মহাভারত:বিরাটপর্ব-০৩৬-০৪০

৩৬. দ্রোণাচার্য্যের যুদ্ধ ও পরাভব
কৃপাচার্য্য ভঙ্গ যদি হইল সমরে।
অর্জ্জুন বলেন তবে বিরাট কুমারে।।
রক্তবর্ণ চারি ঘোড়া যোড়া যেই রথে।
শীঘ্র রথ লহ মোর তাঁহার অগ্রেতে।।
শুনিয়া বিরাট পুত্র বায়ুসম বেগে।
চালাইয়া দিল রথ দ্রোণাচার্য্য আগে।।
নিকটে দেখিয়া দ্রোণ অর্জ্জুনের রথ।
আগুবাড়ি নিজে গুরু আসে কত পথ।।
গুরু দেখি পার্থ অস্ত্র যুড়েন যুগল।
দুই অস্ত্র পড়ে গিয়া দুই পদতল।।
আচার্য্য যুগল অস্ত্র এড়িল তখন।
দুই ভুজে ধরি পার্থে কৈল আলিঙ্গন।।
কর যুড়ি গুরুদেবে বলে ধনঞ্জয়।
যুদ্ধসজ্জা কি কারণে দেখি মহাশয়।।
কাহার সহিত যুদ্ধ করিবে আপনে।
আমারে মারিবে অস্ত্র হেন লয় মনে।।
অশ্বত্থামাধিক আমি তোমার পালিত।
কোন্ দোষে দোষী পায় নহি যে দোষিত।।
পাশাকালে কথা তুমি জানহ আপনে।
কপটে যতেক দুঃখ দিল দুষ্টগণে।।
দ্বাদশ বৎসর বনে বঞ্চিলাম ক্লেশে।
অজ্ঞাত বঞ্চিনু এক বর্ষ ক্লীববেশে।।
এ কষ্টের হেতু যেই বৈরী দুষ্টগণ।
এত দিনে পাইলাম তার দরশন।।
যথোচিত ফল আজি দিব আমি তারে।
দুঃখ নিবেদন এই করিনু তোমারে।।
ইহাতে আপনি প্রভু না করিবে ক্রোধ।
তব ক্রোধ করিলে না করি উপরোধ।।
আজ্ঞা কর, একভিতে লহ নিজ রথ।
দুর্য্যোধনে ভেটি গিয়ে, ছাড়ি দেহ পথ।।
হাসিয়া বলেন দ্রোণ, এ কোন্ উচিত।
কৌরবের সেনাগণ আমার রক্ষিত।।
মম অগ্রে কৌরবেরে করিবে ঘাতন।
কিমতে দাঁড়ায়ে আমি করিব দর্শন।।
পার্থ বলে, পাছে দোষ না দিও আমায়।
তোমারি শিক্ষিত বিদ্যা দেখাব তোমায়।।
ইহা শুনি গুরু ক্রোধে হয়ে হুতাশন।
আকর্ণ পূরিয়া এড়ে দিব্য অস্ত্রগণ।।
তিন শত অস্ত্র ‍ামরে অর্জ্জুন উপর।
কাটিয়া অর্জ্জুন বীর ফেলিলেন শর।।
ব্যর্থ বাণ দেখি গুরু ক্রোধে গুরুতর।
অর্জ্জুনে মারিল পুনঃ সহস্র তোমর।।
অন্ধকার করি যায় গগন মণ্ডলে।
শরতের কালে যেন হংসপংক্তি চলে।।
দিব্য অস্ত্র ধনঞ্জয় পূরিয়া সন্ধান।
কাটিয়া ফেলেন যত আচার্য্যের বাণ।।
পুনঃ দিব্য অস্ত্র গুরু মন্ত্রে অভিষেকি।
সম্বর সম্বর বলে অর্জ্জুনেরে ডাকি।।
আকাশে উঠিল অস্ত্র যেন দিবাকর।
মুখ হতে বৃষ্টি হয় মুষল মুদগর।।
পরশু তোমর জাঠি, নাহি লেখাজোখা।
চতুর্দ্দিকে পড়ে যেন জ্বলন্ত উল্কা।।
অস্ত্র এড়ি দ্রোণাচার্য্য ব্যথিত হৃদয়।
ডাকিয়া বলিল, সম্বরহ ধনঞ্জয়।।
দেখিয়া অর্জ্জুন, বাণ এড়েন গন্ধর্ব্ব।
নিমিষেতে নিবারেন গুরু অস্ত্র সর্ব্ব।।
দোঁহে দিব্য শিক্ষা, রণে না করে বিশ্রাম।
গুরু শিষ্যে এই মত হইল সংগ্রাম।।
ক্রোধে গুরু, পঞ্চ বাণ মারে কপিধ্বজে।
বাণাঘাতে কপিধ্বজ অধিক গরজে।।
পুনঃ দিব্য বাণ পূরে গুরুদেব দ্রোণ।
গগন ছাইয়া কৈল অস্ত্র বরিষণ।।
না দেখি বানরধ্বজ সারথি অর্জ্জুন।
মেঘে যেন আচ্ছাদিল না দেখি অরুণ।।
দ্রোণের বিক্রমে উল্লসিত দুর্য্যোধন।
নিমিষেকে অস্ত্র তার কাটেন অর্জ্জুন।।
তবে পার্থ দিব্য অস্ত্র করিয়া সন্ধান।
আচার্য্যেরে মারিলেন সহস্রেক বাণ।।
সহস্র সহস্র বাণ আচার্য্য মারিল।
দুই অস্ত্রে গগণেতে মহাশব্দ হৈল।।
ঢাকিল সূর্য্যের তেজ, ছাইল আকাশ।
অন্ধকার হৈল সূর্য্য, রুধিল বাতাস।।
অস্ত্র অস্ত্র ঘরিষণে হৈল উল্কা বৃষ্টি।
অমর ভুজঙ্গ নর চাহে একদৃষ্টি।।
আকাশে প্রশংসা করে যত দেবগণ।
সাধু দ্রোণাচার্য্য ভরদ্বাজের নন্দন।।
যাহার শিক্ষিত বিদ্যা অদ্ভুত দর্শন।
যার শিষ্য ধনঞ্জয় জয়ী ত্রিভুবন।।
তবে পার্থ ইন্দ্র-অস্ত্র যোড়েন গাণ্ডীবে।
সহস্র সহস্র বাণ যাহাতে প্রসবে।।
মন্ত্রে অভিষেকি বাণ মারেন তখন।
চক্ষুর নিমিষে সব ছাইল গগন।।
যেন মহা-দাবানলে বেড়িল পর্ব্বত।
অস্ত্র-অগ্নি আচ্ছাদিল, নাহি দেখি পথ।।
অগ্নিতে বেড়িল দ্রোণে, নাহি দেখি আর।
যতেক কৌরবদল করে হাহাকার।।
সাধু ধনঞ্জয় বলি ডাকে দেবগণ।
সুগন্ধি কুসুম কত করে বরিষণ।।
বাপের সঙ্কট দেখি অশ্বত্থামা বেগে।
জনকে করিয়া পাছে হৈল পার্থ আগে।।
৩৭. অশ্বত্থামার যুদ্ধ ও পরাজয়
যেই বেগে হৈল আগে দ্রোণের তনয়।
ধ্বজ কাটি ফেলিলেন বীর ধনঞ্জয়।।
অশ্বত্থামা আগে পড়ে কাটা রথচূড়া।
না করিতে রণ আগে রথ হৈল মুড়া।।
লজ্জিত হইয়া ক্রোধে দ্রোণের নন্দন।
অর্জ্জুন উপরে করে বাণ বরিষণ।।
প্রলয়ের মেঘ যেন মুষলের ধারে।
সেইমত অস্ত্রবৃষ্টি করে পার্থোপরে।।
দিবানিশি নাহি জ্ঞান, অস্ত্রে আচ্ছাদিল।
থাকুক অন্যের কাজ, পবন রুধিল।।
অশ্বত্থামা অর্জ্জুনের যুদ্ধ অনুপাম।
যেন ইন্দ্র বৃত্রাসুর, রাবণ শ্রীরাম।।
পূর্ব্বে যথা যুদ্ধ হৈল দেবতা অসুর।
দোঁহার ধনুক-ঘোষে কম্পে তিন পুর।।
ঝাঁকে ঝাঁকে অস্ত্রবৃষ্টি, নাহি লেখাজোখা।
অস্ত্র বিনা রণমধ্যে অন্য নাহি দেখা।।
চট্ চট্ শব্দ উঠে, কর্ণে লাগে তালি।
দোঁহা অস্ত্র দোঁহে কাটে, দোঁহে মহাবলী।।
বিচিত্র চালায় রথ উত্তর সারথি।
চক্রবৎ ক্রমে যেন বায়ু সম গতি।।
অর্জ্জুনের ছিদ্র দ্রৌণি চিন্তিয়া অন্তরে।
গাণ্ডীব ধনুক চাহে কাটিবার তরে।
অচ্ছেদ্য অভেদ্য ধনু দেবের নির্ম্মাণ।।
কি করিতে পারে তাহে মনুষ্য-পরাণ।
মহাক্রোধে অশ্বত্থামা হইয়া ক্রোধিত।।
সপ্তচত্বারিংশ শর মারিল ত্বরিত।
ধনুকে বিংশতি, ধনুর্গুণে সপ্ত শর।
কপিধ্বজে দশ, দশ উত্তর উপর।।
ক্রোধে ধনঞ্জয় করিলেন শরবৃষ্টি।
প্রলয়ের কালে যেন সংহারিতে সৃষ্টি।।
কভু বা দক্ষিণ হস্তে বিন্ধে কভু বামে।
এইমত শরবৃষ্টি করিলেন ক্রমে।।
অক্ষয় পার্থের তূণ, পূর্ণ অস্ত্রচয়।
যত ব্যয় তত হয়, নাহি তার ক্ষয়।।
সেইমত দ্রোণ পুত্র অস্ত্রবৃষ্টি কৈল।
দোঁহাকার শরজালে পৃথিবী ঢাকিল।।
সহস্র সহস্র অস্ত্র মারে পুনঃ পুনঃ।
দ্রৌণির হইল ক্রমে শরশূন্য তূণ।।
৩৮. কর্ণের পুনর্ব্বার যুদ্ধ ও পলায়ন
রণমধ্যে অশ্বত্থামা নিরস্ত্র হইল।
দেখিয়া সূর্য্যের পুত্র ক্রোধেতে ধাইল।।
বিজয় নামেতে ধনু ভৃগুপতি দত্ত।
আকর্ণ পূরিয়া ধায় যেন গজ মত্ত।।
হাসিয়া অর্জ্জুন বীর ছাড়িয়া দ্রৌণিরে।
সম্মুখে দেখিয়া কর্ণে কহিছেন তারে।।
ক্রোধে কয় ধনঞ্জয় চক্ষু রক্তবর্ণ।
হে রাধেয় মুঢ়মতি সূতপুত্র কর্ণ।।
সতত কহিস্ করি মহা অহঙ্কার।
পৃথিবীতে বীর নাহি সমান আমার।।
তাহার পরীক্ষা আজি করিব এক্ষণে।
সাক্ষাতে দেখুক আজি কুরুবীরগণে।।
সভামধ্যে বসি যত কৈলে অহঙ্কার।
ক্ষত্র হয়ে প্রাণে তাহা সহিবে কাহার।।
দ্রৌপদীর অপমান যতেক করিলি।
তার প্রতিশোধ পাবি এই কথা বলি।।
ধর্ম্মপাশে বন্দী আছিলাম সেইকালে।
সকল সহিনু কষ্ট যতেক করিলে।।
অগ্নিসম অঙ্গমাজে দহিছে সে ক্লেশ।
অরণ্যের মহাকষ্ট, অজ্ঞাত বিশেষ।।
আজি তোরে দিব আমি সমুচিত ফল।
সাক্ষাতে দেখুক আজি কৌরব সকল।।
এত শুনি কহে তবে কর্ণ মহাবীর।
নাহিক সম্ভ্রম কিছু, নির্ভয় শরীর।।
যে কহিলে ধনঞ্জয় কর শীঘ্রগতি।
যত পরাক্রম তোর, যতেক শকতি।।
পাশাকালে দ্রৌপদীর যত অপমান।
মনে মনে আজি তাহা অন্তরেই জান।।
দ্রোণ স্থানে ইন্দ্র-স্থানে সে অস্ত্র পাইলি।
যে পার করহ শীঘ্র, এই তোরে বলি।।
ইন্দ্রাদি সঙ্গে কির যদি আসিস্ রণে।
বাহুড়িয়া যাবি হেন না করিস্ মনে।।
ইহা শুনি হাসি হাসি বলে ধনঞ্জয়।
লজ্জা যার থাকে, সে কি হেন কথা কয়।।
এইক্ষণে পূর্ণ নাহি হইতে প্রহর।
বিদ্যমানে কাটিলাম তোর সহোদর।।
ভঙ্গ দিয়া পলাইলি লইয়া জীবন।
কোন্ মুখে কহ হেন এ দর্প বচন।।
যাহা কহ, নহ শক্য করিতে যে কাজ।
রণমাঝ কহিতে না ভাব তুমি লাজ।।
এত বলি ধনঞ্জয় যুড়িলেন বাণ।
কর্ণোপরি মারিলেন বজ্রের সমান।।
অস্ত্রে অস্ত্রে নিবারিল কর্ণ মহাবল।
কুলেতে নিবৃত্ত যেন হয় সিন্ধুজল।।
তবে দিব্য পঞ্চ বাণ মারিল অর্জ্জুন।
ফেলিল কর্ণের কাটি ধনুকের গুণ।।
আর গুণ চড়াইল সংগ্রামে নিপুণ।
সে গুণ কাটিয়া তবে ফেলেন অর্জ্জুন।।
গুণ চড়াইতে কাটিলেন ধনঞ্জয়।
ধনু ছাড়ি শক্তি নিল সূর্য্যের তনয়।।
এড়িলেন শক্তিগোটা, সূর্য্য সম জ্বলে।
মহাশব্দ করি আসে গগন মণ্ডলে।।
অর্দ্ধচন্দ্র বাণে পার্থ করি খণ্ড খণ্ড।
দুই বাণে কাটিলেন সারথির মুণ্ড।।
কাটিলেন মত্ত হস্তিধ্বজ শোভাধার।
দেখিয়া কৌরব-সৈন্য করে হাহাকার।।
কর্ণের সহায় ছিল বহু রথিগণ।
অর্জ্জুনে বেড়িয়া করে বাণ বরিষণ।।
কাটিয়া সকল বাণ পার্থ মহাবল।
মুহূর্ত্তেকে মারিলেন সহায় সকল।।
দিব্য বাণ এড়িলেন অর্জ্জুন প্রচণ্ড।
কর্ণের কবচ কাটি করে খণ্ড খণ্ড।।
আঘাতে ব্যথিত হয়ে তবে অঙ্গনাথ।
চিন্তিয়া দেখিল আর অস্ত্র নাহি সাথ।।
বিশেষে অর্জ্জুন-বাণে শরীর পীড়িল।
রণ ত্যজি কর্ণবীর পৃষ্ঠভঙ্গ দিল।।
৩৯. শকুনির লাঞ্ছনা
কর্ণ যদি ভঙ্গ দিল সংগ্রাম ভিতর।
ভঙ্গ দিয়া পলাইল যত কুরুবর।।
পলায় দুর্ম্মুখ বিবিবংশতি মহাবল।
চিত্রসেন বেগে ধায় শকুনি সৌবল।।
শকুনি পলায়ে যায় অর্জ্জুনের আগে।
দেখিয়া অর্জ্জুন রথ চালালেন বেগে।।
শকুনিরে আগুলিয়া রাখিলেন রথ।
বিহ্বল সৌবল, পলাইতে নাথি পথ।।
মুখেতে উড়িল ধূলা নাহি সরে কথা।
অর্জ্জুনে দেখিয়া দুষ্ট হেঁট করে মাথা।।
অর্জ্জুন বলেন, কোথা পালাও মাতুল।
আমাদের যত কষ্ট, তুমি তার মূল।।
তোমারে মারিলে হয় দুঃখ বিমোচন।
কপট পাশার হও তুমিই কারণ।।
তোমায় আমায় আজি খেলাইব পাশা।
নিঃশব্দ হইলে কেন, নাহি কহ ভাষা।।
ধনুক করিব পাশা, অস্ত্রগণ অক্ষ।
মস্তক করিব সারি, যত তোর পক্ষ।।
তুমি সে কৌরব কুলে দুষ্ট বুদ্ধিদাতা।
সব দ্বন্দ্ব ঘুচে, যদি কাটি তোর মাথা।।
চিন্তিয়া শকুনি কহে করিয়া উপায়।
যতেক কহিলে তাত, তোমারে যুয়ায়।।
তোমার শকতি নাহি আমারে মারিতে।
আমার প্রতিজ্ঞা সহদেবের সহিতে।।
অবধ্য তোমার শত্রু, জানহ আপনে।
অঙ্গে ঘাত করিতে না পার কদাচনে।।
আমার প্রতিজ্ঞা তুমি জান ভালমতে।
অস্ত্রাঘাতে পারি ক্ষিতি দহন করিতে।।
আমার সাক্ষাতে যুদ্ধে রবে কোন্ জন।
প্রাণ লয়ে শীঘ্রগতি পলাহ অর্জ্জুন।।
ইহা বলি বিধ্য অস্ত্র ধনঞ্জয়ে মারে।
নানা অস্ত্র বৃষ্টি করে অর্জ্জুন উপরে।।
শুনিয়া পার্থের মনে হইল স্মরণ।
প্রতিজ্ঞা করেছে পূর্ব্বে মাদ্রীর নন্দন।।
চিন্তিয়া অর্জ্জুন অস্ত্র মারে বেড়াপাক।
রথ ঘুরে শকুনির কুমারের চাক।।
ভ্রমাইয়া লয়ে গেল রজকের গৃহে।
খরপৃষ্ঠে চাপাইয়া বান্ধিলেক তাহে।।
অদ্ভুত দেখে যে দূরে কুরুবীরগণ।
চক্রাকার সম ঘুরে সুবল-নন্দন।।
বিপাক দেখিয়া শকুনির লোকে হাসে।
আর যত কুরুসৈন্য পলায় তরাসে।।
ঊর্দ্ধশ্বাসে হীনবাসে ধায় সব বীর।
ভীষ্মের চরণে গিয়া রাখয়ে শরীর।।
মহাভারতের কথা বর্ণিতে অপার।
কাশীরাম দাস কহে, ভক্তি সুধাসার।।
৪০. ভীষ্মের যুদ্ধ ও পরাজয়
উত্তরে চাহিয়ে বলিলেন ধনঞ্জয়।
হেথা হৈতে লহ রথ বিরাট-তনয়।।
ভয়েতে আবৃত হয়ে সকলে পলায়।
ভয়ার্ত্ত জনেরে মারিবারে না যুয়ায়।।
ক্ষুদ্রজীবী হীনবলে মারি কোন্ কর্ম্ম।
বিশেষে ভয়ার্ত্ত জনে মারিলে অধর্ম্ম।।
যথায় শান্তনু পুত্র ভীষ্ম পিতামহ।
শীঘ্র তাঁর সন্নিধানে মম রথ লহ।।
তাঁহার রক্ষিত সব কৌরবের সেনা।
তাঁহারে জিনিলে তবে জিনি সর্ব্বজনা।।
উত্তর বলিল, মোর শক্তি নাহি আর।
কিমতে রথের অশ্ব চালাব তোমার।।
এই দেখ অঙ্গ মোর হইল বিবর্ণ।
শব্দেতে বধির দেখ হৈল মম কর্ণ।।
কুম্ভকার চক্র প্রায় ভ্রমে মোর মনে।
দিবানিশি নাহি জ্ঞান, না দেখি নয়নে।।
তোমার গর্জ্জন আর মহা হুহুঙ্কার।
বিপরীত শব্দ তব ধনুক-টঙ্কার।।
শরীরের রক্ত মোর হৈল জলবৎ।
দিক্গণ ভ্রমে যেন নাহি দেখি পথ।।
বিশেষে তোমার কর্ম্ম অদ্ভুত কাহিনী।
দেখিবারে থাক কভু কর্ণে নাহি শুনি।।
কখন আদান কর কখন সন্ধান।
লক্ষিতে না পারি তুমি কারে ছাড় বাণ।।
অনুক্ষণ দেখি দনু মণ্ডল আকার।
শতহস্ত হও চিত্তে লাগয়ে আমার।।
পূর্ব্বের সে রূপ তব নাহিক এখন।
ভয়ঙ্কর মূর্ত্তি দেখি ভয় হয় মন।।
শীঘ্র কর মহাবীর ইহার উপায়।
কহিনু নিশ্চয় মোর প্রাণ বাহিরায়।।
পার্থ বলে, কি কহিছ বিরাট-কুমার।
ক্ষত্রিয় লক্ষণ কিছু না দেখি তোমার।।
সমূহ শত্রুর মাঝে কহিছ এমত।
কি উপায় আছে ইথে কে চালাবে রথ।।
স্থির হও, ভয় ত্যজ, ধর অশ্বদড়ি।
চাপিয়া বৈসহ, লহ প্রবোধের বাড়ি।।
এখনি কেমনে চাহ ত্যজিবারে রণ।
ক্ষণেক থাকিয়া দেখ বিরাট-নন্দন।।
আজি সব বিনাশিব কৌরবের সেনা।
দেখুক আমার তেজ আজি সর্ব্বজনা।।
ক্ষিতিমধ্যে দেখাইব রক্তের কর্দ্দম।
বহাইব রক্ত নদী, দেখাইব যম।।
রুধির করিব নীর, কুম্ভীর কুঞ্জর।
কচ্ছপ হইবে অশ্ব, মীন হবে নর।।
হস্ত পদ হবে সব তৃণ কাষ্ঠবৎ।
হংসবৎ ভাসি যাবে যত সব রথ।।
কি যুদ্ধ দেখিয়া তব শুষ্ক হৈল কায়।
রাজপুত্র তোর হেন কর্ম্ম কি যুয়ায়।।
কালানল প্রায় দেখ এই ভীষ্ম বীর।
কুরুসৈন্য মীন, যেন সাগর গভীর।।
শীঘ্র রথ লহ মম তাঁহার সম্মুখে।
আমার হস্তের বেগ দেখাব তাঁহাকে।।
পূর্ব্বে আমি সুরপুরে এই ধনু ধরি।
নিষ্কণ্টক স্বর্গ করিলাম দৈত্য মারি।।
নিবাতকবচ পুলোমাদি কালকেয়।
সিন্ধুপুর হেমপুরবাসী অপ্রমেয়।।
ইন্দ্রতুল্য পরাক্রম সবে মহাবলা।
বায়ে উড়াইনু যেন শিমূলের তূলা।।
সেইমত আজি আমি করিব সমর।
ক্ষত্র-পরাক্রমে বৈস রথের উপর।।
এত বলি অঙ্গে তার হাত বুলাইয়া।
উত্তরে করেন শান্ত আশ্বাস করিয়া।।
উত্তর বসিল পুনরপি সিংহবৎ।
ধরিয়া ঘোড়ার দড়ি চালাইল রথ।।
বায়ুবেগে নিল রথ ভীষ্মের গোচর।
পার্থে দেখি আগু হৈল ভীষ্ম বীরবর।।
পিতামহ পদ ধৌত বিচারিয়া মনে।
বরুণ যুগল অস্ত্র মারেন চরণে।।
দেখি ‍দুই অস্ত্র ভীষ্ম মারিল তখন।
অর্জ্জুনের শিরে গিয়া করিল চুম্বন।।
রক্ষক আছিল ভীষ্ম-রথে চারি জন।
দুঃসহ দুর্ম্মুখ বিবিংশতি দুঃশাসন।।
আগু হয়ে পথে আসি আগুলিল পথ।
জ্বলন্ত আগুনে যেন পতঙ্গের মত।।
আকর্ণ পূরিয়া বাণ মারে দুঃশাসন।
অর্জ্জুন উপরে করে বাণ বরিষণ।।
হাসিয়া মারেন পার্থ তারে পঞ্চ শর।
বাণাঘাতে দুঃশাসন হইল ফাঁফর।।
বেগে পলাইয়া যায়, নাহি চায় পাছে।
আর তিন বীর গিয়া বেড়িলেক কাছে।।
দুবানে দুর্ম্মুখে পার্থ করে অচেতন।
দেখি ভঙ্গ দিয়া যায় আর দুই জন।।
ভঙ্গ দিল চারি বীর দেখিয়া সংগ্রাম।
আগু হয়ে পার্থ ভীষ্মে করেন প্রণাম।।
পার্থ বলিলেন, দেব ভদ্র আপনার।
কি হেতু এ মৎস্যদেশে গমন তোমার।।
বিরাটের গবী নিতে আসিয়াছ প্রায়।
এমত কুকর্ম্ম নাহি তোমা শোভা পায়।।
গরগবী নিলে দেব যত হয় পাপ।
আপনি জানহ তুমি, অঙ্গে ভুঞ্জে তাপ।।
তথাপিহ লোভ নাহি পার সম্বরিতে।
সসৈন্যেতে আসিয়াছ গরগবী নিতে।।
ভীষ্ম বলে, নাহি আসি গবীর কারণ।
তুমি আছ এই স্থানে, শুনিনু বচন।।
বহুদি নাহি দেখি ব্যাকুলিত চিত্ত।
দুর্য্যোধন সহ আসিলাম এ নিমিত্ত।।
ক্ষত্রিয় নিয়ম আছে, বেদের বচন।
বাহুবলে শাসিবেক পররাজ্য জন।।
আমার এ ধন রাজ্যে কোন্ প্রয়োজন।
যতেক করি যে তোমা সবার কারণ।।
পার্থ বলে, পিতামহ তোমার প্রসাদে।
বঞ্চিলাম ত্রয়োদশ বর্ষ অপ্রমাদে।।
তোমার প্রসাদে মোরা ‍ভাই পঞ্চ জনে।
বহু বহু কষ্টে রক্ষা ‍পাইলাম বনে।।
তুমি যে গুরুর গুরু হও মহাগুরু।
কুরুবংশ কর্ত্তা তুমি যেন কল্পতরু।।
এমত সময়ে তুমি হইলে সদয়।
তোমার প্রসাদে করি কুরুসৈন্য জয়।।
পাশাকালে দুঃখ পাই, জানহ আপনে।
তাহার উচিত ফল দিব দুষ্টগণে।।
আজ্ঞা কর একভিতে নিতে নিজ রথ।
দুর্য্যোধনে ভেটি গিয়া, ছাড়ি দেহ পথ।।
ভীষ্ম বলে, আমি রক্ষা করি দুর্য্যোধন।
মোরে না জিনিলে কোথা পাবে দরশন।।
অর্জ্জুন বলেন, তবে বিলম্বে কি কাজ।
শীত্র কর উপায় রাখিতে কুরুরাজ।।
এত শুনি মহাক্রুদ্ধ হয়ে কুরুবর।
অষ্ট বাণ প্রহারিল অর্জ্জুন উপর।।
অষ্টগোটা সর্প সম সেই অষ্ট শর।
মহাশব্দে চলি যায় অর্জ্জুন উপর।।
দিব্য ভল্ল দিয়া কাটিলেন ধনঞ্জয়।
পুনঃ দিব্য অস্ত্র মারে গঙ্গার তনয়।।
মহাশব্দে আসে বাণ ভাস্কর সমান।
অর্দ্ধপথে ধনঞ্জয় করে খান খান।।
দুই জনে ‍যুদ্ধ হৈল অতি ভয়ঙ্কর।
নানাবর্ণে এড়িলেন চোক চোক শর।।
দোঁহে দোঁহাকার বাণ করেন বারণ।
অনিমিষ দোঁহাকার নয়নে নয়ন।।
অনলে বরুণ মারে, বায়ব্যে বারুণি।
আকাশে বায়ব্য মারে, শীতেতে আগুনি।।
পন্নগে পন্নাগাসন, বায়ুতে পর্ব্বত।
পুনঃ পুনঃ দোঁহে অস্ত্র ছাড়ে এইমত।।
দোঁহাকার শরজালে ত্রৈলোক্য কম্পিত।
চট্ চট্ শব্দ যেন হৈল অপ্রমিত।।
দোঁহাকার বাণে দোঁহে ব্যথিত হৃদয়।
দোঁহাকার অঙ্গে সদা শ্রমজল বয়।।
সাধু পার্থ, সাধু ভীষ্ম গঙ্গার নন্দন।
সাধু সাধু ধন্যবাদ দেয় দেবগণ।।
ইন্দ্র-অস্ত্র দিয়া তবে ইন্দ্রের নন্দন।
ভীষ্মের হাতের ধনু করেন ছেদন।।
আর ধনু ধরি ভীষ্ম বরিষয়ে বাণ।
সেই ধনু কাটিলেন করিয়া সন্ধান।।
দিব্য অস্ত্রে কাটে ‍পার্থ কবচ তাঁহার।
তীক্ষ্ণ দশ বাণ দিয়া করেন প্রহার।।
বাণাঘাতে অচেতন গঙ্গার তনয়।
দেখিয়া বিস্ময় মানি চাহে কুরুচয়।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুন পুণ্যবাণ।।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র