৭১. ভীমান্বেষণে যুধিষ্ঠিরাদির যাত্রাযুধিষ্ঠির বলে, মুনি কর অবধান।ভীমের বিলম্বে মোর আকুল পরাণ।।কেমন কুবুদ্ধি প্রভু হৈল মম মনে।ভীমেরে পাঠানু আমি পুষ্পের কারণে।।যখন বিপদকাল হয় উপস্থিত।পাপযুক্ত বুদ্ধিতে আচ্ছন্ন হয় চিত।।কুকর্ম্ম যতেক বুঝে সুকর্ম্মের প্রায়।নহে প্রবর্ত্তিত কেন কপট পাশায়।।আশ্চর্য্য দেখহ আর বিধির ঘটন।পঞ্চ ভাই কৃষ্ণা সহ আইলাম বন।।অস্ত্রশিক্ষা হেতু পার্থ স্বর্গেতে রহিল।মিছা কার্য্যে পুষ্প হেতু ভীমসেন গেল।।ব্যস্ত প্রাণ না দেখিয়া দোঁহাকার মুখ।বিধি দেয় দুঃখের উপরে আর দুখ।।এত বলি ঘটোৎকচে করেন স্মরণ।স্মরণ করিবামাত্র ভীমের নন্দন।।আসিয়া সবার পদে করিল প্রণতি।আশীর্ব্বাদ করিয়া বলেন নরপতি।।ভাগ্যে আজি দেখিলাম বদন তোমার।মন দিয়া শুন বাপু কহি সমাচার।।পুষ্প হেতু গেল ভীম জনক তোমার।বহুদিন না পাই তাহার সমাচার।।এই হেতু চিন্তা সদা হতেছে আমার।ঘটোৎকচ এ সঙ্কটে করহ উদ্ধার।।প্রাণের অধিক মম বৃকোদর ভাই।শীঘ্রগতি চল সবে, তথাকারে যাই।।আমারে লইবে আর ভাই দুই জন।সকল বর্ণের গুরু লইবে ব্রাহ্মণ।।দ্রুপদ নন্দিনী কৃষ্ণা জননী তোমার।সে কারণে লইবারে, মোর অঙ্গীকার।।ঘটোৎকচ বলে, দেব তোমার আজ্ঞায়।পৃথিবী বহিতে পারি কত বড় দায়।।মোর পৃষ্ঠে আরোহণ কর সব জনে।তোমার প্রসাদে তথা যাব এইক্ষণে।।এত শুনি তুষ্ট হয়ে ধর্ম্মের নন্দন।প্রশংসা করিয়া বহু দেন আলিঙ্গন।।আরোহণ কৈল আগে ব্রাহ্মণ মণ্ডলী।কৃষ্ণা সহ তিন ভাই বৈসে কুতূহলী।।চলিল ভীমের পুত্র ভীম পরাক্রম।অনায়াসে গমনে তিলেক নাহি শ্রম।।দেখিয়া বনের শোভা আনন্দিত সবে।কুসুমিত কাননে কোকিল কলবরে।।মধুপানে মত্ত হয়ে ভ্রমর ঝংঙ্কার।অনঙ্গ মোহিত অঙ্গ রঙ্গে সবাকার।।পশু পক্ষী মৃগেতে পূরিত বনস্থল।দিব্য সরোবর, তাহে শোভিত কমল।।বিহরে কৌতুকে রাজহংস চক্রবাক।নানাবর্ন মৎস্য বিহরে লাখে লাখ।।বিবিধ তড়াগ কৃপ বহু নদ নদী।স্থাবর জঙ্গম যত, কে করে অবধি।।প্রতি ডালে নানা পক্ষী করে কলবর।কৌতুকে দেখিছে যেন মহামহোৎসব।।লঙ্ঘিয়া উদ্যান সব উপবন যত।উদ্দেশ পাইল গন্ধমাদন পর্ব্বত।।নানা কথা কহিতে লাগিল মুনিগণ।শুনিয়া সানন্দ বড় ধর্ম্মের নন্দন।।এইমত অল্পক্ষণে রাজা যুধিষ্ঠির।উপনীত যথা আছে বৃকোদর বীর।।দেখিল অনেক সৈন্য কুবের কিঙ্কর।যুদ্ধেতে লইল প্রাণ বীর বৃকোদর।।দিব্য সরোবর দেখে অগাধ সলিল।কমল কুমুদ রক্ত শ্বেত পীত নীল।।জলজন্তু বিহঙ্গম অতি মনোহর।কুসুম উদ্যান চারি তটের উপর।।ক্রীড়ায় কৌতুকী মন ভীম মহামতি।হেনকালে দেখিল আগত ধর্ম্মপতি।।লোমশ ধৌম্যের কৈল চরণ বন্দন।মাদ্রীপুত্র দুই জনে কৈল আলিঙ্গন।।মধুর সম্ভাষে তুষ্টা কৈল যাজ্ঞসেনী।ভীমে সম্বোধিয়া কহে ধর্ম্ম নৃপমণি।।শুন ভাই, তব যোগ্য নহে এই কর্ম্ম।দেব দ্বিজ হিংসা নহে ক্ষত্রিয়ের ধর্ম্ম।।হেন কর্ম্ম কভু নাহি করিবে সর্ব্বথা।কিছু না কহিয়া ভীম রহে হেঁট মাথা।।বিদায় লইল তবে ঘটোৎকচ বীর।দিন কত তথায় রহেন যুধিষ্ঠির।।সুবর্ণ পঙ্কজ পুষ্প তুলি সর্ব্বজনে।ইষ্টের অর্চ্চনা করে আনন্দিত মনে।।ছায়া সুশীতল জল, স্থল মনোরম।সহজে সুখের স্থান, দেবের আশ্রম।।মৃগয়া করেন নিত্য ভীম মহাবল।আনয়ে বনের ফল ব্রাহ্মণ সকল।।ভক্তিভাবে দ্রুপদ নন্দিনী ভক্তিমনা।ব্রাহ্মণ পালনে রতা জননী সমানা।।এমনি কৌতুকযুক্ত আছে সর্ব্বজন।একদিন শুন তথা দৈবের ঘটন।।মৃগয়া করিতে ভীম গেল দূর বনে।ধৌম্য পুরোহিত গেল সরোবর স্নানে।।লোমশ পুষ্পের হেতু প্রবেশিল বন।নিঃসহায় আশ্রমে থাকেন চারিজন।।হেনকালে জটাসুর বকের বান্ধব।বন্ধুর পরম শত্রু জানিয়া পাণ্ডব।।হিংসা হেতু আশ্রয় করিল সেই বন।ছিদ্র চাহি সাবধানে থাকে অনুক্ষণ।।না পারে হিংসিতে দুষ্ট ভীমে করি ভয়।বিশেষ রক্ষক মন্ত্র ব্রাহ্মণ পঠয়।।দৈবযোগে সেই দি দেখি শূন্যালয়।শীঘ্রগতি আসে তথা দুষ্ট দুরাশয়।।ভয়ঙ্কর মূর্ত্তি অতি গভীর গর্জ্জনে।কহিতে লাগিল দুষ্ট ধর্ম্মের নন্দনে।।আরে পাপমতি দুষ্ট পাপিষ্ঠ পাণ্ডব।হিড়িম্বক আদি মোর বন্ধু ছিল সব।।সবারে মারিল দুষ্ট ভীম তোর ভাই।সেই অনুতাপে আমি নিদ্রা নাহি যাই।।স্ববাঞ্ছিত ফল আজি বিধাতা ঘটাল।সে কারণে চারি জনে একান্তে মিলিল।।নিশ্চয় নিধন আজি করিব সবাকে।ভীমার্জ্জুন মরিবেক তোমাদের শোকে।।নিপাত হইল শত্রু, কাল হৈল পূর্ণ।এতেক বলিয়া দুষ্ট ধরিলেক তূর্ণ।।পৃষ্ঠে আরোপিয়া সবে উঠি শীঘ্রগতি।ভীমে ভয় করিয়া পলায় দুষ্টমতি।।মহাভারতের কথা অমৃত সমান।কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।৭২. জটাসুর বধ এবং পাশুবদিগেরবদরিকাশ্রমে যাত্রাযুধিষ্ঠির বলে, পাপ রাক্ষস অধম।বুঝিলাম আজি তোরে স্মরিলেক যম।।অহিংসক জনেরে হিংসয়ে যেই জন।অল্পকালে দণ্ড তারে করয়ে শমন।।না বুঝিয়া কি কারণে করিস্ কুকর্ম্ম।পাপেতে পড়িলি দুষ্ট, মজাইলি ধর্ম্ম।।ধর্ম্ম নষ্ট করি যার সুখে অভিলাষ।সর্ব্ব ধর্ম্ম নষ্ট হয়, নরকেতে বাস।।ফলিবে এখনি দুষ্ট তোর দুষ্টাচার।হইবি ভীমের হাতে সবংশে সংহার।।দ্রুপদ নন্দিনী কৃষ্ণা এই সব দেখি।পরিত্রাহি ডাকে দেবী মুদি দুই আঁখি।।হা কৃষ্ণ করুণাসিন্ধু কৃপার নিধান।করহ কমলাকান্ত কষ্টে পরিত্রাণ।।তোমারে পাণ্ডব বন্ধু বলি লোকে কয়।সেই কথা পালন করিতে যোগ্য হয়।।কোথা গেলে ভীমসেন, করহ উদ্ধার।তোমা বিনা এ দুস্তরে কে তারিবে আর।।কোথায় রহিলে গিয়া বীর ধনঞ্জয়।রক্ষা কর, পাণ্ডুবংশ মজিল নিশ্চয়।।বিকলা হইয়া কৃষ্ণা কান্দে উচ্চরায়।কত দূরে ভীমসেন শুনিবারে পায়।।বুঝিল অমনি বীর, কান্দে যাজ্ঞসেনী।ব্যগ্র হয়ে বীরবর ধাইল তখনি।।দেখিল, পলায় দুষ্ট হরি চারি জনে।ডাকিয়া কহিল ভীম আশ্বাস বচনে।।তিলার্দ্ধ মনেতে ভয় না কর রাক্ষসে।এখনি মারিব দুষ্টে চক্ষুর নিমিষে।।এত বলি উপাড়িয়া দীর্ঘ তরুবর।ডাকি বলে, রহরে পাপিষ্ঠ দুরাচার।।ভীমের পাইয়া শব্দ বেগে ধায় জটা।গগনমণ্ডলে যেন নবমেঘ ঘটা।।অসুরের কর্ম্ম দেখি বেগে বীর ধায়।ঘুরায়ে বৃক্ষের বাড়ি মারিল মাথায়।।বৃক্ষাঘাতে ব্যথা পেয়ে অতি ক্রোধমনে।ভীমেরে ধরিল দুষ্ট ছাড়ি চারি জনে।।ধাইয়া ভীমের হাতে দিল এক টান।চলিতে নারিল ভীম, পায় অপমান।।ক্রোধে কম্পমান তনু, বৃক্ষ লয়ে হাতে।প্রহার করিল দুষ্ট মারুতির মাথে।।পরশি ভীমের মাথে বৃক্ষ হৈল চূর।বক্ষেতে চাপড় ক্রোধে মারিল অসুর।।করাঘাতে কম্পমান বৃকোদর বীর।অঙ্গে বহে শ্রমজল, হইল অস্থির।।মারিল জটার বুকে দৃঢ় মুষ্ট্যাঘাত।পর্ব্বত উপরে যেন হৈল বজ্রাঘাত।।ভীমের ভৈরব নাদ, অসুরের শব্দ।কানন নিবাসী যত শুনি হৈল স্তব্ধ।।বৃক্ষাঘাতে করাঘাতে আর পদাঘাতে।দ্বিতীয় প্রহর যুদ্ধ হৈল হেনমতে।।মল্লযুদ্ধে বিশারদ দোঁহে মহাবল।সিংহনাদে প্রপূরিল সর্ব্ব বনস্থল।।ধরাধরি করি দোঁহে ক্ষিতিমধ্যে পড়ি।যুগল হস্তীর প্রায় যায় গড়াগড়ি।।ক্ষণেক উপরে ভীম, ক্ষণেক রাক্ষস।সমান শকতি দোঁহে সমান সাহস।।তবে বীর বৃকোদর পেয়ে অবসর।ত্বরিতে উঠিল জটাসুরের উপর।।বুকের উপরে বসি পদে চাপে কর।বাম হাতে গলা চাপি ধরিল সত্বর।।তুলিয়া দক্ষিণ কর মুষ্ট্যাঘাত মারি।ভাঙ্গিয়া ফেলিল তার দন্ত দুই সারি।।পদাঘাতে শিরোদেশ করিলেক চূর।ত্যজিল পরাণ পাপ দুরন্ত অসুর।।দেখিয়া আনন্দযুক্ত ধর্ম্মের নন্দন।শিরোঘ্রাণ করি ভীমে দেন আলিঙ্গন।।কৌতুকে লোমশ ধৌম্য করে আশীর্ব্বাদ।মরিল অসুর দুষ্ট, ঘুচিল বিষাদ।।আসিয়া আশ্রমে সবে হরিষ বিধানে।নিত্য নিয়মিত কাজ কৈল জনে জনে।।পরদিন প্রাতঃকালে ধর্ম্ম অধিকারী।কহেন লোমশ প্রতি করযোড় করি।।মম এক নিবেদন, শুন মহাশয়।অতঃপর এইস্থানে থাকা যোগ্য নয়।।দেখ দুষ্ট জটাসুর মরিল পরাণে।শুনিয়া রুষিবে আসি তার বন্ধুজনে।।সে কারণে এই স্থান বাসযোগ্য নয়।বুঝিয়া করহ কর্ম্ম উচিত যে হয়।।লোমশ বলেন, সত্য কহিলে সুমতি।এই যুক্তি সার বলি লয় মম মতি।।ব্যাসের আশ্রম বদরিকা পুণ্যস্থানে।তথায় চলহ, সবে থাকি প্রীত মনে।।এতেক শুনিয়া সবে লোমশের স্থানে।প্রশংসা করিয়া তথা যায় সর্ব্বজনে।।পর্ব্বত উপরে বৃক্ষচ্ছায়া সুশীতল।কমলে শোভিত রম্য সরোবর জল।।দেখেন অনেকবিধ কৌতুক বিহিত।বদরিকা পুণ্যাশ্রমে সবে উপনীত।।আনন্দে রহেন তথা চারি সহোদর।অর্জ্জুন বিচ্ছেদে সবে কাতর অন্তর।।অমৃত সমান মহাভারতের কথা।কাশীরাম রচিল পয়ার পুণ্য গাঁথা।।৭৩. পাণ্ডবগণের বদরিকাশ্রম হইতেগন্ধমাদন পর্ব্বতে গমনকহেন জনমেজয়, কহ তপোধন।বদরিকাশ্রমে যান পাণ্ডুর নন্দন।।কেমনে রহেন তথা অর্জ্জুন বিহনে।বিস্তারিয়া কহ মুনি শুনিব শ্রবণে।।মুনি বলে, অবধান কর নৃপবর।বনবাসে গত হয় চতুর্থ বৎসর।।পঞ্চ বর্ষ প্রবেশিয়া সপ্তমাস গেল।একদিন পঞ্চজনে একান্তে বসিল।।অর্জ্জুন বিহনে সবে নিরানন্দ মন।কহিল লাগিল কৃষ্ণা করিয়া রোদন।।দেখ মহারাজ এই দৈবের কারণ।সর্ব্বসুখ বিলাসে বঞ্চিত এই জন।।যে হেতু অর্জ্জুন গেল অস্ত্র শিখিবারে।হইল বৎসর পঞ্চ, না দেখি তাহারে।।প্রাণের বিহনে যেন শরীর ধারণ।অর্জ্জুন বিচ্ছেদে তেন আছি পঞ্চজন।।তোমা সবাকার মনে না জানি কি লয়।পার্থের বিহনে মম প্রাণ স্থির নয়।।ভীম বলে, যা কহিলে দ্রুপদ নন্দিনী।শীর্ণ মম কলেবর, এই সব গণি।।সূর্য্যের সমান সেই সর্ব্ব গুণাধার।শাসিলাম মহী বাহুবলেতে যাহার।।যাহার তেজেতে হৈল সুরাসুর বশ।এ তিন ভুবনে যার প্রকাশিল যশ।।তাহার বিহনে প্রাণ শান্ত কিবা হয়।হেনকালে কহে দোঁহে মাদ্রীর তনয়।।যত দিন নাহি দেখি পার্থ মহাবীর।আহারে অরুচি, চিত্ত সদাই অস্থির।।কোথা দিব তুলনা সে অর্জ্জুনের গুণ।পাণ্ডব কুলের চক্ষু কেবল অর্জ্জুন।।তবে যদি পার্থ সহ নহে দরশন।আমরা ত্যজিব প্রাণ এই নিরূপণ।।এত শুনি কহিলেন ধর্ম্ম নৃপমণি।কহিলে যতেক কথা, সব আমি জানি।।অসাধ্য সাধন হেতু যেই ভাই মূল।তাহার বিচ্ছেদে মম পরাণ আকুল।।কিন্তু আমি শুনিয়াছি মুনির বচন।অর্জ্জুন অজেয়, হেন কহে সর্ব্বজন।।চিন্তা না করিহ কিছু আমার কারণে।পূর্ব্বকথা স্মরণ হইল এতদিনে।।আমারে কহিল পার্থ গমনের কালে।আশীর্ব্বাদ করিহ যে আসি ভালে ভালে।।চিন্তা না করিহ কিছু তাহার কারণে।পঞ্চবর্ষে আসি পুনঃ নমিব চরণে।।গন্ধমাদনেতে সবে করিবে গমন।সেইখানে আসি আমি মিলিব তখন।।চলহ তথায় শীঘ্র, যাই সর্ব্বজন।অবশ্য অর্জ্জুন সনে হবে দরশন।।এত বলি নম্রভাবে ধর্ম্মের নন্দন।লোমশ মুনিরে করিলেন নিবেদন।।মুনি আশ্বাসিয়া কহিলেন এই কথা।চল শীঘ্র, অবশ্য যাইব সবে তথা।।চলিল লোমশ আগে ধৌম্যের সহিত।কৃষ্ণাসহ চারি ভাই যান হরষিত।।দুর্গম কানন পথ লঙ্ঘি শত শত।উদ্দেশিয়া যান গন্ধমাদন পর্ব্বত।।নানাবিধ গিরি বন বহু নদ নদী।পশু পক্ষী বৃক্ষ লতা কে করে অবধি।।নানা মিষ্ট আলাপনে হর্ষযুক্ত মন।ছাড়ি মৈনাকাদি করিলেন গমন।।উত্তরেতে হিমালয় পর্ব্বতের শ্রেষ্ঠ।কত দূরে গন্ধমাদন হৈল যে দৃষ্ট।।পরম সুন্দর শুক্ল স্ফটিক সঙ্কাশ।দেখিয়া সবার হৈল পরম উল্লাস।।যত্নে উঠিলেন সবে অতি উচ্চগিরি।তথা থাকি দেখিলেন কুবেরের পুরী।।দূরেতে নগরবর অতি শোভা ধরে।হইল অমরাবতী ভ্রম সবাকারে।।বিবিধ প্রশংসা তার করি সর্ব্বজন।কৌতুকে দেখয়ে সবে গিরি উপবন।।কুবের শাসন সেই হয় গিরিবর।রক্ষা হেতু আছে লক্ষ যক্ষ অনুচর।।একদিন প্রাতঃকালে উঠি যুধিষ্ঠির।কৃষ্ণা সহ চারি ভাই হৈলেন বাহির।।সহিত লোমশ ধৌম্য আদি মুনিগণ।পরম কৌতুকে প্রবেশের পুষ্পবন।।শীতল সৌরভ বহে মন্দ সমীরণ।প্রফুল্ল হইল গন্ধে সবাকার মন।।নানা পুষ্পে মধুপান করিছে ভ্রমর।কোকিল ঝঙ্কার করে বসন্ত কিঙ্কর।।দেখিয়া প্রশংসা করি সাধু সাধু বলি।মনের মানসে সবে নানাপুষ্প তুলি।।গতায়াতে ভগ্ন হৈল বহু পুস্পবন।দেখিয়া কুপিল যত অনুচরগণ।।ডাকিয়া বলিল শুন মনুষ্য অধম।এতদিনে সবাকারে স্মরিলেক যম।।আরে মন্দমতি এই কুবের আলয়।ঈধৃশ করিলি কাজ, মনে নাহি ভয়।।ইহার উচিত ফল এইক্ষণে দিব।মুহূর্ত্তেকে যমালয়ে সবারে পাঠাব।।এত বলি চতুর্দ্দিকে বেড়ে সর্ব্বজনে।অন্ধকার করিলেক অস্ত্র বরিষণে।।দেখিয়া কুপিল তবে ভীম মহাবল।মুহূর্ত্তেকে নিবারিল রক্ষক সকল।।মারিল কতেক, তাহা কে করে গণনা।প্রাণভয়ে পলাইল শেষ যত জনা।।অতি ত্রাসে ঊর্দ্ধশ্বাসে ধায় অতি বেগে।কান্দিয়া কহিল গিয়া কুবেরের আগে।।অবধান মহারাজ করি নিবেদন।পুষ্পবনে আসিয়াছে নর কতজন।।ভাঙ্গিয়া পুষ্পের বন মারিল রক্ষক।কাহারে না করে ভয় অসীম সাহস।।বলেতে সমান তার নহে কোন জন।বিনয় করিলে তবু না শুনে বচন।।যতেক রক্ষকগণ মারিল সকল।তাহে রক্ষা পাইয়াছি আমরা কেবল।।বিরোধ তাহার সাথে বড়ই সংশয়।বুঝিয়া করহ কর্ম্ম, উচিত যে হয়।।শুনিয়া চরের মুখে এতেক ভারতী।জ্বলন্ত অনল তুল্য কোপে যক্ষপতি।।সাজিল অনেক সৈন্য, চতুরঙ্গ সেনা।যক্ষ রক্ষ পিশাচ গন্ধর্ব্ব অগণনা।।যথায় ধর্ম্মের সুত কুসুম কাননে।উত্তরিল যক্ষপতি অতি ক্রোধমনে।।দেখিয়া জানিল এই রাজা যুধিষ্ঠির।মাদ্রীপুত্র দুই সহ বৃকোদর বীর।।নিকট হইল যবে ধর্ম্ম নরবর।কহিতে লাগিল ক্রোধে গুহ্যক ঈশ্বর।।বড় বংশে জন্ম রাজা, নহ ত অজ্ঞান।কি কারণে কর কর্ম্ম নীচের সমান।।দেবতা ব্রাহ্মণ হেতু ক্ষত্রিয়ের জন্ম।পুনঃ পুনঃ হিংসা কর ত্যজিয়া স্বধর্ম্ম।।ক্ষমায় না কহি কিছু, ধর্ম্মভয় বাসি।পুনঃ পুনঃ ক্ষিপ্ত মত কর্ম্ম কর আসি।।নহি আমি হীনশক্তি, না হই দুর্ব্বল।মুহূর্ত্তেকে দিতে পারি সমুচিত ফল।।এতেক শুনিয়া তবে ধর্ম্মের তনয়।করযোড় করিয়া কহেন সবিনয়।।কৃপার সাগর তুমি, দয়ার নিধান।বিশেষে বালক ভীম, কিবা তার জ্ঞান।।জনক না লয় যথা বালকের দোষ।কৃপা করি দূর কর মনের আক্রোশ।।ইত্যাদি অনেক মতে করিয়া স্তবন।যক্ষরাজে তুষিলেন ধর্ম্মের নন্দন।।তুষ্ট হয়ে বর দিয়া মধুর সম্ভাষে।মনুষ্য বাহনে গেল আপন নিবাসে।।পরম কৌতুকে মনে ধর্ম্ম নরপতি।মনোরম দেখি তথা করেন বসতি।।নানাসুখে মহানন্দে রহে সর্ব্ব জন।অনুক্ষণ ধ্যান অর্জ্জুনের আগমন।।ভারত প্ঙ্কজ রবি মহামুনি ব্যাস।পাঁচালি প্রবন্ধে বিরচিল তাঁর দাস।।৭৪. ইন্দ্রালয়ে অর্জ্জুনেরসপ্ত স্বর্গ দর্শনাথ যাত্রাএদিকে ইন্দ্রের পুরে বীর ধনঞ্জয়।ইন্দ্রের আদরে পান সর্ব্বত্র বিজয়।।নানা বিদ্যা পাইলেন, নাহি পরিমাণ।নৃপে গুণে পরাক্রমে ইন্দ্রের সমান।।দেবতা গন্ধর্ব্ব যক্ষ রক্ষ বিদ্যাধর।আছিল ছত্রিশ কোটি যত পরাৎপর।।শিখাইল অস্ত্র সহ সবে নিজ মায়া।ইন্দ্রের নন্দন জানি সবে করে দয়া।।নৃত্যগীতে বিশারদ ক্ষমী নম্র ধীর।শান্ত মূর্ত্তি সদা সর্ব্বগুণেতে গভীর।।হেনমতে মহাসুখে আছে কুন্তীসুত।দেখিয়া আনন্দযুত দেব পুরুহূত।।তবে ইন্দ্র জানিল অর্জ্জুন পরাক্রম।সুরাসুর নাগ নরে কেহ নহে সম।।নিবাতকবচ দৈত্য কালকেয় আদি।অসাধ্য সাধন যত দেবের বিবাদী।।বিনা পার্থ নাশিবারে নাহি অন্য জন।আনিলাম অর্জ্জুনেরে এই সে কারণ।।প্রাণের অধিক প্রিয় পুত্র ধনঞ্জয়।হেন সঙ্কটেতে পাঠাইতে যোগ্য নয়।।নহিলে না হয় কিন্তু বৈরী নিপাতন।সাক্ষাতে কহিতে লজ্জা করে বিবেচন।।এমন উদ্বেগচিত্ত অমরের পতি।ডাকিয়া আনিল শীঘ্র মাতলি সারথি।।একে একে কহিল যতেক সমাচার।পার্থ বিনা নাহি ইথে করিতে উদ্ধার।।না কহিয়া ধনঞ্জয়ে এই বিবরণ।ছলে পাঠাইব স্বর্গ করতে ভ্রমণ।।সহিত যাইবে তুমি, জানাবে সকল।প্রথমে যাইবে যত দেবতার স্থল।।সপ্ত স্বর্গে বাস করে যত যত জন।দেবতা গুহ্যক সিদ্ধ গন্ধর্ব্ব চারণ।।ক্রমে ক্রমে দেখাইবে সবার আলয়।প্রফুল্ল দেখিবে যবে বীর ধনঞ্জয়।।আমার পরম শত্রু কহিবে অসুর।গতায়াতে পথভ্রমে যাইবে সে পুর।।জানিয়া বিরোধ পার্থ অবশ্য করিবে।অর্জ্জুনের বাণে দুষ্ট সংহার হইবে।।এমত হইলে তবে ঘুচিবে অনর্থ।এইরূপে সাধ কার্য্য না জানিবে পার্থ।।শুনিয়া মাতলি কহে, যে আজ্ঞা তোমার।এরূপ হৈলে হইবে অসুর সংহার।।মাতলিরে বিদায় করিল সুরমণি।কোনমতে গেল দিন, প্রভাত রজনী।।উঠিয়া সানন্দমতি সহস্রলোচন।নিত্য নিয়মিত কর্ম্ম করি সমাপন।।বসিলা সভার মাঝে সহস্রলোচন।মাতলি আসিয়া আগে করে নিবেদন।।হেনকালে উপনীত পার্থ ধনুর্দ্ধর।নিজ পার্শ্বে বসাইল শচীর ঈশ্বর।।প্রশংসা করিয়া অঙ্গে বুলাইল হাত।কহিল পার্থের প্রতি বিবুধের নাথ।।স্বকার্য্য সাধিলা পুত্র আপনার গুণে।অনেক বিলম্ব হৈল সেই সে কারণে।।না দেখি তোমার মুখ ধর্ম্মের তনয়।চিন্তাযুক্ত থাকিবেন, মম মনে লয়।।এখন বিলম্বে আর নাহি কিছু কাজ।ভেটিতে উচিত হয় শীঘ্র ধর্ম্মরাজ।।রথ আরোহণ করি মাতলি সংহতি।স্বর্গের বৈভব দেখি এস শীঘ্রগতি।।আজ্ঞা পেয়ে আনে রথা মাতলি সত্বর।ইন্দ্রেরে প্রণাম করি পার্থ ধনুর্দ্ধর।।সসজ্জ হইয়া ধনুর্ব্বাণ লয়ে হাতে।গোবিন্দ বলিয়া বীর চড়িলেন রথে।।মাতলি চালায় রথ, অতি বিচক্ষণ।পবন অধিক বেগে রথের গমন।।ক্রমে ক্রমে দেখে যত অমর আলয়।নন্দন কাননে যান বীর ধনঞ্জয়।।অতি সে সুন্দর বন মুনি মনোলোভা।প্রফুল্লিত পুষ্পবন মনোহর শোভা।।নিরন্তর মূর্ত্তিমন্ত আছে ছয় ঋতু।মত্ত হয়ে বিহার, করয়ে মৎস্যকেতু।।মধুপানে মদমত্ত ভ্রমর ঝঙ্কার।কোকিলের রব বিনা নাহি শুনি আর।।প্রতি ডালে কলরব করে নানা পক্ষ।মৃগমৃগী মৃগেন্দ্রাদি চরে লক্ষ লক্ষ।।নানা পক্ষী সুশোভিত, রম্য ফুল ফল।মন্দ মন্দ সদা গতি বায়ু সুশীতল।।দেখিয়া বনের শোভা পরম কৌতুকে।দিন কত এই স্থানে রহে হেন সুখে।।তথা হৈতে গেল পার্থ গন্ধর্ব্বের পুরী।দেখিল নিবসে যত কৌতুকে বিহরি।।নৃত্য গীতে আনন্দিত সবাকার মন।সমান বয়স বেশ আছে যত জন।।হেনমতে অপ্সর কিন্নর আদি যত।ভ্রমণ করয়ে পার্থ চালাইয়া রথ।।যথাক্রমে সপ্ত স্বর্গ দেখিয়া সকল।আনন্দে বিহ্বল চিত্ত পার্থ মহাবল।।আপনারে সাধুবাদ করিলেন মনে।ধন্য আমি, এত সব দেখিনু নয়নে।।তবেত মাতলি গেল যমের ভবন।নানা কার্য্য দেখিলেন কুন্তীর নন্দন।।দেখেন ধর্ম্মের সভা, ধর্ম্মের বিচার।পুণ্যবন্ত সুখে আছে, দুঃখে পাপাচার।।পুণ্যবন্ত লোক যত দিব্য সিংহাসনে।করিছে বিবিধ ভোগ আনন্দ বিধানে।।পাপীর কষ্টের কথা কহনে না যায়।প্রহার করিয়া তারে নরকে ডুবায়।।মহাপাপী যতজন পড়িয়া নরকে।কৃমির কামড়ে পাপী পরিত্রাহি ডাকে।।ঘোর অন্ধকার কূপে পাপী মারা যায়।গোময় পোকায় তার মাথা খুলি খায়।।দেখিয়া বিস্ময়াপন্ন পাণ্ডুর নন্দন।মাতলি জানিয়া তবে করিল গমন।।চোরের নিদ্রায় যথা নাহি প্রয়োজন।ইন্দ্রকার্য্যে জাগে তথা মাতলির মন।।সপ্ত স্বর্গে ছিল যত কৌতুক অশেষ।অর্জ্জুনে দেখায়ে যায় দৈত্যগণ দেশ।।মহাভারতের কথা অমৃত সমান।কামীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবাণ।।৭৫. নিবাতকবচ বধইন্দ্র বাক্য ম করি মাতলি সারথি।দৈত্যের দেশেতে তবে যায় দ্রুতগতি।।যাইতে দৈত্যের পুরী দেখি বামভাগে।শীঘ্রগতি রথ তবে চালাইল বেগে।।কালকেয় নিবাতকবচ যেই দেশে।মাতলি চালায় রথ চক্ষুর নিমিষে।।জিনিয়া অমরাবতী পুরীর নির্ম্মাণ।বিস্ময় মানিয়া পার্থ করে অনুমান।।দেবের বসতি নহে মম অগোচর।ভুবন তিনের সার কাহার নগর।।মাতলিবে জিজ্ঞাসেন বীর ধনঞ্জয়।কহ সত্য, জান যদি কাহার আলয়।।সর্ব্বলোক সুখী আছে, নানা পরিচ্ছদ।ইন্দ্রের অধিক দেখি প্রজার সম্পদ।।মাতলি কহেন, পার্থ কর অবধান।নিবাতকবচ নামে, দৈত্যের প্রধান।।দেবের অবধ্য হয় তপস্যার বলে।সমান নাহিক স্বর্গ মর্ত্ত্য রসাতলে।।ইন্দ্রের বিপক্ষ বড়, এই দৈত্যগণ।ইন্দ্রের সমান তেজ সৈন্য পরাক্রম।।মহাবলবন্ত সব নিবাতের দেশে।ইন্দ্রত্ব লইতে পারে চক্ষুর নিমিষে।।এই দুষ্ট দেবেন্দ্রের মহাশত্রু হয়।নিদ্রা নাহি শচীনাথে এই দৈত্য ভয়।।তোমার এ বধ্য বটে জানিয়া বিশেষে।আনিনু তোমারে পার্থ শুন এই দেশে।।মাতলি কহিল যদি এতেক ভারতী।কহিতে আরম্ভ করে পার্থ মহামতি।।পিতার পরম শত্রু এই দুরাচার।কি হেতু বিলম্ব আর করিতে সংহার।।নিশ্চয় পূরাব আজি পিতৃ-মনোরথ।নির্ভয় হইয়া চালাইয়া দেহ রথ।।মাতলি কহিল, রথ চালাইতে নারি।রথী মাত্র একা তুমি, এ কারণে ডরি।।লক্ষ লক্ষ সেনা আছে, বহু যোদ্ধৃবর।একা তুমি কি প্রকারে করিবে সমর।।চল শীঘ্র জানাইব অমরের নাথে।অনুমতি দিলে কত সৈন্য লয়ে সাথে।।পশ্চাৎ করিব যুদ্ধ আসিয়া হেথায়।যে আজ্ঞা তোমার হয়, মনে যেই লয়।।এতেক কহিল যদি সারথি মাতলি।ক্রোধভরে গর্জ্জি উঠি কহে মহাবলী।।একা মোরে দেখি বুঝি ঘৃণা কর মনে।বিরোধ করিবে কেবা বল মম সনে।।সুরাসুর একত্রেতে আসি যদি বাদে।চক্ষুর নিমিষে নিবারিব অপ্রমাদে।।এখনি মারিব যত অমরের বৈরী।না মারিলে বৃথা আমি পার্থ নাম ধরি।।ধনু টঙ্কারিয়া শঙ্খ বাজান সঘনে।রোষে গুণ দেন পার্থ নিজ ধনুর্ব্বাণে।।মহাক্রোধ সিংহনাদ করে মহাবল।দেখি কম্পমান হৈল ত্রৈলোক্য মণ্ডল।।শত বজ্রাঘাত জিনি বিপরীত শব্দ।শুনিয়া দৈত্যের পতি হৈল মহাস্তব্ধ।।কালকেয় নিবাতকবচ বীর আদি।ক্রোধভরে ধায় যত অমর বিবাদী।।সসজ্জ হইয়া যত অস্ত্র লয়ে হাতে।আরোহণ করি সবে অশ্ব গজ রথে।।বিবিধ বাদ্যের শব্দ সৈন্য কোলাহলে।ভেটিল আসিয়া সবে পার্থ মহাবলে।।মাতলি সারথি রথে, ইন্দ্রতুল্য রূপ।দেখিয়া জানিল সবে অমরের ভূপ।।চতুর্দ্দিকে বেড়ি সবে করে অস্ত্রবৃষ্টি।প্রলয় কালেতে যেন মজাইতে সৃষ্টি।।না হয় নিমেষ পূর্ণ ছাড়িতে নিশ্বাস।শরজাল করিয়া পূরিল দিশপাশ।।দিবা দ্বিপ্রহরে হৈল ঘোর অন্ধকার।অন্যের থাকুক নাহি পবন সঞ্চার।।অগ্নি অস্ত্র এড়িলেন পার্থ মহাবল।মুহূর্ত্তেকে শরজালে পূরিল সকল।।মেঘ হৈতে মুক্ত যেন হইল মিহির।প্রকাশ পাইল তথা পার্থ মহাবীর।।মেঘ অস্ত্র পার্থ করিলেন বরিষণ।বায়ু অস্ত্রে দৈত্যবর করে নিবারণ।।এড়িল পর্ব্বত অস্ত্র দৈত্যের ঈশ্বর।অর্দ্ধচন্দ্র বাণে কাটে পার্থ ধনুর্দ্ধর।।তবে দৈত্য ধনঞ্জয়ে মারে দশ বাণ।বাজিল পার্থের বুকে বজ্রের সমান।।মহাঘাতে পার্থ হৈয়া ব্যথায় ব্যথিত।মুহূর্ত্তেকে উঠিলেন গর্জ্জি সিংহমত।।ধনুকে টঙ্কার দিয়া ক্রোধের আবেশে।সহস্র তোমর এড়ে দৈত্যের উদ্দেশে।।গর্জ্জিয়া উঠিল বাণ গগণ মণ্ডলে।প্রাণভয়ে দৈত্যগণ পলায় সকলে।।সৈন্য ভঙ্গ দেখি ক্রুদ্ধ দৈত্যের ঈশ্বর।ঐষিক বাণেতে কাটে সহস্র তোমর।।বাণ ব্যর্থ দেখি পার্থ দুঃখিত অন্তরে।দিব্য ভল্ল মারিলেন দৈত্যের উপরে।।বাণাঘাতে মুর্চ্ছাগত হৈল দৈত্যপতি।রথ চালাইয়া বেগে পলায় সারথি।।পরে দৈত্যপতি জ্ঞান পায় কতক্ষণে।কালকেয়গণ আসি বেড়িল অর্জ্জুনে।।মহাবল মহাশিক্ষা যত বীরবর।প্রাণপণে করে যুদ্ধ পার্থ একেশ্বর।।মানুষী রাক্ষসী দৈবী গান্ধর্ব্বী পিশাচী।দ্রোণ স্থানে যত অস্ত্র পায় সব্যসাচী।।প্রহর পর্য্যন্ত যুঝি পার্থ মহাবল।রুধির সহিত অঙ্গে বহে ঘর্ম্মজল।।দেখিয়া আনন্দমতি দৈত্যের ঈশ্বর।উপায় না দেখি পার্থ হলেন ফাঁফর।।মনে ভাবে পরম সঙ্কট আজি হৈল।মাতলি এতেক দেখি কহিতে লাগিল।।নিশ্চয় জানিনু পার্থ হৈলে জ্ঞান হত।প্রাণপণে দেখাইলে নিজ শক্তি যত।।তথাপি দুরন্ত দৈত্য না হৈল সংহার।বিনা ব্রক্ষঅস্ত্র ইথে নাহি প্রতিকার।।পাশুপত অস্ত্র আছে পশুপতি দান।এড়িলে ভুবন যার পতঙ্গ সমান।।সে হেন আছয়ে তব মহারত্ননিধি।এমত সংযোগে তারে নিয়োজিল বিধি।।এই সে আশ্চর্য্য বড় লাগে মম মনে।এ সময়ে সেই অস্ত্র নাহি ছাড় কেনে।।শুনি বীর পাশুপত নিলেন তৎক্ষণে।মন্ত্র পড়ি যুড়িলেন ধনুকের গুণে।।কোটি সূর্য্য জিনি অস্ত্র হৈল তেজোময়।থাকুক অন্যের কার্য্য দেবতা সভয়।।অস্ত্র অবতারকালে ত্রিবিধ উৎপাত।নির্ঘাত উল্কা সদা বহে তপ্তবাত।।প্রলয় জানিয়া সবে স্বর্গের নিবাসী।রহিল অস্ত্রের মুখে দৃষ্টি অভিলাষী।।অস্ত্রমুখে যেই হৈল হুতাশন বৃষ্টি।দহন করিল তাতে অসুরের সৃষ্টি।।জ্বলন্ত অনলে যেন শিমূলের তূলা।তাদৃশ হইল ভস্ম দুষ্ট দৈত্যগুলা।।অস্ত্রজাত অনলের প্রচণ্ড বাতাসে।জীব জন্তু না রহিল দানবের দেশে।।হেনকালে শূন্যবাণী শুনি এই রব।সম্বর সম্বর পার্থ মজিল যে সব।।ভাল হৈল, দুষ্ট দৈত্য হইল নিধন।মনুষ্যেরে ত্যাগ ইহা না কর কখন।।সংহার কারণ সৃষ্টি বিধির সৃজন।বিনাশ করিতে ইহা ধরে ত্রিলোচন।।যাবৎ না দহে ক্ষিতি অস্ত্রের আগুনে।মন্ত্রবলে সম্বরিয়া রাখ নিজ তূণে।।পুনঃ পুনঃ এইমত হৈল শূন্যবাণী।আনন্দে বিহ্বল পার্থ ইষ্টসিদ্ধি জানি।।মন্ত্রবলে অস্ত্র সম্বরেন বীরবর।আশীর্ব্বাদ করি সবে গেল নিজ ঘর।।মহাভারতের কথা অমৃত সমান।কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon