শ্রীমদ্ভগবত গীতা দ্বিতীয় অধ্যায়

শ্রীমদ্ভগবত গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের সার-সংক্ষেপ শ্রীমদ্ভগবত গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে মূলত: আত্মতত্ত্ব বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আলোচনা করা হয়েছে জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তির বিষয়েও। ভক্তি, কর্ম ও জ্ঞান এ তিনটি বিষয়কে যে ভাবে গীতায় সমন্বয় করা হয়েছে তা অন্য কোন গ্রন্থে পাওয়া যাবে না। আর সমন্বয়ই হচ্ছে গীতর ধর্ম। তাই বলা হয়ে থাকে গীতার জ্ঞান আহরণ করলে আর কোন গ্রন্থের প্রয়োজনীতা নেই। ১ শ্লোকে অর্জুনের মোহ। ২-৩ শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সংক্ষেপে উত্তর। ৪-৮ শ্লোকে শ্লোকে যুদ্ধ না করার পক্ষে অর্জুনের যুক্তি। ১১-৩০ শ্লোকে দেহের বিনাশ, আত্মার অবিনাশিতা সর্ম্পকে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। ৩১-৩৭ শ্লোকে যুদ্ধ করার পক্ষে অর্জুনকে উপদেশ। ৩৮-৫৩ শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে সর্বপ্রকার দ্বন্দ্ব হতে মুক্ত হয়ে ‘যোগস্থ’ হয়ে অর্থাৎ নিষ্কামভাবে কর্ম করার জন্য উপদেশ দিচ্ছেন। ৫৪-৬৩ শ্লোকে স্থিতপ্রজ্ঞের লক্ষ্মণসমূহ বর্ণনা করেছেন। ৬৩-৭২ শ্লোকে যোগস্থ হয়ে কর্ম করার ফলে কর্মির মন যখন পরমেশ্বর ভগবানে সমাহিত হয় তখন এ অবস্থাকে বলা ব্রাহ্মীস্থিতি। আর এ হচ্ছে মোক্ষলাভ।
|সঞ্জয় উবাচ|
তং তথা কৃপয়াবিষ্টমশ্রুপূর্ণাকুলেক্ষণম্।
বিষীদন্তমিদং বাক্যমুবাচ মধুসূদনঃ ।।১।।
অর্থ :সঞ্জয় বললেন- মোহজনিত মায়ায় অর্জুনের মন অভিভূত, তাঁর দু'নয়ন অশ্রুতে পূর্ণ হওয়ায় তিনির কিছূ দেখতে পাচ্ছেন না। তখন শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন।
|শ্রীভগবানুবাচ|
কুতস্ত্বা কশ্মলমিদং বিষমে সমুপস্থিতম্ ।
অনার্যজুষ্টমস্বর্গ্যমকীর্তিকরমর্জুন ।।২।।
অর্থ : এই সঙ্কটকালে কিসের মোহ তোমাকে অধিকার করেছে যে তুমি নিজের ধর্ম থেকে ভ্রষ্ট হতে চাও? এই স্বধর্মচ্যুতি আর্যগণের গ্রহণযোগ্য নয়, এতে স্বর্গলাভের পথে বাধা ঘটে এবং এতে কীর্তিলাভও হয় না।
ক্লৈব্যং মা স্ম গমঃ পার্থ নৈতত্ত্বয্যুপপদ্যতে ।
ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং ত্যক্ত্বোত্তিষ্ঠ পরন্তপ ।।৩।।
অর্থ :হে পার্থ! মোহবশত: কাপুরুষতাকে আশ্রয় করো না-এই কাতরতা তোমার শোভ পায় না। হৃদয়ের ক্ষুদ্র দুর্বলতা ত্যাগ করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও।
।অর্জুন উবাচ।
কথং ভীষ্মমহং সাংখ্যে দ্রোণং চ মধুসূদন ।
ইষুভিঃ প্রতিযোৎস্যামি পূজার্হাবরিসূদন ।।৪।।
অর্থ : অর্জুন বললেন- হে শত্রুমর্দন! হে মধূসুদন! ভীষ্ম ও দ্রোণ প্রভৃতি আমাদের পূজনীয়। তাঁদের বিরুদ্ধে শর প্রয়োহ ক'রে কিভাবে যুদ্ধ করবো?
গুরূনহত্বা হি মহানুভাবান শ্রেয়ো ভোক্তুং ভৈক্ষ্যমপীহ লোকে ।
হত্বার্থকামাংস্তু গুরুনিহৈব ভুঞ্জীয় ভোগান্ রুধিরপ্রদিগ্ধান্ ।।৫।।
অর্থ : মহানুভব গুরুজনদের বধ না করে ইহলোকে ভিক্ষার অন্নও ভোজন করা অনেক ভাল। আর যদি গুরুজন বধ ক'রে রাজ্যলাভ করি, তবে ইহলোকেও যে ভোগ্য বিষয় গ্রহণ করবে, তা হবে গুরুজনের রক্তলিপ্ত।
ন চৈতদ্ বিদ্মঃ কতরন্নো গরীয়ো যদ্ বা জয়েম যদি বা নো জয়েয়ুঃ ।
যানেব হত্বা ন জিজীবিষামস্ তেহবস্থিতাঃ প্রমুখে ধার্তরাষ্ট্রাঃ ।।৬।।
অর্থ :এই যুদ্ধে যদি জয়ী হই কিংবা এরা যদি আমাদের পরাজিত করেন-এই দুইয়ের মধ্যে কোনটি আমাদের পক্ষে শ্রেয় তা বুঝতে পারছি না; যাঁদের বধ করে আমরা বেঁচে থাকতে চাইনে সেই ধৃতরাষ্ট্র পক্ষীয়গণ আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছেন?
কার্পণ্যদোষোপহতস্বভাবঃ পৃচ্ছামি ত্বাং ধর্মসম্মূঢ়চেতাঃ ।
যচ্ছ্রেয়ঃ স্যান্নিশ্চিতং ব্রূহি তন্মে শিষ্যস্তেহহং শাধি মাং ত্বাং প্রপন্নম্ ।।৭।।
অর্থ : অর্জুন বললেন- কার্পন্যজনিত দূর্বলতার প্রভাবে আমি এখন কিংকতব্যবিমূঢ়। আমার কর্তব্য সম্মন্ধে বিভ্রান্ত হয়ে আপনাকে জিজ্ঞাসা করছি এখন কি করা আমার পক্ষে শ্রেয়। আমি সম্পূর্ণ ভাবে আপনার শরণাগত। দয়া করে আপনি আমারক শিক্ষা দিন।
ন হি প্রপশ্যামি মমাপনুদ্যাদ্ যচ্ছোকমুচ্ছোষণমিন্দ্রিয়াণাম্ ।
অবাপ্য ভূমাবসপত্নমৃদ্ধং রাজ্যং সুরাণামপি চাধিপত্যম্ ।।৮।।
অর্থ : পৃথিবীতে নিষ্কন্টক এবং মসৃদ্ধ রাজ্য এবং দেবলোকের অধিপত্য পেলেও যে শোক আমার ইন্দ্রিয়গুলোকে শোষণ করবে সেই শোক দূর করতে পারে এমন তো কোন উপায় দেখছি না।
|সঞ্জয় উবাচ|
এবমুক্ত্বা হৃষীকেশং গুড়াকেশঃ পরন্তপ: ।
ন যোৎস্য ইতি গোবিন্দমুক্ত্বা তূষ্ণীং বভূব হ ।।৯।।
অর্থ : যিনি আলস্য জয় করেছেন এং যিনি শত্রুর সন্তাপ সৃষ্টি করেন, সেই অর্জুন অন্তর্যামী ও সর্বজ্ঞ শ্রীকৃষ্ণকে বললেন- আমি যুদ্ধ করবো না। এই বলে তিনি নীবর হলেন।
তমুবাচ হৃষীকেশঃ প্রহসন্নিব ভারত ।
সেনয়োরুভয়োর্মধ্যে বিষীদন্তমিদং বচঃ ।।১০।।
অর্থ : হে ধৃতরাষ্ট্র! দুই সেনাদলের মধ্যে -বিষাদগ্রস্থ অর্জুনকে হৃষীকেশ হাসতে হাসতে এই কথা বললেন।
|শ্রীভগবানুবাচ|
অশোচ্যানন্বশোচস্ত্বং প্রজ্ঞাবাদাংশ্চ ভাষসে ।
গতাসূনগতাসূংশ্চ নানুশোচন্তি পণ্ডিতাঃ ।।১১।।
অর্থ : ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন- যে হৃষীকেষ! তুমি প্রাজ্ঞের মত কথা বলছ অথচ যে বিষয়ে শোক করা উচিৎ নয় সেই বিষয়ে শোক করছ। যারা যথার্থ পন্ডিত তারা কখনও জীবত অথবা মৃত কারোর জন্যেই শোক করে না।
ন ত্বেবাহং জাতু নাসং ন ত্বং নেমে জনাধিপাঃ।
ন চৈব ন ভবিষ্যামঃ সর্বে বয়মতঃপরম্ ।।১২।।
অর্থ :পূর্বে আমি কখনও ছিলাম না, এমন নয় ( অর্থাৎ ছিলাম যেহেতু আত্ম নিত্য), সেইরুপ তুমি কখনও ছিলে না আর এই সকল নরপতি কখনও ছিলেন না -তাও নয় (যেহেতু সকলই আমার অংশ) এর পর ভবিষ্যতে থাকবো না তাও নয় (যেহেতু আত্মা মন্ম-মরণশূণ্য)।
দেহিনোহস্মিন্ যথা দেহে কৌমারং যৌবনং জরা।
তথা দেহান্তরপ্রাপ্তির্ধীরস্তত্র ন মুহ্যতি ।।১৩ ।।
অর্থ :দেহে যেভাবে কৌমার্য যৌবন এবং জরার মাধ্যমে দেহের রুপ পরিবর্তন করে মৃত্যুকালে ঔ দেহী আত্মা এক দেহ থেকে আরেক দেহে দেহান্তরিত হয়। তাই স্থিতপ্রজ্ঞ পন্ডিতেরা কখনও এই পরিবর্তনে মুহ্যমান হন না।
মাত্রাস্পর্শাস্তু কৌন্তেয় শীতোষ্ণসুখদুঃখদাঃ।
আগমাপায়িনোহনিত্যাস্তাংস্তিতিক্ষস্ব ভারত ।। ১৪ ।।
অর্থ : হে কৌন্তেয়! ইন্দ্রিয়ের সাথে বিষয়ের সংযোগের ফলে অনিত্য সুখ দু:খের অনুভব হয় ঠিক যেন শীত ও গ্রীষ্ম ঋতুর গমনাগমনের মত। তাই হে ভরত কুলপ্রদীপ! ইন্দ্রিয় অনুভূতির দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে সহ্য করার চেষ্টা কর।
যং হি ন ব্যথয়ন্ত্যেতে পুরুষং পুরুষর্ষভ।
সমদুঃখসুখং ধীরং সোহমৃতত্বায় কল্পতে ।। ১৫ ।।
অর্থ : হে পুরুষ শ্রেষ্ঠ! (এই সকল মাত্রাস্পর্শ অর্থাৎ বিষয়ের সাথে ইন্দ্রিয়ের সংযোগজনিত জ্ঞান) যে ধীর ব্যক্তিকে বিচলিত করতে পারে না, তিনি দু:খে সুখে অবিচলিত, তিনিই অমৃতত্বলাভের অধিকারী হন।
নাসতো বিদ্যতে ভাবো নাভাবো বিদ্যতে সতঃ।
উভয়োরপি দৃষ্টোহন্তস্ত্বনয়োস্তত্ত্বদর্শিভিঃ ।। ১৬ ।।
অর্থ : অবিদ্যমান বস্তুর অস্তিত্ব নেই, বিদ্যমান বস্তুর বিনাশ নেই। এই উভয় প্রকার বস্তুর স্বরুপ তত্ত্বদর্শীরা নির্ণয় করেছেন। অবিনাশি তু তদ্বিদ্ধি যেন সর্বমিদং তত ।
অবিনাশি তু তদ্বিব্ধি যেন সর্বমিদম ততম্।
বিনাশমব্যয়স্যাস্য ন কশ্চিৎ কর্তূমর্হতি ।। ১৭ ।।
অর্থ : যিনি এই সমগ্র জগৎ ব্যাপ্ত হয়ে রয়েছেন, তাঁকেই অবিনাশী আত্মা বলে জানবে। কেউ সেই অব্যয় আত্মার বিনাশ করতে পারে না।
অন্তবন্ত ইমে দেহা নিত্যস্যোক্তাঃ শরীরিণঃ ।
অনাশিনোহপ্রমেয়স্য তস্মাদ্ যুধ্যস্ব ভারত ।। ১৮ ।।
অর্থ : প্রমাণের অতীত, অবিনাশী ও নিত্য আত্মার আশ্রয় এই দেহসমুহ নশ্বর বলা হয়েছে। (জড় দেহ কালে নষ্ট হবে) কিন্তু আত্মা নিত্য অবিনাশী, প্রমাণের অতীত। সুতরাং যুদ্ধ কর।
য এনং বেত্তি হন্তারং যশ্চৈনং মন্যতে হতম্ ।
উভৌ তৌ ন বিজানীতো নায়ং হন্তি ন হন্যতে ।। ১৯ ।।
অর্থ : যে আত্মাকে হত্যা বলে জানে এবং যে তাকে "হত" বলে মনে করে, তারা উভয়েই আত্মতত্ত্ব জানে না। ইনি হত্যা করেন না হতও হন না।
ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্ নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ ।
অজো নিত্য: শাশ্বতোহয়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে ।। ২০ ।।
অর্থ : আত্মার কখনও জন্ম বা মৃত্যু হয় না, পুন: পু:ন উৎপত্তি বা বৃদ্ধি হয় না। জন্মরহিত, নিত্য, শ্বাশত এবং নবীন। দেহ নষ্ট হলেও আত্ম কখনও বিনষ্ট হয় না।
বেদাবিনাশিনং নিত্যং য এনমজমব্যয়ম্ ।
কথং স পুরুষঃ পার্থ কং ঘাতয়তি হন্তি কম্ ।। ২১ ।।
অর্থ :হে পার্থ! যিনি এই আত্মাকে অবিনাশী, নিত্য, অজ ও অব্যয় বলে জানেন, তিনি কিভাবে কাকে হত্যা করেন, কাকেই বা হত্যা করাতে পারেন।
বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় নবানি গৃহ্নাতি নরোহপরাণি ।
তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণান্যন্যানি সংযাতি নবানি দেহী ।। ২২ ।।
অর্থ : মানুষ যেমন জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করে নতুন বস্ত্র পরিধান করে আত্মা তেমনি জীর্ণ দেহ ত্যাগ করে নতুন দেহ ধারণ করে। অতএব তোমার কর্তব্য সম্পাদনের সময় শোক করা উচিৎ নয়।
নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ ।
ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ ।। ২৩ ।।
অর্থ :আত্মাকে অস্ত্রের দ্বারা কাটা, আগুনে পোড়ানো, জলে ভিজানো বা হাওয়াতে শুকানো যায় না।
অচ্ছেদ্যোহয়মদাহ্যোহয়মক্লেদ্যোহশোষ্য এব চ ।
নিত্য: সর্বগতঃ স্থাণুরচলো্হয়ং সনাতনঃ ।।২৪ ।।
অর্থ : এই আত্মা অচ্ছেদ্য, অদাহ্য, অক্লেদ্য, অশোষ্য, ইনি নিত্য, সর্বব্যাপী , স্থির, অচল ও সনাতন।
অব্যক্তোহয়মচিন্ত্যাহয়মবিকার্যোহয়মুচ্যতে ।
তস্মাদেবং বিদিত্বৈনং নানুশোচিতুমর্হসি ।। ২৫ ।।
অর্থ : আত্মা প্রত্যেক্ষগোচর নন. এঁর মুক্তি নেই, তাই মন এঁকে চিন্তাও করতে পারে না। এঁকে বলা হয় অবিকারী, এঁর কোন বিকার নেই। আত্মাকে এই ভাবে জেনে তুমি শোক ত্যাগ কর। আত্মাকে জানার পর শোক অসঙ্গত।
অথ চৈনং নিত্যজাতং নিত্য বা মন্যসে মৃতম্।
তথাপি ত্বং মহাবাহো নৈবং শোচিতুমর্হসি ।। ২৬ ।।
অর্থ : আর যদি তুমি মনে কর, আত্মা প্রত্যেক দেহের জন্মের সংগে সংগে জন্মান এবং প্রত্যেক দেহের বিনাশের সংগে সংগে মৃত্যু বরণ করেন, তা হলেও হে মহাবাহো! তোমার এঁর জন্য শোক করা অসঙ্গত।
জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যুর্ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ।
তস্মাদপরিহার্যেহর্থে ন ত্বং শোচিতুমর্হসি ।। ২৭ ।।
অর্থ : যার জন্ম হয়েছে তার মৃত্যু যেমন অবশ্যম্ভাবী তেমনি যার মৃত্যু হয়েছে তার জন্ম তেমনী অবশ্যম্ভাবী। সুতরাং যা আবশ্যম্ভাবী সেই বিষয়ে শোকার্ত হওয়া অনুচিত।
অব্যক্তাদীনি ভূতানি ব্যক্তমধ্যানি ভারত ।
অব্যক্তনিধনান্যেব তত্র কা পরিদেবনা ।। ২৮ ।।
অর্থ : হে অর্জুন! জীবগণ আদিতে অব্যক্ত, মধ্যে ব্যক্ত, আবার বিনাশে অব্যক্ত- তাতে আবার কিসের শোক?
আশ্চর্যবৎ পশ্যতি কশ্চিদেনম্ আশ্চর্যবদ্ বদতি তথৈব চান্য:।
আশ্চর্যবচ্চৈনমন্য: শৃণোতি শ্রুত্বাপ্যেনং বেদ ন চৈব কশ্চিৎ।। ২৯ ।।
ব্যাখ্যামুলক অনুবাদ : যা হঠাৎ দেখা যায়, যা অদ্ভুত এবং যা এর আগে দেখা যায়নি, তাই আশ্চর্য। যেমন স্বপ্ন, মায়া, ইন্দ্রজাল প্রভৃতি। কেউ আত্মাকে আশ্চর্য রুপে (অর্থাৎ অদ্ভুদ রুপে দেখেন (উপলব্ধি করেন), অন্য কেউ দেখে যা বলেন তাও অদ্ভুদ, অর্থাৎ আশ্চর্য(বোধগম্য হয় না বলে)-জ্ঞানার্থী উপদেষ্ঠার মুখে আত্মাতত্ত্ব অদ্ভুদরুপেই শোনেন-অর্থাৎ শুনেও তাঁদের আত্মোপলব্ধি হয় না। এর কারণ আত্মতত্ত্ব অত্যন্ত দুর্জ্ঞেয়; সকলের কাছেই আত্মা বিস্ময়ের বস্তুমাত্র যাঁদের আত্মদর্শন (আত্মসাক্ষাৎকার, আত্মোলব্দি) হয় তাঁরা আত্মাকে আশ্চর্যবৎ কিছু বলে বোধ করেন, কেউ বা একে আশ্চর্যবৎ কিছু বলে বর্ণনা করেন, আবার কেউ কেউ শোনেন। আত্মা আশ্চর্যবৎ কিছু-এঁদের সকলের কাছেই আত্মা এক পরম বিম্সয়, আত্মার প্রকৃত স্বরুপ কেউ জানেন না। বিজ্ঞ ব্যক্তিরাও যে শোকে অভিভূত হন, তার কারণ আত্মজ্ঞানের অভাব।
দেহী নিত্যমবধ্যোহয়ং দেহে সর্বস্য ভারত।
তস্মাৎ সর্বাণি ভূতানি ন ত্বং শোচিতুমর্হসি ।। ৩০ ।।
অর্থ : হে অর্জুন! প্রাণীগণের দেহে অবস্থিত আত্মা সর্বদাই অবধ্য, তাই কোন প্রাণীর দেহনাশে তোমার শোক করা উচৎ নয়।
স্বধর্মমপি চাবেক্ষ্য ন বিকম্পিতুমর্হসি ।
ধর্ম্যাদ্ধি যুদ্ধাচ্ছ্রেয়োহন্যৎ ক্ষত্রিয়স্য ন বিদ্যতে ।। ৩১ ।।
অর্থ :আর ধর্মের কথা ভেবেও তোমার ভীত হওয়া উচিৎ নয়। কারণ ধর্মযুদ্ধ ছাড়া ক্ষত্রিয়ের পক্ষে কল্যাণকর আর কিছুই নেই।
যদৃচ্ছয়া চোপপন্নং স্বর্গদ্বারমপাবৃতম্।
সুখিনঃ ক্ষত্রিয়াঃ পার্থ লভন্তে যুদ্ধমীদৃশম্ ।। ৩২ ।।
অর্থ : অপ্রার্থিতভাবে এই ধর্মযুদ্ধ তোমার কাছে এসেছে। এই যুদ্ধ যেন উন্মুক্ত স্বর্গদ্বার তুল্য। এইরুপ যুদ্ধের সুযোগ ভাগ্যবান ক্ষত্রিয়েরাই লাভ ক'রে থাকেন।
অথ চেত্ত্বমিমং ধর্ম্যং সংগ্রামং ন করিষ্যসি ।
ততঃ স্বধর্মং কীর্তিং চ হিত্বা পাপমবাপ্স্যসি ।। ৩৩ ।।
অর্থ : তুমি যদি এই ধর্মযুদ্ধ না কর তা হলে ধর্ম ও কীর্তি ত্যাগ করে পাপের ভাগী হবে। (শাস্ত্রের বিধান এই- ক্ষত্রিয়ের পক্ষে ধর্ম যুদ্ধ থেকে বিরত থাকা পাপজনক- তা ছাড়া যুদ্ধ না করলে এযাবৎ অর্জিত কীর্তি তো হারাবেই।)
অকীর্তিং চাপি ভূতানি কথয়িষ্যন্তি তেহব্যয়াম্ ।
সম্ভাবিতস্য চাকীর্তির্মরণাদতিরিচ্যতে ।। ৩৪ ।।
অর্থ :তা ছাড়া সকলে চিরকাল তোমার অখ্যাতি ঘোষণা করবে। সম্মানিত পুরুষের পক্ষে অখ্যাত মৃত্যু অপেক্ষাও অধিকতর দু:খদায়ক।
ভয়াদ্ রণাদুপরতং মংস্যন্তে ত্বাং মহারথাঃ ।
যেষাং চ ত্বং বহুমতো ভূত্বা যাস্যসি লাঘবম্ ।। ৩৫ ।।
অর্থ :(কর্ণ প্রভৃতি) মহারথীগণ মনে করবেন, তুমি ভয় পেয়েই যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত হয়েছে। ফলে, তুমি যাঁদের কাছে সম্মানিত ছিলে তাঁদের কাছে হেয় হবে।
অবাচ্যবাদাংশ্চ বহূন্ বদিষ্যন্তি তবাহিতাঃ ।
নিন্দন্তস্তব সামর্থ্যং ততো দুঃখতরং নু কিম্ ।। ৩৬ ।।
অর্থ :আর তোমার শক্ররাও তোমার সামর্থ্যের নিন্দা করে বহু অকথ্য কথা বলবে। তার চেয়ে দু:খকর আর কি হতে পারে?
হতো বা প্রাপ্স্যসি স্বর্গং জিত্বা বা ভোক্ষ্যসে মহীম ।
তস্মাদুত্তিষ্ঠ কৌন্তেয় যুদ্ধায় কৃতনিশ্চয়ঃ ।। ৩৭ ।।
অর্থ : হে কৌন্তেয়! যতি তুমি যুদ্ধে নিহত হও, তবে স্বর্গলাভ করবে আর যদি জয়ী হও তাহলে রাজ্য ভোগ করবে। অতএব যুদ্ধের জন্য উত্থিত হও।
সুখেদু:খে সমে কৃত্বা লাভালাভৌ জয়াজয়ৌ।
ততো যুদ্ধায় যুজ্যস্ব নৈবং পাপমবাপ্স্যসি।। ৩৮ ।।
অর্থ : তুমি সুখ-দু:খ, লাভ ক্ষতি, জয়-পরাজয়, সমান দৃষ্টিতে দেখে (ধর্ম) যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। এই ভাবে যুদ্ধ করলে গুরুজনাদির বধজনিত কোন পাপ তোমাকে স্পর্শ (তুমি লাভ) করবে না।
এষা তেহভিহিতা সাংখ্যে বুদ্ধির্যোগে ত্বিমাং শৃণু ।
বুদ্ধ্যা যুক্তো যয়া পার্থ কর্মবন্ধং প্রহাস্যসি ।। ৩৯ ।।
অর্থ :হে অর্জুন! তোমাকে আত্মতত্ত্ব বিষয়ে জ্ঞানের উপদেশ দিয়েছি। এখন কর্মযোগ বিষয়ে বলছি শোন। নিষ্কাম কর্মবিষয়ে এই জ্ঞান লাভ করলে তুমি কর্মের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারবে।
নেহাভিক্রমনাশোহস্তি প্রত্যবায়ো ন বিদ্যতে ।
স্বল্পমপ্যস্য ধর্মমস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ ।। ৪০ ।।
অর্থ : এই নিষ্কামকর্মযোগে আরদ্ধ কর্ম নিষ্ফল হয় না, ক্রটিবিচ্যুতি জনিত পাপও এতে নেই। এই ধর্মের অতি অল্প আচরণও মহাভয় থেকে ত্রাণ করে।
ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিরেকেহ কুরুনন্দন ।
বহুশাখা হ্যনন্তাশ্চ বুদ্ধয়োহব্যবসায়িনাম্ ।। ৪১ ।।
অর্থ : যে বু্দ্ধি নিষ্কাম কর্মের সংগে যুক্ত সেই বুদ্ধি একনিষ্ঠ। এই বুদ্ধি স্থির এবং একাভিমুখী অর্থাৎ বহুদিকে ধাবিত হয় না। অস্থির চিত্ত কামনাযুক্ত ব্যক্তিদের বুদ্ধি বহু শাখাবিশিষ্ট এবং বহুমুখী।
যামিমাং পুষ্পিতাং বাচং প্রবদন্ত্যবিপশ্চিতঃ ।
বেদবাদরতাঃ পার্থ নান্যদস্তীতি বাদিনঃ ।। ৪২ ।।
কামাত্মানঃ স্বর্গপরা জন্মকর্মফলপ্রদাম্ ।
ক্রিয়াবিশেষবহুলাং ভোগৈশ্বর্যগতিং প্রতি।।৪৩।।
অর্থ : বিবেকবর্জিত লোকেরাই বেদের পুষ্পিত বাক্যে আসক্ত হয়ে স্বর্গসুখ ভোগ, উচ্চকুলে জন্ম, ক্ষমতা লাভ আদি সকাম কর্মকেই জীবনের চরম উদ্দেশ্যে বলে মনে করে। ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ ও ঐশ্বর্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তারা বলে যে, তার উর্ধ্বে আর কিছুই নেই।
ভোগৈশ্বর্যপ্রসক্তানাং তয়াপহৃতচেতসাম্ ।
ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিঃ সমাধৌ ন বিধীয়তে।।৪৪।।
অর্থ : যারা ভোগ ও ঐশ্বর্যসুখে আসক্ত, সেই সমস্ত বিবেকবর্জিত মূঢ় ব্যক্তিদের বুদ্ধির সমাধি অর্থাৎ ভগবানে একনিষ্ঠতা লাভ হয়।
ত্রৈগুণ্যবিষয়া বেদা নিস্ত্রৈগুণ্যে ভবার্জুন ।
নির্দ্বন্দ্বো নিত্যসত্ত্বস্থো নিযোর্গক্ষেম আত্মবান‌্।।৪৫।।
অর্থ :বেদে প্রধানত: জড়া প্রকৃতির তিনটি গুণ সম্বন্ধেই আলোচনা করা হয়েছে। হে অর্জুন! তুমি সেই গুণগুলিকে অতিক্রম করে নির্গুণ স্তরে অধিষ্ঠিত হও। সমস্ত দ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত হও এবং লাভ-ক্ষতি ও আত্মরক্ষার দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে অধ্যাত্ম চেতনায় অধিষ্ঠিত হও।
যাবানর্থ উদপানে সর্বতঃ সংপ্লুতোদকে ।
তাবান্ সর্বেষু বেদেষু ব্রাহ্মণস্য বিজানতঃ।।৪৬।।
অর্থ : ক্ষুদ্র জলাশয়ে যে সমস্ত প্রয়োজন সাধিত হয়, সেগুলি বৃহৎ জলাশয় থেকে আপনা হতেই সাধিত হয়ে যায়। তেমনই, ভগবানের উপাসনার মাধ্যমে যিনি পরব্রহ্মের জ্ঞান লাভ করে সব কিছুর উদ্দেশ্য উপলব্ধি করেছেন, তাঁর কাছে সমস্ত বেদের উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে।
কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন ।
মা কর্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্মণি।।৪৭।।
অর্থ : তোমার কর্মেই অধিকার, ফলে নয়-কর্মফলে যেন তোমার আসক্তি না হয়। তুমি কর্মফল লাভের হেতু হয়ো না অর্থাৎ কর্মফলের আশায় কর্ম করো না। আবার কর্ম-ত্যাগও যেন তোমার প্রাবৃত্তি না হয়।
যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা ধনঞ্জয়।
সিদ্ধ্যসিদ্ধ্যো: সমো ভূত্বা সমত্বং য়োগ উচ্যতে।।৪৮।।
অর্থ : হে ধনঞ্জয়! যোগস্থ হয়ে ফলাকাঙ্খা ও কর্তৃত্বের ভাব ত্যাগ করে; সিদ্ধি ও অসিদ্ধি এ দুয়েতেই সমভাবাপন্ন হয়ে কর্ম কর। চিত্তের সমত্ব বুদ্ধি বা নির্বিকার ভাবকেই যোগ বলে।
দূরেণ হ্যবরং কর্ম বুদ্ধিযোগাদ্ধনঞ্জয়।
বুদ্ধৌ শরণমন্বিচ্ছ কৃপণাঃ ফলহেতবঃ।।৪৯।।
অর্থ : হে ধনঞ্জয়! সকাম কর্ম নিষ্কাম কর্ম অপেক্ষা অত্যন্ত নিকৃষ্ট। সুতরাং তুমি কামনাশূন্য হয়ে বুদ্ধিযোগে নিষ্কাম কর্মের আশ্রয় গ্রহণ কর। যারা ফলাকাঙ্খী হয়ে কাজ করে, তারা নিকৃষ্ট।
বুদ্ধিযুক্তো জহাতীহ উভে সুকৃতদুষ্কৃতে।
তস্মাদ্ যোগায় যজ্যস্ব যোগঃ কর্মসু কৌশলম্ ।।৫০।।
অর্থ : যিনি ভগবদ্ভক্তির অনুশীলন করেন, তিনি এই জীবনেই পাপ ও পূণ্য উভয় থেকেই মুক্ত হন। অতএব, তুমি নিষ্কাম কর্মযোগের অনুষ্ঠান কর। সেটিই হচ্ছে সার্বঙ্গীন কর্মকৌশল।
কর্মজং বুদ্ধিযুক্তা হি ফলং ত্যক্ত্বা মনীষিণঃ।
জন্মবন্ধবিনির্মুক্তাঃ পদং গচ্ছন্ত্যনাময়ম্।।৫১।।
অর্থ :নিষ্কাম কর্মযোগী মনীষিগণ কর্মজাত ফল ত্যাগ করে জন্মরুপ সংসার বন্ধন থেকে মুক্ত হন এবং সকল প্রকার উপদ্রব-শূন্য মোক্ষাবস্থা লাভ করেন।
যদা তে মোহকলিলং বুদ্ধির্ব্যতিতরিষ্যতি।
তদা গন্তাসি নির্বেদং শ্রোতব্যস্য শ্রুতস্য চ।।৫২।।
অর্থ : যখন তোমার বুদ্ধি মোহময় অবিবেক রুপ কলুষ অতিক্রম করতে পারবে, তখন তুমি শ্রোতব্য ও শ্রুত বিষয়ে বৈরাগ্য লাভ করবে।
শ্রুতিবিপ্রতিপন্না তে যদা স্থাস্যতি নিশ্চলা।
সমাধাবচলা বুদ্ধিস্তদা যোগমবাপ্সসি।।৫৩।।
অর্থ :নানারুপ ফলের কথা শ্রবণে ( বেদের বিচিত্র ভাষার দ্বারা )তোমার চিত্ত বিক্ষিপ্ত হয়ে যখন অন্য বিষয়ে আকৃষ্ঠ হবে না (নিশ্চল হবে), যখন তোমার বার বার অভ্যাসের ফলে তোমার চিত্ত পরমাত্মায় স্থির (অচল) হয়ে থাকবে, তখন তুমি সাম্যবুদ্ধি লাভ করবে।
|অর্জুন উবাচ|
স্থিতপ্রজ্ঞ্যি কা ভাষা সমাধিস্থস্য কেশব ।
স্থিতধীঃ কিং প্রভাষেত কিমাসীত ব্রজেত কিম।।৫৪।।
অর্থ : অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন হে কেশব! স্থিতপ্রজ্ঞ অর্থাৎ অচলা বু্দ্ধিসম্পন্ন মানুষের লক্ষণ কি? তিনি কিভাবে কথা বলেন, কিভাবে অবস্থান করেন এবং কিভাবেই বা তিনি বিচরণ করেন?
|শ্রীভগবানুবাচ|
প্রজহাতি যদা কামান্ সর্বান্ পার্থ মনোগতান‌।
আত্মন্যেবাত্মনা তুষ্টঃ স্থিতপ্রজ্ঞস্তদোচ্যতে ।।৫৫।।
অর্থ :পরমেশ্বর ভগবান বললেন- হে পার্থ! জীব যখন মানসিক জল্পনা-কল্পনা থেকে উদ্ভুত সমস্ত মনোগত কাম পরিত্যাগ করে এবং তার মন যখন এভাবে পবিত্র হয়ে আত্মাতেই পরিপূর্ণ তৃপ্তি লাভ করে, তখনই তাকে স্থিতপ্রজ্ঞ বলা হয়।
দুঃখেষ্বনুদ্বিগ্নমনাঃ সুখেষু বিগতস্পৃহঃ ।
বীতরাগভয়ক্রোধঃ স্থিতধীর্মুনিরুচ্যতে।।৫৬।।
অর্থ : ত্রিতাপ দু:খের মধ্যেও যিনি উদ্বেগহীন, সুখে নিস্পৃহ এবং অনুরাগ, ভয় ও ক্রোধ শূন্য তিনিই হচ্ছেন স্থিতপ্রজ্ঞ।
য: সর্বত্রানভিস্নেহস্তত্তৎ প্রাপ্য শুভাশুভম্ ।
নাভিনন্দতি ন দ্বেষ্টি তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা।।৫৭।।
অর্থ : যিনি সর্বত্র স্নেহশূন্য, শুভ লাভ হলে আনন্দিত হন না অশুভ হলেও দু:খিত হন না( উদাসীনভাবেই কথা বলেন), তিনিই পূর্ণ জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
যদা সংহরতে চায়ং কূর্মোহঙ্গানীব সর্বশঃ।
ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেভ্যস্তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা।।৫৮।।
অর্থ :ভয় পেলে কূর্ম যেমন তার মস্তক এবং অন্য সব অঙ্গ সঙ্কুচিত করে, তেমনি যিনি ইন্দ্রিয়ের বিষয় থেকে ইন্দ্রিয়গুলো প্রত্যাহার ক'রে নেন, তাঁর প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত।
বিষয়া বিনিবর্তন্তে নিরাহারস্য দেহিনঃ ।
রসবর্জং রসোহপ্যস্য পরং দৃষ্ট্বা নিবর্ততে।।৫৯।।
অর্থ :দেহবিশিষ্ট জীব ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ থেকে নিবৃত্ত হতে পারে, কিন্তু তবুও ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের আসক্তি থেকে যায়, কিন্তু যখন পরমাত্মার দর্শন হয়, তখন বিষয় ও বিষয়তৃষ্ণা চিরকালের মত দূর হয়ে যায়।
যততো হ্যপি কৌন্তেয় পুরুষস্য বিপশ্চিতঃ।
ইন্দ্রিয়াণি প্রমাথীনি হরন্তি প্রসভং মনঃ ।।৬০।।
অর্থ :হে কুন্তিপুত্র! ইন্দ্রিয়সমুহ এতই বলবান যে, অতি যত্নশীল শাস্ত্রজ্ঞ পুরুষের মনকেও বলপূর্বক বিষয়ের দিকে আকর্ষণ করে।
তানি সর্বাণি সংযম্য যুক্ত আসীত মত্পরঃ ।
বশে হি যস্যেন্দ্রিয়াণি তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা ।।৬১।।
অর্থ : যিনি তাঁর ইন্দ্রিয়গুলিকে সম্পূর্ণরুপে সংযত করে আমার প্রতি উত্তমা ভক্তিপরায়ন হয়ে তাঁর ইন্দ্রিয়গুলিকে সম্পূর্ণরুপে বশীভূত করেছেন, তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ।
ধ্যায়তো বিষয়ান্ পুংসঃ সঙ্গস্তেষুপজায়তে।
সঙ্গাৎ সঞ্জায়তে কামঃ কামৎ ক্রোধোহভিজায়তে।।৬২।।
অর্থ : ইন্দ্রিয়জাত বিষয় সমুহ সম্বন্ধে চিন্তা করতে করতে মানুষের মনে আসক্তির উদয় হয়। আসক্তি থেকে কামনার উৎপন্ন হয় এবং কাম থেকে ক্রোধ উৎপন্ন হয়।
ক্রোধাদ্ ভবতি সম্মেহঃ সম্মেহাৎ স্মৃতিবিভ্রমঃ ।
স্মৃতিভ্রংশাদ্ বুদ্ধিনাশো বুদ্ধিনাশাৎ প্রণশ্যতি।।৬৩।।
অর্থ :ক্রোধ থেকে সম্মোহ, সম্মোহ থেকে স্মৃতি বিভ্রম, স্মৃতি বিভ্রম থেকে বুদ্ধিনাশ, আর বুদ্ধিনাশ হওয়ার ফলে সর্বনাশ হয়। মানুষ পুনরায় জড় জগতের অন্ধকুপে অধ:পতিত হয়।
রাগদ্বেষবিমুক্তৈস্তু বিষয়ানিন্দ্রিয়ৈশ্চরন্ ।
আত্মবশ্যৈর্বিধেয়াত্মা প্রসাদমধিগচ্ছতি।।৬৪।।
অর্থ : বিধেয়াত্মা অর্থাৎ যার মন নিজের বশীভূত, তিনি অনুরাগ ও বিদ্বেষ থেকে মুক্ত, নিজের বশীভূত ইন্দ্রিয়গণের দ্বারা বিষয় ভোগ ক'রে আত্মপ্রসাদ লাভ করেন।
প্রসাদে সর্বদুঃখানাং হানিরস্যোপজায়তে ।
প্রসন্নচেতসো হ্যাশু বুদ্ধিঃ পর্যবতিষ্ঠতে।।৬৫।।
অর্থ : এইভাবে চিত্তপ্রসাদ লাভের পর শুদ্ধচিত্ত ব্যক্তির সমস্ত দু:খের নিবৃত্তি হয়। যেহেতু তিনি প্রসন্নচেতা, তাঁর মন শীঘ্রই তাঁর উপাস্য দেবতায় নিশ্চল হয়ে স্থিতিলাভ করে।
নাস্তি বুদ্ধিরযুক্তস্য ন চাযুক্তস্য ভাবনা ।
ন চাভাবয়তঃ শান্তিরশান্তস্য কুতঃ সুখম্।।৬৬।।
অর্থ : যে ব্যক্তি কৃষ্ণভাবনায় যুক্ত নয়, তার চিত্ত সংযত নয় এবং তার পারমার্থিক বুদ্ধি থাকতে পারে না। আর পারমার্থ চিন্তাশূন্য ব্যক্তির শান্তি লাভের কোন সম্ভাবনা নেই। এই রকম শন্তিহীন ব্যক্তির প্রকৃত সুখ কোথায়?
ইন্দ্রিয়াণাং হি চরতাং যন্মনোহনুবিধীয়তে ।
তদস্য হরতি প্রজ্ঞাং বায়ুর্নাবমিবাম্ভসি।।৬৭।।
অর্থ : প্রতিকূল বায়ু নৌকাকে যেমন অস্থির করে, তেমনি সদা বিচরণকারী যে কোন একটি মাত্র ইন্দ্রিয়ের আকর্ষণেও মন অসংযত ব্যক্তির প্রজ্ঞাকে হরণ করতে পারে।
তস্মাদ্ যস্য মহাবাহো নিগৃহীতানি সর্বশঃ ।
ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেভ্যস্তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা।।৬৮।।
অর্থ : হে মহাবাহো! যাঁর ইন্দ্রিয়গুলি ইন্দ্রিয়ের বিষয় থেকে সর্বপ্রকারে নিবৃত্ত হয়েছে, তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ।
যা নিশা সর্বভূতানাং তস্যাং জাগর্তি সংযমী ।
যস্যাং জাগ্রতি ভূতানি সা নিশা পশ্যতো মুনেঃ ।।৬৯।।
অর্থ : সাধারণ প্রাণীগণের পক্ষে যা(আত্মনিষ্ঠা) অন্ধকার রাত্রিস্বরুপ, সেই আত্মনিষ্ঠাতে সংযমীব্যক্তি জাগ্রত (অবস্থিত) থাকেন, আর যাতে অর্থাৎ বিষয়ানিষ্ঠাতে অজ্ঞ প্রাণীরা জাগ্রত থাকে (সংসার দর্শন করে) আত্মদর্শী মুনির কাছে তা অন্ধকার রাত্রিতুল্য।
আপূর্যমাণমচলপ্রতিষ্ঠং সমুদ্রমাপঃ প্রবিশন্তি যদ্বৎ ।
তদ্বৎ কামা: যং প্রবিশন্তি সর্বে স শান্তিমাপ্নোতি ন কামকামী।।৭০।।
অর্থ :নদীর জলে সমুদ্রপূর্ণ হচ্ছে, সমুদ্র নির্বিকার। জলরাশি তাতে প্রবেশ ক'রে লীন হয়ে যাচ্ছে, কোন বিক্ষোপ সৃষ্টি করছে না- তেমনি যে আত্মনিষ্ঠ পুরুষে কামসমুহ প্রবেশ করেও কোন চিত্ত বিক্ষোপ সৃষ্টি করে না- তিনিই শান্তি লাভ করেন, বিষয়ভোগী ব্যক্তি শান্তি লাভ করে না।
বিহায় কামান্ য: সর্বান পুমাংশ্চরতি নিঃস্পৃহঃ ।
নির্মমো নিরহংকারঃ স শান্তিমধিগচ্ছতি।।৭১।।
অর্থ : যিনি সমস্ত কামনা-বাসনা ত্যাগ করে জড় বিষয়ের প্রতি নিস্পৃহ হয়ে বিচরণ করেন, যিনি মমতাশূন্য এবং অহঙ্কারশূন্য, তিনিই শান্তিলাভ করেন।
এষা ব্রাহ্মী স্থিতিঃ পার্থ নৈনাং প্রাপ্য় বিমুহ্যতি ।
স্থিত্বাস্যামন্তকালেহপি ব্রহ্মনির্বাণমৃচ্ছতি।।৭২।।
অর্থ : হে অর্জুন! এই অবস্থারই নামই ব্রাহ্মীস্থিতি। এই অব্স্থা লাভের পর জীবের আর মোহ হয় না। মৃত্যুকালেও এই অবস্থায় থেকে তিনি ব্রহ্মে মিলনরুপ মোক্ষলাভ করেন।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র