০৬.যুধিষ্ঠিরের নিকট অর্জুনের কর্ণবধে প্রতিজ্ঞাকর্ণের বচন শুনি শল্য বলে দাপে।বিস্তর কহিলে তুমি অতুল প্রতাপে।।এই দেখ রথে আইল সর্ব্ব সৈন্যগণ।কাহার সামর্থ্য করে পার্থে নিবারণ।।হের দেখ ভীমসেন পবনকুমার।সহদেব বীর দেখ ভুবনের সার।।মহারাজা যুধিষ্ঠির দেখ বিদ্যমান।ধৃষ্টদ্যুন্ন সেনাপতি অগ্নির সমান।।দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র কি দিব তুলনা।ইহাদের অগ্রসর হবে কোন জনা।।শিখণ্ডী সাত্যকি দেখ রাজা আগুয়ান।চলহ সমরে আজি হয়ে সাবধান।।সিদ্ধ হৈল মনোরথ দেখ ধনঞ্জয়।সংগ্রামে করহ আজি অর্জ্জুনের ক্ষয়।।এই কথা কহিতে মিশিল দুই দল।মহাযুদ্ধ বাধিল হইল কোলাহল।।ক্রোধ করি কর্ণ বীর প্রবেশিল রণে।সিংহ যেন চলে যায় কুতুহল মনে।।প্রবেশিয়া কর্ণ বীর করে মহারণ।বাছিয়া বাছিয়া মারে বড় বীরগণ।।সংগ্রামেতে প্রবেশিল কর্ণের কুমার।দশ বাণে ভীম তারে করিল সংহার।।সাক্ষাতে দেখিয়া কর্ণ আপনা পাসরে।পুত্রের কাটিল মাথা বীর বৃকোদরে।।কর্ণপুত্রে নাশিয়া কৃপের কাটে ধনু।তিন বাণে বিন্ধিলেন দুঃশাসন-তনু।।ছয় বাণে শকুনিরে করিল বিকল।রথ কাটি বিন্ধেন উলূক মহাবল।।থাক থাক সুষেণ কাটিব তব শির।এত বলি বাণ মারে ভীম মহাবীর।।তিন বাণে বিন্ধিলেন ভীমবীর তাকে।সুষেণ সুতীক্ষ্ম অস্ত্র মারে ঝাঁকে ঝাঁকে।।নকুল সহিত যুদ্ধ বাড়িল বহুল।দুঃশাসন সাত্যকিতে সংগ্রাম তুমুল।।অতি ক্রোধে কর্ণবীর রণে প্রবেশিল।ইন্দ্র দেবরাজ যেন সমরে আইল।।একে কর্ণ মহাবীর পেয়ে অপমান।নিজ পুত্র পড়িল আপনি বিদ্যমান।।যুধিষ্ঠির বধে যুক্তি কৈল কর্ণবীর।ক্রোধে পরিপূর্ণ কর্ণ কাঁপয়ে শরীর।।একেবারে যুড়ি মারে শত শত বাণ।বিন্ধি পাণ্ডবের সৈন্য কৈল খান খান।।মহাধনুর্দ্ধর বীর বরিষয়ে শর।বিচিত্র বিক্রম দেখি কর্ণ ধনুর্দ্ধর।।মহারথিগণে বিন্ধে নিবারিতে নারে।একেশ্বর কর্ণ যুঝে পাণ্ডব সমরে।।গজ বাজী ধ্বজ ছত্র রথ সারি সারি।অযুত অযুত পাড়ে লিখিতে না পারি।।মুণ্ড কাটি পাড়ে কার কুণ্ডল সহিত।অশ্ব রথ কাটিয়া যে পাড়িল ত্বরিত।।যুধিষ্ঠিরে রাখিতে ধাইল বহু দল।দৃষ্টিমাত্র কাটি পাড়ে কর্ণ মহাবল।।যুধিষ্ঠির বলিলেন কর্ণে উচৈঃস্বরে।শুন কর্ণ এক কথা বলি যে তোমারে।।দুর্য্যোধন বাক্যে কর মম সহ রণ।শুদ্ধ অভিলাষ তোর খণ্ডাব এখন।।এত বলি ধর্ম্ম মারিলেন দশ শর।তাঁর শরাশন কাটে কর্ণ ধনুর্দ্ধর।।ক্রোধভরে যুধিষ্ঠির যেন হুতাশন।টঙ্কারিয়া লইলেন অন্য শরাসন।।যম দণ্ড সম ধনু অতি ভয়ঙ্কর।মহেশের শূল যেন জ্বলে বৈশ্বানর।।বজ্রের সমান সেই বাণে যুধিষ্ঠির।কর্ণের দক্ষিণ ভাগে বিন্ধিলেন বীর।।বেদনা পাইল তাহে কর্ণ ধনুর্দ্ধর।মূর্চ্ছিত হইয়া পড়ে রথের উপর।।হাহাকার কুরুদলে প্রচার হইল।পাণ্ডবের সৈন্যে জয়ধ্বনি প্রকাশিল।।মহা সিংহনাদ করে পাণ্ডবের দল।চেতনা পাইয়া উঠে কর্ণ মহাবল।।যুধিষ্ঠির নিধন চিন্তিল মনে মন।টঙ্কারিয়া হাতে নিল দিব্য শরাসন।।বিজয় নামেতে ধনু নিল আরবার।যাহাতে আছয়ে চন্দ্র সূর্য্যের আকার।।সত্যষেণ সুষেণ কর্ণের দুই সুত।তিন বাণে ধর্ম্মে বিন্ধে বিক্রমে অদ্ভূত।।বিন্ধিল নৃপতি সত্যষেণের শরীরে।তিন বাণে বিন্ধিলেক কর্ণ মহাবীরে।।সর্ব্ব অস্ত্র নিবারিল কর্ণ একেশ্বর।সপ্তবাণে বিন্ধিলেক ধর্ম্ম নৃপবর।।রাজারে রাখিতে এল এত যোদ্ধাগণ।ধৃষ্টদ্যুন্ন ভীম সেন দ্রুপদ নন্দন।।সহদেব সুষেণ নকুল কাশীপতি।শিশুপাল তনয় আইল শীঘ্রগতি।।একেবারে অস্ত্র এড়ে কর্ণের উপর।সর্ব্ব অস্ত্র নিবারিল কর্ণ ধনুর্দ্ধর।।পাণ্ডবের সৈন্য সর্ব্ব করে পরাজয়।কালান্তক যম যেন কর্ণ মহাশয়।।যুধিষ্ঠির রাজার হাতের কাটে ধনু।সন্ধান পূরিয়া বীর বিন্ধিলেক তনু।।কবচ কাটিয়া পাড়ে ধরণী উপরে।রুধির পড়িছে ধারে ধর্ম্ম-কলেবরে।।শক্তি অস্ত্র মারিলেন রাজা যুধিষ্ঠির।শক্তি নাহি ভেদিল সে কর্ণের শরীর।।অতি ক্রোধে কর্ণবীর মারে তীক্ষ্মশর।সেই শরে বিন্ধিলেক ধর্ম্ম-কলেবর।।হৃদয়ে বিন্ধিল আর বিন্ধিল কপাল।ধ্বজছত্র কাটিলেন বিক্রমে বিশাল।।গজ অঙ্গ কাটা গেল হইল প্রমাদ।ছিন্ন ভিন্ন সৈন্য সব করে আর্ত্তনাদ।।অন্য রথে চড়িলেন ধর্ম্ম নৃপবর।রথ চালাইয়া দেন কর্ণের গোচর।।জিনিলেন কর্ণ বীর পাণ্ডবের নাথ।উপহাস করে কর্ণ ধর্ম্মের সাক্ষাৎ।।ক্ষন্ত্রকুলে জন্মিয়াছ তুমি মহাজন।কাণেতে কাতর হয়ে পরিহর রণ।।ক্ষন্ত্রধর্ম্মে তোমারে সুদক্ষ নাহি গণি।ব্রহ্মচর্য্য ধর্ম্মেতে তোমাকে বাখানি।।আর যুদ্ধ না করহ কর্ণবীর সনে।যদি প্রাণে রক্ষা পাও যাও নিজস্থানে।।এত বলি কর্ণবীর ছাড়িল নৃপতি।ক্ষমিল সকল বীরে কর্ণ সেনাপতি।।কোপেতে ধাইল ভীম মহাবলধর।রাজারে করিল পাছু দুই সহোদর।।কর্ণ ভীম সমাগমে হৈল মহারণ।বিমানে চড়িয়া দেখে দেবঋষিগণ।।কালদণ্ড সম যেন বিজলী ঝঙ্কার।কর্ণেরে মারিল ভীম অস্ত্র খরধার।।শরে কর্ণ বীরবরে করে ছারখার।মহাশব্দে ভীমসেন করে মার মার।।হাতে ধনু লয়ে বীর সমরে প্রচণ্ড।হানিয়া রাজার পুত্রে করে খণ্ড খণ্ড।।দুই বীরে শরবৃষ্টি করিল প্রকাশ।অন্ধকারময় শূণ্য না চলে বাতাস।।আকর্ণ, পূরিয়া কর্ণ করিল সন্ধান।ভীমের হাতের ধনু করে খান খান।।গদাঘাত কর্ণে করিল বৃকোদর।মুর্চ্ছিত হইল কর্ণ রথের উপর।।রথ বাহুড়িল তবে সারথি সত্বর।ক্ষণেকে চেতন পায় কর্ণ ধনুর্দ্ধার।।বাহুযুদ্ধ করে দোঁহে মহাবীর।অশ্বথামা বীর তবে প্রতিজ্ঞা করিল।।রাজার গোচরে গিয়া এমত কহিল।ধৃষ্টদ্যুন্ন বীর বটে মম পিতৃবৈরী।।তোমারে তুষিব আজি তাহারে সংহারি।বিনা ধৃষ্টদ্যুন্ন বধে যুদ্ধ যদি করি।।আজিকার যুদ্ধে আমি হব পিতৃবৈরী।প্রতিজ্ঞা করিয়া বীর আসিলেক রণে।।ধৃষ্টদ্যুন্ন সেনাপতি আসিল তখনে।হুহুঙ্কার করি যুঝে দ্রোণপুত্র সনে।।অশ্বথামা মহাবীর মিলিল সমানে।মহাবীর অশ্বথামা সংগ্রামে নিপুণ।।ধৃষ্টদ্যুন্ন বীরের কাটিল ধনুগুণ।অশ্বসহ সারথিরে করিল সংহার।।নাহিক সম্ভ্রম কিছু দ্রোণের কুমার।ক্রোধভরে আসে অশ্বথামা মহাবীর।।মনে ভাবি কাটিবেন ধৃষ্টদ্যুন্ন শির।ভীমসেন করিল তাঁহার পরিত্রাণ।।আকাশে অমরগণ করয়ে বাখান।মহাবীর কর্ণে তবে বরিষয়ে শর।।বরিষার মেঘ ঘেন বরিষে নির্ঝর।ভাঙ্গিল নারেন সৈন্য ধর্ম্ম নৃপবরে।।পুনঃ যুধিষ্ঠিরে ধায় কর্ণ মহাবীর।নারাচ বাণেতে বিন্ধে রাজার শরীর।।যুধিষ্ঠির হৃদয়ে বিন্ধিল সাত বাণ।ধর্ম্মের শরীর বিন্ধি কৈল খান খান।।রাখিবারে রাজারে এল যোদ্ধাগণ।কর্ণবীর বাণেতে করিল নিবারণ।।সহদেব নকুল ধর্ম্মের পাশে থাকে।দুই ভাই বিপক্ষে মারিল লাখে লাখে।।ত্রিভুবনে বীর নাই কর্ণের সোসর।কাটিল রাজার ধনু কর্ণ ধনুর্দ্ধর।।এক বাণে কাটিয়া পাড়িল শরাসনে।শর ধনু কাটিয়া পাড়িল সেইক্ষণে।।অবিলম্বে অশ্ব রথ কাটেন কর্ণবীর।অস্ত্র বৃষ্ঠি করিলেন ধর্ম্মের উপর।।দুই ভাই চড়িলেন সহদেব রথে।পুনরপি কর্ণবীর ধনু নিল হাতে।।পাণ্ডবের মাতুল মদ্রের অধিপতি।কর্ণের সারথী সেই বীর মহামতি।।ভাগিনার দুঃখ দেখি হৃদয়ে আকুল।বিস্তর বলিল পাণ্ডবের অনুকূল।।শুন কর্ণ মহাশয় আমার বচন।আপনি প্রতিজ্ঞা কৈলা বিস্মর এখন।।অর্জ্জুনের সঙ্গে রণ প্রতিজ্ঞা করিলে।ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠির সঙ্গে আরম্ভিলে।।হীন অস্ত্র যুধিষ্ঠির কবচ রহিত।তাহাকে বিন্ধিতে কর্ণ না হয় উচিত।।পার্থে এড়ি যুধিষ্ঠিরে মারিবার আশ।কৃষ্ণসনে অর্জ্জুন করিবে উপহাস।।শল্যের বচন শুনি ফিরে কর্ণবীর।লজ্জা পেয়ে শিবিরে গেলেন যুধিষ্ঠির।।রথ হৈতে নামিলেন ধর্ম্ম নরপতি।সরক্ত শরীর রাজা সবিকল মতি।।সহদেব নকুলেরে পাঠান সত্বর।যথা যুদ্ধ করে মহাবীর বৃকোদর।।যুধিষ্ঠিরে এড়ি কর্ণ অন্যেকে ধাইল।মৃগযুথ মধ্যে যেন গজেন্দ্র পশিল।।যত অস্ত্র ভৃগুরাম দিল মহাবীরে।মারিলেন কর্ণবীর নির্ভর অন্তরে।।পাণ্ডবের সৈন্যেতে করিল হাহাকার।যুগান্তের যম যেন করিল সংহার।।অর্জ্জুন অর্জ্জুন বলি মহাশব্দ করে।ধনঞ্জয় ধনুর্দ্ধর গেল কোথাকারে।।সংসপ্তকগণ সঙ্গে সংগ্রাম দুষ্কর।আসিতে অর্জ্জুন নাহি পান অবসর।।শ্রীকৃষ্ণ বলেন শুন ধনঞ্জয় বীর।সৈন্য সব সংহার করিল কর্ণ মহাবীর।।পরশুরামের অস্ত্র করিল সন্ধান।লক্ষ কোটী বাণ মারে দেখ বিদ্যমান।।যুগান্তের যম যেন কর্ণবীর ধায়।হের দেখ সৈন্য সব সম্ভ্রমে পলায়।।কৌরবের সৈন্য সব করে সিংহনাদ।পাণ্ডবের সৈন্য করে বহুল বিষাধ।।প্রাণ উপেক্ষিয়া যুদ্ধ করে বৃকোদর।যুধিষ্ঠিরে নাহি দেখি সংগ্রাম ভিতর।।শুনিয়া কহেন ধনঞ্জয় গদাধরে।সত্বরে চালাও রথ দেখি যুধিষ্ঠিরে।।সংসপ্তকগণ মম আছে অবশিষ্ট।শীঘ্রগতি চল প্রভু দেখি মোর জ্যেষ্ঠ।।অর্জ্জুন বচনে কৃষ্ণ দেন অনুমতি।যুধিষ্ঠির স্থানে ত্বরা যান শীঘ্রগতি।।শঙ্খনাদ করিয়া চলেন ধনঞ্জয়।অর্জ্জুনে রোধিল অশ্বথামা মহাশয়।।দিব্য অস্ত্র দুই বীর করিল সন্ধান।দেবাসুর যুদ্ধ যেন নাহি অবসান।।দ্রোণপুত্রে জিনিয়া অর্জ্জুন মহাবীর।ভীমের পশ্চাতে আইলেন অতি ধীর।।জিজ্ঞাসেন ভীমসেনে রাজার বৃত্তান্ত।কর্ণযুদ্ধ কথা ভীম কহিল আদ্যন্ত।।কর্ণ শরে বিহবল হইল কলেবর।গেলেন বিষাদে রাজা শিবির ভিতর।।দেবে বাঁচিলেন ভাই ধর্ম্ম নরপতি।এত বলি নিশ্বাস ছাড়িল মহামতি।।শুনিয়া বিকল কৃষ্ণ অর্জ্জুন দুর্জ্জয়।ভীমেরে বলেন তবে বীর ধনঞ্জয়।।কৃপকর্ণ দ্রোণপুত্র রাজা দুর্য্যোধন।উহাদের সঙ্গে যুদ্ধ করিব এখন।।আমি হেথা যুদ্ধ করি তুমি যাও তথা।বৃত্তান্ত করিয়া এস নৃপবর যথা।।ভীমসেন বলিলেন আমি আছি রণে।যুদ্ধ হইতেছে মম কুরুসৈন্য সনে।।হেনকালে এড়ি যাই যদি আমি রণ।নিন্দিবে পলাল বলি যত কুরুগণ।।যুদ্ধ ছাড়িবার এই নহেত সময়।দেখিয়া আইস যুধিষ্ঠির মহাশয়।।ভীমেরে রাখিয়া তবে সংগ্রাম ভিতরে।কৃষ্ণ পার্থ আইলেন দেখিতে রাজারে।।মহাভারতের কথা অমৃত সমান।কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।০৭.ভীম কর্তৃক দু:শাসনের রক্তপানকৃষ্ণের সহিত পার্থ মহাধনুর্দ্ধর।হেনমতে চলিলেন সংগ্রাম ভিতর।।মাদ্রী-পুত্রদ্বয় সহ বীর বৃকোদর।নিরখিয়া কুরুবল বরিষরে শর।।সারথি বিশোক নামে তারে ভীম পুছে।আমার রথেতে দেখ কত অস্ত্র আছে।।আজি রণে পড়িবে সকল কুরুগণ।নতুবা আমারে মারিবেক দুর্য্যোধন।।ভীমের বচনে তবে বিশোক দেখিল।ষাটি সহস্রেক বাণ গণিয়া বলিল।।দশ সহস্রেক বাণ বজ্রের সমান।আর যত বাণ আছে কে করে গণন।।অবশিষ্ট কত বাণ রথোপরি রহে।বিশোক সারথি তবে ভীম প্রতি কহে।।তবে ভীমসেন বীর প্রতিজ্ঞা করিল।আজিকার রণেতে কৌরব হত হৈল।।যতক্ষণ না আইসে কৃষ্ণ ধনঞ্জয়।সুসজ্জা করহ রথ করিতে বিজয়।।সহসা উত্তরদিকে হৈল কোলাহল।ছাইল অর্জ্জুন-বাণ গগন-মণ্ডল।।চতুরঙ্গ সেনা পড়ে অর্জ্জুনের বাণে।সৌবল বলিল শুন রাজা দুর্য্যোধন।হের দেখ সৈন্য ক্ষয় করিল অর্জ্জুন।।আমি অগ্রসরি করি ভীমেরে সংহার।মজিল কৌরব সৈন্য নাহিক নিস্তার।।মহাবল সৌবল ভীমের প্রতি ধায়।মহাযুদ্ধ ঘোরতর হইল তথায়।।মারিলেক শক্তি ভীম সৌবলের মাথে।সেই শক্তি সৌবল ধরিল বামহাতে।।সেই শক্তি ফেলি মারে ভীমের উপরে।বাহুবিন্ধি রথোপরে পাড়িল ভীমেরে।।পুনঃ উঠি ভীমসেন বিন্ধিল সৌবলে।মুর্চ্ছিত সৌবল রাজা পড়িল ভূতলে।।রথ ফিরাইয়া নিল রথের সারথি।ভঙ্গ দিল কুরুবল যত সেনাপতি।।ভঙ্গ দিল আপনি নৃপতি দুর্য্যোধন।সৈন্যগণ লন গিয়া কৃষ্ণের শরণ।।যুঝিতে আইল কর্ণ দেখি সৈন্যভঙ্গ।জ্বলন্ত অনল যেন দেখিতে তুরঙ্গ।।পাণ্ডবের সৈন্য সব বরিষয়ে শর।বেড়িয়া মারয়ে সব কর্ণ ধনুদ্ধর।।সাত্যকিরে বিন্ধিল বিংশতি মহাশরে।শিখণ্ডীরে দশ বাণ পঞ্চ বৃকোদরে।।ধৃষ্টদ্যুন্ন শত বাণ মারে বজ্র শরে।সপ্তদশ বাণ মারে দ্রুপদকুমারে।।সংশপ্তকে মারে সহদেব দশ শর।সাত বাণ মারিল নকুল ধনুর্দ্ধর।।ক্রমেতে বিন্ধিল ভীম ত্রিশ মহাশর।সব শর নিবারিল কর্ণ ধনুর্দ্ধর।।ক্রমেতে বিন্ধিল ভীম ত্রিশ মহাশর।সব শর নিবারিল কর্ণ ধনুর্দ্ধর।।হাসিয়া বিজয় ধনু লইলেক হাতে।বাণাঘাতে সর্ব্ব সৈন্য যায় চতুর্ভিতে।।সাত্যকির ধ্বজ কাটি কাটে শরাসন।আর বাণ হৃদয়ে বিন্ধিল সেইক্ষণ।।রথ শূণ্য হইলেন সাত্যকি তখন।তিন বাণে সারথিরে করিল নিধন।।নিমিষে বিমুখ কৈল সব ধনুর্দ্ধর।ভীত হয়ে সৈন্য সব পলায় সত্বর।।দূরে থাকি দেখেন অর্জ্জুন মহাবীর।দেবাসুর যুদ্ধে যায় নির্ভয় শরীর।।কৃষ্ণেরে বলেন মহাবীর ধনঞ্জয়।হের দেখ কর্ণবীর যুঝয়ে নির্ভয়।।ভাঙ্গিল পাণ্ডব দল সৈন্য দিল ভঙ্গ।পলাইয়া যায় যেন আকুল তরঙ্গ।।ঝাট রথ চালাও গোবিন্দ মহাবল।সংগ্রামে মারিব আজি কৌরব সকল।।হাসিয়া চালান রথ গোবিন্দ সারথি।দূরে থাকি রণ দেখে কুরু নরপতি।।কর্ণেরে বলিল তবে রাজা দুর্য্যোধন।হের দেখ আসিতেছে নর নারয়ণ।।ক্রোধভরে আইল অর্জ্জুন ধনুর্দ্ধর।ইহা সম বীর নাহি সংগ্রাম ভিতর।।সর্ব্ব সৈন্য আদেশিল কর্ণ মহামতি।সবে মেলি মার আজি পার্থ মহামতি।।অশ্বথামা দুঃশাসন বীর আদি করি।অর্জ্জুনেরে বেড়িল যে কর্ণ আগুসারি।।অর্জ্জুনের বাণে সব বিমুখ হইল।হাতে অস্ত্র কর্ণবীর রণে প্রবেশিল।।সাত্যকি বিন্ধিল বাণ কর্ণ বিদ্যমান।কাটিয়া সকল সৈন্য করে খান খান।।গদা লয়ে ভীমসেন করে মহারণ।সহস্র সহস্র পড়ে গজ অগণন।।তবে দুঃশাসন বীর বাছি মারে শর।তিন বাণে বিন্ধিল ভীমের কলেবর।।কাটিয়া হাতের ধনু রথের সারধি।শরেতে জর্জ্জর হৈল ভীম মহামতি।।মত্তগজ সব বীর গদা লয়ে হাতে।যম সম আইলেন সংগ্রাম করিতে।।গদা ফেলি মারিলেন দুঃশাসন শিরে।দুঃশাসন পড়ে শত ধনুক অন্তরে।।সারথ কবচ অশ্ব আর শরাসন।গদার প্রহারে চূর্ণ কৈল সেইক্ষণ।।রথেতে পড়িল যদি বীর দুঃশাসন।পূর্ব্বের প্রতিজ্ঞা ভীম করিল স্মরণ।।শীঘ্র গেল যথায় পড়িল দুঃশাসন।রথ হৈতে লাফ দিয়া পড়ে সেইক্ষণ।।দাণ্ডাইয়া দেখে যত কৌরব কুমার।বাহু আস্ফালিয়া ভীম বলে বার বার।।দুঃশাসন দুরাত্মার রক্ত করি পান।কার শক্তি আজি এরে করে পরিত্রাণ।।ক্রোধমনে ভীমসেন কহে উচ্চৈঃস্বরে।ধরিল রাক্ষসমূর্ত্তি সংগ্রাম ভিতরে।।অতিক্রোধে ভীমসেন সংগ্রামে অপার।খড়গ লয়ে বিদারিল হৃদয় তাহার।।বেগে রক্ত উঠে প্রস্রবণের সমান।মহানন্দে ভীমসেন করে তাহা পান।।করিয়া শোণিত পান কহে বৃকোদর।অমৃত পানেতে যেন ভরিল উদর।।মধু-ঘৃত-শর্করাতে নাহি পরিতোষ।মায়ের দুগ্ধ্বেতে যত না হয় সন্তোষ।।ততোধিক তৃপ্তি হয়, ঘুচে অবসাদ।কি মধুর দুরাত্মার রুধিরের স্বাদ।।দুর্য্যোধন কর্ণবীর দেখে বিদ্যমান।ভীমসেন করে দুঃশাসন-রক্ত পান।।রক্ত পিয়ে ভীমসেন সংগ্রাম ভিতরে।রাক্ষস বলিয়া লোক পলাইল ডরে।।দেখিয়া ধাইল বীর কর্ণ মহামতি।ভীমের উপরে বাণ মারে শীঘ্রগতি।।যুধামন্যু মহাবীর যুড়ি শর মারে।চিত্রসেন মহাবীর পড়িল সমরে।।দুঃখী হয়ে দুর্য্যোধন ভ্রাতার মরণে।পাণ্ডব সৈন্যেতে তবে আইল আপনে।।মহাভারতের কথা অমৃত সমান।কাশী কহে কর্ণ পর্ব্বে মরে দুঃশাসন।।০৮.অর্জুনের হস্তে কর্ণপুত্র বৃষসেন বধজিজ্ঞাসেন জন্মেজয় যুদ্ধ বিবরণ।ব্যক্ত করি যুদ্ধ কথা কহ তপোধন।।কর্ণেরে বলিল দুর্য্যোধন মহাশয়।গাণ্ডীব লইয়া আসে বীর ধনঞ্জয়।।রক্তপান করি তবে বীর বৃকোদর।দুঃশাসন রক্তেতে লেপিল কলেবর।।দুর্য্যোধন যথা আছে ভ্রাতৃগণ সঙ্গে।অস্ত্র লয়ে তথা ভীম যান মনোরঙ্গে।।দেশবাণ মারিয়া কাটিল পঞ্চজন।সেই শোকে ভয়েতে পলায় দুর্য্যোধন।।দেখি কর্ণ আইলেক করিবারে রণ।কর্ণে দেখি পলায় সকল সৈন্যগণ।।সর্ব্ব সৈন্য ভঙ্গ দিল নাহি চায় পাছে।ভ্রাতৃশোকে দুর্য্যোধন প্রাণমাত্র আছে।।সর্ব্ব মুখ্য কর্ণবার খ্যাত ধনুর্দ্ধর।মুখ্য বীর বৃষসেন হাতে নিল শর।।কর্ণপুত্রে নকুলে হইল মহারণ।নকুলের রথ কাটি ফেলে সেইক্ষণ।।ভীম রথে চড়িলেন নকুল দুর্জ্জয়।মহাবলবন্ত বীর রণেতে নির্ভয়।।সহদেব নকুল ও ধৃষ্টদ্যুন্ন বীর।দ্রৌপদীর পঞ্চ পুত্র নির্ভয় শরীর।।ভীমে খেদাড়িয়া চলে বীর বৃষসেন।কিঞ্চিৎ নাহিক ভয় কর্ণের নন্দন।।অশ্বথামা কৃপ দুর্য্যোধন নরপতি।বৃষসেনে রক্ষিবারে আসে শীঘ্রগতি।।দুই দলে মহাযুদ্ধ, অস্ত্রের নির্ঘাত।চতুরঙ্গ দলে হৈল বহুত নিপাত।।তবে বৃষসেন বীর কর্ণের নন্দন।তিন বাণে অর্জ্জুনে বিন্ধিল সেইক্ষণ।।মারিল দ্বাদশ শর কৃষ্ণ কলেবরে।মহাবীর বৃকোদরে বিন্ধিলেক শরে।।সাত বাণে নকুলের নাশে অহঙ্কার।মহাবীর বৃষসেন সংগ্রামে দুর্ব্বার।।রুষিয়া অর্জ্জুন বীর হাতে নিল শর।তাহাতে বিন্ধেন বৃষসেন কলেবর।।ক্ষুরবাণে ধনঞ্জয় কাটি ধনুর্ব্বাণ।মাথা কাটি ফেলিলেন কর্ণ বিদ্যমান।।পুত্রশোকে কর্ণের লোচনে জল ঝরে।উল্কাপাত পড়ে যেন পৃথিবী উপরে।।পুত্রশোকে কর্ণবীর ধাইল সত্বর।যুগান্তের যম যেন হাতে ধনুঃশর।।সিংহনাদ ছাড়ে বীর, বলে ধর ধর।দেখিয়া পাণ্ডব-সৈন্য পলায় সত্বর।।অর্জ্জুনে বলেন, কৃষ্ণ শুন মহামতি।পুত্রশোকে ধায় দেখ কর্ণ সেনাপতি।।দেবাসুর-জয়ী এই কর্ণ মহাবীর।সাবধানে যুদ্ধ কর না হও অস্থির।।এবে দেখ শরজাল বর্ষে কর্ণবীর।বরিষার মেঘ যেন বরিষয়ে নীর।।ইন্দ্রের ধনুক হেন দেখ বিদ্যমান।কর্ণ হাতে শোভিত বিজয় ধনুর্ব্বাণ।।দুর্য্যোধন মহাবীর করে সিংহনাদ।ধনুক টঙ্কার শুনি জয় জয় নাদ।।রণ করি কর্ণ বীরে করহ নিধন।তোমার সমান বীর নহে কোন জন।।বর দিল তোমারে প্রসন্ন শূলপাণি।কর্ণে সংহারিবে তুমি ইহা আমি জানি।।অর্জ্জুন বলেন কৃষ্ণ না কর বিস্ময়।কর্ণেরে মারিব আজি জানিহ নিশ্চয়।।হেনকালে কর্ণ আসে সংগ্রাম ভিতরে।পুত্রশোকে তাহার নয়নে জল ঝরে।।দুই বীরে দেখা দেখি হইল সত্বর।রণেতে শোভিল যেন দুই দিবাকর।দুই রথে দীপ্তমান উভয়ের ধ্বজ।এক ধ্বজে কপি শোভে আর ধ্বজে গজ।।কর্ণ বেড়ি কৌরব করয়ে সিংহনাদ।শঙ্খ ভেরি বাজে আর জয় জয় নাদ।।অর্জ্জুনেরে বেড়িয়া বিচিত্র বাধ্য বাজে।সিংহনাদ শব্দ করে পাণ্ডবের মাঝে।।নানা অস্ত্র মারি সৈন্য করয়ে নিধন।মহাবজ্রাঘাতে যেন পড়ে তরুগণ।দুই দলে মিশাইয়া চাহে কুতুহলে।।দেবতা গন্ধর্ব্ব এল গগনমণ্ডলে।যতেক দানব যক্ষ পিশাচ রাক্ষস।।সকলে চাহয়ে সদা রাধেয়ের যশ।চাহেন অর্জ্জুন যশ সকল অমর।।অন্তরীক্ষে পুত্রযশ চাহে দিবাকর।অর্জ্জুনের যশ চান ত্রিদশ-ঈশ্বর।।দুই বীরে যুদ্ধ করে অতি ঘোরতর।শল্য নৃপে জিজ্ঞাসেন কর্ণ ধনুর্দ্ধর।।আমারে স্বরূপ কহ শল্য বীরবর।অর্জ্জুনের যুদ্ধে যদি আমি পড়ি রণে।।তবে কোন কোন কর্ম্ম করিবা আপনে।হাসিয়া বলিল শল্য আমি একেশ্বর।কৃষ্ণ সহ সংহারিব পার্থ ধনুর্দ্ধর।।গোবিন্দেরে জিজ্ঞাসেন বীর ধনঞ্জয়।যদ্যপি আমারে কর্ণ করে পরাজয়।।কোন কর্ম্ম করিবে আপনি নারায়ণ।কেমনে হইবে তবে কর্ণের নিধন।।হাসিয়া বলেন তবে কৃষ্ণ মহাশয়।শুন বীর ধনঞ্জয় কহিব নিশ্চয়।।সূর্য্য যদি শূণ্য হৈতে ভ্রষ্ট ক্ষিতিতলে।খণ্ড খণ্ড হর যদি পৃথিবীমণ্ডলে।।কহিলাম এত যদি হয় বিপরীত।তোমারে জিনিতে কর্ণ নারে কদাচিৎ।।অর্জ্জুন বলেন তবে করি অহঙ্কার।অবশ্য করিব আজি কর্ণেরে সংহার।।শৃঙ্গ ভেরী দুন্দুভি যে ঘন ঘন বাজে।দুই দলে মহাযুদ্ধ হয় রণমাঝে।।অর্জ্জুনে বিন্ধিল দশ বাণে কর্ণবীর।হাসেন অর্জ্জুন বীর অক্ষয় শরীর।।আকর্ণ পূরিয়া তবে বীর ধনঞ্জয়।দশ বাণ মারিলেন কর্ণের হৃদয়।।এইমত বাণ যুদ্ধ হইল বিস্তর।অক্ষয় শরীর দোঁহে মহাধনুর্দ্ধর।।নারাচ বরিষে কত অতি খরসান।অর্দ্ধচন্দ্র ক্ষুরপাদি আর নানা বাণ।।অস্ত্রগণ পড়ে যেন পক্ষী ঝাঁকে ঝাঁকে।ভ্রুকুটি কটাক্ষে যেন বিজলী ঝলকে।।কর্ণকে পরশুরাম ব্রহ্ম অস্ত্র দিল।হেন অস্ত্র কর্ণবীর সন্ধান পূরিল।।যুগান্তের যম যেন উড়ি যায় শর।নিবারিতে নারিলেন পার্থ ধনুর্দ্ধর।।মহাবেগে পড়ে বাণ অর্জ্জুন উপরে।হেনকালে কৃষ্ণ তাহা ধরে দুই করে।।কর্ণের প্রতাপে স্থির নহে সৈন্যগণ।ভীম কৃষ্ণ অর্জ্জুনেরে বলিল তখন।।উপরোধ ছাড় ভাই না করিহ হেলা।কর্ণ বধ কর অস্ত্র যুড়ি এই বেলা।।সাবধানে মার অস্ত্র না হও বিমন।তব বিদ্যমানে পড়ে সব সৈন্যগণ।।ভীম-বাক্যে নানা অস্ত্র এড়ে ধনঞ্জয়।মহাসত্ব কর্ণ বীর নাহি করে ভয়।।বাণে অন্ধকার করিলেক কর্ণবীর।পাণ্ডবের সৈন্যগণ হইল অস্থির।।নিরন্তর বিন্ধিল অর্জ্জুন কলেবর।সর্ব্ব বাণ কাটিলেন পার্থ ধনুর্দ্ধর।।বাসুদেবে বিন্ধিল মারীচ বাণ মারি।আর যত বাণ পড়ে লিখিতে না পারি।।সর্ব্বলোক চিন্তিত চাহিয়া দুইজনে।কৃষ্ণার্জ্জুনে নিবারিল কর্ণ মহাবাণে।।সর্ব্বাঙ্গ হইল ক্ষত পার্থ ধনুর্দ্ধর।সহস্র এড়েন বাণ কর্ণের উপর।।কর্ণ শল্য কুরুবল বাণে আবরিল।অন্ধকার করি সবে বাণ বরষিল।।শল্যকে বিন্ধেন পার্থ তীক্ষ্ম দশ শরে।বিন্ধেন দ্বাদশ বাণ কর্ণের শরীরে।।রুধির পড়িছে ধারে কর্ণের শরীরে।পুনঃ সপ্ত বাণ বিন্ধে কর্ণ মহাবীরে।।সহস্র সহস্র বাণ নিমিষে চলিল।অন্ধকার করি অস্ত্র গগণ ভরিল।।অর্জ্জুনের বাণ যেন বিজলী তরঙ্গ।লষ্ট হৈল কুরুবল রণে দিল ভঙ্গ।।ভঙ্গ দিল কুরুবল কর্ণ একেশ্বর।মহারথি সারথি দুর্জ্জয় ধনুর্দ্ধর।।জয়নাদ করে অস্ত্র ধরি করে বীর।দেবাসুর যুদ্ধে যার অক্ষত শরীর।।কর্ণবীর অর্জ্জুনেরে বধে মনে করি।অর্জ্জুনে মারিতে অস্ত্র এড়ে সারি সারি।।শরজালে কর্ণবীর পূরিল গগন।কম্পমান হইল পাণ্ডব সৈন্যগণ।।হেনকালে এক সর্প রাক্ষস সমান।পাতাল হইতে সে হইল আগুয়ান।।যুদ্ধ করে কর্ণ বীর পার্থের সহিত।দাণ্ডাইয়া কহে সর্প কর্ণের সাক্ষাৎ।।মম ভ্রাতৃবধ কৈল কুন্তীর কুমার।এইকালে করি আমি পার্থেরে সংহার।।কোনরূপে করি আজ অর্জ্জুনে সংহার।অতি ক্রোধে সর্প তবে বলে বার বার।।মহাভারতের কথা অমৃত সমান।কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।০৯.কর্ণ বধহিতে খান্ডব বন, মম মায়ে বিনাশন,করিলেন পাণ্ডুর নন্দন।বাজি বৈরী উদ্ধারিব, অর্জ্জুনের সংহারিব,কর্ণ সনে করিব মিলন।।এতেক ভাবিয়া নাগ, মনেতে করিয়া রাগ,আকাশে উঠিল সেইক্ষণ।জননীর বৈরি শোধি, কিরূপে অর্জ্জুন বধি,এই যুক্তি ভাবে মনে মন।।আপনি সুবুদ্ধি বীর, সঙ্কুচিয়া স্বশরীর,রণ মধ্যে করিল প্রবেশ।মুখেতে অনল জ্বলে, উল্কা যেন ভূমিতলে,যোগবলে হৈল বাণ বেশ।।হেনকালে দিব্যবাণ, কর্ণ পূরিল সন্ধান,অর্জ্জুনের বধ মনে করি।সুবিখ্যাত কর্ণবীর, কোপভরে নহে স্থির,রুদ্র বাণ নিল করে ধরি।।রুদ্র বাণ লয়ে হাতে, মহাবীর অঙ্গনাথে,অধিষ্ঠাতা তাহে হৈল সর্প।সন্ধান করিল বীর, বিনাশিতে পার্থ বীর,পরশুরামের যত দর্প ।।বুঝিয়া বিশেষ কার্য, নিষেধিল শল্যরাজ,ভাগিনীরে করিবারে ত্রাণ।শুন কর্ণ বীরবর, পুনশ্চ সন্ধান কর,শরাসন নহে পরিমাণ।।ক্রোধমুখে বীর কর্ণ, নয়ন অরুণ বর্ণ,না করিব সেই শরবৃষ্টি।মারে আর দুই শর, বিন্ধি করে জর জর,উপদেশ না করে অনিষ্টি।।মারিব অর্জ্জুন তোকে, দেখিবে সকললোকে,এত বলি এড়ে কর্ণ শর।আকাশে আইসে বাণ, অগ্নি যেন দীপ্তমান,ব্যস্ত হইলেন দামোদর।।পায়ে চাপি রথবর, বসায়েন ভূমিপর,হাঁটু গাড়ি তুরঙ্গ পশিল।প্রশংসয়ে দেবগণ, সুশিক্ষিত জনার্দ্দন,এত হস্তে পৃথিবী ধরিল।।পার্থ মহাবীরবর, নাশিতে নারেন শর,মাথার কিরীট কাটা গেল।বিশ্বকর্ম্মা নির্ম্মাইল, নানারত্ন শোভা ছিল,যে কিরীট ইন্দ্র দিয়াছিল।।যেন অস্ত গিরিবর, একা রহে দিনকর,গিরি হৈতে চূড়া পড়ে খসি।সে হেন কিরীট পড়ি, ভূমে যায় গড়াগড়ি,প্রভা উঠে গগন পরশি।।পুনঃ গেল শর্প বাণ, কর্ণবীর বিদ্যমান,বিনয়ে কহিল বহুতর।না পাই সন্ধান যোগ, বিফল হইল ভোগ,এড় পুনঃ উল্কা সম শর।।পুছে কর্ণ মহাশয়, সর্প দিল পরিচয়,পুনঃ রণে কর্ণ মহাশয়।পূর্ব্বের সংগ্রাম যত, সকলি হইল হত,এবে করি অর্জ্জুনের ক্ষয়।।জানিয়া কর্ণের দর্প, পুনঃ গেল কালসর্প,অর্জ্জুনেরে করিতে সংহার।মুখেতে অনল বৃষ্টি, ধাইলেন ঊর্দ্ধদৃষ্টি,সর্ব্বলোকে দেখে ভয়ঙ্কর।।জানিয়া সর্পের তত্ত্ব, শ্রীকৃষ্ণ কহেন সত্য,সন্ধান করহ ধনঞ্জয়।সত্বরে আইলে সর্প, অগ্নি সম মহাদর্প,শীঘ্র তারে কর পরাজয়।।ছয় বাণ যুড়ি বীর, কাটিল সর্পের শির,খণ্ড খণ্ড হইয়া পড়িল।দর্পে পরাজয় করি, কৃষ্ণ দুই হাতে ধরি,ভূমি হত রথ উদ্ধারিল।।পুনঃ কর্ণ ধরি ধনু, বিন্ধিল অর্জ্জুন তনু,বাছিয়া বাছিয়া এড়ে বাণ।বাণে নিবারিয়া বাণ, ধনঞ্জয় ধনুর্ব্বাণ,নিজ বাণ করেন সন্ধান।।কর্ণের শরীর ভেদি, রক্তে যেন বহে নদী,সর্ব্ব গাত্রে বহিছে রুধির।কর্ণবীর অস্ত্র মারি, সর্ব্ব অস্ত্র নাশ করি,পুনঃ অস্ত্র এড়ে মহাবীর।।ভেদিল দ্বাদশ শরে, দামোদর কলেবরে,আর বাণ মারে শীঘ্রগতি।সন্ধান করিয়া শরে, বিন্ধিলেক পার্থবীরে,হাসিলেন কর্ণ যোদ্ধাপতি।।অর্জ্জুন যে সুসন্ধানে, কবচ কাটেন বাণে,নিবারিতে নারে কর্ণবীর।বাছিয়া মারেন শর, ধনঞ্জয় ধনুর্দ্ধর,পুনঃ পুনঃ মারিছেন তীর।।হৈল যেন বজ্রাঘাত. কম্পে যেন দীনাথ,কর্ণবীর সহিতে না পারে।বাছিয়া মারিলা শর, ধনঞ্জয় ধনুর্দ্ধর,সত্বরে বিন্ধেন কর্ণবীরে।।অবশ হইল তনু, খসিল হস্তের ধনু,মুর্চ্ছিত হইল কর্ণবীর।কর্ণকে মুর্চ্ছিত দেখি, শ্রীকৃষ্ণ কহেন ডাকি,শুন ধনঞ্জয় মহাবীর।।সাবধানে কর রণ, আজি কর নিপাতন,শীঘ্র বিন্ধ কর্ণের শরীর।প্রকাশিয়া নিজ শৌর্য্য, কর কর্ণ বধকার্য্য,যাহা কহিলেন যুধিষ্ঠির।।শুনয়া কৃষ্ণের বাক্য, নাশিতে বিপক্ষ পক্ষপার্থ মারিলেন বহু বাণ।মহা অস্ত্র যত ছিল, সে সকল পাসরিলমগুরুশাপে হইয়া অজ্ঞান।।মহাসত্ব কর্ণবীরম চৈতন্য পাইয়া ধীরনানা অস্ত্র করে বরিষণ।তিন বাণে জনার্দ্দনে, বিন্ধিলেন সেইক্ষণে,ধনঞ্জয় মারে সাত বাণ।।কাটা গেল ধনুগুণ, লজ্জিত হইল পুন,আর গুন দিয়া যুড়ি শরে।অর্জ্জুন মারেন শর, কাটে কর্ণ ধনুর্দ্ধর,হাসি পুনঃ বাণ নিল করে।।ধরিয়া বিজয় ধনু, বিন্ধিল অর্জ্জুনত,শরে কর্ণ করে অন্ধকার।অর্জ্জুনে ফাঁপর দেখি, শ্রীকৃষ্ণ কহেন ডাকি,শীঘ্র কর কর্ণেরে সংহার।।কৃষ্ণবাক্যে রুদ্র বাণ, পার্থ করি সুগদ্ধ,বজ্র যেন হাতে লৈল শত্রু।ব্যর্থ, হ্য় ব্রহ্মপাপ, কর্ণ পায় অনুত,পৃথিবী গ্রাসিল রথচক্র।।ক্রন্দন করয়ে বীর, নয়নেতে বহেঅর্জ্জুনে কহিলা উচ্চৈঃস্বরে।মুহুর্ত্তেক ক্ষমা কর, ওহে পার্থ ধনুর্দ্ধর,রথচক্র উদ্ধারিব করে।।যেই জন মুক্তকেশ, প্রহারে বিকল বেশ,শরণ মাগয়ে যদি রণে।কবচ রহিত জনে, নাহি ধরে অস্ত্রগণে,তারে মারে কাপুরুষ জনে।।তুমি লোকে নরোত্তম, তব কীর্ত্তি অনুপম,ধর্ম্মজ্ঞানে তোমারে বাখানি।রথের উপরে তুমি, অভাগ্যেতে আমি ভূমি,মুহূর্ত্তেক ক্ষমা কর জানি।।কৃষ্ণ হৈতে নাহি ভয়, তোমাতে সংশয় হয়,সে কারণে সাধি হে তোমাকে।বিধি মোরে হৈল বক্র, পৃথিবী গিলিল চক্র,ক্ষমা করি উদ্ধার আমাকে।।শুনিয়া কর্ণের বাণী, ক্রোধে কন চক্রপাণি,বিপদ কালেতে স্মর ধর্ম্ম।একবস্ত্রা রজঃস্বলা, দ্রুপদনন্দিনী বালা,সভামধ্যে কৈলা কোন কর্ম্ম।।শকুনি সৌবল সনে, দুর্য্যোধন নরাধমে,কপটে রচিল পাশা সারি।ক্ষত্রধর্ম্ম ছাড়ি কার্য্য, কপটে লইল রাজ্য,কোন শাস্ত্রে পাইলা বিচারি।।সন্দেশ মিশ্রিত বিষে ভীমে খাওয়ালে শেষে,বান্ধিয়া সকল কলেবর।ফেলাইয়া দিলে জলে, রক্ষা পায় ধর্ম্মবলে,সেই কথা কহিতে বিস্তর।।জৌগৃহ নির্ম্মাণ করি, তাহাতে পাণ্ডব ভরি,অগ্নি দিলে কি বিচার করি।কোন শাস্ত্রে হেন ধর্ম্ম, বিচারিয়া কর কর্ম্ম,দৈবে তাহা আনিল উদ্ধারি।।দ্বাদশ বৎসর বনে, বঞ্চিলেন পঞ্চজনে,বৎসরেক রহে অজ্ঞাতেতে।সভাতে মাগিল যবে, রাজ্য নাহি দিলে তবে,হেন ধর্ম্ম বুঝাও কিমতে।।অভিমন্যু গেল রণে, যেড়ি মারো সপ্তজনে,দুগ্ধপোষ্য শিশুত কুমার।কোনধর্ম্মে মার তারে, স্বরূপ কহিবা মোরে,কোথা ছিল ধর্ম্মের বিচার।।শুনিয়া কৃষ্ণের কথা, অর্জ্জুনের বাড়ে ব্যথা,পূর্ব্ব পূর্ব্ব কথা মনে হয়।বাড়িল পার্থের ক্রোধ, না মানেন উপরোধ,রত্তচক্ষু ওষ্ঠ কম্প হয়।।তবে কর্ণ মহাক্রোধে, নিতান্ত মরিব বোধে,ব্রহ্ম অস্ত্র এড়ে সেইক্ষণ।অর্জ্জুন ব্রহ্মান্ত্র মারি, কর্ণ বাণ ব্যর্থ করি,দিব্যাস্ত্র যুড়িল শরাসন।।পার্থ যুড়ি অগ্নিবাণ, যেন অগ্নি দীপ্তিমান,কর্ণ পানে চান একদৃষ্টি।বরুণ বাণেতে কর্ণ, জলে করি পরিপূর্ণ,অনল নিভায় করি বৃষ্টি।।অর্জ্জুনের বায়ু বাণ, মেঘ করে খান খান,পুনঃ কর্ণ যোড়ে মহাশর।হাহাকার দেবগণে, ভূমিকম্প ক্ষণে ক্ষণে,বাণ এড়ে কর্ণ ধনুর্দ্ধর।।হৃদয়ে বিন্ধিল শর, রক্ত পড়ে নিরন্তর,আপনা বিস্মৃত ধনঞ্জয়।খসিল হাতের ধনু, স্তদ্ধ হৈল সর্ব্ব তনু,অতি ব্যগ্র কৃষ্ণ মহাশয়।।এই পেয়ে অবসর, কর্ণ মহা ধনুর্দ্ধর,রথ উদ্ধারিতে বীর চলেন।না পারিল দুই হাতে, শ্রম হৈল অঙ্গনাথে,পুনঃ রথ পশিল ভূতলে।।সচেতন ধনঞ্জয়, দেখি কৃষ্ণ মহাশয়,অর্জ্জুনে কহেন কুতূহলে।আমার বচন ধর, ধনঞ্জয় ধনুর্দ্ধর,কাটি পাড় কর্ণ মহাবলে।।কৃষ্ণের বচন শুনি, অর্জ্জুন হৃদয়ে গণি,গাণ্ডীবে যুড়েন ক্ষুরবাণ।ক্ষুর প্রবেশিল চণ্ড, কাটিয়া পড়িল দণ্ড,শঙ্কা পায় কর্ণ বলবান।।ঝাঁকে ঝাঁকে সূর্য্যবাণ, পার্থ ছাড়িলেন বাণ,বজ্র যেন ছাড়ে পুরন্দর।সর্ব্বভূতে ভয়ঙ্কর, দেখি দিব্য মহাশর,বেগে ধায় শব্দ ঘোরতর।।নিক্ষেপিয়া মহাশর, ভাবিলেন ধনুর্দ্ধর,পূর্ব্ব কথা আছয়ে স্মরণে।যদি হই পার্থ বীর, কাটি পাড়ি কর্ণশির,নাশিব কর্ণেরে আজি রণে।।ছেদিব কর্ণের শির, এত বলি পার্থ বীর,মহাশর মারেন কর্ণেরে।সর্ব্বলোকে ভয়ঙ্কর, দেখি যেন রুদ্র শর,বেগে পড়ে কর্ণের শরীরে।।সন্ধ্যাকালে পড়ে কর্ণ, গগন লোহিত বর্ণ,সর্ব্বলোকে চাহিয়া বিস্ময়।উঠিয়া গগনোপরে, প্রবেশিল দিনকরে,কর্ণের যতেক তেজচয়।।কর্ণ হৈল অপচয়, পৃথিবী কম্পিত হয়,রথ লয়ে গেল মদ্রপতি।কুরুদলে হাহাকার, সব হৈল অন্ধকার,কর্ণ বিনা কি হইবে গতি।।হাহা কর্ণ মহাবীর, মোর প্রাণের দোসর,হারাইলা ভুব্ন দুর্জ্জয়ে।এত বলি দুর্য্যোধন, শ্বাস ছাড়ে ঘনে ঘন,কুরুবল ভঙ্গ দিল ভয়ে।।ভীম করে সিংহনাদ, শুনি জয় জয় বাদ,বিজয় দুন্দভি বাজে দলে।সর্ব্ব সেনাপতিগণ, আশ্বাসিয়া ঘনে ঘন,নাচে গায় সবে কুতূহলে।।কোপে রাজা দুর্য্যোধন, আদেশিল সৈন্যগণ,কর দিয়া পাণ্ডবসংহার।যুদ্ধ করি সর্ব্বজন, কৃষ্ণার্জ্জুন দুইজন,বিনাশিতে করহ বিচার।।রাজার আদেশ পেয়ে, সৈন্যগণ গেল ধেয়ে,সাগর কল্লোল শব্দ করে।গদাঘাতে বৃকোদর, ক্রোধে অতি ভয়ঙ্কর,ক্ষণমাত্রে বহু সৈন্যে মারে।।আপনি নৃপতি সাজে, নিষেধিল শল্যরাজে,আজি ক্ষমা কর নরবর।পড়ে মহাবীর কর্ণ, সৈন্য হৈল ছিন্ন ভিন্ন,নাহি হয় যুদ্ধ অবসর।।আকুলিত কর্ণশোকে, সান্তাইল রাজলোকে,শিবিরে চলিল দুর্য্যোধন।দেব ঋষি গেল ঘর, হরিষত পাণ্ডুবর,শিবিরে গেলেন সর্ব্বজন।।অর্জ্জুনেরে দিয়া কোল, গোবিন্দ বলেন বোল,তোমারে সদয় পুরন্দর।কাটিয়া কর্ণের শির, ত্রিভুবন মধ্যে বীর,ধন্য তুমি ভুবন ভিতর।।শিবিরেতে গেল সব, কর্ণ হৈল পরাভব,সবাই কহিল যুধিষ্ঠিরে।কর্ণের মরণ শুনি, আনন্দিত নৃপমণি,প্রশংসা করিল অর্জ্জুনেরে।।রথে চড়ি যুধিষ্ঠির, দেখিলেন কর্ণবীর,পুত্র সনে পড়িয়াছে রণে।চন্দ্রসনে যেন ভানু, তেজে যেন বৃহদ্ভানু,বার বার দেখেন নয়নে।।কৃষ্ণেরে করেন স্তুতি, যুধিষ্ঠির নরপতি,আজি মম সুখী হৈল মন।তুমি যার সুসারথি, ভাগ্যবান সেই রথী,জিনিতে পারয়ে ত্রিভুবন।।আজি আমি রাজ্য পাব, আজি নরপতি হব,আজি সে সফল পরিশ্রম।কর্ণবীর মহাবল, পড়িল অবনীতল,সংগ্রামে সাক্ষাৎ ছিল যম।।হেনমতে মনোরঙ্গে, রাজা যুধিষ্ঠির সঙ্গে,সর্ব্বলোক শিবিরে আইল।আনন্দিত পাণ্ডুদলে, নৃত্যগীত কুতূহলে,যে যার শিবিরে প্রবেশিল।।ইহকালে শুভযোগ, পরকালে স্বর্গভোগ,ভরতের পুণ্যকথা শুনি।শ্রবণেতে পাপক্ষয়, সংগ্রামে বিজয় হয়,কাশীরাম বিরচিল গণি।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon