গান্ধারী

গান্ধারী : গান্ধার দেশে যদুবংশী সুবল নামে এক রাজা ছিল। তার কন্যার নাম গান্ধারী, সুশ্রী, বুদ্ধিমতী। ব্যাসদেবের বরে গান্ধারী শতপুত্রের জননী হবে এবং পুত্ররা মহাবলশালী হবে এ সংবাদ ভীষ্ম জানার পর দূতমারফত বিবাহের প্রস্তাব পাঠালেন। রাজা সুবল মনে মনে ভাবলেন কুরুবংশ মহাবংশ জগতে বিখ্যাত। কিন্তু পাত্র অন্ধ। ভীষ্ম রুষ্ট হবে বিবেচনায় সুবল ধৃতরাষ্ট্রের সাথে তার কন্যার বিবাহ দিলেন। গান্ধারী জানল তার পতি জন্মন্ধ। কিন্তু কোন অনুযোগ করল না। ভাগ্যকে মেনে নিলেন। কিন্তু গান্ধারী গর্ভ সঞ্চার দুই বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও সন্তান না হওয়ায় ধৃতরাষ্ট্রে অজান্তে তিনি গর্ভপাত করেন। তাতে এক লৌহকঠিন মাংস পিন্ডের প্রসব হয়। সেই মাংসপিন্ড গান্ধারী বিনষ্ট করার উদ্যোগ নিলে ব্যাসদেবের পরামর্শে গান্ধারী সেই মাংশ পিন্ড শীতল জলে রেখে কিছুদিন পর তা হতে একশত ভ্রুণে বিভক্ত করেন। গান্ধারী একশত একটি ঘৃত কলসে একশত একটি ভ্রুণ আলাদাভাবে রেখে দেন। এক বছর একটি কলসে দূর্যোধনের জন্ম হয় এবং অপরাপর কলসে দু:শাসন, বিকর্ণ ও চিত্রসেনসহ ৯৯ জন পুত্র এবং দু:শলা নামে এক কন্যার জন্ম হয়।

দ্যুতসভায় ছলনা ও দ্রৌপদীক অপমান করার জন্য দুর্যোধনকে ত্যাগ করার জন্য গান্ধানী একাধিকবার ধৃতরাষ্ট্রকে অনুরোধ করেন। কিন্তু পুত্রস্নেহে অন্ধ ধৃতরাষ্ট তা করতে পারেননি। দুর্যোধন ও দূ:শাসনের অপরাধ গান্ধারী কখনও ক্ষমা করেননি। পান্ডবদের প্রাপ্য অর্ধেক রাজ্য ফেরত দেয়ার জন্য গান্ধারী যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। অজ্ঞাতবাস শেষে পান্ডবরা হৃত রাজ্য ফেরত পাওয়ার জন্য হস্তিনাপুরে দূত প্রেরণ করেন। তখন গান্ধারী পান্ডবদের সাথে সন্ধি করার জন্য দুর্যোধনকে অনেক বুঝানো চেষ্টা করেন।তিনি বলেন ধর্মহীন ঐর্শ্বয্য প্রাপ্তির চেষ্টা পরিণামে মৃত্যু ডেকে আনে। দুর্যোধন মার্তৃ আজ্ঞা অবজ্ঞা করেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পূর্বে দুর্যোধন মাতা গান্ধারীর নিকট হতে আশীর্বাদ চাইলে গান্ধানী বলেন,“যতো ধর্ম স্ততো জয়:”। অর্থাৎ যেখানে ধর্ম সেখানেই জয়।” যুদ্ধ শেষে গান্ধারী কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ভয়াবহতা দর্শন করে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েন। চারিদিকে এত মৃত্যু, এত ধ্বংস দেখে নিজেকে কিছুতেই স্থির রাখতে পারছিলেন না। যুধিষ্ঠির স্বয়ং গান্ধারীকে সান্তনা দিতে লাগলেন। কৃষ্ণও গান্ধারীকে পুত্রশোকের জন্য সান্তনা দিতে লাগলেন। কৃষ্ণের সান্তনা বাক্য শ্রবণ করে গান্ধারী বলতে লাগলেন,“কি বলব অচ্যুত! তুমি বিনাশিলা কুরুকূল। শতপুত্রের মৃত্যু শোকে আমার হৃদয় আগুনের মত জ্বলছে। এমন পুত্র শোক কখনও হয়েছে কি কোনজনে? শোন হাজার হাজার পতিহীনার ক্রন্দন ধ্বনি। হোক সুপুত্র বা কুপুত্র তবুও তো সন্তান। সংসারে যত শোক আছে পুত্র শোক তারও তুল্য নহে। আপনি অনাদি পুরুষ। আপনি কৃষ্ণ মুরারী। আপনি পুরুষ প্রধান। আপনি জগন্নাথ। আপনিই দ্যুতসভায় দ্রৌপদীর সম্মান রক্ষা করেছিলেন। আপনিই ছলনা করে হলেন অর্জুনের সারথি আর আমার পুত্রকে দিলেন দশলক্ষ নারায়ণী সেন। অর্জুনকে বধ করার অস্ত্র কর্ণের কাছে ছিল কিন্তু সেই অস্ত্র ঘটোৎকচের উপর প্রয়োগ করার জন্য কর্ণকে প্ররোচিত করার মন্ত্রণা আপনিই দিয়েছিলেন। আপনার এত ক্ষমতা, এত শক্তি থাকার পরও কেন আপনি এ যুদ্ধ কেন হতে দিলেন? এত ছলনা, এত কপটতা, এত অন্যায় কেন হতে দিলেন? আমি মহাতপস্বীনী সুবল কন্যা, আমি মহাযোগিনী ধৃতরাষ্ট্র পত্নি, আমি শত পুত্র হারানো এক হতভাগ্য মাতা, আপনাকে অভিশাপ দিচ্ছি যেভাবে কুরু-পান্ডবেতে বিভেদ সৃষ্টি করে কুরু বংশের বিনাশ হয়েছে তেমনি আপনার চোখের সামনে যাদব বংশের বিনাশ হবে। আমার বাক্য অলংঘনীয়।” গান্ধারীর অভিশাপ বাক্য শুনে বাসুদেব কৃষ্ণ ঈষৎ হেসে বললেন,“মাতা!অবশ্যই আপনার বাক্য অলংঘনীয়। আমি সসগড়ার পাপ মোচনের জন্য আবির্ভূত হয়েছিলাম। এতদিনে তার ভার ঘুচিল। দুর্যোধনের দোষে কৌরব বংশ নিধন হলো। আপনি না জানিয়া আমাকে শাপ দিলেন, মাতা। আমি যদি দোষী হই নিশ্চয় শাপ ফলিবে। যাদবদের সংহারকর্তা আমি ভিন্ন আর কেউ নেই। যাদবগণ মানুষ ও দেব-দানবের দ্বারা বধ্য নয়, তারা পরস্পরের মধ্যে হানাহানি করে নিহত হবে। আপনি ক্রন্দন নিবারণ করুন।” এভাবে শ্রীকৃষ্ণ গান্ধারী সান্তনা দিলেন।

গান্ধারী পতি পরায়ণ ছিলেন। পতির কষ্টকে নিজের কষ্ট মনে করেই গান্ধারী বস্ত্রখন্ড দ্বারা তার চোখ সব সময় বেঁধে রাখতেন। পতির সুখ দু:খ গান্ধারী ভাগ করে নিয়েছিলেন। গান্ধারী মনস্বিনী, পুত্রের দৃষ্টতা, পুত্রের দূর্বৃত্ততা, পুত্রের অন্যায় আচরণ, নিষ্ঠুরতা, রূঢ়তা এবং পতির দূর্বলতা দেখে শংকিত হন, আতংকিত হন, ভৎসনাও করেন কিন্তু রাজ্যের বা সমাজের বা পরিবারের কোন প্রতিকার করতে পারেন না। শতপুত্র হন্তার পর গান্ধারীর যত রাগ, যত দ্বেষ, যত কষ্ট, যত মান-অভিমান সবই কৃষ্ণ ও যুধিষ্ঠির উপর স্বাভাবিকভাবেই আরোপিত হয়েছিল। ক্ষণিক পরে তার রাগ স্তিমিত হলে তিনি পান্ডবদের নিজের পুত্র বলেই জ্ঞান করেছিলেন।
সূত্র : মহাভারত ও বিভিন্ন পৌরানিক গ্রন্থ।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র