২৬. ঘটোৎকচের যুদ্ধযাত্রা ও নিশা-রণদুর্য্যোধন বলে, শুন সর্ব্ব যোদ্ধাগণ।রাত্রি দিন যুদ্ধ কর নাহি নিবারণ।।উল্কা জ্বালিয়া আজি করহ সমর।পুনঃ পুনঃ বলে রাজা হইয়া কাতর।।এত বলি শত শত উলকা জ্বালিল।উলকা জ্বালিয়া যুদ্ধ করিতে লাগিল।।এতেক দেখিয়া পাণ্ডবের সেনাগণ।উলকা জ্বালিল লক্ষ লক্ষ সেইক্ষণ।।দুই দুই উল্কা ধরি রথের উপর।হেনমতে যোদ্ধাগণ করয়ে সমর।।সংশপ্তকে চলিলেন পার্থ নারায়ণ।মহাঘোর যুদ্ধ হৈল, না যায় লিখন।।চক্রব্যূহ করি তথা দ্রোণ মহাবীর।পাণ্ডবের সেনাগণে করিল অস্থির।।নিবারিতে না পারিল বীর বৃকোদর।রাজারে ধরিতে যায় দ্রোণ ধনুর্দ্ধর।।হেনকালে শীঘ্রগতি ধৃষ্টদ্যুম্ন বীর।হাতে ধনু করি ধায় নির্ভয় শরীর।।বাণবৃষ্টি করে দ্রোণ তাহার উপর।নিবারয়ে বাণ ধৃষ্টদ্যুম্ন ধনুর্দ্ধর।।তবে ক্রোধে দ্রোণাচার্য্য এড়ে পঞ্চ বাণ।কবচ কাটিয়া তার করে খান খান।।আর বাণ এড়ে দ্রোণ, তারা হেন ছুটে।ধৃষ্টদ্যুম্ন অঙ্গে বাণ বজ্রসম ফুটে।।রথেতে পড়িল বীর হয়ে অচেতন।সারথি পলায় রথ লয়ে সেইক্ষণ।।ধৃষ্টদ্যুম্ন পলাই, দেখি দ্রোণ বীর।বাণে খণ্ড খণ্ড করে রাজার শরীর।।রাজার সংশয় দেখি সাত্যকি সত্বর।শত শত বাণ এড়ে দ্রোণের উপর।।সন্ধান পূরিয়া করে বাণ বরিষণ।সাত্যকি দেখিয়া দ্রোণ হইল ক্রোধমন।।সাত্যকি উপরে গুরু পূরিল সন্ধান।একবারে প্রহারিল একশত বাণ।।দেখিয়া সাত্যকি বীর অগ্নির সমান।খান খান করি কাটে আচার্য্যের বাণ।।কাটিয়া সকল বাণ সত্যক-নন্দন।দ্রোণের উপরে এড়ে তীক্ষ্ণ অস্ত্রগণ।।বাণাঘাতে দ্রোণাচার্য্য হৈল অচেতন।খসিয়া পড়িল হাত হৈতে শরাসন।।বাণে খণ্ড খণ্ড হৈল দ্রোণের শরীর।শতেক ধারাতে অঙ্গে বহিছে রুধির।।সিংহনাদ করি বুলে সত্যক-নন্দন।মুহূর্ত্তেক নিপাতিল বহু সেনাগণ।।সাত্যকির যুদ্ধ দেখি ধর্ম্মের কুমার।ধন্য ধন্য করি প্রশংসয়ে বহুবার।।কতক্ষণে দ্রোণাচার্য্য পাইল চেতন।হাতে ধনু করি বীর মহাক্রোধ মন।।ধনুর্গুণ টঙ্কারিয়া এড়ে দিব্য বাণ।আকর্ণ পূরিয়া বীর করিল সন্ধান।।একবারে প্রহারিল দশগোটা বাণ।রথেতে সাত্যকি পড়ে হইয়া অজ্ঞান।।মূর্চ্ছিত দেখিয়া রথ ফিরায় সারথি।সাত্যকিরে লয়ে পলাইল শীঘ্রগতি।।তবে মহোক্রোধে দ্রোণ অস্ত্রবৃষ্টি করে।লক্ষ লক্ষ সেনা পড়ে সংগ্রাম ভিতরে।।দ্রোণের বিক্রম দেখি ধর্ম্মের তনয়।সৈন্যগণ পড়ে বহু দেখি হৈল ভয়।।চিন্তাকুল যুধিষ্ঠির কুন্তীর নন্দন।কি করিব, কি হইবে, কে করিবে রণ।।দুঃখিত হইয়া তবে ধর্ম্ম-নরপতি।রথ ছাড়ি সেই স্থলে বসিলেন ক্ষিতি।।রাজারে চিন্তিত দেখি হিড়িম্বা-নন্দন।সত্বরে আসিল বীর দেখিতে ভীষণ।।যুধিষ্ঠির আগে কহে করি যোড়কর।কিসের কারণে দুঃখ ভাব নরবর।।মোরে আজ্ঞা কর যদি শুনি নরনাথ।একেশ্বর কৌরবেরে করিব নিপাত।।এত শুনি আনন্দিত ধর্ম্মের নন্দন।শিরে চুম্ব দিয়া তারে কৈল আলিঙ্গন।।যুধিষ্ঠির বলিলেন, শুন মহাবীর।তোমার বিক্রমে দেবগণ নহে স্থির।।ব্যূহ ভেদি মার পুত্র কুরু- সেনাগণ।মহাধনুর্দ্ধর বীর ভীমের নন্দন।।ঘটোৎকচ বলে, তুমি দেখ নরপতি।অবশ্য মারিব আমি দ্রোণ সেনাপতি।।এত বলি মহাবীর গদা লয়ে করে।শীঘ্রগতি প্রবেশিল ব্যূহের ভিতরে।।মহাশব্দ করি বীর ব্যূহে প্রবেশিল।দেখিয়া পাণ্ডব-বল সানন্দ হইল।।ধৃষ্টদ্যুম্ন সাত্যকি যে আর বৃকোদর।সহদেব নকুল ও পাঞ্চাল ঈশ্বর।।শতানিক মদিরাক্ষ মৎস্য-নরবর।জরাসন্ধ-সুত সহদেব ধনুর্দ্ধর।।দ্রৌপদীর পঞ্চ পুত্র, রাজা যুধিষ্ঠির।একযোটে চলে যত লক্ষ লক্ষ বীর।।মার মার করি সবে ব্যূহে প্রবেশিল।রথ রথী গজে গজে মহাযুদ্ধ হৈল।।জন্মেজয় জিজ্ঞাসিল, কহ মুনি আর।কিরূপে করিল যুদ্ধ ভীমের কুমার।।বিস্তারিয়া সেই কথা কহ মহাশয়।কৃপা করি মুনি মোর খণ্ডাহ বিস্ময়।।দ্রোণপর্ব্বে সুধারস ঘটোৎকচ-বধে।কাশীরাম দাস কহে গোবিন্দের পদে।।২৭. কুরুসৈন্যের সহিত ঘটোৎকচেরমহাযুদ্ধ ও অলম্বুষ বধমহাপরাক্রম বীর হিড়িম্বা নন্দন।।তালতরু সম গদা হাতে মহাবীর।কুরুসেনা মধ্যে ধায় নির্ভয় শরীর।।গদা লয়ে ঘটোৎকচ বায়ুবেগে ধায়।রথ গজ পদাতিক চূর্ণ করি যায়।।সৃষ্টি নাশ করে যেন প্রচণ্ড তপন।সেইমত ঘটোৎকচ ভীমের নন্দন।।পর্ব্বত আকার কৈল দীর্ঘ কলেবর।অভেদ্য শরীর কৈল বজ্র সম সর।।কৈল দশ যোজন সুদীর্ঘ কলেবর।মেঘের আকার বর্ণ মহাভয়ঙ্কর।।মুখখান যুড়ে পৃথ্বী গগণমণ্ডল।আনন্দিত ঘটোৎকচ হাসে খল খল।।মুখ দেখি কুরুসৈন্য হারায় চেতন।বিনা যুদ্ধে শত শত ত্যজিল জীবন।।ঘটোৎকচ মুখ দেখি কুরুসেনাগণ।সত্বরে পলায় সবে লইয়া জীবন।।শিমুলের তুলা যেন উড়ায় পবন।হেনমতে পলাইল সব সেনাগণ।।ঘটোৎকচ আগেতে না রহে কোন বীর।সিংহনাদ করে বীর নির্ভয় শরীর।।হেনকালে আসে দুঃশাসনের নন্দন।দোষণ তাহার নাম রূপেতে মদন।।রথে চড়ি ধনু ধরি আসে শীঘ্রগতি।শরজালে আবরিল ঘটোৎকচ রথী।।আনন্দিত ঘটোৎকচ ভীমের নন্দন।গদা লয়ে ধায় যেন কাল হুতাশন।।ক্ষুধার্ত্ত গরুড় যেন পইল ডুণ্ডুভ।মহাক্রোধে ঘটোৎকচ ধায় সেইরূপ।।গদার প্রহার কৈল তাহার উপর।রথ অশ্ব সারথিরে দিল যমঘর।।লাফি দিয়া যায় দুঃশসনের নন্দন।দেখি ধায় ঘটোৎকচ মহাক্রুদ্ধ মন।।অষ্টশিরা গদা গোটা নিল বীর হাতে।হাসিতে হাসিতে মারে দোষণের মাথে।।বজ্রাঘাতে যেন গিরি শৃঙ্গ চূর্ণ হয়।সেইমত পড়ে দুঃশাসনের তনয়।।দোষণ পড়িল দেখি কান্দে দুঃশাসন।হাহাকার করি কান্দে যত যোদ্ধাগণ।।পুত্রশোকে দুঃশাসন মহাক্রুদ্ধ হয়ে।হাতে ধনু করি আসে দিব্য শর লয়ে।।সন্ধান পূরিয়া যোড়ে চোখ চোখ শর।দেখি ঘটোৎকচ বীর হরিষ অন্তর।।দুঃশাসনে ডাকি বলে ঘটোৎকচ বীর।আজি যুদ্ধ দেহ মোরে হইয়া সুস্থির।।কৌতুক দেখিবে আজি যত যোদ্ধাগণ।অবশ্য পাঠাব তোরে যমের সদন।।এত বলি দিব্য অস্ত্র নিল ঘটোৎকচ।দশ বাণে বিপক্ষের কাটিল কবচ।।আর দশ বাণ এড়ে পূরিয়া সন্ধান।দুঃশাসন অঙ্গ কাটি করে খান খান।।মূর্চ্ছিত হইয়া পড়ে দুঃশাসন বীর।রণ ত্যজি পলাইল হইয়া অস্থির।।দুঃশাসন ভঙ্গ দেখি হাসে মহাবীর।সিংহনাদ করি বুলে নির্ভয় শরীর।।নানা মায়া করি বুলে ভীমের নন্দন।রাক্ষসী মায়ায় বীর বড় বিচক্ষণ।।কোনখানে অগ্নিরূপে দহে সেনাগণ।দাবানলে ধরি কোথা হস্তী করে নাশ।।দেখিয়া কৌরবগণ গণিল তরাস।ঘটোৎকচ যুদ্ধ দেখি ধর্ম্মের নন্দন।।ধন্য ধন্য করিয়া করেন প্রশংসন।কৌরবের দলে হৈল রোদন অপার।।একা ঘটোৎকচ বীর কৈল মহামার।সৈন্যগণ পড়ে দেখি কান্দে দুর্য্যোধন।।হেনকালে আসে কর্ণ রবির নন্দন।ক্রোধে ধনু ধরি বীর চলে সেইক্ষণ।ঘটোৎকচ সহ গেল করিবারে রণ।।দেখি ঘটোৎকচ বীর ধাইল সত্বর।গদা তুলি মারে বীর কর্ণের উপর।।অশ্ব সহ সারথিরে করিলেক চূর।লাফ দিয়া পলাইল কর্ণ মহাশূর।।কর্ণ পলাইল দেখি ভীমের নন্দন।মহাকোপে বহু সৈন্য করিল নিধন।।শত শত হস্তী মারে গদার প্রহারে।লক্ষ লক্ষ পদাতিক নিমিষে সংহারে।।শত শত রথ পড়ে হয়ে খান খান।দেখিয়া কৌরবদল হৈল কম্পমান।।হাহাকার শব্দ করে যত যোদ্ধাগণ।দেখি দুর্য্যোধন রাজা শোকাকুল মন।।ঘটোৎকচ যুদ্ধ দেখি দ্রোণের নন্দন।সিংহনাদ করি গেল করিবারে রণ।।সন্ধান পূরিয়া অশ্বথামা এড়ে বাণ।দেখি ঘটোৎকচ বীর ক্রোধে কম্পমান।।এক লাফে নিজ রথে চড়ে বীরবর।গদা এড়ি ধনুঃশর লইল সত্বর।।হাতে তুলে নিল বীর দুর্দ্ধরিষ ধনু।সন্ধান পুরিয়া বিন্ধে দ্রোণপুত্র তনু।।শীঘ্র অস্ত্র অশ্বথামা পূরিয়া সন্ধান।নিমিষেতে নিবারিল ঘটোৎকচ বাণ।।বাণ ব্যর্থ দেখি বীর সন্ধান পূরিল।তীক্ষ্মভল্ল দশ গোটা অঙ্গেতে মারিল।।মোহ গেল ঘটোৎকচ রথের উপর।সিংহনাদ করি বুলে দ্রোণের কুমার।।কতক্ষণে ঘটোৎকচ পাইল চেতন।ক্রোধমূর্ত্তি দেখি যেন কাল হুতাশন।।ধনু এড়ি গদা লয়ে ধাইল সত্বর।দোহাতিয়া বাড়ি মারে রথের উপর।।যদার প্রহারে রথ খণ্ড খণ্ড হৈল।লাফ দিয়া অশ্বথামা বেগে পলাইল।।ভয়ে কম্পমান হৈল দ্রোণের নন্দন।দ্রুতগতি পলাইল লইয়া জীবন।।তবে ঘটোৎকচ বীর কুপিত অন্তরে।হাতে গদা করি বীর ভ্রময়ে সমরে।।লেখা জোখা নাহি যত পড়ে সেনাবর।পলাইয়া যায় সবে ত্যজিয়া সমর।।বায়ুবেগে ধায় যত অশ্ব আসোয়ার।পলায় পদাতিগণ লেখা নাহি তার।।হেনমতে ঘটোৎকচ করে মহামার।কৌরবের দলে উঠে শব্দ হাহাকার।।হেনকালে অলম্বুষ আইল রাক্ষস।মহাপরাক্রম বীর অসীম সাহস।।রাক্ষসের সেনা লয়ে ধাইল সত্বর।পর্ব্বত আকার বীর মহাভয়ঙ্কর।।রাক্ষস দেখিয়া ধায় ঘটোৎকচ বীর।মহাগদা হাতে করি নির্ভয় শরীর।।গদার প্রহার করে রাক্ষস উপর।অনেক রাক্ষস মারে সংগ্রাম ভিতর।।অশ্ব হস্তী পদতিক সম্মূখে যা পায়।গদার প্রহারে বীর চূর্ণ করি ধায়।।কোটি কোটি সেনা পড়ে না যায় লিখন।দেখি পলাইয়া যায় যত যোদ্ধাগণ।।তবে ক্রোধে অলম্বুষ রাক্ষস ঈশ্বর।গদা লয়ে ধায় বীর সংগ্রাম ভিতর।।তবে ক্রোধে ঘটোৎকচ ভীমের কোঙর।গদা প্রহারিল অলম্বুষের উপর।।গদার প্রহারে বীর হইল জর্জ্জর।ত্রাস পেয়ে উঠে গিয়া আকাশ উপর।।অন্তরীক্ষে থাকি বীর করে ঘোর রণ।দেখিয়া কুপিল বীর হিড়িম্বা নন্দন।।অন্তরীক্ষে ঘটোৎকচ উঠিল সত্বর।মহাযুদ্ধ করে দোঁহে শূন্যের উপর।।মহাত্রাসে অলম্বুষ মেঘে লুকাইল।দেখি ঘটোৎকচ বীর কুপিত হইল।।মায়া করি লুকাইল হিড়িম্বা নন্দন।দেখি ভয়ে রাক্ষস পলায় সেইক্ষণ।।তথা হৈতে অলম্বুষ নামে রণস্থল।দেখিয়া ধাইল ঘটোৎকচ মহাবল।।পুনরপি দুইজনে হইল সংগ্রাম।নানা মায়া করে বীর অতি অনুপম।।দিব্য রথে অলম্বুষ করি আরোহণ।ভীমের নন্দনে করে বাণ বরিষণ।।তবে কটোৎকচ বীর গদা লয়ে ধায়।রথ অশ্ব চূর্ণ বীর করে এক ঘায়।।লাফ দিয়া পলাইল রাক্ষস ঈশ্বর।পুনরপি গদা লয়ে ধাইল সত্বর।।মহাযুদ্ধ করে দোঁহে ধরণী উপর।গদার প্রহারে দোঁহে হইল জর্জ্জর।।পুনরপি রাক্ষস হইল লুকি কায়।কোথায় আছয়ে কেহ দেখিতে না পায়।।কতক্ষণে রাক্ষস আইল আরবার।সৈন্যের উপরে করে গদার প্রহার।।দেখিয়া ধাইল বীর হিড়িম্বানন্দন।পুনরপি দুইজনে করে মহারণ।।দিব্য রথে চড়ি দোঁহে করয়ে সমর।বাণাতে দোঁহার অঙ্গ হইল জর্জ্জর।।তবে কোপে বাণ এড়ে ঘটোৎকচ বীর।বাণে বিন্ধে অলম্বুষে করিল অস্থির।।সহিতে না পারি ভঙ্গ দিল দ্রুতগতি।পুনরপি লুকাইল রাক্ষসের পতি।।মায়া করি পর্ব্বত হইল নিশাচর।শত শৃঙ্গ ধরে তার মহাভয়ঙ্কর।।তার এক শৃঙ্গে রহে রাক্ষসের পতি।রণস্থলে পর্ব্বত হইল শীঘ্রগতি।।মহাশব্দ করি পড়ে সৈন্যের উপর।রথধ্বজ চূর্ণ করে সংগ্রাম ভিতর।।দেখি ঘটোৎকচ বীর ধাইল সত্বর।এক লাফে চড়ে গিয়া পর্ব্বত উপর।।পর্ব্বতের শৃঙ্গে দেখে বসেছে রাক্ষস।গদা হাতে করি ধায় অসীম সাহস।।এক গদাঘাতে সব মায়া কৈল চূর।অলম্বুষ পলাইয়া গেল অতি দূর।।পুনরপি রাক্ষস আইল আচম্বিত।দেখি ধায় ঘটোৎকচ নহে কিছু ভীত।।একলাফে চড়ে তার রথের উপর।অলম্বুষ রাক্ষসেরে ধরিল সত্বর।।চুলে ধরি রাক্ষসেরে ভূমেতে পাড়িল।মুকুটির ঘায়ে তার মস্তক ভাঙ্গিল।।অলম্বুষ পড়িল তরাস কুরুদলে।মহামার ঘটোৎকচ করে রণস্থলে।।মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবাণ।।২৮. ঘটোৎকচ কর্ত্তৃক অলম্বুষি বধপিতার মরণ দেখি অলম্বুষি বীর।সিংহনাদ করি আসে নির্ভয় শরীর।।হস্তীর উপরে বীর আরোহণ করি।নানা মায়া করে বীর হাতে ধনু ধরি।।দেখিয়া ধাইল ঘটোৎকচ মহাবলে।গদার প্রহার করে করিকুম্ভস্থলে।।পৃথিবীতে দন্ত দিয়া পড়িল বারণ।লাফ দিয়া পলাইল রাক্ষস দুর্জ্জন।।পুনরপি অলম্বুষি চড়ি দিব্য রথে।সংগ্রামের স্থলে আসে ধনুঃশর হাতে।।সন্ধান পূরিয়া বিন্ধে ঘটোৎকচ বীরে।সর্ব্ব অঙ্গ রক্তবর্ণ হইল রুধিরে।।তবে ঘটোৎকচ বীর ক্রোধে ভয়ঙ্কর।গদা ফেলি মারে তার রথের উপর।।গদার প্রহারে রথ চূর্ণ হয়ে গেল।লাফ দিয়া অলম্বুষি ভূমিতে পড়িল।।ধনু অস্ত্র এড়ি তবে গদা নিল করে।গদা যুদ্ধ করে দোঁহে সংগ্রাম ভিতরে।।মহাকোপে ডাক ছাড়ে করে মার মার।দোঁহে দোঁহাকারে করে গদার প্রহার।।মণ্ডলী করিয়া দোঁহে ফিরে চারিভিত।কোপে হুহুঙ্কার ছাড়ে অতি বিপরীত।।তবে ঘটোৎকচ বীর মহামার কৈল।অলম্বুষির সব্যহস্তে গদা প্রহারিল।।দারুণ প্রহারে হস্ত খণ্ড খণ্ড হৈল।মর্ম্মব্যথা পেয়ে বীর ভূমিতে পড়িল।।লাফ দিয়া ধরে ঘটোৎকচ মহাবল।এক চড়ে ভাঙ্গিল তাহার বক্ষঃস্থল।।মহাকায় রাক্ষস পড়িল ভূমিতলে।দেখিয়া হইল ভয় কৌরবের দলে।।অলম্বুষি পড়িল দেখিল বিদ্যমান।ভয়ে কোন বীর আর নহে আগুয়ান।।গদা হাতে করি ধায় ঘটোৎকচ বীর।গদার প্রহারে সৈন্য করিল অস্থির।।২৯. ঘটোৎকচ কর্ত্তৃক পাণ্ড্য রাজা বধমহাকোপে ঘটোৎকচ বায়ুবেগে ধায়।রথ সৈন্য অশ্বগণে র্চূর্ণ করি যায়।।লক্ষ লক্ষ পদাতিক করিল সংহার।দেখি দুর্য্যোধন রাজা করে হাহাকার।।আজি ঘটোৎকচ বীর করিল সংহার।মম সৈন্যে বীর নাহি সমান ইহার।।অভিমন্যু ঘটোৎকচ সম দুইজনা।অন্য বীর নাহি এই দোঁহের তুলনা।।ভীমের সমান বীর মহাপরাক্রম।গদা হাতে করি ধায় যেন কাল সম।।হেনকালে পাণ্ড্য রাজা রথে চড়ি এল।দুর্য্যোধন প্রতি তবে ডাকিয়া বলিল।।কি কারণে মহারাজ চিন্তা কর তুমি।দেখ ঘটোৎকচ বীরে বিনামিব আমি।।এত বলি ধনু ধরি যায় নৃপবর।দেখি দুর্য্যোধন বীর হরিষ অন্তর।।ঘটোৎকচে দেখি বীর ছাড়ে সিংহনাদ।আজি তোর ঘুচাইব সমরের সাধ।।স্থির হয়ে ঘটোৎকচ দেহ মোরে রণ।এক বাণে পাঠাইব যমের সদন।।এত শুনি ঘটোৎকচ মহাক্রুদ্ধ হৈল।হাতে গদা করি বীর সমরে ধাইল।।সন্ধান পূরিয়া পাণ্ড্য রাজা এড়ে বাণ।গদায় ঠেকিয়া তাহা হৈল খান খান।।তবে পাণ্ড্য রাজা কোপে এড়ে পঞ্চবাণ।পঞ্চবাণে গদা কাটি করে খান খান।।গদা কাটা গেল বীর অস্ত্র নাহি আয়।চড় চাপড়েতে বীর করে মহামার।।মহাকোপে ঘটোৎকচ ভীমের নন্দন।রথখান সাপটিয়া ধরে সেইক্ষণ।।এক টানে ফেলে বীর দ্বাদশ যোজন।হেনমতে পাণ্ড্যরাজা ত্যজিল জীবন।।এতেক দেখিয়া সবে লাগে চমৎকার।কৌরবের সেনাগণ গণিল অসার।।দুর্য্যোধন বলে শুন সর্ব্ব যোদ্ধাগণ।সবে মেলি ঘটোৎকচে করহ নিধন।।সর্ব্বনাশ কৈল মম ভীমের নন্দন।কিরুপেতে জয় হবে আজিকার রণ।।ইহার বিধান সবে কহ ত আমারে।ঘটোৎকচ বধ করি কিমত প্রকারে।।দুর্য্যোধনে কাতর দেখিয়া সর্ব্বজন।রথে চড়ি ধায় সবে করিবারে রণ।।প্রাণ উপেক্ষিয়া সবে করয়ে সমর।নানা অস্ত্র ফেলে ঘটোৎকচের উপর।।ভূষণ্ডী তোমর শক্তি শেল জাঠাজাঠি।ত্রিশূল পট্টিশ নানা অস্ত্র কোটি কোটি।।মুষলের ধারে যেন বৃষ্টি হয় নীর।হেনমতে অস্ত্র ফেলে সব মহাবীর।।দেখিয়া কুপিল বীর হিড়িম্বানন্দন।কোপেতে লোহিত নেত্র সাক্ষাৎ শমন।।শীঘ্রগতি ধনু করি করিল সন্ধান।খণ্ড খণ্ড করি কাটে সবাকার বাণ।।কাটিয়া সকল অস্ত্র ভীমের তনয়।দশ দশ বাণে বিন্ধে সবার হৃদয়।।বাণাঘাতে যোদ্ধাগণ হৈল অচেতন।ভঙ্গ দিয়া পলাইয়া যায় সর্ব্বজন।।তবে ক্রোধে ঘটোৎকচ যমের সমান।নিমিষেকে মারিলেক লক্ষ সেনাগণ।।দেখিয়া ব্যাকুল বড় হৈল দুর্য্যোধন।রোদন করিয়া ধায় যত যোদ্ধাগণ।।রথ ছাড়ি হয় ছাড়ি পথে সবে ধায়।আতঙ্কেতে ভঙ্গ দিয়া পলাইয়া যায়।।বিষম সমরে সেনা করিল নিধন।বিমানে বসিয়া দেখে সর্ব্ব দেবগণ।।শোকাকুল দুর্য্যোধন হইল মূর্চ্ছিত।জ্ঞানহীন হৈল যেন নাহিক সম্বিত।।৩০. কর্ণ কর্ত্তৃক ঘটোৎকচ বধকি করিব কি হইবে ইহার উপায়।ভাবিতে ভাবিতে তার হৃদয় শুকায়।।চিন্তাজ্বর উপজিল থর থর কাঁপি।আগুন ছুটিল গায় হয়ে অনুতাপী।।হেনকালে অশ্বথামা দ্রোণের নন্দন।কর্ণেরে কহিল শুন আমার বচন।।একঘাতী অস্ত্র আছে তোমার সদনে।বজ্রের সদৃশ অস্ত্র নহে নিবারণে।।সেই অস্ত্র এড়ি মার ভীমের নন্দন।অবশ্য সংহার হবে না যায় খণ্ডন।।ইহা বিনা আর কিছু না দেখি উপায়।সেই বাণে হবে ক্ষয় কহিনু তোমায়।।কর্ণ বলে সেই বাণে বধিব অর্জ্জুনে।যতনে রাখিনু আমি তাহার কারণে।।কবচ বিতরি পাই সেই মহাবাণ।তাহাতে অর্জ্জুন বীর না ধরিবে টান।।এই অস্ত্রাঘাতে যদি ঘটোৎকচে বধি।নিশ্চয় লিখিল মম মৃত্যু তবে বিধি।।অর্জ্জুনের হাতে মম অবশ্য মরণ।করিল বিধাতা তার এই সংঘটন।।বধিতাম অর্জ্জুনে অবশ্য এই বাণে।যত্ন করি রাখিয়াছি তাহার কারণে।।অশ্বথামা বলে, ভাল বলিলে বিধান।আজি ঘটোৎকচেরে কর সমাধান।।ইহার হাতেতে যদি রক্ষা পাও রণে।তবে অর্জ্জুনেরে তুমি বধিবে জীবনে।।এই শুনি কর্ণ কহে আনন্দিত মন।ভাল যুক্তি কহিলা হে গুরুর নন্দন।।দুর্য্যোধন বলে শুন কর্ণ ধনুর্দ্ধর।এই অস্ত্র এড়িয়া রাক্ষস বধ কর।।হেন অস্ত্র আছে যদি তোমার সদনে।তবে চিন্তা কর তুমি কিসের কারণে।।অর্জ্জুনে বধিবে বলি রাখিয়াছে বাণ।যে হয় পশ্চাৎ তার করিব বিধান।।আজি রক্ষা কর ঝাট রাক্ষসের হাতে।কেমনে দেখহ সেনা সংহারে সাক্ষাতে।।এইকালে শীঘ্র কর রাক্ষস সংহার।কোটি কোটি সৈন্য দেখ মারিল আমার।।এত শুনি কর্ণবীর চলিল সত্বর।হাতে ধনু করি উঠে রথের উপর।।মহাদম্ভ করি যায় রবির নন্দন।দেখি দুর্য্যোধন হৈল আনন্দিত মন।।তবে কর্ণ মহাবীর সন্ধান পূরিয়া।ঘটোৎকচ সন্নিধানে উত্তরিল গিয়া।।কোপে ঘটোৎকচ বীর গদা লয়ে করে।হুঙ্কার করিয়া ধায় সংগ্রাম ভিতরে।।গদার প্রহারে মারে বড় বড় রথী।নলবন দলে যেন মদমত্ত হাতী।।গলা ধরি ঘোড়া মারে করি কুম্ভে গদা।গর্জ্জিয়া গজেন্দ্র পড়ে, পাড়ে রণে গদা।।চরণের বীরদাপে বসুমতী কাঁপে।সাগর লঙ্ঘিতে যার শক্তি একলাফে।।বাণ নাহি বিন্ধে গায় উখড়িয়া পড়ে।ঘন ঘন সংগ্রামেতে সিংহনাদ ছাড়ে।।বিপরীত বীরবর মহা বক্রগতি।দেখি মহাকোপে ধায় অঙ্গদেশ পতি।।লইয়া একাঘ্নী অস্ত্র রবির তনয়।সন্ধান পূরিয়া মারে রাক্ষস হৃদয়।।অনল সমান চলে একঘাতী অস্ত্র।দেখি ঘটোৎকচ ভয়ে হইলা নিরস্ত্র।।পর্ব্বত হইয়া অস্ত্র আইসে ত্বরিতে।পড়িছে অনলকণা সে অস্ত্র হইতে।।বাণ দেখি রাক্ষসের উড়িল পরাণ।নিতান্ত ইহার হাতে নাহিক এড়ান।।নানা অস্ত্র এড়ে বীর বাণ কাটিবারে।মুষল মুদগর মারে অস্ত্রের উপরে।।সর্ব্ব অস্ত্র ব্যর্থ করি ধায় বাণপতি।বক্ষঃদেশ বিন্ধিলেক ঘটোৎকচ রথী।।বাণাঘাতে ব্যথিত হইল বীরবর।ডাকিয়া বলিল শুন পিতা বৃকোদর।।হেন বুঝি অন্তকাল হইল আমার।মৃত্যুকালে কি করিব তব উপকার।।এত শুনি বৃকোদর শোকেতে আকুল।ডাকিয়া বলিল চাপি পড় কুরুকুল।।বারকর্ম্ম করিয়াছ অতুল সংসারে।সম্মূখ সংগ্রামে পড়ি যাও স্বর্গপুরে।।এত শুনি ঘটোৎকচ হৈল ভয়ঙ্কর।দ্বাদশ যোজন দীর্ঘ করে কলেবর।।কুরুবল চাপিয়া পড়িল মহাশূর।লক্ষ লক্ষ রথ অশ্ব করিলেক চূর।।শত শত হস্তী পড়ে দীর্ঘ দীর্ঘ দন্ত।পদাতিক যত পড়ে নাহি তার অন্ত।।কুরুবল ক্ষয় করে ভীমের নন্দন।দেখি শোকাকুল তাহে যত বন্ধুজন।।দুই দলে হইল ক্রন্দন কোলাহল।প্রলয়ের কালে যেন সমুদ্র কল্লোল।।দ্বিতীয় প্রহর রাত্রি ঘোর অন্ধকার।এই কালে ঘটোৎকচ হইল সংহার।।রোদন করয়ে যত পাণ্ডবের সেনা।কুরুকুলে জয় জয় বাজিছে বাজনা।।দ্রোণপবর্ব সুধারস ঘটোৎকচ বধে।কাশীরাম দাস কহে পাঁচালীর ছাঁদে।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon