধনঞ্জয়।স্বপ্নেতে তোমরা দেখ পাণ্ডুর তনয়।।গুরু বলি সঙ্কোচে না কহি কোন কথা।আমার শত্রুর গুণ গাও যথা তথা।।দুর্য্যোধন-বাক্য গুরু না শুনিল কাণে।ভীষ্ম প্রতি চাহি তবে কহেন সেক্ষণে।।বিপরীত অকুশল দেখ হেথা আজি।নিরুৎসাহ সর্ব্বসৈন্য কান্দে গজ বাজী।।রক্তবৃষ্টি হইতেছে, বহে তপ্ত বাত।অন্ধকার দশদিক, সঘনে নির্ঘাত।।বিনা মেঘে রক্তবৃষ্টি মহাকলবর।বহু প্রাণী বিনাশের লক্ষণ এ সব।।যত সৈন্য সবে থাক সংগ্রামের সাজে।সবে মেলি রক্ষা কর দুর্য্যোধন রাজে।।গবী হেতু সঙ্কটেতে পড়িলাম সবে।বহুকাল জীব, আজি রক্ষা পাই তবে।।এত বলি ভীষ্মে চাহি বলেন বচন।চিনিলে কি অঙ্গনায় গঙ্গার নন্দন।।লঙ্কার ঈশ্বর বনরিপু যায় ধ্বজ।নগনামে নাম যার নগারি অঙ্গজ।।অঙ্গনার বেশধারী দুষ্টনাশকারী।গোধন লইবে আজি কুরুসৈন্য মারি।।সঙ্কেতে এতেক গুরু বলেন বচন।উত্তর করেন শুনি শান্তনু-নন্দন।।কি হেতু সঙ্কেতে কথা বল আর গুরু।প্রকাশ করিয়া বলে শুনুক সে কুরু।।সভাস্থলে পূর্ব্বে ধর্ম্ম সে কৈল নির্ণয়।গেল দিন পরিপূর্ণ হইল সময়।।সে ভয় ত্যজিয়া কহ, শুনুক সকলে।শুনি দুর্য্যোধনে চাহি গুরুদেব বলে।।বলিলে তুমি তো রাজা বচন না শুন।তথাপি নিলর্জ্জ হয়ে কহি পুনঃ পুনঃ।।এই যে ক্লীবের বেশে গেল মহাশূর।সর্ব্বসৈন্য-অন্তকারী খ্যাত তিন পুর।।ধনঞ্জয় নারম যার কুরুকুলবর।প্রতিজ্ঞা তাহার যত তোমাতে গোচর।।যথা যায়, জয় নাহি করিয়া বাহুড়ে।সুরাসুর যার নামে নিজস্থানে ছাড়ে।।মম শিষ্য বলি তুমি না করিহ মনে।ইন্দ্র শিব আদি দেব দিল অস্ত্রগণে।।বহুবিদ্যা পাইয়াছে অমর-ভুবনে।অতি ক্রোধে আসিতেছে, লয় মম মনে।।পার্থ সহ কে যুঝিবে তব রথী মাঝ।একজন নয়নে না দেখি মহারাজ।।এত শুনি বলে তবে কর্ণ মহাবীর।প্রশংসা করহ তুমি সদা গাণ্ডীবীর।।দুর্য্যোধন তার সহ যুদ্ধে যোগ্য নয়।অনুক্ষণ কহ তুমি, প্রাণে কত সয়।।যদি এই জন হবে পাণ্ডুর কুমার।তবে ত মানস পূর্ণ হইল আমার।।দুর্য্যোধন বলে, যদি ধনঞ্জয় এই।কামনা হইল পূর্ণ, আমি যাহা চাই।।যার হেতু চর মোর খুঁজিল সংসার।হেন জনে পাইলে কি চাহি তবে আর।।ত্রয়োদশ বৎসর অজ্ঞাত বাস আদি।পূর্ণ না হইতে পার্থ দেখা দিল যদি।।কহ গুরু কেমনে না যাবে পুনঃ বন।সবে জান, যুধিষ্ঠির করিল যে পণ।।অর্জ্জুন না হয় যদি, অন্য জন হবে।এখনি মারিব তারে যেন ক্ষুদ্র জীবে।।কর্ণের বচন শুনি দ্রোণ বলে বাণী।যত বড় যেই জন সব আমি জানি।।অর্জ্জুন যেমত, তাহা ত্রিলোকে বিখ্যাত।খাণ্ডব দাহনে সেই জিনে সুরনাথ।।অপ্রমেয় পরাক্রম যদুবলে জিনি।হরিয়া আনিল বলরামের ভগিনী।।বাহুযুদ্ধে পরাজয় কৈল পশুপতি।এক রথে জয় করে সগাগরা ক্ষিতি।।নিবাতকবচগণে করে নিপাতন।দশ রাবণের তেজ এক এক জন।।বহুকাল কালকেয় ইন্দ্রের বিবাদী।সবে মারি নিষ্কণ্টক করে জম্ভভেদী।।চিত্রসেনে জিনি দুর্য্যোধনে মুক্ত কৈল।সহজে কহিতে তোর অঙ্গে না সহিল।।এখনি সাক্ষাতে আজি দেখিবে নয়নে।কোন্ জন যুঝিবেক অর্জ্জুনের সনে।।মহাভারতের কথা ক্ষীরোদ লহরী।পুণ্য ধর্ম্মকথা সুধা স্নাত পূতবারি।।নরলোকের যে পাপ তাপ ব্যথাহারী।কাশীরাম কহে কিবা বর্ণিবারে পারি।।২০. অর্জ্জুনের সহিত উত্তরের শমীবৃক্ষ নিকটে গমন ও উত্তরের অস্ত্র বিষয়ে প্রশ্নএতেক বিচার করে কুরু সৈন্যগণ।শমী-বৃক্ষতলে যানে ইন্দ্রের নন্দন।।উত্তরে বলেন, তুমি যুদ্ধে যোগ্য নহ।এই দীর্ঘ শমীবৃক্ষ উপরে আরোহ।।ধনুঃশ্রেষ্ঠ গাণ্ডীব যে আছে বৃক্ষোপরে।দিব্য যুগ্ম তূণ আছে পরিপূর্ণ শরে।।বিচিত্র কবচ ছত্র শঙ্খ মনোহর।বৃক্ষ হৈতে নামাইয়া আনহ সত্বর।।পঞ্চ ধনু মধ্যে যেই ধনু মনোরম।বল যার এক লক্ষ তালবৃক্ষ সম।।শুনিয়া বিরাটপুত্র করিল উত্তর।কিমতে চড়িব এই বৃক্ষের উপর।।শুনিয়াছি এক গাছে শব বান্ধা আছে।রাজপুত্র হয়ে কিসে চড়িব এ গাছে।।পার্থ বলে, শব নহে বৃক্ষ উপরেতে।পাপকর্ম্ম কেন তোমা কহিব করিতে।।শব বলি রেখেছিনু কপট-বচন।শব নহে, আছে ইথে ধনু অস্ত্রগণ।।এত শুনি রাজসুত চড়ে সেইক্ষণ।ছাড়াইল যত ছিল বস্ত্র-আচ্ছাদন।।অর্কচন্দ্র-প্রভা যেন ধনু অস্ত্র যত।সর্পের মণির প্রায় জ্বলে শতশত।।ব্যস্ত হয়ে রাজসুত ধনঞ্জয়ে কয়।ধনু অস্ত্র কোথা, সব দেখি সর্পময়।।দেখিয়া অদ্ভুত মোর কাঁপিছে হৃদয়।স্পর্শ করা দূরে থাক, দেখি লাগে ভয়।।পার্থ বলে, সর্প নহে ধনু-অস্ত্রগণ।শুনিয়া উত্তর পুনঃ কহিছে বচন।।অদ্ভূত বিচিত্র দীর্ঘ তালবৃক্ষ সম।মণিরত্নে বিভূষিত ধনু মনোরম।।মৃগচিহ্ণ হুলে যার দুরাকর্ষ দেখি।কোন্ মহাবীর হেন ধনু গেল রাখি।।বিচিত্র দ্বিতীয় ধনু রিপুকুল-ধ্বংস।কাহার এ ধনুপৃষ্ঠে শোভে রাজহংস।।তৃতীয় সুবর্ণ গোধা শোভে ধনুহুলে।কাহার বিচিত্র ধনু, অগ্নি হেন জ্বলে।।চতুর্থ অদ্ভূত ধনু, দেখি যে কাহার।চতুর্দ্দশ ব্যাঘ্র পৃষ্ঠে শোভিত যাহার।।কাহার এ ধনু, পৃষ্ঠে হেমশিখি-শোভা।মণি রত্ন বিভূষিত শত চন্দ্র-আভা।।বিচিত্র শকুনিপত্র বিভূষিত শর।পূর্ণ দেখি ছয় গোটা তূণ মনোহর।।চর্ম্ম মধ্যে পঞ্চ শঙ্খ কাহার সুন্দর।সেই শঙ্খ বাদ্য করে কোন্ ধনুর্দ্ধর।।অর্কপ্রভ তীক্ষ্ণ পঞ্চ শঙ্খ মনোহর।বৃক্ষমধ্যে পঞ্চ শঙ্খ রাখে কোন্ নর।।নাহি দেখি, নাহি শুনি, লোকের বদনে।হেন অস্ত্র ধনু, বল রাখে কোন্ জনে।।পার্থ বলে, যেই ধনু নীলোৎপলনিভ।ত্রৈলোক্য-বিজয়ী নাম ধরয়ে গাণ্ডীব।।সুরাসুর সুপূজিত শত্রুর শমন।শতেক সহস্র বল যাহার গণন।।ব্রহ্মবৎশে ব্রহ্মা ধরে শতেক বৎসর।পঞ্চাশী বৎসর ধরিলেন পুরন্দর।।পঞ্চশত বর্ষ ধরে দেব নিশাকরে।চৌষট্টি বরষ ছিল প্রজাপতি করে।।শতেক বরষ ধরিলেক জলপতি।বরুণে মাগিয়া নিল অগ্নি মহামতি।।খাণ্ডব দাহন হেতু দিল অর্জ্জুনেরে।পঞ্চষষ্টি বর্ষ উহা রহে পার্থ-করে।।দেবের নির্ম্মিত ধনু, দেবমূর্ত্তি ধরে।দেবকার্য্যে পাইলাম অগ্নি দিল মোরে।।পূর্ব্বে ব্রহ্মা দেবগণ লয়ে যজ্ঞ কৈল।পঞ্চবিংশ পর্ব্বে এক বের্ণ-বৃক্ষ হৈল।।বিষ্ণুর ধনুক নবপর্ব্বে নিরমিত।শারঙ্গ যাহার নাম, বল অপ্রমিত।।সপ্তপর্ব্বে জয়ন্তী সে ধনুক নির্ম্মাণ।সংহার কারণে থাকে মহেশের স্থান।।পঞ্চপর্ব্বে কোদণ্ডক ধনুক নির্ম্মিল।দানব দলন হেতু দেবরাজে দিল।।পঞ্চ লক্ষ বল তার থাকে ইন্দ্র হাতে।রাবণ বিনাশ হেতু দিল রঘুনাথে।।তিন পর্ব্বে গাণ্ডীবের হয়েছে নির্ম্মাণ।খাণ্ডব দহিতে অগ্নি মোরে দিল দান।।মোহন মূরলী এক পর্ব্বে ধাতা কৈল।গোপীর মোহন হেতু গোবিন্দেরে দিল।।গাণ্ডীব ধনুর জন্ম, কৈনু যেই মতে।ত্রিগুণে নির্ম্মিত গুণ সর্ব্ব ধনুকেতে।।দ্বিতীয় ধনুক হেম বিদ্যুতে শোভয়।ছয় হংস-চিত্র ধর্ম্ম-নৃপতি ধরয়।।সত্তর সহস্র বল ধনুক নির্ম্মাণ।দ্রোণাচার্য্য গুরু পূর্ব্বে মোরে দিল দান।।সহস্রেক গোধা যেই ধনু অনুপাম।বৃকোদর ধনু তার সুপার্শ্বক নাম।।পঞ্চ শত সত্তর সহস্র বল ধরে।কাড়ি নিল ধনু বলে জয়দ্রথ বীরে।।ব্যাঘ্র-বিভূষিত ধনু নকুল বীরের।পঁষট্টি সহস্র বল শল্যের করের।।শিখিচিহ্ন ধনু সহদেব বীর ধরে।চতুঃষষ্টি বল পূর্ব্বে দিল চক্রধরে।।অতিদীর্ঘ তরুবর পিপ্পলী ভূষিত।ভীমসেন ঠাকুরের জগতে বিদিত।।এতেক বলেন যদি বীর ধনঞ্জয়।তবু না জানিল মূঢ় বিরাটতনয়।।পুনঃ জিজ্ঞাসিল, সত্য কহ বৃহন্নলে।ধনু অস্ত্র রাখি তাঁরা, গেল কোন্ স্থলে।।শুনেছি পাশাতে হারি গেল রাজ্য ধন।কৃষ্ণা সহ বনে প্রবেশিল ছয় জন।।হেথায় কিমতে অস্ত্র রাখিল পাণ্ডব।তুমি জ্ঞাত হৈলে কিসে, বল এই সব।।হাসিয়া বলেন পার্থ আমি ধনঞ্জয়।কঙ্ক সভাসদ সেই ধর্ম্মের তনয়।।বৃকোদর বল্লব, যে পাচক তোমার।অশ্বপাল নাম গ্রন্থি, নকুল কুমার।।সহদেব তব গবী করেন পালন।সৈরন্ধ্রী পাঞ্চালী, হেতু কীচক নিধন।।উত্তর বলিল, মোর মনে নাহি লয়।কহ সত্য তুমি যদি পাণ্ডুর তনয়।।দশ নাম ধরে সেই পার্থ মহাশয়।শুনিলে আমার মনে হইবে প্রত্যয়।।অর্জ্জুন বলেন নাম শুনহ আমার।যেই দশ নাম মম বিখ্যাত সংসার।।অর্জ্জুন ফাল্গুনি সব্যসাচী ধনঞ্জয়।কিরীটি বীভৎসু শ্বেতবাহন বিজয়।।কৃষ্ণ জিষ্ণু, বলি মোর দশ নাম জান।প্রদান করিল যাহা অমর প্রধান।।উত্তর বলিল, কহ করিয়া নির্ণয়।কি হেতু কি নাম হৈল, কুন্তীর তনয়।।দৈবে তুমি জান নাম তাঁর সঙ্গে ছিলে।শুনি জ্ঞান হৌক, শীঘ্র কহ বৃহন্নলে।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon