৪১. দৈব ও পুরুষকারযুধিষ্ঠির কহিলেন, শুন পিতামহ।দৈব ও পুরুষকারে কেবা শ্রেষ্ঠ কহ।।ভীষ্মদেব বলিলেন, ধর্ম্মের নন্দন।মন দিয়া শুন যাহা করিব কীর্ত্তন।।একদা বশিষ্ঠদেব জিজ্ঞাসে ব্রহ্মারে।দৈব ও পুরুষকার, শ্রেষ্ঠ বলি কারে।।বশিষ্ঠেরে কহিলেন বিধাতা তখন।কেবা বড়, কেবা ছোট, শুনহ এখন।।বীজ হতে বীজ হয়, বীজ হতে ফল।বীজ বিনা যত কিছু, সকলি নিষ্ফল।।কৃষক করয়ে ক্ষেত্রে যে বীজ বপন।সে বীজের ফল তাহে জন্মিবে তেমন।।উপযুক্ত ক্ষেত্রে বীজ বপন করিলে।তাহা হৈতে ফল ফলে সময় হইলে।।ঊষর-ক্ষেত্রেতে কিন্তু করিলে বপন।তাহা হৈতে ফল নাহি ফলে কদাচন।।সেরূপ পুরুষকার নাহি থাকে যার।প্রসন্ন না হন দৈব উপরে তাহার।।ক্ষেত্রই পুরুষকার বীজ দৈব-ফল।একত্র হইলে দুই, তবে ফলে ফল।।কর্ম্ম করিলেই তবে তার ফলে ফল।কর্ম্ম না করিলে ফল কভু নাহি মিলে।।কর্ম্ম ছাড়ি শুধু দৈব করিলে আশ্রয়।কিছুতে না হয় তাহে কোন ফলোদয়।।অলস নিষ্কর্ম্মা পরাক্রম-হীন জন।কিছুতেই নাহি লভে সম্পদ্ কখন।।নির্ভর করিয়া শুধু দৈবের উপর।কর্ম্ম না করিলে ফল নাহি লভে নর।।ক্লীবপতি-সহবাসে রমনীর শ্রম।অবশেষে পণ্ড হয়, ইহাই নিয়ম।।দৈব যার প্রতি বাম হয় একবার।ইহলোকে দুরবস্থা অশেষ তাহার।।যাহার পুরুষকার না থাকে কখন।পরলোক হয় তার অশুভ ঘটন।।যদিও পুরুষকার পরম প্রধান।দৈবে তুচ্ছ-জ্ঞান তবু না হয় বিধান।।দৈবই লোকের কর্ম্মে প্রবৃত্তি জন্মায়।দৈববলে পরকালে লোকে ফল পায়।।তথাপি দৈবের প্রতি নির্ভর করিয়া।কেহ যেন নাহি থাকে নিশ্চিন্ত হইয়া।।সর্ব্বদা পুরুষকার করিয়া আশ্রয়।এ সংসারে সবে যেন সদা মত্ত রয়।।মানুষের শত্রু মিত্র আত্মাই তাহার।সুকর্ম্ম ও দুষ্কর্ম্মের আত্মা সাক্ষী তার।।ঋষিগণ না লইয়া দৈবের আশ্রয়।তপোবলে দুষ্টে দেন শাপ-সমুদয়।।যাদের হৃদয়ে লোভ মোহ বিদ্যমান।দৈব না করিতে পারে তাহাদের ত্রাণ।।বায়ুর সাহায্যে যথা অত্যল্প অনল।দেখিতে দেখিতে হয় পরম প্রবল।।দৈব ও পুরুষকার একত্র হইলে।অবিলম্বে মানুষের শুভ ফল ফলে।।তৈল ক্ষয় হলে যথা দীপশিখা নাশ।কর্ম্মক্ষয় হলে তথা দৈব অপ্রকাশ।।স্ত্রী-পুরুষ দুজনার হইলে মিলন।সুসন্তান করে যথা জনম গ্রহণ।।দৈব ও পুরুষকার উভয়ে মিলিয়া।মানুষের শুভ তথা দেয় জনমিয়া।।মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।৪২. ভীষ্ম কর্ত্তৃক শ্রীকৃষ্ণের স্তবসৌতি বলে অবধান কর মুনিগণ।এতেক শুনিয়া পরীক্ষিতের নন্দন।।যোগমার্গ কথা শুনি সানন্দ হৃদয়।পুনরপি জিজ্ঞাসিল করিয়া বিনয়।।সে যোগমার্গের কথা ভীষ্মমুখে শুনি।কোন্ কর্ম্ম করিলেন ধর্ম্ম নৃপমণি।।কিরূপে করেন ভীষ্ম স্বর্গে আরোহণ।শুনিবারে ইচ্ছা হয় ইহার কথন।।মুনি বলে অবধান কর নরপতি।অনন্তর গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম মহামতি।।যোগমার্গ ইতিহাস পুরাণের সার।কহিলেন ধর্ম্মেরে করিয়া সুবিস্তার।।পুনশ্চ বলেন শুন ধর্ম্মের নন্দন।রাজা হয়ে রাজ্য কর হস্তিনা ভুবন।।মহাযজ্ঞ করিয়া ভজহ দয়াময়।জ্ঞাতিবধ পাপ আদি সব হবে ক্ষয়।।মাঘমাস সীতাষ্টমী আজি শুভদিনে।শরীর ছাড়িব আমি ভজি নারায়ণে।।শুন কৃষ্ণ তব হস্তে করি সমর্পণ।পঞ্চ ভাই দ্রৌপদীরে করিবা পালন।।ইন্দ্রের ভবনে আমি করিব প্রস্থান।এত বলি নিঃশব্দ হইল মতিমান।।নিগুড় করিয়া ধ্যান যোগ চিত্তে ধরি।করেন কৃষ্ণের স্তোত্র ভীষ্ম ভক্তি করি।।নমো নমো নারায়ণ ব্রহ্ম সনাতন।সংসারের হেতু রূপ দেব নারায়ণ।।তুমি আদি তুমি মধ্য তুমি অন্তরূপ।সকল জগত এই তব লোমকূপ।।নমোনমঃ আদি অবতার মৎস্যকায়।নমো নরসিংহ হিরণ্যাক্ষ বিদারয়।।নমো কূর্ম্ম অবতার নমস্তে বামন।নমো ভৃগুপতি ক্ষত্র কুলবিনাশক।।নমো রাম অবতার রাবণনাশক।নমো রাম অবতার রেবতী নায়ক।।নমো কৃষ্ণ অবতার গোকুলবিহার।নমো নমঃ সঙ্কর্ষণ দিব্য অবতার।।নমো কল্কি অবতার ম্লেচ্ছবিনাশন।নমো নমো জয় জয় আদি নারায়ণ।।তুমি ইন্দ্র তুমি চন্দ্র তুমি দিবাকর।আকাশ পাতাল তুমি দীর্ঘ কলেবর।।আত্মারূপে চরাচর জীবে তব স্থিতি।তব তত্ত্ব জানিবারে কাহার শকতি।।এ ভব সংসারে পার কর নারায়ণ।এত স্তুতি করি ভীষ্ম ধ্যানে দেন মন।।মহাভারতের কথা অমৃতের ধার।কাশীদাস দেব কহে রচিয়া পয়ার।।৪৩. ভীষ্মদেবের স্বর্গারোহণধ্যানযোগে সাক্ষাতে দেখেন নারায়ণ।নবজলধর তনু অরুণ লোচন।।পীতবাস পরিধান বনমালাধারী।নানা অলঙ্কারে রূপ ভূষিত মুরারী।।চারু চতুর্ভুজ রূপ মোহন মুরতি।দেখি ভীষ্ম মনে মনে করিলেন স্তুতি।।সাক্ষাতে পদারবিন্দ দেখিয়া নয়নে।শরীর ত্যজেন ভীষ্ম দেখে দেবগণে।।জয় জয় শব্দ হৈল ইন্দ্রের নগরে।পুষ্পবৃষ্টি কৈল দেব ভীষ্মের উপরে।।দিব্য রথ পাঠাইয়া দিল সুরপতি।পবনের গতি রথ মাতলি সারথি।।রথেতে তুলিয়া স্বর্গে করিল গমন।বন্ধুগণ সহ গিয়া হইল মিলন।।চিরদিনের বন্ধুসনে হইল দর্শন।সম্ভ্রম খণ্ডিল পূর্ব্ব জন্মের কথন।।মুনি বলে অবধান কর জন্মেজয়।স্বর্গেতে চলিল ভীষ্ম গঙ্গার তনয়।।মাঘমাসে শুক্লাষ্টমী তিথি শুভদিনে।ত্যজিলেন ভীষ্ম তনু চিন্তি নারায়ণে।।শরীর ত্যজেন ভীষ্ম দেখি যুধিষ্ঠির।রোদন করেন ভূমে লোটায়ে শরীর।।ভীমার্জ্জুন সহ কান্দে মাদ্রীর নন্দন।অনিরুদ্ধ প্রদ্যুন্নাদি যত বন্ধুগণ।।দ্বিজ ক্ষত্র আদি কত নগরের প্রজা।রণ অবশেষে আর যত ছিল রাজা।।ভীষ্মের মরণে সবে অনেক কান্দিল।প্রলয়ের কালে যেন সিন্ধু উথলিল।।যুধিষ্ঠির আদি পঞ্চ পাণ্ডুর কুমার।হাহা ভীষ্ম বলি কান্দে করি হাহাকার।।কোথা গেল পিতামহ ছাড়িয়া আমারে।তোমার বিচ্ছেদে আত্মা ধরি কি প্রকারে।।দুর্য্যোধন পাতক করিল অকারণ।তাহার কারণে হৈল তোমার নিধন।।আপনি মরিল দুষ্ট জ্ঞাতি বিনাশিল।শোক সিন্ধু মধ্যেতে আমাকে ডুবাইল।।এত বলি কান্দে পঞ্চ পাণ্ডুর কুমার।তথা আসিলেন ব্যাস জানি সমাচার।।কুরুক্ষেত্র মধ্যে যথা ভাষ্মের পতন।তথাকারে করিলেন ত্বরিত গমন।।ব্যাসে দেখি সম্ভ্রমে উঠিয়া পঞ্চজন।সম্ভ্রমে করেন তাঁর চরণ বন্দন।।ধূলাতে ধূসর তনু নেত্রে ঝরে বারি।সান্ত্বনা করেন ব্যাস সবারে নিবারি।।নিস্ফল তোমরা সব করহ ক্রন্দন।কত না বুঝান ভীষ্ম গঙ্গার নন্দন।।যোগমার্গ ইতিহাস পুরাণের সার।তবু না ঘুচিল ভ্রম তোমা সবাকার।।ভ্রম দূর কর রাজা তত্ত্বে দেহ মন।অকারণে কর শোক ভীষ্মের কারণ।।পুণ্য আত্মা ভীষ্মবীর বসু অবতার।শাপ ভ্রষ্ট হয়ে কুরুবংশে জন্ম তাঁর।।শাপে মুক্ত হয়ে ভীষ্ম গেলেন স্বস্থান।তাঁর হেতু শোক রাজা কর অকারণ।।দুর্য্যোধন আদি যত কৌরব আছিল।ব্রহ্মার আজ্ঞায় কুরুবংশে জনমিল।।ব্রহ্মার মানস পূর্ণ পৃথিবীর হিতে।হত হৈল যত ক্ষত্র ভারত যুদ্ধেতে।।ব্রহ্মার আজ্ঞায় কৃষ্ণ হয়ে অবতার।পৃথিবীর ভার সব করেন সংহার।।কিছুমাত্র অবশেষ আছে বিষ্ণু অংশ।অল্পদিনে কৃষ্ণ তাহা করিবেন ধ্বংস।।ততদিন রাজ্যভোগ কর নৃপমণি।শোক ত্যাগ কর রাজা শুন মম বাণী।।অগনি সংস্কার কর গঙ্গার নন্দনে।অদাহন পৃথিবী দেখহ যেইখানে।।আপোড়া পৃথিবী যদি তুমি কোথা পাও।আমার বচন তুমি নিশ্চয় জানিও।।কত কত রাজা জনমিল এ সংসারে।কেহ নাহি, সবে গেল শমনের দ্বারে।।চতুর্দ্দশ ভুবনের মধ্যে পৃথিবীতে।আপোড়া কোথাও নাহি কহিনু তোমাতে।।এত বলি স্বস্থানে গেলেন ব্যাস মুনি।বিস্ময় মানেন রাজা ব্যাসবাক্য শুনি।।অর্জ্জুনের আদেশ করিলেন রাজন।শীঘ্র কপিধ্বজে তুমি কর আরোহন।।পৃথিবী খুঁজিতে চাহি ব্যাসের বচনে।ভ্রমিয়া দেখহ সব এ চৌদ্দ ভুবনে।।অদাহ পৃথিবী যদি থাকে কোনখানে।তথা লয়ে দাহ কর গঙ্গার নন্দনে।।জানিয়া আইস ভাই চল শীঘ্রতর।এত শুনি ধনঞ্জয় চলেন সত্বর।।কপিধ্বজ রথ আরোহিয়া সেই ক্ষণে।অগ্রে উপনীত গিয়া ইন্দ্রের ভুবনে।।কোনখানে স্বর্গেতে নাহিক অদাহন।একে এক বিচরেন ইন্দ্রের নন্দন।।সপ্তস্বর্গ পুনরপি করেন বিচার।পাতালে গেলেন তবে ইন্দ্রের কুমার।।সপ্ত পাতালেতে সব দেখেন বিচারি।অদাহন পাতালেতে কোথাও না হেরি।।অনন্তরে মর্ত্ত্যে আসিলেন ধনঞ্জয়।সপ্ত দ্বীপ বিচারিয়া করেন নির্ণয়।।অদাহন পৃথিবী না দেখি কোনখানে।সবিস্ময় হয়ে আসি কহেন রাজনে।।শুনিয়া ধর্ম্মের পুত্র মানেন বিস্ময়।ব্যাসের বচনে পূর্ব্ব ভ্রম দূর হয়।।শোক ত্যাগ করি রাজা কার্য্যে দেন মন।ভীমার্জ্জুনে আজ্ঞা তবে করেন রাজন।।নানা কাষ্ঠ চন্দনাদি আনহ সত্বরে।এক লক্ষ ঘৃত কুম্ভ সভার ভিতরে।।কুরুক্ষেত্র মধ্যে শীঘ্র করহ সঞ্চয়।চতুর্দ্দোলে করি আন গঙ্গার তনয়।।আজ্ঞামাত্রে ধনঞ্জয় মাদ্রীর কুমারে।অগনি সংস্কার দ্রব্য আনেন সত্বরে।।শত শত ঘৃত কুম্ভ কাষ্ঠ রাশি রাশি।আনিল ক্ষন্ত্রিয়গণ পৃথিবী নিবাসী।।চতুর্দ্দোলে তুলি নিল ভীষ্মের শরীর।বিধিমতে অগ্নি দেন রাজা যুধিষ্ঠির।।ভীষ্মের শরীর দহি ভাই পঞ্চজন।গঙ্গাতে যাইয়া তবে করেন তর্পন।।শ্রাদ্ধ শ্রান্তি করিলেক ক্ষন্ত্রিয় বিধানে।নানারত্ন অলঙ্কার দিলেন ব্রাহ্মণে।।ভীষ্মের ভাবনা বিনা অন্য নাহি মনে।অন্ন জল নাহি রুচে দুঃখিত রাজনে।।মুনি বলে জন্মেজয় কর অবধান।এতদূরে শান্তিপর্ব্ব হৈল সমাধান।।শান্তিপর্ব্ব সমাপ্ত।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon