১৬. ধর্ম্মফল কথনবৃত্তিদান দিয়া যেই স্থাপয়ে ব্রাহ্মণে।তার পুণ্যফল কত কহিব বদনে।।বরঞ্চ ভূমির রেণু গণিবারে পারি।সমুদ্রের জল বরং কলসিতে ভরি।।তথাপি তাহার পুণ্য না হয় বর্ণন।ইতিহাস বলি এক শুন দিয়া মন।।সুবোধ নামেতে এক বিপ্রের নন্দন।কুণ্ডীন নগরবাসী মহাতপোধন।।অষ্টভার্য্যা শতপুত্র কন্যা শত জন।সম্পদবিহীন দ্বিজ অদৃষ্ট কারণ।।নানা দুঃখ ক্লেশ দ্বিজ করে অনিবার।তথাপি ভরণ নাহি হয় সুত দার।।অন্ন বিনা শিশু পুত্র শিশু কন্যাগণ।দ্বারে দ্বারে বুলে তারা করিয়া ক্রন্দন।।দুঃখিত সন্তান জানি যত পুরজন।ঘৃণা বাসি ক্রোধে সবে করয়ে তাড়ন।।যার স্থানে যে বাঞ্ছা করয়ে দ্বিজবর।নাহি দেয় দুঃখী হেতু বলে কটুত্তর।।এইমত দুঃখে কাল কাটে তপোধন।একদিন গৃহে বসি ভাবে মনে মন।।পৃথিবীতে বৃথা জন্ম ধনহীন জনে।সর্ব্বসুখে হীন নর সম্পদবিহনে।।কুলীন পণ্ডিত কিবা জন্ম মহাকুলে।নৃপতি হউন কিবা বলে মহাবলে।।ধনহীন পুরুষে না মানে কোনজন।ধন যার থাকে, হয় সর্ব্বত্র পূজন।।যে জনের ধন নাহি বিফল জীবন।ফলহীন বৃক্ষ যেন ছাড়ে পক্ষিগণ।।জ্ঞাতি বন্ধু ভ্রাতৃ মিত্র আদি পরিবার।অন্যের থাকুক দায়, ছাড়ে সুত দার।।জলহীন সরোবর না হয় শোভন।ধনহীন পৃথিবীর মনুষ্য তেমন।।চন্দ্রহীন রাতি যেন সব অন্ধকার।ধনহীন তেমন না শোভে পরিবার।।দ্বিজ ক্ষত্র বৈশ্য কিন্বা জন্ম শূদ্রকুলে।চণ্ডালাদি জন্ম কিম্বা হউক ভূতলে।।ধনবান হৈলে হয় সর্ব্বত্র পূজিত।ধনেতে সর্ব্বত্র মান বিধি নিয়োজিত।।পাপী কিম্বা চোর যদি হয় দুষ্টজন।ধন যদি থাকে হয় সর্ব্বত্র সম্মান।।সুখ দুঃখ ফল দুই অদৃষ্ট কারণ।বিধির লিখন যাহা না হয় খণ্ডন।।কেহ কেহ বলে দুঃখ স্থান হৈতে পায়।স্বস্থান ছাড়িয়া যদি অন্য স্থানে যায়।।স্থানদোষে দুঃখ পায় স্থানে শোক হয়।অদৃষ্ট হইতে সেই শাস্ত্রমত কয়।।এইরূপে দ্বিজবর অনেক চিন্তিল।সে স্থান ছাড়িয়া শীঘ্র গমন করিল।।কৌশল নামেতে রাজা কোশল দেশেতে।পরিবার সহ দ্বিজ চলিল তথাতে।।বৃত্তিদান মাগিলেন নৃপতির স্থান।নৃপতি করেন যথাযোগ্য বৃত্তিদান।।আনন্দে রহিল দ্বিজ কোশল নগরে।পরিবার সহ থাকি সুখভোগ করে।।বৃত্তি দিয়া ব্রাহ্মণে স্থাপিল নরবর।সেই পুন্যে হৈল স্থিতি স্বর্গের উপর।।শতেক বৎসর স্থিতি আনন্দ কৌতুকে।দুই কোটি যুগ রাজা স্বর্গে ভুঞ্জে সুখে।।অনন্তর ব্রহ্মলোকে হইল গমন।এক লক্ষ যুগ তথা করিল বঞ্চন।।অনন্তর হৈল তার বৈকুণ্ঠেতে স্থিতি।দুই কোটি কল্প তথা করিল বসতি।।ব্রাহ্মণের মহিমা বেদেতে অগোচর।ব্রাহ্মণ হইতে তরে পতিত পামর।।বিষ্ণুর শরীর দ্বিজ বিষ্ণু অবতার।যাহারে গোবিন্দ করিলেন পরিহার।।পদাঘাত খেয়ে স্তুতি করেন সে কালে।অদ্যপিও পদচিহ্ন আছে বক্ষঃস্থলে।।এত শুনি জিজ্ঞাসেন ধর্ম্মের নন্দন।স্বয়ং বিষ্ণু সর্ব্ব কর্ত্তা আদি সনাতন।।তাঁরে পদাঘাত কেন করিল ব্রাহ্মণ।কহ পিতামহ শুনি সব বিবরণ।।শুনিয়া কহেন হাসি গঙ্গার নন্দন।সাবহিতে শুন রাজা হৈয়া একমন।।পূর্ব্বে ভৃগু মহামুনি ব্রহ্মার নন্দন।ব্রহ্মসত্র কৈল ব্রহ্মজ্ঞানের কারণ।।পৌলস্ত্য পুলহ ক্রতু আদি তপোধন।বশিষ্ঠ নারদ বিষ্ণু যত মুনিগণ।।একত্র হইয়া সবে যজ্ঞ আরম্ভিল।হেনকালে ভৃগুচিত্তে বিতর্ক উঠিল।।দেখি সব মুনিগণে বিস্ময় জন্মিল।কেবা সে ঈশ্বর বলি জানিতে নারিল।।অতি শীঘ্র মহামুনি ব্রহ্মার নন্দন।জানিবার তরে গেল হরের সদন।।মহাদেবে কপটে না করিল প্রণতি।দেখি মাহক্রোধ করিলেন পশুপতি।।ক্রোধ সন্বরিয়া হর কহেন বচন।কি হেতু আইলা হেথা ভৃগু তপোধন।।শুনিয়া উত্তর কিছু না দিল তাহারে।মহাক্রোধে শঙ্কর বলেন আরবারে।।অহঙ্কার কর তুমি না মান আমারে।অবহেলা কর কেন জিজ্ঞাসি তোমারে।।অহঙ্কারে উত্তর না দেও দুরাচার।এই হেতু তোরে আজি করিব সংহার।।এত বলি ত্রিশূল তুলিয়া নিয়া হাতে।ভৃগুরে মারিতে ক্রোধে যান ভূতনাথে।।হাতে ধরি শিবেরে রাখেন ত্রিলোচনা।তথা হৈতে গেল ভৃগু হইয়া বিমনা।।শীঘ্রগতি ব্রহ্মলোকে উত্তরিল গিয়া।ব্রহ্মারে না বলে কিছু চিত্তে দুঃখী হৈয়া।।কপটে সম্ভাষা না করিল জনকেরে।দেখি ক্রোধ করিলেন বিরিঞ্চি অন্তরে।।পুত্র বলি করিলেন ক্রোধ সন্বরণ।তথা হৈতে বৈকুণ্ঠে চলিল তপোধন।।তথায় দেখিল হরি খট্বার উপরে।শয়নে আছেন লক্ষী পদসেবা করে।।দেখি ভৃগু মুনিবর না ভাবি অন্তরে।দ্রুত তাঁর বক্ষঃস্থলে পদাঘাত করে।।ক্রুদ্ধা হইলেন দেখি লক্ষী ঠাকুরাণী।নিদ্রাভঙ্গে উঠিলেন দেব চক্রপাণি।।ভৃগুমুনি দেখি প্রভু উঠিয়া সত্বরে।তাঁর পদ সেবন করেন পদ্মকরে।।আমার কঠিন দেহ বজ্রের তুলনা।চরণ কমলে তব হইল বেদনা।।শুনি মহামুনি ভৃগু লজ্জিত বদন।নানাবিধ প্রকারেতে করিল স্তবন।।নমঃ প্রভু ভগবান অখিলের পতি।নমস্তে ব্রহ্মণ্য দেব নমো জগৎপতি।।তুমি হে জানহ ভক্ত ভয়ত্রাতা।করিলাম এই দোষ হইয়া অজ্ঞান।।মম অপরাধ ক্ষমা কর ভগবান।যোড়হাত করিয়া কহেন দামোদর।।কদাচিত চিন্তান্তর নহ দ্বিজবর।পদাঘাত নহে মম হইল ভূষণ।।এত শুনি সানন্দ হইল তপোধন।নানামত স্তুতি করে প্রভু নারায়ণে।।মুনি পুনঃ গমন করিল যজ্ঞস্থানে।মহাভারতের কথা অমৃত লহরী।।শুনিলে অধর্ম্ম খণ্ডে পরলোকে তরি।চন্দ্রচূড় পদদ্বয় করিয়া ভাবনা।।কাশীরাম দেব করে পয়ার রচনা।১৭. নারায়ণ ও একাদশীর মাহাত্ম্যভীষ্ম বলিলেন রাজা করহ শ্রবণ।পৃথিবীতে জন্মি পুণ্য করে যেই জন।।সর্ব্ব পাপে মুক্ত সেই নিষ্পাপ শরীর।অন্তে মোক্ষগতি লভে শুন যুধিষ্ঠির।।অষ্টমীর উপবাস করে যেই জন।শুদ্ধচিত্তে শিবদুর্গা করে আরাধন।।ভূমিদান রত্নদান করিয়া ব্রাহ্মণে।অতিথি অথর্ব্ব পূজা করে অন্নাদানে।।দিব্য অন্ন উপহার করিয়া রন্ধন।কুটুম্বেরে দিয়া পরে করয়ে পারণ।।এমত মাসে মাসে অষ্টমীর ক্ষণে।শুদ্ধচিত্তে এই ব্রত করে সাবাধনে।।সর্ব্ব পাপে মুক্ত হৈয়া শিবলোকে যায়।কদাচিত যমের তাড়না নাহি পায়।।নারায়ণ নামে ব্রত বিখ্যাত জগতে।নারায়ণ ব্রত যেই করে শুদ্ধ চিত্তে।।তাহার পুণ্যের কথা না যায় বাখান।সংক্ষেপে কহিব কিছু কর অবধান।।গৃহ ধর্ম্মে থাকিয়া করিবে যেই জন।সর্ব্বভূতে দয়া করি করিবে পূজন।।যেমন বৈভব তথা করিবেক ব্যয়।ব্রাহ্মণেরে দিবে ধন হৈয়া শুদ্ধাশয়।।মূলমন্ত্র তিনবার করিবে চিন্তন।উপহার বৈভব করিবে নিবেদন।।অবশেষে প্রণমিয়া পড়িবে ধরণী।ভক্তিভাবে বলিবে বিবিধ স্তুতিবাণী।।লক্ষী নারায়ণ জয় জগত জীবন।নমস্তে গোবিন্দ জয় জয় নারায়ণ।।এইরূপে ভক্তি করি লক্ষী নারায়ণ।অবশেষে করি আবাহন বিসর্জ্জন।।ভূমিদান দিবে আর অন্নদান আদি।অতিথি ব্রাহ্মণেরে পূজিবে যথাবিধি।।দ্বিজ গুরু আজ্ঞা তবে মস্তকে ধরিয়া।পশ্চাতে ভুঞ্জিবে সুখে নিয়ম করিয়া।।এইমত নারয়ণ ব্রত যে আচরে।কুটুম্বের সহ যায় বৈকুণ্ঠ নগরে।।একাদশী মহাব্রত বাখানে পুরাণে।তার কথা কহি রাজা শুন একমনে।।গালব নামেতে মুনি মহাতপোধন।ভদ্রশীল নাম ধরে তাহার নন্দন।।সর্ব্ব ধর্ম্ম ত্যজিয়া আরাধে নারায়ণ।তাহার পণ্যের কিছু কহিব কথন।।স্বয়ম্ভূ নন্দন হেন ধ্রুব মহাশয়।শিশুকাল অবধি আরাধে জন্মেজয়।।সেইরূপ ধর্ম্মশীল গালবনন্দন।সর্ব্ব ধর্ম্ম ত্যজিয়া আরাধে নারায়ণ।।দেব পাঠ তপ জপ শাস্ত্র অধ্যয়ণ।সব ত্যজি করে হরিমন্দির মার্জ্জন।।মাসে মাসে কৃষ্ণ শুক্লা দুই একাদশী।শুদ্ধচিতে আরাধয়ে পরম তপস্বী।।দেখিয়া পুত্রের কর্ম্ম সবিস্ময় মন।জিজ্ঞাসিল কহ তাত ইহার কারণ।।নানামত বিষ্ণুভক্তি আছে শাস্ত্রমতে।তপ জপ পূজা ধর্ম্ম বিখ্যাত জগতে।।ব্রাহ্মণের তপ জপ ধর্ম্ম আচরণ।ইহার কি ফল কহ শুনি হে নন্দন।।এত শুনি ভদ্রশীল বলয়ে বচন।এই যে ব্রতের ফল না যায় কথন।।আকাশের তারা যদি গণিবারে পারি।সমুদ্রের জল যদি কলসীতে ভরি।।পৃথিবীর রেণু যদি পারি যে গণিতে।তথাপি এ ব্রতপুণ্য না পরি কহিতে।।সংক্ষেপে কহিব কিছু শুন সারোদ্ধার।সোমবংশে পূর্ব্বজন্ম আছিল আমার।।ধর্ম্মকীর্ত্তি নাম ছিল বিখ্যাত জগতে।দুষ্টমার্গে রত বড় ছিলাম মর্ত্ত্যেতে।।একচ্ছত্র ভূপতি ছিলাম জম্বুদ্বীপে।অধর্ম্মে ছিলাম রত ধর্ম্মেতে বিরূপে।।প্রজাগণে পীড়িনু হিংসিনু শান্তজন।এইরূপে পাপ করিলাম আচরণ।।একদিন দৈবযোগে সৈন্যের সহিতে।মৃগয়া করিতে গেনু চড়ি অশ্ব রথে।।বিপিনে যাইয়া এক ঘেরিনু হরিণে।ডাক দিয়া কহিনু সকল সৈন্যগণে।।যার দিক দিয়া এই হরিণ যাইবে।কদাচিত তারে যদি মারিতে নারিবে।।বংশের সহিত তারে করিব সংহার।এই বাক্য সবার বলিনু বার বার।।শুনিয়া সজাগ হৈল সর্ব্ব সৈন্যগণ।সশঙ্কিত হৈয়া মৃগ ভাবে মনে মন।।যদ্যপি পলাই এই সৈন্য দিক দিয়া।সবংশে তাহারে রাজা ফেলিবে কাটিয়া।।এক প্রাণী রক্ষা হেতু মরিবে অনেক।শুভদিন আজি একাদশী অতিরেক।।ইতিমধ্যে যদ্যপি আমার মৃত্যু হয়।পশুত্ব খণ্ডিবে মোক্ষ লভিব নিশ্চয়।।যে হৌক সে হৌক মম যাউক পরাণ।নৃপতির দিক দিয়া করিব প্রস্থান।।যদি বা আমাকে রাজা করিবে নিধন।মোক্ষগতি হবে পাপ পশুত্ব মোচন।।যদি কদাচিত প্রাণ রহেত আমার।নৃপতি পাইবে লজ্জা সৈন্যের নিস্তার।।এতেক ভাবিয়া মৃগ সেইরূপ করে।মম দিক দিয়া মৃগ চলিল সত্বরে।।আকর্ণ পূরিয়া বাণ মারি শীঘ্রগতি।না বাজিল মৃগে বাণ এমতি নিয়তি।।লজ্জা ভাবি তবে ক্রোধে চড়িয়া অশ্বেতে।ঘোর বনে গেল মৃগ না পাই দেখিতে।।দণ্ডক অরণ্যে বহু করিয়া ভ্রমণ।নাহি পাইলাম মৃগ দৈব নির্ব্বন্ধন।।অশ্ব হত হৈল, শ্রম হইল বহুল।ক্ষুধায় তৃষ্ণায় চিত্ত হইল আকুল।।ক্ষুধা তৃষ্ণাযুত আমি হইয়া বিশেষে।বৃক্ষতলে রহিলাম দিবা অবশেষে।।রাত্রিশেষে হৈল মম দৈবে লোকান্তর।দুই যমদূত আসে অতি ভয়ঙ্কর।।মহাশাপ দিয়া মোরে করিল বন্ধন।সত্বরে লইয়া গেল যমের সদন।।দেখি ধর্ম্মরাজ বড় গর্জ্জিল দূতেরে।অকারণে কেন হেথা আনিলে ইহারে।।সর্ব্বপাপে মুক্ত আছে এই নরবর।একাদশী উপবাসে হৈল লোকান্তর।।শুন কহি দূতগণ আমার বচন।একাদশী ব্রত আচরিবে যেই জন।।দাস্যভাবে করে হরি মন্দির মার্জ্জন।তারে হেথা তোরা না আনিবি কদাচন।।গোবিন্দের নাম যেই করয়ে স্মরণ।সর্ব্বভূতে সমভাবে ভজে নারায়ণ।।কদাচ তাহারে তোরা হেথা না আনিবি।সাবধান বিস্মরণ কভু নাহি হবি।।দেবতুল্য পিতৃ মাতৃ যে করে সেবন।অতিথি সেবয়ে করে তীর্থ পর্য্যটন।।ভূমিদান গো দানাদি করে দ্বিজগণে।দুঃখী দরিদ্রকে তৃপ্ত করে অন্ন ধনে।।সভামধ্যে মুখে যার মিথ্যা নাহি খসে।দৈবযজ্ঞ করে যেই ব্রাহ্মণ উদ্দেশে।।গোধন পালন করে সর্ব্ব জীবে দয়া।সন্ন্যাস গ্রহণ করে ত্যজি গৃহমায়া।।যোগ সাধি মৃত্যুঞ্জয়ে ভজে যেই জন।শুদ্ধভাবে যেই আরাধয়ে নারায়ণ।।সাবহিত হয়ে করে পুরাণ শ্রবণ।পুরাণ পড়য়ে যেই শুদ্ধ চিত্ত মন।।ধর্ম্মকথা কহিয়া লওয়ায় অধর্ম্মিরে।কদাচিত তাহারে না আন হেথাকারে।।ব্রাহ্মণের নিন্দা যেই করে অনুক্ষণ।পিতৃ মাতৃ নিন্দে যেই বেশ্যাপরায়ণ।।বিষ্ণুভক্তি আশ্রয় করিয়া যেইজন।পরনারী সঙ্গে সদা করয়ে রমন।।তাহারে আনিবি তোরা প্রহার করিয়া।নাসিকা ছেদন করি পাশেতে বান্ধিয়া।।পরনারী হয়ে যেবা হইয়া অজ্ঞান।সভামধ্যে গুরুজনে করে অপমান।।তাহারে আনিবি তোরা আমার সদন।হাতে গলে মহাপাশে করিয়া বন্ধন।।দেবতা উদ্দেশে দ্রব্য আনি যেই জন।দেবতারে নাহি দিয়া করয়ে ভক্ষণ।।লৌহপাশে বান্ধি তারে আনিবে হেথারে।করিয়া প্রহার মাথে লৌহের মুদগরে।।ধর্ম্ম বিঘ্নকর আর বিদ্বেষী যেই জন।উপহাস করে দ্বিজে হৈয়া দুষ্টমন।।উপহাস করে দ্বিজে হৈয়া দুষ্টমন।হেথকারে বান্ধি তোরা আনিবি তাহারে।।পরবৃত্তি হরে যেবা জন্মিয়া সংসারে।পরভার্য্যা হরে যেবা বলাৎকার করি।।অজ্ঞান হইয়া যেবা হরয়ে কুমারী।তাহারে আনিবি তোরা করিয়া বন্ধন।।এইরূপ পাপ আচরয় যেই জন।এই শুনি বিস্ময় মানিল দূতগণ।।করযোড়ে ধর্ম্মারাজে করয়ে স্তবন।এ সকল কথা পিতা করিয়া শ্রবণ।।অবশেষে পাপ মম হইল খণ্ডন।বিধিমতে যম মোরে করিল পূজন।।স্বর্গ হতে দিব্য রথ আইল তখন।অজ্ঞানে হইল একাদশী আচরণ।।সেই পুণ্যে হল মম স্বর্গে আরোহণ।কোটি কোটি বর্ষ তাত স্বর্গে হৈল স্থিতি।।তদন্তরে ব্রহ্মলোকে করিনু বসতি।কোটি যুগ ব্রহ্মলোকে করিয়া ভ্রমণ।।তোমার ঔরসে আসি হইল জনম।দিব্যজ্ঞানে পাপ মোর না হয় বাধক।।সে কারণে একাদশী করিনু সাধক।।ইহার বৃত্তান্ত এই কহিলাম পিতঃ।শুনিয়া গালব মুনি হইল বিস্মিত।।আনন্দিত হৈয়া পুত্রে করিল চুম্বন।সেই হৈতে হৈল মুনি হরি পরায়ণ।মহাভারতের কথা অমৃত লহরী।।একচিত্তে শুনিলে তরয়ে ভববারি।শান্তিপর্ব্ব ভারতের অপূর্ব্ব কথন।।সাবহিত হইয়া শুনয়ে যেই জন।মনোবাঞ্ছা ফল লভে নাহিক সংশয়।।ব্যাসের বচন ইথে কভু মিথ্যা নয়।মস্তকে বন্দিয়া ব্রাহ্মণের পদরজ।।কহে কাশীদাস গদাধরের অগ্রজ।১৮. বীরবাহু রাজার উপাখ্যানআর এক কথা কহি শুনহ রাজন।একাদশী ব্রতের শুনহ বিবরণ।।বীরবাহু রাজা ছিল বড় পুণ্যবান।জনম অবধি রাজা করে নানা দান।।বসন ভূষণ দান দেয় ত ব্রাহ্মণে।যত দান করে তার নাহি পরিমাণে।।প্রবাল মুকুতা মণি করিয়া ভূষিত।স্বর্ণশৃঙ্গ রৌপ্যখুর যেই শাস্ত্রনীত।।নব নব বৎস সহ গাভী দুগ্ধবতী।লক্ষ লক্ষ গাভী দান কৈল নরপতি।।বস্ত্র অলঙ্কার আর রথ সহ সাজ।তুরঙ্গ করিল দান আর গজরাজ।।যে কিছু আছিল রাজা সব দান কৈল।সিংহাসন আদি করি দ্বিজে সব দিল।।খাদ্যপূর্ব্ব দিল ধন ভাণ্ডারে যে ছিল।কিছু ধন সেই রাজা বক্রী না থুইল।।থাল ঝারি বাটা বাটী সব কৈল দান।অনেক করিল দান নাহি পরিমাণ।।আর কিছু নাহি ঘরে সব দ্বিজে দিল।রাজা রাণী একবাস হইয়া রহিল।।সন্ধ্যাতে আইল তবে এক দ্বিজবর।শীঘ্র করি চলি গেলা রাজার গোচর।।অসকালে দ্বিজবর গেল রাজ-স্থান।আমি কিছু নাহি পাই শুনহ রাজন।।পশ্চাৎ আইনু রাজা আমি নাহি পাই।তব দান যশ কীর্ত্তি শুনি সর্ব্ব ঠাঁই।।শুনিয়া দ্বিজের বাক্য রাজা ক্রোধ কৈল।সকল লইয়া দ্বিজ এবে না ছাড়িল।।বিষম ব্রাহ্মণজাতি বড়ই জঞ্জালে।একবার ঘরে থুইয়া আইল সন্ধ্যাকালে।।সর্ব্বস্ব করিয়া দান কুপিল রাজন।অশ্ববিষ্ঠা অঞ্জলি করিয়া দিল দান।।স্বস্তি বলি অশ্ববিষ্ঠা নিল দ্বিজবর।অঞ্চলে বান্ধিয়া দ্বিজ চলিল সত্বর।।পরম যতন করি দিল দ্বিজবরে।অন্তঃপুরে গেল রাজা দ্বিজ গেল ঘরে।।এই পাপ হৈল যদি রাজার শরীরে।দান ফলে লক্ষগুণ বাড়ে নিরন্তরে।।পূর্ব্বের যতেক দান সকল নাশিল।অশ্ববিষ্ঠা পর্ব্বত প্রমাণ তবে হৈল।।অশ্ববিষ্ঠা হৈল দুই পর্ব্বত শিখরে।এত দান নাশ কৈল পাপ দানফলে।।সেই দেশে বৈসে এক দেবীদাস মালী।তাহার মালঞ্চেতে গন্ধর্ব্বে ফুল তুলি।।গন্ধর্ব্বে তোলয়ে পুষ্প মালঞ্চ ভিতরে।ফুল নাহি পায় মালী মহাশোক করে।।দৈবযোগে এক দ্বিজ মালঞ্চে বসিয়া।ত্রিলোচন পূজা কৈল হরষিত হৈয়া।।দৈবের নির্ব্বন্ধ কিছু খণ্ডন না যায়।শিবের নির্ম্মাল্য লাগে গন্ধর্ব্বের পায়।।পাপ হৈল গন্ধর্ব্বের চলিতে না পারে।রথ নাহি চলে তার স্বর্গের উপরে।।হইল প্রভাতকাল দেখিল সকল।চুরি করি নিল ফুল সেই পাপফল।।মালী আসি গন্ধর্ব্বেরে বহু মন্দ বলি।নৃপে শীঘ্র জানাইল করিয়া অঞ্জলি।।রাজার নিকটে কহে সর্ব্ব বিবরণ।অপূর্ব্ব শুনিয়া রাজা আইল তখন।।পুছিলেন মহারাজ তুমি কোন জন।কি নাম তোমার হেথা আইলে কি কারণ।।গন্ধর্ব্ব বলেন, আমি ইন্দ্রের পালিত।এই মালঞ্চের পুষ্প তুলি নিত্য নিত্য।।পুষ্পদন্ত নাম মোর গন্ধর্ব্বের পতি।কহিনু সকল কথা শুন মহামতি।।রাজা বলে, স্বর্গে নাহি গেলে কি কারণ।কোন কার্য্যে মনুষ্য করিলা দরশন।।গন্ধর্ব্ব বলিল, মোর পাপ হৈল কায়।তেকারণে মোর রথ স্বর্গে নাহি যায়।।রাজা বলে, স্বর্গপুরে কোন পুণ্যে যাই।ইহার কারণ তুমি বল মোর ঠাঁই।।গন্ধর্ব্ব বলয়ে যেবা করে একাদশী।সে আসি ছুঁইলে রথ হব স্বর্গবাসী।।তবে মোর রথ চলে পাপ হৈয়া ক্ষয়।এত শুনি চিন্তিত হইল মহাশয়।।কিবা ব্রত একাদশী কেবা করে হেথা।কেমন বিধান তার কিমত ব্যবস্থা।।গন্ধর্ব্ব বলয়ে শুন রাজরাজেশ্বর।তিথি একাদশী সেই হরির বাসর।।আপনি গোবিন্দ হৈলা তিথি একাদশী।একাদশী মাহাত্ম্য শুনহ পরকাশি।।দশমীতে সংযম করিবে একাহার।সদাচার হবিষ্যাদি বিবিধ প্রকার।।একাদশী উপবাস নিরম্বু সাধিবে।ফলমূল জলাহার নাহিক করিবে।।দ্বাদশী পারণ করিবেক তারপর।যাহাতে তরয়ে লোক এ ভব সাগর।।পূর্ব্বে রুক্মাঙ্গদ রাজা ছিল মহীতলে।রাজ্য সহ স্বর্গে গেল একাদশী ফলে।।তোমার পুরেতে কেবা করে উপবাস।তাহারে খুঁজিয়া রাজা আন মোর পাশ।।শুনিয়া নৃপতি তবে বিচারিল দেশ।না জানি ব্রতের নাম কহিতে বিশেষ।।কিমত প্রকার সেই নাম একাদশী।হেন নাহি জানি ব্রত রহে উপবাসী।।লীলা নামে এক বেশ্যা ছিল ত নগরে।মায়ের সহিত দ্বন্দ্ব করিল সত্বরে।।একাদশী দিনে সেই থাকিল শুইয়া।না খাইল অন্ন জল কোন্দল করিয়া।।পুরুষ সহিত সেই না বঞ্চিল রাতি।সেই বেশ্যা আনে বীরবাহু নরপতি।।ছুঁইল গন্ধর্ব্বরথ চলিল তখন।তাহা দেখি গন্ধর্ব্ব হইল হৃষ্টমন।।অপূর্ব্ব দেখিল তবে বীরবাহু রায়।করযোড়ে করি বলে গন্ধর্ব্বের পায়।।মোর নিবেদন কিছু তোমার চরণে।পাপ-পুণ্য কিবা মোর পুছহ ইন্দ্রস্থান।।বারেক আসিয়া মোরে দিবে দরশন।আজি হৈতে মৈত্র মোর করি নিবেদন।।শুনিয়া গন্ধর্ব্ব তাঁরে কহিলা নিশ্চয়।অবশ্য করিব কার্য্য নাহিক সংশয়।।গন্ধর্ব্ব এতেক বলি গেলা স্বর্গপুরে।কহিল সকল কথা গিয়া সুরেশ্বরে।।শুনি সুরপতি গন্ধর্ব্বের হাত ধরি।দেখাইল লৈয়া ইন্দ্র অপূর্ব্ব এক পুরী।।সুবর্ণ রচিত পুরী অতি মনোহর।সুবর্ণ পতাকা উড়ে ঘরের উপর।।মণিময় মাণিক্যেতে করে ঝলমল।অন্ধকার নাহি তাহে সদাই উজ্জ্বল।।খাট পাট সিংহাসন আছে থর থরে।মন্দ মন্দ পবন বহিছে সেই পুরে।।শীতল সলিল তাহে বহে অনিবার।পুরের নির্ম্মাণ দেখে চন্দ্রের আকার।।সুবর্ণ প্রাচীর তার শোভে চারিভিতে।দেবতার বাসযোগ্য কহিল তোমাতে।।রতনের সিংহাসন রতন-মন্দির।দেখিতে আনন্দ বড় দেবের শরীর।।নানা উপহার দ্রব্য দেবের দুর্লভ।একে একে গন্ধর্ব্বেরে দেখাইলে সব।।এক সরোবর জল অমৃত-সমান।তার মধ্যে পর্ব্বত আছয়ে দুইখান।।তাহা দেখি গন্ধর্ব্ব জিজ্ঞাসে ইন্দ্রস্থানে।জলমধ্যে পর্ব্বত আছয়ে কি কারণে।।ইন্দ্র বলে, বীরবাহু বড় পুণ্যবান।ত্রিভুবনে পুণ্য নাহি তাহার সমান।।ধর্ম্মবলে এই পুরী পাইবে বসতি।ভুঞ্জিবে সকল সুখ রাজা আসি ইথি।।কিন্তু আগে কীট হৈয়া নরক ভুঞ্জিবে।নরকপর্ব্বত এই নিশ্চিত পাইবে।।অশ্ববিষ্ঠা দ্বিজবরে রাজা দিল দান।দুই লক্ষগুণ হৈল পর্ব্বত-প্রমাণ।।ইহা ত ভুঞ্জিলে তার পাপ হবে ক্ষয়।তবে ত ভুঞ্জিবে পুণ্য কহিনু নিশ্চয়।।শুনিয়া ব্যাকুল হৈল গন্ধর্ব্ব ঈশ্বর।ইন্দ্রকে প্রণাম করি গেল নিজঘর।।আর দিন গেলা তবে বাহুর মন্দিরে।কহিল সকল কথা রাজার গোচরে।।শুনিয়া ব্যাকুল রাজা পুছে গন্ধর্ব্বেরে।কিমতে হইবে মোর পাপের উদ্ধারে।।পুনর্ব্বার যাহ তুমি পুরন্দর স্থান।এই যে নরক হবে কিসে পরিত্রাণ।।আর দিন পুষ্পদন্ত সুরপুরে গেল।ইন্দ্রের অগ্রেতে তবে কহিতে লাগিল।।রাজা বীরবাহু যে করিল এই কর্ম্ম।কহিবে কিমতে তার খণ্ডিবে অধর্ম্ম।।কোন্ পুণ্যে পাপ তার হইবে মোচন।কহ সুরপতি মোরে ইহার কারণ।।ইন্দ্র বলে শুন এবে গন্ধর্ব্বের পতি।দুহিতা লইয়া যদি থাকে নরপতি।।কন্যা লয়ে গুপ্তে থাকে নহে পাপ মন।রাজার দুর্ণীতি যদি দোষে সর্ব্বজন।।তবে ত তাহার পাপ হইবে বিনাশ।কন্যা লৈয়া নৃপতি নির্জ্জনে করু বাস।।তবে তার এই পাপ হইবেক ক্ষয়।আর কোনমতে পাপ দূর নাহি হয়।।শুনিয়া গন্ধর্ব্ব গেল রাজার সদন।বীরবাহু নৃপে কহে সব বিবরণ।।শুনিয়া নৃপতি বড় দুঃখী হৈল মনে।এমত দুর্ণীত কর্ম্ম করে কোন্ জনে।।না করিলে পাই আমি নরক দুস্তর।করিলেও অপকীর্ত্তি হবে চরাচর।।শুনিয়া গন্ধর্ব্বরাজ দিলেন উত্তর।কি হেতু আক্ষেপ তুমি কর নৃপবর।।লোক অপযশ গাবে পরকাল রয়।অবশ্য করিবে তাহা শুন মহাশয়।।ধর্ম্মচিন্তা কর রাজা আপন মঙ্গল।ধর্ম্মেতে বিরাগ যেন নহে তব স্থল।।এত বলি পুষ্পদন্ত নিজস্থানে গেল।দুহিতা লইয়া রাজা নির্জ্জনে চলিল।।নারীগণ ত্যজি রাজা দুহিতা লইয়া।নির্জ্জনে করিল বাস একত্র হইয়া।।দুহিতা সঙ্গতি একা রহে নরপতি।নৃপপাশে রহে কন্যা ষোড়শী যুবতী।।সকল দেশেতে রাজার হইল অখ্যাতি।কন্যার সহিত রহে রাজা মহামতি।।রাজ্যসহ সর্ব্বলোক করে হাহাকার।রাজা পাপী হৈল করে কন্যা পরদার।।কেনে দুষ্টমতি হৈল না বুঝি কারণ।বুঝি রাজা করিবেক নরকে গমন।।ইহার যে দেখে মুখ সেই হবে পাপী।এমত রাজ্যেতে আর না রব কদাপি।।যত দান ধর্ম্ম কৈল সব নষ্ট হৈল।কন্যারে হরিয়া রাজা নরকে পড়িল।।কেহ বলে, হেন কর্ম্ম কৈল কোন্ জন।অধর্ম্ম করিয়া করে দুহিতা গমন।।এই বাক্য নগরে ঘোষয়ে সর্ব্বজন।বৃদ্ধ যুবা বাল্য আদি যত নারীগণ।।যথা তথা বসি লোক এই কুৎসা গায়।যত কহে তত রাজার পাপ হয় ক্ষয়।।সর্ব্বদা বলয়ে লোক পথে ঘাটে মাঠে।যত কহে তত সেই অশ্ববিষ্ঠা টুটে।।যেই যেই কহে সেইপাপ বাটি লয়।নগর-বাহিরে তার এক তাঁতি রয়।।পরম ধর্ম্মিক সেই কৃষ্ণপরায়ণ।তাঁত বুনে সদা করে হরিসর্ঙ্কীর্ত্তন।।হরি হরি সদা সেই বলে অনুক্ষণ।সদাই করেন হরিনাম উচ্চারণ।।পুরাণ শ্রবণ আর হরি হরি বলে।ধীরে ধীরে বলে কভু, কভু উচ্চস্বরে।।সতত বলয়ে তাঁতি হরি হরি হরি।এই মতে তিনবার বলে উচ্চস্বরী।।সে তাঁতি রাজার নিন্দা কভু নাহি করে।হরিনাম বিনা তার নাহিক অন্তরে।।কতদিনে আইল তবে গন্ধর্ব্বের নাথ।আসিয়া রাজার সনে করিল সাক্ষাৎ।।রাজা বলে, কহবন্ধু আপন কুশল।আমার পাপের ভার গেল কি সকল।।পুষ্পদন্ত বলে রাজা বলিতে না পারি।আছে কি গিয়াছে অশ্ববিষ্ঠা স্বর্গপুরী।।রাজা বলে গন্ধর্ব্বেরে বিনয় বচন।কৃপা করি কহ মোরে এ সব কথন।।গন্ধর্ব্ব বলিল, আমি যাই স্বর্গপুরী।তবেত সে সব কথা কহিব বিস্তারি।।তদন্তরে পুষ্পদন্ত স্বর্গপুরে গেল।রাজার দুয়ারে বিষ্ঠামুষ্টিক দেখিল।।ইহা দেখি পুষ্পদন্ত বিস্ময় হইল।সত্বর হইয়া তবে ইন্দ্রপাশে গেল।।এই সব কথা তবে পুছে ইন্দ্রস্থানে।মুষ্টিক প্রমাণ রহে কিসের কারণে।।ইন্দ্র বলে, শুন এবে গন্ধর্ব্বের পতি।তাঁতি বলে, পাপ নাহি করে নরপতি।।তেকারণে কিছু পাপ রহিল রাজার।যত দান কৈল তত বিষ্ঠা আছে আর।।যদি একাদশী ব্রত করিবে রাজন।তবেত রাজার পাপ হইবে মোচন।।শুনিয়া কহিল আসি গন্ধর্ব্বের পতি।তবে একাদশী কৈল নৃপ মহামতি।।খণ্ডিল সকল পাপ রাজার শরীরে।মরিয়া ত গেল রাজা ইন্দ্রের নগরে।।ইহার অধিক ব্রত নাহি যুধিষ্ঠির।একাদশী কর তুমি মন কর স্থির।।একাদশী-ব্রতাধিক নাহি ধর্ম্ম রায়।একাদশী মাহাত্ম্য আমি কহিনু তোমায়।।১৯. একাদশী ব্রতোপলক্ষে যজ্ঞমালীর উপাখ্যানকহেন গঙ্গার পুত্র কুম্ভীর পুত্রেরে।আর কিছু ব্রতকথা কহিব তোমারে।।একাদশী ব্রতকথা সর্ব্বব্রত সার।অবধান কর শুন ধর্ম্মের কুমার।।পূর্ব্বে কহিয়াছি একাদশী অনুষ্ঠানে ।পারণাদি অতঃপর শুন একমনে।।শুদ্ধচিত্তে এই ব্রত কর আচরণ।সর্ব্বদুঃখে তরে সেই পাপ বিমোচন।।প্রাতঃকালে স্নান করি একাদশী দিনে।ধৌত বস্ত্র পরি তৈল গ্রহণ বর্জ্জনে।।সেইরূপে জনার্দ্দন করিয়া স্থাপন।ত্রিকোণ করিয়া করি আসন রচন।।পূর্ব্বমুখ হয়ে ব্রতী বসিবে আসনে।শুদ্ধচিত্তে আরাধিবে দেব নারায়ণে।।ন্যসমন্ত্র পড়ি স্নান জপ নমস্কার।মূলমন্ত্র জপি ধ্যান করি আরবার।।তদন্তরে নানা পুষ্পে পূজিবে বিধানে।হৃদয় কমলোপরি স্মরি নারায়ণে।।তদন্তরে নৈবেদ্যাদি নানা উপহারে।তাহা দিয়ে পুনরপি পূজিবে আচারে।।নৈবেদ্য তুলসী দিয়া করি নিবেদন।পূজা অনুসারে তবে করি বিসর্জ্জন।।অবশেষে বাঁটিয়া দিবেক ভক্তগণে।শিরে কর ধরি করি পূজা সমাধানে।।পরদিন প্রাতঃকালে স্নান দান করি।নানাবিধ উপহারে পূজিবে শ্রীহরি।।পূজা সমাপন করি দিয়া বিসর্জ্জন।তদন্তরে দ্বিজগণে করাবে ভোজন।।নিজ বন্ধু বান্ধব যতেক জ্ঞাতিগণ।সবাকারে আনিবে করিয়া নিমন্ত্রণ।।পারণ করিবে তবে বন্ধুগণ লয়ে।ব্রত সমর্পিবে পরে সাবধান হয়ে।।এইরূপে পূজা করি যে সেবে শ্রীহরি।সর্ব্ব পাপে মুক্ত হয়ে যায় বিষ্ণুপুরী।।পূর্ব্ব ইতিহাস কথা কহিনু তোমাতে।একাদশী দিনে উপবাস হৈল যাতে।।গালব মুনির পিতা পুত্রের সংবাদ।একাদশী করি তার ঘুচিল প্রমাদ।।কহিনু তোমারে রাজা ধর্ম্মের নন্দন।পুরাণ সম্মত কথা ব্যাসের বচন।।মুনি বলে অবধানে শুন জন্মেজয়।এতেক শুনিয়া কথা ধর্ম্মের তনয়।।চিত্তগত ভ্রান্তি গেল শান্ত হৈল তনু।পুনরপি জিজ্ঞাসেন কুন্তী অঙ্গজনু।।কোন প্রকারেতে ভক্তি সাধি দামোদরে।কিবা ভক্তি সাধিলে কি ফল পায় নরে।।বিষ্ণুর মন্দির যেবা করয়ে মার্জ্জন।দাস্যভাব করিয়া যে ভজে নারায়ণ।।তাহার কি ফল হয় কহ মহাশয়।নিতান্ত উদ্বেগ চিত্ত খণ্ডাহ সংশয়।।ভীষ্ম কন ভাল জিজ্ঞাসিলা নৃপমণি।অবধান কর কহি পূর্ব্বের কাহিনী।।দেবমালী নামে বিপ্র ছিল শান্তিপুরে।সর্ব্বশাস্ত্রে বিশারদ বিদিত সংসারে।।যজন যাজন কৃষি বাণিজ্য ব্যাপারে।করিল সঞ্চয় ধন বিবিধ প্রকারে।।এইরূপে নানাসুখে বঞ্চে তপোধন।অপত্যবিহীন দ্বিজ সদা দুঃখীমন।।একদিন ভার্য্যা সহ বসি তপাধন।পুত্রাভাবে নানারূপ করয়ে শোচন।।পুত্রহীন বৃথা জন্ম বেদের বচন।ইহকালে দুঃখ অন্তে নরকে গমন।।দুগ্ধহীন গাভী যেন পুত্রহীন তেন।এইরূপে দ্বিজ বহু করিল শোচন।।পুত্রহীন চিন্তায় আকুল তপোধন।নারদ জানিয়া দেখা দিলেন তখন।।নারদে দেখিয়া মুনি কৈল আরাধন।পাদ্য অর্ঘ্যে করিলেন চরণ বন্দন।।দেবমালী দ্বিজেরে জিজ্ঞাসে তপোধন।কহ মুনিবর কেন বিরস বদন।।করযোড় করিয়া করিল নিবেদন।সর্ব্ব তত্ত্ব জ্ঞাত তুমি মহা তপোধন।।চরাচরে হইয়াছে যেবা হইবেক।ভূত ভাবী বর্ত্তমান জানহ প্রত্যেক।।নারদ কহেন মন বুঝিয়া তাহার।সন্দেহ না কর দ্বিজ হইবে কুমার।।অচিরে হইবে তব যুগল নন্দন।এত বলি স্বস্থানে গেলেন তপোধন।।দেবমালী মহাযজ্ঞ কৈল আরম্ভন।যজ্ঞভেদী হল আসি দুইটি নন্দন।।পরম সুন্দর শিশু অতি সুলক্ষণ।দেখি আনন্দিত মন ব্রাহ্মণী ব্রাহ্মণ।।যজ্ঞেতে জন্মিল নাম যজ্ঞমালী হৈল।সুমালী কনিষ্ঠপুত্র পাপীষ্ঠ জন্মিল।।কতদিনে যোগ্য দুই হইল নন্দন।তদন্তরে দেবমালী দৃঢ় করি মন।।সংসারে বাসনা মন ছাড়িতে ইচ্ছিল।আপনার সঞ্চিত যতেক ধন ছিল।।সমান করিয়া ভাগ দিল দুই সুতে।অরণ্যে প্রবেশ কৈল ভার্য্যার সহিতে।।জানন্তি নামেতে তথা মহা তপোধন।সর্ব্বশাস্ত্রে বিজ্ঞ ত্রিকালজ্ঞ বিচক্ষণ।।বিষ্ণুভক্তিপরায়ণ হরিনামে রত।চতুর্দ্দিকে শিষ্ট যত শিষ্য অগণিত।।তাঁর কাছে গিয়া উত্তরিল তপোধন।দেখিয়া জানন্তি মুনি কৈল অভ্যর্থন।।অতিথি বিধানে পূজা করিয়া সাদরে।জানন্তি জিজ্ঞাসে সেই অভ্যাগত নরে।।কোথা হতে আইলেন কোথায় নিবাস।কোন প্রয়োজনেতে আইলা মম পাশ।।এত শুনি বলে ঋষি করিয়া প্রণাম।ভৃগুবংশে জন্ম মম দেবমালী নাম।।যোগ সাধিবারে আইলাম তব স্থান।কৃপা করি মোরে দেব দেহ তত্ত্বজ্ঞান।।কিরূপে তরিব আমি এ ভব সংসার।কাহা হতে সংসার বন্ধনে হব পার।।কহ মুনিবর মোরে যদি কর দয়া।তোমার প্রসাদে যেন তরি ভব মায়া।।এত শুনি কহিতে লাগিল তপোধন।ত্রিদশের নাথ বিষ্ণু এক সনাতন।।তাঁহার আশ্রয় কৈলে সর্ব্ব পাপ খণ্ডে।সংসার হইতে তরে ঘোর যমদণ্ডে।।তাঁহার আশ্রয় বিনা গতি নাহি আর।সেই ব্রহ্ম সনাতন জগতের সার।।তাঁহারে ভজহ পূজ তাঁরে কর স্তুতি।তাঁর সেবা কর তাঁরে করহ ভকতি।।নাম শুন শ্রবণ করিহ অনুক্ষণ।সংসার তরিতে এই কহিনু লক্ষণ।।এত শুনি আনন্দিত হৈল দেবমালী।প্রদক্ষিণ করি বিপ্র তথা হৈতে চলি।।ভার্য্যা সহ উত্তরিল যমুনার তাঁরে।স্তুতি ভক্তি করিয়া পূজিল দামোদরে।।একান্ত ভকতি করি কৃষ্ণে আরাধিল।যোগে তনু ছাড়ি বিষ্ণুপুরে প্রবেশিল।।চিতা করি তার ভার্য্যা জ্বালিল আগুণি।পতি সঙ্গে বিষ্ণুপুরে গেল সুবদনী।।যজ্ঞমাপলী সুমালী যুগল পুত্র তার।মহামতী যজ্ঞমালী ধর্ম্ম অবতার।।পিতার যতেক ধন সঞ্চিত আছিল।নানাবিধ দান দিয়া পুণ্যকর্ম্ম কৈল।।তড়াগাদি জলাশয় দিল স্থানে স্থানে।তড়াগাদি জলাশয় দিল স্থানে স্থানে।।বিচিত্র মন্দির ঘর দিল নারায়ণে।নানাবিধ ধ্যানযোগে দেবে আরাধিল।।দাস্যভাব করি কৃষ্ণচরণ সেবিল।দেখিয়া সকল জীব আত্মার সমান।।নিজ হস্তে কৈল হরি মন্দির মার্জ্জন।এইরূপে যজ্ঞমালী পুণ্য উপার্জ্জিল।পুত্র পৌন্ত্র বৃদ্ধি হয়ে আনন্দে রহলি।।সুমালী পাপিষ্ঠ বড় কৈল অনাচার।পিতার সঞ্চিত ধন যত ছিল তার।।অসৎপাত্রে মজাইল সতে নাহি দিল।বৃষলীর বশ হয়েসব মজাইল।।অবশেষে চুরি হিংসা পরিবাদ কৈল।যত ধন ছিল এইরূপে মজাইল।।তার দুষ্টকর্ম্ম দেখি যত বন্ধুগণ।জ্যেষ্ঠ যজ্ঞমালী সহ মিলে জ্ঞাতিগণ।।এক দিন যজ্ঞমালী নিভৃতে বসিয়া।বিধিমতে বুঝাইল অনেক কহিয়া।।শুনিয়া তাহার কথা ক্রুদ্ধ হৈল মনে।চুলে ধরি সহোদরে কৈল প্রহারণে।।হাহাকার শব্দ উঠে পুরীর ভিতরে।যতেক নগরবাসী আইল সত্বরে।।তার দুষ্টকর্ম্মদেখি সবে ক্রুদ্ধ হৈল।মহাপাশে সুমালীরে বান্ধিয়া ফেলিল।।তর্জ্জন গর্জ্জন বহু করিল তাড়ন।অনেক প্রকার কৈল নগরের জন।।দয়াশীল যজ্ঞমালী দয়া উপজিল।ভ্রাতৃস্নেহ হেতু তারে মুক্ত করি দিল।।দুঃখিত দেখিয়া তারে ক্ষমা দিল চিত্তে।কুলের বাহির তারে করিল দুবৃর্ত্তে।।এইরূপে কতকাল করিল বঞ্চন।হেনকালে দোঁহাকার হইল নিধন।।ধর্ম্ম আত্মা যজ্ঞমালী ধর্ম্মপরায়ণ।পাঠাইয়া বিমান দিলেন নারায়ণ।।দুই দূত আইলেন শরীর সুন্দর।বিমান লইয়া তারা আইল সত্বর।।রথে তুলি যজ্ঞমালী নিল সেইক্ষণ।গন্ধর্ব্বেতে গীত গায় নর্ত্তকে নাচন।।এইরূপে বৈকুণ্ঠেতে করিল গমন।পথে সুমালীর সঙ্গে হৈল দরশন।।ভয়ঙ্কর যমদূত বিকৃতি আকার।পাশে বান্ধি লয়ে যায় করিয়া প্রহার।।দেখি সবিস্ময় চিত্ত যজ্ঞমালী হয়ে।দূতেগণে নিবেদিল বিনয় করিয়ে।।এই দুষ্ট দূত হৈল কাহার কিঙ্কর।কাহারে প্রহার করে কেবা এই নর।।কোথাকারে লয়ে যায় কিসের কারণে।বান্ধিয়া লইয়া যায় কোন্ প্রয়োজনে।।যদি দূত জান তবে কহিবা আমারে।এত শুনি বিষ্ণুদূত কহিল তাহারে।।এই দুই জন হয় যমের কিঙ্কর।এই যে দেখিছ পাপী তব সহোদর।।যতেক অর্জ্জিল পাপ না হয় এড়ান।বান্ধিয়া লইয়া যায় যম বিদ্যমান।।এত শুনি যজ্ঞমালী মানিল বিস্ময়।পুনরপি জিজ্ঞাসিল করিয়া বিনয়।।যদি জান দূতগণ কহ বিবরণ।কোন প্রকারেতে এই হয়ত মোচন।।দূতগণ বলে এই পাপী দুরাচার।আছয়ে উপায় এক মুক্তি করিবার।।তোমার সদনে আছে যদি কর দান।পূর্ব্বের কাহিনী কহি কর অবধান।।কৌশল নগরে পূর্ব্বে কামিলা নামেতে।বেশ্যাকুলে জন্ম এক ছিল দুষ্টচিতে।।গো ব্রাহ্মণ বিনাশিয়া হয় দুষ্ট চোর।তাহার পাপের কথা কি কহিব ঘোর।।চুরি হিংসা করে আর বেশ্যাপরায়ণ।নানারূপ কুকর্ম্ম অধর্ম্মি দুষ্টজন।।তার দুষ্টকর্ম্ম দেখি যত বন্ধুজন।নগর বাহির করি দিল সেইক্ষণ।।বন্ধুগণ তাড়নেতে ভয় পেয়ে মনে।ক্ষুধা তৃষ্ণাযুক্ত হয়ে প্রবেশিল বনে।।ভ্রমিতে ভ্রমিতে শ্রম হইল শরীর।দৈবেতে পাইল এক কেশব মন্দির।।মন্দির সমীপে এক সরোবর ছিল।স্নান দান নিত্যকর্ম্ম তাহাতে করিল।।শ্রম দূরে গেল শান্ত হৈল কলেবর।আশ্রয় লইল সেই মন্দির ভিতর।।যত ভস্ম অঙ্গার আছিল ভাঙ্গা ঘরে।পরিষ্কার যে সব করিল নিজ করে।।শ্রমযুক্ত হয়ে তাহে শয়ন করিল।আয়ুশেষে আসি কাল উপনীত হৈল।।গৃহের ভিতর মহাকাল সর্প ছিল।দংশিয়া বৈশ্যেরে সেই বনান্তরে গেল।।দৈবের নির্ব্বন্ধ খণ্ডে যোগ্যতা কাহার।সর্পের দংশনে মৃত্যু হইল তাহার।।দুই দূত সেখানে আইল সেইক্ষণ।মহাপাশে বৈশ্যপুত্রে করিল বন্ধন।।জানিয়া যমের দুষ্ট কর্ম্ম গদাধর।আমা দোঁহে পাঠাইয়া দিলেন সত্বর।।সেইক্ষণে করিলাম মোচন তাহার।যমদূতে করিলাম বহু তিরস্কার।।সেই পুণ্যে বিষ্ণুর সাহায্যে মুক্তি পায়।পূর্ব্বের কাহিনী এই জানাই তোমায়।।গোচর্ম্ম প্রমাণ বিষ্ণু মন্দির মার্জ্জনে।উদ্ধারহ নিজ ভ্রাতা দিয়া পুণ্যদানে।।এত শুনি যজ্ঞমালী আনন্দিত মনে।সুমালীরে পুণ্যদান দিল সেইক্ষণে।।পুণ্যের প্রভাবে সব পাপ হৈল ক্ষয়।যমদূত প্রতি তবে বিষ্ণুদূত কয়।।ভ্রাতৃ পুণ্যফলে এই পাইল নিস্তার।ছাড়হ ইহারে তোরা আরে দুরাচার।।ইহার উপরে তোর নাহিক শাসন।এত বলি মুক্তি করি দিল সেইক্ষণ।।যজ্ঞমালী শুনি তবে স্তব্ধচিত্ত হৈয়া।উভয়ে বৈকুণ্ঠে গেল বিমানে চাপিয়া।।সুমালীর কথা যমদূত নিবেদিল।শুনিয়া সকল দূতে যম প্রবোধিল।।সেইক্ষণে যজ্ঞমালী নির্ব্বাণ পাইল।বিষ্ণুর সাহায্যে মুক্তি সুমালী পাইল।।সেই পুণ্যফলে সেই গেল স্বর্গবাস।ধর্ম্ম সনে গঙ্গাপুত্র কন ইতিহাস।।শ্রদ্ধাভক্তি হয়ে যেই দাস্যভাব করি।মন্দির মার্জ্জন করি ভজয়ে শ্রীহরি।।তাহার পুণ্যের কথা কে কহিতে পারে।অবহেলে এ ভব সংসার সুখে তরে।।কহিলাম তোমারে এ ধর্ম্মের নন্দন।পূর্ব্বের কাহিনী এই ব্যাসের বচন।।একচিত্তে একমনে শুনে যেই জন।তাহার পুণ্যের কথা না হয় কথন।।এ ভব সংসার সুখে তরে অবহেলে।তাহার পাপের পীড়া নাহি কোন কালে।।নাহিক সংশয় ইথে ব্যাসের বচন।কাশীরাম কহে ভাবি গোবিন্দ চরণ।।২০. হরিমন্দির মার্জ্জনের ফলভীষ্ম বলিলেন শুন রাজা ধর্ম্মরায়।আর কিছু ধর্ম্মকথা কহিব তোমায়।।গোবিন্দেরে করয়ে যে স্তুতি আচরণ।নানা উপহার দিয়া করয়ে পূজন।।সোমবার দ্বাদশী দিবস শুভক্ষণে।ক্ষীর জলে স্নান যে করায় নারায়ণে।।বংশের সহিত যায় বৈকুণ্ঠ ভুবন।কদাচ না পায় সেই যমের তাড়ন।।ভাদ্রমাসে কৃষ্ণাষ্টমী রোহিণী লক্ষণে।ক্ষীরজলে স্নান যে করায় নারায়ণে।।উপবাস করি হরি করয়ে চিন্তন।ত্রিভঙ্গ ললিত দিব্য মূর্ত্তি নারায়ণ।।সর্ব্বপাপে মুক্ত হয় সেই মহাশয়।বংশের সহিত হয় বৈকুণ্ঠে বিজয়।।গোবিন্দ মন্দির যেই করয়ে মার্জ্জন।তাহার পুণ্যের কথা না যায় কথন।।অজ্ঞানে সজ্ঞানে করে নাহিক বিচার।সর্ব্ব ধর্ম্ম লভে সেই মহাপাপে পার।।পূর্ব্বে শুনিলাম আমি দেবলের মুখে।সেই হেতু মহারাজ কহিব তোমাকে।।সাবধান হয়ে রাজা শুন একচিত্তে।যজ্ঞধ্বজ নাম ছিল ইক্ষ্বাকু বংশেতে।।মহাধর্ম্মশীল রাজা বিখ্যাত সংসার।একচ্ছত্র জম্বুদ্বীপ যাঁর অধিকার।।রাজধর্ম্ম যত সব ত্যজিয়া রাজন।স্বহস্তে করেন হরিমন্দির মার্জ্জন।।বীতিহোত্র নামে তার কুল পুরোহিত।এ সব দেখিয়া যজ্ঞধ্বজের চরিত্র।।সচিন্তিত হৃদয় হইয়া তপোধন।একদিন নৃপতিরে জিজ্ঞাসে কারণ।।কহ শুনি রাজা তুমি সর্ব্ব ধর্ম্মান্বিত।সর্ব্বশাস্ত্রে বিজ্ঞ তুমি বিচারে পণ্ডিত।।কি কর্ম্ম অসাধ্য তব আছে পৃথিবীতে।যাহা ইচ্ছা করিবারে পারহ করিতে।।এত শুনি হাসিয়া বলয়ে নরপতি।ইহিতাস কথা কহি কর অবগতি।।ছিলাম পূর্ব্বেতে দুষ্টমতি পাপাচার।পরদ্রব্য চুরি হিংসা করেছি অপার।।বৃষলী আসক্ত আমি হয়ে একেবারে।গৃহের যতেক ধন দিলাম তাহারে।।গৃহের যতেক ধন দিলাম তাহারে।মম কর্ম্ম দেখি পিতৃ মাতৃ ভ্রাতৃগণ।।ক্রুদ্ধ হৈয়া সবে মোরে করিল তাড়ন।সবাকার বাক্য আমি করি অবহেলা।।রাহু যেন নিঃশঙ্কে গ্রাসয়ে চন্দ্রকলা।মাহক্রুদ্ধ হৈল তবে যত ভ্রাতৃগণ।প্রহার করিয়া মোরে করিল বন্ধন।।নিবারিতে না পারিল অশেষ বিশেষে।গৃহ হৈতে দূর করি দিল অবশেষে।।ক্রোধে গৃহ হৈতে আমি হইয়া বারিত।মহাঘোর বনে গিয়া পশিনু ত্বরিত।।অনাহারে অবসন্ন হইল শরীর।ঘোর বনে পাই এক বিষ্ণুর মন্দির।।বৃষ্টিজলে কর্দ্দম আছিল মন্দিরেতে।পরিষ্কার করি শেষে শুইনু তাহাতে।।দৈবযোগে এক সর্প তাহাতে আছিল।নিদ্রার আবেশে মোর চরণে দংশিল।।সেইক্ষণে কালপূর্ণ হইল আমার।দুই যমদূত এল বিকৃতি আকার।।মহাপাশে শীঘ্র মোরে করিল বন্ধন।হেনকালে বিষ্ণুদূত আসে দুইজন।।ক্রোধে যমদূতে চাহি বড়ই গর্জ্জিল।পাশ হৈতে মুক্ত মোরে ত্বরিত করিল।।দেখি সবিস্ময় হৈল যমদূতগণ।করযোড়ে বিষ্ণুদূতে করে নিবেদন।।মোরা দোঁহে হই ধর্ম্মরাজ অনুচর।তাঁর আজ্ঞা ধরি মোরা মস্তক উপর।।সংসারের মধ্যে যত মরে জীবগণ।পশু পক্ষী মনুষ্যাদি জন্তু অগণন।।সবারে লইয়া যাই যমের সদন।পাপ পুণ্য বুঝি যম করেন তাড়ন।।এই যজ্ঞমালী পাপী বিখ্যাত জগতে।ইহার পাপের কথা না পারি কহিতে।।কি কারণে পাপমুক্ত করিলে ইহারে।কেবা দোঁহে পরিচয় দেহত আমারে।।এত শুনি হাসি দোঁহে করিল উত্তর।মোরা দুইজনে হই বিষ্ণুর কিঙ্কর।।জগতের র্হ্ত্তা কর্ত্তা দেব নারায়ণ।তাঁর আজ্ঞা মাথে ধরি করি যে ভ্রমণ।।হরিনাম স্মরণ করয়ে যেই জন।হরি পূজা করে হরিমন্দির মার্জ্জন।।শ্রবণ কীর্ত্তন নাম করয়ে বন্দন।দাস্যভাব সখ্যভাব আত্ম নিবেদন।।তারে অধিকার তব নাহি কদাচন।সর্ব্বপাপে মুক্ত আছে সেই মহাজন।।গোবিন্দ মন্দির এই করিল মার্জ্জন।ইথে অধিকার তব নাহি কদাচন।।এতেক বলিয়া দুই হরির কিঙ্কর।লয়ে গেল শীঘ্র মোরে বৈকুণ্ঠনগর।।সহস্র শতেক যুগ তথা হৈল স্থিতি।অদন্তর ব্রহ্মলোকে করিনু বসতি।।শতকল্প ব্রহ্মলোকে করিনু বিহার।তদন্তর ইন্দ্রলোকে হই আগুসার।।চতুর্দ্দশ মন্বন্তর কাল পরিমাণ।যত ভোগ করি স্বর্গে না হয় বাখান।।তদন্তর এই মহা ইক্ষ্বাকুবংশেতে।সেই পুণ্যে আসিয়া জন্মিনু পৃথিবীতে।।অজ্ঞানে করিনু হরিমন্দির মার্জ্জন।তাহাতে এ গতি হৈল শুন তপোধন।।জ্ঞানে যেবা করে হরিমন্দির মার্জ্জন।শুদ্ধভাব হইয়া পূজয়ে নারায়ণ।।পৃথিবীর রেণু যদি পারি যে গণিতে।তাহার পুণ্যের কথা না পারি কহিতে।।ভীষ্ম বলিলেন রাজা করহ শ্রবণ।এত শুনি বীতিহোত্র হন তুষ্ট মন।।কয়যোড়ে নৃপতিরে করিল বন্দন।সর্ব্ব ধর্ম্ম ত্যজি নিল গোবিন্দ শরণ।।শান্তিপর্ব্ব ভারতের অপূর্ব্ব কথন।একচিত্তে একমনে শুনে যেই জন।।সর্ব্ব দুঃখে তরে সেই নাহিক সংশয়।পয়ার প্রবন্ধে কাশীদাস দেব কয়।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon