ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা ও কন্ব মুনির পারণ

কন্ব নামে একজন মহামুনি তপস্যারত ছিলেন। দ্বাদশী দিবসে তার তপোভঙ্গ হল। তিনি মনে মনে ভাবলেন আজ উত্তম করে পারণা দিবসে ভোজন করবেন। তাই তাড়াতাড়ি করে তিনি বাহির হয়ে নন্দালয়ে উপস্থিত হলেন।তিনি নন্দঘোষকে ডাকলেন। ডাক শোনে নন্দপত্নী বাহির হয়ে মুনিকে দেখতে পেয়ে চরণে প্রণাম করলেন। যশোদা দুই হাত জোড় করে বলেন,“কেন প্রভু নন্দঘোষকে প্রয়োজন।“ নন্দরাণীর প্রতি দৃষ্টি দিয়ে কন্ব মুনি বলেন,“কাল একাদশী ব্রত পালন করেছি। আজ পারণ করব। অনেক দিন পর পারণে মন গেছে। তাই নন্দকে খুঁজছিলাম থাকলে পারণ করতাম এখানে।” তখন নন্দরানী বললেন,“প্রভু! কৃপা করে আমার বাড়ীতে এসেছেন। নন্দঘোষ বাড়ীতে না থাকলে কি ক্ষতি। আমি আপনার পারণের সব আয়োজন করে দিচ্ছি।” এ বলে নন্দরাণী আনন্দিত হয়ে কন্ব মুনিকে আতপ চাল, দুগ্ধ ও চিনি দিলেন।কন্ব মুনি রন্ধন শেষে সুর্বণ থালে পায়েস ঢালেন। আচমন করে মুনি শুদ্ধমনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে নিবেদন করেন। বক্ষ:স্থলে হাত দিয়ে জানতে পারলেন শ্রীহরি পায়সান্ন গ্রহণ করেছেন।
অঙ্গনের অদূরেই শ্রীহরি খেলা করছিলেন। ভাবলেন মুনির আশা পূর্ণ করবেন। “গোপালায় নমঃ” বলে কন্ব মুনি ধ্যানে বসলেন। গোপাল ডাকতেই শ্রীহরি কন্ব মুনি ঘরে গেলেন। বাম জানু পাতি বাম হতে পাত্র ধরে দক্ষিণ করেতে বসে শ্রীহরি বসেন আহারে। কন্ব মুনি ধ্যান সমাপন করে চেয়ে দেখেন নন্দপুত্র বসে পায়সান্ন খাচ্ছেন। তিনি ক্রোদ্ধ হলেন। সঘনে যশোদা রাণীকে ডাকলেন। যশোদা এসে দেখে নীলমনি মনের আনন্দে পায়সান্ন আহার করছেন। তা দেখে যশোদার মনে ভয় হয় পাছে যদি মুনিবর শাপ দেন। এ সকল চিন্তা করতে করতে যশোদা মুনিবরকে বললেন,“প্রভু আমার গোপালের প্রতি আপনি ক্রুদ্ধ হবেন না। আমাকে দেখে আমার গোপালকে ক্ষমা করুন।” সকাতর বচনে মুনিবর শান্ত হলো। মুনিবর মনে মনে ভাবেন বালক স্বভাব দেব-দ্বিজ মানে না। পুনরায় যশোদা রাণী পারণের আয়োজন করে দিলেন। মুনিবর পায়সান্ন রন্ধন করলেন। যশোদাকে শুধালেন,“তোমার নীলমনিকে সামলিয়ে রেখো।” যশোদা কৃষ্ণকে কোলে নিলেন। ঘরের ভিতর শিকল দিয়ে রাখলেন। কন্ব মুনি নিজে দেখললেন যশোদা রাণী নীলমনিকে ঘরে আটকে রাখলেন।
কন্ব মুনি পুনরায় ভক্তিভরে আচমন করে “শ্রীকৃষ্ণায় নমঃ“ বলে নিবেদন করেন। “কোথায় নারায়ণ” আমার এ পরমান্ন গ্রহণ কর প্রভু”। শ্রীকৃষ্ণ ভাবেন আর তো সহিতে পারি না। মুনি নিবেদিত আহার গ্রহণ করিব। ভাবতেই শিকল মুক্ত হল এবং দ্ধার উন্মোচিত হলো। তাড়াতাড়ি এসে হরি নিবেদিত আহার ভোজন করতে লাগলেন। নয়ন মেলে পুনরায় কন্ব মুনি দেখল নীলমনি আপন মনে আবারও পায়সান্ন আহার করছে। তখন কন্ব মুনি ক্রোদ্ধান্বিত হয়ে নন্দরাণীকে ডেকে বললেন,“তোর নীলমনি আবার পায়সান্ন খেয়েছে। আমি কি রাধুনী ব্রাহ্মণ যে বার বার রন্ধন করব। খেতে যদি না দিবে ভেবেছিলে মনে তবে দুবার কেন আমাকে দিয়ে রান্না করালে। বুঝিলাম আমাকে খেতে দেবে না। কর্মভোগ করবে তোর নীলমনি।
এ কথা বলে কন্বমুনি কুশাকুশি ও কমন্ডুল হাতে তুলে চলে যেতে উদ্যত হলো। তা দেখে যশোদা রাণী ত্বরায় মুনির অগ্রভাগে গিয়ে কাঁপতে কাঁপতে হাত জোড় করে বললেন,“ক্ষমা কর প্রভু, ক্রোধ নিবেন না। অভাগীকে দেখে মার্জনা করুন। অবোধ বালক আমার দেবতা কি, দ্বিজ কি চেনে না। দ্বারে শিকল দিয়ে নীলমনিকে ঘরে রেখেছিলাম। জানিনা কি করে নীলমনি বাহিরে এলো। তা না জেনেই তুমি রাগ করে চলে যাবে মুনিবর। তবে কি তোমার কোপে গোপালকে হারাব। শঙ্কর-শঙ্করী কে বিল্বদলে পূজা করে সেই পূণ্যে গোপালকে পেয়েছি। মার্জনা কর মুনিবর। পুনরায় পায়েস রন্ধন করে পারণা করুন।” যশোদা রাণীর কথা শুনে মুনিবর বলেন,“তোর নীলমনির জন্য আমি আবার পায়সান্ন রন্ধন করিব। এখনো তোর নীলমনির উদর ভরেনি।” যশোদা বলেন,“এবার আর পায়সান্ন নষ্ট হবে না। গোপালকে আমি আপনার সামনে কোলে করে রাখব। কিছুতেই ছেড়ে দেবনা। অনুগ্রহ করে আবার পায়সান্ন রন্ধন করুন। পায়সান্ন রন্ধন না করে আপনি যেতে পারবেনা।” শুনে মুনিবর মনে মনে ভাবে যশোদার তো কোন দোষ নেই। নীলমনিকে আমার সম্মুখে ঘরে শিকল দিল। জানি না কেমনে বাহির হলো। যশোদাও সামনে ছিল না। যশোদাকে যখন ডাকলাম তখন সে অন্য গৃহ হতে সাড়া দিল। কিছু বুঝতে পারছিনা। তবে কি দীননাথ আমায় বঞ্চনা করছেন। এবার পায়সান্ন রন্ধন করে বুঝিব হরির বঞ্চনা না নারীর ছলনা।”
এসব কথা চিন্তা করে মুনিবর ফিরে এসে পুনরায় পায়সান্ন রন্ধন করতে লাগলেন এবং যশোদা রাণীকে সাবধান করলেন। যশোদা রাণী মুনিবরকে আশ্বাস দিলেন আর এরকম হবে না। মুনিবর পায়সান্ন রন্ধন করে নামানোর সাথে সাথে যশোদা নীলমনিকে কোলে তুলে নিলেন। মুনিবর পুনরায় আচমন করল। পায়সান্নে তুলসী পত্র দিল। “শ্রীকৃষ্ণায় নমঃ” বলে তাতে জল দিল। কোথা জগন্নাথ! কৃপা করে আস প্রভু। এ কৃপণকে কৃপা কর প্রভু। অনুগ্রহ করে একবার এস কৃষ্ণ।” মায়ের কোলে থেকে প্রভু মনে মনে বলেন মুনিবর বার বার আমাকে ডাকছেন আমি কাছে থেকে যদি না যাই তবে ভক্ত-বাৎসল্য নাম কেমনে রাখিব। ভক্তিভাবে কেহ ডাকলে আমি তো  থাকতে পারি না। কিন্তু যশোদা রাণী অংহকারে পুত্র বলে আমাকে ধরে রেখেছে। খাইতে দিবে না। কিন্তু ভক্ত ডাকলে যে আমি থাকতে পারি না সে কথা নন্দরানী জানে না। এ সব বিবেচনা করে শ্রীহরি নন্দরানীর কোল হতে নামলেন। কিন্তু নন্দরানী কোনকিছু বুঝতে পারলেন না। পায়েস পাত্রের নিকটে গিয়ে শ্রীহরি অঞ্জলি করে পায়েস আহার করতে লাগলেন। কন্বমুনি শ্রদ্ধাভরে অর্পন করলেন। শ্রীহরি পরমতৃপ্তিসহকারে পায়েস ভোজন করলেন এবং মনে মনে বলতে লাগলেন,“আমাকে ডেক না এমন করে। তোমরা ডাকলে আমি বৈকুন্ঠ হতে আসি। আমি যে তোমার সাক্ষাতে আছি। আজি যে পরম তৃপ্তিসহকারে খাওয়ালে তুমি, ব্রজে এসে এমন করে ভোজন করিনি আমি। ব্রাহ্মণের নিবেদিত আহার খেয়ে পরম তৃপ্তি পেলাম।” ধ্যান ভঙ্গ করে মুনিবর দেখেন নীলমনি পরম তৃপ্তিসহকারে পায়েস খাচ্ছেন আর তথায় যশোদা রানী বসে আছেন। মহাক্রোধে কন্বমুনি বলেন,“বুঝেছি তোমার চরিত্র। আমাকে এত কষ্ট দেয়া তোমার উচিৎ হয়নি।” যশোদা রানী চেয়ে দেখেন নীলমনি তার কোলে নেই। দেখেন অঞ্জলি করে পরমান্ন খাচ্ছেন। যশোদা চক্ষু রক্তবর্ণ করে বলেন,“এ কি বিপরীত কর্ম নীলমনি।” বলে নীলমনির পিঠে চাপর দিলেন। দেখিলে তো মুনিবর তিন তিনবার রন্ধন করেছে আর, তুমি তিন বারই তা খেয়ে ফেলেছ। জান না তুমি মুনিবরের কুপানলে পড়বে।” ইহা বলে পুন: নন্দরানী হাত তুলেন নীলমনির উপর। নীলমনি কেন্দে কহে জননীরা প্রতি। শোনে যশোদা নীলমনির পৃষ্ঠে প্রহার করেন। এতে নীলমনির চোখে জল আসে। পায়েসে পাত্র হাতে দিয়ে উর্ধ্বমুখি হয়ে কন নীলমনি,“কেন মা তুমি আমাকে প্রহার করলে। তুমি বুঝ কি দোষ আমার। মুনি বার বার “কৃষ্ণ কৃষ্ণ” বলে ডাকে আমায়। কেমনে থাকব গো জননী কর তার বিচার। শোন মা-জননী-শ্রদ্ধা করে দিলে কোন দ্রব্য আমি তা গ্রহণ করি। চোখ মুদে মুনি আমাকে ডাকলেন তাই এ পায়েস আমি খেয়েছি গো জননী। না বুঝে তুমি আমাকে কেন প্রহার করলে।” যশোদা শুনে বলেন,“কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলে কি আর কোন নাম এ সংসারে নেই। যে প্রভু শ্রীকৃষ্ণ বৈকন্ঠে থাকে মুনিবর সেই কৃষ্ণকে ধ্যানে ডাকছেন।” তখন কন্বমুনি মনে মনে ভাবেন কৃষ্ণ ডাকি সেই কথা যশোদানন্দ কিভাবে জানল? ধ্যানযোগে সব কিছু জানিব।” মুনিবর কৃষ্ণকে প্রহার করতে নিষেধ করল। আগে জানি কেন এ বালক আগে খায়। যশোদা তুমি ক্ষণকাল অপেক্ষা কর।” সেই কথা বলে মুনিবর আচমন করে ধ্যানস্থ হলেন। যোগবলে স্বর্গ-মর্ত্য দেখেন মুনিবর। প্রথমে দেখেন গোকুলেতে হরি নেই। সপ্ত স্বর্গ দেখে তারপর পাতাল দেখেন। তারপর ভূতল দেখেন কোথাও হরি নেই। শেষে দেখেন হরি ব্রজধানে আছেন। ব্রজধানে কোথায় হরি দেখেন নন্দালয়ে। তারই সম্মুখে পায়সায়ন্ন খাছেন। এ সব তত্ত্ব জেনে যশোদাকে কন‍‌‌,“আর নীলমনিকে প্রহার করিও না যশোদা, ধ্যানযোগে সবকিছূ জেনেছি।” ইহা শুনে ঈষৎ হাসে নীলমনি। তখন বৈজ্ঞবী মায়াতে যশোদা জননীকে ভুলাল। কারণ কন্বমুনির স্তব-স্তুতি করার ফলে যদি যশোদার ব্রহ্মজ্ঞানের উদয় হয়। তারপর কন্বমুনি কৃতাঞ্জলী হয়ে জোরহাতে প্রণাম করল এবং বলতে লাগল,“না জেনে অন্যায় করেছি প্রভু । আমাকে ক্ষমা করুন। এ কথা বলে বিভিন্ন স্তব-স্তুতি করতে লাগল –
“ হে কৃষ্ণ কেশব মধুকৈটভ-ঘাতন।
জয় কেশিমর্দ্দন হে গজেন্দ্রমোক্ষণ।।
জয় পদ্মপলাশ-লোচন দৈত্য-অরি।
জয় গোপ-পালক হে গোবর্দ্ধনধারী।।
জয় মধুসূদন হে মুকুন্দ মুরারী।
জয় বনমালী ব্রহ্ম জয় বংশীধারী।।
জয় সৃষ্টি-পালক হে শ্রীবৎসলাঞ্ছন।
জয় জগন্নাথ জয়দীশ জনার্দ্দন।।
জয় কুঞ্জবিহারী হে গোলক-পালন।
জয় গোপীবল্লভ হে নন্দের নন্দন।।
জয় জয় ভগবান ভূভার-খন্ডক।
জয় কংসাসুর আদি দুষ্টের অন্তক।।
জয় জয় রমানাথ রক্ষ ভবদায়।
এই নিবেনদ করি প্রভু রাঙ্গা পায়।। “
এইরুপে কন্বমুনি স্তব করেন আর কেন্দে কেন্দে বলেন,“পঞ্চানন পশুপতি কত জয়গান করেও শ্রীহরির কোন তত্ত্ব পায় না। সহস্রবদনে অনন্ত নাগ শ্রীহরির কোন সীমা পায় না। আমি তো অতি ভ্রান্ত। পায়সান্ন আহার করেন আর উচ্ছিষ্ট খাবার গায়ে লেপন করেন। যশোদা কে বলেন.“কত পূণ্য ফলে পেলে নীলধন। না জেনে তোমাকে কত মন্দ কটু কথা বলেছি। আমাকে ক্ষমা কর ভাগ্যবতী যশোদমতি।” নারায়ণকে প্রণাম করে কন্বমুনি বলে,“শ্রীহরি আমার পায়সান্ন আহার করেছেন সে জন্যে আমি কৃতার্থ হয়েছি।” এ কথা বলে নারায়ণের গুনকীর্তন করতে করতে কন্বমুনি গেল চলে। আর নন্দরানী নীলমনিকে কোলে তুলে নিল। যে জন এ কথা শ্রদ্ধাসহকারে শ্রবণ করে সে অন্তিমকালে পায় নারায়ণ।
Previous
Next Post »

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র