বাসুদেব কৃষ্ণ

বাসুদেব ভগবান শ্রীকৃষ্ণ :মহাভারতের এক মহান চরিত্র শ্রীকৃষ্ণ। উগ্রসেনের পুত্র কংস অত্যন্ত দূরাচারী ছিলেন। বড় হয়ে পিতাকে রাজ্যচুত্য করে সিংহাসন দখল করেন। কংস তার ভগিনী দেবকীর সহিত বসুদের ধূমধাম করে বিবাহ দেন। রথে চড়ে ভগিনী ও বাসুদেবকে নিয়ে যাওয়ার সময় দৈববাণী হয় যে, দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান কংসকে হত্যা করবে। এ বাণী শ্রবণ করা মাত্রই দেবকীকে হত্যা করতে উদ্যত হন কংস। বাসুদেবের প্রচেষ্টায় দেবকীকে কংসের হাত থেকে বাঁচালেও একে একে ছয়টি সন্তানকে কংস হত্যা করে। সপ্তম গর্ভকে বিষ্ণু বসুদেবের দ্বিতীয় স্ত্রী রোহীনি গর্ভে স্থানান্তর করেন। কংসসহ সকলেই জানল দেবকীর গর্ভপাত হয়েছে। সপ্তম গর্ভের এ সন্তান বলরাম নামে খ্যাত। অষ্টম গর্ভের সন্তান জন্ম লাভ করার পূর্বে ভগবান স্বয়ং দেবকী ও বসুদেবকে সাক্ষাত দর্শন দেন এবং তার গর্ভের সন্তানকে নন্দালয়ে রেখে যশোদার সদ্যজাত কন্যাকে এখানের নিয়ে আসার জন্য বলেন। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণা অষ্টমী তিথিতে কৃষ্ণের জন্মের সংগে সংগেই বসুদেব কৌশলে কারাগার হতে অষ্টম সন্তান কৃষ্ণকে নিয়ে নন্দালয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। শীষনাগ পথপ্রদর্শক হিসেবে সাহায্য করে এবং যমুনার জলও শুষ্ক হয়ে যায়। বসুদেব যমুনা অতিক্রম করে যশোদার অজান্তে সন্তান পরিবর্তন করে, কারাগারে দেবকীকে যশোদার কন্যাকে দিয়ে যান। কংস কন্যার জন্মের সংবাদ পেয়ে সাথে কারাগারে চলে আসেন এবং কন্যাকে পাথরের উপর নিক্ষেপ করে হত্যা করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু শিশুকন্যা নীচে না পড়ে উপরে উঠে যায় এবং বলে “আমি যোগমায়া, তোমাকে যে সন্তান হত্যা করবে অন্যত্র জন্ম গ্রহণ করেছে।” এ কথা বলে আকাশে অদৃশ্য হয়ে যায় যে। বসুদেবের পরামর্শে নন্দ বলরাম ও কৃষ্ণকে নিয়ে মথুরা ত্যাগ করে গোকুলে গমন করেন। তথায় ভ্রাতাদ্বয় একত্রে বড় হতে থাকেন।

কংস নিজের প্রান নাশের আশংকায় তার ভবিষ্যৎ হত্যাকরীর অনুসন্ধান করা অসম্ভব দেখে মথুরার সমস্ত শিশুদের হত্যা করার আদেশ দেন। পুতনা রাক্ষরীর সাহায্যে কংস অসংখ্য শিশুকে নিহত করেন। পুতনার বিষাক্ত স্তন পান করলেই শিশুরা মৃত্যুমুখে পতিত হত। কিন্তু কৃষ্ণ এ পুতনার স্তন এমনভাবে পান করেন যে, যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে পুতনা তৎক্ষণাৎ মৃত্যুমুখে পতিত হয়। কংস এইবার বুঝতে পারেন যে, কৃষ্ণই তার প্রধান শত্রু; সেজন্য নানা উপায়ে কৃষ্ণকে হত্যা করবার চেষ্টা করতে থাকেন। কংস নিয়োজিত , অঘাসুর,বকাসুর, বৎসাসুর ও অরিষ্ট প্রভৃতি দানবরা কৃষ্ণের হাতে নিহত হয়। এই সময়ে কৃষ্ণ কালীয় নাগকে দমন করে কালীয়দহের জল বিষমুক্ত করেন। কৃষ্ণের পরামর্শে গোপগণ ইন্দ্রে পূজা ত্যাগ করে, তাদের গোধনের আশ্রয়দাতা গোবর্ধনগিরির পূজা করায় ইন্দ্র ক্রুদ্ধ হয়ে গোবর্ধন পর্বত নিমজ্জিত করার জন্য ভীষণ বৃষ্টি ও বন্যার সৃষ্টি করেন। তখন কৃষ্ণ আঙ্গুলের উপর সাত দিন ধরে গোবর্ধন পর্বত ধারণ করে, ইন্দ্রকে পরাভূত করে গোপগণের গোধন ও গোকুল রক্ষা করেন।

অবশেষে কংস কৃষ্ণ-বলরামকে নিমন্ত্রণ করবার জন্য অক্রুরকে পাঠান। অক্রুর কৃষ্ণকে কংসের নিমন্ত্রণ ও গুপ্ত অভিসন্ধির কথা জানান। কৃষ্ণ ও বলরাম নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে মথুরায় চলে আসেন। মথুরায় দুই ভাই ক্রীড়াক্ষেত্রে প্রবেশ করলে কংস দুইজন মল্লযোদ্ধাকে এদের সংগে যুদ্ধ করতে বলেন। তাদের গোপন অভিসন্ধি ছিল যে, তারা কৃষ্ণ-বলরামকে পরাজিত করে হত্যা করবে। কংস গোপনে একটি হ্স্তীকে নিযুক্ত করেন। এই দুরভিসন্ধি নিয়ে যে, যেন প্রয়োজন হলে হস্তীটি এদের উভয়কেই পদদলিত করতে পারে। মল্লযোদ্ধারা কৃষ্ণ-বলরাম কর্তৃক পরাজিত ও নিহত হয় এবং হস্তীটিও তাদের হস্তে নিহত হয়। তারপর কংসের রক্ষীদের হত্যা করে কৃষ্ণ কংসকে নিহত করেন ও কারারুদ্ধ উগ্রসেনকে মুক্ত করে মথুরার সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। এরপর কৃষ্ণ-বলরাম মথুরায় পিতামাতার সংগে বাস করতে থাকেন। তারপর সান্দীপনি নামে এক বেদজ্ঞের কাছে কৃষ্ণ শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। সেইখানে তিনি পঞ্জজন্য নামে সমুদ্রচর দৈত্যকে বধ করে পাঞ্জজন্য শঙ্খ লাভ করেন। দ্বারকায় বিদর্ভরাজ ভীষ্কক-কন্যা রুক্সিণী কৃষ্ণকে মনে মনে পতিত্বে বরণ করে চরমুখে কৃষ্ণের নিকট সে সংবাদ পাঠান। কৃষ্ণ রুক্মিণকে বিবাহের প্রস্তাব করলে বিদর্ভরাজ ভীষ্মক তার পুত্র রুক্মীর অমতে এই বিবাহে অসম্মত হন। কৃষ্ণ-বলরাম স্বয়ংবর সভায় উপস্থিত হয়ে তৎকালীন প্রথানুযায়ী রুক্নিণীকে হরণ করেন। রুক্নিণী রাজা শিশুপালের বাগদ্ত্তা ছিলেন। শিশু পাল ঈর্ষান্বিত হয়ে কৃষ্ণের সহিত যুদ্ধ করেন। কিন্তু পরিশেষে পরাজিত হয়ে স্বরাজ্য প্রস্থান করেন। রুক্নিণীর গর্ভে কৃষ্ণের প্রদ্যুম্ন প্রমুখ দশ জন পুত্র ও চারুমতি নামে এক কন্যা হয়। রুক্নিণী ভিন্ন কৃষ্ণের জাম্ববতী , সুশীলা, সত্যভামা ও লক্ষ্মনা নামে চারটি প্রধানা স্ত্রী এবং যোল হাজার অপ্রধানা স্ত্রী ছিলেন।একবার সত্যভামার সহিত স্বর্গে ভ্রমণকালে সমুদ্রমন্থনোত্থিত পারিজাত বৃক্ষ কৃষ্ণ নিয়ে আসেন। এই বৃক্ষের অধিকারণী ছিলেন ইন্দ্রের স্ত্রী শচীদেবী। স্ত্রীর জিনিস উদ্ধারের জন্য ইন্দ্র কৃষ্ণের সহিত যুদ্ধ করেন বটে, কিন্তু কৃষ্ণ কর্তৃক পরাজিত হন। কৃষ্ণের এই কাহিনী হরিবংশ ও ভাগবতে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত আছে।

কৃষ্ণ পান্ডবদের মাতুলপুত্র । কুন্তী কৃষ্ণের পিসি। দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় তিনি উপস্থিত ছিলেন। এ স্বয়ংবর সভাতেই পান্ডবদের সহিত কৃষ্ণের প্রথম পরিচয় ও সম্প্রীতি স্থাপিত হয়। নিজের অসামান্য ব্যক্তিত্বের প্রভাবে পরিচয়ের সূত্র থেকেই পান্ডবরা কৃষ্ণের অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেন। পান্ডবরা ন্যায়ত: দ্রৌপদীকে লাভ করেছেন, এই অভিমত ব্যক্ত করে কৃষ্ণ সমবেত রাজাদের পান্ডবদের সংগে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হতে নিবৃত্ত করেন। কৃষ্ণের পরামর্শক্রমেই বনবাসকালে অর্জুন তার ভগিনী সুভদ্রাকে হরণ করে বিবাহ করেন। সুভদ্রার বিবাহোপলক্ষে কৃষ্ণ ইন্দ্রপ্রস্থে কিছুকাল বাস করেন। এই সময় অগ্নির অগ্নিমন্দা দুর করবার জন্য তারই প্রার্থনায় কৃষ্ণার্জুন ইন্দ্রের বাধা সত্ত্বেও খান্ডববন দাহন করেন। অগ্নি এই কাজের জন্য কৃষ্ণকে একটি চক্র ও কৌমোদকী নামে গদা দান করেন।মগধরাজ জরাসন্ধ কৃষ্ণের মহাপরাক্রান্ত শক্র ছিলেন। তার ভয়ে কৃষ্ণকে মথুরা ত্যাগ করে রৈবতক পর্বতের নিকট কুশস্থলীতে আশ্রয় নিতে হয়। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়যজ্ঞের পূর্বে কৃষ্ণ, ভীম ও অর্জুন ছদ্মবেশে মগধে যান ও সেখানে কৃষ্ণের পরামর্শানুযায়ী ভীম মল্লযুদ্ধে জরাসন্ধকে বধ করেন।যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়যজ্ঞের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে ভীষ্ম কৃষ্ণকে অর্ঘ্য দান করায় কৃষ্ণের পিতৃম্বসার পুত্র চেদিরাজ শিশুপাল ঈর্ষান্বিত হয়ে কৃষ্ণের নিন্দা করেন। পূর্বে কৃষ্ণ শিশুপালের শত অপরাধ মার্জনা করতে প্রতজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। এইবার তিনি চক্রদ্বারা শিশুপালের শিরচ্ছেদ করেন। পান্ডব-কৌরবদের অক্ষক্রীড়া সভায় কৃষ্ণ অনুপস্থিত ছিলেন। তখন তিনি শল্বরাজের সৌভনগর বিনষ্ট করতে ব্যস্ত ছিলেন। দ্যূতক্রীড়া সভায় বস্ত্র হরণকালে দ্রৌপদী লজ্জা থেকে ত্রাণ পাবার জন্য কৃষ্ণ, বিষ্ণু ও হরিকে ডাকেন; তখন স্বয়ং ধর্ম নানা বর্ণের বস্ত্রের রুপধারণ করে তাকে আবৃত করেন।যুদ্ধের প্রাক্কালে কুরুপান্ডব উভয় পক্ষই সাহায্যপ্রার্থী হয়ে দ্বারকায় কৃষ্ণের নিকট আসেন। কৃষ্ণ তখন নিদ্রিত ছিলেন। প্রথমে দুর্যোধন কৃষ্ণের শিয়রে একটি উৎকৃষ্ট আসনে এসে বসেন ও পরে অর্জুন এসে কৃষ্ণের পাদদেশে যুক্ত করে অপেক্ষা করতে থাকেন। কৃষ্ণ জাগ্রত হয়ে প্রথমে অর্জুন ও পরে দুর্যোধনকে দেখেন এবং উভয় কর্তৃক নিজ নিজ পক্ষে যোগদান করতে অনুরুদ্ধ হন। কৃষ্ণ তখন বললেন,” যদিও দুর্যোধন আগে এসেছেন, তবু অর্জুনকে তিনি আগে দেখেছেন। অতএব উভয়পক্ষকেই তিনি সাহায্য করবেন। একদিকে কৃষ্ণের দশকোটি দুর্ধর্ষ নারায়ণী সেনা ও অপরদিকে তিনি স্বয়ং নিরস্ত্র ও যুদ্ধবিমুখ - এই দুই পক্ষের মধ্যে নির্বাচনের জন্য বয়:কনিষ্ঠ বলে আগে অর্জুনকেই বরণ করলেন ও দুর্যোধন নারায়ণী সেনা নিলেন। যুদ্ধের প্রাক্কলে পান্ডবদের অনুরোধে কৃষ্ণ একবার শান্তির দৌত্য করেন, কিন্তু তা নিষ্ফল হয়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তিনি অর্জুনের সারথ্য গ্রহণ করেন। যুদ্ধের প্রাক্কালে তিনি অর্জুনকে যে ‍উপদেশ দিয়েছিলেন তাই ‘ভগবদগীতা’। এই যুদ্ধে তিনি বন্ধুভাবে পরামর্শ দিয়ে পান্ডবদের জয়ে সাহায্য করেন। দ্রোণ-বধের জন্য যুধিষ্ঠিরকে মিথ্যাভাষণের পরামর্শ ও অন্যায় যুদ্ধে দুর্যোধনের উরুভঙ্গের পরামর্শ দিতে তিনি কুন্ঠীত হন নি। কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধে অস্ত্রধারণ না করার প্রতিজ্ঞ সত্ত্বেও ‍তৃতীয় দিনের যুদ্ধে ভীষ্মের পরাক্রম দেখে তিনি স্বয়ং সুদর্শনচক্র হস্তে ভীষ্মকে বধ করতে অগ্রসর হন। ভীষ্ম সানন্দে তাকে অভ্যর্থনা করেন এবং অর্জুন সানুনয়ে তাকে নিবৃত্ত করেন। ভগদত্তের বৈষ্ণবাস্ত্র নিবারণ করে তিনি অর্জুনের প্রাণরক্ষা করেন। জয়দ্রথ, দ্রোণ ও কর্ণবধ কৃষ্ণের সাহায্য ভিন্ন সম্পন্ন হত না। অশ্বত্থামা ব্রহ্মশির নিক্ষেপে উত্তরার গর্ভস্থ সন্তান পরীক্ষিৎ নিহত হলে কৃষ্ণ তাকে পুনরুজ্জীবিত করেন।

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শেষ। যুদ্ধক্ষেত্র দর্শন করে শত পুত্রের মৃত্যুসহ অসংখ্য মানুষের মৃতদেহ দেখে গান্ধারী কৃষ্ণকে অভিশাপ দেন যে, জ্ঞাতি বিনষ্টকারী এ যুদ্ধ বন্ধ করার সমর্থ থাকলেও কৃষ্ণ তা করেননি, তখন এই যুদ্ধের ছত্রিশ বৎসর পরে যদুবংশ ধ্বংস হবে ও কৃষ্ণের অপঘাতে মৃত্যু ঘটবে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মাতা অভিশাপ মাথা পেতে নেন। যুদ্ধে জয়লাভের পর কৃষ্ণ দ্বারকায় প্রত্যাবর্তন করেন। পরে যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞে তিনি পুনরায় হস্তিনাপুরে আসেন ও যজ্ঞান্তে আবার দ্বারকায় ফিরে যান।

একবার বিশ্বামিত্র,কণ্ব ও নারদ মুনি দ্বারকায় গেলে যাদবগণ কুবুদ্ধি বশত: কৃষ্ণপুত্র শাম্বকে স্ত্রী-বেশে সজ্জিত করে ঋষিদের কাছে নিয়ে গিয়ে বলেন যে ইনি বভ্রুর স্ত্রী এর কি সন্তান হবে। মুনিরা প্রতারণা ধরতে পেরে ক্রুদ্ধ হয়ে অভিশাপ দেন যে শাম্ব এক লৌহমুষল প্রসব করবে, তার দ্বারা যদুবংশ ধ্বংস হবে। পরদিন শাস্ব মুষল প্রসব করেন এবং যাদবগণ সেই মুষল চূর্ণ করে সমুদ্রে নিক্ষেপ করেন। কৃষ্ণ, বলরাম, উগ্রসেন প্রভৃতি যাদব শ্রেষ্ঠগণ কঠোরভাবে নগরে সূরাপান নিষিদ্ধ করেন। ক্রমে চতুর্দিকে নানা অমঙ্গলের চিহ্ন দেখে কৃষ্ণ সকলকে সমুদ্রতীরস্থ প্রভাস তীর্থে গিয়ে মাত্র একদিনের জন্য সুরাপানের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন। সেখানে প্রচুর সুরাপানে উন্মত্ত যাদবগণ পরস্পরের সহিত কলহে প্রবৃত্ত হন। ক্রমে উত্তেজিত সাত্যকি কৃতবর্মার শিরচ্ছেদ করায় সকলে পানপাত্রের আঘাতে সাত্যকি ও কৃষ্ণপুত্র প্রদুম্নকে কৃষ্ণের সম্মুখেই হত্যা করেন। সেখানকার সমস্ত তৃণই মুষলে রুপান্তরিত হওয়ায় তার দ্বারা যাদবগণ পরস্পরকে হত্যা করে যদুবংশ ধ্বংস করেন। কৃষ্ণ বলরাম বনবাসী হবার সঙ্কল্প করে সারথি দারুককে অর্জুনের কাছে সংবাদ জানিয়ে পাঠান। ইতিমধ্যে বলরাম দেহত্যাগ করেন এবং দূর থেকে ভূমিতে উপবিষ্ট কৃষ্ণকে মৃগভ্রমে এক ব্যাধ পাদমুলে শরবিদ্ধ করায় তার মৃত্যু হয়। হস্তিনাপুরে সংবাদ পেয়ে অর্জুন দ্বারকায় আসেন। দ্বারকানগরী সমু্দ্রগর্ভে লীন হয়। ।

উপমহাদেশে তথা বিশ্বের সনাতন সম্প্রদায়ের মানুষই বিশ্বাস করে যে, শ্রীকৃষ্ণ পরম পুরুষোত্তম ভগবান। তিনি লীলাপুরুষোত্তম, তিনি পরম ব্রহ্ম, তিনি পরমধাম, তিনি অব্যয়, তিনি ভূতেশ, তিনি ভূতভাবন, তিনি অজ, তিনি অনাদিরাদির গোবিন্দ,তিনি সর্বকারণের কারণ। কৃষ্ণের উপাসনা বাংলার ঘরে ঘরে হয়ে থাকে। সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর উপাসনা করা হয়, নাম সংকীর্তন করা হয়। কৃষ্ণ আর আমরা বাঙ্গালী হিন্দু একাত্মা। কৃষ্ণ নাম স্মরণ করে সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রাতকার্যাদি শেষ করে কৃষ্ণ পূজা করে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে আমারা একেবারে ঘরের মধ্যে এনে যেভাবে মনের মনিকোটায় স্থান ‍দিয়েছি তা ভাবলে শিহরণ সৃষ্টি হয়। আমাদের বিশ্বাস আমাদেরকে এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। বিশ্বাস ব্যতীত কোন ধর্মই চলতে পারে না। আমাদের বাঙ্গালী মা-বোনেরা শ্রীমদ্ভগবতগীতা, শ্রীমদ্ভাগবত, মহাভারত, শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, পুরাণ, উপনিষৎ ইত্যাদি গ্রন্থগুলো পাঠ না করলেও ভালভাবেই চেনে বা জানে। এ চেনা বা জানাটা হচেছ বড় বিষয়। তারাতো সাংখ্যযোগের মাধ্যমে কৃষ্ণকে জানতে চায়না তারা কেবল ভক্তির মাধ্যমে নিজেকে তাঁর কাছে সপে দিতে চায়। তার প্রচেষ্টা হিসেবে সকাল-সন্ধ্যা দুবেলা তাঁরই পূজার্চ্চনা করে। শ্রীকৃষ্ণের মানব চরিত্র বিশ্লেষণ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। যাকে আমরা পরম পুরুষ বলে জানি, যাকে আমরা ভগবান বলে মানি, যার কৃপা ব্যতীত উদ্ধারের কোন পথ নেই; সেই পরম পুরুষের চরিত্র বিশ্লেষণ! শ্রীকৃষ্ণের মানব চরিত্র অত্যন্ত বৈচিত্রপূর্ণ। বাল্যকালে ননীচোরা, কৈশরে গোপনারীদের সাথে পরকীয়া প্রেম, পরিণত বয়সে প্রেমিক। আসলে এসবই অপ্রাকৃতিক বিষয়। আমরা প্রাকৃত চোখে তা অনুভব করতে পারি না বলেই এমনিটি ভাবি। যেমন দরুন বস্ত্রহরণ। ব্রজনারী কানাইকে পতি হিসেবে চায়, তাইতো বস্ত্রহরণের মত কাহিনীর জন্ম হয়েছে।

মহাভারতে কৃষ্ণের স্থান সবার উপরে। তিনি যদুবংশের রাজা না হয়েও চালক ছিলেন। শ্রীকৃষ্ণের মানব চরিত্র অত্যন্ত বৈচিত্রপূর্ণ ও জটিলতায় ভরপুর। শ্রীমদ্ভগবদগীতায় কৃষ্ণ বলেছেন যে, যখন ধর্মের গ্লানি ও অধর্মের অভূত্থান হয় তখন তিনি নিজেকে সৃষ্টি করেন। সাধুদের পরিত্রাণ, দুষ্কৃতকারীদের বিনাশ ও ধর্মস্থাপনের জন্য তিনি যুগে যুগে আবির্ভূত হন। তার ধর্মরাজ্য স্থাপনের অন্তরায় ছিলেন শক্তিশালী রাজা জরাসন্ধ ও শিশুপাল। এদের দুইজনকে নিহত করে কৃষ্ণ প্রত্যক্ষভাবে কৌরবদের বিনাশের জন্য পান্ডবপক্ষে যোগ দেন। তার আগে শ্রীকৃষ্ণ এ যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য দূতের ভূমিকাও পালন করেন কিন্তু দূর্যোধনের অহংকারের কারণে যুদ্ধ অবধারিত হয়ে পড়ে। এ যুদ্ধে তিনি অর্জুনের সারথি হন এবং যুদ্ধে কোন অস্ত্র ধারণ করবেন না বলেও প্রতিশ্রুত হন। তারপরও অস্ত্রধারণ না করলেও পান্ডবদের ন্যায়পরায়ণতার কারণে প্রতি মুর্হতে তাদের সাথে সাথে রয়েছেন। প্রত্যেকটি বিপদ থেকে উদ্ধার করেছেন। রাজসভায় দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অপার লীলায় সংগঠিত হতে পারেনি। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে মানব জাতি পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস উপহার পেয়েছে। আর তা হলো ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখনিসৃত: অমৃত বাণী যা পারমার্থিক জ্ঞানের এক অফুরন্ত ভান্ডার। যা কোন দিন শেষ হবে না। প্রলয় না হওয়া পর্যন্ত তা মানব জাতির মধ্যে থাকবে। শ্রীমদ্ভগবত গীতার প্রতিটি শ্লোকের পরতে পরতে রয়েছে আধ্যাত্মিক চেতনা শক্তির এক মহা-আয়োজন। রয়েছে আত্মা ও পরমাত্মাকে জানার এক দূর্বার বাসনা। পরা প্রকৃতি ও অপরা প্রকৃতির সমন্বয় ঘটিয়ে চৈতন্যের প্রকাশ।ত্রি-গুনাত্মিকা মায়া শক্তি। মানুষকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌছানোর জন্য অর্থাৎ মায়া শাক্তিকে বিনাশ করে কিভাবে মোক্ষলাভ করা যায় তার উত্তরণের পথ। গীতার কথা মানুষের জন্য। কোন সম্প্রদায়ের জন্য নয়। ভগবানকে জানার জন্য গীতাই যথার্থ। প্রাপ্তির জন্য নেই কোন লোভ-লালসা, আছে শুধু ত্যাগের মহিমা, আছে শুধু অপ্রাকৃত নাম সূধা, আছে শুধু নামের মহাত্ম্য, নেই কোন ধর্মের ধ্বজা উড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা, নেই কোন প্রলোভন, নেই কোন জৈবিক চাহিদা, নেই কোন চাওয়া-পাওয়ার দ্বন্দ্ব। আছে শুধু নির্মল আনন্দ, শুধু আনন্দ, শুধু আনন্দ। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ময়দানে অর্জুনকে নিমিত্ত করে মানব জাতিকে ভগাবন শ্রীকৃষ্ণ যে বস্তুটি দান করে গিয়েছেন পরম্পরাক্রমে থাকবে যদি না কোন দিন পরম্পরা ছিন্ন হয়।
মহাভারতের রাজনীতিক, শাসক, যোদ্ধা, দূত, গীতার দার্শনিক, করুণার সাগর, প্রেমের স্পন্দন স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। পাশাপাশি কেহ কেহ তাকে নিয়ে বিপরীত চিন্তাও করেন। কেহ কেহ বলেন শ্রীকৃষ্ণ অতিমানব, আধ্যাত্মিক শক্তির ভান্ডার, কেহ কেহ বলেন তিনি যাদুকর, কেহ কেহ বলেন তিনি তান্ত্রিক, কেহ কেহ বলেন তিনি লম্পট, কেহ কেহ বলেন তিনি পরকীয়ক, কেহ কেহ বলেন তিনি ছলনাকারী ইত্যাদি ইত্যাদি। এদের সম্পর্কে তিনি নিজেই বলছেন-

ত্রিভির্গুণময়ৈর্ভাবৈরেভিঃ সর্বমিদং জগৎ |
মোহিতং নাভিজানাতি মামেভ্য পরমব্যয়ম্ || ৭|১৩ ||
অর্থ:তিনটি গুণের দ্বারা মোহিত হওয়ার ফলে সমগ্র জগৎ এই সমস্ত গুণের অতীত ও অব্যয় আমাকে জানতে পারে না।
দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া |
মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে || ৭|১৪ ||
অর্থ:আমার এই দৈবী মায়া ত্রিগুণাত্মিকা এবং তা দুরতিক্রমণীয়া। কিন্তু যাঁরা আমাতে প্রপত্তি করেন, তাঁরাই এই মায়া উর্ত্তীণ হতে পারেন।
ন মাং দুষ্কৃতিনো মূঢাঃ প্রপদ্যন্তে নরাধমাঃ |
মায়য়াপহৃতজ্ঞানা আসুরং ভাবমাশ্রিতাঃ || ৭|১৫ ||
অর্থ:মূঢ়, নরাধম, মায়ার দ্বারা যাদের জ্ঞান অপহৃত হয়েছে এবং যারা আসুরিক ভাবসম্পন্ন, সেই সমস্ত দুষ্কৃতকারীরা কখনও আমার শরণাগত হয় না।
নাহং প্রকাশঃ সর্বস্য যোগমায়াসমাবৃতঃ |
মূঢোহয়ং নাভিজানাতি লোকো মামজমব্যয়ম্ || ৭|২৫ ||
অর্থ:আমি সকলের নিকট প্রকাশিত হই না। কেননা যোগমায়ায় আবৃত থাকি এজন্যে মূঢ় লোক আমার অজ ও অব্যয় স্বরুপকে জানতে পারে না।
অবজানন্তি মাং মূঢ়া মানুষীং তনুমাশ্রিতম্ |
পরং ভাবমজানন্তো মম ভূতমহেশ্বরম‌ || ৯|১১ ||
অর্থ: আমি যখন মনুষ্যরুপে অবতীর্ণ হই, তখন মূর্খেরা আমাকে অবজ্ঞা করে। তারা আমার পরম ভাব সম্বন্ধে অবগত নয় এবং তারা আমাকে সর্বভূতের মহেশ্বর বলে জানে না।
মোঘাশা মোঘকর্মাণো মোঘজ্ঞানা বিচেতসঃ |
রাক্ষসীমাসুরীং চৈব প্রকৃতিং মোহিনীং শ্রিতাঃ || ৯|১২ ||
অর্থ:এভাবেই যারা মোহাচ্ছন্ন হয়েছে, তারা রাক্ষসী ও আসুরী ভাবের প্রতি আকৃষ্ট হয়। সেই মোহাচ্ছন্ন অবস্থায় তাদের মুক্তি লাভের আশা, তাদের সকাম কর্ম এবং জ্ঞানের প্রয়াস সমস্তই ব্যর্থ হয়।
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ | কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে | হরে রাম হরে রাম | রাম রাম হরে হরে |

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র