মহাভারত:আদিপর্ব ৮২-৮৬

৮২. পাণ্ডবগণের একচক্রা নগরে বাস ও বকবধ বৃত্তান্ত
অজ্ঞাতে ব্রাহ্মণ-গৃহে পাণ্ডুপুত্রগণ।
নগরে ভ্রমেন নিত্য ভিক্ষার কারণ।।
ভিক্ষা করি আসি সবে দিবা অবসানে।
যে কিছু পায়েন দেন জননীর স্থানে।।
জননী করেন পাক দেন সবাকারে।
অর্দ্ধেক বাটিয়া দেন বীর বৃকোদরে।।
মাহাসহ অর্দ্ধ খান চারি সহোদর।
তথাপিও তৃপ্ত নহে বীর বৃকোদর।
হেনমতে বিপ্রগৃহে বঞ্চে অতিক্লেশে।
ভিক্ষা করে অনুদিন ব্রাহ্মণের বেশে।।
একদিন গৃহেতে রহিল বৃকোদর।
ভিক্ষাতে গেলেন আর চারি সহোদর।।
আচম্বিতে বিপ্রগৃহে মহাশব্দ শুনি।
বিলাপ করিয়া কান্দে ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণী।।
করুণ হৃদয়া কুন্তী সহিতে নারিয়া।
কহেন নিকটে বৃকোদরেরে ডাকিয়া।।
এতদিন বিপ্রগৃহে আছি যে অজ্ঞাতে।
পরম সাহায্য বিপ্র করিল বিপত্তে।।
এখন বিপদগ্রস্থ হইল ব্রাহ্মণ।
অবশ্য বিপদে তারে করহ রক্ষণ।।
উপকারী জনে যে সাহায্য নাহি করে।
পরলোক পাপ হয় অযশ সংসারে।।
ভীম বলিলেন, মাতা জিজ্ঞাস ব্রাহ্মণে।
শক্তি-অনুসারে রক্ষা করিব তৎক্ষণে।।
ভীমের আশ্বাস পেয়ে যান কুন্তীদেবী।
বৎসের বন্ধনে যেন ধায় ত সুরভি।।
ব্রাহ্মণের ঘরে কুন্তী করেন গমন।
দেখেন ব্যাকুল হৈয়া কাঁদিছে ব্রাহ্মণ।।
ব্রাহ্মণ কাতর হৈয়া বলে ব্রাহ্মণীরে।
এই হেতু পূর্ব্বে কত বলিনু তোমারে।।
রাক্ষসের উপদ্রব যেই দেশে হয়।
সে দেশে বসতি কভু উপযুক্ত নয়।।
পিতা-মাতা-স্নেহে তুমি লঙ্ঘিলা বচন।
তাহার উচিত দুঃখ পাইলা এখন।।
কি করিব উপায় না দেখি যে ইহার।
কোন্ বুদ্ধি করিব না দেখি প্রতিকার।।
তুমি ধর্ম্মপত্নী হও আমার গৃহিণী।
সর্ব্ব ধর্ম্ম-বিশারদা সুখ-প্রদায়িণী।।
বিশেষ বালক পুত্র আছে যে তোমার।
তোমা বিনা মুহূর্ত্তেক না জীবে কুমার।।
অরণ্যের প্রায় দুঃখ হবে তোমা বিনে।
জীয়ন্তে হইবে মরা তোমার মরণে।।
আপনা রাখিয়া তোমা দিব রাক্ষসেরে।
অপযশ হবে আমা সংসার ভিতরে।।
অপূর্ব্ব সুন্দরী এই কন্যা সুবদনী।
কন্যারে রাক্ষসে দিলে কুযশ কাহিনী।।
কন্যা-জন্ম হৈলে পিতৃলোকে করে আশ।
দান কৈলে চিরকাল হয় স্বর্গবাস।।
ইহা লৈয়া দিব আমি রাক্ষস-ভক্ষণে।
ধিক্ ধিক্ তবে মোর কি কাজ জীবনে।।
আপনি যাইব আমি রাক্ষসের স্থানে।
এত বলি কান্দে দ্বিজ সজল নয়নে।।
ব্রাহ্মণী বলেন, প্রভু কেন দুঃখ ভাব।
তোমরা থাকহ সুখে, আমি তথা যাব।।
তুমি যদি যাও তথা, একে হবে আর।
একেবারে মরিবে সকল পরিবার।।
আমি সহমৃতা হব তোমার মরণে।
অনাথ হইবে কন্যা পুত্র দুই জনে।।
তবে কদাচিৎ যদি রাখিব জীবন।
কি শক্তি আমার শিশু করিতে পালন।।
তোমা বিনা অনাথ হইব তিন জনে।
অনাথের বহু কষ্ট হবে দিনে দিনে।।
দরিদ্র দেখিয়া তবে অকুলীন জন।
এই কন্যা বরিবেক দিয়া কিছু ধন।।
অল্পকালে এই পুত্র হইবে ভিক্ষুক।
কুলধর্ম্ম আর বেদে হইবে বিমুখ।।
বলিষ্ঠ দুর্ম্মুখ লোক কামে মুগ্ধ হৈয়া।
মোরে আকর্ষিবে চিত্তে অনাথা দেখিয়া।।
বিবিধ দুর্গতি হবে তোমার বিহনে।
অনুচিত তোমার যাইতে সে কারণে।।
অপত্য নিমিত্ত তুমি করিলা সংসার।
কন্যা পুত্র দুইগুটি হৈয়াছে তোমার।।
কন্যা দান কর আর পড়াহ বালকে।
পুনর্ব্বার বিবাহ করিয়া থাক সুখে।।
আমা বিনা গৃহস্থলী হবে আরবার।
তোমার বিহনে সর্ব্ব হবে ছারখার।।
ভার্য্যার পরম ধর্ম্ম স্বামীর সেবন।
স্বামী বিনা অকারণ নারীর জীবন।।
সঙ্কটে তারয়ে স্বামী দিয়া আপনাকে।
ভুঞ্জয়ে অক্ষয় স্বর্গ, যশ ইহলোকে।।
তপ জপ যজ্ঞ ব্রত নানাবিধ দান।
স্বামীর প্রসাদে হয় সর্ব্বত্র সম্মান।।
সর্ব্বধর্ম্ম আছে ইথে শাস্ত্রের বিহিত।
রাক্ষসের ঠাঁই আমি যাইব নিশ্চিত।।
ব্রাহ্মণী এতেক যদি বলিল উত্তর।
গলে ধরি উচ্চৈঃস্বরে কান্দে দ্বিজবর।।
স্বামীর ক্রন্দন দেখি কান্দয়ে ব্রাহ্মণী।
মা বাপের দশা দেখি কন্যা বলে বাণী।।
অনাথের প্রায় দোঁহে কান্দ কি কারণ।
ক্রন্দন সম্বর, শুন মোর নিবেদন।।
রাক্ষসের ঠাঁই যদি জননী যাইবে।
জননী-বিচ্ছেদে এই বালক মরিবে।।
পিণ্ডস্থান যাবে আর হবে কুলক্ষয়।
সে কারণে মাতার যাইতে বিধি নয়।।
জন্ম হৈলে কন্যারে অবশ্য ত্যাগ করে।
বিধির সৃজন ইহা খণ্ডিতে কে পারে।।
দৈবেতে আমারে পিতা অন্যে দিবে দান।
এক্ষণে রাক্ষসে দিয়া দোঁহে পাও ত্রাণ।।
আমা হেন কত হবে তোমরা থাকিলে।
সে কারণে মোরে দিয়া বঞ্চ কুতূহলে।।
হইলে আমার পুত্র তারিবে পশ্চাতে।
সম্প্রতি তারিয়া আমি যাইব নিশ্চিতে।।
এতেক শুনিয়া কান্দে ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী।
তিনজনে গলাগলি কান্দে উচ্চধ্বনি।।
এমন শুনিয়া পুত্র তিনের ক্রন্দন।
মুখে হস্ত দিয়া করে সবারে বারণ।।
হাতে এক তৃণ লৈয়া বলে সেই শিশু।
রাক্ষসের ভয় তোরা না করিস্ কিছু।।
রাক্ষসে মারিব এই তৃণের প্রহারে।
কোথা আছে দেখাইয়া দেহ, দেখি তারে।।
বালকেরবচন শুনিয়া তিনজন।
হাসিতে লাগিল তারা ত্যজিয়া ক্রন্দন।।
ক্রন্দন নিবৃত্ত দেখি ভোজের নন্দিনী।
বলেন ব্রাহ্মণ প্রতি সকরুণ বাণী।।
মৃতের উপরে যেন সুধা বরিষণে।
জিজ্ঞাসেন কুন্তীদেবী মধুর বচনে।।
কি কারণে ক্রন্দন করহ তিনজন।
জানিলে, হইলে সাধ্য করিব মোচন।।
দ্বিজ বলে, যেই হেতু করি যে ক্রন্দন।
মনুষ্যের শক্তি নাহি করিতে মোচন।।
এই ত নগরে আছে বক নিশাচর।
অত্যন্ত দুরন্ত সেই রাজ্যের ঈশ্বর।।
যক্ষ রক্ষ প্রেত ভূত পরচক্র-ভয়।
তার ভুজবলে ইথে নাহিক সংশয়।।
নগরের মধ্যে এই আছে যত নর।
রাক্ষসের নির্ণয় করিল এই কর।।
পায়স পিষ্টক অন্ন শকটে পূরিয়া।
এক নর আর দুই মহিষ ধরিয়া।।
এই কার্য্য বিনা অন্য নাহিক তাহার।
বহুকালে মম প্রতি হয়েছে করার।।
এইরূপে বলি নাহি দেয় যেইজন।
সকুটুম্ব সহ তারে করয়ে ভক্ষণ।।
আজি তার পালা পড়িয়াছে মম ঘরে।
কি করিব কি হইবে বুদ্ধি নাহি সরে।।
এই ভার্য্যা কন্যা পুত্র আছি চারিজনা।
কারে দিব বলিদান, করি এ ভাবনা।।
মনুষ্য কিনিয়া দিব নাহি হেন ধন।
সুহৃদ কুটুম্ব দিতে নাহি লয় মন।।
কারো মায়া তেয়াগিতে নারে কোন জনে।
সবে মিলি যাব কর্ম্মে যা থাকে লিখনে।।
ব্রাহ্মণের এতেক কাতর বাক্য শুনি।
সদয় হৃদয়ে বলে ভোজের নন্দিনী।।
ভয় ত্যজ দ্বিজবর না কর ক্রন্দন।
সকুটুম্বে যাবে কেন রাক্ষস-সদন।।
পঞ্চ পুত্র আছে মম শুন হে ব্রাহ্মণ।
এক পুত্র দিব আমি তোমার কারণ।।
ব্রাহ্মণ বলিল, ভাল করিলা বিচার।
অতিথি ব্রাহ্মণ আছ আশ্রমে আমার।।
আপনার প্রাণ হেতু করিব এ কর্ম্ম।
লোকে অসম্ভব হবে মজিবেক ধর্ম্ম।।
আত্মা দিয়া দ্বিজ রাখে, বেদে শাস্ত্রে কয়।
দ্বিজ দিয়া আত্মরক্ষা উচিত না হয়।।
অজ্ঞানে ব্রাহ্মণ বধে নাহি প্রতিকার।
জ্ঞানেতে করিব হেন কর্ম্ম দুরাচার।।
কুন্তী বলিলেন, যে কহিলা দ্বিজমণি।
মম অগোচর নহে, সব আমি জানি।।
লোকের বেদনা মম না সহে পরাণে।
বিশেষ ব্রাহ্মণ-দুঃখ সহিব কেমনে।।
দ্বিজ বলে হেন বাক্য না বলিহ মোরে।
এ পাপ ভুঞ্জিব আমি যুগ যুগান্তরে।।
নিঃশব্দে বলেন কুন্তী, শুন দ্বিজবর।
আমার তনয়গণ মহা-বলধর।।
রাক্ষসে খাইবে হেন না করিহ মনে।
রাক্ষস সংহার কৈল মম বিদ্যমানে।।
বেদবিদ্যা বুদ্ধিবলে মম পুত্রগণ।
পৃথিবীতে নাহিক জিনিতে কোন জন।।
শতপুত্র থাকিলে কি পুত্রে অনাদর।
ভয় ত্যজি অন্য বলি করহ সত্বর।।
কুন্তীর অদ্ভুত বাক্য শুনিয়া তখন।
মৃতদেহে দ্বিজ যেন পাইল জীবন।।
দ্বিজ সঙ্গে করি কুন্তী করিয়া গমন।
ভীমেরে জানাইলেন সব বিবরণ।।
মায়ের বচনে ভীম করেন স্বীকার।
হরিষে ব্রাহ্মণ গেল গৃহে আপনার।।
কতক্ষণে আইলেন ভাই চারিজন।
যুধিষ্ঠির শুনিলেন সব বিবরণ।।
একান্তে ধর্ম্মের সুত ডাকিয়া মায়েরে।
জিজ্ঞাসা করেন, ভীম গেল কোথাকারে।।
তোমার সম্মতি কিবা আপন ইচ্ছায়।
কাহার বুদ্ধিতে হেন করিলা উপায়।।
কুন্তী বলে, আমার বচনে বৃকোদর।
বিপ্রের কারণে আর রাখিতে নগর।।
ধর্ম্ম কীর্ত্তি আছে ইথে নাহি অপযশ।
বিশেষ ব্রাহ্মণ-রক্ষা পরম পৌরুষ।।
এত শুনি যুধিষ্ঠির কহেন বিরস।
কি বুদ্ধিতে মাতা হেন করিলা সাহস।।
এমন দুষ্কর নাহি শুনি ইহলোকে।
মাতা হৈয়া পুত্রে দেয় রাক্ষসের মুখে।।
পুত্রের ভিতরে পুত্র কব কি বিশেষে।
সবে প্রাণ রাখিয়াছি তাহার আশ্বাসে।।
ভিক্ষা মাগি প্রাণ রাখি, যথা তথা বাস।
পুনঃ রাজ্য পাব বলি যার বলে আশ।।
যার ভুজবলে নিদ্রা না যায় কৌরবে।
যার তেজে জতুগৃহে রক্ষা পাই সবে।।
স্কন্ধে করি নিল সবা হিড়িম্বক-বনে।
হিড়িম্বে মারিয়া কৈল সবার রক্ষণে।।
হেন পুত্র দিলা তুমি রাক্ষস-ভক্ষণে।
আমরা বাঁচিব আর কিসের কারণে।।
গর্ভধারী হয়ে ইহা কেহ নাহি করে।
বেদেতে নাহিক, নাহি সংসার ভিতরে।।
রাজার দুহিতা তুমি রাজার মহিষী।
দুঃখ পেয়ে হতবুদ্ধি, হৈলা বনবাসী।।
কুন্তী বলেষ যুধিষ্ঠির না ভাবিহ তাপ।
মম অগোচর নহে ভীমের প্রতাপ।।
অযুত হস্তীর বল ধরে কলেবরে।
ভীমে পরাজয় করে নাহিক সংসারে।।
জন্মকালে পরাক্রম শুনহ তাহার।
প্রসবিয়া নিতে শক্তি নহিল আমার।।
কিছুমাত্র তুলি পুনঃ ফেলাইনু তলে।
গিরিশৃঙ্গ চূর্ণ হৈল ভীমের আস্ফালে।।
বারণাবতেতে তুমি দেখিলা নয়নে।
চারি হস্তী তুল্য যে তোমরা চারিজনে।।
আমা সহ সবারে লইল স্কন্ধে করি।
হিড়িম্বা লইল বলে হিড়িম্বে সংহারি।।
ভীম-পরাক্রম পুত্র আমি জানি ভালে।
রাক্ষস-সংহার হবে ভীম-ভুজ-বলে।।
উপস্থিত ভয়ে ত্রাণ করে যেই জন।
তাহা সম পুণ্য বাপু না করি গণন।।
বিশেষ গো-বিপ্র হেতু দিবে নিজ প্রাণ।
আপনাকে দিয়া দ্বিজে করিবেক ত্রাণ।।
রাজ্য রক্ষা দ্বিজ রক্ষা আর যে পৌরুষ।
হেন কর্ম্মে কেন তুমি হইলা বিরস।।
মায়ের এতেক নীতি শুনিয়া বচন।
ধন্য ধন্য বলিলেন ধর্ম্মের নন্দন।।
পরদুঃখে দুঃখী তুমি দয়ালু হৃদয়।
তোমা বিনা হেন বুদ্ধি অন্যের কি হয়।।
পর-পুত্র প্রাণ হেতু নিজ পুত্র দিলা।
ব্রাহ্মণের এ সঙ্কটে রক্ষণ করিলা।।
তোমার পুণ্যেতে দ্বিজ তরিবে বিপদে।
রাক্ষস মারিবে ভীম তোমার প্রসাদে।।
আর এক কথা মাতা কহ দ্বিজবরে।
এ সব প্রচার যেন না হয় নগরে।।
তবে কুন্তী কহিলেন তথ্য সে ব্রাহ্মণে।
বলি ভোজ্য করি দ্বিজ দিল ততক্ষণে।।
নিশাকালে বৃকোদর শকটে চড়িয়া।
যথা বসে বনে বক উত্তরিল গিয়া।।
রে রে বক নিশাচর আইস সত্বর।
এত বলি অন্ন খান বীর বৃকোদর।।
নাম ধরি ডাকাতে ক্রোধেতে থর থর।
বক বীর আসে যেন পর্ব্বত-শিখর।।
মহাকায় মহাবেশ মহা-ভয়ঙ্করে।
চলিতে বিদরে ক্ষিতি চরণেতে ভরে।।
অন্ন খান বৃকোদর, দেখি বিদ্যমান।
ক্রোধে দুই চক্ষু যেন অরুণ-সমান।।
ডাক দিয়া বলে বক অরে দুষ্টমতি।
মনুষ্য হইয়া কেন করিস্ অনীতি।।
সকুটুম্ব ব্রাহ্মণে খাইব তোর দোষে।
এত বলি নিশাচর ধায় অতি রোষে।।
রাক্ষসের বাক্য ভীম না শুনিয়া কাণে।
পৃষ্ঠ দিয়া তারে অন্ন পূরেন বদনে।।
দেখি ক্রোধে নিশাচর করয়ে গর্জ্জন।
ঊর্দ্ধ বাহু করি ধায়অতি ক্রোধ মন।।
দুই হাতে বজ্রমুষ্টি পৃষ্ঠেতে প্রহারে।
তথাপি ভ্রূক্ষেপ নাহি বীর বৃকোদরে।।
পৃষ্ঠে যে রাক্ষস মারে, সহেন হেলায়।
পায়সান্ন খায় বীর সহি নিঃশঙ্কায়।।
দেখিয়া অধিক ক্রোধ হইল নিশাচরে।
বৃক্ষ উপাড়িয়া হানে ভীমের উপরে।।
তথাপিহ অন্না খান হাসি বৃকোদর।
বামহাতে কাড়িয়া নিলেন তরুবর।।
পুনঃ মহাবৃক্ষ উপাড়িল নিশাচর।
গর্জ্জিয়া মারিল বৃক্ষ ভীমের উপর।।
ভোজনান্তে বৃকোদর করি আচমন।
বৃক্ষ উপাড়িলেন যে ঘোর দরশন।।
বৃক্ষে বৃক্ষে যুদ্ধ হৈল না যায় কথনে।
উৎসন্ন হইল বৃক্ষ না রহিল বনে।।
শিলাবৃষ্টি করে দোঁহে দোঁহার উপর।
বাহু-বাহু যুদ্ধ হৈল দেখি ভয়ঙ্কর।।
মুণ্ডে, মুণ্ডে, বুকে বুকে, ভুজে ভুজে তাড়ি।
জড়াজড়ি করি দোঁহে যায় গড়াগড়ি।।
যুদ্ধেতে হইল শ্রান্ত বক নিশাচর।
রাক্ষসে ধরিল বীর কুন্তীর কোঙর।।
বাম হস্তে দুই জানু, ডান হস্তে শির।
বুকে জানু দিয়া টানিলেন ভীমবীর।।
মধ্যে মধ্যে ভাঙ্গিয়া করেন দুইখান।
মহাশব্দ করি বক ত্যজিল পরাণ।।
আর যত আছিল বকের অনুচর।
ভয়ে পলাইয়া সবে গেল বনান্তর।।
নগর নিকটে ভীম বকে ফেলাইয়া।
মাতৃ-ভ্রাতৃ-স্থানে সব কহিলেন গিয়া।।
হরষিতা কুন্তীদেবী ডাকি যুধিষ্ঠিরে।
আলিঙ্গিয়া প্রশংসা করেন বৃকোদরে।।
রজনী প্রভাত হৈল, উদয় অরুণ।
বাহির হইল যত নগরের জন।।
দেখিয়া সকল লোক হৈল চমৎকার।
পড়িয়াছে বক যেন পর্ব্বত-আকার।।
কেহ বলে, এ কর্ম্ম করিল কোন্ জন।
কেহ বলে, নিষ্কণ্টক হৈল সর্ব্বজন।।
পরম দুরন্ত বক সদা হিংসা করে।
আপনার পাপে দুষ্ট এত দিনে মরে।।
তবে সবে বিচারিয়া নগরের জন।
তদন্ত করহ বকে কে কৈল নিধন।।
কালিকার ভোজ্য যার আছিল পঞ্চক।
সেই বলিবারে পারে বকের অন্তক।।
ব্রাহ্মণের ঘরে বলি জানিল নির্ণীত।
সবে মিলি ব্রাহ্মণেরে ডাকিল ত্বরিত।।
জিজ্ঞাসিল ব্রাহ্মণেরে সব বিবরণ।
ব্রাহ্মণ বলিল, শুনি ইহার কারণ।।
কালিকার দিনে পালা ছিল মম ঘরে।
আমাকে শোকার্ত্ত দেখি এক দ্বিজবরে।।
সদয় হইয়া দিল আমারে অভয়।
বলি লৈয়া বক-স্থানে গেল মহাশয়।।
সেই দ্বিজবর বকে করিল সংহার।
এইত রাজ্যের দ্বিজ করিল নিস্তার।।
এত শুনি মহাহৃষ্ট হৈল সর্ব্বজন।
ব্রাহ্মণের মহাপূজা করিল তখন।।
আনন্দে ব্রাহ্মণ এল আপনার ঘরে।
দেবতুল্য দ্বিজবর পূজে পাণ্ডবেরে।।
৮৩. ধৃষ্টদ্যৃম্ন ও দ্রৌপদীর উৎপত্তি
হেনমতে দ্বিজগৃহে কত দিন যায়।
আচম্বিতে এক দ্বিজ আইল তথায়।।
বিবিধ দেশের কথা কহে তপোধন।
পঞ্চ পুত্র সহ কুন্তী করেন শ্রবণ।।
দ্বিজ বলে, করিলাম দেশ পর্য্যটন।
বহু নদী তীর্থক্ষেত্র না যায় গণন।।
দেখিলাম আশ্চর্য্য যে পাঞ্চাল নগরে।
মহোৎসব দ্রুপদ-কন্যার স্বয়ম্বরে।।
দ্রুপদ-রাজার কন্যা কৃষ্ণা নাম ধরে।
রূপে গুণে তুল্য নাহি পৃথিবী ভিতরে।।
অযোনি-সম্ভবা কন্যা জন্ম যজ্ঞ হৈতে।
যাজ্ঞসেনী নাম তাই বিখ্যাত জগতে।।
দ্রুপদের পুত্র এক রূপ গুণধাম।
দ্রোণে বিনাশিতে জন্ম, ধৃষ্টদ্যুন্ন নাম।।
এত শুনি জিজ্ঞাসেন পাণ্ডু-পুত্রগণ।
কহ শুনি দ্বিজবর ইহার কারণ।।
দ্বিজ বলে, পূর্ব্বে দ্রোণ দ্রুপদের মিত।
কত দিনে কলহ হইল আচম্বিত।।
অভিমানে গেল দ্রোণ হস্তিনা-নগরে।
অস্ত্র-শিক্ষা করালেন কৌরব-কোঙরে।।
শিক্ষা-অন্তে শিষ্যগণে দক্ষিনা মাগিল।
দ্রুপদ-রাজার বান্ধি আনিতে কহিল।।
কুন্তীপুত্র অর্জ্জুন গুরু-আজ্ঞা পাইয়া।
দ্রুপদ রাজারে বান্ধি দিলেন আনিয়া।।
অর্দ্ধরাজ্য দিয়া দ্রোণ হইলেন মিত।
মুক্ত করি দ্রুপদেরে দিলেন ত্বরিত।।
অভিমানে দ্রুপদে না রুচে অন্ন জল।
কেমনে মারিব চিন্তে দ্রোণ মহাবল।।
এই ত ভাবনা বিনা অন্য নাহি মন।
সদা গঙ্গাতীরে রাজা করেন ভ্রমণ।।
যাজ উপযাজ নামে দুই সহোদর।
বেদেতে বিখ্যাত দোঁহে ব্রাহ্মণ কোঙর।।
উপযাজে দ্রুপদ দেখিল এক দিনে।
বহু পূজা ভক্তি কৈল তাঁহার চরণে।।
বিনয়-মধুর ভাষে যুড়ি দুই কর।
উপযাজ প্রতি বলে পাঞ্চাল-ঈশ্বর।।
দশ কোটি ধেনু দিব অসংখ্য সুবর্ণ।
যাহা চাহ দিব আমি করি মনঃপূর্ণ।।
মম ইষ্টকর্ম্ম এই শুন মহাশয়।
দ্রোণ নামে আছে ভরদ্বাজের তনয়।।
অস্ত্রধারী তার তুল্য নাহি ক্ষিতিমাঝে।
পৃথিবীতে নাহি হেন তার সনে যুঝে।।
দ্বিতীয় পরশুরাম সম পরাক্রমে।
হেন বুদ্ধি কর, তারে জিনি যে সংগ্রামে।।
ক্ষত্রের অজেয় শক্তি হৈয়াছে তাহার।
তপ মন্ত্রবলে তার কর প্রতিকার।।
হেন যজ্ঞ কর, হয় আমার নন্দন।
তার ভুজবলে দ্রোণ হইবে নিধন।।
উপযাজ বলে মম এই যুক্তি লয়।
ব্রাহ্মণের বধ-কর্ম্ম উচিত না হয়।।
দ্বিজের এতেক বাক্য শুনিয়া রাজন।
পুনঃ বহু স্তুতি করি বলিল বচন।।
দ্রুপদের বিনয় দেখিয়া দ্বিজবর।
প্রসন্ন হইয়া বলে, শুন দণ্ডধর।।
মম জ্যেষ্ঠ ভাই যাজ পরম তপস্বী।
বেদেতে পারগ, সদা অরণ্য-নিবাসী।।
প্রার্থনা তাঁহার স্থানে করহ রাজন।
তিনি করিবেন তব দুঃখ-বিমোচন।।
উপযাজ-বাক্যে গেল যাজের সদন।
প্রণমিয়া সকল করিল নিবেদন।।
সদয় হইয়া যাজ করিল স্বীকার।
যজ্ঞ আরম্ভিল তবে পৃষত কুমার।।
রাণী সহ ব্রত আচরিল নরবর।
যজ্ঞ-পূর্ণ দিতে জন্ম হইল কোঙর।।
অগ্নিবর্ণ হৈল বীর, হাতে ধনুঃশর।
অঙ্গেতে কবচন ধরে, মাথায় টোপর।।
সব্যহস্তে ধরে খড়্গ লোকে ভয়ঙ্কর।
পুত্র দেখি আনন্দিত পাঞ্চাল-ঈশ্বর।।
তবে সেই যজ্ঞমধ্যে কন্যার উৎপত্তি।
জন্মমাত্রে দশদিক করে মহাদ্যুতি।।
নীলোৎপল-আভা অঙ্গে অমর-বর্ণিনী।
নিষ্কলঙ্ক ইন্দু- জ্যোতি পীনঘনস্তনী।।
অঙ্গের সৌরভ এক যোজন ব্যাপিত।
সুরাসুর যক্ষ রক্ষ গন্ধর্ব্ব-বাঞ্ছিত।।
পুত্র কণ্যা দুই জনে যজ্ঞেতে জন্মিল।
হেনকালে আকাশে আকাশবাণী হৈল।।
এ কন্যার জন্ম হৈল ভার নিবারণে।
ইহা হৈতে ক্ষত্র সব হইবে নিধনে।।
কুরুবংশ ক্ষয় হবে এই কন্যা হৈতে।
এই পুত্র জন্ম হৈল দ্রোণ বিনাশিতে।।
এতেক আকাশবাণী শুনি সর্ব্বজন।
জয় জয় শব্দ কৈল পাঞ্চালের গণ।।
যত বীর যোদ্ধাগণ ছাড়ে সিংহনাদ।
আনন্দে দ্রুপদ রাজ ত্যজিল বিষাদ।।
কন্যা তনয়ের নাম থুইল তখন।
ধৃষ্টদ্যুন্ন বলিয়া ডাকিল সর্ব্বজন।।
কৃষ্ণ অঙ্গে কৃষ্ণা নাম থুইল নন্দিনী।
পিতৃনামে দ্রৌপদী, যজ্ঞের যাজ্ঞসেনী।।
সম্প্রতি হইবে সে কন্যার স্বয়ম্বর।
দেখিতে আইল যত রাজ-রাজ্যেশ্বর।।
দ্বিজমুখে শুনিয়া এতেক সমাচার।
যাইতে হইল চেষ্টা তথা সবাকার।।
পুত্রগণ-চিত্ত জানি ভোজের নন্দিনী।
সবাকার প্রতি দেবী কহেন আপনি।।
বহুদিন করিলাম এস্থানে বসতি।
একস্থানে বহুদিন নাহি শোভে স্থিতি।।
পূর্ব্বমত ভিক্ষা ইথে না মিলে এখন।
বড় দয়াবন্ত শুনি পাঞ্চাল রাজন।।
চল যাব তথাকারে যদি লয় মন।
শুনিয়া স্বীকার করিলেন ভ্রাতৃগণ।।
পুত্র সহ কুন্তীদেবী করেন বিচার।
হেনকালে আইলেন ব্যাস সদাচার।।
প্রণাম করেন তাঁরে ভোজের নন্দিনী।
পঞ্চ ভাই প্রণমেন লোটায়ে ধরণী।।
আশীর্ব্বাদ করিলেন মুনি সবাকারে।
পরস্পর মিষ্টবাক্য হৈল শিষ্টাচারে।।
৮৪. অর্জ্জুন-অঙ্গারপর্ণ সংবাদ এবং তপতী-সংবরণোপাখ্যান
মুনি বলিলেন, শুন পঞ্চ সহোদর।
দ্রুপদ নৃপতি করে কন্যা-স্বয়ন্বর।।
পৃথিবীতে বসে যত রাজ-রাজেশ্বর।
স্বয়ম্বরে এল সবে পাঞ্চাল নগর।।
অদ্ভুত রচিল লক্ষ্য পাঞ্চালের পতি।
সে লক্ষ্য কাটিতে নাহি কাহার শকতি।।
অর্জ্জুন কাটিবে লক্ষ্য সভার মাঝার।
পাঞ্চালের কন্যা প্রাপ্তি হইবে তাহার।।
শীঘ্রগতি যাহ তথা না কর বিলম্ব।
চারিদিন হৈল স্বয়ম্বরের আরম্ভ।।
এত বলি বেদব্যাস গেলেন স্বস্থান।
কুন্তীসহ পঞ্চ ভাই করেন প্রস্থান।।
অন্তর্হিত হইলেন ব্যাস তপোধন।
উত্তরমুখেতে যান পাণ্ডু-পুত্রগণ।।
দিবানিশি চলিলেন নাহিক বিশ্রাম।
নানাদেশ নদ-নদী লঙ্ঘিলেন গ্রাম।।
আগে যান ধনঞ্জয় ঘোর রজনীতে।
অন্ধকার হেতু ধরি দেউটি করেতে।।
কত দিনে উত্তরেন জাহ্নবীর তীরে।
স্ত্রীসহ গন্ধর্ব্ব এক তথায় বিহরে।।
পাণ্ডবের শব্দ শুনি বলে ডাক দিয়া।
বড় অহঙ্কার দেখি মনুষ্য হইয়া।।
প্রয়াগ গঙ্গার মধ্যে আমার আশ্রয়।
রাত্রিকালে আসি জীয়ে, কে হেন আছয়।।
যক্ষ রক্ষ রাক্ষস পিশাচ ভূতগণ।
নিশাকালে অধিকারী এই সব জন।।
বিশেষে অঙ্গারপূর্ণ নাম মোর খ্যাত।
নিশ্চয় আমার হাতে হইবে নিপতি।।
পার্থ বলিলেন, শাস্ত্র না জান দুর্ম্মতি।
জাহ্নবীর জলে স্থানে কিবা দিবা রাতি।।
অকাল হইল তাহে, কিবা আসে যায়।
তোর কাছে যে দুর্ব্বল, সে তোরে ডরায়।।
গঙ্গার মহিমা না জানহ মূঢ়মতি।
স্বর্গেতে অলকানন্দা, ভূমে ভাগীরথী।।
পিতৃলোকে বৈতরণী, অধো ভাগীরথী।
অকাল-সুকাল নাহি, সদা লোক গতি।।
হেন গঙ্গাস্নান রুদ্ধ করহ অজ্ঞান।
ইহার উচিত ফল পাবে মম স্থান।।
অর্জ্জুনের বাক্যে কোপে গন্ধর্ব্ব-ঈশ্বর।
ধনু টঙ্কারিয়া এড়ে সর্পময় শর।।
হাতেতে উলকা ছিল, ইন্দ্রের নন্দন।
তাহে করিলেন তার অস্ত্র নিবারণ।।
ডাকিয়া বলেন পার্থ, শুন রে গন্ধর্ব্ব।
এই অস্ত্র বলেতে করিতেছিল গর্ব্ব।।
তোর বাণ লইব তোমার আজি প্রাণ।
পূর্ব্বে দ্রোণাচার্য্য অস্ত্র দিলেন আমারে।
এড়িলাম অস্ত্র, এই রাখ আপনারে।।
এত বলি এড়িলেন অস্ত্র ধনঞ্জয়।
গন্ধর্ব্বের রথ পুড়ি হৈল ভস্মময়।।
পলায় গন্ধর্ব্বপতি রণে ভঙ্গ দিয়া।
পাছে পাছে অর্জ্জুন ধরেন চুলে গিয়া।।
স্বামীর দেখিয়া হেন সঙ্কট সময়।
নারীগণ গেলা যথা ধর্ম্মের তনয়।।
গন্ধর্ব্বের ভার্য্যা কুম্ভনসী নাম ধরে।
যুধিষ্ঠির পায়ে ধরি বিনয় সে করে।।
সাধুজন-শ্রেষ্ঠ তুমি ধর্ম্ম-অবতার।
তোমার আশ্রয়ে দুঃখ খণ্ডে সবাকার।।
পরম সঙ্কট হৈতে মোরে কর ত্রাণ।
সহস্র সতীনে মোর স্বামী দেহ দান।।
কামিনীর ক্রন্দন শুনিয়া পাণ্ডুপতি।
অর্জ্জুনে করেন আজ্ঞা, ছাড় শীঘ্রগতি।।
ধর্ম্মের পাইয়া আজ্ঞা ছাড়েন অর্জ্জুন।
গন্ধর্ব্ব বলয়ে তবে বিনয় বচন।।
মোরে প্রাণদান যদি দিলা মহাশয়।
করিব তোমার প্রীতি, উচিত যে হয়।।
অদ্ভুত চাক্ষুসী বিদ্যা আছে মোর স্থানে।
এ বিদ্যা জানিলে লোক জানে সর্ব্বজনে।।
মনু পূর্ব্বে এই বিদ্যা দিলেন চন্দ্রেরে।
বিশ্বাবসু চন্দ্র-স্থানে, সে দিল আমারে।।
মনুষ্য-অধিক আমি সেই বিদ্যা হৈতে।
সেই বিদ্যা দিব আমি তোমার প্রীতিতে।।
ভাই প্রতি শত অশ্ব দিব আনি আর।
সেই অশ্ব শ্রান্ত নহে ভ্রমিলে সংসার।।
পূর্ব্বে ইন্দ্র বৃত্রাসুরে বজ্র প্রহারিল।
অসুরের মুণ্ডে বজ্র শতখান হৈল।।
স্থানে স্থানে সেই বজ্র কৈল নিয়োজন।
সবা হৈতে শ্রেষ্ঠ বজ্র ব্রাহ্মণ-বচন।।
শূদ্রগণ কর্ম্ম করে, বজ্র তার সেহি।
বৈশ্যগণ দান করে, বজ্র তারে কহি।।
ক্ষত্রিয় থুইল বিদ্যা রথের বাজিতে।
সে কারণে দিব অশ্ব তোমার সে হিতে।।
অর্জ্জুন বলেন, তুমি হারিলা সমরে।
তব স্থানে লব অস্ত্র , না শোভে আমারে।।
গন্ধর্ব্ব বলিল, যাতে সর্ব্বলোকে জানে।
হেন বিদ্যা জানি, তুমি ত্যজ কি কারণে।।
অর্জ্জুন বলেন, আমি জানিনু সকল।
ভয় পেয়ে এতেক বিনয় কেন বল।।
গন্ধর্ব্ব বলেন, আমি জানি যে তোমারে।
তপতী হইতে জন্ম বিখ্যাত সংসারে।।
তোমার পুরুষকার জানি ভালমতে।
গুরু দ্রোণ জানি, তিনি খ্যাত ত্রিজগতে।।
তবু রুষিলাম রাত্রে, আমার বিষয়।
বিশেষ স্ত্রীসহ মোর ক্রীড়ার সময়।।
স্ত্রীসহিত ক্রীড়াতে অবজ্ঞা যেবা করে।
বলবান নাহি বুঝি রুদ্ধ করি তারে।।
অনাহূত অনাগ্নেয় যেই দ্বিজগণ।
তাহারে করি যে বদ্ধ নিশার কারণ।।
আর যত জাতি আমি পাই নিশাকালে।
অবশ্য সংহার তার শোর শরানলে।।
পুরোহিত কিম্বা দ্বিজ সঙ্গেতে করিয়া।
গৃহ হৈতে বাহিরায় দেবতা স্মরিয়া।।
সর্ব্বত্র মঙ্গল তার যথাকারে যায়।
তাহাতে নাহিক শক্তি হিংসতে আমায়।।
জিতেন্দ্রিয় ধার্ম্মিক তোমরা পঞ্চজন।
আমারে জিনিতে শক্ত হৈলা সে কারণ।।
মোর বাক্য তাপত্য শুনহ এইক্ষণে।
সকল নিষ্ফল পুরোহিতের কারণে।।
আপন মঙ্গল বাঞ্ছা করে যেই জন।
কভু না লঙ্ঘিবে পুরোহিতের বচন।।
সহজেতে পুরোহিত সদা হিতকারী।
পুরোহিত ভজি ইন্দ্র স্বর্গ অধিকারী।।
অর্জ্জুন বলেন, শুন বলি যে তোমারে।
তাপত্য বলিয়া কেন বলিলা আমারে।।
জননী আমার কুন্তী আছেন সংহতি।
তাপত্য বলিলা কেন, কেবা সে তপতী।।
গন্ধর্ব্ব বলিল, শুন ইহার কারণ।
তব পূর্ব্ববংশ-কথা শুন দিয়া মন।।
এইত সূর্য্যের কন্যা হইল তপতী।
ত্রৈলোক্যতে তাঁর সমা নাহি রূপবতী।।
যৌবন সময়ে তাঁরে দেখি দিনকর।
চিন্তিলেন নাহি দেখি কন্যা- যোগ্য বর।।
তোমার উপর বংশে রাজা সম্বরণ।
নিরবধি করিলেন সূর্য্যের সেবন।।
উপবাস নিয়ম করেন চিরকাল।
তাহাতে হলেন তুষ্ট দেব লোকপাল।।
সূর্য্যের সেবায় সম্বরণ মহারাজা।
রূপে অনুপম হৈল বলে মহাতেজা।।
তাঁর রূপগুণে তুষ্ট হৈল বলে মহাতেজা।।
তাঁর রূপগুণে তুষ্ট হৈল দিনকর।
মনে চিন্তা কৈল তপতীর যোগ্যবর।।
তবে কতদিনে সম্বরণ নৃপবর।
মৃগয়া করিতে গেল অরণ্য ভিতর।।
একা অশ্বে চড়িয়া ভ্রময়ে বনে বনে।
বহু শ্রমে অশ্ব মরে জলের বিহনে।।
অশ্বহীন পদব্রজে ভ্রমে নরবর।
দিক্ জানিবারে উঠে পর্ব্বত উপর।।
পর্ব্বত উপরে দেখে কন্যা নিরুপমা।
বিদ্যুতের পুঞ্জ, কিবা কাঞ্চন প্রতিমা।।
কন্যার রূপের তেজে দীপ্ত করে গিরি।
দেখিয়া নৃপতি চিন্তে আপনা পাসরি।।
সফল আমার জন্ম, বলে নৃপবর।
হেন রূপ দেখিলাম চক্ষুর গোচর।।
পূর্ব্বেতে নৃপতি যত দেখিল স্ত্রীগণে।
সবাকারে নিন্দা রাজা করে নিজ মনে।।
ত্রিভুবন রূপ কিবা বিধাতা মথিল।
সবাকার শ্রেষ্ঠ করি ইহারে নির্ম্মিল।।
স্থির করি কায় রাজা করে নিরীক্ষণ।
চিত্তের পুত্তলি প্রায় হইল রাজন।।
কতক্ষণে নৃপতি মধুর মৃদুভাষে।
মদনে পীড়িত হৈয়া গেল কন্যাপাশে।।
রাজা বলে, কহ শুনি মন্মথমোহিনী।
নির্জ্জন কাননে কেন আছ একাকিনী।।
রাতুল চরণ কিবা যুগ-পদ্ম-রম্ভা চারু।
তাহাতে স্থাপন তব যুগ্ম রম্ভা ঊরু।।
নিতম্ব কুঞ্জর কুম্ভ, কটিদেশ সরু।
নয়ন খঞ্জন যুগ কামচাপ-ভুরু।।
অতুল-যুগল কুচ কন্দর্প কলস।
ভুজঙ্গ-যুগল ভুজ, জঘন সরস।।
অনিন্দিত-অঙ্গ কন্যা! দেখিয়া তোমার।
পরশিতে বাঞ্ছা করে রত্ন-অলঙ্কার।।
কেবা তুমি দেবকন্যা অথবা অপ্সরী।
নাগিনী মানুষী কিবা, হবে বা কিন্নরী।।
কত দেখিয়াছি চক্ষে শুনিয়াছি কাণে।
হে হেন অপূর্ব্বরূপ লোকে নাহি জানে।।
কে তুমি, কাহার কন্যা, কহ শশিমুখি।
কি হেতু পর্ব্বত মধ্যে আছহ একাকী।।
চাতকের প্রায় মম কর্ণ করে আশা।
তৃপ্ত কর কর্ণ মম কহি এক ভাষা।।
বিবিধ বিনয় করি ভূপতি কহিল।
কিছু না বলিয়া কন্যা অন্তর্দ্ধান হৈল।।
মেঘের উপরে যেন বিদ্যুৎ লুকায়।
উন্মত্ত হইয়া রাজা চারিদিকে চায়।।
কন্যা না দেখিয়া রাজা হৈল অচেতন।
ভূমে গড়াগড়ি যায় রাজা সম্বরণ।।
অন্তরীক্ষে থাকি তাহা তপতী দেখিল।
ডাক দিয়া তপতী সে রাজারে বলিল।।
কি কারণে অচেতন হৈলা নৃপবর।
উঠহ নৃপতি তুমি যাহ নিজ ঘর।।
কন্যার এতেক বাক্য শুনিয়া রাজন।
মৃত-কলেবরে যেন পাইল চেতন।।
চেতন পাইয়া রাজা ঊর্দ্ধমুখে চায়।
অন্তরীক্ষে দেখে কন্যা বিদ্যুতের প্রায়।।
রাজা বলে, কামশরে হানিল শরীর।
ইচ্ছা করি ধৈর্য্য ধরি চিত্ত নহে স্থির।।
তোমার বদন দেখি অন্য নাহি মনে।
গরলে ব্যাপিল যেন ভুজঙ্গ দংশনে।।
তোমা বিনা অন্যে দেখি রাখিব জীবন।
কদাচিৎ নহে হেন অবশ্য মরণ।।
পাইলাম প্রাণ শুনি তোমার বচন।
অনুগ্রহ কৈলা মোরে যেন লয় মন।।
মোর প্রতি দয়া যদি হইল তোমার।
আলিঙ্গন দিয়া প্রাণ রাখহ আমার।।
কন্যা বলে, নরপতি এ নহে বিচার।
প্রার্থনা পিতার স্থানে করহ আমার।।
পরিচয় আমার শুনহ নরপতি।
সূর্য্যকন্যা আমি, নাম ধরি যে তপতী।।
তপঃক্লেশ ব্রত কর, সূর্য্য-আরাধন।
সূর্য্য দিলে আমারে সে পাইবা রাজন।।
এত বলি তপতী হইল অন্তর্ধান।
পুনঃ পড়ে নরপতি হইয়া অজ্ঞান।।
হেথা রাজমন্ত্রী সব সৈন্যগণ লৈয়া।
ভ্রমিল সকল বন রাজা না দেখিয়া।।
পর্ব্বত উপরে তবে দেখে নরবর।
পড়িয়াছে অজ্ঞান মোহিত কলেবর।।
শীতল সলিল অঙ্গে সিঞ্চে মন্ত্রিগণ।
ধরি বসাইল তবে করিয়া যতন।।
চৈতন্য পাইয়া রাজা চারিদিকে চায়।
মন্ত্রিগণ দেখি কিছু না বলিল রায়।।
কন্যার ভাবনা বিনা অন্য নাহি মনে।
বিদায় করিল রাজা সব সৈন্যগণে।।
রাজা বৃদ্ধমন্ত্রী এক রাখিল সংহতি।
সূর্য্যের উদ্দেশে তপ করে নরপতি।।
ঊর্দ্ধপদে অধোমুখে সদা উপবাসে।
একচিত্তে তপ করে সূর্য্যের উদ্দেশে।।
তবে চিত্তে অনুমানি রাজা সম্বরণ।
পুরোহিত বশিষ্ঠেরে করিল স্মরণ।।
আইল বশিষ্ঠ মুনি রাজার স্মরণে।
রাজার দেখিয়া ক্লেশ চিন্তে মুনি মনে।।
তপতী কারণে তপ তপন-সেবন।
জানি মুনিরাজ চিত্তে ভাবিল তখন।।
অন্তরীক্ষে উঠি গেল আকাশ-মণ্ডল।
দ্বিতীয় ভাস্কর তেজ যাঁর তপোবল।।
কৃতাঞ্জলি করি সূর্য্যে করিল প্রণাম।
সবিনয়ে জানাইল আপনার নাম।।
ভাস্কর বলেন, মুনি কহ সমাচার।
কোন্ প্রয়োজনে এলে আলয়ে আমার।।
কোন্ কার্য্যে অভিলাষ বলহ আমারে।
দুষ্কর হইলে তবু তুষিব তোমারে।।
প্রণমিয়া বশিষ্ঠ কহেন পুনর্ব্বার।
মম এই নিবেদন তোমার গোচর।।
ভারত-বশের রাজা নাম সম্বরণ।
রূপে গুণে অনুপম বিখ্যাত ভুবন।।
তোমার ভজনে রাজা বড় অনুরত।
তাহার বরণ হেতু তোমার অনুগত।।
তপতী নামেতে সেই সাবিত্রী তনুজা।
অযোগ্য না হয় রাজা উর্ব্বীতে প্রধান।
এই হেতু, যেই আজ্ঞা করহ বিধান।।
ভাস্কর বলেন, তুমি মুনিতে প্রধান।
নাহি কেহ ক্ষত্রেতে সম্বরণ সমান।।
তপতী সমান কন্যা নাহিক তুলনা।
তিন স্থানে শ্রেষ্ঠ যে তোমরা তিনজনা।।
তোমার বচন আমি না করিব আন।
তপতী কন্যারে দিব সম্বরণে দান।।
এত বলি কন্যা লৈয়া কৈল সমর্পণ।
কন্যা লৈয়া মুনিরাজ করিল গমন।।
তপতী দেখিয়া তপ ত্যজি নৃপবর।
বশিষ্ঠকে স্তব করে করি যোড় কর।।
তবে ঋষি দোঁহারে বিবাহ করাইল।
রাজারে রাখিয়া মুনি নিজাশ্রমে গেল।।
বশিষ্ঠের লৈয়া আজ্ঞা সেই মহাবনে।
তপতী লইয়া ক্রীড়া করে সম্বরণে।।
যেই বৃদ্ধমন্ত্রী ছিল রাজার সংহতি।
তাঁরে রাজ্যভার দিয়া পাঠায় নৃপতি।।
বিহার করয়ে রাজা পর্ব্বত উপরে।
তপতী সহিত ক্রীড়া দ্বাদশ বৎসরে।।
হেথায় রাজার রাজ্যে অনাবৃষ্টি হৈল।
দ্বাদশ বৎসর ইন্দ্র বৃষ্টি না করিল।।
বৃক্ষ আদি যত শস্য গেল ভস্ম হৈয়া।
গাভী-অশ্ব-পক্ষী যত মরিল পুড়িয়া।।
দুর্ভিক্ষ হইল রাজ্যে, হয় ডাকা চুরি।
একেরে না মানে অন্যে সত্য পরিহরি।।
কুটুম্ব বান্ধবগণে কেহ নাহি সয়।
সকল মনুষ্যগণ হৈল শবপ্রায়।।
হীনশক্তি স্থানে স্থানে রহিল পড়িয়া।
স্থানে স্থানে অস্থিপুঞ্জ পর্ব্বত জুড়িয়া।।
হাহাকার রব বিনা অন্য নাহি শুনি।
দেশান্তরে গেল লোক পরমাদ গণি।।
রাজ্যের এতেক কষ্ট রাজা নাহি জানে।
আইলেন বশিষ্ঠ সে দেশে কতদিনে।।
রাজ্যভঙ্গ দেখিয়া চিন্তিত মুনিবর।
রাজারে আনিতে যান পর্ব্বত উপর।।
বার্ত্তা পেয়ে অনুতাপ করিল রাজন।
তপতী সহিত দেশে করিল গমন।।
দেশে আসি যজ্ঞ দান করে নৃপবর।
তবে বৃষ্টি করিলেন দেব পুরন্দর।।
পুনঃ শস্য জন্মিল, সানন্দ প্রজাগণ।
পূর্ব্বমত রাজ্য পুনঃ কৈল সম্বরণ।।
তপতী সহিত ক্রীড়া করে চিরকাল।
তপতীর গর্ভে হৈল কুরু মহীপাল।।
কুরুর যতেক কর্ম্ম না যায় লিখন।
কুরুবংশ নাম খ্যাত হৈল সে কারণ।।
পুরোহিত বশিষ্ঠের সাহায্য কারণ।
পাইলেন ধর্ম্ম অর্থ কাম সম্বরণ।।
তপতীর গর্ভজাত কুরু নরবর।
তোমরা যাহার বংশে পঞ্চ সহোদর।।
তাপত্য বলিয়া তাই বলি যে তোমারে।
পূর্ব্ববংশ-কথা এই খ্যাত চরাচরে।।
শুনিয়া হরিষ হৈল পার্থ ধনুর্দ্ধর।
পুনঃ জিজ্ঞাসিল কহ গন্ধর্ব্ব-ঈশ্বর।।
সম্বরণ নৃপে রক্ষা করিলেন যিনি।
কে তিনি, বশিষ্ঠ, কহ তাঁর কথা শুনি।।
গন্ধর্ব্ব বলিল, সে বিখ্যাত তপোধন।
বশিষ্ঠের গুণ কর্ম্ম না যায় কহন।।
কাম ক্রোধ জিনে হেন নাহি ত্রিভুবনে।
হেন কাম ক্রোধ সেবে মুনির চরণে।।
বিশ্বামিত্র বহু তাঁর ক্রোধ না করিল।
ইক্ষবাকু-বংশের রাজা যাঁর বুদ্ধিবলে।
নিষ্কন্টক বৈভব ভুঞ্জিল ভুমণ্ডলে।।
মহাভারতের কথা অমৃতের ধার।
কাশী কহে, শুনি ভববারি হই পার।।
০৮৫. বিশ্বামিত্র-বশিষ্ঠ-বিরোধ ও কল্মাষপাদ রাজার উপাখ্যান
জিজ্ঞাসেন ধনঞ্জয় অদ্ভুত-কথন।
বিশ্বামিত্র বশিষ্ঠে কলহ কি কারণ।।
গন্ধর্ব্ব কহিল শুন কথা পুরাতন।
কান্যকুব্জ দেশে গাধি নামেতে রাজন।।
তাঁর পুত্র বিশ্বামিত্র সর্ব্ব-গুণ-যুত।
বেদবিদ্যা বুদ্ধিবলে ভুবনে অদ্ভুত।।
এক দিন সসৈন্যেতে গাধির নন্দন।
মহাবনে প্রবেশিল মৃগয়া কারণ।।
মারিল অনেক মৃগ বনের ভিতর।
মৃগরায় শ্রান্ত বড় হৈল নৃপবর।।
ক্ষুধায় পীড়িত বড় হৈল পরিশ্রম।
ভ্রমিতে ভ্রমিতে গেল বশিষ্ঠ-আশ্রম।।
মনোহর স্থল দেখি হৈল হৃষ্টমন।
উত্তরিল যথায় বশিষ্ঠ তপোধন।।
রাজারে দেখিয়া পাদ্য-অর্ঘ্য দিয়া মুনি।
অতিথি বিধানে পূজা করিলেন তিনি।।
রাজার যতেক সৈন্য পরিশ্রান্ত দেখি।
নন্দিনী ধেনুর প্রতি বলিল যে ডাকি।।
দেখহ, রাজার সৈন্য অতিথি আমার।
যেই যাহা চাহে তোষ করহ তাহার।।
বশিষ্ঠের আজ্ঞা পেয়ে সুরভি- নন্দিনী।
সংসারে যাঁহার কর্ম্ম অদ্ভুত কাহিনী।।
হুঙ্কারে বিবিধ দ্রব্য করিল সৃজন।
চর্ব্ব- চুর্ষ্য -লেহ্য-পেয় নানা রত্নধন।।
বস্ত্র অলঙ্কার মাল্য কুসুম চন্দন।
বিচিত্র পালঙ্ক শয্যা বসিতে আসন।।
যেই যাহা মাগে, তাহা পায় ততক্ষণে।
পাইল পরমানন্দ সর্ব্ব-সৈন্যগণে।।
গবীর দেখিয়া কর্ম্ম বিস্ময় রাজন।
বশিষ্ঠ-মুনিরে বলে গাধির নন্দন।।
এই গবী মুনিরাজ দান কর মোরে।
এক কোটি গবী দিব স্বর্ণ মণ্ডি খুরে।।
নতুবা সকল রাজ্য লহ তপোধন।
হস্তী অশ্ব পদাতিক যত সৈন্যগণ।।
বশিষ্ঠ বলেন, নাহি দিতে পারি দান।
দেবতা অতিথি হেতু আছে মম স্থান।।
রাজা বলে, মুনি তুমি জাতিতে ব্রাহ্মণ।
ব্রাহ্মণের হেন দ্রব্যে নাহি প্রয়োজন।।
হেন দ্রব্য মুনিবর রাজাকে যে সাজে।
কি করিবা তুমি ইহা, থাক বন মাঝে।।
গবী নাহি দিবে, যদি আপন ইচ্ছায়।
নিশ্বয় লইব গবী, জানাই তোমায়।।
মাগিলে না দিবে গবী, লৈয়া যাব বলে।
ক্ষত্র-কর্ম্ম আমার, লইব বলে ছলে।।
বশিষ্ঠ বলেন, তুমি অধিকারী দেশে।
বলিষ্ঠ ক্ষত্রিয়-সৈন্য সহায় বিশেষে।।
যাহা ইচ্ছা কর শীঘ্র না কর বিচার।
সহজে তবস্বী দ্বিজ, কি শক্তি আমার।।
শুনি বিশ্বামিত্র বলে, শুন সৈন্যগণ।
কামধেনু লয়ে চল করিয়া বন্ধন।।
শুনি যত সৈন্যগণ গলে দিল দড়ি।
চালাইল কামধেনু, পাছে মারে বাড়ি।।
প্রহারে পড়িল গবী তবু নাহি যায়।
ক্ষুব্ধমুখে সজলাক্ষে মুনিপানে চায়।।
মুনি বলে, নন্দিনী কি চাহ মম ভিতে।
তোমার যতেক কষ্ট দেখেছি চক্ষেতে।।
তপস্বী ব্রাহ্মণ আমি কি করিতে পারি।
বলে তোমা লয়ে যায় রাজ্য-অধিকারী।।
তবে রাজ-সৈন্যগণ বৎসকে ধরিয়া।
আগে লৈয়া যায় তারে গলে দড়ি দিয়া।।
বৎসকে ধরিয়া লয়, কান্দয়ে নন্দিনী।
ডাক দিয়া বলে দেখ হের মহামুনি।।
উপরোধ না মানিল যদি দুষ্ট লোকে।
কি করিব মুনি, আজ্ঞা করহ আমাকে।।
মুনি বলে, আমি তোমা ত্যাগ নাহি করি।
বলে লৈয়া যায় রাজা কি করিতে পারি।।
নিজ শক্তিবলে যদি পার রহিবারে।
তবে সে রহিতে পার, কি কব তোমারে।।
মুনিরাজ মুখে যদি এতেক শুনিল।
অতি ক্রোধে ভয়ঙ্কর তনু বাড়াইল।।
ঊর্দ্ধপুচ্ছ করি গবী হাম্বারবে ডাকে।
নানাজাতি সৈন্য বাহিরায় লাখে লাখে।।
পহ্লব নামেতে জাতি, নানা অস্ত্র হাতে।
পুচ্ছ হৈতে বাহির হইল আচম্বিতে।।
মূত্রেতে পাইল জ্ন্ম বহু বাধ্যগণ।
দুই পার্শ্বে জন্ম নিল কিরাত যবন।।
জন্মিল অনেক সৈন্য মুখের ফেণাতে।
নানাজাতি ম্লেচ্ছ হৈল চারি পদ হৈতে।।
নানা অস্ত্র লইয়া ধাইল সর্ব্বজন।
দুই সৈন্যে দেখাদেখি, হৈল মহারণ।।
বিশ্বামিত্র-সৈন্যগণ যতেক আছিল।
একজন প্রতি তার পঞ্চজন হৈল।।
সহিতে না পারি রণ বিশ্বামিত্র-সেনা।
রাজ-বিদ্যামান ভঙ্গ দিল সর্ব্বজনা।।
পড়িল অনেক সৈন্য, রক্তে বহে নদী।
মুনি-সৈন্য রাজ-সৈন্য পাছে যায় খেদি।।
পলায় সকল সৈন্য পাছে নাহি চায়।
সর্ব্বসৈন্য বিশ্বামিত্র পাছে খেদি যায়।।
বনেরে বাহির করি গাধির কুমারে।
বাহুড়িয়া সৈন্যগণ প্রণমে মুনিরে।।
তবে বিশ্বামিত্র বড় মনে অভিমান।
মুনির নিকটে এত পাই অপমান।।
অদ্ভুত দেখিয়া কর্ম্ম মনে মনে গণে।
সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ জানিনু এতক্ষণে।।
ধিক্ ক্ষত্রজাতি, মম ধিক্ রাজপদে।
একই তপস্বী দ্বিজে না পারি বিবাদে।।
এ জন্ম রাখিয়া আর কোন্ প্রয়োজন।
তপস্যা করিয়া আমি হইব ব্রাহ্মণ।।
ব্রাহ্মণ হইব কিম্বা যায় যাক্ প্রাণ।
এত চিন্তি বিশ্বামিত্র করে সম্বিধান।।
দেশে পাঠাইয়া দিল সর্ব্ব-সৈন্যগণে।
তপস্যা করিতে গেল গহন কাননে।।
বিশ্বামিত্র-তপ-কথা অদ্ভুত কথন।
যাঁর তপে তাপিত হইল ত্রিভুবন।।
গ্রীষ্মকালে চতুর্দ্দিকে জ্বালি হুতাশন।
ঊর্দ্ধপদে তার মধ্যে থাকেন রাজন।।
নাকে মুখে রক্ত বহে, ঘোর দরশন।
অস্থি-চর্ম্ম-সার মাত্র আহার পবন।।
বরিষা-কালেতে যথা সদাই বরিষে।
যোগাসন করি রাজা তথাই নিবসে।।
অহর্নিশি জলধারা বরিষে উপর।
স্থাবর সদৃশ হৈয়া থাকে নৃপবর।।
শীতকালে হীনবস্ত্র হৈয়া নিরাশ্রয়।
হেমন্ত-পর্ব্বতে যথা সদা বরিষয়।।
এইরূপে তপ করে সহস্র বৎসর।
তপে তুষ্ট হৈয়া ব্রহ্মা দিতে এল বর।।
ব্রহ্মা বলে, বর মাগ গাধির নন্দন।
বিশ্বামিত্র বলে, কর আমারে ব্রাহ্মণ।।
বিরিঞ্চি বলেন, তব ক্ষুন্দ্রকুলে জন্ম।
কেমনে হইবে দ্বিজ, দুষ্কর এ কর্ম্ম।।
অন্য বর চাহ তুমি, যেই লয় মন।
বিশ্বামিত্র বলে, অন্যে নাহি প্রয়োজন।।
ব্রহ্মা বলে, পরজন্মে হইবে ব্রাহ্মণ।
এক্ষণে যে চাহ, তাহা মাগহ রাজন।।
বিশ্বামিত্র বলে, আমি অন্য নাহি চাই।
কিবা প্রাণ যায় কিবা ব্রাহ্মণত্ব পাই।।
এত শুনি বিধাতা গাধির নন্দন।
পুনঃ তপ আরম্ভিল গাধির নন্দন।।
ঊর্দ্ধ দুই পদ কুর ঊর্দ্ধমুখ হৈয়া।
এক পদে অঙ্গুলিতে রহে দাণ্ডাইয়া।।
শুষ্ক কাষ্ঠ মত সে হইল নরবর।
কেবল আছয়ে প্রাণ মজ্জার ভিতর।।
তাঁর তপে মহাতাপ হৈল তিন লোক।
ইন্দ্রাদি দেবতা ভয় হইল সবাকে।।
সহিতে নারিয়া ব্রহ্মা আসি আরবার।
বলিলেন, মাগ বর গাধির কুমার।।
বিশ্বামিত্র বলে, আমি মাগিয়াছি পূর্ব্বে।
ব্রাহ্মণ করহ যদি মোরে বর দিবে।।
এড়াইতে নারিয়া সৃষ্টির অধিকারী।
বিশ্বামিত্র-গলে দেন আপন উত্তরী।।
বর দিয়া বিধাতা করিলেন গমন।
বিশ্বামিত্র-মুনি হৈল মহা-তপোধন।।
কেহ নহে তপস্যায় তাঁহার সমান।
সদা মনে জাগে বশিষ্ঠের অপমান।।
সুরাসুর নাগ নর বশিষ্ঠকে পূজে।
সুধা পান করিল সহিত দেবরাজে।।
বশিষ্ঠের অপমান সদা জাগে মনে।
বশিষ্ঠের ছিদ্র খুঁজি ভ্রমে অনুক্ষণে।।
ইক্ষবাকু, বংশেতে রাজা সর্ব্ব-গুণধাম।
সংসারেতে বিখ্যাত কল্মাষপাদ নাম।।
মহামুনি বশিষ্ঠ তাঁহার পুরোহিত।
যজ্ঞহেতু তাঁহারে করিল নিমন্ত্রিত।।
বশিষ্ঠ বলেন, কিছু আছে প্রয়োজন।
রাজা বলে, যজ্ঞ আমি করিব এক্ষণ।।
মুনি না আইল, রাজা হৈল ক্রোধ মন।
বিশ্বামিত্রে যজ্ঞ হেতু কৈল নিমন্ত্রণ।।
বিশ্বামিত্র লৈয়া সঙ্গে আইসে রাজন।
পথেতে ভেটিল শক্তি বশিষ্ঠ-নন্দন।।
রাজা বলে পথ ছাড়ি দেহ মুনিবর।
শক্তি বলে, মোরে পথ দেহ নরেশ্বর।।
রাজা বলে, রাজপথ জানে সর্ব্বজন।
পথ ছাড় যাব আমি যজ্ঞের কারণ।।
শক্তি বলে, দ্বিজ-পথ বেদের বিহিত।
পথ ছাড়ি দেহ মোরে যাইব ত্বরিত।।
এইমতে বোলাবুলি হৈল দুই জন।
কেহ না ছাড়িল পথ, কুপিল রাজন।।
হাতেতে প্রবোধ-বাড়ি আছিল রাজার।
ক্রোদে মুনি-অঙ্গে রাজা করিল প্রহার।।
প্রহারে জর্জ্জর শক্তি, রক্ত পড়ে ধারে।
ক্রোধ-চক্ষে চাহিয়া বলিল নৃপবরে।।
উত্তম বংশেতে জন্মি করিস্ অনীতি।
ব্রাহ্মণের হিংসা তুই করিস্ দুর্ম্মতি।।
এই পাপে মম শাপে হও নিশাচর।
মনুষ্যের মাংসে তোর পূরুক উদর।।
শাপ শুনি ভীত হৈল সৌদাস-নন্দন।
কৃতাঞ্জলি করি বলে বিনয় বচন।।
হেনকালে বিশ্বামিত্র পেয়ে অবসর।
রাজ-অঙ্গে নিয়োজিল এক নিশাচর।।
রাক্ষস-শরীর হৈল, রাজা হতজ্ঞান।
দেখি বিশ্বামিত্র-মুনি হৈল অন্তর্ধান।।
সম্মুখে পাইয়া শক্তি ধরিল রাজন।
ব্যাগ্য যেন পশু ধরি করয়ে ভক্ষণ।।
মোরে শাপ দিলা দুষ্ট, ভুঞ্জ তার ফল।
বধিয়া ঘাড়ের রক্ত খাইল সকল।।
শক্তি কে খাইয়া মূর্ত্তি হৈল ভয়ঙ্কর।
উন্মত্ত হইয়া ভ্রমে বনের ভিতর।।
দেখি বিশ্বামিত্র-মুনি ভাবিল অন্তর।
রাক্ষস লইয়া সঙ্গে গেল মুনিবর।।
যথা আছে বশিষ্ঠের শতেক কুমার।
কাল পেয়ে বিশ্বামিত্র দেয় ফল তার।।
একে একে দেখাইয়া সর্ব্বজনে দিল।
রাক্ষস সবারে ধরি ভক্ষণ করিল।।
বশিষ্ঠ আসিয়া গৃহে দেখে শূন্যময়।
শতপুত্র না দেখিয়া হইল বিস্ময়।।
ধ্যানেতে জানিল যত বিশ্বামিত্র কৈল।
শক্তি সহ শত পুত্র রাক্ষসে ভক্ষিল।।
শতপুত্র-শোকে তাঁর দহয়ে শরীর।
অতি ধৈর্য্যবন্ত তবু হইল অস্থির।।
আপনার মরণ বাঞ্ছিয়া মুনিবর।
শোকানলে প্রবেশিল সমুদ্র-ভিতর।।
সমুদ্র দেখিয়া তাঁরে রাখি গেল কূলে।
মরণ না হইল যদি সমুদ্রের জলে।।
অত্যুচ্চ পর্ব্বতে গিয়া উঠিল সে মুনি।
তথা হৈতে শোকাকুল পড়িল ধরণী।।
বিংশতি সহস্র ক্রোশ উচ্চ হৈতে পড়ি।
তুলারাশি পরে মুনি যায় গড়াগড়ি।।
তাহাতে নহিল মৃত্য, চিন্তে মুনিরাজ।
প্রবেশ করিল গিয়া অনলের মাঝ।।
যোজন প্রসর অগ্নি পরশে আকাশে।
শীতল হইলা অগ্নি মুনির পরশে।।
তবে মুনি প্রবেশিল অরণ্য ভিতর।
নানা পশু ব্যাঘ্র হস্তী ভল্লুক শূকর।।
বশিষ্ঠে দেখিয়া সবে পলাইয়া যায়।
হেনমতে কৈল মুনি অনেক উপায়।।
মরণ নহিল, মুনি ভ্রমিল সংসার।
কত দিনে আসে মুনি গৃহ আপনার।।
একশত পুত্র নাই দেখি মুনিবর।
পুত্র শোকে অবশ হইল কলেবর।।
চতুর্দ্দিকে অনুক্ষণ বেদ-অধ্যয়ন।
নানা শাস্ত্র পঠন করিত পুত্রগণ।।
এ সব চিন্তিয়া মুনি অধিক তাপিত।
গৃহমধ্যে প্রবেশিতে নাহি লয় চিত।।
পুনরপি বশিষ্ঠ চলিল দেশান্তর।
মরিতে উপায় মুনি করে নিরন্তর।।
দেখিল একটি নদী অত্যন্ত গভীর।
ভয়ঙ্কর লক্ষ লক্ষ আছয়ে কুম্ভীর।।
তাহে পড়িবার তরে ইচ্ছা কৈল মুনি।
হেনকালে পাছু হৈতে শুনে বেদধ্বনি।।
বিস্ময় হইলা মুনি উলটিয়া চায়।
শক্তি-ভার্য্যা অদৃশ্যন্তী দেখিল তথায়।।
যোড়হাত করি বলে শক্তির বনিতা।
তোমার সংহতি প্রভু আইলাম হেথা।।
মুনি বলে, সঙ্গে আর আছে কোন্ জন।
শত শত বেদধ্বনি করে উচ্চারণ।।
শক্তির কন্ঠের প্রায় শুনিলাম স্বর।
এত শুনি বলে দেবী বিনয়ে উত্তর।।
শক্তির নন্দন আছে আমার উদরে।
দ্বাদশ বৎসর বেদ অধ্যয়ন করে।।
এত শুনি বশিষ্ঠ হইল হৃষ্টমন।
বংশ আছে শুনি নিবর্ত্তিল তপোধন।।
বধূ সঙ্গে লইয়া চলিল পুনঃ ঘর।
হেনকালে ভেটিল রাক্ষস নরবর।।
নির্জ্জন গহনবনে থাকে নিরন্তর।
বহু নর পশু খেয়ে পূরয়ে উদর।।
নৃপতি কল্মাষপাদ দেখি বশিষ্ঠেরে।
মুখ মেলি ধাইল মুনিরে গিলিবারে।।
বিপরীত মূর্ত্তি দেখি হাতে কাষ্ঠদণ্ড।
তৃতীয় প্রহরে যেন তপন প্রচণ্ড।।
নিকটে আইল মূর্ত্তি অতি ভয়ঙ্কর।
দেখি অদৃশ্যন্তী দেবী কাঁপে থর থর।।
শ্বশুরে ডাকিয়া বলে শুন মহাশয়।
মৃত্যু উপস্থিত, হের রাক্ষস দুর্জ্জয়।।
রাক্ষসের হাতে দেখি নিকট মরণ।
তোমা বিনা রাখে ইথে নাহি কোন জন।।
বশিষ্ঠ বলিল, বধূ, না করিহ ভয়।
নৃপতি কল্মাষপাদ রাক্ষস এ নয়।।
এতেক বলিতে দুষ্ট আইল নিকটে।
মুনি গিলিবারে যায় দশন বিকটে।।
মুনির হুঙ্কারেতে রহিল কতদূরে।
কমণ্ডলু-জল মুনি ফেলিল উপরে।।
রাজ-অঙ্গ হৈতে হৈল রাক্ষস বাহির।
রাহু হৈতে যেন হৈল বাহির মিহির।।
পূর্ব্বজ্ঞান হৈল, রাজা পাইল চেতন।
কৃতাঞ্জলি-পুটে করে বশিষ্ঠে স্তবন।।
অধম পাপিষ্ঠ আমি, পাপে নাহি অন্ত।
দয়া কর মুনিরাজ তুমি দয়াবন্ত।।
মুনি বলে, চলে শীঘ্র অযোধ্যা-নগরে।
কদাচিত অমান্য না করহ দ্বিজেরে।।
রাজা বলে, আজি হৈতে তোমার কিঙ্কর।
তব আজ্ঞাবর্ত্তী আমি হব নিরন্তর।।
সূর্য্যবংশে জন্ম মোর সৌদাস-নন্দন।
হেন কর মোরে, নাহি নিন্দে কোন জন।।
এত বলি নৃপবর আজ্ঞা যে পাইয়া।
অযোধ্যা-নগরে পুনঃ রাজা হৈল গিয়া।।
বধূ সহ বশিষ্ঠ আইল নিজ ঘর।
কতদিনে জন্ম হৈল মুনি পরাশর।।
পৌত্রে দেখি বশিষ্ঠের শোক নিবারিল।
অতি যত্নে মুনিরাজ বালকে পুষিল।।
শিশুকাল হৈতে পরাশর মহামুনি।
পিতা বলে বশিষ্ঠের জানে সে আপনি।।
একদিন পরাশর মায়ের গোচরে।
পিতৃ সম্বোধন করি ডাকে বশিষ্ঠেরে।।
শুনি অদৃশ্যন্তী শোক করিল প্রচুর।
রোদন করিয়া পুত্র বলেন মধুর।।
পিতৃহীন পুত্র তুমি বড় অভাগিয়া।
পিতামহে পিতা বলি ডাক কি লাগিয়া।।
যেই কালে ছিলা তুমি আমার উদরে।
তোমার জনকে বনে খায় নিশাচরে।।
মায়ের মুখেতে শুনি এতেক বচন।
বিশেষ মায়ের দেখি শোকেতে ক্রন্দন।।
ক্রোধেতে শরীর কম্পে, লোহিত লোচন।
কি করিব হৃদয়ে চিন্তিল তপোধন।।
এত বড় নিদারুণ নির্দ্দয় বিধাতা।
রাক্ষসের হাতে মোর বিনাশিল পিতা।।
আজি তার সর্ব্বসৃষ্টি করিব নিধন।
না রাখিব ত্রিলোকে তাহার একজন।।
এত যদি মনে কৈল শক্তির কুমার।
বশিষ্ঠ জানিল এ সকল সমাচার।।
মধুর বচনে তারে করেন প্রবোধ।
অকারণে শিশু তুমি কারে কর ক্রোধ।।
ব্রাহ্মণের ধর্ম্ম এই না হয় উচিত।
ক্ষমা শান্তি ব্রাহ্মণের বেদের বিহিত।।
কর্ম্ম-অনুরূপে শক্তি হইল নিধন।
তার প্রতি অনুশোচ কর অকারণ।।
কার এত শক্তি তারে মারিবারে পারে।
কর্ম্ম-অনুরূপ ফল ভুঞ্জয়ে সংসারে।।
ক্রোধ শান্তি কর বাপু তত্ত্বে দেহ মন।
অকারণ সৃষ্টি কেন করিবা নিধন।।
মহাভারতের কথা অমৃত-লহরী।
শুনিলে অধর্ম্ম ক্ষয়, পরলোকে তরি।।
৮৬. কৃতবীর্য্য-চরিত ও ভৃগুপুত্র ঔর্ব্বের বৃত্তান্ত
পূর্ব্বের বৃত্তান্ত কহি তোমার গোচর।
কৃতবীর্য্য নামে ছিল এক নরবর।।
ভৃগুবংশে ব্রাহ্মণ তাহার পুরোহিত।
নানা যজ্ঞ-ক্রিয়া রাজা কৈল অপ্রমিত।।
সর্ব্বধন দিয়া রাজা গেল স্বর্গবাসে।
ধনহীন হৈল, যেই রাজা হৈল দেশে।।
ভৃগুবংশে দ্বিজগণে আনিল ধরিয়া।
মাগিল যতেক ধন দেহ ফিরাইয়া।।
ভয়ে তবে বিপ্রগণ বলিল বচন।
যার গৃহে যত আছে, দিব সব ধন।।
এত শুনি ছাড়ি দিল সর্ব্ব দ্বিজগণে।
গৃহে আসি বিচার করিল সর্ব্বজনে।।
রাজভয়ে কোন দ্বিজ সর্ব্বধন দিল।
কেহ কেহ কত ধন পুতিয়া রাখিল।।
কত ধন দিল লৈয়া রাজার গোচর।
অল্প ধন দেখিয়া রুষিল নরবর।।
চর হইতে সন্ধান পাইল রাজন।
পুতিল ঘরের ভিতরেতে কত ধন।।
সসৈন্যেতে ঘর সব বেড়িল যে গিয়া।
বাহির করিল রেখেছিল যা পুতিয়া।।
ধন দেখি ক্রোধ কৈল যত ক্ষত্রগণ।
ব্রাহ্মণ মারিতে আজ্ঞা করিল রাজন।।
হাতে খড়্গ করিয়া যতেক রাজবল।
যতেক ব্রাহ্মণগণে কাটিল সকল।।
বাল বৃদ্ধ যুবা সর্ব্ব যতেক আছিল।
দুগ্ধপোষ্য বালকাদি সকলি মারিল।।
গভীবতী স্ত্রীগণের চিরিয়া উদর।
মারিল অনেক দ্বিজ দুষ্ট নরবর।।
মহা কলরব হৈল ব্রাহ্মণ-নগরে।
প্রাণ লইয়া স্ত্রীগণ যায় দেশান্তরে।।
এক ভৃগুপত্নী যে আছিল গর্ভবতী।
স্বামীগর্ভ রক্ষা হেতু বিচারিল সতী।।
উদর হইতে গর্ভ ঊরুতে থুইয়া।
ক্ষত্রগণ ভয়েতে যায়েন পলাইয়া।।
যতেক ক্ষত্রিয়গণ বেড়িল তাহারে।
যাইতে নহিল শক্তি পূর্ণ গর্ভ-ভরে।।
মহাভয়ে প্রসব হইল সেই খানে।
শত সূর্য্য প্রায় তেজ ধরয়ে নন্দনে।।
দৃষ্টিমাত্র ক্ষত্রগণ সব অন্ধ হৈল।
কত কত ক্ষত্রগণ ভস্ম হৈয়া গেল।।
যোড়হাতে স্তুতি বহু বিনয় বচন।।
পুত্রে কহি ব্রাহ্মণী সবারে চক্ষু দিল।
প্রাণ লৈয়া ক্ষত্রগণ পলাইয়া গেল।।
পিতৃপিতামহ সর্ব্ব হইল সংহার।
মহাক্রুদ্ধ হৈল শুনি ভৃগুর কুমার।।
মহাদুষ্ট ক্ষত্রগণ কৈল অবিচার।
অনাথের প্রায় দ্বিজ করিল সংহার।।
বিধাতার দৃষ্ট কর্ম্ম জানিনু এখন।
এই হেতু বিনাশ করিব ত্রিভুবন।।
এত চিন্তি তপস্যা যে করে মুনিবর।
অনাহারে তপ ষষ্টি হাজার বৎসর।।
তাঁর তপে তাপিত হইল ত্রিভুবন।
হাহাকার কলরব সবে সর্ব্বজন।।
দেবগণ মিলি যুক্তি করিল তখন।
নিবারণ হেতু পাঠাইল পিতৃগণ।।
ঔর্ব্ব প্রতি পিতৃগণ বলিল বচন।
এত ক্রোধ কর বাপু কিসের কারণ।।
আমা সবা হেতু দুঃখ ভাবহ অন্তরে।
আমা সবা মারিবারে কার শক্তি পারে।।
কাল উপস্থিত হৈল কর্ম্মের লিখন।
সে কারণে ক্ষত্র করে হইল মরণ।।
আপনার মনে জানি ক্ষমা করি মনে।
হীনকর্ম্মে হীনতাপী নহে কোন জনে।।
শম তপ ক্ষমা এই ব্রাহ্মণের ধর্ম্ম।
আমা সবা না রুচে তোমার ক্রোধ-কর্ম্ম।।
পিতৃগণ-বচন শুনিয়া ঔর্ব্বমুনি।
কহেন, কহিলা যত আমি সব জানি।।
পূর্ব্বে আমি ক্রোধে করিলাম অঙ্গীকার।
তপস্যা করিয়া সৃষ্টি করিব সংহার।।
বিশেষ ক্ষত্রিয়গণ কৈল দুরাচার।
দুষ্টে শাস্তি না করিলে মজিবে সংসার।।
দুষ্ট লোকে সম শাস্তি যদি নাহি পায়।
সংসারে যতেক লোক সেই পথে যায়।।
অপ্রমিত কুকর্ম্ম করিল ক্ষত্রগণ।
অল্পদোষে বিনাশিল অনেক ব্রাহ্মণ।।
যখন ছিলাম আমি জননী-উদরে।
ক্ষত্রভয়ে মোর মাতা এড়িলেন ঊরে।।
আর যত ব্রাহ্মণী পাইয়া গর্ভবতী।
উদর চিরিয়া মারিলেক দুষ্টমতি।।
অনাথের প্রায় করি মারিল সবারে।
সে সব স্মরিয়া মম হৃদয় বিদরে।।
হেন দুষ্টমনে যদি শাস্তি না হইবে।
এইমত দুষ্টাচার ত্যাগ কে করিবে।।
শক্তি আছে, শাস্তি নাহি দেয় যেই জন।
কাপুরুষ বলি তারে সংসারে ঘোষণ।।
এই হেতু ক্রোধ মম হইল অপার।
নিবৃত্ত না হবে ক্রোধ না করি সংহার।।
ঔর্ব্ব প্রতি পুনরপি বলে পিতৃগণ।
নিবৃত্ত করহ ক্রোধ, শান্ত কর মন।।
ক্রোধ-তুল্য মহাপাপ নাহিক সংসারে।
তপ জপ জ্ঞান সব ক্রোধেতে সংহারে।।
বিশেষ যতির ক্রোধ চণ্ডাল গণন।
এ সব গণিয়া বাপু কর সম্বরণ।।
আমরা তোমার পিতৃগণ গুরুজন।
আমা সবাকার বাক্য না কর লঙ্ঘন।।
নিবৃত্ত করিতে যদি নাহিক শকতি।
উপায় কহি যে এক, শুন মহামতি।।
ত্রৈলোক্য-জনের প্রাণ জলের ভিতরে।
জল বিনা মুহূর্ত্তেকে না বাঁচে সংসারে।।
সে কারণে জলমধ্যে এড় ক্রোধানল।
জলেরে হিংসিলে হিংসা পাইবে সকল।।
ঔর্ব্ব বলে, না লঙ্ঘিব সবার বচন।
সমুদ্রে থুইল ক্রোধ ভৃগুর নন্দন।।
অদ্যাপি মুনির ক্রোধ-অনলের তেজে।
দ্বাদশ যোজন নিতি পোড়ে সিন্ধুমাঝে।।
বশিষ্ঠ বলেন, তাত পূর্ব্বের কাহিনী।
এত অপরাধ ক্ষমা কৈল ঔর্ব্ব মুনি।।
এত শুনি পরাশর ক্রোধে শান্ত হৈল।
রাক্ষসে মারিব বলি অঙ্গীকার কৈল।।
রাক্ষস আমার তাতে করিল ভক্ষণ।
পিতৃবৈরী নিশাচরে করিব নিধন।।
রাক্ষস বলিয়া না থুইব পৃথিবীতে।
পরাশর-মুনি এত দৃঢ় কৈল চিতে।।
বশিষ্ঠের শক্তিতে না হইল বারণ।
রাক্ষস-বধের যজ্ঞ কৈল আরম্ভণ।।
পরাশর-যজ্ঞ-কথা-অদ্ভুত কথন।
যে যজ্ঞে হইল সব রাক্ষস নিধন।।
রাক্ষসের দুষ্টাচার জানিয়া সকল।
পরাশর মুনি হৈল জ্বলন্ত অনল।।
বেদমন্ত্রে অগ্নি জ্বালি কৈল অঙ্গীকার।
সঙ্কল্প করিল সব রাক্ষস-সংহার।।
যজ্ঞের অনল গিয়া উঠিল আকাশে।
মন্ত্রে আকর্ষিয়া যত আনয়ে রাক্ষসে।।
গিরীন্দ্র নগর হৈতে কাননাদি গ্রাম।
দ্বীপ দ্বীপান্তরে যথা রাক্ষসের ধাম।।
লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি অর্ব্বুদ অর্ব্বুদে।
হাহাকার কলরব করিয়া শবদে।।
পুঞ্জ পুঞ্জ হৈয়া পড়ে অগ্নির ভিতরে।
ব্যাকুল হইয়া কেহ কান্দে উচ্চৈঃস্বরে।।
মহাতেজ মহাকায় মহা ভয়ঙ্কর।
কারো সপ্ত মুণ্ড, কারো অষ্টাদশ কর।।
বিকট দশন, রক্ত-লোমাবলি দেহ।
কূপ-সম চক্ষুতে বহয়ে ঘন লোহ।।
পর্ব্বত আকার কেহ জিহ্বা লহ লহ।
বিপুল উদর কারো দেখি শুঙ্ক দেহ।।
কেহ কেহ প্রবেশিল পর্ব্বত কোটরে।
প্রাণে ব্যগ্র কোনজন বৃক্ষ চাপি ধরে।।
কেহ প্রবেশয়ে গিয়া সমুদ্র-ভিতরে।
পাতালে প্রবেশে কেহ, যায় দিগন্তরে।।
কর্কট সিংহেতে যেন সলিল বরিষে।
লিখন না যায় কত অনলে প্রবেশে।।
দশদিকে কলবর হৈল হাহাকার।
প্রলয়-কালেতে যেন মজয়ে সংসার।।
আকুল হইয়া কেহ শরীর আছাড়ি।
ভয়েতে কম্পয়ে তনু, যায় গড়াগড়ি।।
কোনখানে রাক্ষসের না হয় রক্ষণ।
যজ্ঞে লৈয়া আসে মন্ত্রে করিয়া বন্ধন।।
পরাশর-যজ্ঞে কৈল রাক্ষস সংহার।
পুলস্ত্য পাইলে এ সকল সমাচার।।
পুলস্ত্য নামেতে তথা ব্রহ্মার নন্দন।
যাঁর সৃষ্টি হৈল যত নিশাচরগণ।।
সৃষ্টিনাশ হৈল, চিন্তিত মুনিবর।
যথা যজ্ঞ করে মুনি চলিল সত্বর।।
পুলস্ত্যেরে দেখিয়া উঠিল মুনিগণ।
বসিবারে দিল দিব্য কনক-আসন।।
চিত্তে ক্রোধ করিয়া বসিল মুনিবর।
পরাশবে চাহি মুনি করিলা উত্তর।।
বড় যশ উপার্জ্জিল শক্তির নন্দন।
অনেক রাক্ষসগণে করিলা নিধন।।
বেদশাস্ত্র জ্ঞাত হৈয়া কর হেন কর্ম্ম।
কোন্ বেদশাস্ত্রে আছে পরহিংষা ধর্ম্ম।।
পৃথিবীতে দ্বিজ নাহি তোমার বিচারে।
আর কোন দ্বিজ কেহ নাহি তপ করে।।
তোমার বিচারে শক্তি ছিল হীন জন।
সে কারণে কৈল তারে রাক্ষসে ভক্ষণ।।
মৃত্যু বলি সংসারে বড়ই আছে ব্যাধি।
ত্রৈলোক্যে না পাই বাপু ইহার ঔষধি।।
শত বৎসরেতে কেহ সহস্র বৎসরে।
শরীর ধরিলে লোক অবশ্য যে মরে।।
ব্যাঘ্র-হস্তী-হস্তে-কিম্বা জলে ডুবি মনে।
শত শত ব্যাধি আরো আছয়ে সংসারে।।
যথায় যাহার মৃত্যু কর্ম্ম-নিবন্ধন।
কার আছে শক্তি তাহা করয়ে খণ্ডন।।
সকল জানহ তুমি শাস্ত্র-অনুসারে।
জানিয়া এমন কর্ম্ম কর অবিচারে।।
বিশেষ আপন দোষে শক্তির নিধন।
মহাক্রোধ হৈল অল্প দোষের কারণ।।
আপনার মৃত্যু তবে আপনি সৃজিল।
নৃপতিরে শাপ দিয়া রাক্ষস করিল।।
অল্পদোষে মহাক্রোধ দ্বিজে অনুচিত।
সেই পাপে মৃত্যু তার কর্ম্ম নিবর্ত্তিত।।
রাক্ষসের কোন্ দোষ বুঝিলা আপনে।
অসংখ্য রাক্ষস ভস্ম কৈলা অকারণে।।
যে কর্ম্ম করিলা তুমি দ্বিজের এ নয়।
দ্বিজ-ক্রোধ হৈলে ক্ষণে হইবে প্রলয়।।
ক্রোধ করি দ্বিজ যদি সংসার নাশিবে।
কাহার শকতি তবে পৃথিবী রাখিবে।।
ক্রোধ শান্ত কর বাপু আমার বচনে।
হুতশেষ যেই আছে করহ রক্ষণে।।
আমার বচন যদি মনোরম্য নহে।
জিজ্ঞাসহ বশিষ্ঠে তোমার পিতামহে।।
বশিষ্ঠ কহেন, সত্য কহিলেন মুনি।
পূর্ব্বেই কহিনু বাপু এ সব কাহিনী।।
অকারণে হিংসা-কর্ম্মে উপজিল পাপ।
এ সব করিলে কিবা পুনঃ পাবে বাপ।।
ক্রোধ ত্যাগ কর, ছাড় লোকের হিংসন।
পুলস্ত্য-মুনির বাক্য করহ পালন।।
এত শুনি পরাশর কৈল সমাধান।
বহুযত্নে কৈল যজ্ঞঅগ্নির নির্ব্বাণ।।
নিবৃত্ত না হৈল অগ্নি পূর্ব্ব-অঙ্গীকারে।
সংকল্প করিল সর্ব্ব রাক্ষস-সংহারে।।
আহুতি না পেয়ে অগ্নি প্রবেশিল বনে।
অদ্যাপি অনল উঠে কানন-দাহনে।।
গন্ধর্ব্ব বলিল, শুন পাণ্ডুর নন্দন।
কহিলাম এ সকল কথা পুরাতন।।
বশিষ্ঠের ক্ষমা সম নাহিক সংসারে।
বিশ্বামিত্র সংহারিল শতেক কুমারে।।
তথাপিহ তারে ক্রোধ না করিল মুনি।
যম হৈতে লৈতে পারে, তথাপি না আনি।।
কারণ বুঝিবা মুনি অতি ক্ষমাবান।
নৃপতি কল্মাষপাদে দিল পুত্র-দান।।
যে রাজা হইল হেতু শত পুত্র-নাশে।
তারে পুত্রবান্ কৈল আপন ঔরসে।।
অর্জ্জুন বলেন, কহ ইহার কারণ।
কি কারণে হেন কর্ম্ম কৈল তপোধন।।
একে ত পরের দারা দ্বিতীয়ে অগম্য।
কি কারণে বশিষ্ঠ করিল হেন কর্ম্ম।।
গন্ধর্ব্ব বলিল, শুন তার বিবরণ।
শক্তি-শাপে নিশাচর হইল রাজন।।
ক্ষুধায় তৃষ্ণায় যে আকুল কলেবর।
ভক্ষ্য-অনুসারে ফিরে অরণ্য-ভিতর।।
হেনকালে দেখে পথে ব্রাহ্মণী ব্রাহ্মণ।
রাজারে দেখিয়া পলাইল দুইজন।।
দেখিয়া ব্রাহ্মণে গিয়া ধরিল নৃপতি।
ভয়েতে বিলাপ করে ব্রাহ্মণ-যুবতী।।
কাতর হইয়া বলে বিনয় বচন।
পৃথিবীর রাজা তুমি সৌদাস-নন্দন।।
তোমার বংশেতে সব দ্বিজের কিঙ্কর।
ব্রাহ্মণেরে বধ না করিহ নরবর।।
আজি মোর প্রথম হইয়াছে ঋতু-স্নান।
বংশ-রক্ষা হেতু মোরে স্বামী দেহ দান।।
অতিশয় ক্ষুধার্ত্ত হৈয়াছ যদি তুমি।
আমারে ভক্ষণ কর ছাড় মোর স্বামী।।
এতেক কাতরে যদি ব্রাহ্মণী বলিল।
সহজে অজ্ঞান রাজা শুনি না শুনিল।।
ব্যাঘ্র যেন পশু ধরি করয়ে ভক্ষণ।
ঘাড় ভাঙ্গি রক্তপান কৈল ততক্ষণ।।
ব্রাহ্মণের মৃত্যু দেখি ব্রাহ্মণী বিকল।
আনিয়া বনের কাষ্ঠ জ্বালিল অনল।।
অগ্নি প্রদক্ষিণ করি ডাকি বলে নৃপে।
ওরে দুষ্ট দুরাচার শুন মোর শাপে।।
মোর ঋতু ভুঞ্জিতে না পাইলেন স্বামী।
এইমত নিরাশ হইবা দুষ্ট তুমি।।
স্ত্রী-স্পর্শ করিলে তোর অবশ্য মরণ।
এ শাপ দিলাম তোরে নহিবে খণ্ডন।।
সূর্য্যবংশ কারণ জানাই উপদেশে।
বংশরক্ষা হবে তোর ব্রাহ্মণ-ঔরসে।।
এত বলি ব্রাহ্মণী পড়িল অগ্নিমাঝ।
দ্বাদশ বৎসর বনে ফিরে মহারাজ।।
বশিষ্ঠ হইতে মুক্ত হইয়া রাজন।
সচেতন হৈয়া দেশে করিল গমন।।
স্নান দান জপ হোম করিল নৃপতি।
শয়ন করিতে গেল যথা মদয়ন্তী।।
মদয়ন্তী বলে, রাজা নাহিক স্মরণ।
ব্রাহ্মণী দিলেন শাপ দারুণ বচন।।
স্ত্রী-স্পর্শ করিলে তব হইবে মরণ।
সে কারণে মোর অঙ্গ না ছোঁও রাজন।।
রাণীর বচনে নিবর্ত্তিল নরপতি।
বংশরক্ষা কারণ চিন্তিত মহামতি।।
বশিষ্ঠে রাখিবে বংশ শুনি লোকমুখে।
ভার্য্যা-নিয়োজন কৈল বশিষ্ঠ মুনিকে।।
বশিষ্ঠ-ঔরসে অশ্মক নামে হৈল পুত্র।
সুর্য্যবংশ রাখিল বশিষ্ঠ দেবমূর্ত্ত।।
এত শুনি অর্জ্জুন হইল হৃষ্টমন।
গন্ধর্ব্বেরে বলিলেন বিনয় বচন।।
এ সব শুনিয়া মম ব্যগ্র হৈল মন।
পুরোহিত-যোগ্য কোথা পাইব ব্রাহ্মণ।।
রাজগণ পূর্ব্বে পুরোহিতের সুতেজে।
বহু সঙ্কটেতে রক্ষা পায় ক্ষিতিমাঝে।।
গন্ধর্ব্ব বলিল, যদি পুরোহিতে মন।
দেবল-ঋষির ভ্রাতা ধৌম্য তপোধন।।
পুরোহিত করি তাঁরে করহ রবণ।
এত শুনি পার্থ হয় প্রসন্ন বদন।।
যত অস্ত্র দিয়াছিল, গন্ধর্ব্ব রাজনে।
পার্থ বলিলেন, ইহা থাকুক এখানে।।
কার্য্যকালে অস্ত্র সব মাগিব তোমারে।
তখনি এ অস্ত্র-প্রাপ্তি হইবে আমারে।।
এত শুনি গন্ধর্ব্ব হইল হৃষ্টমন।
একে একে পঞ্চ ভাই কৈল আলিঙ্গন।।
বিদায় হইয়া গেল আপন আলয়।
উৎকোচক-তীর্থে গেল কুন্তীর তনয়।।
পুরোহিত করি ধৌম্যে করিল বরণ।
উল্লাসেতে কৈল ধৌম্য আশিস্-বচন।।
ধৌম্য সহ পঞ্চ ভাই পাঞ্চালে চলিল।
পথেতে যাইতে বহু ব্রাহ্মণ দেখিল।।
দ্বিজগণ বলে, কে তোমরা পঞ্চজন।
কোথা হৈতে আসিতেছ কোথায় গমন।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন, একচক্রা হৈতে।
পঞ্চ ভাই যাইতেছি জননী সহিতে।।
দ্বিজগণ বলে, চল মোদের সংহতি।
কন্যা-স্বংন্বর করে পাঞ্চালেন পতি।।
বহুদিন হৈতে তথা আসে দ্বিজগণ।
বহুধন দিতেছেন বিজয়-কারণ।।
স্বয়ম্বর দেখিব, পাইব বহু ধন।
আমা লবা সংহতি চলহ পঞ্চজন।।
তোমা পঞ্চজনে যদি পাঞ্চালী দেখিবে।
মনে হেন লয়, তোমা অবশ্য বরিবে।।
তোমা পঞ্চজনে কৃষ্ণা বরিবে কাহারে।
দেখিয়া বিস্ময় তার জন্মিবে অন্তরে।।
এত বলি দ্বিজগণ চলিল সহিত।
পাঞ্চাল-নগরে সবে হৈল উপনীত।।
আদিপর্ব্বে উত্তম বশিষ্ঠ-উপাখ্যান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।
 

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র