ব্রহ্মা কর্তৃক মায়া দ্বারা গোপ বালক ও বৎস হরণ

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও গোপবালগণ গোষ্ঠে ধেনু চড়াতে চড়াতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। কৃষ্ণ বললেন,” আমরা ক্লান্ত। এখানে আমরা ভোজন করব। বৎসগণ জলপান করে আমাদের চারপাশে বিচরণ করতে থাকুক।” সকলেই তাতে সায় দিল। গোপবালকগণ বৎসগণকে জল পান করিয়ে তৃণবহুল স্থানে বেঁধে রাখল। তারপর শিকাতে যে সকল খাদ্যদ্রব্য ছিল তা বের করে ভগবানের সহিত আনন্দে ভোজন করল। ব্রজবালকগণ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চতুর্দিকে পদ্মের ন্যায় বৃত্তাকারে বহু পংক্তিতে শ্রীকৃষ্ণের অভিমুখে উৎফুল্ল নয়নে একত্রে উপবিষ্ট হয়ে পদ্মের কর্ণিকার পত্রগণের ন্যায় বনমধ্যে শোভা পাচ্ছে।বালকগণের কেহ পুষ্প, কেহ পত্র, কেহ কেহ পল্বব, কেহ অংকুর, কেহ ফল, কেহ শিকা, কেহ বৃক্ষত্বক, কেহ প্রস্তর দ্বারা ভোজন পত্র কল্পনা করে ভোজন করতে লাগল। বালকগণ হাস্য-পরিহাস করতে করতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সাথে ভোজন করতে লাগল। কৃষ্ণগতপ্রাণ বৎসপালগণ তৃণলোভে দূরে বনমধ্যে প্রবেশ করেছিল। এ বিশ্বের ভয়ের যিনি ভয়স্বরূপ, সেই কৃষ্ণ সকল বৎসপালগণকে ভয়সন্ত্রস্ত দেখে সংগীয় গোপ বালকগণকে বলল,” তোমরা ভোজন হতে বিরত হয়ো না। আমি বৎসগণকে এখানে নিয়ে আসছি। এ বলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পর্বত, পর্বতগুহা, তৃণ-লতাদি আচ্ছাদিত স্থান অন্বেষণ করতে লাগলেন।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক যেভাবে অঘাসুর নিহত হয়ে মোক্ষ লাভ করেছিল তা ব্রহ্মা আকাশেস্থিত হয়ে অবলোকন করে বিস্মিত হয়েছিলেন। মায়াবালকরূপী হরির অন্য প্রকার মনোহর মহিমা বা লীলা দর্শন করার ইচ্ছায় তাদের বৎস এবং ভোজন স্থান হতে বৎসপালগণকে অপহরণ করে ব্রহ্মা অন্তর্নিহিত হলেন। এ দিকে শ্রীকষ্ণ বৎসসকলকে দেখতে না পেয়ে পুলিনে ফিরে আসলেন এবং সেখানেও বৎসপালকগণকে দেখতে না পেয়ে বনের চতুর্দিকে বৎস ও বৎসপালগণকে অন্বেষণ করতে লাগলেন। হঠাৎ জানতে পারলেন এ সকল কাজ (লুকোচুরি) ব্রহ্মার। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সর্বজান্তা, তিনি সর্বজ্ঞ। এ বিষয়ে অবগতহওয় বিচিত্র নহে। তারপর বিশ্বকর্তা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সে সকল বালকদের জননীর তথা ব্রহ্মা আনন্দ নিমিত্ত নিজেকে বৎস ও বৎসপাল এ দ্বিবিধ রূপে রচনা করলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বিবেচনা করলেন, ব্রহ্মা বৎস ও বৎসপালগণ হরণ করেছে, যদি তিনি নিরব হয়ে থাকে তা হলে বালকদের মাতৃগণের বিষাদের সীমা থাকবে না। আর যদি সে সকল বালককেই আনয়ন করেন তা হলে ব্রহ্মার মোহ হতে পারে না। তাই হরি উভয়েরই প্রীতির নিমিত্ত আপনিই দ্বিবিধ হয়ে রইলেন। “সমস্ত জগৎ যে বিষ্ণুময়”, এ যে প্রসিদ্ধ বাক্য তা যেন মুর্ত্তিমান হয়ে প্রত্যক্ষ গোচর হলো। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এভাবে সর্বাত্মা হয়ে ব্রজে প্রবেশ করলেন।ভগবান মায়ারূপে গোপবালকগণের রূপ ধারণ করেছিল। তাই সে সে বৎসসকলকে পৃথক পৃথক নিয়ে গিয়ে সে সে গৃহে প্রবেশ করালেন। ব্রজবাসীদের ইতিপূর্বে যশোদনন্দন শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আপনাদের পুত্র অপেক্ষা যে স্নেহাধিক্য ছিল এ সকল সন্তানের প্রতি তৎঅপেক্ষা অনেক বেশী বৃদ্ধি পেয়েছিল তার কোন সীমা রইল না। এভাবে স্বয়মাত্মা শ্রীকৃষ্ণ বৎস ও বৎসপালকচ্ছলে আপনি আপনাকে পালন করত: এক বৎসর পর্যন্ত বনে বনে ও গোষ্ঠে ক্রীড়া করছিলেন। বলদেবও ঐ সময় পর্যন্ত মোহ ছিল।বৎসর পূর্ণ হওয়ার পাঁচ ছয় রাত্র অবশিষ্ট থাকতে একদিন বলরামের সহিত শ্রীকৃষ্ণ বৎসচারণ করতে করতে অরণ্যে প্রবেশ করলেন।সেই বন হতে অনেক দূরে গোবর্ধন পর্বতের শিখরে ভৃণভক্ষণরত গাভীসকল ব্রজের নিকটে বিচরণশীল বৎস সকলকে দেখতে পেল।তখন গাভীসকল পর্বতের শিখর হতে দ্রুতে বেগে দুর্গম পথ অতিক্রম করে ব্রজের দিকে ধাবিত হতে লাগল। ঐ সকল বৎসবতী গাভীগণ গোবর্ধন পর্বতের নীচে প্রবেশ করে তাদের বৎেসগণকে গিলে ফেলিবার ন্যায় অঙ্গ চাটতে লাগল এবং তাদেরকে স্তন পান করতে লাগল।গোপগণ ঐ সকল গাভী সকলকে অবরোধ করার নিমিত্ত ব্যর্থ প্রয়াসে লজ্জিত ও ক্রুদ্ধ হয়ে দুগম পথ কষ্টে অতিক্রম পূবক গাভীগণের নিকট এসে গোবৎস সকলের সাথে নিজ নিজ পুত্রগণেকে দেখতে পেলেন।পুত্রগণকে দেখিবা মাত্র তাদের মধ্যে অনির্বচনীয় প্রেমরসে তাদের চিত্ত আপ্লুত হলো। তাই বালকগণের প্রতি তাদের আর কোন ক্রুধ রইল না। যে সকল শিশু স্তন পান পরিত্যাগ করেছিল তাদের প্রতি ব্রজবাসীদের প্রেমাতিশয়ের কারণ জানতে না পেরে চিন্তা করতে লাগল। ব্রজবাসীদের শ্রীকৃষ্ণের প্রতি যে অসীম প্রেম ছিল তাদের বালকদের প্রতিও ব্রজবাসীদের তদ্রুপ প্রেম বৃদ্ধি পাচ্ছে।এর কারণ কি? এ কোন মায়া? তবে কি এ মায়া দেবতা বা মানবদিগের বা দানবগণের? এ মায়া কার দ্বারা প্রযুক্ত হয়েছে? অন্য মায়া আমাকে বিমোহিত করতে পারে না, যেহেতু ইহা আমাকেও মায়া মোহ করেছে, আমার মনে এ মায়া আমার প্রভু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের। বলারাম এ রূপ চিন্তা করে জ্ঞানময় নেত্রে তিনি বৎ ও বৎসপালগণ সকলকে শ্রীকৃষ্ণস্বরূপ দর্শন কররেন।তখন বলরাম শ্রীকৃষ্ণ বলল,” এ সকল বৎসপালক দেবগণের অংশ নয়, ঋষিগণেরও অংশ নয়, ভেদাশ্রয় হলেও তুমিই ইহাদিগের মধ্যে প্রতিভাত হচ্ছ, অতএব ইহারা সকলে পৃথক অথচ কিরূপে তুমিই ইহাদের স্বরূপ হলে, ইহা সংক্ষেপে আমাকে বল।” এরূপ উক্ত হয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সংক্ষেপে বলরামকে সবিস্তারে সকল কিছু বর্ণনা করলেন।
শ্রীকৃষ্ণ মায়াবলে বৎস ও বৎসপাল সৃজন করে ক্রীড়া করতে লাগলেন। এভাবে এক বৎসর অতিবাহিত হলো। কিন্তু মনুষ্যের এক বৎসর ব্রহ্মার আত্ম পরিমাণে ক্রটিমাত্র পরিমিত কাল। ব্রহ্মা ঐ কালের পর ঐ স্থানে পুনরায় আগমন করে দেখলেন, ভগবান পূর্বের ন্যায় অনুচরগণসহ মিলিত হয়ে ক্রীড়া করছে। ব্রহ্মা চিন্তা করতে লাগলেন, গোকুলে যত বালক ও বৎস ছিল, সে সকলই আমার মায়াশয্যায় শায়িত আছে, তাদের এখনও পুনরুত্থান হয়নি। আমার মায়ায় মোহিত বালকগণ হতে ভিন্ন এ সকল বৎস ও বালকগণ কোথ হতে আসল? ইহারা এখানেই বা কি প্রকারে আসল? সে পরিমান বালকগণ এ স্থানে বিষ্ণুর সহিত এ বৎসরকার পর্যন্ত ক্রীড়া করছে।” অনেকক্ষণ চিন্তা করেও ব্রহ্মা ঐ দ্বিবিধ বালক ও বৎসগণের মধ্যে কারা সত্য, কারা অসত্য, ইহা কোনরূপে নিণয় করতে পারলেন না। মোহশূন্য অথচ বিশ্বমোহন শ্রীকৃষ্ণকে মায়া দ্বারা মুগ্ধ করতে গিয়ে ব্রহ্মা নিজেরমায়ায় নিজেই বিমোহিত হলেন।
ঠিক এ সময় ব্রহ্মার সম্মুখে এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। সকল বৎস, বৎসপাল, ষষ্টি, শৃঙ্গ প্রভৃতি পদার্থ , নবীননীরদশ্যাম, পীতকৌশেয়বসনধারী, চতুর্ভূজ, শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম-হস্ত, কিরীট কুন্ডল হার এবং বনমালায় অলঙ্কৃত শোভা পাচ্ছিল। সকলের বাহুতে শ্রীবৎসের প্রভাযুক্ত অঙ্গদ, সকলেরই হস্তে কটক, কটিসূত্র তথা অঙ্গুরীয়ক দ্বারা উদ্দ্যাতিত। সকলেরই গাত্রে জন্মাজ্জিত পূ্ণ্যশালী ভক্তজন কর্তৃক অর্পিত  কোমল তুলসীর নতুন মালা এবং তারদ্বারা সকলেরই চরশ ও মস্তক পরিপূর্ণ ছিল। সকলেই জ্যোৎস্নার ন্যায় নির্মল হাসি, অরুণবণ অপঙ্গের দর্শন দ্বারা নিজ ভক্তগণের অভিলাষ সকলে স্রষ্টা ও পালকের ন্যায় প্রকাশ পাচ্ছিল।মূর্ত্তিমা ব্রহ্মাদি তৃণ পর্যন্ত চরাচর সকলেই নৃত্যগীতাদি বহবিধ অহণ দ্বারা তাদিগের পৃথক পৃথক উপাসনা করছিল। অপর সকলেই অণিমাদি ঐশ্বর্য্য , অবিদ্যাদি শক্তি এবং মহদাদি চতুর্বিংশতিতত্বে বেষ্টিত বলে বোধ হলো। ভগবানের মহিমা দ্বারা যাদের স্বতন্ত্রতা তিরোহিত হয়, সে কাল, স্বভাব, সংস্কার, কাম, কর্ম ও গুণাদি পদার্থ সকল মূর্ত্তিমান হয়ে ঐ সকলের উপাসনা করছিল। সত্য, জ্ঞান এবং অনন্ত আনন্দ মাত্রেই যে ব্রহ্ম তাহাই তাদের মূর্ত্তি ছিল, অতএব, তাদের মাহাত্ম জ্ঞানচক্ষু আত্মজ্ঞগণেরও স্পর্শযোগ্য হয়নি। যার দীপ্তি দ্বারা সকল চরাচর এ জগৎ প্রকাশিত হচ্ছে, ব্রহ্মা এ প্রকারে ঐ সমস্ত আত্মাকে সে পরব্রহ্মরূপ দর্শন করেছিল। তারপর আশ্চযহেতু দৃষ্টি পরাবর্ত্তন করে অথবা নিজ বাহন হংস পৃষ্ঠ হতে নিপতিত হয়ে নিশ্চল হলেন। ঐ সকল বালকের তেজে তার সমুদয় ইন্দ্রিয় নিস্তদ্ধ হলো। ব্রহ্মাকে তদ্রুপ দেখে ঐ সময় এরূপ বোধ হলো যেন ব্রজাধিষ্ঠাত্রী দেবীর সমীপে একটি চতুর্মুখী কনক প্রতিমা হয়ে রয়েছেন।
সেই ভগবানের সেই অসাধারণ মহিমাময় ঐশ্বর্য্য মুগ্ধ হয়েছিলেন, এমনকি তিনি ইহা দেখতে অসমর্থ হলেন। তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হঠাৎ মায়া রূপ যবনিকা অপসারিত করলেন।ব্রহ্মা লোকপালাভিমানী, তাই ভগবানের ঐশ্বর্য্য দেখবার যোগ্য নয়। এ জন্য ব্রহ্মার উপর মায়া বিস্তার করেছিলেন। মায়া সরে যাওয়ার পর ব্রহ্মা বাহ্য দৃষ্টি ফিরে পেয়ে মৃত ব্যক্তির ন্যায় কিঞ্চিৎ উঠে ধারালেন। তারপর অতি কষ্টে নয়ন উন্মীলন করে আপনার সহিত এ জগৎ দেখতে পেলেন। চতুর্দিক নিরী্ক্ষণ করতে করতে হঠাৎ সম্মুখস্থিত বৃন্দাবন দেখতে পেলেন।সেই বৃন্দাবনে অদ্বয় অনন্ত এক এবং অগাধ বোধ স্বরূপ হওয়ায় ভগবান সে সময় গোপশিশুর অভিনয় করছিল, তিনি পূর্বের ন্যায় এক হস্তে ভোজনের গ্রাস গ্রহণ করি বৎস ও সখাগণকে অন্বেষণ করছেন, ইহা ব্রহ্মা দেখেছিলেন। ব্রাহ্মা পরব্রহ্ম শ্রীকৃষ্ণকে দেখে নিজ বাহন হতে অতি দ্রুত অবতরণ করেলেন এবং নিজ শরীরকে সুবর্ণ-দন্ডের ন্যায় ভুতলে পতিত করলেন, তারপর মস্তকচতুষ্টয়স্ত চারটি মুকুটের অগ্রভাগ দ্বারা ভগবানের চরণদ্বয় স্পর্শ করেনিজেকে আনন্দাশ্রুলে সিক্ত করলেন। ব্রহ্মা ইতিপূর্বে ভগবানের যে মহিমা দর্শন করেছিলেন তা পুন: পুন: স্মারণ করে বার বার উত্থানপূর্বক অনেকক্ষণ পর্যন্ত পাদপদ্মে পতিত হয়ে থাকলেন। তার ব্রহ্মা ধীরে ধীরে গা্ত্রোত্থান করে নয়নদ্বয় মার্জনা করতে করতে নতকন্দর হয়ে ভগবানের প্রতি  দৃ্ষ্টি নিক্ষেপ করলে এবং বিনীত ও বদ্বাঞ্জলি হয়ে সমাহিত চিত্তে কাঁপতে কাঁপতে গদগদবচনে স্তব করতে আরম্ভ করলেন।  

Previous
Next Post »

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র