০৭. দধীচির অস্থিতে বজ্র নির্ম্মাণগোবিন্দ কহেন শুন সকল দেবতা।খন্ডিরে সকল দুঃখ দূর হবে ব্যথা।।আমার অবধ্য বৃত্র শুন দেবগণ।আমার পরম ভক্ত শুনহ বচন।।দধীচি মুনির অস্থি আন সর্ব্বজন।তাহাতে করহ অস্ত্র বজ্র সুগঠন।।সেই অস্ত্রে বৃত্রাসুর হইবে নিধন।এই তার বধোপায় আছে নিরূপণ।।শুনি ইন্দ্র কহিতে লাগিল যুড়ি কর।দধীচি ছাড়িবে কেন নিজ কলেবর।।অনেক পুন্যেতে হয় মনুষ্যের কায়।নিজ কায় কেমনে ছাড়িবে মুনিরায়।।তাহাতে ব্রাক্ষ্মণ অঙ্গ শ্রেষ্ঠতম গণি।ব্রাক্ষ্মণ শরীর হৈলে মুক্ত হয় প্রাণী।।চৌরাশী সহস্র যোনি ভ্রমণ করিয়।পশ্চাৎ ব্রাক্ষ্মণ জন্ম লভয়ে আসিয়।।কর্ম্মক্রমে পারে যদি সাবধান হতে।দুই জন্মে মুক্ত হয় কহি বেদমতে।।কহ প্রভু ইহার বিধান অনুসারে।কোনমতে নিধন করিল বৃত্রাসুরে।।গোবিন্দ কহেন শুন সকল দেবতা।দধীচির পূর্ব্বেকার কহি এক কথা।।পরম দয়ালু মুনি উপকারে রত।পর উপকারে প্রাণ ত্যজে অতি দ্রুত।।স্বর্গ বৈদ্য অশ্বিনীকুমার দুই জন।উপাসনা হেতু গেল দধীচি সদন।।অনেক বিনয়ে স্তব কৈল মুনিবরে।সদয় হইয়া মুনি জিজ্ঞাসে দোঁহারে।।কি হেতু আইলে দোঁহে আমার সদন।কি কার্য্য সাধিব শীঘ্র কহ দুই জন।।আপনার প্রাণ দিলে যদি কার্য্য হয়।অবশ্য কর্ত্তব্য এই কহিনু নিশ্চয়।।অশ্বিনীকুমার বলে শুন মুনিবর।তোমার হইব শিষ্য দুই সহোদর।।শুনিয়া কহেন মুনি করিব অবশ্য।উপদেশ দিয়া দোঁহা করি লব শিষ্য।।অঙ্গীকার করি আমি নাহিক সংশয়।আজি দিন ভাল নহে যাহ নিজ গৃহ।।এই বাক্য শুনি দোঁহে প্রণাম করিয়া।আপন ভবনে গেল বিদায় হইয়া।।এ কথা শুনিয়া ইন্দ্র নারদের স্থানে।তখনি গেলেন দধীচির সন্নিধানে।।ইন্দ্রেরে দেখিয়া মুনি করিল আদর।পাদ্য অর্ঘ্য আসনেতে পূজিল বিস্তর।।সন্তুষ্ট হইয়া ইন্দ্র বসেন আসনে।দধীচি জিজ্ঞাসে তারে মধুর বচনে।।কিবা হেতু আগমন হৈল সুরেশ্বর।কি কার্য্য সাধিব আজ্ঞা করহ সত্বর।।পুরন্দর কহে শুন মুনি মহাশয়।হেয়ায় আসিয়াছিল অশ্বিনীতনয়।।শুনিলাম আপনি করাবে উপাসনা।এই হেতু আইলাম করিতে যে মানা।।তবে যদি তাহারে করিবে তুমি শিষ্য।তোমার মস্তক আমি কাটিব অবশ্য।।ইন্দ্রের শুনিয়া কথা কহে মুনিবর।শিক্ষা নাহি দিব বিদ্যা জেনো পুরন্দর।।এত শুনি বিদায় হইল সুরপতি।জিজ্ঞাসেন জন্মেজয় মুনিবর প্রতি।।ইহার কারণ মুনি বলহ আমারে।ইন্দ্র কেন নিষেধ করিল দধীচিরে।।কোন শাস্ত্রে বড় ইন্দ্র অশ্বিনীকুমারে।বিশেষ করিয়া মুনি কহিবা আমারে।।মুনি বলে শুন পরীক্ষিতের নন্দন।যে হেতু নিষেধ করে সহস্রলোচন।।ইন্দ্র-উপাসিতা যেই বিদ্যা সারাৎসার।মুনিরে মাগিল তাহা অশ্বিনীকুমার।।যেই বিদ্যা প্রভাবে বাসব স্বর্গপতি।গ্রহণ করিবে মম বিদ্যা মূঢ়মতি।।সে বিদ্যা গ্রহণে হবে সমান আমার।মন্ত্রবলে নিতে পারে মম অধিকার।।এতেক ভাবিয়া ইন্দ্র করিল নিষেধ।শুন রাজা পূর্ব্বকার বৃত্তান্ত বিভেদ।।শুনিয়া সে জন্মেজয় হৈল হৃষ্টমন।হরি পুনঃ কি কহেন কহ তপোধন।।বিদায় হইয়া যদি আখন্ডল গেল।দোঁহে মুনি সন্নিধানে প্রভাতে আইল।।মুনিবরে প্রণমিয়া দুই সহোদর।নিকটে বসিল দোঁহে হরিষ অন্তর।।কথোপকথন বহু হৈল মুনি সনে।ইন্দ্রের সংবাদ মুনি কহে দুইজনে।।উপদেশ তোমায় করাই যদি আমি।মম শিরশ্ছেদন করিবে সুরস্বামী।।তোমা দোঁহে মন্ত্র দিয়া হারাইব প্রাণ।বুঝি দুইজনে ইহা কর সমাধান।।অশ্বিনীকুমার বলে শুন মহাশয়।এই বাক্যে কদাচিত না করিহ ভয়।।অনেক ঔষধ মোরা জানি মুনিবর।ক্ষণে জিয়াইতে পারি মৃত কলেবর।।স্বর্গ বৈদ্য অশ্বিনীকুমার দুই ভাই।যতেক ঔষধি কিছু অগোচর নাই।।প্রতিজ্ঞা করিল ইন্দ্র কাটিবে তোমায়।মম এক নিবেদন শুন মহাশয়।।কাটিয়া তোমার মুন্ড রাখি গুপ্তস্থানে।গুপ্ত মুন্ড কথা যেন ইন্দ্র নাহি জানে।।অশ্বমুন্ড তব স্কন্ধে করিয়া যোজন।সেই মুন্ডে মন্ত্র মোরা লব দুইজন।।মন্ত্র দিলে দেবরাজ কুপিত হইয়া।তোমার অশ্বের মুন্ড যাবেক কাটিয়া।।তোমার স্বকীয় মুন্ড মোরা দুইজন।পুনরপি তব স্কন্ধে করিব যোজন।।শুনিয়া দধীচি মুনি করিল স্বীকার।মুনি শির কাটিলেন অশ্বিনীকুমার।।অশ্বমুন্ড যোড়া দিল মুনিবর স্কন্ধে।পরাণ পাইল মুনি নাহি কোন সন্ধে।।বিদায় লইয়া দোঁহে গেল নিকেতন।নারদ জানিয়া গেল সব বিবরণ।।সকল সংবাদ কহিলেন পুরন্দরে।খড়গ হাতে করি ইন্দ্র যায় ক্রোধ ভরে।।যোগে যথা আছে বসি সে দধীচি মুনি।তথা গিয়া উপনীত হৈল বজ্রপাণি।।দেখিল ধেয়ানে মুনি আছয়ে বসিয়া।মুনির অশ্বের মুন্ড ফেলিল কাটিয়া।।অশ্বমুন্ড লইয়া ইন্দ্র করিল গমন।দধীচি মুনির স্কন্ধ আছয়ে তেমন।।অশ্বিনীকুমার চর ছিল সেইখানে।দ্রুতগতি বার্ত্তা দিল ভাই দুইজনে।।অশ্বিনীকুমার তথা গেল শীঘ্রতর।মুনিমুন্ড যুড়িলেক স্কন্ধের উপর।ঔষধ পরশে মুনি পাইল পরাণ।।অশ্বিনীকুমারে বহু করিল বাখান।শুন সবে দধীচি মুনির আদ্যন্তর।।পরকার্য্যে দিল মুনি নিজ কলেবর।সকলে চলিয়া যাহ দধীচির স্থান।।দেবের কারণে মুনি ছাড়িবে পরাণ।এতেক কহেন যদি দেব নারায়ণ।।বিদায় হইল তবে যত দেবগণ।প্রণাম করিয়া সবে চলিল সত্বরে।।সঙ্গেতে করিয়া নিল অশ্বিনীকুমারে।উপনীত হৈল যথা মুনি মহাশয়।।প্রণাম করিল গিয়া দেবতা নিচয়।পাদ্য অর্ঘ্য দিয়া মুনি পূজিল সবারে।।বসিল সকল দেব আসন উপরে।জিজ্ঞাসিল মুনিবর গমন কারণ।।কহিতে লাগিল তবে সহস্রলোচন।অবধান কর মুনি তপের গোঁসাই।।নিজ নিবেদন কথা কহিতে ডরাই।বৃত্রাসুর হইল ত্রিদিব অধিকারী। ।নারায়ণ স্থানে সবে করিণু গোহারী।কহিলেন কৃষ্ণ বৃত্র বধের কারণ।।সকল দেবতা যাহ দধীচি সদন।দেব উপকার হেতু মুনির কুমার।।দয়া করি ছাড়িবেন প্রাণ আপনার।তাঁর অস্থি লয়ে অস্ত্র কর আখন্ডল।বজ্রাঘাতে মারহ দানব মহাবল।।শুন মুনি রক্ষা হয় না হয় অন্যথা।আপনার প্রাণযদি ছাড়হ সর্ব্বথা।।মুনি বলে হেন বাক্য নাহি শুনি কাণে।পরের লাগিয়া কেহ ছাড়ে নিজ প্রাণে।।অনেক পুন্যেতে প্রাণী নরযোনি পায়।কেমনে ছাড়িতে তাহা বল দেবরায়।।দুর্ল্লভ জনম এই মনুষ্য উত্তম।আর যত দেহ দেখ সকলি অধম।।শূকর জনম হৈয়া বিষ্ঠা মূত্র খায়।শরীর ছাড়িতে তার মনে ব্যথা পায়।।মারিতে উদ্যত যদি কেহ করে তায়।শরীর মমতা হেতু সঘনে পলায়।।কাক গৃধ্র শিবা শ্বান খেচর গর্দ্দভ।পিপীলিকা সর্প ভেক দেখ যত সব।।অধম যোনীর মধ্যে যেই প্রাণ ধরে।ইচ্ছাবশে কোন জন ছাড়ে কলেবরে।।বিশেষ ব্রাক্ষ্মণদেহ হয়েছে আমার।বহু পুন্যে দ্বিজতনু পাইনু এবার।।সকল প্রাণীতে জ্ঞান আছয়ে নিশ্চয়।আহার মৈথুন নিদ্রা আর আছে ভয়।।মনুষ্য সমান জ্ঞানী নাহি কোন জন।এ দেহে অনেক কর্ম্ম ভজন সাধন।।হেন দেহ ছাড়িবার কহ দেবরাজ।আমি যদি মরি তবে সিদ্ধ হবে কার্য।।না হইল তব কার্য্য মম কিবা দায়।না বুঝি আদেশ কেন কর দেবরায়।।না ছাড়িব প্রাণ আমি শুনহ বিচার।শুনিয়া সবার মনে লাগে চমৎকার।।ইন্দ্র আদি দেবগণ অধোমুখ হৈয়া।ক্ষিতি পরে সর্ব্বজন মৌনেতে বসিয়া।।ত্রাসে কারো মুখে নাহি বচন নিঃসরে।সদয় হৃদয় মুনি জানিল অন্তরে।।কহিতে লাগিল মুনি করুণা বচন।ভয় ত্যজ কহি শুন সর্ব্ব দেবগণ।।আমি মলে রক্ষা পায় দেবতা সমাজ।এ ছার শরীরে তবে কিবা আর কাজ।।অবশ্য মরিব আমি দেবের কারণ।মম অস্থি লয়ে ইন্দ্র সাধ প্রয়োজন।।পৃথিবীতে যত যত করিলাম পুণ্য।আমার সার্থক জন্ম হল ধন্য ধন্য।।আশ্বাস পাইয়া ইন্দ্র কহে যুড়ি কর।কত কল্প অমর হইলে মুনিবর।।তোমার অস্থিতে হবে অস্ত্র বলবান।এ তোমার মৃত্যু নহে জীবন সমান।।এতেক শুনিয়া মুনি করিল স্বীকার।যোগাসনে বসি প্রাণ ত্যজে আপনার।।ইন্দ্রাদি দেবতাগণ হন হরষিত।পুষ্পবৃষ্টি মুনি পরে করে অপ্রমিত।।নাচিতে লাগিল দেবগণ ঊর্দ্ধবাহু।কার্য্যসিদ্ধি করিয়া আনন্দ করে বহু।।শঙ্খ ভেরি আদি বাজয়ে বিশাল।বীণা ডম্ফ ঘন বাজে ফুকারে কহাল।।মধুর সুনাদ বাঁশী বাজে শত শত।উৎসব করয়ে আসি অপ্সরাদি যত।।মেনকা উর্ব্বশী আর রম্ভা তিলোত্তমা।জানপদী সহজন্যা রূপে অনুপমা।।নানারঙ্গে নৃত্য করে যত বারাঙ্গনা।গন্ধর্ব্ব কিন্নর গায় হরষিত মনা।।মহা মহোৎসব হৈল না পারি বর্ণিতে।ডাক দিয়া দেবরাজ লাগিল কহিতে।।হরিষ বিধানে কহে দেব আখন্ডল।আজি হৈতে পুণ্য তীর্থ হইল এ স্থল।।দধীচির তীর্থ নাম করি নিরূপণ।আমার ভারতী এই শুন দেবগণ।।অনন্ত জন্মের পাপ খন্ডিবে ইহাতে।স্নানদান করে যেই দধীচি তীর্থেতে।।তথাস্তু বলিয়া চলিলেন দেবগণ।দধীচির অস্থি লয়ে সহস্রলোচন।।ডাকি বিশ্বকর্ম্মারে কহেন শীঘ্রগতি।বজ্র নির্ম্মাইয়া মোরে দেহ মহামতি।।আজ্ঞা মাত্র বির্ম্মকর্ম্মা বজ্র নিরমিল।সকল অস্ত্রের তেজ তাহে সমর্পিল।।ব্রক্ষ্মর নিকটে লয়ে গেলেন মঘবা।প্রণাম করিল ইন্দ্র হয়ে নতগ্রীবা।।বজ্র দেখি হরষিত হয়ে পদ্মযোনি।ব্রক্ষ্মমন্ত্রে অভিষেক করেন তখনি।।জীবন্যাস দিয়া ইন্দ্রে বলেন বচন।এই অস্ত্র লয়ে কর দানব মর্দ্দন।।ইন্দ্র বজ্র পাইয়া হইয়া আনন্দিত।ব্রহ্মারে প্রণাম করি চলেন ত্বরিত।।দেবসৈন্য সমস্ত করিয়া সমাবেশ।নিজরাজ্য প্রাপ্তি হেতু উদযোগী সুরেশ।।যুঝিতে চলিল বৃত্রাসুরের সংহতি।ইন্দ্রের নিনাদ পাইলেক দৈত্যপতি।।নিজ সৈন্যে সাজিয়া চলিল দৈত্যেশ্বর।দুইদলে মহাযুদ্ধে হয় ঘোরতর।।রথী রথী মহাযুদ্ধ হৈল বাণে বাণে।পদাতি পদাতি যুদ্ধ হইল সঘনে।।ঘোড়ায় ঘোড়ায় যুদ্ধ হৈল মহামার।বাণে বাণে গগনে হইল অন্ধকার।।অনল বায়ব্য বাণ দোঁহে এড়ে রণে।দুইবাণ নষ্ট হয় দোঁহাকার বাণে।।মুখ মেলি দৈত্য ইন্দ্রে গিলিবারে যায়।দেখিয়া বৃত্রের বল বাসব পলায়।।ইন্দ্র পলাইল দূরে লয়ে সব দেবে।বিষ্ণুর শরণ লইলেন গিয়া সবে।।যুদ্ধ সমাচার কহে দেব নারায়ণে।বিষ্ণু বলিলেন ইন্দ্র শুন সাবধানে।।বিষ্ণু তেজ নাহি কিছু তোমার শরীরে।এই মম তেজ ধর দ্বিলাম তোমারে।।বিষ্ণুতেজ পাইয়া হইয়া বলবান।পুনঃ যুদ্ধ করিবারে গেল মরুত্বান।।মহাযুদ্ধ সুরাসুরে হয় ঘোরতর।পড়িল অনেক সৈন্য সংগ্রাম ভিতর।।যুদ্ধকালে বৃত্রাসুর ইন্দ্রে বলে বাণী।আমারে করহ বধ বাসব আপনি।।ধর্ম্মপরায়ণ বৃত্র পরম বৈষ্ণব।নারারূপ বৃত্রাসুর শক্রে করে স্তব।।সুরপতি বলে বৃত্র তুমি বলবান।তোমাকে ক্ষমিয়া আমি সন্বরিনু বাণ।।বৃত্র বলে কার্যসিদ্ধি নহিল আমার।ইন্দ্র মোরে ক্ষমিয়া করিলা পরিহার।।শুন মূর্খ রণে পড়ি যাব স্বর্গলোক।এ কর্ম্ম না করি আমি বৃথা করি শোক।।এত বলি বৃত্রাসুর ইন্দ্রে দেয় গালি।শুন রে পামর ইন্দ্র তোর প্রতি বলি।।গুরুদারা হরিলি করিলি মহাপাপ।তোরে মারি গৌতমের খন্ডাইব তাপ।।এতেক কুবাক্য বৃত্র বাসবেরে বলে।শুনি সুরপতি ক্রোধে অগ্নি হেন জ্বলে।।কুলিশ ধরিয়া ইন্দ্র মারিলেন তোরে।চূর্ণ হৈল বৃত্রাসুর কুলিশ প্রহারে।।অপর সকল দৈত্য পলাইল রণে।ইন্দ্র পুনঃ রাজা হৈল অমর ভুবনে।।যার যেই কার্য্য সেই লভিলসত্বর।সকল অমর হৈল সুস্থির অন্তর।।শুনহ ভূপতি কুরুবংশ চূড়ামণি।কহিলাম দধীচির তীর্থের কাহিনী।।সেই তীর্থে বলরাম হৈয়া উপনীত।স্নানদান যজ্ঞ করিলেন নিয়মিত।।মহাভারতের কথা সমান শীযূষ।যাহার শ্রবণে নর হয় নিষ্কলুষ।।০৮. শাণ্ডিল্যাশ্রমে নারদ বলরামের সংবাদজিজ্ঞাসেন জন্মেজয় শুন মুনিবর।পুনঃ কোন তীর্থে চলিলেন হলধর।।বলেন বৈশম্পায়ন শুনহ রাজন।হইয়া একাগ্র মন করহ শ্রবণ।।পৃথিবীর যত তীর্থ ভ্রমণ করিয়া।শাণ্ডিল্য আশ্রমে রাম উত্তরিল গিয়।।শাণ্ডিল্য আশ্রমে সেই যমুনার তীরে।তথায় দেখেন রাম নারদ মুনিরে।।তথা স্নানদান করি মনের হরিষে।ব্রাক্ষ্মণ ভোজন আদি করান বিশেষে।।নারদ সহিত তথা হইল দর্শন।বলদেব মুনিবর কহেন বচন।।তীর্থযাত্রা হেতু তুমি গেলে দেশান্তর।কৌরব পাণ্ডব যুদ্ধ হৈল ঘোরতর।।একাদশ অক্ষৌহিণী দুর্য্যোধন সেনা।মরিল নৃপতি বহু কে করে গণনা।।সপ্ত অক্ষৌহিণী পতি রাজা যুধিষ্ঠির।তাহার সহায় হৈল মহা মহা বীর।।আপনি হইলা কৃষ্ণ অর্জ্জুন সারথি।সেই যুদ্ধে নষ্ট হয় সকল নৃপতি।।ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ আদি পড়িল সমরে।আর তব ভাগিনেয় অভিমন্যু মরে।।দুর্য্যোধন একামাত্র কৃপ অশ্বন্থামা।অবশেষে এই মাত্র কহিলাম সীমা।।পঞ্চভাই পাণ্ডব দ্রৌপদী পঞ্চসুত।অবশেষে আর কিছু নাহিক প্রস্তুত।।হত সৈন্য দেখি পলাইল দুর্য্যোধন।দ্বৈপায়ন হ্রদ মধ্যে পশিল রাজন।।তথাপি কৃষ্ণের মনে দয়া না হইল।হ্রদ হৈতে রাজা দুর্য্যোধনে উঠাইল।।ভীম দুর্য্যোধনে হবে গদার সমর।দেখিতে বাসনা যদি থাকে হলধর।।এই ক্ষণে সেই স্থানে করহ গমন।বাঁচাইতে পার যদি রাজা দুর্য্যোধন।।শুনিয়া নারদ বাক্য দেব বলরাম।তথায় গেলেন দ্রুত না করি বিশ্রাম।।হইলেন দ্বৈপায়ন হ্রদে উপনীত।দেখিয়া গোবিন্দ উঠিলেন ত্বরান্বিত।।যুধিষ্ঠির আদি পঞ্চ পাণ্ডুর নন্দন।সম্ভ্রমে করিল সবে চরণ বন্দন।।গোবিন্দেরে আলিঙ্গন বলরাম দেন।কৃষ্ণ বলরাম শোভা দেখি অনুপম।।প্রেম-অশ্রুজলে দোঁহে করিলেন স্নান।প্রীতি বাক্যে জিজ্ঞাসেন সবার কল্যাণ।।যুধিষ্ঠির পঞ্চজনে করি আশীর্ব্বাদ।শুভ জিজ্ঞাসেন রাম হরিষ বিষাদ।।গোবিন্দ কহেন রাম শুন জগন্নাথ।পৃথিবীর রাজগণে করিল নিপাত।।যতেক নৃপতিগণ হইল সংহার।উদ্ধারিতে ক্ষিতি ভার তব অবতার।।উত্তম করিলে ভাই ইথে নাহি দোষ।এই কর্ম্মে সবাকার হইল সন্তোষ।।রামের বচন শুনি কৃষ্ণ মহাশয়।নিবেদিতে সব কথা করে অভিপ্রায়।।হেনকালে দুর্য্যোধন কাঁন্দিতে কাঁন্দিতে।প্রণাম করিল রামে ব্যাকুল চিত্তেতে।।দুর্য্যোধনে কোলে নিয়া বহে নেত্রজল।বলরাম জিজ্ঞাসেন তাহার কুশল।।কহিলেন সর্ব্ব কথা কুরু নৃপমণি।শুনিয়া ভৎসেন কৃষ্ণে দেব হলপাণি।।তুমি বিদ্যমানে উহা শোভা নাহি পায়।সামঞ্জস্য কেন নাহি করিলে দোঁহার।।জগন্নাথ কহিলা করিয়া যোড়হাত।নিবেদন করি শুন রেবতীর নাথ।।শিশুকালে পাণ্ডব যে কৈল দুরাচার।সকল আছয়ে দেব গোচর তোমার।।ত্রয়োদশ বৎসর তুমি নাহি ছিলে দেশে।।যতেক করিল দুষ্ট শুন সবিশেষে।কপটে খেলিয়া পাশা নিল রাজ্যধন।।কপট পাশাতে কৈল দ্রৌপদীকে পণ।শকুনির বশেতে আছিল পাশাসারি।হারিলেন যুধিষ্ঠির রাজা নিজ নারী।।দুঃশাসন দ্রৌপদীকে আনে সভামাঝ।তাহাকে আদেশ কৈল দুর্য্যোধন রাজ।।দ্রৌপদী হইল দাসী নাহিক বিচার।শীঘ্রগতি আনহ বসন অলঙ্কার।।সভামাঝে দ্রৌপদীর বস্ত্র কাড়ি লয়।কুলবধূ জনে কি এমন উচিত হয়।।তবে অন্ধ বর দিয়া কৈল পরিত্রাণ।পুনঃ পাশা খেলিবারে করিল বিধান।।যে হারিবে দ্বাদশ বৎসর যাবে বন।অজ্ঞাত বৎসর এক কৈল নিরূপণ।।আজ্ঞাকারী পাশা যেই ছিল শকুনির।সেই পণে হারিলেন রাজা যুধিষ্ঠির।।দ্বাদশ বৎসর বনে ভ্রমিয়া পাণ্ডব।যত দুঃখ পায় বনে কি বলিব সব।।বঞ্চিলেন অজ্ঞাত বৎসর মৎস্যদেশে।অজ্ঞাতে উদ্ধার হৈল উপায় বিশেষে।।যুধিষ্ঠির চাহিলেন স্বীয় রাজ্যভার।কদাচিত রাজ্য নাহি দিল দুরাচার।।দূত হয়ে যাইলাম যথা দুর্য্যোধন।আমারে রাখিতে চাহে করিয়া বন্ধন।।কটুবাক্য আমারে কহিল দুর্য্যোধন।বিনা যুদ্ধে রাজ্য নাহি দিব কদাচন।।তবে সে হইল নাথ যুদ্ধ সমাবেশ।যুদ্ধে রাজগণ সব হইল নিঃশেষ।।মম অপরাধ এতে কি হৈল গোঁসাই।দুর্য্যোধন তুল্য দুষ্ট পৃথিবীতে নাই।।উহাকে করহ শান্ত রেবতীরমণ।তব প্রিয় শিষ্য বটে রাজা দুর্য্যোধন।।যুধিষ্ঠির এক্ষণে চাহেন পঞ্চগ্রাম।সামঞ্জস্য করিয়া আপনি দেহ রাম।।তব আজ্ঞা যুধিষ্ঠির না করে লঙ্ঘন।উহাকে করিয়া দ্বন্দ্ব কর নিবারণ।।সকল গিয়াছে একা আছে দুর্য্যোধন।তবু পঞ্চগ্রাম মাগে ধর্ম্মের নন্দন।।শুনিয়া কৃষ্ণের বাণী রোহিণী নন্দন।দুর্য্যোধন প্রতি কিছু বলিল বচন।।শুন ভাই দুর্য্যোধন মম হিত কথা।যুদ্ধ না করিবা তুমি শুনহ সর্ব্বথা।।সর্ব্ব সৃষ্টিনাশ হৈল আর নাহি কেহ।যুদ্ধে কিছু কার্য্য নাহি চিত্তে ক্ষমা দেহ।।হৃদ্যতা করাই তোমা পাণ্ডব সহিতে।অর্দ্ধ রাজ্য দেহ তুমি পাণ্ডব সম্প্রীতে।।এতেক কহিল যদি দেব হলধর।কতক্ষণে দুর্য্যোধন করিল উত্তর।।মোরে আর হিতবাণী না বল গোঁসাই।পান্ডবের সহ আর মম প্রীতি নাই।।যত দুঃখ দিলাম পাণ্ডব পুত্রগণে।ভগ্ন স্নেহে প্রীতি আর হইবে কেমনে।।সর্ব্বদুঃখ পাণ্ডব পারিবে পাসরিতে।অভিমন্যু শোক না ভুলিবে কদাচিতে।।সপ্তরথী একত্র হইয়া আসি রণে।মারিনু অন্যায় যুদ্ধে শুভদ্রা নন্দনে।।এবে মম রাজ্যভার নাহি কিছু মনে।সৌহৃদ্য করিতে কেন বল অকারণে।।পূর্ব্বে পণ করিয়াছি সভার ভিতরে।বিনা যুদ্ধে রাজ্য নাহি দিব পান্ডবেরে।।সূচী অগ্রে যতখানি উঠিবেক ভূমি।বিনা যুদ্ধে ততখানি নাহি দিব আমি।।সমরে আমারে ভীম করিবে সংহার।যুধিষ্ঠির পাইবেন সব রাজ্যভার।।সবার ঈশ্বর হয়ে ভূঞ্জিলাম ক্ষিতি।যুদ্ধে মরি স্বর্গে গিয়া করিব বসতি।।রাজত্ব আমাকে আর নাহি শোভা পায়।যুদ্ধে মম প্রাণ পণ করেছি নিশ্চয়।।এত যদি দুর্য্যোধন কহিলা ভারতী।তাহারে কহিলা তবে রেবতীর পতি।।যাহা ইচ্ছা মনে হয় তাহা কর তুমি।যুদ্ধ কর দোঁহে দ্বারাবতী যাই আমি।।গোবিন্দ বলিলা দেব শুনিলা আপনি।পান্ডবের অপরাধ শুনিলে এখনি।।এইক্ষণে দ্বারকা গমন যুক্তি নয়।দোঁহাকার গদাযুদ্ধ দেখ মহাশয়।।বলরাম কহিলেন শুন দামোদর।দেখিতে হইল তবে গদার সমর।।যুধিষ্ঠির চাহি বলিলেন বলরাম।এ ভূমিতে না করাও দোঁহার সংগ্রাম।।সমন্তপঞ্চক নাম কুরুক্ষেত্র জানি।শুনিয়াছি মুনিগণ বদনে কাহিনী।।সেই স্থানে হয় যার সমরে বিনাশ।চিরকাল হয় তার স্বর্গেতে নিবাস।।হ্রদতীর নহে শুন সংগ্রামের স্থান।এই মত ধর্ম্মেরে কহিলা ভগবান।।সাধুবাদ করিলা সকলে হলধরে।তখনি গেলেন কুরুক্ষেত্র তীর্থবরে।।সমর আরম্ভ হৈল ভীম দুর্য্যোধনে।বসিল সকল লোক যথাযোগ্য স্থানে।।মহাভারতের কথা সমান পীযূষ।যাহার শ্রবণে নর হয় নীষ্কলুষ।।০৯. কুরুক্ষেত্রের বিবরণজিজ্ঞাসিল মুনিবরে রাজা জন্মেজয়।কুরুক্ষেত্র মহিমা বলহ মহাশয়।।পুণ্যক্ষেত্র কেমনে হইল সেই স্থান।আমাকে বলহ মুনি করিয়া ব্যাখ্যান।।মুনি বলে শুন পরীক্ষিতের নন্দন।তোমাকে জানাব কুরুক্ষেত্র বিবরণ।।তব পূর্ব্বপুরুষ ছিলেন কুরুরাজা।পুত্রবৎ করিয়া পালিত সব প্রজা।।প্রতাপে ছিলেন রাজা মহাধনুর্দ্ধর।সসাগরা পৃথিবীর হইল ঈশ্বর।।বিপক্ষ দলন মহারাজ চক্রবর্ত্তী।পৃথিবী পূরিয়া যাঁর যশ আর কীর্ত্তি।।ধনুক অভ্যাস ভৃগুরামের সমান।পরম যোগেন্দ্র শুকদেব সবজ্ঞান।।প্রভাতে উঠিয়া নিত্য করে স্নানপূজা।বৃহৎ লাঙ্গল এক স্কন্ধে নিয়া রাজা।।দুই নীল বৃষ নিজে যুড়িয়া লাঙ্গলে।প্রহর পর্য্যন্ত চষে মহা কুতূহলে।।প্রহর পর্য্যন্ত বৃষ যতদূর যায়।সেইক্ষণে চাষে ক্ষমা দেন কুরুরায়।।তারপর রাজকার্য্যে রত নরবর।দরিদ্র দুঃখীরে দান করে নিরন্তর।।প্রতিদিন এইমতে চষেণ ভূপতি।সহস্র বৎসরকাল চষিলেন ক্ষিতি।।একদিন চষে রাজা আপনার মনে।ছদ্মবেশে সহস্রাক্ষ গেলেন সে স্থানে।।জিজ্ঞাসা করিল ইন্দ্র চাতুরী করিয়া।নৃপবর এই ক্ষেত্র চষ কি লাগিয়া।।রাজা হয়ে কেন কর কৃষকের কর্ম্ম।ইহার কি মর্ম্ম রাজা কিবা আছে ধর্ম্ম।।রাজা বলিলেন স্বর্গে ইন্দ্রের শাসন।ধর্ম্মাধর্ম্ম করয়ে যতেক রাজগণ।।পুরন্দর তুষ্ট হৈলে সর্ব্ব ধর্ম্ম হয়।চারিবেদে এই কথা বিদিত নিশ্চয়।।স্বর্গেতে অধীপ হৈল কশ্যপের সুত।তাঁর অংশে রাজগণ ভূমি পুরুহূত।।যত কর্ম্ম করিবেন ক্ষিতির রাজন।তার ধর্ম্মাধর্ম্ম পান সহস্রলোচন।।আপনি করিব যজ্ঞ এই ক্ষেত্রমাঝে।অগ্র যজ্ঞভাগেতে তুষিব দেবরাজে।।রাজার এতেক শুনি ধার্ম্মিক বচন।তুষ্ট হয়ে কহিলেন সহস্রলোচন।।আমি ইন্দ্র শুন রাজা বলি পরিচয়।ইষ্টবর মাগ রাজা যেবা মনে লয়।।লাঙ্গল ছাড়িয়া রাজা গলে বস্ত্র দিয়া।ইন্দ্রের চরণযুগে পড়িলেন গিয়া।।তুমি ছদ্মরূপধারী দেব সুরপতি।চর্ম্মচক্ষে চিনিতে না পারি মূঢ়মতি।।ইন্দ্র বলিলেন রাজা কিছু নাহি পাপ।স্তুতিবাদ করি কেন বাড়াও সন্তাপ।।বর মাগ রাজা তব যেবা লয় মন।মনোনীত বর দিব শুনহ রাজন।।রাজা বলে সুরপতি কর অবধান।মোরে বর দিয়া প্রভু করহ বিধান।।সহস্র বৎসর আমি চষিয়াছি ভূমে।কুরুক্ষেত্র বলিয়া হউক মম নামে।।এ ক্ষেত্রের ধূলি উড়ে লাগে যার গায়।অসংখ্য জন্মের পাপ সে জনের যায়।।অনিচ্ছায় বা ইচ্ছায় মরে যে এ স্থানে।পায় যেন সে নির্ব্বাণ মুক্তি সেই ক্ষণে।।এই বর দেহ মোরে দেব দৈত্যভেদী।এই তীর্থ রহিবেক চন্দ্র সূর্য্যাবধি।।তথাস্তু বলিয়া ইন্দ্র হৈলা অন্তর্দ্ধান।কুরুরাজ নিজ গৃহে করিল পয়াণ।।এই হেতু কুরুক্ষেত্র শুন নৃপমণি।তোমাকে জানানু কুরুক্ষেত্রের কাহিনী।।জন্মেজয় বলেন শুনহ তপোধন।তারপর কি হইল ভীম দুর্য্যোধন।।মুনি বলে শুন শুন অপূর্ব্ব কথন।দুইজনে যুদ্ধ হয় শুনহ রাজন।।হেথায় সঞ্জয় কহে অন্ধ নৃপতিরে।দুর্য্যোধন গদাযুদ্ধে পড়িল সমরে।।শুনি হাহাকার করি করয়ে ক্রন্দন।মহাশোকাকুল রাজা হয় অচেতন।।সঞ্জয় বলেন রাজা কেন কান্দ আর।সর্ব্বনাশ হৈল রাজা কপটে তোমার।।কহ রাজা কি হইবে এখন কান্দিলে।কিংজিতং কিংজিতং বলি যবে জিজ্ঞাসিলে।।পান্ডবেরে যত তুমি কর ভিন্ন ভাব।সে সব কর্ম্মেতে এবে হৈল এই লাভ।।ধৃতরাষ্ট্র বলে শুন ধর্ম্মের নন্দন।কিমতে করিল যুদ্ধ ভীম দুর্য্যোধন।।সঞ্জয় বলেন রাজা শুন মন দিয়া।ভীম দুর্য্যোধন যুদ্ধ কহি বিস্তারিয়া।।মহাভারতের কথা সমান পীযূষ।যাহার শ্রবণে নর হয় নিষ্কলুষ।।ব্যাসের বচন শিরে করিয়া বন্দন।কাশীরাম দাস কহে শুন সাধুজন।।১০. দুর্য্যোধনের উরুভঙ্গভীম দুর্য্যোধন, করে মহারণ,দেখে সবে কুতূহল।দেখিতে সমর, লইয়া অমর,আসিলেন আখন্ডল।।চড়িয়া বাহন, করে আগমন,তেত্রিশ কোটি অমর।যার যেই বেশ, করিয়া বিশেষ,বসিলা যুড়ি অন্বর।।অপ্সরী অপ্সর, কিন্নরী কিন্নর,গন্ধর্ব্ব পিশাচ রক্ষ।প্রেত ভূতগণ, না যায় গণন,আসিলেক লক্ষ লক্ষ।।হংসে পদ্মাসন, বৃষে পঞ্চানন,পার্ব্বতী কেশরী যানে।দেব জলেশ্বর, আসিল সত্বর,চড়িয়া নিজ বাহনে।।হরিণে পবন, নরে বৈশ্রবণ,মুষিকে বিঘ্নবিনাশন।হইয়া কৌতুকী, চাপি মত্ত শিখী,আসিলেন ষড়ানন।।শমন মহিষে, পরম হরিষে,আসেন দেখিতে রণ।অষ্টলোকপালম সজ্জা করি ভাল,করিলেন আগমন।।দিবা নিশাপতি, রমণী সংহতি,করি রথ আরোহণে।যত সিদ্ধগণ, না যায় গণন,আসেন যুদ্ধ সদনে।।দেবি ঋষি আদি, নাহিক অবধি,নারদাদি মুনি আর।ঊর্দ্ধরেতা যত, হয়ে উল্লসিত,করিলেন আগুসার।।সবে স্থানে স্থানে, বসিলেন যানে,দেখিতে সমর রঙ্গ।ভীম দুর্য্যোধন, দোঁহে করে রণ,উঠিল রণ তরঙ্গ।।দুই মহাবলা, গদা স্বন্ধে তুলি,ফিরায় মন্ডলী করি।সঘনে গর্জ্জন, করে দুই জন,যেমন দুই কেশরী।।যেন দুই হাতী, ধায় দ্রুতগতি,পদভরে কাঁপে ক্ষিতি।দুই বৃষে যেন, করয়ে গর্জ্জন,কম্পিত শেষাহিপতি।।ভীম বামাবর্ত্তে, ফিরে মহাসত্বে,দক্ষিণে কৌরবপতি।পর্ব্বত সমান, দুই বলবান,ফিরিছে পবন গতি।।বাকযুদ্ধ আগে, করে দোঁহে রাগে,কেহ আর নহে ঊন।ভীম মহাযোদ্ধা, ফিরাইছে গদা,দুর্য্যোধন পুনঃ পুনঃ।।সাঞি সাঞি ডাকে, গদা ঘন পাকে,দুজনে ভ্রময়ে কোপে।দুই পদভরে, টলমল করে,সঘনে অবনী কাঁপে।।দুই গদাঘাত, যেন বজ্রপাত,ঠনঠনি শব্দ শুনি।দুর্য্যোধন অঙ্গে, ভীম মহারঙ্গে,করে গদার ঘাতনি।।মহা গদাঘাত, খেয়ে কুরুনাথ,পড়িল ধরণীতলে।পড়ি ক্ষণমাত্র, ধৃতরাষ্ট্র পুত্র,সেইক্ষণে উঠে বলে।।পুনঃ দুই বীরে, গদা নিয়ে করে,মন্ডলী করিয়া ফিরে।গদার প্রহারম করে মহামার,দুজনে হানে দোঁহারে।।রাজা দুর্য্যোধন, হয়ে কোপ মন,গদা প্রহারিল ভীমে।বীর বৃকোদর, কাঁপি থর থর,সঘনে পড়িল ভূমে।।হয়ে অচেতন, পবন নন্দন,ভূতলে পড়িল ঠায়।দেখি নারায়ণে, বিনয় বচনে,জিজ্ঞাসেন ধর্ম্মরায়।।কহ দামোদর, কৌরব ঈশ্বর,ভীমে গদা প্রহারিল।ভীম মহাবল, হইয়া বিকল,যুদ্ধে অচেতন হৈল।।মহাবলবন্ত, কৌরব দুরন্ত,ভীম হৈতে বলবান।প্রলয় সংগ্রাম, করে অবিরাম,কহ হেতু ভগবান।।গোবিন্দ কহেন, করহ শ্রবণ,দুয্যোধন রণে কৃতী।জানাই তোমাতে, ভীমসেন হৈতে,বলাধিক কুরুপতি।।শুনি যুধিষ্ঠির, হইয়া অস্থির,জিজ্ঞাসেন হরি স্থানে।দুর্য্যোধন কৃতী, বলিলা শ্রীপতি,বুঝি জয় নাহি রণে।।কহেন শ্রীকান্ত, রাজা হও শান্ড,ভয় নাহি কর মনে।উপায় ইহারম আছে সারোদ্ধার,কহিব দেব এক্ষণে।।গোবিন্দ বচনে, স্থির হয়ে মনে,রহিলেন ধর্ম্মসুত।পবন-নন্দন, পাইয়া চেতন,উঠিলেন অতি দ্রুত।।পুনঃগদা তুলি, করিয়া মন্ডলী,ভ্রমে ভীম দুর্য্যোধন।নিজ ঊরুতলে, করাঘাত ছলে,মারিলেন নারায়ণ।।পবননন্দন, ছিল বিষ্মরণ,আপন প্রতিজ্ঞা কথা।কৃষ্ণের সঙ্কেতে, পড়িল মনেতে,হইলেন সব জ্ঞাতা।।বলরাম কাছে, যুদ্ধস্থলে আছে,নাহিক অন্যায় রণ।নাভির নীচেতে, গদা প্রহারিতে,শাস্ত্রে নাহি কদাচন।।এই ভয় মনে, পবন নন্দনে,অন্যায় করিতে মন।হলধর ভয়, ভাবিল হৃদয়,রাম যদি ক্রুদ্ধ হন।।সাত পাঁচ মনে, ভাবে ক্ষণে ক্ষণে,যে করুন হলধর।প্রতিজ্ঞা পালন, করিব আপন,প্রহারিব ঊরুপর।।এইরূপে দোঁহে, গদা লয়ে তাহে,মন্ডলী করিয়া ভ্রমে।দুর্য্যোধন গদা, মারিতে সর্ব্বদা,উদ্যম করিল ভীমে।।ঊরূর উপর, বীর বৃকোদর,মারিতে না করে মন।মস্তক উপর, মারিতে সত্বর,ভাবিলেক দুর্য্যোধন।।এক লাফ দিয়া, শূন্যেতে উঠিয়া,বারিব ভীমের গদা।এই অনুমানি, কুরু নৃপমণি,লাফ দিয়া উঠে তথা।।দৈবের কারণ, না যায় খন্ডন,দুর্য্যোধন লাফ দিতে।ভীম গদাঘাত, যেন বজ্রপাত,বাজে তাহার ঊরুতে।।লোক দেখে রঙ্গে, দুই ঊরু ভঙ্গে,ভূমে পড়ে দুর্য্যোধন।দেখি দেবগণ, চমকিত মন,ভীম করে আস্ফালন।।ব্যাসের বচন, ভাবি অনুক্ষণ,পাঁচালী কৈল রচন।গদাপর্ব্ব বাণী, অপূর্ব্ব বাহিনী,কাশীদাসের কথন।।১১. দুর্য্যোধনের মস্তকে ভীমের পদাঘাতইন্দ্র যেন গিরিভেদ করে বজ্রাঘাতে।ঊরুভঙ্গে কুরুবীর পড়িল তেমতে।।কুরুপতি ঊরুযুগ দেখিয়া নয়নে।কামের অধীন হয়ে ভজে নারীগণে।।হেন ঊরুভঙ্গ হয়ে পড়ে কুরুপতি।দুরু দুরু শব্দেতে কাঁপয়ে বসুমতি।।অন্যায় সমরেতে পড়িল কুরুসুত।উৎপাত হইল তবে দেখিতে অদ্ভূত।।বিপরীত বাত বহে নির্ঘাত সদৃশ।শিবাগণ কান্দে রক্তবৃষ্টি অসদৃশ।।দুর্য্যোধনে চাহি ভীম বলিল বচন।শুন ওহে কুরুপতি মূঢ় দুর্য্যোধন।।যাজ্ঞসেনী দ্রৌপদীর কৈলে অপমান।তার ফল ভুঞ্জ এবে শুন রে অজ্ঞান।।হেঁটমাথা করি আছে কুরু মহামতি।ভীম বামপদে শিরে মারিলেক লাথি।।কৃপার সাগর যুধিষ্ঠির সাধুজন।অশেষ বিলাপ করি ভীমসেনে কন।।ওরে ভীম কি করিলি কর্ম্ম বিগর্হিত।এত অপমান করা অতি অনুচিত।।সমস্ত পৃথিবীপতি রাজা দুর্য্যোধন।জ্যেষ্ঠতাত ধৃতরাষ্ট্র রাজার নন্দন।।কেন তারে চরণ হানিলে কুলাধাম।কুরুনাথে মারিলে করিয়া অনিয়ম।।সসাগরা পৃথিবীর রাজচক্রবর্ত্তী।তাহার এমন কেন করিলে দুর্গতি।।মৃগমদ চন্দন সুগন্ধ সুবাসিত।পদ্মমালা শিরে শোভে কাঞ্চন রচিত।।ভাস্কর মুকুট মণি দিনকর প্রায়।দুর্য্যোধন শিরোমণি ধরণী লোটায়।।ওরে দুষ্ট ভীমসেন বড় দুরাচার।কেমনে করিলি বাম চরণে প্রহার।।কৃপাশীল যুধিষ্ঠির করিল ক্রন্দন।দেখিয়া বিস্মিত হয় যত সভাজন।।আপনি মরিলে ভাই, বান্ধবে মারিলে।।নিজ কর্ম্মদোষে ভাই রাজ্য হারাইলে।সসাগরা পৃথিবীর ছিলা অধিকারী।।ভূমিতলে পড়িয়াছ রথ পরিহরি।ইন্দ্রের সমান তব প্রচন্ড প্রতাপ।।সিংহাসন ছাড়ি ভূমে এই বড় তাপ।মহারাজগণ নাহি পান দরশন।।রাজ্যেশ্বর হয়ে এবে ভূতলে শয়ন।সহস্রেক বিদ্যাধরী তব সেবা করে।।মোহন পুরুষ তুমি সংসার ভিতরে।এবে তুমি লোটাহ পড়িয়া ভূমিতলে।।পৃথিবী শাসিলে ভাই নিজ বাহুবলে।মাগিলাম পঞ্চগ্রাম কৃষ্ণে পাঠাইয়া।।পাপিষ্ঠ শকুনি বাক্যে না দিলে ছাড়িয়া।ভাই হয়ে চন্ডাল হইলে মহারাজ।।এতেক করিয়া ভাই কি করিলে কাজ।রাজার ক্রন্দন দেখি সকল সমাজ।।পঞ্চালক সোম আর যত মহারাজ।কান্দয়ে সকল লোক যুধিষ্ঠির সনে।।ভূমে গড়াগড়ি যান রাজা দুর্য্যোধনে।কান্দিলেন যুধিষ্ঠির শোকে মনোদুঃখে।।জানুপরে শির দিয়া কাঁদে অধোমুখে।ভ্রাতৃবধ তাপে ধৈর্য্য ধরা নাহি যায়।।ভাই ভাই বলি রাজা কাঁদে উভরায়।রাজপাট সিংহাসন সকল ত্যজিয়।।ভূমেতে লোটাও ভাই জ্ঞান হারাইয়া।কুবুদ্ধি শুনিয়া ভাই না শুনিলে বোল।।গুরুবাক্য না শুনিয়া যমে দিলে কোল।রাজার লক্ষণ ভাই আছিল তোমাতে।।তোমা হেন সত্যবাদী নাহি অবনীতে।সমর সাগর ঘোর দেখি লাগে ভয়।।একাকী করিলে রণ তুমি মহাশয়।তব যশ ঘুষিবেক এ তিন ভূবনে।।পুত্রশোক ধৃতরাষ্ট্র সহিবে কেমনে।কি বলিয়া প্রবোধিব গান্ধার জননী।।কি বলিয়া অশ্বাসিব যতেক রমণী।এতেক বিলাপ করে ধর্ম্ম নরপতি।।যুধিষ্ঠিরে প্রবোধেন আপনি শ্রীপতি।কি কারণে ক্রন্দন করহ গুণনিধি।।এই দুর্য্যোধন রাজা দুষ্টের জলধি।সে কালে এ দুষ্ট না ধরিল কার বোল।।এখন সে মহাতাপে মৃত্যু দিল কোল।একবস্ত্র রজঃস্বলা দ্রুপদকুমারী।।সভামধ্যে আনে তারে উপহাস করি।জতুগৃহে পোড়াইল তোমা পঞ্চজনে।।ভীমে বিষ দিল দুষ্ট নিধন কারণে।অনেক পাপেতে রিপু গেল রসাতল।।হেন ছারে বল ধর্ম্ম ভাই মহাবল।১২. শ্রীকৃষ্ণের প্রতি দুর্য্যোধনের কোপএতেক বলেন যদি দেব নারায়ণ।শুনি দুর্য্যোধন হল অতি ক্রুদ্ধমন।।বাহুযুগ পৃথিবীতে জাঁকি দিয়া ভর।হাঁটু অরোপিয়া ভূমি বলে নৃপবর।।কহিতে লাগিল চাহি কৃষ্ণের বদন।বুঝিলাম নিজে মন্ত্রী তুমি নারায়ণ।।কহিলে অর্জ্জুনে তুমি উপদেশ বাণী।ভীমে জানাইল পার্থ চক্ষুকোণ হানি।।তোমার আদেশ মতে পাপী পাণ্ডুসুত।অন্যায় সমরে বীর মারিল বহুত।।কর্ণ ভূরিশ্রবা সোমদত্ত গুরু দ্রোণ।অন্যায় সমরেতে মারিলা নারায়ণ।।তোমার চরিত্র আমি ভালমতে জানি।পান্ডবের পক্ষ তুমি চিন্ত মম হানি।।ধিক্ ধিক্ তোমার জীবন অকারণ।যেন আমি তেন তব পাণ্ডুর নন্দন।।তুমি সে মারিলা মম সকল সমাজ।আমারে মারিয়া তুমি সাধিলা কি কাজ।।এত শুনি কেশব বলেন অতিশয়।শুন দুষ্ট দুরাশয় গান্ধারী তনয়।।আপনি মরিলে তুমি অধর্ম্মের ফলে।দ্রৌপদী সতীরে চাহ করিবারে কোলে।।তোর যত অধর্ম্মে মরিল রাজগণ।ভূরিশ্রবা দ্রোণ ভীষ্ম কর্ণ মহাজন।।করিলে অধর্ম্ম যত তাহা পড়ে মনে।অভিমন্যু সপ্তরথী মারিলে যখনে।।আপনি তোমার ঠাঁই গেলাম যখন।যুধিষ্ঠির লাগি পঞ্চ গ্রামের কারণ।।অঙ্গুলি প্রমাণ নাহি দিলে বসুমতি।এখন বান্ধব হৈল ধর্ম্ম নরপতি।।কৃষ্ণের বচন শুনি বলে দুর্য্যোধন।না জানি মাধব তব বীরত্ব কেমন।।জানিনু পুরাণ বেদশাস্ত্র ধর্ম্মাধর্ম্ম ।জগতে না দেখি কেহ করে হেন কর্ম্ম।।ক্ষভ্র হয়ে ক্ষন্ত্রধর্ম্ম করিনু পালন।এবে চলিলাম সঙ্গে লয়ে রাজগণ।।বিধবা লইয়া রাজ্য কর যুধিষ্ঠির।স্বর্গেতে লইয়া যাই যত সব বীর।।দুর্য্যোধন নৃপতির শুনিয়া উত্তর।মহাকোপে বলিলেন দেব হলধর।।অন্যায় সমর আজি করি আকর্ষন।দুর্য্যোধন মহারাজে করিল নিধন।।এত বলি ক্রোধে কম্পে নাহি পরিমাণ।লাঙ্গল ধরেন হাতে সুমেরু সমান।।দারুণ প্রহারে মারি ভীম দুরাচার।অনিয়ম যুদ্ধ করে অগ্রেতে আমার।।এত বলি লাঙ্গল যুড়িল হলধর।দেখিয়া পাইল ভয় যত চরাচর।।সশঙ্ক হইয়া কহিলেন নারায়ণ।কোপ দূর কর প্রভু করি নিবেদন।।একবস্ত্রা রজস্বলা দ্রৌপদী সুন্দরী।সভামধ্যে তাহারে আনিল কেশে ধরি।।আনিয়া বসাবে বলি নিজ ঊরুপর।সেই দিন প্রতিজ্ঞা করিল বৃকোদর।।হেন কর্ম্ম করে দুষ্ট গোচরে আমার।সেই হেতু ভীম ঊরু ভাঙ্গিল উহার।।পাতকের প্রায়শ্চিত্ত হইল উচিত।আপনি এ সব কথা না আছ বিদিত।।আর কিছু পূর্ব্বকথা শুন হলধর।মৈত্রেয় নামেতে ছিল এক ঋষিবর।।তার স্থানে অপরাধী ছিল দুর্য্যোধন।মৈত্র ঋষি অভ্যন্তরে ছিল কোপমন।।তেজস্বী মৈত্রেয় ঋষি দিল তারে শাপ।ভীম তোর ঊরু ভাঙ্গি ঘুচাইবে তাপ।।সত্য অঙ্গীকার ভীম কৈল সে কারণ।কুরুপতি ঊরু ভাঙ্গি করিল নিধন।।ক্ষত্র হয়ে ক্ষন্ত্রধর্ম্ম রাখে আপনার।ইহাতে করিতে ক্রোধ না হয় তোমার।।এতেক শুনিয়া ক্রোধ সন্বরেণ রাম।দুর্য্যোধনে প্রশংসা করেন অবিশ্রাম।।নিন্দা করি ভীমেরে বলেন বার বার।ধিক্ ধিক্ ভীমসেন জীবনে তোমার।।আপনার বীরত্ব দেখালে ভালমতে।অন্যায় সমরে খ্যাতি রাখিলে জগতে।।আছিলেন দুর্য্যোধন রণ পরিহরি।তুমি তারে মারিলে অন্যায় যুদ্ধ করি।।হেন ছার সভাতে বসিতে না যুয়ায়।এত বলি রথে চড়ি যান যদুরায়।।দুর্য্যোধন রণ দেখি দেবগণ তুষ্টি।হরিষে বর্ষন করিলেন পুষ্পবৃষ্টি।।নৃপগণে লইয়া গেলেন ধর্ম্মরাজ।বিষণ্নবদনে যান শিবিরের মাঝ।।যার যেই শিবিরে গেলেন সর্ব্বজন।বেলা অবসান, অস্ত হইল ভপন।।বিজয় পাণ্ডব কথা অমৃত সমান।অবহেলে শুনিলে বাড়য়ে দিব্যজ্ঞান।।যতেক আছয়ে তীর্থ পৃথিবীমন্ডলে।তার ফল লভে মহাভারত শুনিলে।।মহাভারতের কথা সুধাসিন্ধুবত।কাশীরাম দাস কহে পাঁচালীর মত।।গদা পর্ব্ব সমাপ্ত।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon