ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আজ্ঞাবহ হয়ে উদ্ধবের ব্রজপুরে আগমন

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আজ্ঞাবহ হয়ে উদ্ধবের ব্রজপুরে আগমনঃ
দ্ধব বৃষ্ণিকুলের শ্রেষ্ঠ মন্ত্রী, বৃহস্পতির শিষ্য, অতিশয় মেধাবী ও বাগ্মী এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পরম ভক্ত । একদিন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ উদ্ধবকে ডেকে তার হাতে হাত রেখে বললেন,” হে সৌম্য! তুমি শ্রীঘ্র ব্রজপুরে যাও। সেখানে আমার পিতা-মাতা রয়েছেন। আমার বিরহে তারা কাতর হয়েছেন। আমার সংবাদ প্রদান করে তাদের আনন্দ উৎপাদান কর। আমার অদর্শনে গোপীদের হৃদয়ে মন:পীড়ার সৃষ্টি হয়েছে। তাদেরকেও আমার সংবাদ শ্রবণ করিয়ে তাদের বেদনা নাশ কর। গোপীগণ আমার প্রাণ। তাদের মন আমাতেই অর্পিত। তারা আমার জন্য স্ত্রী-পুত্রাদি ত্যাগ করেছে। আমিই তাদের প্রাণ। আমিই তাদের দয়িত, শ্রেষ্ঠ ও আত্মা। তারা মনোদ্বারা আমাকে প্রাপ্ত হয়েছে। যে সকল ব্যক্তি তাদের ঐহিক ও পারত্রিক সুখ বির্জন দিয়েছে আমি তাদেরকে পালন করি। উদ্ধব! গোপীরা প্রিয়তম যাবতীয় বস্তুর মধ্যে আমাকে সবচেয়ে বেশী ভালবাসে। আমি দূরে অবস্থান করায় সকল গোপীগণ আমাকে স্মরণ করে মুগ্ধ হচ্ছে এবং তারা সকলেই আমার বিরহজনিত উৎকন্ঠায় বিমোহিত হচ্ছে। আমি যে আবার ফিসে আসব বলেছিলাম, এ কথা স্মরণ করে নিচিশ্চই তারা অতিকষ্টে কোনরূপে জীবন ধারণ করে আছে।” ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিকট হতে সন্দেশ বাক্য শ্রবণ করে উদ্ধব রথে আরোহন করে নন্দের গোকুলে যাত্রা করলেন। তিনি যখন ব্রজপুরে প্রায় আগত তখন সূর্য পশ্চিমদিকে ডুব ডুব করছে। গাভীরা খুরের দ্ধারা ধূলি আন্দোলিত করে গৃহে ফিরছে। তাদের ধূলোয় উদ্ধবের রথ আচ্ছন্ন হচ্ছে। রজ:স্বলা গাভীকে দেখে ব্রজের মত্ত বৃষগণ যুদ্ধ করছে। উধোভারাক্রান্ত গাভী সকল বৎস পালকদের নিকট দৌড়ে আসছে। শুভ্র গোবৎস সকল ইতস্তত: ছূটাছুটি করে ব্রজভুমির শোভা বর্ধন করছে। চারিদিকে গোদোহন ও বেণুধ্বন্বিত শব্দ হচ্ছে। তারমধ্যে “ত্যাগ কর, আনয়ন কর, দেও” ইত্যাদি শব্দ শ্রুত হচ্ছিল। সুসজ্জিত গোপ-গোপীগণ রাম ও কৃষ্ণের গুণগাধা করছে এবং ব্রজভূমি তাদের দ্ধারা শোভিত হচ্ছে। অগ্নি,সূর্য, অতিথি, গো, ব্রাহ্মণ, পিতৃ ও দেবগণ গোপদের ঘরে ঘরে অর্চিত হচ্ছে। তাদের গৃহসকল ধূপ দীপে অপরূপ শোভা ধারণ করেছিল। ব্রজের চারিদিকের পুষ্পিত বন হতে কুসুম ছড়াচ্ছে। পাখী ভ্রমরগণ তাতে খেলা করছে। হংস-কারন্ডবাকীর্ণ কমলকূলে উহার সমধিক শোভা হয়েছিল। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অনুচর উদ্ধবকে আসতে দেখে নন্দ আনন্দে তার নিকট গেলেন এবং আলিঙ্গন করে শ্রীকৃষ্ণ জ্ঞানেই তাকে অর্চন করলেন। তারপর নন্দ উদ্ধবকে পরমান্ন ভোজন করালেন। ভোজনের পর পদসম্বাহন দ্ধারা উদ্ধবের শ্রম দূরিভূত হলে নন্দ বললেন,“ হে মহাভাগ! আমার সখা শুরনন্দন বসুদেব কারামুক্ত হয়ে পুত্র-সুহৃদগণসহ কুশলে আছেন তো? পাপাত্মা কংস সর্বদাই সাধুগণকে ও যদুগণের প্রতি দ্বেষ করত। ভাগ্যক্রমে সে দূরাত্মা নিজ পাপে অনুজগণসহ নিহত হয়েছে। হে উদ্ধব। শ্রীকৃষ্ণ কি আমাদিগকে এবং তার মাতাকে স্মরণ করেন? তার সুহৃদ-সখা সে গোপগণকে কি স্মরণ করেন? তিনি নিজে যার নাথ সেই ব্রজ, গাভী, বৃন্দাবন ও গোবর্দ্ধন কি তার মনে পড়ে? বাসুদেব কি একবার স্বজন দর্শন করার জন্য গোকুলে আসবেন? তাঁর সুন্দর নাসিকাযুক্ত সহাস্য বদন আমরা দেখতে পাব কি? মহাত্মা শ্রীকৃষ্ণ আমাদিগকে দাবানল, প্রবল বাত বর্ষ, বৃষ, সর্প এবং অন্যান্য দুরতিক্রমণীয় মৃত্যু হতে রক্ষা করেছেন। শ্রীকৃ্ষ্ণের সে সকল বিবিধ বীর্য, লীলাসমূহ, বক্রদৃষ্টি, হাস্য ও বাক্য স্মরণ করলে আমাদের যাবতীয় কার্য নিস্তেজ হয়ে আসে। গোবিন্দের পদচিহ্নিত স্থানসমূহ দর্শন করলে আমাদের মন তন্ময় হয়ে উঠে। গর্গমুনির বচন শ্রবণে ইহা মনে হয় যে, রাম-কৃষ্ণ দুজনেই শ্রেষ্ঠ দেবতা। দেবগণের মহাপ্রয়োজন সিদ্ধ করার জন্য তিনি ধরাতলে অবতীর্ণ হয়েছেন। রাম-কৃষ্ণ অবলীলাক্রমে দশ সহস্র মত্ত হস্তীর বলশালী কংসকে এবং প্রখ্যাত দুই মল্রকে এবং গজপতিকে, পশুরাজ সিংহ যেমন পশুদিগকে বধ করে তেমনি অবলীলাক্রমে নিহত করিলেন। গজরাজ যেমন অবলীলাক্রমে ষষ্টি ভঙ্গ করে তেমনি কংসের তালত্রয় সম(প্রায় সত্তর হাত লম্বা)সুকঠিন ধনু ভঙ্গ করেন। যখন ব্রজনগরী বৃষ্টির কারণের বিধ্বস্ত হচ্ছিল তখন সপ্তাহকাল ব্যাপী এক হস্তে প্রকান্ড গিরি পর্বত ধারণ করে রেখেছিলেন। প্রলম্ব, ধেনুক, অরিষ্ট, তৃণাবর্ত্ত, বক প্রভৃতি বিখ্যাত দৈত্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণের হাতে নিহত হয়েছে। কৃষ্ণগতপ্রাণ নন্দরাজ কৃষ্ণের এ সকল বীরত্বগাধা কাহিনী স্মরণ করে আবেগ আপ্লুত হয়ে তার কন্ঠ জড়িত হয়ে আসছিল, চোখ অশ্রুপূর্ণ হয়ে উঠছিল। পুত্রের বিচিত্র চরিত্র শ্রবণ করে মা যশোদর নয়নও অশ্রুপূর্ণ হলো এবং পুত্রস্নেহে তার স্তন হতে দুগ্ধ ক্ষরণ হতে লাগল। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি নন্দ-যশোদার এরকম গাঢ় অনুরাগ দেখে উদ্ধব আনন্দে বললেন,“ হে নন্দ! ইহ লোকে তোমারা দুজনেই শ্লাঘ্যতম (প্রধান ভক্ত/আত্মপ্রংসা/)কারণ অখিলগুরু নারায়ণে তোমাদের এত মতি রয়েছে। রাম ও কৃষ্ণ পরম পুরুষ ও প্রকৃতি; বিশ্বের বীজ; অনাদি। ভূতগণে প্রবিষ্ঠ হয়ে তদুপহিত বিবিধ ভেদ ও জীবের নিয়ন্তা তারাই। লোকে প্রাণত্যাগকালে ক্ষণকাল মাত্র যার প্রতি বিশুদ্ধ ও অবিশুদ্ধ মন সমাবেশিত করে কর্মবাসনা অগ্নিতে আহুতি দিয়ে স্বরুপজ্ঞানবান ও শুদ্ধসত্ত্বমূর্তি হয়ে পরা গতি প্রাপ্ত হওয়া যায়। যিনি অখিলের আত্মা ও কারণ এবং প্রয়োজনবশে যিনি অবতাররূপ গ্রহণ করেন, তোমরা দুজনেই সে ভগবান নারায়ণে একান্ত ভক্তি করছ, অতএব তোমাদের নিজ কার্যের আর কি অবশিষ্ট আছে? হে গোপরাজ! ভগবান যাদবপতি শ্রীকৃষ্ণ শ্রীঘ্রই ব্রজে আসবেন এবং পিতামাতার প্রিয় সাধন করবেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রঙ্গমধ্যে সর্বযাদবগণের শত্রু কংসকে বধ করে তোমাদের নিকট আগমনপূর্বক যা বলেছিলেন তা তিনি সত্য করবেন। তোমরা দু:খ করিও না। অচিরেই তিনি ব্রজে আসবেন। কাষ্ঠমধ্যে অগ্নির ন্যায় তিনি সকলে অন্তরে বিরাজ করেন। তিনি সকলে প্রতি সমদর্শী, তিনি অভিমানশূন্য, কেহ তার প্রিয় বা অপ্রিয় নয়, কেহ তার উত্তম নয় বা অধম নয়। তার পিতা, মাতা, ভার্যা, পুত্রাদি, অথবা আত্মীয়-অনাত্মীয়, দেহ, জন্ম কিছুই নেই। তার কোন কর্মও নেই। তিনি জন্মরহিত হয়েও ক্রীড়াবশে সাধুগনের রক্ষার্থে সাত্তিক, রাজসিক ও তামসিক যোনিতে অথবা দেবতা, মৎস্যাদি ও নৃসিংহাদি যোনিতে আবির্ভূত হয়ে থাকেন। তিনি ক্রীড়াতীত ও গুণাতীত হয়েও ক্রীড়া করে সত্ত্ব, রজ: ও তম গুণের ভজনা করেন এবং সে গুণ দ্বারাই সৃজন, পালন ও ধ্বংস করেন। কুম্ভকারের ঘূর্ণায়মান চক্রে দৃষ্টে নিক্ষেপ করলে যেমন মনে হয় সমস্ত ভূমিই ঘুরছে বলে মনে হয় তেমনি চিত্ত কর্তা হলেও অহংদৃষ্টিনিবদ্ধ মানব আত্মাকেই কর্তা বলে মনে করে থাকে। ভগবান হরি কেবল তোমাদেরই পুত্র নয়; তিনি সকলেরই পুত্র, আত্মা, পিতা, মাতা এবং তিনিই ঈশ্বর। ভূত, ভবিষ্য, বর্তমান, স্থাবর, জঙ্গম, বড় ছোট যা কিছু দৃষ্ট ও শ্রুত হয় একমাত্র অচ্যুত ব্যতীরেকে কোন বস্তুই নেই, তিনিই ঐ সকল, তিনিই পরমাত্মস্বরূপ। হে রাজন! নন্দ ও উদ্ধবের আলাপচারিতায় রজনী অতিবাহিত হলো। নিশাবসানে গোপবধূগণ ঘুম হতে উঠে গৃস্থালী কাজ সম্পন্ন করে দধিমন্থন আরম্ভ করল। গোপীগণের মুখম্ডল অরুণবর্ণ কুম্কুমে রঞ্জিত ছিল এবং কর্ণ কুন্ডলের কিরণচ্ছটা্য় কপোলদেশ অধিক শোভা প্রাপ্ত হয়েছিল। তাদের কাঞ্চী প্রভৃতিতে মণি সকল প্রজ্জলিত দীপের আভায় উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল। গোপীদের কঙ্কণমালায় অলঙ্কৃত ভুজযুগ দ্বারা মন্থনরজ্জু আকৃষ্ট হয়ে তাদের নিতম্ব, স্তন ও হারগুচ্ছ সকল হেলিতে দুলিতে লাগল। ব্রজাঙ্গনাগণ পদ্মপলাশলোচন ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে উদ্দেশ্য করে গাওয় গীত ধ্বনী ও দধিমন্থন ধ্বনীর শব্দ একত্রে মিলিত হয়ে আকাশ মন্ডল স্পর্শ করল। সে গীতের প্রভাবে সকল অমঙ্গল দূরীভূত হয়। ভগবান সূর্যদেব উদিত হলে ব্রজনারীগণ ব্রজদ্ধারে স্বণখচিত রথ দেখে বলল- এ রথ কার? ব্রজনারীরা বলল.“ যে ব্যক্তি কংসের প্রয়োজনে আমাদের কৃষ্ণকে আমাদের কাছ হতে মথুরায় নিয়ে গিয়েছিলেন সে অক্রুর কি আবার এসেছেন? আমাদের দেহ দ্ধারা কি অক্রুর মৃত প্রভু কংসের পিন্ডদান করবেন? ইতোমধ্যে উদ্ধব আহ্নিক সম্পন্ন করে তথায় আগমন করলেন। আজানুলম্বিত বাহু, নবীন পদ্মতুল্য নয়ন, পীতম্বর, পদ্মমালী, সুন্দর বদন সেই উদ্ধবকে দেখে ব্রজনারীরা বিস্মিত হলো। তারা বলাবলি করতে লাগল,“ কে এই সুদর্শন পুরুষ? কোথা হতে এসেছেন? কার দূত? তার বেশভূষা দেখছি আমাদের অনিন্দ্যসুন্দর শ্রীকৃষ্ণের মত।তারা তাকে ঘিরে দাড়াল। যখন তারা বুঝতে পারলেন উদ্ধব শ্রীকৃষ্ণের বার্তাবাহক হয়ে এখানে এসে্ছেন তখন ব্রজনারীরা সলজ্জ হাস্য ও সুমিষ্ট বাক্যে তাকে অর্চন করলেন। গোপীরা তাকে নিরাময় প্রশ্ন করে বলল,“ আমরা জেনেছি, আপনি যদুপতি কৃষ্ণের সেবক। পিতামাতার প্রিয় করতেই আপনার প্রভূ আপনাকে এখানে প্রেরণ করেছেন। এছাড়া এ ব্রজে তার আর কিছূ স্মরণীয় দেখি না। যারা সংসার ত্যাগী মুনি, বন্ধুর প্রতি স্নেহাকর্ষন তাদেরও থাকে- সে স্নেহ তারও ত্যাগ করতে পারে না। অন্যের সহিত মিত্রতা কেবল কার্যানুসারেই করা হয়। স্ত্রীগণের সহিত পুরুষের মিত্রতা, পষ্পরাজির সহিত ভ্রমরগণের মিত্রতারই অনুরূপ। বারবধূ- নির্দ্ধন ব্যক্তিকে, প্রজাগণ- অসমর্থ রাজাকে, কৃতবিদ্যা ব্যক্তি গুরুকে এবং পুরোহিত- দক্ষিণাদানান্তে যজমানকে পরিত্যাগ করে; বিহঙ্গেরা ফলশূন্য বৃক্ষ ছাড়িয়া যায়, অতিথি ভোজনান্তেই গৃহ পরিত্যাগ করে, মৃগগণ দগ্ধ অরণ্য ছেড়ে যায় এবং জারগণ সম্ভোগান্তে অনুরক্ত অতুপ্ত কামনিীকে পরিত্যাগ করে থাকে। সাধারণত এ সকল কার্যই দৃষ্ট হয়ে থাকে। ব্রজনারীগণের বাক্য, কায় ও মন সম্পূর্ণভাবে গোবিন্দে অর্পিত ছিল। কৃষ্ণদূত উদ্ধব ব্রজে আগমন করলে শ্রীকৃষ্ণের বাল্য ও কৈশোরের কর্মসমূহ স্মরণ করতে করতে নির্লজ্জ হয়ে লৌকিক ব্যবহার পরিত্যাগ করে রোদন করতে লাগল। প্রিয়ের আগমন আসন্ন চিন্তা করতে করতে কোন এক গোপী ভ্রমরকে দেখে, প্রিয় যেন তাকে দূত প্রেরণ করেছে এরূপ কল্পনা করে বলতে লাগল,“ হে ধূর্ত্তের বন্ধু! আমাদের চরণ স্পর্প করিও না। আমাদের সপত্নীর কুচমন্ডলে শ্রীকৃষ্ণের যে বনমালা বিলুন্ঠিত হয়েছে, তোমার শ্মশ্রুতে তার কুম্কুম রয়েছে; মধুপতি সে সকল মাননীদিগকেই প্রসন্ন করুন। আমাদিগকে প্রসন্ন করে কি হবে? তুমি তোম যদুপতি দূত? এখানে কেন আগমন? তোমার জন্যই তো তিনি যদু সভায় উপহাসাস্পদ হবেন। তুমি যেমন পু্ষ্পের মধু নি:শেষিত করে পুষ্পকে ত্যাগ কর, তেমনি যদুপতি আমাদিগকে একবার মাত্র তার মোহিনী অধর-সুধা পান করিয়ে আমাদিগকে ত্যাগ করেছেন। স্বয়ং লক্ষ্মী যার চরণরেণুর উপাসনা করেন, আমরা আর কে? কিন্তু যিনি দু:খীর প্রতি দয়াশীল ‘উত্তম:শ্লোক’ শব্দটি তার প্রতিই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। হে ভ্রমর! তুমি আমার চরণে তোমার মাথা রাখিও না। তুমি শ্রীকৃষ্ণের নিকট হতে দৌত্য কর্ম ও প্রিয় বচন দ্ধারা প্রার্থনা করতে খুবই চতুর। তোমার সকল বিষয়েই জানলাম। তুমিও কৃষ্ণের মত অবিশ্বাসী। যার জন্য আমারা গৃহ, পতি-পুত্র সবই ত্যাগ করেছি, তার সাথে আবার সন্ধি কিসের? হে ভ্রমর! তার হৃদয় ব্যাধের ন্যায় কঠোর। ব্যাধ যেমন বিনা অপরাধে পক্ষীকে হত্যা করে তেমনি তিনি রামাবতারে বনবাসী হয়ে অঙ্গদকে উপলক্ষ করে বালীকে রাজাকে নিহত করেন। স্ত্রীর বশবর্তী হয়ে (অর্থাৎ সীতার অনুরোধে)সুর্পণখার কর্ণ ও নাসিক কর্তন করেছিলেন। বলি রাজার উপহার গ্রহণ করিয়াও তাকে কাকবৎ আচরণে তাকে বন্ধনপূর্বক পাতালবাসী করেছিলেন। সেই কৃষ্ণবর্ণের সহিত আমাদের সখ্যতার প্রয়োজন নেই। যার কথা অমৃতস্বরুপ, তার কণিকামাত্র একবার পান করলে বা শ্রবণ করলে তাদের রাগ-দ্বেষ দ্বন্দ্ব মোহ বিনষ্ট হয়ে যায়; কত যোগী ব্যক্তি তার অমৃতকথা একবার মাত্র শ্রবণ করে সকল দ্বীন ও কুটম্বগণকে পরিত্যাগ করে অরণ্যচারী পাখির ন্যায় ভিক্ষা করে কোনরকম জীবন ধারণ করে। কিন্তু আমরা যে নিরুপায়, আমরা কি করিব? আমার যে কৃষ্ণবর্ণ মানুষটির কথা স্মরণ না করে থাকতে পার না। সে হরিকথা যে এমন সর্বনাশী তা জেনেও আমার তা ছাড়তে পারছি না। যেমন কৃষ্ণসার হরিণ বধূগণ ব্যাধের মধুর গীতে মুগ্ধ হয়ে শর বিদ্ধ হয়ে যাতনা ভোগ করে, তেমনি সেরূপ আমরাই সেই কঠিনের (শ্রীকৃষ্ণে)বাক্য সত্য মনে করে প্রণয়কথা স্মরণ করে বার বার মদনব্যথা সহ্য করছি। হে দূত! সুতরাং তুমি কৃষ্ণালাপ ব্যতীত অন্য কথা বলো। হে ভ্রমর! তুমি আরবর কোথায় চলে গেলে? তোমার সখা শ্রীকৃষ্ণ কি তোমারক আবার আমাদের কাছে প্রেরণ করেছেন? দেখ, তুমি আপাদের পূজনীয়। আমাদেরকে বল কি তোমার অভিলাষ? তুমি কি আমাদিগকে মধুপুরে কৃষ্ণসঙ্গ লাভের জন্য নিয়ে যেতে চাও? কিন্তু সেখানে কেন আমাদিগকে নিয়ে যাবে? তিনি তো অপর নারীর সংসর্গ ছাড়া কখনই একা থাকতে পারেন না। লক্ষ্মী তো সতত তার বক্ষস্থলে বিরাজমান। এ সকল কথা বলে উক্ত গোপীনি কিছুটা অপ্রকৃতস্থ হয়ে সরলভাবে গাম্ভীর্য ও দীনতার সাথে উদ্ধবকে বলল,“ হে মৌম্য! আর্যপুত্র শ্রীকৃষ্ণ কি এখনও মধুপুরে আছেন। তিনি কি পিতৃগৃহ ও গোপদিগকে স্মরণ করেন? আমরা তার দাসী ছিলাম, তিনি কি আমাদের কথা স্মরণ করেন? তার অগুরু-সুগন্ধি বাহু কবে আমাদের মস্তকে স্থাপন করবেন? উদ্ধব কৃষ্ণগত প্রাণ ব্রজনারীদের এ সকল কথা শ্রবণ করে কৃষ্ণদর্শনে অভিলাষিণী গোপিগণকে সান্তনা দিতে দিতে বললেন,“ অহো! এ জগত সংসারে তোমরা লোকপূজিতা এবং কৃতার্থ হয়েছে। কারণ তোমাদের মনপ্রাণ সম্পূর্ণভাবে ভগবান বাসুদেবে অর্পিত হয়েছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। হে অবলাগণ! দান, ব্রত, তপস্যা, জপ, হোম, বেদ অধ্যয়ন, ইন্দ্রিয়নিগ্রহ এবং অন্যান যে কোন পবিত্র কর্মের অনুষ্ঠান দ্ধারা ভগবান শ্রীকৃষ্ণে প্রতি ভক্তি সাধনেরই পথ। সৌভাগ্যবশত: তোমরা সেই উত্তম:শ্লোকের প্রতি মুনিগণদুর্লভ অতুৎকৃষ্ট যে ভক্তি , তাই লাভ করেছ। কারণ পতি, পুত্র, দেহ, স্বজন ও গৃহাদি বিসর্জনপূর্বক ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি তোমরা যেভাবে আত্মসমর্পণ করেছ তোমাদের পক্ষে এর থেকে আর কি সৌভাগ্যের বিষয় হতে পারে? ব্রজের গোপীগণের সহিত উদ্ধবের কথোপকথন: হে সৌভাগ্যবতীগণ! শ্রীকৃষ্ণের প্রতি তোমাদের প্রগাঢ় প্রেম ও ভক্তি জন্মিয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের প্রতি তোমাদের বিরহ আমার প্রতিও অনুগ্রহ প্রদান করেছে; কারণ সেজন্যেই আমিও ভগবৎপ্রেমিকাদের মুখদর্শন করতে পারলাম। হে সাধ্বাগণ! এখন আমি তোমাদের কা্ছে সেই সুখময় সংবাদ প্রকাশ করব যা আমি আমার প্রভুর কাছ থেকে বহন করে নিয়ে এসেছি। তা শ্রবণ করলে অবশ্যই তোমাদের মনে সুখ উৎপাদন হবে। তোমাদের ভর্ত্তা শ্রীকৃষ্ণের সকল গুহ্য কার্যই আমি সম্পাদন করে থাকি। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,“ হে গোপীগণ! আমার সহিত তোমাদের বিচ্ছেদ হয়নি। কারণ আমি সর্বাত্মা। আকাশাদি অর্থাৎ আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জর ও বায়ু পঞ্চমহাভূত যেমন সকল ভূতের আশ্রয়, আমিও তেমনি মন, প্রাণ, বুদ্ধি, ইন্দ্রিয় ও গুণগণের আশ্রয়রূপে সকল হৃদয়ে বিরাজ করি। আমি আমার অচিন্ত্য শক্তির প্রভাবে পঞ্চভূত, ইন্দ্রিয় ও গুণস্বরূপ নিজের দ্ধারা নিজেকেই সৃষ্টি করি, পালন করি এবং কখনও বা ধ্বংস করি। জীবের আত্মা শুদ্ধ জ্ঞানময়, কারণ গুণ কখনও তাকে স্পর্শ করতে পারে না।; তিনি চৈতন্যস্বরূপ। শুদ্ধ, সুযুপ্ত, স্বপ্ন ও জাগরণরূপ মনোবৃত্তি দ্ধারাই তিনি বিশ্বতৈজস প্রাজ্ঞরূপে প্রতীয়মান হন। নিদ্রাভঙ্গে প্রবুদ্ধ ব্যক্তি যেমন অলীক স্বপ্ন দেখে মনে মনে সুখ, দু:খ অনুভব করে, সেরূপ মায়াময় ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষয় জালে জীবাত্মা যে অবস্থায় আবদ্ধ হয় সর্বাগ্রে সে মন ও ইন্দ্রিয়কে দমন করা কর্তব্য অর্থাৎ মনই অলীক স্বপ্নের মত বিষয়ের আরাধনা কর, মনের নিরোধই সর্বশাস্ত্রের তাৎপর্য বাক্য। এই মনোনিরোধই বেদোক্ত কর্মকলাপ, অষ্টাঙ্গযোগ, সাংখ্য, সন্ন্যাস, তপস্যা, ইন্দ্রিয়দমন এবং সত্য এ সমস্ত ব্যাপারে নদীসমূহের সমুদ্রে মিলিত হওয়ার মত। এক মনের নিরোই সকলে পরিসমাপ্তি হয়। হে সুন্দরীগণ! আমি যে তোমাদের দৃষ্টির আড়াল আছি, আমাকে ধ্যানের দ্ধারা তোমার আমার নৈকট্য লাভ করবে এটি হচ্ছে উদ্দেশ্য। প্রিয়তম দূরে অবস্থান করলে স্ত্রীগণের মন যেমন আবিষ্ট হয়, নিকটবর্তী বা দৃষ্টির গোচরে থাকলে স্ত্রীগণের মন তেমন আবিষ্ট হয় না। তাই তোমরা মনকে বিষয়বৃত্তি হতে নিবৃত্ত করে নিরন্তর আমাতে মন সন্নিবেশিত করে নিত্য ধ্যান করতে করতেই শ্রীঘ্রই আমাকে প্রাপ্ত হবে। হে কল্যাণীগণ! বৃন্দাবনের মধ্যে নিশীথকালে আমি যখন রাসক্রীড়া করছিলাম, তখন যে সকল ব্রজস্ত্রীগণ স্বজনের প্রতিবন্ধকতায় রাসক্রীড়ায় আসতে পারেনি, তারা আমার লীলা চিন্তায় দেহ ত্যাগ করে আমাকেই প্রাপ্ত হয়েছে। ব্রজনারীগণ প্রিয়তম শ্রীকৃষ্ণের আদেশবার্তা শ্রবণ করে তাদের চিত্ত আশ্বস্ত হলো এবং স্মৃতিপটে ক্রমশ: ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলাসমূহ উদ্ভাসিত হতে লাগল। গোপীনিগণ প্রসন্নচিত্তে উদ্ধবকে বলল,“ হে সৌম্য! সৌভাগ্য এই যে, যদুকুল বিদ্বেষী কংস অনুরচসহ নিহত হয়েছেন। শ্রীকৃষ্ণ এখন কুশলে আছেন ইহাই আমাদের কাছে সুখের বিষয় সন্দেহ নেই। শ্রীকৃষ্ণ আমাদের প্রতি যে ভালবাস প্রদর্শন করতেন মধুপুরীর কামিনীদিগের প্রতিও কি সেরূপ ভালবাসে? তিনি কি সে সকল অঙ্গনার স্নিগ্ধ ও সলজ্জ হাস্যসহ উদার অবলোকন করে আমাদের মত তার অর্চনা করেন? শ্রীকৃষ্ণ রতিবিশেষজ্ঞ। পুরকামিনীদের প্রিয় এবং তাদের বাক্য ও বিলাসাদি দ্ধারা পূজিত হবেন এতে আর সন্দেহ কি? হে সাধু! আমরা গ্রাম্যনারী। পুরস্ত্রীগণের সভায় কথাচ্ছলে কি গোবিন্দ কখনও আমাদেরকে স্মরণ করেন? তখন অন্য বিদগ্ধ গোপনারী বলল,“ হে উদ্ধব! কুমুদ-কুন্দ-পুষ্প ও শশাঙ্ক সুশোভিত বৃন্দারণ্যের বিপিনমধ্যে শ্রীকৃষ্ণ যখন নিশীতকালে রাসক্রীড়া করতেন, আমাদের চরণে-নূপুর শিঞ্জিত হতো। তারমধ্যে গোবিন্দ কত মনোমুগদ্ধকার কথা বলতে বলতে আমাদের সাথে ক্রীড়া করতেন। সে সকল রাত্রির কথা কি তিনি এখনও স্মরণ করেন? আমরা সকল গোপনারী রাসচক্রে তার মনোমুগ্ধকর কথা শুনে স্তব করেছিলাম। হে সাধুবর! ইন্দ্র যেমন অমৃতবর্ষণ দ্ধারা নিদাঘতপ্ত বনরাজিকে সঞ্জীবিত করেন, সেরূপ জগত সংসারের পালক ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কি স্বকীয় সুখময় করস্পর্শাদি দ্ধারা আমাদের তাপিত অঙ্গকে সুশীতল করার জন্য এ ব্রজধামে আগমন করবেন?” অপর গোপনারীগণ বলল,“ সখি! তুমি কি বলছ। তিনি তার শক্র ধ্বংস করেছেন। রাজ্য লাভ করেছেন। রাজ-কন্যাদিগকে বিবাহ করে, বন্ধু-বান্ধবে পরিবেষ্ঠিত হয়ে মথুরাপুরে পরম সু্খে জীবন যাপন করছেন। তিনি এমন ঐশ্বর্য সুখ পরিত্যাগ করে তিনি কেন এখানে আসবেন?” অপর কোন কামিনী বলল,“ সখিগণ তোমরা প্রকৃত তত্ত্ব অবগত নও। শ্রীকৃষ্ণ পূর্ণকাম এবং সকলের আশা পূরণের সার্মথ্য, তিনি ধারণ করেন। তিনি জিতেন্দ্রিয়। আমরা বনচারিনী কি তার অভিলাষ পূর্ণ করতে পারি? রাজকন্যা বা অন্য কোন গোপীনারী দ্ধারা প্রয়োজন সিদ্ধ হতে পারে না। হবার নয়। পিঙ্গলা নামক স্মৈরিণী বলেছিল- নৈরাশ্যই পরম সুখ। আমরা তা জানি। কিন্তু তারপরও আমরা আশা যে ছাড়তে পারছিনা। আমরা কি করব? আমারদের কি করা উচিৎ। সেই উত্তমশ্লোক ভগবানের লীলাবার্ত্তা শ্রবণে কার না ইচ্ছা হয়। যিনি ইচ্ছা পোষণ না করলে স্বয়ং কমলাও যার অঙ্গ পরিত্যাগ করতে পারে না। আর সে অচ্যুতকে আমরা বিস্মৃত হতে পারলে ক্লেশ হয় না কিন্তু আমাদের তো বিস্মরণ ঘটছে না। আমরা যে ভুলতে পারছিনা। হে প্রভো উদ্ধব! ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলরামসহ এ নদী, পর্বত, সরোবর ও বনপ্রদেশ বিচরণপূর্বক বেণুধ্বনি করে গাভী বিচরণ করতেন। সে সকল স্থানে তার অপূর্ব শোভাবিশিষ্ট পদ চিহ্নই অবলোকন করেই স্মৃতি পটে উদবাসিত হচ্ছে এবং বার বার মনে পড়ছে। কিছুতেই তো তাকে ভুলতে পারছিনা। হে উদ্ধব! শ্রীকৃষ্ণের মনোহর গতি, উদার হাস্য, লীলাবলোকন ও মধুর বচন আমাদের চিত্ত হরণ করেছে; তাই কেমন করে তাকে বিস্মৃত হবো? হে কৃষ্ণ! হে নাথ! হে ব্রজনাথ! হে আর্ত্তিনাশক! হে গোবিন্দ! এ গোকুল দু:খ সাগরে নিমগ্ন হয়ে আছে, তুমি এসে গোকুলকে উদ্ধার কর। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সন্দেশ বার্তা শ্রবণ করে ব্রজনারীগনের বিরহ ব্যাথা প্রশমিত হলো। উদ্ধবের উপদেশাবলী শ্রবণ করে জানতে পারলেন যে শ্রীকৃষ্ণ ইন্দ্রয়াতীত, স্বয়ং পরমাত্মা। তাই তারা উদ্ধবকে গুরুজ্ঞানে পূজা করলেন। তারপর কয়েক মাস উদ্ধব গোকুলে অবস্থান করে গোকুলবাসীকে কৃষ্ণ-লীলা-কথা শুনিয়ে পরম আনন্দ দান করলেন। ভগবদ্ভক্ত উদ্ধব যতদিন ব্রজপুরে অবস্থান করেন ততদিন কৃষ্ণের লীলা কীর্তন করেছিন, সে সকল দিন তাদের কাছে ক্ষণ তুল্য মনে হয়েছিল। উদ্ধব ব্রজের নদী, বন, পর্বত, ও পুষ্পিত কানন দেখে দেখে ব্রজবাসীগণকে শ্রীকৃষ্ণের কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন। গোপীকামিনীদের চিত্ত শ্রীকৃষ্ণেই আসক্ত, শ্রীকৃষ্ণের জন্যই তারা ব্যাকুলিত, কৃষ্ণ বিরহে তাদের যত কাতরতা দর্শনে অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে তাহাদিগকে নমস্কার করার পূর্বেই এরূপ গান করেছেন যে- এ গোপবধূগণ যখন শ্রীকৃষ্ণে এরূপ চিত্ত সমর্পণ করতে সক্ষম হয়েছে, তখন জগতে তাদের জন্মই সার্থক। সংসার বিমুখ মুনিগণ এবং আমাদের মত অভক্তেরাও চিরকাল প্রার্থনাই করছি কিন্তু কৃপা লাভে সমর্থ হচ্ছি না। অখিলাত্মা গোবিন্দে গোপীদের সেই পরম প্রেম জন্মেছে। হরি কথায় যার অনুরাগ আছে, তার ব্রহ্মজন্মে প্রয়োজন কি? এ সকল গোপকামিনী বনচারনিী; ব্যভিচারে দোষিত, ইহারাই বা কোথায়? আর পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণের পরম প্রেমই বা কোথায়? ঈশ্বর ভজনশীল অজ্ঞ ব্যক্তিরও পরম মঙ্গল করেন, না জেনে অমৃত পান করলে তাতে মঙ্গল লাভ হয়ে থাকে। রসোৎসবে ভগবানের ভুজদন্ড যাদের কন্ঠার্পিত হয়েছিল, যারা পরম মঙ্গল লাভ করেছিল, সে সকল ব্রজনারীরা যে প্রসাদ লাভ করেছিল-অন্যান্য কামিনীদিগের কথা দুরে থাক, যিনি শ্রীহরির একান্ত অনুরাগভাজন হয়ে বক্ষ:স্থলে বাস করেন, সেই লক্ষ্মীও সে প্রসাদ পান না; পদ্মগন্ধা ও পদ্মবর্ণা দীপ্তিমতী স্বর্গকামিনীগণও পান না। এ সকল গোপীনিগণ দুস্ত্যজ ও আত্মীয়স্বজন, পতি-পুত্রাদি পরিত্যাগ করে, বেদে যার অন্বেষণ করতে হয়, সে গোবিন্দপদবী ভজনা করছে; সুতরাং বৃন্দাবনের বনমধ্যে যে গুল্ম, লতা এবং ওষধি ইহাদিগের চরণরেণু সেবা করছে, আমি যেন তাদের মধ্যেও কেহ হয়ে বৃন্দাবনে বাস করতে পারি। লক্ষ্মী দেবী যার অর্চনা করেন এবং ব্রহ্মাদি আপ্তকাম মুনিগণ মানসমন্দিরে যার অর্চনা করেন। ভগবানের সেই চরণ-কমল ইহারা রাসোৎসবে কুচমন্ডলে আলিঙ্গন করে সন্তাপ দূর করেছিলেন। আমি সেই সকল নন্দগোকুলস্থ গোপবনিতগণের চরণরেণু বার বার প্রণাম করি যাদের হরিকথা-গান ত্রিভুবনকে পবিত্র করছে। উদ্ধব কিছুদিন গোকুলে কাটিয়ে পরে গোপীগণ, নন্দ ও যশোদার কাছ হতে বিদায় নিয়ে মথুরায় যাত্রা করার উদ্দেশ্যে রথে আরোহন করলেন। তার যাত্রাকালে নন্দাদি গোপবৃন্দ রামকৃষ্ণের জন্য উপটৌকনসমেত তার সমীপে আগমনপূর্বক অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন,“ হে উদ্ধব! আমাদের একান্ত প্রার্থনা আমাদের মন প্রান সকল যেন কৃষ্ণপাদপদ্মকে আশ্রয় করে থাকে, বাক্য যেন তার গুণগাথাই গান করে এবং দেহ যেন কৃষ্ণপ্রণামাদি কার্য্যে রত থাকে। ঈশ্বরের ইচ্ছায় নিজ নিজ কর্মবশে যে কোন যোনিতেই জন্মগ্রহণ করি, আমাদের মঙ্গল কার্যের অনুষ্ঠান ও দানাদি দ্ধারা ভগবান শ্রীকৃষ্ণেই যেন আমাদের মতি থাকে।” গোপগণ কর্তৃক কৃষ্ণভক্তি দ্ধারা এ রূপে পূজিত হয়ে, উদ্ধব পুনরায় কৃষ্ণ পালিতা মথুরায় আমন করলেন। পরে শ্রীকৃষ্ণকে প্রণাম করে ব্রজবাসীগণের ঐকান্তিক ভক্তির কথা নিবেদন করে তাদের প্রদত্ত উপহার সমাগ্রী বাসুদেব, বলরাম ও রাজার সমীপে অর্পণ করলেন।
Previous
Next Post »

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র