০০১-গণেশ বন্দনা বিঘ্ন-বিনাশন, গৌরীর নন্দন, বন্দি দেব গনরাজে। ব্রত যজ্ঞ হোমে, সবার প্রথমে, ধাতে যাঁরে আগে পূজে।। খর্ব্ব স্থূল অঙ্গ, বদন মাতঙ্গ, সুন্দর লম্ব-উদর। চন্দনে চর্চ্চিত, সৌরভে উম্মত ব্যালোল গণ্ড ভ্রমর।। হৃদি বিভূষিত, বৈরীর শোণিত, পরিধান দ্বীপি-ছাল। ভুজ করি-কর, সরোরুহ কর, পাশাঙ্কুশ জপমাল।। আসন ইন্দুর, ভূষণ সিন্দূর, আজানুলম্বিত নাসা। প্রচণ্ড মণ্ডল, মুকুট কুণ্ডল, তিলক তিমিরনাশা।। নানা পরিচ্ছদ, কঙ্কন অঙ্গদ, নূপুর কিঙ্কিণী বাজে। যতি জিতেন্দ্রিয়, যোগিজন-প্রিয়, যোগীন্দ্র যোগীর মাঝে।। যাঁহার চরণ, করিয়া সেবন, রচিত বিবিধ গাথা। বাল্মীকি বশিষ্ঠ, ব্যাস কবিশ্রেষ্ঠ, ক্ষিতিতে হইল খ্যাতা। জয় বিঘ্নেশ্বর, মোর বিঘ্ন হর, হরি নামামৃত-পানে। তব পদাম্ভুজ, কৃষ্ণদাসানুজ, সদা কাশী ধ্যায় ধ্যানে।। ০০২-ব্যাসবন্দনা পরাশর পিতা যাঁর, শুকদেব সুত। বেদের বিভাগ-কর্ত্তা বলি যিনি খ্যাত।। বদরিকাশ্রমে যাঁর নিয়ত বসতি। কৃষ্ণবর্ণে বিভূষিত যাঁহার মূরতি।। দ্বীপের উপরি হৈল জনম যাঁহার। সে ব্যাস-দেবের পদে প্রণাম আমার।। বশিষ্ঠ-প্রপৌত্র, শক্তি-পৌত্র যাঁরে গণি। পরাপর-পুত্র, শুক-পিতা হন যিনি।। কিছুমাত্র কোন পাপ না আছে যাঁহার। সে ব্যাস-দেবের পদে প্রণাম আমার।। চারি মুখ নাহি যাঁর, তবু ভূমণ্ডলে। যাঁহারে স্বয়ং ব্রহ্মা সকলেই বলে।। চারি বাহু নাহি যাঁর, তবু ত্রিভুবনে। যাঁহারে স্বয়ং বিষ্ণু বলি সবে গণে।। যাঁর ভালে চন্দ্র নাই, তবু এই ভবে। যাঁরে মহেশ্বর বলি সকলেই ভাবে।। যিনি এক, কিন্তু যাঁহে তিনের মিলন। ধন্য ধন্য সেই ব্যাস-দেব তপোধন।। বন্দি মহামুনি ব্যাস, মুনির তিলক। সুত শুক পরাশর যাঁহার জনক।। বেদশাস্ত্র-পরনিষ্ঠ শুদ্ধবুদ্ধি ধীর। নীলপদ্ম-আভা যিনি কোমল শরীর। কনক-পিঙ্গল জটাভাব যাঁর শিরে। প্রকাণ্ড শরীর পরিধান ব্যাঘ্র-চীরে।। নয়ন-কমল দীপ্ত যুগল মিহির। পদযুগে নত সুর-মুনি ইন্দ্রশির।। ভাগবত ভারতাদি যতেক পুরাণ। যাঁহার কমল মুখে সবার নির্ম্মাণ।। লীলায় বিবিধ বেদ কৈল চারিখান। ঋক্ সাম যদুঃ আর অথর্ব্ব বিধান।। কৈবর্ত্তী জননী যাঁর দ্বীপমধ্যে জন্ম। বাল্যকাল হৈতে যাঁর অচরণ ব্রহ্ম।। নমস্কার করি তাঁর চরণ-পঙ্কজে। পরম আনন্দে কাশীরাম দাস ভজে।। ০০৩-গ্রন্থ-সূচনা বেদ রামায়ণে আর আছয়ে ভারতে। ইত্যাদি যতেক শাস্ত্র আছে ত্রিজগতে। এ সকল বিচারিয়া কহি পুনঃ পুনঃ । আদি অন্ত মধ্যে সব হরিগুণ-গান।। সর্ব্বশাস্ত্র বিচারিয়া কহি পুনর্ব্বার। শ্রীমহাভারত-গ্রন্থ সর্ব্বশাস্ত্র-সার।। সর্ব্বশাস্ত্র বীজ হরিনাম দ্বি-অক্ষর। আদি অন্ত নাহি যার বেদে অগোচর।। প্রণমহ পুস্তক ভারত-নামধর। যাহার শ্রবণেতে নিষ্পাপ হয় নর।। পরাশর-সুতমুখে হইল সম্ভব। অমল কমল দৈব্য ত্রৈলোক্য-বল্লভ।। ব্রহ্মা আদি দেবতার শ্রবণ বাঞ্ছিত। বিবিধ পুরাণে গ্রন্থ ভারত সঙ্গীত।। গীতি অর্থ কৈল তাহে সুগন্ধি নির্ম্মাণ। চিত্র বিচিত্র কথা ভারত আখ্যান।। হরিতে সদ্ভক্তি যেই প্রচণ্ড তপনে। ভারত-পঙ্কজ ফুটে যার দরশনে।। সজ্জন সুবুদ্ধিলোক হইয়া ষট্পদী। ভারত-পঙ্কজ-মধু পিয়ে নিরবধি।। বিপুল বৈভব ধর্ম্ম, জ্ঞানের প্রকাশ। কলির কলুষ যত হয় তাহে নাশ।। ষষ্টি লক্ষ গ্রন্থ ব্যাস ভারত রচিল। ত্রিশ লক্ষ শ্লোক তার দেবলোকে নিল।। সুরলোকে পড়েন নারদ তপোধন। ইন্দ্র আদি দেবতারা করেন শ্রবণ।। পঞ্চদশ লক্ষ শ্লোক পিতৃগণ শুনে। অসিত দেবল তথা করেন পঠনে।। শুকদেব-মুখে শুনে গন্ধর্ব্ব যক্ষ রক্ষ। মহাভারতের শ্লোক চতুর্দশ লক্ষ।। একলক্ষ শ্লোক প্রচারিল মর্ত্তপুরে। সংসারো-নরক হৈতে উদ্ধারিতে নরে।। বৈশম্পায়ন কহেন জন্মেজয় শুনে। পরম পবিত্র কথা ব্যাসের রচনে।। চারি বেদ ষট্ শাস্ত্র একভিতে কৈল। ভারত-সংহিতা মুনি তুলেতে তুলিল।। ভারেতে অধিক তেঁই হইল ভারত। বিবিধ পুরান গ্রন্থ যাহার সম্মত।। সুরাসুর নাগ নর এ তিন ভুবনে। সংসারের মধ্যে যত হৈল পূণ্যজনে।। সবার চরিত্র এই ভারত-ভিতর। যাহার শ্রবণে পাপহীন হয় নর।। সর্ব্বশাস্ত্র মধ্যে যার প্রধান গণন। দেবগন মধ্যে যথা দেব নারায়ণ।। নদ-নদীগণ যেন প্রবেশে সাগর। সকল পুরাণ-কথা ভারত ভিতর।। অনেক কঠোর তপে ব্যাস-মহামুনি। রচিলা বিচিত্র গ্রন্থ ভারত-কাহিনী।। শ্লোকচ্ছন্দে সংস্কৃত বিরচিলা ব্যাসে। গীতিচ্ছন্দে কহি তাহা শুন অনায়াসে।। ০০৪-সৌতির নিকটে শৌনকাদি ঋষির ভৃগুবংশ বিবরণ জিজ্ঞাসা শৌনকাদি মুনিগণ নৈমিষ-কাননে। দ্বাদশ বর্ষ যজ্ঞ করে একমনে।। লোমহর্ষণের পুত্র সৌতি নাম-ধর। ব্যাস-উপদেশে সর্ব্বশাস্ত্রেতে তৎপর।। ভ্রমিতে ভ্রমিতে গেল নৈমিষ-কাননে। সনকাদি মুনি যজ্ঞ করে সেইখানে।। মুনিগণে প্রণমিল সূতের নন্দন। আশীর্ব্বাদ করি সবে দিলেন আসন।। আসনে বসিলে সৌতি কন মুনিগণ। কোথা হতে হৈল সৌতি তব আগমন।। কোথায় বা এতকাল করিলা যাপন। সবিস্তারে কহ সবে করিব শ্রবণ।। মুনিগণ-প্রশ্ন শুনি সূতের কুমার। সবিনয়ে করপুটে কহেন বিস্তার।। মহারাজ জন্মেজয় পরীক্ষিৎ-পুত্র। সর্প-কুল বিনাশার্থে কৈলা সর্প-সত্র।। সেই যজ্ঞে মুনিশ্রেষ্ঠ শ্রীবৈশম্পায়ন। ব্যাস-বিরচিত কথা করান শ্রবণ।। বিস্তারে শ্রবণ করে ভারত-আখ্যান। যাহার শ্রবণে নর পায় দিব্যজ্ঞান।। নানা তীর্থ পর্য্যটন করি অবশেষে। উপনীত হইয়াছি তোমা সবা পাশে।। সূর্য্যাগ্নির সমতেজা, তোমা সবা জনে। ব্রহ্মরূপে অবতীর্ণ নৈমিষ-কাননে।। ধর্ম্ম-ইতিহাস কিম্বা পুরাণ-কাহিনী। শ্রবণে মানস কিবা কহ মহামুনি।। আদেশ করুন আমি করিব কীর্ত্তন। যাহার শ্রবণে সর্ব্বপাপ-বিমোচন।। সৌতির বচন শুনি কন মহামুনি। তত তাত সূত ছিলা সর্ব্বশাস্ত্র-জ্ঞানী।। নানা চিত্র বিচিত্র কথন পুরাতন। সূত-মুখে বহুশাস্ত্র করেছি শ্রবণ।। তাঁর পুত্র তুমি হে জিজ্ঞাসি সে কারণ। কি জানহ কহ তুমি করিব শ্রবণ।। ভৃগুবংশ উৎপন্ন হইল কি রূপেতে। বিস্তার করিয়া কহ সবার অগ্রেতে।। ০০৫-ভৃগুবংশ উপাখ্যান সৌতি বলে অবধান কর মুনিগণ। কহিব বিচিত্র কথা ব্যাসের বচন। ব্রহ্মার নন্দন হৈল ভৃগুমহামুনি। পুলোমা নামেতে কন্যা তাহার গৃহিণী।। গর্ভবতী পুলোমা রাখিয়া নিজ ঘরে। মহামুনি ভৃগু গেল স্নান করিবারে।। হেনকালে তথা আসে দৈত্য একজন। হরিবারে গুরুপত্নী করিয়া মনন।। কামেতে পীড়িত চিত্ত অন্যে নাহি ভয়। ফলমূল দিল কন্যা কিছু নাহি লয়। বলেতে ধরিব বলি বিচারিল মনে। গৃহে প্রবেশিতে দেখে জলন্ত আগুনে।। অগ্নিপানে চাহি বলে দানব দুরন্ত। কহ বৈশ্বানর তুমি জান আদি অন্ত।। ইহার জনক পূর্ব্বে বরিলেক মোরে। না দিয়া বিবাহ মোরে দিলেন ভৃগুরে।। মিথ্যাবাদি ভৃগু নাহি করিল বিচার। বিভা করি আনে কন্যা বরণ আমার।। না কহিও মিথ্যা তুমি কহ সত্যবাণী। ন্যায়েতে এ কন্যা হয় কাহার গৃহিণী।। দানবের কথা শুনি অগ্নি হৈল ভীত। কহিব কেমনে মিথ্যা হইল চিন্তিত।। সত্য কৈলে কন্যা লৈয়া যাইবে দানব। ভাবিয়া তাহার প্রতি বলে জলোদ্ভব।। যে কালে ইহার বাপ কহিলেক মোরে। বিধিমত বেদমন্ত্র তোমা নাহি বরে।। বিধিমতে বিভা কৈল ভৃগু মুনিবর। ইহার জনক দিল আমার গোচর।। ন্যায়েতে পুলোমা হৈল ভৃগুর রমণী। শুনিয়া দানব হৈল জলন্ত আগুনি।। বলে ধরি কন্যা ল’য়ে চলিল সত্বর। ভয়েতে বিকলা কন্যা কাঁপে থর থর।। কান্দয়ে পুলোমা বহু বিলাপ করিয়া। বালকে জন্মিল ক্রোধ গর্ভেতে থাকিয়া।। দ্বিতীয় সূর্যের প্রায় হইল বাহির। বিখ্যাত চ্যবন নাম সেই মহাবীর।। দৃষ্টি মাত্রে ভৃগুপুত্র রাক্ষস দুর্জ্জন। সেই দণ্ডে ভস্মীভূত কৈল তপোধন।। হেনকালে তথায় আইল পদ্মযোনি। ক্রন্দন নিবৃত্ত কৈল বলি প্রিয়বাণী।। ক্রন্দনে বহিল অশ্রুজল পুলোমার। খরতর স্রোতে বহে নদী সে অপার।। দেখিয়া বিস্ময় চিত্ত হইলেন বিধি। নাম তার দিল তবে বধূমতী নদী।। বধূকে রাখিয়ে গৃহে গেল প্রজাপতি। পুত্র কোলে করিয়া আছয়ে দুঃখমতি।। হেনকালে স্নান করি আসে ভৃগু তথা। জিজ্ঞাসিল কেন তোর চিত্ত বিচলতা।। স্বামীরে দেখিয়া কন্যা করিয়া রোদন। কহিলেন যতেক দানব-বিবরণ।। তোমার তনয় এই কৈল প্রতিকার। দানবে মারিয়া মোরে করিল উদ্ধার।। এত বলি পুনঃ ভৃগু হেতু জিজ্ঞাসিল। কি কারণে দানব ধরিয়া তোরে নিল।। কন্যা বলে আচম্বিতে আসি দুষ্টমতি। আমারে দেখিয়া জিজ্ঞাসিল অগ্নি প্রতি।। বৈশ্বানর-বাক্যে মোরে নিলেক দুর্জ্জন। শুনি শাপ দিল ভৃগু ক্রোধে অচেতন।। আজি হৈতে সর্ব্বভক্ষ্য হও হুতাশন। ত্রাসিত অনল শুনি ভৃগুর বচন।। কোন্ দোষে ভৃগুমুনি শাপ দিলে মোরে। যাহা জানি তাহা বলি আমি দানবেরে।। জানিয়া শুনিয়া মিথ্যা বলে যেই জন। ইহলোকে কুৎসা অন্তে নরকে গমন।। উভয় সপ্তম কুল নরকে প্রবেশে। জানিয়া আমারে শাপ দিলে কোন্ দোষে।। মোর মুখে দিলে তৃপ্ত দেব পিতৃগণ। অনুচিত শাপ মোরে দিলে কি কারণ।। এত বলি বৈশ্বানর দেবগণ লৈয়া। ব্রহ্মারে সকল কথা নিবেদিল গিয়া।। ব্রহ্মা বলে অগ্নি দুঃখ না ভাবিহ মনে। সকল হইবে শুদ্ধ তোমার কারণে।। ব্রহ্মার বচনে অগ্নি সন্তুষ্ট হইয়া। পুনরপি ত্রিজগতে ব্যাপিল আসিয়া।। ০০৬-রুরুর সর্প হিংসা সৌতি বলে অবধান কর মুনিবর। হেনমতে ভৃগু পুত্র হইল চ্যবন।। প্রমতি নামেতে হৈল চ্যবন-তনয়। তাহার তনয় হৈল রুরু মহাশয়। প্রমদ্বরা ভার্য্যা তার পরমা-সুন্দরী। গর্ভে জন্ম হৈল তার মেনকা অপ্সরী।। কতকালে মৈল কন্যা সর্পের দংশনে। দেখি শোকাকুল হৈল যত বন্ধুগণে।। ভার্য্যার মরণশোকে প্রমতি-নন্দন। একাকী অরণ্যমধ্যে করয়ে ক্রন্দন।। মুনির ক্রন্দন দেখি যত দেবগণ। পাঠাইল দেবদূত প্রবোধ-কারণ।। দেবদূত বলে রুরু কান্দ কি কারণে। মরিল তোমার ভার্য্যা আয়ুর বিহনে।। ইহার উপায় আর নাহিক ত্রিলোকে। আছয়ে উপায় এক কহিব তোমাকে।। আপন অর্দ্ধেক আয়ু যদি দেহ তারে। তবে পাবে নিজ ভার্য্যা কহিনু তোমারে।। অর্দ্ধ আয়ু দিব রুরু কৈল অঙ্গীকার। জীউক যে ভার্য্যা মোর কর প্রতিকার।। এত শুনি দেবদূত রুরুকে লইয়া। যমের ভবনে গেল বিমানে চড়িয়া।। যমেরে কহিল দূত সব বিবরণ। অর্দ্ধ আয়ু স্ত্রীকে দল প্রমতি-নন্দন।। ধর্ম্মরাজ বলে পাবে তোমার কামিনী। যাও যাও নিজালয়ে ওহে দ্বিজমণি।। ধর্ম্মবলে প্রেমদ্বারা জীবন পাইল। দেখিয়া প্রমতি-পুত্র সানন্দ হইল।। প্রতিজ্ঞা করিল রুরু ক্রোধে ততক্ষণে। মারিব ভুজঙ্গ যত দেখিব নয়নে।। হাতে দণ্ড ভ্রমে রুরু সর্প অম্বেষণে। মারিল অনেক সর্প না যায় গণনে।। একদিন ভ্রমে মুনি অরণ্য ভিতর। দেখিলেন মহাসর্প অতি ভয়ঙ্কর।। সর্প দেখি দণ্ড ল’য়ে যায় মারিবারে। দেখিয়া ডুণ্ডুভ ডাকি কহে উচ্চৈঃস্বরে।। কি দোষ করিনু আমি তোমার সদনে। অহিংসক জনে মার কিসের কারণে।। রুরু বলে দোষ গুণ না করি বিচার। সর্প পেলে সংহারিব প্রতিজ্ঞা আমার।। ডুণ্ডুভ বলেন আমি নাম মাত্র সাপ। অহিংসক হিংসনে জন্মায় মহাপাপ।। এতেক শুনিয়া রুরু ভাবে মনে মন। জিজ্ঞাসিল সর্প তুমি কোন্ মহাজন।। সর্প বলে পূর্ব্বে ছিনু মুনির কুমার। চিত্রসেন নামে সখা ছিলেন আমার।। তালপত্র এক সর্প করিয়া রচন। সখারে দিলাম আমি হাস্যের কারণ।। সর্প দেখি মোহ গেল মুনির তনয়। ক্রোধ করি শাপ মোরে দিল অতিশয়।। হীনবীর্য্য সর্প হৈয়া থাকহ কাননে। পুনরপি কহে মোরে করুণ বচনে।। অচিরে হইবে মুক্ত শুন প্রাণসখা। রুরু সহ যেই দিনে হবে তব দেখা।। প্রমতির পুত্র তুমি ভৃগুবংশে জন্ম। দ্বিজ হৈয়া কর কেন ক্ষত্রিয়ের কর্ম্ম।। ব্রাহ্মণের কর্ম্ম নয় লোকের হিংসন। অল্প দোষে দেখ মোর দুর্গতি লক্ষণ।। অহিংসা পরম ধর্ম্ম করহ পালন। ভয়ার্ত্ত জনেরে রক্ষ করিয়া যতন।। পূর্ব্বে রাজা জন্মেজয় সর্পযজ্ঞ কৈল। ?য়ায় সর্পের কুল ব্রহ্মণে রাখিল।। আস্তিক নামেতে দ্বিজ জরৎকারু-সুত। যাঁহার চরিত্র-কথা শুনিতে অদ্ভুত।। রুরু বলে কহ শুনি আস্তিক-আখ্যান। কিমতে নাগের কুল কৈল পরিত্রাণ।। কি কারণে সর্পযজ্ঞ কৈল জন্মেজয়। কহ শুনি মুনিবর ঘুচুক বিস্ময়।। মুনি কহে সেই কথা কহিতে বিস্তার। শুনিবারে চিত্ত যদি আছয়ে তোমার।। মুনিগণে জিজ্ঞাসিলে কহিবে সকল। আজ্ঞা দেহ যাব আমি আপনার স্থল।। এতবলি দিব্যমূর্ত্তি হৈল ততক্ষণে। অন্তর্দ্ধান হৈয়া মুনি গেল যথাস্থানে।। বিস্ময় জন্মিল রুরু মনোদুঃখী তাপে। আপনার গৃহে আসি জিজ্ঞাসিল বাপে।। প্রমতি বলেন আমি তাহা সব জানি। আস্তিকের উপাখ্যান অদ্ভুত কাহিনী।। মহাভারতের কথা অমৃতের ধার। শ্রবণের সুখ ইহা বিনা নাহি আর।। কাশীরাম দাসের প্রণাম সাধুজনে। পায় সে পরম প্রীতি ভারত-শ্রবণে।। ০০৭-জরৎকারু উপাখ্যান জিজ্ঞাসিল রুরু তবে জনকের স্থানে। সর্পযজ্ঞ জন্মেজয় কৈল কি কারণে।। প্রমতি বলেন, বৎস কর অবধান। মহাশ্চর্য্য সর্প-যজ্ঞ অপূর্ব্ব আখ্যান।। যাযাবর বংশে জন্ম জরৎকারু মনি। যোগেতে পরম যোগী ত্রিজগতে জানি।। স্বচ্ছন্দে ভ্রমিয়া গেল দেশ-দেশান্তরে। উলঙ্গ উম্মত্তবেশ সদা অনাহারে।। একদা অরণ্য-মধ্যে ভ্রমে তপোধন। একগোটা গর্ত্ত দেখে অদ্ভুত রচন।। তার মধ্যে দেখয়ে মনুষ্য কত জন। এক উলামূল ধরি আছে সর্ব্বজন।। অপূর্ব দেখিয়া জিজ্ঞাসিল মুনিবর। কি কারণে এত দুঃখ তোমা সবাকার।। যে উলার মূল ধরি আছ সর্ব্বজনে। মূষিক খুঁজিছে মূল, না দেখ নয়নে।। একগোটা মূল মাত্র দৃঢ় আছে তৃণে। এখনি ছিঁড়িবে উহা ইন্দুর-দংশনে।। তবে ত পড়িবে সবে গর্ত্তের ভিতর। এত শুনি পিতৃগণ করিল উত্তর।। যাযাবর বংশে আমা সবার উৎপত্তি। নির্ব্বংশ হইনু সেই হৈল হেন গতি।। ঋষি বলে, বংশে কেহ নাহি কি তোমার। বংশ-রক্ষা করি করে সবার উদ্ধার।। পিতৃগণ বলে, মাত্র আছে একজন। মূর্খ দুরাচার সেই বংশ-অভাজন।। না করিল কুলধর্ম্ম বংশের রক্ষণ। জরৎকারু নাম তার, শুন মহাজন।। এত শুনি জরৎকারু বিস্ময় হইয়া। আমি জরৎকারু বলি কহিল ডাকিয়া।। কি করিব, আজ্ঞা মোরে কর পিতৃগণ। যে আজ্ঞা করিবে, তাহা করিব পালন।। পিতৃগণ বলে, কর বনিতা গ্রহণ। পুত্র জন্মাইয়া কর বংশের রক্ষণ।। সর্ব্বশাস্ত্রে বিজ্ঞ তুমি তপেতে-তৎপর। পুত্রবন্তে যেই ধর্ম্ম তোমাতে গোচর।। মহাপুণ্য করি লোক না যায় যথায়। পুত্রবন্ত লোক সব তথাকারে ধায়।। তে কারণে বিবাহ করহ মুনিবর। পুত্র জন্মাইয়া আমা-সবা রক্ষা কর।। পিতৃগণ-বাক্য শুনি বলে জরৎকার। যত্নে না করিব বিভা, মম অঙ্গীকার।। মোর নামে কন্যা যদি যাচি কেহ দেয়। তবে সে করিব বিভা কহিনু নিশ্চয়।। তাহার গর্ভেতে যেই জন্মিবে কুমার। তোমা সবাকারে সেই করিবে উদ্ধার।। শুনি অন্তর্দ্ধান হৈল যত পিতৃগণ। শূন্যেতে ডাকিয়া তবে বলিল বচন।। বিভা করি জরৎকারু জন্মাও সন্ততি। সন্তান জন্মিলে হবে বংশের সদ্গতি।। যেই বেণামূল সবে ছিলাম ধরিয়া। তুমি আছ, তাই মূল আছে ত লাগিয়া।। মূষিকে খুঁড়িতেছিল মূষিক সে নয়। মূষা-রূপে আপনি সে ধর্ম্ম-মহাশয়।। তাহা শুনি জরৎকারু করিল গমন। বহু-দেশ-দেশান্তর করেন ভ্রমণ।। পিতৃ-গণ আজ্ঞা শুনি চিন্তে অনুক্ষণে। যাচি কন্যা দিতে কেহ নাহি কি ভুবনে।। মহাবনে প্রবেশ করিল জরৎকার। কন্যা কার আছে দেহ, বলে তিনবার।। আছিল তথায় বাসুকির অনুচর। মুনির সন্দেশ কহে বাসুকি-গোচর।। এত শুনি বাসুকি যে আনন্দ অপার। ভগিনী সহিত গেল যথা জরৎকার। মুনিবরে ফণিবর কহে নিবেদন। আমার ভগিনী তুমি করহ গ্রহণ।। মুনি বলে, এই কন্যা কোন নাম ধরে। সত্য করি কহ শুনি না ভাণ্ডিহ মোরে।। মোর নামে হয় যদি ভগিনী তোমার। বিবাহ করিব তবে, কৈনু অঙ্গীকার।। বাসুকি বলিল, নাম ধরে জরৎকারী। তোমার লাগিয়া জন্ম ল’য়েছে সুন্দরী।। যত্নে রাখিয়াছি আমি তোমার কারণে। তোমার আজ্ঞায় আনিলাম এতদিনে।। এত বলি কন্য দিয়া গেল ফণিবর। শুনি নাগলোকে হৈল আনন্দ বিস্তর।। মহাভারতের কথা সুধা হইতে সুধা। কর্ণপথে কর পান, যাবে ভব-ক্ষুধা।। বহু চিত্র-কথা যত ব্যাস বিরচিত। অমর-কিন্নর-নর-নাগের চরিত।। বিবিধ বিপদ খণ্ডে যাহার শ্রবণে। আত্মশুদ্ধি বংশবৃদ্ধি পাপ-বিমোচনে।। স্ববাঞ্ছিত ফল হয় ইথে নাহি আন। হরিপদে মতি হয়, জন্মে দিব্যজ্ঞান। এই কথা শ্রবণে সকল পাপ নাশে। গীতিচ্ছন্দে বিরচিল তাহা কাশীদাসে।। ০০৮-নাগগণের উৎপত্তি ও অরুণের জন্ম মুনিগণ বলে, কহ ইহার কারণ। ভগিনীকে দিল নাগ কোন প্রয়োজন।। মুনি হেতু কি কারণে কন্যার উৎপত্তি। বিস্তারিত সব কথা কহ পুনঃ সৌতি।। সৌতি বলে, অবধান কর মুনিগণ। বাসুকি দিলেন ভগ্নী যাহার কারণ।। দক্ষের দুহিতা কদ্রু বিনতা সুন্দরী। স্বামী কশ্যপেরে দোঁহে বহু সেবা করি।। তুষ্ট হয়ে বলে মুনি, মাগ দোঁহে বর। ইহা শুনি কদ্রু বলে যুড়ি দুই কর।। সহস্রেক নাগ হবে আমার কুমার। এই বাঞ্ছা মোর পূর্ণ কর মুনিবর।। বিনতা মাগিল বর কশ্যপের পায়। দুই পুত্র মোরে মুনি দেহ মহাশয়।। কদ্রু-পুত্রে বলাধিক হইবে নন্দন। হাসিয়া কশ্যপ বর দিল ততক্ষণ।। মুনি-বরে দুইজনে হৈল গর্ভবতী। দোঁহে আশ্বাসিয়া বনে গেল মহামতি।। কত দিনে দুই জনে প্রসব করিল। সহস্রেক ডিম্ব প্রসবিল বিনতা সুন্দরী। রাখিল সকল ডিম্ব স্বর্ণপাত্রে ভরি।। পঞ্চশত বৎসরে জন্মিল নাগগণ। মুনি-বরে পায় কদ্রু সহস্র-নন্দন। বিনতা দেখিয়া তাপ হৃদয়ে ভাবিল। এককালে দুইজনে ডিম্ব প্রসবিল।। সহস্র পুত্রের কদ্রু জননী হইল। কি হেতু না জানি মোর পুত্র না জন্মিল।। এই ভাবি এক ডিম্ব বিনতা ভাঙিল। তাহাতে লোহিরবর্ণ পুত্র যে জন্মিল।। অর্দ্ধাঙ্গ-বিহীন হৈল পক্ষীর আকার। ক্রোধ করি জননীকে বলিল কুমার।। পরপুত্র দেখি হিংসা জন্মিল হৃদয়ে। অকালে ভাঙ্গিলা ডিম্ব, পূর্ণ নাহি হয়ে।। অঙ্গহীন করি মোরে জন্মাইলা তুমি। সে-কারণে জননী, শাপিব তোরে আমি।। যে ভগিনী-পুত্র দেখি হিংসা হৈল মনে। হইয়া তাহার দাসী সেব চিরদিনে।। এই ডিম্বে আছে যেবা পুরুষ-রতন। তাহা হৈতে হবে তব শাপ-বিমোচন।। মহা-বীর্য্যবান বীর এই ডিম্বে আছে। অকালে আমায় প্রায় ভাঙ্গি ফেল পাছে।। আপনি হইবে ভগ্ন সহস্র বৎসরে। এত বলি প্রবোধ করিল জননীরে।। হেনমতে একদিন দৈবের ঘটনে। কদ্রু আর বিনতা আছয়ে একস্থানে।। উচ্চৈঃশ্রবা অশ্ববর পরম সুন্দর। সূর্য্যের কিরণ নিন্দি তার কলেবর।। নানা রত্ন-অলঙ্কার অঙ্গেতে ভূষণ। মহাবীর্য্যবন্ত অশ্ব পবন-গমন।। সমুদ্র-মন্থনে সেই অশ্বের উৎপত্তি। এত শুনি মুনি জিজ্ঞাসিল সৌতি প্রতি।। সমুদ্র-মন্থন হৈল কিসের কারণ। কহ শুনি বিস্তারিয়া সূতের নন্দন।। ০০৯-সমুদ্র-মন্থন সৌতি বলে, অবধান কর মুনিগণ। যে হেতু হইল পূর্ব্বে সমুদ্র-মন্থন।। ব্রহ্মারে কহিল পূর্ব্বে দেব গদাধর। দেবাসুরগণ নিয়া মন্থহ সাগর।। অমৃত উৎপত্তি হবে সাগর-মন্থনে। দেবগণ অমর হইবে সুধা-পানে।। যত মহৌষধি আছে পৃথিবী-ভিতরে। মন্দর লইয়া মথ ফেলিয়া সাগরে।। বিষ্ণুর পাইয়া আজ্ঞা যত দেবগণ। মন্দর-পর্ব্বত যথা করিল গমন।। অতি উচ্চ গিরিবর পরশে গগন। ঊর্দ্ধে উচ্চ একাদশ-সহস্র যোজন।। উপাড়িতে বহু শক্তি কৈলা দেবগণে। না পারিয়া নিবেদিল বিষ্ণুর সদনে।। বিষ্ণুর আজ্ঞাতে সে অনন্ত মহীধর। উপাড়িয়া ভুজবলে আনিন মন্দর।। দেবগণ সব গেল সমুদ্রের তীরে। বরুণে বনিল, তুমি ধরহ মন্দরে।। বরুণ বলিল, গিরি বড়ই বিস্তার। মোর শক্তি নাহিক ধরিতে মহাভার। মন্দর ধরিতে এক আছয়ে উপায়। মোর জলে কূর্ম্ম আছে অতি মহাকায়।। এত শুনি দেবগণ কূর্ম্মে আরাধিল। মন্দর ধরিতে কূর্ম্ম অঙ্গীকার কৈল।। কূর্ম্মপৃষ্ঠে গিরিবর করিয়া স্থাপন। বাসুকি-নাগের দড়ি করিল যোজন।। পুচ্ছেতে ধরি দেব, মুখে দৈত্যগণ আরম্ভ করিল সিন্ধু করিতে মন্থন।। গিরি-ঘরষণে নাগ ছাড়য়ে নিশ্বাস। ধূম উপজিল তাহে ব্যাপিল আকাশ।। সেই ধূমে হৈল যত মেঘের জনম। বৃষ্টি করি সুরগণে খণ্ডাইল শ্রম।। ত্রিভুবন বিকম্পিত সর্পের গর্জ্জনে। অনেক মরিল দৈত্য বিষের জ্বলনে।। মন্দরের আন্দোলে বরুণ কম্পমান। জলচর জীব যত ত্যজিল পরাণ।। অগ্নি উঠে গিরি-বৃক্ষ-মূল ঘরষণে। পর্ব্বত-নিবাসী পোড়ে তাহার আগুনে।। দেখিয়া করিল দয়া দেব পুরন্দর। আজ্ঞায় বরিষে মেঘ পর্ব্বত উপর।। নির্ব্বাণ হইল অগ্নি জল-বরিষণে। ঔষধের বৃক্ষ যত হৈল ঘরষণে।। তাহার যতেক রস সমুদ্রে পড়িল। সেই রস পরশনে জলচর জীল।। হেনমতে দেব দৈত্য সমুদ্র মথিল। অনেক হইল শ্রম সুধা না মিলিল।। ব্রহ্মারে কহিল তবে সব দেবগণ। তোমার আজ্ঞায় হৈল সমুদ্র-মন্থন।। অমৃত না মিলে হৈল পরিশ্রম সার। পুনঃ মথিবারে শক্তি নাহি সবাকার।। এত শুনি ব্রহ্মা নিবেদিল নারায়ণে। অশক্ত হইল সবে সমুদ্র-মন্থনে।। তোমা বিনা সিন্ধু মথে কাহার শকতি। এত শুনি অঙ্গীকার করিল শ্রীপতি।। সব দেবগণ তবে বিষ্ণুদেজ পাইয়া। পুনরপি সিন্ধু মথে মন্দর ধরিয়া।। হেনমতে দেবাসুর মথন করিতে। দ্বিজরাজ-জন্ম তবে হৈল আচম্বিতে।। সুধাংশ ষোড়শ-কলা নাম ধরে সোম। দুই লক্ষ যোজনে করিল স্থিতি ব্যোম।। দরশনে অখিল জনের হৈল তৃপ্তি। যোজন পঞ্চাশ কোটি ব্রহ্মাণ্ডেতে দীপ্তি।। দেখি হরষিত হৈল সুরাসুর-নর। পুনরপি মথে সিন্ধু ধরিয়া মন্দর।। তবেত জন্মিল হস্তী, নাম ঐরাবত। শ্বেত-অঙ্গ চতুর্দ্দন্ত, আকারে পর্ব্বত।। মদিরা জন্মিল, অশ্ব উঠে উচ্চৈঃশ্রবা। পারিজাত-পুষ্পবৃক্ষ সুরপরী-শোভা।। অমৃতের কমণ্ডলু লৈয়া বাম কাঁখে। ধন্বন্তরি উঠিলেন, সুরাসুর দেখে।। রত্নগণ উপজিল, দেখে দেবগণ। আনন্দেতে পুনঃ সিন্ধু করয়ে মথন।। মন্দরের আন্দোল ক্ষীরোদ-সিন্ধু-মাঝ। না পারিল সহিতে বরুন জলারাজ।। পাত্র-মিত্রগণ ল’য়ে করিল বিচার। কিরূপে মথন হৈতে পাইব নিস্তার।। মন্ত্রী বলে, উপায় শুনহ মোর বাণী। শরণ লইবে চল যথা চক্রপাণি।। জনমিল যেই কন্যা কমল-কাননে। তাহা দিয়া পূজা কর দেব-নারায়ণে।। পূর্ব্বে নাম ছিল তাঁর লক্ষ্মী হরিপ্রিয়া। মুনি-শাপ-ভ্রষ্ট হৈয়া জন্মিল আসিয়া।। তাহার কারণে সিন্ধু হইল মথন। নিবারণ হবে, লক্ষ্মী পেলে নারায়ণ।। শুনি তবে জলরাজ বিলম্ব না কৈল। দিব্য-রত্নচয়ে চতুর্দ্দোল বানাইল।। আপনি লইল স্কন্ধে পুত্রের সহিতে। নারীগণ চামর ঢুলায় চারিভিতে।। সহস্র-ফনায় ছত্র শিরে ধরে শেষ। বাহির হইলা সিন্ধু হইলে জলেশ।। রূপেতে করিল আলো এ তিন ভুবন। মলিন হইল সূর্য্য-আদি জ্যোতির্গণ।। কমল জিনিয়া অঙ্গ অতি কোমলতা। কমল-বদন, চক্ষু কমলের পাতা।। দ্বিভুজা কমল-দন্তা চড়ি চতুর্দ্দোলে। কর-কমলেতে ধৃত যুগল কমলে।। যুগল কমল-পদ, কমল-আসনে। বিদ্যুত-বরণী, নানা রতনে ভূষণে।। স্থাবর জঙ্গম ক্ষিতি সমুদ্র আকাশ। দরশনে সবাকার হইল উল্লাস।। জীবাত্মা-বিহনে যেন হয় মৃত তনু। তেমতি ত্রৈলোক্য ছিল বিনা লক্ষী-জনু।। দেবকন্যা নাগকন্যা মানবী অপ্সরী। হুলাহুলি শব্দেতে পূরিল তিন পুরি।। দুন্দুভির শব্দে নৃত্য করে বরাঙ্গনা। ত্রৈলোক্যেতে জয় জয় হইল ঘোষণা।। ব্রহ্মা-ইন্দ্র আদি যত অমর-মণ্ডলে। করযোড়ে প্রণমি পড়িল ভূমিতলে।। চতুর্দ্দিকে স্তুতি করে দেব-ঋষিগণ। উত্তরিলা সন্নিকটে দেব-নারায়ণ।। প্রণমিয়া বরুণ পড়িল কত দূরে। আজ্ঞামাত্র উঠি দাঁড়াইল যোড়-করে।। কৃতাঞ্জলি করি বলে মৃদু-মন্দ-ভাষে। স্তুতি করে নারায়ণে অশেষ-বিশেষে।। তুমি সূক্ষ্ম, তুমি স্থুল, তুমি সর্ব্বব্যাপী। ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর, তুমি জগদব্যাপী।। স্থাবর জঙ্গম তুমি সিন্ধু ধরাধর। আকাশ পাতাল তুমি দেব নাগ নর।। তোমার সৃজন দেব এ তিন ভুবন। স্থানে স্থানে সকলেতে তোমা নিয়োজন।। ইন্দ্রে স্বর্গ দিলা, যমে সংযমনী-পুর। কুবেরে কৈলাস দিলা ধনের ঠাকুর।। জল মধ্যে আমারে করিয়া দিলা স্থিতি। তব আজ্ঞায় চিরকাল করি যে বসতি।। কোন দোষে দোষী নহি তব পদ্মপাদে। তবে কেন আমি এত পড়িনু প্রমাদে।। দ্বিতীয় সুমেরু-সম মন্দর পর্ব্বত। মোর-পুর মধ্যেতে মথিল অবিরত।। যোজন পঞ্চাশকোটি যে পৃথ্বি-বিস্তার। হেন ক্ষিতি তিলবৎ শিরে রহে যাঁর।। অবিরত সেই স্থল মন্থে সেই শেষ। সুরাসুর ত্রৈলোক্যেতে ঘর্ষণ বিশেষ।। জীব জন্তু যতেক আছিল যত জন। একটিও না রহিল লইয়া জীবন।। ভাঙ্গিল আমার পুর, হৈল লণ্ডভণ্ড। না জানি কাহার দোষে মোর হৈল দণ্ড।। এতকাল স্থান দিয়াছিলা সিন্ধুমাঝ। কোথায় রহিব আজ্ঞা কর দেবরাজ।। এতেক মিনতি যদি করিলা বরুণ। শুনিয়া করুণাময় হৈলা সকরুণ।। আশ্বাসি বলেন হরি, শুন জলেশ্বর। না করহ চিন্তা কিছু, না করিহ ডর।। দুর্ব্বাসার শাপে লক্ষ্মী ছাড়ি নিজ স্থল। তিনপুর ত্যজি প্রবেশিলা সিন্ধু-জল।। হতলক্ষ্মী হয়ে কষ্ট পায় সর্ব্বজন। সমুদ্র মথিল সবে তাহার কারণ।। লক্ষ্মী যদি মিলিল, মথনে কিবা কাজ। বিশেষ তোমার ক্লেশ হৈল জলরাজ।। এত বলি মথন করিল নিবারণ। শুনি হৃষ্টমতি হৈল বরুণ তখন।। সর্ব্ব-রত্ন-সার যেই ত্রৈলোক্য দুর্লভ। গোবিন্দের গলে মণি দিলেন কৌস্তভ।। চন্দ্র-সূর্য্য-প্রভা-জিনি যাহার কিরণ। নারায়ণ-বক্ষঃস্থলে হৈল সুশোভন।। মথন নিবারি চলিলেন হৃষীকেষ।। মভারতের কথা অমৃত লহরী। একমনে শুনিলে তরয়ে ভববারি।। ০১০-নারদ কর্ত্তৃক মহাদেবের নিকট সমুদ্র-মন্থনের সংবাদ প্রদান সুরাসুর যক্ষ রক্ষ ভুজঙ্গ কিন্নর। সবে সিন্ধু মথিল, না জানে মহেশ্বর।। দেখিয়া নারদ মুনি হৃদয়ে চিন্তিত। কৈলাসে হরের ঘরে হৈল উপনীত।। প্রণমিলা শিব-দুর্গা দোঁহার চরণ। আশিস্ করিয়া দেবী দিলেন আসন।। দেবী জিজ্ঞাসিলা, কহ ব্রহ্মার নন্দন। কোথা হতে হেথা তব হল আগমন।। নারদ বলেন, আমি ছিনু সুরপুরে। শুনিনু মথিল সিন্ধু যত সুরাসুরে।। বিষ্ণু পায় কমলা কৌস্তুভ-মণি-আদি। ইন্দ্র উচ্চৈঃশ্রবা ঐরাবত গজনিধি।। নানারত্ন পায় লোক, জল জলধর। অমৃত অমর-বৃন্দ কল্পতুরু বর।। নানা ধাতু মহৌষধি পায় নরলোক। এই হেতু হৃদয়ে জন্মিল বড় শোক।। স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতালে আছয়ে যতজনে। সবে ভাগ পাইল কেবল তোমা বিনে।। সে কারণে তত্ত্ব নিতে আইলাম হেথা। সবার ঈশ্বর তুমি বিধাতার ধাতা।। তোমারে না দিয়া ভাগ সবে বাঁটি লৈল। এই হেতু মোর চিতে ধৈর্য্য নাহি হৈল।। এতেক নারদ মুনি বলিল বচন। শুনি কিছু উত্তর না কৈল ত্রিলোচন।। তাহা দেখি ক্রোধে সকম্পিতা ত্রিলোচনা। নারদেরে কহে তবে করিয়া ভৎসনা।। কাহারে এতেক বাক্য বল মুনিবর। বৃক্ষেরে বলিলে যেন না পায় উত্তর।। কণ্ঠেতে হাড়ের মালা বিভূষণ যার। কৌস্তুভাদি-মণি-রত্নে কি কাজ তাহার।। কি কাজ চন্দনে, যার বিভূষণ ধূলি। অমৃতে কি কাজ, যার ভক্ষ্য সিদ্ধি-গুলি।। মাতঙ্গে কি কাজ, যার বলদ-বাহন। পারিজাতে কিবা কাজ, ধুতুরা ভূষণ।। এ সকল চিন্তি মোর অঙ্গ জরজর। পূর্ব্বের বৃত্তান্ত সব জান মুনিবর।। জানিয়া উহারে দক্ষ পূজা না করিল। সেই অভিমানে তনু ত্যজিতে হইল।। দেবীবাক্য শুনি হাসি বলেন ঈশান। যে বলিলা হৈমবতী কিছু নহে আন।। বাহন ভূষণে মোর কিবা প্রয়োজন। আমি লই তাহা, যাহা ত্যজে অন্য জন।। ভক্তিতে করিয়া বশ মাগিলেন দাস। অম্লান অম্বর পট্টাম্বর দিব্য-বাস।। ঘৃনা করি ব্যাঘ্রচর্ম্ম কেহ না লইল। তাই মোরে বাঘাম্বর পরিতে হইল।। অগুরু চন্দন নিল কুঙ্কুম কস্তূরী। বিভূতি না লয় তাই সমাদরে ধরি।। মণি-রত্ন হার নিল মুকুতা প্রবাল। কেহ না লইল, তাই পরি হাড়মাল।। ধুতুরা-কুসুম নাহি লয় কোন জন। তাই কর্ণে ধুতুরা করিনু বিভূষণ।। রথ গজ লইল বাহন পরিচ্ছদ। কেন নাহি লয় তাই আছয়ে বলদ।। অজ্ঞান তিমিরে দক্ষ মোহিত হইল। মোহে মত্ত হয়ে দক্ষ যজ্ঞ যে করিল।। সকল দেবেরে পূজি মোরে না পূজিল। সমুচিত দণ্ড তার তখনি পাইল।। পশুর সদৃশ হৈল ছাগলের মুণ্ড। মূত্র-পুরীষেতে পূর্ণ হৈল যজ্ঞকুণ্ড।। ব্রহ্মা বিষ্ণু ইন্দ্র যম বরুণ তপন। মোরে না পূজিয়া দেবী আছে কোন্ জন।। স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতালেতে দেখ জীবগণে। আমা ছাড়া কেবা আছে এ তিন ভুবনে।। দেবী বলে, দারাপুত্রে গৃহী যেই জন। তাহারে না হয় যুক্ত এ সব বচন।। বিভূতি-বৈভব-বিদ্যা সঞ্চয়ে যতনে। সংসারে বিমুখ ইথে আছে কোন্ জনে।। সংসারেতে যে জন বিমুখ ও সকলে। কাপুরুষ বলিয়া তাহারে লোকে বলে।। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-ইন্দ্র আদি যেমন পূজিত। সাক্ষাতেই সে সকল হইল বিদিত।। রত্নাকর মথি সবে নিল রত্নধন। কেহ না পুছিল তোমা করিয়া হেলন।। পার্ব্বতীর হেন বাক্য শুনিয়া শঙ্কর। ক্রোধেতে অবশ অঙ্গ কাঁপে থরথর।। কাশীরাম কহে, কাশীপতি ক্রোধমুখে। বৃষভ সাজাতে আজ্ঞা করিল নন্দীকে।। মহাভারতের কথা অমৃত-সমান। কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।। ০১১-সমুদ্র-মন্থন-স্থানে মহাদেবের আগমন পার্ব্বতীর কটুভাষ, শুনি ক্রোধে দিগ্ বাস, টানিয়া বান্ধিল ব্যাঘ্র-বাস। বাসুকি-নাগের দড়ি, কাঁকালে বান্ধিল বেড়ি, করে তুলি নিল মৃগ-বাস।। কপালেতে শশীকলা, গলে শোভে হাড়মালা, করযুগে কঞ্চুক-কঙ্কণ। ভানু বৃহদ্ভানু শশী, ত্রিবিধ প্রকারে ভূষি, ক্রোধে যেন প্রলয়-কিরণ।। যেন গিরি হেমকূটে, আকাশে লহরী উঠে, ভ্রমে গঙ্গা মধ্যে জটাজূটে। রজতাগরির আভা, কোটিচন্দ্র মুখশোভা, ফণি-মণি বিরাজে মুকুটে।। গলে দোলে কাল সাপ, টঙ্কারি পিনাক-চাপ, ত্রিশূল খট্টাঙ্গ নিলা করে। সাজিল শিবের সেনা, যক্ষ রক্ষ অগণনা, ভূত প্রেত ভূচর খেচরে।। আগে ধায় যত দানা, কান্ধেতে আয়ুধ নানা, মুখরবে মহা কোলাহল। ডমরুর ডিমি ডিমি, আকাশ-পাতাল-ভূমি, কম্পান্বিত ত্রৈলোক্য-মণ্ডল।। বৃষভ সাজায়ে বেগে, আনি নন্দী দিল আগে, নানা রত্নে করিয়া ভূষণ। ক্রোধে কাঁপে ভূতনাথ, যেন কদলীর পাত, অতি শীঘ্র কৈল আরোহণ।। আগুদলে সেনাপতি, ময়ূর বাহনে গতি, শক্তি করে দেব ষড়ানন। গণেশ চড়িয়া মূষ, করে ধরি পাশাঙ্কুশ, দক্ষিণ ভাগেতে ক্রোধ মন।। বামে নন্দী মহাকাল, করে শূল সুবিশাল, পাশে ভৃঙ্গী ধায় তিন পাদে। চলিলেন দেবরাজ, দেখিয়া শিবের সাজ, তিন লোক গণিল প্রমাদে।। ক্ষণেকে ক্ষীরোদ-কূলে, উত্তরিলা দলবলে, যথা ছিল সবে সুরাসুর। কহে কাশীদাস দেবে, দ্রুততর-গতি সবে, প্রণময়ে দেখিয়া ঠাকুর।। ০১২-পুনর্ব্বার সিন্ধু-মন্থন ও মহাদেবের বিষপান করযোড়ে দাঁড়াইল সব দেবগণে। শিব বলে মথ সিন্ধু, থামাইলে কেনে।। ইন্দ্র বলে, মথন হইল দেব শেষ। নিবারিয়া আপনি গেলেন হৃষীকেশ।। একে ক্রোধে আছিলেন দেব-মহেশ্বর। তাহাতে ইন্দ্রের বাক্যে কম্পে কলেবর।। শিব বলে, এত গর্ব্ব তোমা সবাকার। আমারে হেলন কর করি অহঙ্কার।। রত্নাকর মথি রত্ন নিলা সবে বাঁটি। কেহ চিত্তে না করিলা আছয়ে ধূর্জ্জটি।। যা করিলা তাহা কিছু নাহি করি মনে। আমি মথিবারে বলি করহ হেলনে।। এতেক বলিলা যদি দেব-মহেশ্বর। ভয়েতে দেবেরা কেহ না কৈল উত্তর।। নিঃশব্দে রহিল যত দেবের সমাজ। করযোড়ে বলয়ে কশ্যপ মুনিরাজ।। অবধান কর দেব পার্ব্বতীর কান্ত। কহিব ক্ষীরোদ-সিন্ধু মথন বৃত্তান্ত।। পারিজাত মাল্য দুর্ব্বাসার গলে ছিল। স্নেহে সেই মাল্য মুনি ইন্দ্র-গলে দিল।। গজরাজ আরোহণে ছিল পুরন্দর। সেই মাল্য দিল তার দন্তের উপর।। সহজে মাতঙ্গ অনুক্ষণ মদে মত্ত। পশুজাতি নাহি জানে মালা মুনিদত্ত।। শুণ্ডে জড়াইয়া মালা ফেলিল ভূতলে। দেখিয়া দুর্ব্বাসা ক্রোধে অগ্নি-সম জ্বলে।। অহঙ্কারে ইন্দ্র মোরে অবজ্ঞা করিল। মোর দত্ত পুষ্পমাল্য ছিঁড়িয়া ফেলিল।। সম্পদে হইয়া মত্ত তুচ্ছ কৈল মোরে। দিল শাপ হবে হতলক্ষ্মী পুরন্দরে।। ব্রহ্মশাপে লোকমাতা প্রবেশিলা জলে। লক্ষ্মী-বিনা কষ্ট হৈল ত্রৈলোক্য-মণ্ডলে।। লোকের কারণে ব্রহ্মা কৃষ্ণে নিবেদিল। সমুদ্র মথিতে আজ্ঞা নারায়ণ কৈল।। এই হেতু ক্ষীরোদ মথিলা পুরন্দর। শেষ মথনের দড়ি, মথনি মন্দর।। অনেক উৎপাত হৈল বরুণের পুরে। লক্ষ্মী দিয়া আসি স্তব কৈল গদাধরে।। নিবারিয়া মথন গেলেন নারায়ণ। পুনঃ তুমি আজ্ঞা কর মথন-কারণ।। বিষ্ণু বলে বড় বলী আছিল অমর। এবে বিষ্ণু বিনা শ্রান্ত সব কলেবর।। দ্বিতীয়ে মথন-দড়ি নাগরাজ শেষ। সাক্ষাতে আপনি দেব দেখ তার ক্লেশ।। অঙ্গের যতেক হাড় সব হৈল চূর। সহস্র-মুখেতে লাল বহিছে প্রচুর।। বরুণের যত কষ্ট না যায় কথন। আর আজ্ঞা নাহি কর করিতে মথন।। শিব বলে, আমা হেতু মথ একবার। আগমন অকারণ না হৌক্ আমার।। শিব-বাক্য কার শক্তি লঙ্ঘিবারে পারে। পুনরপি মথন করিল সুরাসুরে।। শ্রমেতে অশক্ত-কলেবর সর্ব্বজনা। ঘনশ্বাস বহে যেন আগুনের কণা।। অত্যন্ত ঘর্ষণে তবে মন্দর পর্ব্বত। সুতপ্ত হইল গিরি মহা অগ্নিবৎ।। ছিণ্ডি খণ্ড খণ্ড হৈল নাগের শরীর। ক্ষীরোদ-সমুদ্রে সব বহিল রুধির।। অত্যন্ত ঘর্ষণ নাগ সহিতে নারিল। সহস্র-মুখের পথে গরল বহিল।। সিন্ধুর ঘর্ষণ-অগ্নি সর্পের গরল। দেবের নিশ্বাস-অগ্নি, মন্দর-অনল।। চারি অগ্নি মিশ্রিত হইয়া এক হৈল। সিন্ধু হতে আচম্বিতে বাহির হইল।। প্রাতঃ হৈতে দিনকর তেজ যেন বাড়ে। দাবানল-তেজে যেন শুষ্ক বন পোড়ে।। যুগান্তের কালে যেন সমুদ্রের জল। মুহূর্ত্তে ব্যাপিল তথা সংসার সকল।। দহিল সবার অঙ্গ বিষের জ্বলনে। সহিতে না পারি ভঙ্গ দিল সর্ব্বজনে।। পলায় সহস্রচক্ষু কুবের বরুণ। প্রলয় সমান অগ্নি দেখিয়া দারুণ।। অষ্টবসু নবগ্রহ অশ্বিনী-কুমার। অসুর রাক্ষস যক্ষ যত ছিল আর।। পলাইয়া গেল যত ত্রৈলোক্যের জন। বিষণ্ন বদনে তবে চাহে ত্রিলোচন।। দূরে থাকি দেবগণ সবে করে স্তুতি। রক্ষা কর ভূতনাথ অনাথের গতি।। তোমা বিনা রক্ষাকর্ত্তা নাহি দেখি আন। সংসার হইল নষ্ট তোমা বিদ্যমান।। রাখ রাখ বিশ্বনাথ, বিলম্ব না সয়। ক্ষণেক রহিলে আর হইবে প্রলয়।। দেবের বিষাদ দেখি কাকুতি-স্তবন। বিষে দগ্ধ হয়ে সৃষ্টি দেখি ত্রিলোচন।। বিশেষে চিন্তেন পূর্ব্বকৃত অঙ্গীকার। এবার মথনে সিন্ধু-রত্ন যে আমার।। আপন অর্জ্জিত তাহে সৃষ্টি করে নাশ। হৃদয়ে চিন্তিয়া আগু হেন কৃত্তিবাস।। সমুদ্র জুড়িয়া বিষ আকাশ পরশে। আকর্ষণ করি হর নিলেন গণ্ডূষে।। দূরে থাকি সুরাসুর দেখয়ে কৌতুকে। করিলেন বিষপান একই চুমুকে।। অঙ্গীকার-পালন স্বধর্ম্ম দেখাবারে। কণ্ঠেতে রাখেন বিষ, না লন উদরে।। নীলবর্ণ কণ্ঠ অদ্যাপিহ বিশ্বনাথ। নীলকণ্ঠ নামে তাই হইল বিখ্যাত।। আশ্চর্য্য দেখিয়া যত ত্রৈলোক্যের জন। কৃতাঞ্জলি করি হরে করেন স্তবন।। তুমি ব্রহ্মা, তুমি বিষ্ণু, ধনের ঈশ্বর। যম সূর্য্য বায়ু সোম তুমি বৈশ্বানর।। তুমি শেষ বরুণ নক্ষত্র বসু রুদ্র। তুমি স্বর্গ ক্ষিতি অধঃ পর্ব্বত সমুদ্র।। যোগ জ্ঞান বেদ শাস্ত্র তুমি যজ্ঞ জপ। তুমি ধ্যান ধারণা, তুমি সে উগ্রতপ।। অকালে করিলে তুমি এ মহাপ্রলয়। কি করিব আজ্ঞা এবে দেহ মৃত্যুঞ্জয়।। এত শুনি আজ্ঞা দিল দেব মহেশ্বর। রাখ নিয়া যথাস্থানে আছিল মন্দর।। মথন-নিবৃত্তি কর, নাহি আর কাজ। অনেক পাইলে কষ্ট দেবের সমাজ।। এত শুনি আনন্দিত হৈল দেবগণ। মন্দর লইতে সবে করিল যতন।। অমর তেত্রিশ কোটি অসুর যতেক। মন্দর তুলিতে যত্ন করিল অনেক।। কারো শক্তি নহিল তুলিতে গিরিবর। তুলিয়া লইল গিরি শেষ বিষধর।। যথাস্থানে মন্দর থুইল লয়ে শেষ। নিবারিয়া গেল সবে যার যেই দেশ।। কাশীরাম দাস কহে করিয়া মিনতি। অনুক্ষণ নীলকণ্ঠ পদে থাক্ মতি।। মহাভারতের কথা সুধা হৈতে সুধা। করিলে শ্রবণে পান যায় ভব-ক্ষুধা।। ০১৩-অমৃতের নিমিত্ত সুরাসুরের দ্বন্দ্ব ও শ্রীকৃষ্ণের মোহিনীরূপ ধারণ মুনিগণ বলে শুন সূতের নন্দন। শুনিলাম যে কথা সে অদ্ভূত কথন॥ অমর অসুর মিলি সমুদ্র মথিল। উপজিল যত রত্ন দেবতারা নিল॥ রত্নের বিভাগ কিছু পায় কি অসুর। কহ শুনি সূতপুত্র শ্রবণে মধুর॥ সৌতি বলে দৈত্যগণ একত্র হইয়া। দেবগণ হৈতে সুধা লইল কাড়িয়া॥ সবে শ্রম করিলেন সমুদ্র মন্থনে। যে কিছু উঠিল সব নিল দেবগণে॥ ঐরাবত হস্তী নিল বাজী উচ্চৈঃশ্রবা। লক্ষ্মী কৌস্তুভাদি মণি শত-চন্দ্র আভা॥ অমরের ভাগে পাছে হয় সুধা হাণ্ডি। সকল লইল যেন শিশুগণে ভাণ্ডি॥ এত বলি কাড়িয়া লইল দৈত্যগণ। দেব-দৈত্যে কলহ হইল ততক্ষণ॥ মধ্যস্থ হইয়া হর কলহ ভাঙ্গিয়া। তবে দৈত্যগণ প্রতি কহেন ডাকিয়া॥ অকারণে দ্বন্দ্ব সবে কর কি কারণ। সবার অর্জ্জিত সুধা লহ সর্ব্বজন॥ শিবের বচনে সবে নিবৃত্ত হইল। কে বাটিয়া দিবে সুধা সকলে কহিল॥ হেনকালে নারায়ণ ধরিয়া স্ত্রীবেশ। ধীরে ধীরে উপনীত হৈল সেই দেশ॥ রূপেতে হইল আলো চতুর্দ্দশ পুর। সুবর্ণ-রচিত তাঁর চরণে নূপুর॥ কোকনদ জিনি পদ মনোহর গতি। যে চরণে জন্মিলেন গঙ্গা ভাগীরথী॥ যার গন্ধে মকরন্দ ত্যজি অলিবৃন্দ। লাখে লাখে পড়ে ঝাঁকে পেয়ে মধুগন্ধ॥ যুগ্ম ঊরু রম্ভাতরু চারু দুই হাত। মধ্যদেশ হেরি ক্লেশ পায় মৃগনাথ॥ নাভিপদ্ম জিনি পদ্ম অপূর্ব্ব-নির্ম্মাণ। কুচযুগ ভরা বুক দাড়িম্ব সমান॥ ভুজ সম ভুজঙ্গম মৃণাল জিনিয়া। সুরাসুর মূর্চ্ছাতুর যাহারে হেরিয়া॥ পদ্মবর জিনি কর চম্পক অঙ্গুলি। নখবৃন্দ জিনি ইন্দু প্রভা গুণশালী॥ কোটি কাম জিনি ধাম বদন-পঙ্কজ। মনোহর ওষ্ঠাধর গরুড়-অগ্রজ॥ নাসিকায় লজ্জা পায় শুষ্ক-চঞ্চুখানি। নেত্রদ্বয় শোভা হয় নীলপদ্ম জিনি॥ পুষ্পচাপ হরে দাপ ভ্রু-দ্বয় ভঙ্গিমা। ভালে প্রাতঃ দিননাথ দিতে নারে সীমা॥ পীতবাস করে হাস স্থির সৌদামিনী। দন্তপাঁতি করে দ্যুতি মুক্তার গাঁথনি॥ দীর্ঘকেশে পৃষ্ঠদেশে বেণী লম্বমান। আচম্বিতে উপনীত সবা বিদ্যমান॥ দৃষ্টিমাত্রে সর্ব্বগাত্রে কামাগ্নি দহিল। সুরাসুর তিনপুর ঢলিয়া পড়িল॥ সবে মূর্চ্ছাগত হৈল দেখিয়া মোহিনী। কতক্ষণে চেতন পাইল শূলপাণি॥ মোহিনীর প্রতি হর একদৃষ্টে চান। দুই ভূজ প্রসারিয়া ধরিবারে যান॥ কন্যা বলে যোগী তোর কেমন প্রকৃতি। ঘনাইয়ে আস বুড়া হ’য়ে ছন্নমতি॥ এত বলি নারায়ণ যান শীঘ্রগতি। পাছে পাছে ধাইয়া চলেন পশুপতি॥ হর বলে হরিণাক্ষি মুহূর্ত্তেক রহ। দাঁড়াইয়া তুমি মোরে এক কথা কহ॥ কে তুমি কোথায় থাক কাহার নন্দিনী। কি হেতু আইলে তুমি কহ সত্যবাণী॥ ত্রৈলোক্যের মধ্যে যত আছে রূপবতী। তব পদ-নখ-তুল্য নহে কার’ জ্যোতি॥ দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, শচী, অরুন্ধতী। উর্ব্বশী, মেনকা, রম্ভা, তিলোত্তমা, রতি॥ নাগিনী, মানুষী, দেবী ত্রৈলোক্যবাসিনী। সবে মোরে জানে আমি সবাকারে জানি॥ ব্রহ্মাণ্ডে আছহ কভু না শুনি না দেখি। কোথা হৈতে এলে কহ সত্য শশীমুখী॥ কন্যা বলে বুড়া তোর মুখে নাহি লাজ। তোরে পরিচয় দিতে আমার কি কাজ॥ তৈল বিনে বিভূতি মাথায় জটাভার। তাম্বূল বিহনে দন্ত স্ফটিক আকার॥ বসন না মিলে পরিধান ব্যাঘ্রছড়ি। দীঘল করের ন’খ পাকা গোঁফদাড়ী॥ অঙ্গের দুর্গন্ধে উঠে মুখেতে বমন। না জানি আছয়ে কি না বদনে দশন॥ মম অঙ্গ গন্ধে দেখ ব্রহ্মাণ্ড পূরিত। অঙ্গের ছটাতে দেখ ত্রৈলোক্য দীপিত॥ কোন লাজে চাহ তুমি করিতে সম্ভাষ। কেমন সাহসে তুমি আইস মম পাশ॥ ০১৪-মোহিনীরূপী হরির সহিত হরের মিলন হর বলে, হরিণাক্ষি! কেন দেহ তাপ। মোর সহ কভু তব নাহিক আলাপ।। ত্রৈলোক্যের মধ্যে যত আছে মহাপ্রাণী। সবার ঈশ্বর আমি, শুন বরাননি।। ব্রহ্মার পঞ্চম শির নখেতে ছেদিল। বহুকাল সেবি বিষ্ণু অভয় পাইল।। ইন্দ্র যম বরুণ কুবের হুতাশন। সব লোকপাল করে মোর আরাধন।। জ্ঞানযোগে মৃত্যু আমি করিলাম জয়। আমার নয়নানলে কাম ভস্ম হয়।। মহামায়া বল যারে ত্রৈলোক্যে মোহিনী। বিষ্ণু-অংশ জাত গঙ্গা ত্রিপথ-গামিনী।। দাসী হয়ে সেবে মোর চরণ-অম্বুজে। মনোমত বর লভে, মোরে যেই ভজে।। ত্যজ মান মনোরমে করহ সম্ভাষ। আমারে ভজিলে হবে সিদ্ধ অভিলাষ।। কন্যা বলে, যোগী তোরে জানিনু এখন। তোরে মহেশ্বর বলি ডাকে সর্ব্বজন।। ব্যর্থ জপ তপ তোর ব্যর্থ যোগ ধ্যান। ব্যর্থ তোর পঞ্চ-মুখে রাম-নাম গান।। ব্যর্থ জটাভার রাখ ব্যর্থ তুমি যোগী। ভণ্ডতা করিয়া লোকে বলাহ বৈরাগী।। হর বলে, মনোরমে! কর অবধান। তব অঙ্গ দেখি মোর হরিল যে জ্ঞান।। করিলাম এক দাম দহন নয়নে। কোটি কাম জ্বলিতেছে তব চক্ষুকোণে।। তপ জপ যোগ ধ্যান জ্ঞানের বৈরাগ্য। এ সকল কর্ম্ম যদি হয়, শ্রেষ্ঠ ভাগ্য।। এই বাঞ্ছা হয়, তুমি করহ পরশ। আলিঙ্গন দেহ তুমি হইয়া হরষ।। যতেক করিনু তপ জপ হরি নাম। জটা ভস্ম দিগ্বাস শ্মশানেতে ধাম।। তার সমুচিত ফল মিলাইল বিধি। এতকালে পাইলাম তোমা হেন নিধি।। সর্ব্বকর্ম্ম সমর্পণ করিনু চরণে। কৃপা করি আলিঙ্গন দেহ বরাননে।। হরবাক্য শুনি হাসি বলে হয়গ্রীব। অপ্রাপ্য দ্রব্যের কেন বাঞ্ছা কর শিব।। সর্ব্ব কর্ম্ম ত্যজিবারে পারে যেই জন। অন্যমনা না হবে, আমাতে একমন।। কায়-মনোবাক্যে করে আমারে ভজন। সে জনেরে যাচি আমি দিব আলিঙ্গন।। শিব বলে, কন্যা এই সত্য অঙ্গীকার। আজি হৈতে তোমা বিনা নাহি জানি আর।। ত্যজিলাম সর্ব্ব কর্ম্ম ভার্য্যা-পুত্রগণ। সেবিব তোমার পদ দেহ আলিঙ্গন।। নারী বলে, কত মোরে করহ ছলন। কেমনে ত্যজিবা তুমি ভার্য্যা-পুত্রগণ।। এক ভার্য্যা রাখিয়াছ জটার ভিতর। আর ভার্য্যা করিয়াছ অর্দ্ধ কলেবর।। হর বলে, হরিণাক্ষি কেন হেন কহ। ত্যজিয়া কপট মোরে কর অনুগ্রহ।। কি ছার সে নারী পুত্র, নাম লহ তার। শত শত গঙ্গা দুর্গা নিছনি তোমার।। দাসী হয়ে সেবিবে সে, আমি হৈব দাস। কৃপা করি বরাননে পূর মোর আশ।। যদি তুমি নিশ্চয় না দিবা আলিঙ্গন। তোমার সম্মুখে আমি ত্যজিব জীবন।। নেউটিয়া মোর পানে চাহ চারুমুখে। হের, মরি ত্রিশূল মারিয়া নিজ বুকে।। এত বলি ত্রিশূল নিলেন ভূতনাথ। হাসিতে হাসিতে তবে বলেন শ্রীনাথ।। বুঝিলাম গঙ্গাধর! তোমার যে জ্ঞান। কামে বশ হয়ে চাহ ত্যজিবারে প্রাণ।। ধৈর্য্য ধর, ত্যজ খেদ, চিত্ত কর স্থির। দিব আলিঙ্গন, তুমি না ত্যজ শরীর।। নাহি জান বিশ্বনাথ আমার হৃদয়। ভকত-জনেরে আমি দানি যে অভয়।। যে জন যেমন কাম মাগে মোর স্থান। দিই তারে অবশ্য না হয় কভু আন।। বিশেষে আমাকে পূর্ব্বে মাগিয়াছ তুমি। অর্দ্ধ অঙ্গ দিব অঙ্গীকার কৈনু আমি।। এত বলি আলিঙ্গন দিতে জগন্নাথ। আইস বলিয়া বিস্তারেন দুই হাত।। আলিঙ্গনে যুগল-শরীর হৈল এক। অর্দ্ধ ভস্ম-ভূষা হৈল, কস্তূরী অর্দ্ধেক।। অর্দ্ধ জটাজূট, অর্দ্ধ চিকুর চাঁচর। অর্দ্ধেক কিরীটী, অর্দ্ধ ফণি-ফণাধর।। কস্তূরী তিলক অর্দ্ধ, অর্দ্ধ শশিকলা। অর্দ্ধ-গলে হাড়মালা, অর্দ্ধে বনমালা।। মকর-কুণ্ডল কর্ণে, কুণ্ডলী-কুণ্ডল। শ্রীবৎস-লাঞ্ছন অর্দ্ধ শোভিত গরল।। অর্দ্ধ মলয়জ, অর্দ্ধ ভস্ম কলেবর। অর্দ্ধ কটি বাঘাম্বর, অর্দ্ধ পীতাম্বর।। এক পদে ফণী, অন্যে কনক নূপুর। শঙ্খ-চক্র করে শোভে, ত্রিশূল ডম্বুর।। শিব-দুর্গা বিষ্ণু-লক্ষ্মী, চারি মূর্ত্তি হেরি। কাশীদাস করে আশ, তরি ভব-বারি।। চারি মূর্ত্তি হেরিলেই মিলে চারি ফল। ০১৫-সুধাবণ্টন ও রাহু-কেতুর বিবরণ সৌতি বলে, সাবধানে শুন মুনিগণ। কহিনু অপূর্ব্ব হরি-হরের মিলন।। দেবগণ-রক্ষা হেতু দেব ভগবান্। পুনরপি আইলেন সবা বিদ্যমান।। হেথা সুরাসুর সবে পাইয়া চেতন। কোথা কন্যা, কোথা কন্যা, করে অন্বেষণ।। হেনকালে নারী-বেশে দেখে নারায়ণে। এই এই বলিয়া ধাইল সর্ব্বজনে।। চতুর্দ্দিক হইতে ধাইল সুরাসুর। কন্যারে বেড়িল সবে করি লক্ষপুর।। চিত্তের পুত্তলী প্রায় চাহে সর্ব্বজন। ততক্ষণে নারায়ণ বলেন বচন।। এই ক্ষীর -সিন্ধু মধ্যে আমার বসতি। মোহিনী আমার নাম, সমুদ্রে উৎপত্তি।। সহিতে নারিনু অনুক্ষণ কলবর। কি হেতু কলহ কর তোমরা এ সব।। এত শুনি কহিতে লাগিল সর্ব্বজন। অসুর-অমর-দ্বন্দ্ব অমৃত কারণ।। ভাল হৈল, তোমা সহ হইল মিলন। আপনি থাকিয়া দ্বন্দ্ব কর নিবারণ।। বাঁটি দেহ সুধা, দ্বন্দ্ব হৌক সমাধান। তুমি যে করিবা তাহা না করিব আন।। কন্যা বলে, এত দ্বন্দ্বে আমার কি কাজ। কভু না মধ্যস্থ হৈব সুরাসুর-মাঝ।। আমার বিধান যদি নাহি লয় মন। সবে ক্রোধ করিলে কি করিব তখন।। তাহা শুনি ডাকি তবে বলে সর্ব্বজন। সত্য কহি, না লঙ্ঘিব তোমার বচন।। এতেক সবার মুখে শুনি দৃঢ়বাণী। কহিতে লাগিল তবে দেব চক্রপাণি।। তোমা সবাকার বাক্য না করিব আন। আনি দেহ সুধাভাণ্ড আমা-বিদ্যমান।। দুই পংক্তি হইয়া বৈসহ সর্ব্বজন। একভিতে দৈত্য, একভিতে দেবগণ।। মায়াবীর মায়াতে মোহিত সর্ব্বজন। সুধাভাণ্ড আনিয়া দিলেক ততক্ষণ।। দুই পংক্তি বসিল লইয়া পত্রাসন। কাঁখে সুধাভাণ্ড করি করেন বণ্টন।। দেবতার জ্যেষ্ঠ ভাগ বলেন মোহিনী। দেবে সুধা বিতরিতে যুক্তি আগে মানি।। দৈত্যগণ বলিল, যেমত তব মতি। শুনিয়া বাঁটেন সুধা তবে লক্ষ্মীপতি।। ইন্দ্র যম কুবের আদিত্য হুতাশন। ইত্যাদি তেত্রিশ কোটি যত দেবগণ।। সবাকারে ক্রমে সুধা বাঁটিয়া মোহিনী। অবশেষে যত ছিল খাইল আপনি।। হেনকালে ডাকিয়া বলেন রবি শশী। দেখ দেখ রাহু-দৈত্য সুধা খায় আসি।। শুনি সুদর্শনে আজ্ঞা দেন নারায়ণ। চক্রেতে অসুর-মুণ্ড করিল ছেদন।। তথাপি না মরিলেক সুধাপান হেতু। মুখ হৈল রাহু, কলেবর হৈল কেতু।। দৈত্যে মারি সুধা হরি হৈল অন্তর্ধান। দেখি ক্রোধে কম্পাম্বিত হৈল দৈত্যগণ।। মারহ অমরগণে বলিয়া উঠিল। প্রলয়কালেতে যেন সিন্ধু উথলিল।। নানা অস্ত্র শস্ত্র সবে বরিষে প্রচুর। কে বর্ণিতে পারে যুদ্ধ কৈল সুরাসুর।। সুধাপানে বলবান্ যতেক অমর। মথনেতে দৈত্যগণ ক্লান্ত কলেবর।। না পারিয়া ভঙ্গ দিয়া গেল দৈত্যজন। আপন আলয়ে চলি গেলা দেবগণ।। ভারতের পুণ্যকথা শুনে পুণ্যবান। কাশীরাম কহে, কলি-ভয়ে পরিত্রাণ।। ০১৬-নাগগণের প্রতি কদ্রুর অভিসম্পাত ও বিনতার দাসীত্ব বিবরণ শৌনকাদি মুনিগণ সৌতিরে পুছিল। কদ্রু আর বিনতায় কি প্রসঙ্গ হৈল।। সৌতি বলে, দুই জন দেখি তুরঙ্গম। সর্ব্ব সুলক্ষণ অশ্ব অতি মনোরম।। কদ্রু বলে, বিনতা দেখহ অশ্ববর। কোন্ বর্ণ ধরে অশ্ব পরম সুন্দর।। বিনতা কহিল, অশ্ব শ্বেতবর্ণ ধরে। তুমি কোন্ বর্ণ দেখ, কহ দেখি মোরে।। কদ্রু বলে, কৃষ্ণবর্ণ হয় অশ্ববর। দুই জনে বিতণ্ডা যে হইল বিস্তর।। কদ্রু বলে, বিনতা কোন্দল কি কারণ। দুই জনে এস তবে করি কিছু পণ।। দাসী হয়ে থাকিবেক যেই জন হারে। নির্ণয় করিয়া দোঁহে চলি গেল ঘরে।। অস্ত গেল দিনমণি, দৃষ্টি নাহি চলে। কল্য আসি তুরঙ্গম দেখিব সকালে।। এত বলি চলি গেল যে যাহার গৃহে। পণের কারণে কিন্তু মনস্থির নহে।। সহস্রেক পুত্রে কদ্রু আনিল ডাকিয়া। কহিল বৃত্তান্ত যত পুত্রে বসাইয়া।। পুত্রগণ বলে মাতা কি কর্ম্ম করিলে। শ্বেতবর্ণ উচ্চৈঃশ্রবা খ্যাত ভূমণ্ডলে।। কদ্রু বলে, অশ্ব যদি ধবল-আকার। কৃষ্ণাঙ্গ যেমতে হয়, কর প্রতিকার।। বিনতার সহ আমি করিয়াছি পণ। হারিলে হইব দাসী, না হয় খণ্ডন।। এত শুনি নাগগণ বিরস-বদন। মায়ের চরণে তবে করে নিবেদন।। যেমন জননী তুমি তেমন বিনতা। কপটেতে দিব দুঃখ, ভাল নহে কথা।। শুনিয়া কুপিল কদ্রু, দিল শাপবাণী। জন্মেজয়-যজ্ঞে ভ্স্ম হৈবে সব ফণী।। কদ্রু শাপ দিল যদি, আনন্দিত ধাতা। ইন্দ্র সহ আনন্দিত যতেক দেবতা।। বিষম দুর্জ্জয় ফণী লোক-হিংসা করে। আনন্দে কুসুমবৃষ্টি করে পুরন্দরে।। বিষের জ্বলনে লোক হয় ত বিনাশ। রক্ষা-হেতু ব্রহ্মা মন্ত্র করিল প্রকাশ।। দিব্য মন্ত্র গারুড়ির দিল কশ্যপেরে। কশ্যপ হইতে প্রচারিল মর্ত্ত্যপুরে।। মহাভারতের কথা অমৃত-সমান। কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।। কদ্রু ও বিনতার অশ্ব দর্শনে গমন মায়ের বচন শুনি নাগগণে ভয়। শীঘ্রগতি গেল যথা উচ্চৈঃশ্রবা হয়।। তুরঙ্গের পুচ্ছ ছিল ধবল বরণ। ঢাকিল তাহার বর্ণ যত নাগগণ।। নিঃশ্বাসেতে কৃষ্ণাঙ্গ হইল উচ্চৈঃশ্রবা। লুকাইল পূর্ব্বের ধবল-ইন্দুআভা।। হেথায় বিনতা কদ্রু উঠিয়া প্রভাতে। ক্রোধযুক্ত গেল দোঁহে তুরঙ্গ দেখিতে।। পথে যেতে সমুদ্র দেখিল দুইজনে। পর্ব্বত আকার তাহে জলচরগণে।। শতেক যোজন কেহ বিংশতি যোজন। কুম্ভীর-কচ্ছপ-মৎস্য আদি জন্তুগণ।। হেনমতে কৌতুক দেখিয়া দুইজন। উচ্চৈঃশ্রবা অশ্ব যথা করিল গমন।। নিকটেতে গিয়া দোঁহে করে নিরীক্ষণ। কৃষ্ণবর্ণ দেখে ঘোড়া, অতি সুলক্ষণ।। দেখিয়া বিনতা হৈল বিষণ্ণ-বদন। অঙ্গীকার কৈল সপত্নীর দাসীগণ।। ০১৭. কদ্রু ও বিনতার অশ্ব দর্শনে গমন মায়ের বচন শুনি নাগগণে ভয়। শীঘ্রগতি গেল যথা উচ্চৈঃশ্রবা হয়।। তুরঙ্গের পুচ্ছ ছিল ধবল বরণ। ঢাকিল তাহার বর্ণ যত নাগগণ।। নিঃশ্বাসেতে কৃষ্ণাঙ্গ হইল উচ্চৈঃশ্রবা। লুকাইল পূর্ব্বের ধবল-ইন্দুআভা।। হেথায় বিনতা কদ্রু উঠিয়া প্রভাতে। ক্রোধযুক্ত গেল দোঁহে তুরঙ্গ দেখিতে।। পথে যেতে সমুদ্র দেখিল দুইজনে। পর্ব্বত আকার তাহে জলচরগণে।। শতেক যোজন কেহ বিংশতি যোজন। কুম্ভীর-কচ্ছপ-মৎস্য আদি জন্তুগণ।। হেনমতে কৌতুক দেখিয়া দুইজন। উচ্চৈঃশ্রবা অশ্ব যথা করিল গমন।। নিকটেতে গিয়া দোঁহে করে নিরীক্ষণ। কৃষ্ণবর্ণ দেখে ঘোড়া, অতি সুলক্ষণ।। দেখিয়া বিনতা হৈল বিষণ্ণ-বদন। অঙ্গীকার কৈল সপত্নীর দাসীগণ।। ০১৮. গরুড়ের জন্ম ও সূর্য্যের রথে অরুণের সারথ্য হেনমতে দাসীপণে আছেন বিনতা। মহাবীর গরুড়ের জন্ম হৈল হেথা।। ডিম্ব ফাটি বাহির হইল আচম্বিতে। দেখিতে দেখিতে কায় লাগিল বাড়িতে।। প্রাতঃ হৈতে ক্রমে যেন সূর্য্যতেজ বাড়ে। বনে অগ্নি দিলে যেন দশদিক বেড়ে।। কামরূপী বিহঙ্গম মহাভয়ঙ্কর। নিশ্বাসে উড়িয়া যায় পর্ব্বত-শিখর।। বিদ্যুত আকার অঙ্গ, লোহিত লোচন। ক্ষণমাত্রে মুণ্ড গিয়া ছুঁইল গগন।। যুগান্তের অগ্নি যেন দেখে সর্ব্বজনে। সুরাসুর কম্পমান তাহার গর্জ্জনে।। অগ্নি হেন জানি সবে করি যোড় কর। অগ্নির উদ্দেশে স্তব করিল বিস্তর।। অগ্নি বলে, আমারে এস্তুতি কর কেনে। আপনা সংবর বলি বলে দেবগণে।। দেবতার স্তবে অগ্নি কন হাস্য করি। অকারণে ভীত কেন দৈত্য-কুল-অরি।। আমি নহি কাশ্যপেয় বিনতা-নন্দন। সর্ব্বলোক-হিতকারী হিংস্রক-হিংসন।। না করিহ ভয় কেহ থাক মম সঙ্গে। আনন্দিত হয়ে সবে দেখহ বিহঙ্গে।। অগ্নির বচন শুনি যত দেবগণ। যোড়হাত করি করে গরুড়ে স্তবন।। হেন রূপ দেখি তব অতি ভয়ঙ্কর। সংবর করুণা করি বিনতা-কোঙর।। তোমার তেজেতে দেখ চক্ষু যায় জ্বলি। ভীষণ গর্জ্জনে লাগে কর্ণদ্বায়ে তালি।। কশ্যপের পুত্র তুমি হও দয়াবান্। নিজ তেজ সংবরহ কর পরিত্রাণ।। দেবতার স্তবে তুষ্ট হৈল খগেশ্বর। আশ্বাসিয়া সংবরিল নিজ কলেবর।। তবে পক্ষিরাজ বীর অরুণে লইয়া। আদিত্যের রথে তারে বসাইল গিয়া।। বিষম সূর্য্যের তেজে পোড়ে ত্রিভুবন। অরুণের আচ্ছাদনে হৈল নিবারণ।। মুনিগণ বলে, কহ ইহার কারণ। কোন্ হেতু ত্রিভুবন দহিছে তপন।। সৌতি বলে, যেইকালে দেব জনার্দ্দন। সুরগণে সুধারাশি করেন বণ্টন।। গোপনে বসিয়া রাহু অমৃত খাইল। দিবাকর নারায়ণে দেখাইয়া দিল।। সূর্য্যের বচনে তবে দেব নারায়ণ। চক্রেতে অসুর মুণ্ড করেন ছেদন।। সূর্য্যের হইল পাপ তাহার কারণে। ক্রোধে রাহু গ্রাসে তাঁরে পাপগ্রহ দিনে।। সূর্য্যের হইল ক্রোধ যত দেবগণে। ডাকিয়া বলিনু আমি সবার কারণে।। সবে দেখে কৌতুক, আমারে করে গ্রাস। এই হেতু সৃষ্টি আমি করিব বিনাশ।। আপনার তেজেতে পোড়াব ত্রিভুবন। এত চিন্তি মহাতেজ ধরিল তপন।। দেবগণ নিবেদিল ব্রহ্মার গোচর। ত্রৈলোক্য দহিতে তেজ কৈল দিনকর।। ব্রহ্মা বলে, ভয় নাহি কর দেবগণ। ইহার উপায় এক করিব রচন।। কশ্যপের পুত্র হবে বিনতা-উদরে। রবি-তেজ নিবারিবে সেই মহাবীরে।। ততদিন কষ্ট সহি থাক সর্ব্বজনে। এত বলি প্রবোধিয়া গেল দেবগণে।। ভারতের পুণ্যকথা পুণ্যজন শুনে। পাঁচালী-প্রবন্ধে কাশীরাম দাস ভণে।। ১৯. সুধা আনিতে গরুড়ের স্বর্গে গমন অরুণে লইয়া তবে বিনতা-নন্দন। সূর্য্যরথে যত্ন করি করিল স্থাপন।। সপ্ত-অশ্ব করিয়ালি ধরি বাম হাতে। রহিল অরুণ সে সারথি হৈয়া রথে।। সূর্য্যরথে সহোদরে রাখ পক্ষিরাজ। জননীর ঠাঁই গেল ক্ষীর-সিন্ধু-মাঝ।। দুঃখিত জননী দেখি মলিন-বদন। মায়ের চরণ গিয়া করিল বন্দন।। পুত্রে দেখি বিনতার খণ্ডিল বিষাদ। স্নেহবাক্যে গুরুড়ের করে আশীর্ব্বাদ।। হেনকালে কদ্রু ডাকি বলে বিনতারে। রম্যদ্বীপে লয়ে চল কান্ধে করি মোরে।। রম্যক দ্বীপেতে মোর পুত্রের আলয়। ত্বরিতে লইয়া চল বিলম্ব না সয়।। কদ্রুরে লইল কান্ধে বিনতা সুন্দরী। নাগগণে গরুড় লইল কান্ধে করি।। নাগগণে কান্ধে করি গরুড় উড়িল। চক্ষুর নিমিষে সূর্য্য-মণ্ডলে উঠিল।। সূর্য্যের কিরণে পোড়ে যত নাগগণ। নাগ-মাতা দেখে পুড়ি মরিছে নন্দন।। পুড়ি মরে নাগগণ, নাহিক উপায়। আকুল হইয়া কদ্রু স্মরে দেবরায়।। ত্রৈলোক্যের নাথ তুমি দেব শচীপতি। আমার কুমারগণে কর অব্যাহতি।। বহুবিধ স্তুতি কদ্রু কৈল পুরন্দরে। ইন্দ্র ডাকি আজ্ঞা কৈল সব জলধরে।। ততক্ষণে মেঘগণ ঢাকিল আকাশ। জলবৃষ্টি করিয়া ভরিল দিশপাশ।। তবে খগপতি সব লৈয়া নাগগণে। রম্যক দ্বীপেতে বীর গেল ততক্ষণে।। নাগের আলয় দ্বীপ অতি মনোহর। কাঞ্চনে মণ্ডিত গৃহ প্রবাল প্রস্তর।। ফল-ফুলে সুশোভিত চন্দনের বন। মলয়-সুগন্ধি-বায়ু বহে অনুক্ষণ।। আপনার আলয়ে বসিল নাগগণ। গরুড়ে চাহিয়া তবে বলিল বচন।। উড়িবার বড় শক্তি আছয়ে তোমার। চড়িয়া তোমার কান্ধে করিব বিহার।। আর এক দ্বীপে লয়ে চল খগেশ্বর। শুনিয়া গরুড় গেল মায়ের গোচর।। গরুড় বলিল, মাতা কহ বিবরণ। পুনরপি কান্ধে নিতে বলে নাগগণ।। প্রভু যেন আজ্ঞা করে সেবা করিবারে। কি হেতু এমন বোল বলে বারে বারে।। একবার কান্ধে কৈনু তোমার আজ্ঞায়। পুনরপি বলে মোরে, সহনে না যায়।। বিনতা বলেন, পুত্র দৈবের লিখন। আমি কদ্রু-দাসী, তুমি দাসীর নন্দন।। গরুড় বলিল, মাতা কহ বিবরণ। তুমি তার দাসী হৈলা কিসের কারণ।। বিনতা কহিল, পূর্ব্বে সপত্নীর সনে। উচ্চৈঃশ্রবা তরে হই পরাজিতা পণে।। সেই হৈতে দাসীবৃত্তি করি তার আমি। তে কারণে দাসীপুত্র হৈলে বাপু তুমি।। এত শুনি মহাক্রোধ করিল সুপর্ণ। সঘনে নিশ্বাস ছাড়ে চক্ষু রক্তবর্ণ।। মায়ে এড়ি গেল সৎ-মায়ের নিকটে। কদ্রুর অগ্রেতে বীর কহে করপুটে।। আজ্ঞা কর জননী গো, করি নিবেদন। কিমতে মায়ের হয় দাসীত্ব-মোচন।। কদ্রু বলে মুক্ত যদি করিবে জননী। সুরলোক হৈতে সুধা মোরে দেহ আনি।। তাহা শুনি খগবর আনন্দিত অতি। মায়ের নিকটে বীর গেল শীঘ্রগতি।। যা বলিল সৎ-মাতা মায়েরে কহিল। না ভাবিহ আর, দুঃখ-অবসান হৈল।। এখনি আনিব সুধা চক্ষু পালটিতে। ক্ষুধায় উদর জ্বলে, দেহ কিছু খেতে।। জননী বলিল, যাহ সমুদ্রের তীরে। খাও গিয়া যত বৈসে নিষাদ-নগরে।। কিন্তু কহি তাহে এক দ্বিজবর আছে। বুঝিয়া খাইবে বাপু, দ্বিজে খাও পাছে।। অবধ্য ব্রাহ্মণ জাতি, কহিনু তোমারে। ক্ষুধায় আকুল বাছা, খাও পাছে তারে।। অগ্নি সূর্য্য বিষ হৈতে আছে প্রতিকার। ব্রাহ্মণের ক্রোধে বাছা নাহিক নিস্তার।। গরুড় বলিল, যদি তাদৃশ ব্রাহ্মণ। কিবা চিহ্ন ধরে দ্বিজ, কেমন লক্ষণ।। বিনতা বলিল, তুমি ক্ষুধায় আকুল। চিনিয়া খাইতে দুঃখ পাইবে বহুল।। খাইতে তোমার কণ্ঠ জ্বলিবে যখন। নিশ্চয় জানিবে পুত্র সেই সে ব্রাহ্মণ।। এত বলি বিনতা করিল আশীর্ব্বাদ। যাও পুত্র, অমৃত আনহ অপ্রমাদ।। ইন্দ্র যম আদিত্য কুবের হুতাশন। তোমারে জিনিতে শক্ত নহে কোন জন।। এত বলি খগবরে করিল মেলানি। মায়ে প্রণমিয়া বীর উড়িল তখনি।। গরুড় উড়িতে তিন ভুবন কাঁপিল। প্রলয়ের কালে যেন সিন্ধু উথলিল।। পাখসাটে পর্ব্বত উড়িয়া যায় দূরে। গর্জ্জনে লাগিল তালা সুরাসুর-নরে।। কৈবর্ত্তের দেশ দেখি মুখ বিস্তারিল। প্রশ্বাস সহিত সব মুখে প্রবেশিল।। আছিল ব্রাহ্মণ এক তাহার ভিতরে। অগ্নির সমান জ্বলে গরুড়-উদরে।। গরুড় স্মরিল, তবে মায়ের বচন। ডাকিয়া বলিল, শীঘ্র নিঃসর ব্রাহ্মণ।। ব্রাহ্মণ বলিল, নিঃসরিব কি প্রকারে। ভার্য্যা মোর পুড়ি মরে তোমার উদরে।। কৈবর্ত্তিনা ভার্য্যা মোর প্রাণের সমান। ভার্য্যার বিহনে আমি না রাখিব প্রাণ।। গরুড় বলিল, মোর দ্বিজ বধ্য নহে। ত্বরিতে নিঃসর, অগ্নি যাবৎ না দহে।। ধরিয়া ভার্য্যার হাত এস হে বাহিরে। এত শুনি ধরে দ্বিজ কৈবর্ত্তিনী-করে।। লইয়া আপন ভার্য্যা হইল বাহির। অন্তরীক্ষে উড়িল গরুড় মহাবীর।। হেনকালে গরুড়েরে কশ্যপ দেখিল। আশীর্ব্বাদ করিয়া কুশল জিজ্ঞাসিল।। গরুড় বলিল, তাত আছি যে কুশলে। সকলি কুশল, মাত্র ভক্ষ্য নাহি মিলে।। মাতৃ-বোলে খাইলাম নিষাদ-নগর। না হইল ক্ষুধা-শান্তি, পুড়িছে উদর।। বিমাতার বাক্যে যাই অমৃত আনিতে। ক্ষুধায় অবশ তনু জ্বলি অন্তরেতে।। তুমি তাত কিছু মোরে দেহ খাইবারে। ভাল করি দেহ গো উদর যেন পূরে।। কশ্যপ বলিল, তবে শুন পুত্রবর। দেব নরে বিখ্যাত আছয়ে সরোবর।। গজ-কূর্ম্ম দুইজন তথা যুদ্ধ করে। তাহার বৃত্তান্ত শুন আমার গোচরে।। ০২০. গজ-কচ্ছপের বিবরণ বিভাবসু সুপ্রতীক দুই সহোদর। মহাধনে ধনী দোঁহে মুনির কোঙর।। শত্রুগণ দোঁহারে করিল ভেদাভেদ। ধনের কারণে দোঁহে হইল বিচ্ছেদ।। সুপ্রতীক কনিষ্ঠ সে পৃথক হইল। আপনার সমুচিত বিভাগ মাগিল।। শত্রুগণ বলিল, অনেক ধন আছে। আপন উচিত ভাগ ছাড়ি দেহ পাছে।। বিভাবসু জ্যেষ্ঠ কহে, এ ভাগ উহার। অকারণে দ্বন্দ্ব করে সহিত আমার।। দোঁহাকারে দুই রূপ কহে শত্রুগণে। বহুদিন এই মত দ্বন্দ্ব দুই জনে।। নিত্য আসি সুপ্রতীক প্রাতে মাগে ধন। ক্রোধে বিভাবসা শাপ দিল ততক্ষণ।। যে কিছু তোমার ভাগ তাহা দিনু আমি। না লইয়া দ্বন্দ্ব কর পরবাক্যে তুমি।। নিত্য আসি বিসম্বাদ কর মম সনে। দিনু শাপ, গজ হৈয়া কর মম সনে।। সুপ্রতীক বলে, মোরে ভাগ নাহি দিয়া। শাপ দিলে, বল মোরে কিসের লাগিয়া।। তুমিও কচ্ছপ হও জলের ভিতরে। দুই জনে দুই শাপ দিলেক দোঁহারে।। গজ গেল অরণ্যে, কচ্ছপ গেল জলে। ভাই ভাই বিসম্বাদ কৈলে হে ফলে।। পরবাক্যে যারা সব করে যে বিবাদ। অতি ক্লেশ জন্মে তার, হয় ত প্রমাদ।। সেই সে কচ্ছপ আছে জলের ভিতর। যুড়িয়া যোজন দশ তার কলেবর।। তাহার দ্বিগুণ দেহ করিবর ধরে। নিত্য আসি যুদ্ধ করে সরোবর-তীরে।। সেই গজ-কূর্ম্ম গিয়া করহ ভক্ষণ। সর্ব্বত্র মঙ্গল হবে বিনতা-নন্দন।। সমরে প্রবৃত্ত হৈলে দেবগণ সনে। বেদহবীরহস্য রাখিবে তোমা ধনে।। ত্রিভুবন বিজয়ী হও মহাবীর। ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব তব রাখুন শরীর।। কশ্যপের আজ্ঞা পেয়ে গরুড় সত্বর। চক্ষুর নিমিষে গেল যথা সরোবর।। অন্তরীক্ষ হৈতে দেখি বিনতা-কোঙর। বন হইতে বাহির হৈল গজবর।। সরোবর-তীরে আসি করিল গর্জ্জন। ক্রোধ করি কূর্ম্ম দেখা দিলেক তখন।। দুই জনে মহাযুদ্ধ, কহনে না যায়। অন্তরীক্ষে থাকি তাহা দেখে খগরায়।। এক নখে গজে ধরি কূর্ম্ম আর নখে। চক্ষুর নিমিষে উড়ি গেল তপঃলোকে।। কোথায় খাইব বসি ভাবে মনে মন। নানাজাতি বৃক্ষ দেখে পরশে গগন।। এক বটবৃক্ষ তথা অতি উচ্চতর। দেখিয়া গরুড়ে ডাকি বলিল উত্তর।। মোর ডাল দেখ শতযোজন বিস্তার। সুস্থ হয়ে ইথে বসি করহ আহার।। বৃক্ষের বচন শুনি বিনতা-নন্দন। ডালেতে বসিল গিয়া করিতে ভক্ষণ।। ভাঙ্গিল বৃক্ষের ডাল গরুড়ের ভরে। বালখিল্য-মুনিগণ তাহে তপ করে।। শাখা করি অধোমুখে আছে মুনিগণ। দেখিয়া হইল ভীত বিনতা-নন্দন।। ভূমিতে ফেলিলে ডাল মরিবেক মুনি। ঠোঁটেতে ধরিল ডাল, মনে ভয় গণি।। ঠোঁটেতে ধরিল ডাল, গজ-কূর্ম্ম নখে। উড়িয়া বেড়ায় পক্ষী, উপায় না দেখে।। বহুদিন গরুড় উড়িল হেনমতে। কশ্যপে দেখিল গন্ধমাদন-পর্ব্বতে।। গরুড়ের মুখে ডাল দেখি বিপরীত। বালখিল্য মুনিগণ তাহে বিলম্বিত।। কশ্যপ বলেন, পুত্র করিলা কি কাজ। হের দেখ ডালে আছে মুনির সমাজ।। অঙ্গুষ্ঠ প্রমাণ ষাটি-সহস্র ব্রাহ্মণ। উপায় করহ, ক্রোধ নহে যতক্ষণ।। তবে ত কশ্যপ মুনি করি যোড় কর। মুনিগণ প্রতি স্তুতি করিলা বিস্তর।। এই ত গরুড় হয় সবাকার হিত। সে কারণে ক্রোধ তারে না হয় উচিত।। কশ্যপের স্তবে তুষ্ট হয়ে ঋষিগণ। হিমগিরি পরে সবে করিল গমন।। তবে খগেশ্বর জিজ্ঞাসিল কশ্যপেরে। কোথায় ফেলিব ডাল আজ্ঞা কর মোরে।। কাশ্যপ বলিল, যাও ঋষ্য-শৃঙ্গ-গিরি। জীবজন্তু নাহি সেই পর্ব্বত উপরি।। কশ্যপের আজ্ঞা-ক্রমে বীর খগেশ্বর। ফেলিল সে ডাল লয়ে পর্ব্বত উপর।। গজ-কূর্ম্ম খাইলেক পর্ব্বতে বসিয়। অমৃত আনিতে যায় তৃপ্তমনা হৈয়া।। মহাতেজে গগনে উঠিল মহাবল। পাখসাটে উড়ি গেল পর্ব্বত সকল।। দিনকর আচ্ছাদিল হৈল অন্ধকার। অমর-নগরে হৈল উৎপাত অপার।। উল্কাপাত নির্ঘাত হইছে ঘন-ঘন। ঘোর বায়ু, মেঘে করে রক্ত বরিষণ।। ইহা দেখি ইন্দ্র বৃহস্পতিরে পুছিল। এত অমঙ্গল কেন স্বর্গেতে হইল।। বৃহস্পতি বলিল, তোমার পূর্ব্ব পাপে। আসিছে গরুড়-পক্ষী অদ্ভুত-প্রতাপে।। সুধার কারণে আসে বিনতা-নন্দন। অবশ্য লইবে সুধা জিনি দেবগণ।। এত শুনি কুপিত হইল পুরন্দর। ততক্ষণে আজ্ঞা দিল ডাকি অনুচর।। পাইয়া ইন্দ্রের আজ্ঞা যত দেবগণ। সসজ্জ হইল সবে করিবারে রণ।। মুনিগণ বলে, শুন সূতের নন্দন। ইন্দ্রের হইল পাপ কিসের কারণ।। কশ্যপ ব্রাহ্মণ-শ্রেষ্ঠ বিদিত ভুবনে। তাঁর পুত্র পক্ষী হৈল কিসের কারণে।। কামরূপী পক্ষী সেই মহাবলবন্ত। কি হেতু হইল কহ পূর্ব্বের বৃত্তান্ত।। সৌতি কহে, সেই কথা কহিত বিস্তার। সংক্ষেপে কহি যে কিছু শুন সারোদ্ধার।। মহাভারতের কথা অমৃত-সমান। কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।। ০২১. ইন্দ্রের প্রতি বালখিল্যাদির অভিসম্পাত পূর্ব্বেতে কশ্যপ-মুনি যজ্ঞ আরম্ভিল। দেব-ঋষি গন্ধর্ব্বাদি যত কেহ ছিল।। যজ্ঞের সাহায্য দানে করিয়া মমন। যজ্ঞকাষ্ঠ আনিবারে প্রবেশিল বন।। ভাঙ্গিয়া লইল কাষ্ঠ মাথার উপর। পর্ব্বত-প্রমাণ বোঝা নিল পুরন্দর।। শীঘ্র কাষ্ঠ ফেলিয়া আইল সুরমণি। পথেতে দেখিল যত বালখিল্য মুনি।। পলাশের পত্র লয়ে মাথার উপরে। অঙ্গুষ্ঠ-প্রমাণ সবে যায় ধীরে ধীরে।। পথে যেতে সবে এক গোক্ষুর দেখিয়া। পার হৈতে নাহি পারে আছে দাণ্ডাইয়া।। তাহা দেখি হাসিতে লাগিল দেবরাজ। দেখিয়া করিল ক্রোধ মুনির সমাজ।। উপহাস করিলি করিয়া অহঙ্কার। ব্রাহ্মণেরে নাহি চিন মত্ত দুরাচার।। বালখিল্য-মুনিগণ এতেক ভাবিল। অন্য ইন্দ্র করিবারে যজ্ঞ আরম্ভিল।। ইন্দ্র হৈতে শতগুণ বলিষ্ঠ হইবে। কামরূপী মহাকায় ত্রৈলোক্য জিনিবে।। হেনমতে যজ্ঞ করে যত মুনিগণ। শুনিয়া কশ্যপে ইন্দ্র করে নিবেদন।। শীঘ্রগতি গেল তেঁই যজ্ঞের সদন। মুনিগণ-প্রতি তবে বলিল বচন।। দেবরাজ পুরন্দর ব্রহ্মারে সেবিল। দেবের ঈশ্বর করি ব্রহ্মা নিয়োজিল।। অন্য ইন্দ্র-হেতু যজ্ঞ কর কি কারণ। ব্রহ্মার বচন চাহ করিতে লঙ্ঘন।। ব্রহ্মার বচন রাখ, হও সবে প্রীত। আজ্ঞা কর মুনিগণ য হয় উচিত।। বালখিল্য বলে, যজ্ঞে পাই বহু কষ্ট। রাখিতে তোমার বাক্য সব হৈল ভ্রষ্ট।। কশ্যপ বলিল, নষ্ট হবে কি কারণ। হউক পক্ষীন্দ্র যে জিনিবে ত্রিভুবন।। মুনিগণে সান্ত্বাইয়া বলে সুররাজে। উপহাস কভু আর নাহি কর দ্বিজে।। ব্রাহ্মণ দেখিয়া নাহি কর অহঙ্কার। ব্রাহ্মণের ক্রোধে কারো নাহিক নিস্তার।। এত বলি দেবরাজে করেন মেলানি। বিনতারে বলেন কশ্যপ মহামুনি।। সফল করিলা ব্রত শুন গুণবতি। তোমার গর্ভেতে হবে খগেন্দ্র উপত্তি।। এত শুনি বিনতার আনন্দ বিস্তর। হেনমতে পক্ষী হৈল কশ্যপ-কোঙর।। তবে ত গরুড় বীর গেল সুরালয়। ভয়ঙ্কর মূর্ত্তি দেখি সবে পায় ভয়।। যে দেবের হাতে ছিল যেই প্রহরণ। চতুর্দ্দিকে করিতে লাগিল বরিষণ।। শেল শূল জাঠা শক্তি ভূষণ্ডি তোমর। পরিঘ পরশু চক্র মুষল মুদগর।। প্রলয়ের মেঘ যেন করে বরিষণ। ঝাঁকে ঝাঁকে অস্ত্রবৃষ্টি করে করে দেবগণ।। কামরূপী পক্ষিরাজ নির্ভয় শরীর। দেবের চরিত্র দেখি হাসে মহাবীর।। জ্বলন্ত অনল যেন ঘৃত দিলে বাড়ে। গরুড়ের তেজ বাড়ে, যত অস্ত্র পড়ে।। জিনিয়া মেঘের শব্দ গরুড়-গর্জ্জন। দেবের চরিত্র দেখি ভাবে মনে মন।। ইন্দ্র আদি দেবগণ সবাই অবোধ। না জানিয়া আমা সঙ্গে বাড়ায় বিরোধ।। সবারে মারিতে পারি চক্ষুর নিমিষে। সাধিব আপন কার্য্য কি কাজ বিনাশে।। এত চিন্তি ততক্ষণে বিনতা-নন্দন। পাখসাটে পূরাইল ধূলায় গগন।। ইন্দ্রের অমরাবতী নানা রত্নময়। ভাঙ্গিল যে পাখসাটেতে সে সমুদয়।। অনিমিত্র-নেত্রে ভয় পায় দেবগণ। ধূলায় পূরিল, ভঙ্গ দিল সর্ব্বজন।। পবনেরে আজ্ঞা দিল দেব পুরন্দর। ধূলা উড়াইয়া তুমি ফেলাও সত্বর।। ইন্দ্রের আজ্ঞায় ধূলা উড়ায় পবন। পুনঃ আসি গরুড়ে বেড়িল সর্ব্বজন।। চতুর্দ্দিকে নানা অস্ত্র করে বরিষণ। দেখিয়া রুষিল বীর বিনতা-নন্দন।। পাখসাট মারে কারে, বিদারয়ে নখে। ঠোঁটেতে চিরিয়া ফেলে, যে পড়ে সম্মুখে।। সবার শরীর হৈল রক্তে পরিপূর্ণ। ভাঙ্গিল মস্তক কারো, অস্থি হৈল চূর্ণ।। পাখসাটে উড়াইয়া ফেলে চারিদিকে। দক্ষিণে পলায় কেহ কেহ পূর্ব্ব-ভাগে।। পশ্চিমে দ্বাদশ রবি পলাইল ডরে। অশ্বিনী-কুমার দোঁহে পলায় উত্তরে।। পুনঃ পুনঃ আসি যুদ্ধ করে দেবগণ। প্রাণপণ করি সবে সুধার কারণ।। কামরূপী বিহঙ্গম বলে মহাবল। অতিক্রোধে হৈল যেন জ্বলন্ত অনল।। প্রলয়-অনল যেন দহে সর্ব্বজনে। সহিতে না পারি ভঙ্গ দিল দেবগণে।। দেবতা তেত্রিশ কোটি জিনিয়া সমরে। চন্দ্রলোকে উত্তরিল নিমেষ ভিতরে।। চন্দ্রের নিকটে গিয়া দেখে মহাবল। চতুর্দ্দিকে বেড়িয়াছে জ্বলন্ত অনল।। অগ্নি দেখি উপায় করিল খগেশ্বর। সুবর্ণের অঙ্গ হৈয়া প্রবেশে ভিতর।। অগ্নি পার হৈয়া তবে দেখে খগেশ্বর। তীক্ষ্ম-ক্ষুর-ধার চক্র ভ্রমে নিরন্তর।। মক্ষিকা পড়িলে তাতে হয় শতখান। হেন চক্র গরুড় দেখিল বিদ্যমান।। সূচিকা-প্রমাণ রন্ধ্র ছিল চক্রমাঝ। ততোধিক সূক্ষ্ম তথা হৈল পক্ষিরাজ।। চক্র পার হৈয়া তবে বিনতা-নন্দন। দেখে ভয়ঙ্কর সর্প চন্দ্রের রক্ষণ।। দৃষ্টিমাত্র ভস্ম করে সেই দুই ফণী। দেখিয়া চিন্তিত-চিত্ত হৈল খগমণি।। অতি ক্রোধে পাখসাট গরুড় মারিল। পক্ষের ধূলিতে ফণি-নয়ন পূরিল।। ধূলায় পূরিল চক্ষু, হৈল অধোমুখ। ফণিমুণ্ডে চড়ে বীর পরম-কৌতুক।। চন্দ্রমা ধরিলা বীর বিনতা-নন্দন। অমৃত গ্রহণ কৈল আনন্দিত মন।। ঢাকিয়া লইল সুধা পাখার ভিতরে। অতিবেগে তথা হৈতে চলিল সত্বরে।। কামরূপী মহাকায় বিনতা-নন্দন। সেরূপে যাইতে ইচ্ছা করিল তখন।। চক্র-অগ্নি লঙ্ঘিয়া আইসে খগবর। এ-সব কৌতুক দেখি ক্রোধে চক্রধর।। অন্তরীক্ষে আইল যথা বিনতা-নন্দন। দুই জনে যুদ্ধ হৈল না যায় কথন।। চর্তুভুজে চারি অস্ত্রে যুঝে নারায়ণ। পাখসাটে পক্ষিবর করে নিবারণ।। আঁচড় কামড় আর মারে পাখসাট। ক্ষুব্ধ হয় গোবিন্দের হৃদয়-কপাট।। অনেক হইল যুদ্ধ লিখনে না যায়। তুষ্ট হয়ে গরুড়ে বলেন দেবরায়।। তোমার বিক্রমে তুষ্ট হইনু খেচর। মনোমত মাগ তুমি দিব আমি বর।। গরুড় বলিল, যদি তুমি দিবা বর। তোমা হৈতে উচ্চেতে বসিব নিরন্তর।। অজর অমর হব অজিত সংসারে। বিষ্ণু কন, যাহা ইচ্ছা দিলাম তোমারে।। বর পেয়ে হৃষ্টচিত্তে বলে খগেশ্বর। আরি বর দিব তুমি মাগ গদাধর।। গোবিন্দ বলেন, যদি দিবা তুমি বর। আমার বাহন তুমি হও খগেশ্বর।। গরুড় বলিল, মম সত্য অঙ্গীকার। নিশ্চয় বাহন আমি হইব তোমার।। উচ্চস্থল দিলে যে আমারে দিলা বর। শ্রীহরি বলেন, বৈস রথের উপর।। এইমত দোঁহাকারে দোঁহে বর দিয়া। তথা হৈতে চলে বীর অমৃত লইয়া।। পবন অধিক হয় গরুড়ের গতি। দৃষ্টিমাত্রে সুরলোকে গেল মহামতি।। আছিল পরম ক্রোধে দেব পুরন্দর। মহাক্রোধে মারে বজ্র গরুড়-উপর।। হাসিয়া গরুড় বলে শুন দেবরাজ। বজ্র-অস্ত্র ব্যর্থ হৈলে পাবে বড় লাজ।। মুনি-অস্থি-জাত অস্ত্র অব্যর্থ সংসারে। শত বজ্র হলে মোর কি করিতে পারে।। তথাপি মুনির বাক্য করিতে পালন। একগুটি পর্ণ দিব তোমার কারণ।। এত বলি এক পাখা ঠোঁটে উপাড়িয়া। ইন্দ্র মারে বজ্র তাতে দিল ফেলাইয়া।। দেখিয়া বিস্ময়াপন্ন দেব পুরন্দর। সবিনয়ে বলে তবে শুন খগেশ্বর।। তোমার চরিত্র দেখি হইলাম প্রীত। সখ্য করিবারে চাহি তোমার সহিত।। গরুড় বলিল, যদি ইচ্ছা কর তুমি। আজি হৈতে হইলাম তব সখা আমি।। ইন্দ্র বলে, সখা এক করি নিবেদন। তোমার তেজের কথা না যায় কথন।। কত বল ধর তুমি কহ সত্য করি। তোমার বিক্রম দেখি তিনলোকে ডরি।। ইন্দ্রের বচন শুনি বলে পক্ষিরাজ। আপনি আপন গুণ কহিবারে লাজ।। তুমি সখা জিজ্ঞাসিলে কহিতে যুয়ায়। আমার বলের কথা শুন দেবরায়।। সাগর সহিত ক্ষিতি এক পক্ষে করি। আর পক্ষে তোমা সহ অমর-নগরী।। দুই পক্ষে লইয়া উড়িব বায়ুভরে। শ্রম না হইবে মম সহস্র বৎসরে।। শুনিয়া হইল স্তব্ধ দেব পুরন্দর। ইন্দ্র বলে, ইহা সত্য মানি খগেশ্বর।। যতেক বলিলা সব সম্ভবে তোমারে। এক নিবেদন সখা কহি আরবারে।। অমৃত লইয়া যাও কিসের কারণ। ফিরে দেহ আমা সবে করি আকিঞ্চন।। সুপর্ণ কহিল, শুন দেব বজ্রপাণি। দাসীপণে বদ্ধ আছে আমার জনন।। সুধা লয়ে দিতে যদি পারি সর্পগণে। তবে ত জননী মুক্ত হবে দাসীপণে।। এই হেতু সুধা লয়ে যাই নাগলোকে। যথায় জননী কাল হরেন অসুখে।। ইন্দ্র বলে, হেন কথা যুক্তিযুক্ত নয়। মহাদুষ্ট নাগগণ সৃষ্টি করে ক্ষয়।। তোমার যে শত্রু হয় সে শত্রু আমার। শত্রুকে অমৃত দিতে না হয় বিচার।। হেন জনে সুধা দিবে কিসের কারণ। অপর উপায়ে মায়ে করহ মোচন।। জগতের প্রাণ রাখ আমার বচন। সদয় হইয়া সুধা কর প্রত্যর্পণ।। গরুড় বলিল, সখা এ নহে বিচার। মায়ের অগ্রেতে করিয়াছি অঙ্গীকার।। এখনি আনিব সুধা বলিয়াছি বাণী। কেমনে অমৃত ছাড়ি যাই বজ্রপাণি।। তবে এক যুক্তি সখা করহ শ্রবণ। তব বাক্য রবে, হবে মায়ের মোচন।। সুধা লয়ে দিব আমি যত সর্পদলে। সুযোগ বুঝিয়া তুমি হরিবে কৌশলে।। পেয়ে সুধা নাহি পাবে দুষ্ট নাগগণ। লাভে হৈতে জননীর দাসীত্ব-মোচন।। এই যুক্তি মনে লয় সখা সুরপতি। শুনি দেবরাজ হৈল আনন্দিত অতি।। ইন্দ্র বলে, তুষ্ট হৈল আনন্দিত অতি।। বর ইচ্ছা থাকে যদি মাগ মম স্থানে। গরুড় বলিল, আমি কি মাগিব বর। আমার অসাধ্য কিবা ত্রৈলোক্য-ভিতর।। তথাপি করিব রক্ষা সখা তব বাক্য। বর দেহ ফণী যেন হয় মম ভক্ষ্য।। কপটেতে দুষ্টগণ মায় দুঃখ দিল। তথাস্তু বলিয়া ইন্দ্র তারে বর দিল।। বর পেয়ে তথা হৈতে চল খগেশ্বর। ছায়ারূপে সঙ্গে চলিলেন পুরন্দর।। পথে যেতে ইন্দ্র জিজ্ঞাসেন ক্ষণে ক্ষণ। এখন সুদৃঢ় করি বলহ বচন।। যথায় রাখিবে সুধা যবে লব আমি। মোর সহ দ্বন্দ্ব পাছে পুনঃ কর তুমি।। হাসিয়া গরুড় ইন্দ্রের করিল নির্ভয়। তথাপি ইন্দ্রের চিত্তে প্রত্যয় না হয়।। তথা হৈতে চলে বীর তারা যেন খসে। নাগলোকে গেল বীর চক্ষুর নিমিষে।। ডাক দিয়া আনিল যতেক নাগগণে। হের সুধা আনিলাম দেখ সর্ব্বজনে।। দাসীত্বে মোচন হৌক আমার জননী। এত শুনি আনন্দিত হৈল সব ফণী।। ফণিগণ বলিলেক, আর নাহি দায়। দাসীত্বে মোচন করিলাম তব মায়।। এত শুনি হৃষ্টচিত্তে বিনতা-নন্দন। নাগগণে ডাকি তবে বলিল বচন।। স্নান করি শুচি হৈয়া এস সর্ব্বজন। আনন্দিত হয়ে সুধা করহ ভক্ষণ।। এই দেখ সুধা রাখি কুশের উপর। এত বলি সুধা লয়ে ঘেল খগেশ্বর।। গরুড়ের বাক্যে সবে করে স্নান দান। হেথা সুধা লয়ে ইন্দ্র হইল অন্তর্দ্ধান।। শুচি হৈয়া আসিল যতেক নাগগণ। অমৃত না দেখি হৈল বিরস বদন।। জানিল হরিয়া সুধ দেবরাজ নিল। সবে মিলি সেই কুশ চাটিতে লাগিল।। তীক্ষ্মধারে সকলের জিহ্বা হৈল চির। সেই হৈতে দুই জিহ্বা হইল ফণীর।। পবিত্র হইল কুশ সুধা-পরশনে। নিষ্ফল সকল কর্ম্ম কুশের বিহনে।। গরুড়-বিক্রম আর বিনতা-মোচন। নাগের নৈরাশ্য আর অমৃত-হরণ।। এ সব রহস্য কথা শুনে যেই জনে। আয়ু যশ বৃদ্ধি তার হয় দিনে দিনে।। পুত্রার্থীর পুত্র হয় ধনার্থীর ধন। তার প্রতি সুপ্রসন্ন বিনতা-নন্দন।। আদিপর্ব্ব ভারতে গরুড়-জন্মকথা। অপূর্ব্ব পয়ার ছন্দে পাঁচালিতে গাঁথা।। মহাভারতের কথা অমৃত-সমান। কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।। ০২২. শেষ-নাগের তপস্যা ও পৃথ্বিভার বহন শৌনকাদি মুনি বলে সূতের নন্দন। শুনিনু গরুড় কথা অদ্ভুত কথন।। কদ্রুর হইল এক সহস্র কুমার। কোন্ কর্ম্ম কৈল কিবা নাম সবাকার।। সৌতি বলে, কতেক কহিব মুনিগণ। কিছু নাম কহি, শ্রেষ্ঠ ফণী যত জন।। শেষ জ্যেষ্ঠ সহোদর দ্বিতীয় বাসুকি। ঐরাবত তক্ষক কর্কট সিংহ-আঁখি।। বামন কালিয় এলাপত্র মহোদর। কুণ্ডল অনীল নীল বৃত্ত অকর্কর।। মণিনাগ আপূরণ আর্য্যক উগ্রক। সুরামুক দধিমুখ কলশ পোতক।। কৌরব্য কুটর আপ্ত কম্বল তিত্তিরি। হেনমত নাগ সব কত নাম করি।। সর্ব্ব হৈতে শ্রেষ্ঠ জ্যেষ্ঠ শেষ বিষধর। জিতেন্দ্রিয় সুপণ্ডিত ধর্ম্মেতে তৎপর।। ভাই সব দুরাচর দেখি নাগরাজ। বিশেষে মায়ের শাপ ভাবে হৃদিমাঝ।। ত্যজিয়া সকল গেল তপ করিবারে। নানা-তীর্থ করি শেষ ভ্রময়ে সংসারে।। হিমালয়ে আশ্রম করিল নাগবর। অত্যন্ত কঠোর তপ করে নিরন্তর।। তার তপ দেখি তুষ্ট হৈল প্রজাপতি। ব্রহ্মা বলে তপ কেন কর ফণিপতি।। স্ববাঞ্ছিত বর মাগি করহ গ্রহণ। করযোড়ে শেষ তবে কৈল নিবেদন।। আমি কি কহিব সব তোমার গোচর। দুষ্ট দুরাচার মোর যত সহোদর।। গরুড় আমার ভাই বিনতা-নন্দন। তার সহ কলহ করয়ে অনুক্ষণ।। বলেতে সমর্থ কেহ নহে সম তার। নিষেধ না শুনে কেহ করে অহঙ্কার।। সদাই কপট কর্ম্ম, লোকের হিংসন। অহঙ্কারী কুপথী যতেক ভ্রাতৃগণ।। সেই হেতু সকলের সংসর্গ ছাড়িয়া। শরীর ছাড়িব আমি তপস্যা করিয়া।। পুনঃ যেন সংসর্গ না হয় সবা সনে। মরিব তপস্যা করি তাহার কারণে।। বিরিঞ্চি বলেন, শেষ না ভাব এমন। দুষ্টের সংসর্গ তব হইবে মোচন।। ধর্ম্মেতে তৎপর তুমি বলে মহাবল। আপনার তেজে ধর পৃথিবীমণ্ডল।। ব্রহ্মার বচনে শেষ পৃথিবী ধরিল। গরুড় সহিত ব্রহ্মা মৈত্রী করাইল।। ব্রহ্মার আজ্ঞায় গিয়া পাতাল-ভিতর। তথা থাকি পৃথিবী ধরিল বিষধর।। তুষ্ট হৈয়া ব্রহ্মা তারে কৈল নাগরাজা। নাগলোকে দেবলোকে সবে করে পূজা।। হেনমতে শেষ সব ত্যজি ভ্রাতৃগণে। একাকী রহিল তেঁই ব্রহ্মার বচনে।। শেষ যদি গেল তবে বাসুকি চিন্তিত। মায়ের শাপেতে হয় অত্যন্ত দুঃখিত।। সব ভ্রাতৃগণ লৈয়া করেন যুকতি। মায়ের শাপেতে ভাই না দেখি নিষ্কৃতি।। জনকের শাপেতে আছয়ে প্রতিকার। জননীর শাপে নাহি দেখি যে উদ্ধার।। ক্রোধ করি জননী যখন শাপ দিল। পিতৃ-পিতামহ সবে স্বীকার করিল।। জন্মেজয় যজ্ঞে হবে অবশ্য সংহার। এখন তাহার ভাই কর প্রতিকার।। এতেক বচন যদি বাসুকি বলিল। যার যেই যুক্তি আসে কহিতে লাগিল।। এক নাগ বলে, আমি ব্রাহ্মণ হইব। জন্মেজয় যজ্ঞে আমি ভিক্ষা মাগি লব।। আর নাগ বলে, আমি রাজমন্ত্রী হৈয়া। না দিব করিতে যজ্ঞ মন্ত্রণা করিয়া।। আর নাগ বলে, কোন্ বিচিত্র সে কথা। কেমনে করিবে যজ্ঞ খাব যজ্ঞ-হোতা।। নহিলে খাইব সব ব্রাহ্মণে ধরিয়া। দ্বিজ বিনা যজ্ঞ হবে কেমন করিয়া।। অন্যে বলে, আরে ভাই এ নহে বিচার। ব্রাহ্মণ-হিংসিলে ভাই নাহিক নিস্তার।। বিপদে পড়িলে লোক বিপ্রে দান করে। বিপ্র তুষ্ট হলে ভাই সর্ব্বারিষ্ট হরে।। আর নাগ বলে, আমি জলধর হৈয়া। নিবারিব যজ্ঞ-অগ্নি বারি বরষিয়া।। আর নাগ বলে আমি বিপ্ররূপ ধরি। যতেক যজ্ঞের শস্য লব চুরি করি।। কেহ বলে, মোরা সবে একত্র হইয়া। অনিবার যজ্ঞাগার থাকিব বেড়িয়া।। যাহারে দেখিব তারে করিব ভক্ষণ। ভয়েতে করিবে রাজা যজ্ঞ-নিবারণ।। এতেক বলিলা যদি সব নাগগণে। বাসুকি বলিল, নাহি রুচে মম মনে।। আমা সবা মারিবারে দৈব-শক্তি ধরে। কাহার ক্ষমতা ভাই তাহারে নিবারে।। ইহার উপায় কিছু নাহি দেখি আর। অবশ্য সর্পের কুল হইব সংহার।। এলাপত্র নমে সর্প ছিল একজন। বাসুকির বাক্য শুনি কহিল তখন।। মায়ের বচন কভু না হবে লঙ্ঘন। যত যুক্তি কৈল সবে সব অকারণ।। মায়ের বচন আর দৈবের লিখন। অবশ্য হইবে যজ্ঞ না যায় খণ্ডন।। পাণ্ডুবংশে জন্মেজয় হইবে উৎপত্তি। তাঁর যজ্ঞ হিংসিবেক কাহার শকতি।। আছয়ে উপায় এক শুন সর্ব্বজন। সাবধানে শুন সবে ব্রহ্মার বচন।। পুত্রগণে যখন জননী শাপ দিল। দেবগণ তখনি ব্রহ্মাকে জিজ্ঞাসিল।। হেন শাপ কেহ দেয় আপন নন্দনে। আর কোন্ জন হেন আছয়ে ভুবনে।। ব্রহ্মা বলে অবধান কর সুরগণ। পরের অহিতকারী সদা সর্পগণ।। বিনষ্ট হইলে তারা রহিবে সংসার। নতুবা সর্পের বিষে হৈবে ছারখার।। তবে ধর্ম্মে অনুগত যেই নাগ হবে। জন্মেজয়-যজ্ঞে মাত্র সেই রক্ষা পাবে।। শুন সবে আছে এক উপায় তাহার। যাযাবর-বংশে জন্ম লবে জরৎকার।। তাঁহার বিবাহ হবে জরৎকারী-সনে। বাসুকির ভগ্নী সেই বিখ্যাত ভুবনে।। তার গর্ভে জন্মিবেন আস্তিক কুমার। সেই পুত্র নাগকুল করিবে নিস্তার।। এইরূপে ব্রহ্মা আজ্ঞা কৈল দেবগণে। এ সকল কথা আমি শুনেছি শ্রবণে।। আর কোন উপায় করহ ভাইগণ। না হইবে সাধ্য কিছু সব অকারণ।। সেই জরৎকারে যেই ভগিনী সবার। জরৎকারে বিভা দিলে হইবে নিস্তার।। এতেক বলিল এলাপত্র বিষধর। সাধু সাধু করি সবে করিল উত্তর।। তবে দেবাসুরে মিলি সমুদ্র মথিল। তাহার মথন দড়ি বাসুকি হইল।। তুষ্ট হয়ে দেবগণ ব্রহ্মারে বলিল। বাসুকি হইতে সিন্ধু মথন হইল।। মাতৃশাপে বাসুকির দহে কলেবর। আজ্ঞা কর পিতামহ খণ্ডে যেন ডর।। ব্রহ্মা বলে জরৎকারী ভগিনী তাহার। তার পুত্র করিবেক নাগের নিস্তার।। বাসুকি শুনিয়া হৈল আনন্দিত মন। জরৎকারু জন্য চর কৈল নিয়োজন।। চরগণে বলেন থাকিবে অলক্ষ্যেতে। জরৎকারু দেখা হৈলে কহিবে ত্বরিতে।। যাহা জিজ্ঞাসিলে সৌতি বলে মুনিগণে। বাসুকি দিলেন ভগ্নী তাহার কারণে।। মহাভারতের কথা অমতৃ-লহরী। ভক্তিভরে বর্ণন করিব যত পারি।। ইহার শ্রবণে যত সুখী হবে নরে। তাদৃশ নাহিক সুখ ত্রৈলোক্য।। কাশীরাম দাসের সদাই এই মন। নিরবধি বাঞ্ছে সদা ভারত-শ্রবণ।। ০২৩. পরীক্ষিতের প্রতি ব্রহ্মশাপ সৌতি বলে, এইরূপে গেল বহুকাল। পাণ্ডুবংশে হৈল পরীক্ষিত মহীপাল।। মহাপুণ্যবান রাজা প্রতাপে মিহির। কৃপাচার্য্য শিক্ষায় সকল শাস্ত্রে ধীর।। সর্ব্বগুণযুত রাজা সদা সত্যব্রত। মৃগয়াতে প্রিয়, বনে ভ্রমে অবিরত।। দৈবে একদিন রাজা বিন্ধিলা হরিণে। পলায় হরিণ, পাছু ধাইল আপনে।। পরিক্ষীত-বাণে জীয়ে কাহার জীবন। পলাইয়া গেল মৃগ দৈব-নিবন্ধন।। বহুদূর অরণ্যে পশিল নরবর। দেখিতে না পায় মৃগ অরণ্য-ভিতর।। তৃষ্ণায় আকুল বড় হয়ে পরীক্ষিত। গো-চারণ স্থানে এক হৈল উপনীত।। উপনীত হয়ে তথা দেখিবারে পান। বৎসগণ করিতেছে গাভী-দুগ্ধ পান।। তাহাদর মুখসৃত যত ফেণারাশি। বসিয়া করেন পান মৌনে এক ঋষি।। ঋষিবরে দেখি নৃপ করি সম্বোধন। ক্ষুধায়-কাতর হয়ে কহেন বচন।। আমি পরীক্ষিত রাজা শুন তপোধন। মম বিদ্ধ মৃগ এক কৈল পলায়ন।। কোন্ পথে গেল মৃগ বলে দেও মোরে। ক্ষুধায় তৃষ্ণায় ক্লান্ত হয়েছি অন্তরে।। মৌনব্রতধারী মুনি না কহে বচন। ভূপতি জিজ্ঞাসা কিন্তু করে পুনঃ পুনঃ।। মৌনব্রতে আছে মুনি রাজা নাহি জানে। উত্তর না পেয়ে রাজা ক্রুদ্ধ হৈল মনে।। একে ত রাজ্যের রাজা, দ্বিতীয়ে অতিথি। উত্তর না দিল, দুষ্ট ইহার প্রকৃতি।। এত ভাবি নৃপতি কুপিত হৈল মনে। মৃতসর্প ছিল দৈবে তার সন্নিধনে।। ধনুহুলে তুলি সর্প গলে জড়াইল। অশ্ব-আরোহণে রাজা হস্তিনাতে গেল।। ব্রাহ্মণের পুত্র মুনি শৃঙ্গী নাম ধরে। কৃশনামে তার সখা বলিল তাহারে।। কিবা গর্ব্ব কর আপনারে না জানিয়া। তব বাপে রাজা দণ্ডে, ঘরে দেখ গিয়া।। এত শুনি গেল শৃঙ্গী দেখিবারে বাপ। গলায় দেখিল বেড়ি আছে মৃত সাপ।। ক্রুদ্ধ হৈল শৃঙ্গী যেন জ্বলন্ত অনল। রাজাকে দিলেক শাপ হাতে করি জল।। আজি হৈতে সপ্তদিনে পরীক্ষিত নৃপে। তক্ষকে দংশিবে তারে মম এই শাপে।। এত বলি পরীক্ষিতে দিল ব্রহ্মশাপ। পুত্রের শুনিয়া শাপ দ্বিজে হৈল তাপ।। মৌনভঙ্গে দ্বিজবর করয়ে বিলাপ। অজ্ঞান সন্তান তুমি কৈলে মনস্তাপ।। অবোধ সন্তান তুমি করিলে কি কর্ম্ম। ক্রোধে তপ নষ্ট হয় প্রবল অধর্ম্ম।। রাজারে দিবার শাপ উচিত না হয়। রাজার প্রতাপে সব রাজ্য রক্ষা পায়।। রাজার আশ্রয়ে যজ্ঞ করে দ্বিজগণ। যজ্ঞ কৈলে বৃষ্টি হয় জন্মে শস্য-ধন।। দুষ্ট-দৈত্য-চোর-ভয় রাজার বিহনে। রাজ্য-রক্ষা হেতু ধাতা সৃজিল রাজনে।। রাজা দশ শোত্রিয় সমান বেদে বলে। হেন নৃপে শাপ দিয়া কুকর্ম্ম করিলে।। অন্য হেন রাজা নহে রাজা পরীক্ষিত। পিতামহ-সম রাজা স্বধর্ম্মে পণ্ডিত।। ব্রতধারী বলি মোরে রাজা নাহি জানে। ক্ষুধার্ত্ত অহিল রাজা আমার সদনে।। না কৈলে গৃহধর্ম্ম দিলা তবু শাপ। ক্ষমা কর পুত্র তার খণ্ড মনস্তাপ।। এত শুনি বলে শৃঙ্গী বাপের গোচরে। যে কথা বলিলা পিতা নারি খণ্ডিবারে।। সহজে বচন মম খণ্ডন না হয়। যে শাপ দিলাম ইহা খণ্ডিবার নয়।। এত শুনি মুনিবর হইল চিন্তিত। নিশ্চয় জানিল শাপ না হবে খণ্ডিত।। গৌরমুখ নামে শিষ্যে আনিল ডাকিয়া। পাঠাইল নৃপ-স্থানে সকল কহিয়া।। আজ্ঞা পেয়ে গেল শিষ্যে হস্তিনা -নগর। প্রবেশ করিল গিয়া যথা নৃপবর।। ব্রাহ্মণে দেখিয়া রাজা পাদ্য-অর্ঘ্য দিল। কোথা হৈতে আগমন বলি জিজ্ঞাসিল।। ব্রাহ্মণ বলিল, রাজা শুন সাবধানে। মৃগয়া-কারণ তুমি গিয়াছিলা বনে।। যে দ্বিজের গলে জড়াইলে মৃত-সাপ। অজ্ঞান তাহার পুত্র ক্রোধে দিল শাপ।। পুত্র শাপ দিল তাহা পিতা নাহি জানে। সে কারণ আমা পাঠাইল তব স্থানে।। বহু বহু প্রীতিবাক্য পুত্রেরে কহিল। তথাপি শাপান্ত তারে করিতে নারিল।। সাত দিনে করিবেক তক্ষক দংশন। জানিয়া উপায় শীঘ্র করহ রাজন।। বজ্রাঘাত হৈল শুনি ব্রাহ্মণ-বচন। আপনারে নিন্দা করি বলয়ে রাজন।। করিলাম কোন্ কর্ম্ম দুষ্ট কদাচার। ব্রাহ্মণে হিংসিনু আমি না করি বিচার।। আপন মরণ রাজা নাহি চিন্তে মনে। ব্রাহ্মণের তাপ হেতু নিন্দয়ে আপনে।। ধ্যানেতে ছিলেন মুনি আগে নাহি জানি। যে দণ্ড হইল মম সত্য করি মানি।। মুনিরাজে জানাইও আমার বিনয়। দৈবে যাহা করে তাহা খণ্ডন না হয়।। এত বলি ব্রাহ্মাণেরে করিয়া মেলানি। মন্ত্রণা করয়ে যত মন্ত্রিগণ আনি।। তক্ষকে দংশিবে সপ্ত দিবস ভিতরে। কি করি উপায় শীঘ্র জানাও আমারে।। মন্ত্রিগণ বলে রাজা কর অবধান। মঞ্চ এক উচ্চতর করহ নির্ম্মাণ।। উচ্চ এক স্তম্ভে মঞ্চ করিল বচন। চতুর্দ্দিকে জাগিয়া রহিল গুণিগণ।। সর্পের যতেক গদ-ঔষধি সংসারে। চতুর্দ্দিকে রাখিলেক যোজন বিস্তারে।। বেদবিজ্ঞ বিপ্র যত সিদ্ধ বাক্য যার। শত শত চতুর্দ্দিকে রহিল বাজার।। তাহে বসি দান-ধ্যান করে নৃপবর। হরিগুণ শুনে রাজা ধর্ম্মেতে তৎপর।। মহাভারতের কথা অমৃত সমান। কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।। ০২৪. পরীক্ষিতের নিকট তক্ষকের আগমন সৌতি বলে, অবধান কর মুনিগণ। এমত উপায় বহু কৈল মন্ত্রিগণ।। কাশ্যপ নামেতে মুনি সর্পমন্ত্রে গুণী। রাজারে দংশিবে সর্প লোকমুখে শুনি।। ধন ধর্ম্ম যশঃ পাব ভাবি দ্বিজবর। ত্বরা কির গেল দ্বিজ হস্তিনা-নগর।। তক্ষক আইসে বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের রূপে। বটবৃক্ষতলে দেখা পাইল কাশ্যপে।। তক্ষক বিলল, দ্বিজ এলে কোথা হৈতে। কোথাকারে যাহ বড় গমন ত্বরিতে।। কাশ্যপ বলেন, পরীক্ষিত নরবর। আজি তাঁরে দংশিবে তক্ষক-বিষধর।। সে কারণে যেই আমি রাজার সদনে। মন্ত্রবলে রক্ষা আমি করিব রাজনে।। তক্ষক বলিল, তুমি অবোধ ব্রাহ্মণ। কার শক্তি আছে রাখে তক্ষক-দংশন।। নিজ গৃহে ফিরি যাহ শুন দ্বিজবর। অকারণে লজ্জা পাবে সভার ভিতর।। কাশ্যপ বলিল, শুন গুরু মন্ত্রবলে। রাখিতে পারি যে আমি তক্ষক দংশিলে।। শুনিয়া তক্ষক ক্রুদ্ধ হৈল অতিশয়। আমিই তক্ষক বলি দিল পরিচয়।। নিবারিতে পার যদি আমার দংশন। এই বৃক্ষ দংশি দেখি করহ রক্ষণ।। কাশ্যপ বলিল, তুমি দংশ তরুবর। মন্ত্রবলে রাখি দেব আপন গোচর।। এতেক কাশ্যপ বাক্য তক্ষক শুনিয়া। দংশিলেক তরুবর যার ভস্ম হৈয়া।। লাফ দিয়া ভস্মমুষ্টি কাশ্যপ ধরিল। দেখ মোর মন্ত্রবল তক্ষকে বলিল।। মন্ত্র পড়ি ভস্মমুষ্টি গর্ত্তেতে ফেলিল। দৃষ্টিমাত্র সেইক্ষণে অঙ্কুর হইল।। দুই পত্র হয়ে হৈল দীর্ঘ তরুবর। শাখা-পত্র পূর্ব্বে যথা আছিল সুন্দর।। দেখিয়া তক্ষক হৈল বিষণ্ণ-বদন। কাশ্যপে চাহিয়া বলে বিনয়-বচন।। পরম পণ্ডিত তুমি গুণে মহাগুণী। তোমার চরিত্র লোকে অদ্ভুত কাহিনী।। রাখিতে আছয়ে শক্তি দেখিনু তোমার। কেমনে আমার বিষে কৈলা প্রতিকার।। আমা হৈতে রাখ হেন আছয়ে শকতি। রাখিতে নারিবা পরীক্ষিত নরপতি।। পূর্ব্বেতে দহিল তারে ব্রাহ্মণের বিষে। সেই বিষ ভয় করে দেব জগদীশে।। পদাঘাত খাইয়া করিল কৃতাঞ্জলি। বহু স্তব কৈল ভয়ে পাছে দেয় গালি।। ব্রাহ্মণের গালিতে কলঙ্কী শশধর। ব্রাহ্মণের গালিতে ভগাঙ্গ পুরন্দর।। আর যত জন আছে দেখ পৃথিবীতে। হেন জন কে না ডরে বিপ্রের গালিতে।। ব্রহ্মশাপে বিরোধ করিতে যদি মন। তবে তথাকারে তুমি করহ গমন।। যশ লভিবারে যদি যাবে দ্বিজবর। না পারিলে লজ্জা পাবে সভার ভিতর।। ধন ইচ্ছা করি যদি যাহ তথাকারে। আমি দিব যাহা নাহি রাজার ভাণ্ডারে।। এতেক বচন যদি তক্ষক বলিল। শুনিয়া কাশ্যপ দ্বিজ মনেতে ভাবিল।। ভাল বলে ফণিবর, লয় মোর মন। ব্রহ্মশাপে বিরোধ নাহিক প্রয়োজন।। নিশ্চয় জানিনু আয়ু নাহিক রাজার। চিন্তিয়া তক্ষক-বাক্য করিল স্বীকার।। কাশ্যপ বলিল, আমি দরিদ্র ব্রাহ্মণ। তবে আর কেন যাব পাই যদি ধন।। যাইতাম ধন-ধর্ম্ম-যশের কারণে। ব্রহ্মশাপ বিরোধে হইল ভয় মনে।। তুমি যদি দেহ ধন যাইব ফিরিয়া। এত শুনি ফণী মণি দিলেক লইয়া।। যাহার পরশে হয় লৌহাদি কাঞ্চন। হৃষ্ট হৈয়া বাহুড়িল দরিদ্র ব্রাহ্মণ।। বাহুড়ি কাশ্যপ গেল, চিন্তে ফলিবর। আস্তে আস্তে কহে লোক করয়ে উত্তর।। কেহ বলে, নৃপতিরে ব্রহ্মশাপ দিল। সপ্তম দিবস আজি আসি পূর্ণ হৈল।। কেহ বলে, রাজা বড় করিল উপায়। এক স্তম্ভে মঞ্চ করি বসি আছে তায়।। কাহার নাহিক শক্তি যাইতে তথায়। কেমনে তক্ষক গিয়া দংশিবে রাজায়।। নানাবিধ মহৌষধি আছে চারিভিতে। গুণিগণ শূণ্যপথ রুধিল মন্ত্রেতে।। পরস্পর এই কথা বলে সর্ব্বজন। শুনিয়া চিন্তিল চিত্তে কদ্রুর নন্দন।। সহচরগণ প্রতি বলিল বচন। ব্রাহ্মণের মূর্ত্তি এবে ধর সর্ব্বজন।। কেবল যাইতে নাহি ব্রাহ্মণের মানা। ব্রাহ্মাণের মূর্ত্তি তবে ধর সর্ব্বজনা।। ফলফুলে আশীর্ব্বাদ করিবে রাজারে। এই ফল-গুটী লৈয়া দিবে তাঁর করে।। শীঘ্রগতি না যাইবে যাবে ধীরে ধীরে। চিনিতে না পারে যেন রাজ-অনুচরে।। এত বলি ফল মধ্যে করিল আশ্রয়। শুনিয়া সকল নাগ বিপ্রমূর্ত্তি হয়।। সেই ফল নানা পুষ্প হাতে করি নিল। যথা মঞ্চে নরপতি তথায় চলিল।। ব্রাহ্মণের রোধ নাই রাজার দুয়ারে। ফল-ফুলে আশিস্ করিল নরবরে।। আনন্দে নৃপতি তার ফল ফুল নিল। ক্ষত ফল দেখি রাজা নখে বিদারিল।। ক্ষুদ্র এক পোকা তাহে লোহিত বরণ। কৃষ্ণবর্ণ মুখ তার দেখিল রাজন।। হেনকালে নৃপতি বলিল মন্ত্রিগণে। ব্রহ্মশাপে মুক্ত আজি হই সাত দিনে।। মুহূর্ত্তেক অস্ত হৈতে আছে দিনমণি। ব্রহ্মশাপ ব্যর্থ হৈল অদ্ভুত কাহিনী।। এই হেতু আশঙ্কিত হইতেছে মন। অব্যর্থ ব্রাহ্মণ শাপ হইল খণ্ডন।। এই পোকা তক্ষক হউক এইক্ষণ। দংশুক আমারে রহুক ব্রাহ্মণ-বচন।। এতেক বলিয়া পোকা মস্তকে রাখিল। শুনিয়া সকল মন্ত্রী না হৌক বলিল।। হেনমতে রাজা মন্ত্রী করয়ে বিচার। ততক্ষণে তক্ষক ধরিল নিজাকার।। প্রলয়ের মেঘ যেন করয়ে গর্জ্জন। শব্দ শুনি ভয়েতে পলায় মন্ত্রিগণ।। ভয়ঙ্কর মূর্ত্তি দেখি সবে হৈল ডর। জড়াইল লাঙ্গুলে রাজার কলেবর।। সহস্রেক ফণা ধরে ছত্রের আকার। শব্দ করি ব্রহ্মতালু দংশিল রাজার।। নৃপতিরে দংশিয়া চলিল অন্তরীক্ষে। রক্তপদ্ম আভা-তনু দেখে সর্ব্বলোকে।। রাজা সহ মঞ্চ জ্বলে বিষের আগুনে। কান্দে মন্ত্রিগণ সব রাজার মরণে।। অন্তঃপুরে শুনিয়া কান্দয়ে সর্ব্বজন। প্রেতকর্ম্ম রাজার করিল ততক্ষণ।। অগ্নিহোত্রে মৃত তনু করিল দাহন। শ্রাদ্ধ শান্তি কৈল তাঁর বিহিত লক্ষণ।। মন্ত্রিগণ-সহ যুক্তি করি সব প্রজা। তাঁর পুত্র জন্মেজয় তাঁরে কৈল রাজা।। বয়সে বালক শিশু বড় বুদ্ধি মন্ত। পরাক্রমে জন্মেজয় দুষ্টের দুরন্ত।। দেখিয়া রাজার গুণ যত মন্ত্রিগণ। কাশীরাজ কন্যা সহ করিল বরণ।। বপুষ্টমা নামে কাশীরাজের নন্দিনী। নানারত্নে ভূষিয়া দিলেন নৃপমণি।। বিভা করি জন্মেজয় আসে গৃহে লৈয়া। চিরদিন ক্রীড়া করে আনন্দিত হৈয়া।। এক পত্নী বিনা তাঁর অন্যে নাহি মন। ঊব্বশী সহিত যেন বুধের নন্দন।। নাগের চরিত্র আর কাশ্যপের কর্ম্ম। পরীক্ষিত-স্বর্গবাস জন্মেজয়-জন্ম।। এ সব রহস্য-কথা শুনে যেই জন। বংশবৃদ্ধি ধনবৃদ্ধি হরিপদে মন।। সবাঞ্ছিত ফল পায়, কহিলেন ব্যাস। সর্ব্বপাপে মুক্ত হয় পুণ্যের প্রকাশ।। আদিপর্ব্বে ভারত অমৃতবৎ কথা। কাশীরাম দাস কহে পাঁচালীর গাঁথা।। ০২৫. জরুৎকারুর পত্নীত্যাগ শৌনকাদি মুনি বলে শুন সূত-সুত। কহিলা সকল কথা শ্রবণে অদ্ভুত।। জরৎকারু মুনিরে বাসুকি ভগ্নী দিল। কহ শুনি আস্তিকের কিরূপে জন্ম হৈল।। সৌতি বলে, জরৎকারু বিবাহ করিয়া। পূর্ব্ববৎ বনে বনে বেড়ায় ভ্রমিয়া।। একদা ভগ্নীরে ডাকি বাসুকি কহিল। কহ ভগ্নি মুনি-সহ কি কথা হইল।। রক্ষন ভরণ মুনি করে কি তোমার। সত্য করি কহ তুমি অগ্রেতে আমার।। জরৎকারী বলে, আমি মুনি নাহি দেখি। কোথা যায় কোথা থাকে বঞ্চি যে একাকী।। এত শুনি বাসুকির বিষণ্ণ-বদন। আর দিনে মুনির পাইল দরশন।। বাসুকি বলেন, মুনি কর অবধান। তোমাকে আপন ভগ্নী করিলাম দান।। রাখিয়াছিলাম যত্নে তোমার কারণ। বিবাহ করিয়া তারে করিবে পালন।। মুনি বলে, মোর চিত্তে বিবাহ না ছিল। পিতৃগণ-দুঃখে বিভা করিতে হইল।। গৃহে বাস করিতে না লয় মোর মন। শরীরে না সহে মোর কাহার বচন।। তোমার ভগিনী সত্য করুক গোচরে। কখন না কোন বাক্য বলিবে আমারে।। যদি বলে ত্যজিব আমার সত্য-বাণী। বাসুকি বলিল, সত্য যাহা বল মুনি।। মম ভগ্নী করিবে অপ্রিয় যেই দিনে। নিশ্চয় করিও ত্যাগ তাহারে সে দিনে।। তবে ত বাসুকি গৃহ নির্ম্মাণ করিয়া। বহু মণিরত্নে তাহা দিলেন ভরিয়া।। পত্নী-সহ মুনি তথা করেন বসতি। কতদিনে জরুৎকারী হৈল ঋতুমতী।। ধরিল নাগিনী গর্ভ মুনির ঔরসে। শশিকলা বাড়ে যেন দিবসে দিবসে।। বহু সেবা করে কন্যা জানি মুনি-মন। করযোড়ে সম্মুখেতে থাকে অনুক্ষণ।। যখন যে আজ্ঞা করে জরৎকারু মুনি। আজ্ঞামাত্র সেই কর্ম্ম করয়ে নাগিনী।। হেনমতে বহু সেবা করে প্রতিদিনে। দৈবে এক দিন দেখ দিবা অবসানে।। মুনি নিদ্রাযুক্ত কন্যা-উরে শির দিয়া। শয়ন করিয়া আছে অচেতন হৈয়া।। নিদ্রা যায় মুনি, হৈল সন্ধ্যার সময়। দেখিয়া নাগিনী মনে ভাবিলেক ভয়।। অস্ত গেল দিনকর সন্ধ্যা যায় বৈয়া। না বলিলে ক্রোধ মোরে করিবে জাগিয়া।। নিদ্রাভঙ্গ হৈলে পাছে ক্রোধ করে মুনি। হইল পরম চিন্তা এত সব গণি।। যাহা করে করিবেক পরে মুনিরাজে। সন্ধ্যা-ধর্ম্ম না রাখিলে হইবে অকাজ।। অবহেলে যেই দ্বিজ সন্ধ্যা নাহি করে। পঞ্চ মহাপাপ জন্মে তাহার শরীরে।। এত ভাবি জরৎকারী বলিল ডাকিয়া। উঠ সন্ধ্যা কর প্রভু সন্ধ্যা যায় বৈয়া।। নিদ্রাভঙ্গ হৈয়া মুনি উঠে মহাকোপে। লোহিত বরণ মুখ অধরোষ্ঠ কাঁপে।। অমান্য করিলি মোরে করি অহঙ্কার। এই দোষে তোর মুখ না দেখিব আর।। জরৎকারী বলে, প্রভু মোর নাহি দোষ। অকারণে মের প্রতি কেন কর রোষ।। সন্ধ্যা বহি যায় প্রভু সূর্য্য গেল অস্ত। সন্ধ্যাহীনে যত পাপ জানহ সমস্ত।। সে কারণে নিদ্রাভঙ্গ করিনু তোমার। তবে ত্যাগ কর দোষ বুঝিয়া আমার।। মুনি বলে, নাগিনী বলিস না বুঝিয়া। আমি সন্ধ্যা না করিলে যাবে কি বহিয়া।। অরে অরে সন্ধ্যা তোর কেমন বিচার। মোরে না বলিয়া যাহ বড় অহঙ্কার।। সন্ধ্যা বলে মুনিরাজ না করিহ ক্রোধ। এই যে আছি যে, আমি তব উপরোধ।। মুনি বলে, নাগিনী শুনিলি নিজ কানে। অবজ্ঞা করিলি মোরে কি সামান্য জ্ঞানে।। নিশ্চয় ত্যজিয়া তোরে যাই আমি বন। পুনরপি না দেখিব তোর এ বদন।। মুনির নির্ঘাত বাক্য শুনিয়া সুন্দরী। কান্দিতে কান্দিতে কহে চরণেতে ধরি।। না জানিয়া করিলাম প্রভু অপরাধ। এবার ক্ষমহ মোরে করহ প্রসাদ।। ভাই সব শুনি মোর হইবে নিরাশ। তোমারে দিলেক ভাই করি বড় আশ।। মাতৃশাপে ভ্রাতৃ-মনে বড় ছিল ভয়। তোমারে আমাকে দিয়া খণ্ডিল সংশয়।। তোমার ঔরসে যেই হইবে নন্দন। তাহা হৈতে রক্ষা পাবে মোর ভ্রাতৃগণ।। বংশ না হৈতে তুমি যাহ যে ছাড়িয়া। ভ্রাতৃগণে প্রবোধিব কি বোল বলিয়া।।। নিশ্চয় ছাড়িয়া যদি যাবে তুমি মোরে। শরীর ত্যজিব আমি তোমার গোচরে।। এত শুনি সদয় হইল মুনিবর। আশ্বাসিয়া কন্যার উদরে দিল কর।। অস্তি অস্তি বলিয়া বুলায় গর্ভে হাত। এই গর্ভে হবে পুত্র নাগ-কুল-নাথ।। এই গর্ভে আছে যেই পুরুষ রতন। তোমার আমার কুল করিবে রক্ষণ।। চিন্তা ছাড়ি যাহ প্রিয়ে নিজ ভ্রাতৃগৃহে। ভ্রাতৃগণ প্রবোধিবে যেন দুঃখী নহে।। বলিলাম বাক্য মোর কভু মিথ্যা নয়। ত্যজিলায় তোমারে যে জানিহ নিশ্চয়।। এত বলি আশ্বাসিয়া নিজ বনিতায়। গৃহ ত্যজি পুনঃ মুনি যান তপস্যায়।। অব্যর্থ ব্রাহ্মণবাক্য অন্তরেতে গণি। মুনিবরে কিছু আর না কহে নাগিনী।। মস্তকে বন্দিয়া ব্রাহ্মণের পদরজ। কহে কাশীরাম দাস গদাধরাগ্রজ।। ০২৬. আস্তিকের জন্ম ত্যজিয়া কন্যার পাশ, মুনি গেল বনবাস, পত্নীরে রাখিয়া একাকিনী। অশ্রুজলপূর্ণ মুখে, করাঘাত হানে বুকে, ভ্রাতৃস্থানে চলিল নাগিনী।। ক্রন্দন-করয়ে স্বসা, মুখে না আইসে ভাষা, দেখিয়া বাসুকি চমকিত। আশ্বাসিয়া নাগরাজ, স্বসাকে জিজ্ঞাসে কাজ, কান্দ কেন হইয়া দুঃখিত।। ভ্রাতার বচন শুনি, কহে গদগদ বাণী, আপনার যত বিবরণ। অবধান কর ভাই, কিছু মোর দোষ নাই, মুনিরাজ ছাড়ি গেল বন।। নির্ঘাত সদৃশ বাণী, ভগিনীর বাক্য শুনি, নাগরাজ বিষণ্ণ-বদন। একেত মায়ের শাপে, সর্ব্বদা শরীর কাঁপে, তাহে পুন হৈল দুর্ঘটন।। বলে, ভগ্নীকহ মোরে, জিজ্ঞাসিতে লজ্জা করে, উপায় করিয়া দিল ধাতা।। মুনিবীর্য্যে গর্ভ তব, হবে পুত্র সমুদ্ভব, নাগকুল করিবে যে ত্রাণ। তাহার কারণে তোরে, চিরদিন রাখি ঘরে, জরৎকারে করিলাম দান।। না হইতে বংশধর, ত্যজিলেন মুনিবর, মাতৃশাপে সদা চিন্তে মন। হয়েছে কি গর্ভতোর, লজ্জা ত্যজি অগ্রে মোর, কহ শুনি সত্য বিবরণ।। জিজ্ঞাসিতে লজ্জা হয়, তবু না পুছিলে নয়, বড় দায় আমা সবাকার। সত্য করি কহ মোরে, কহিলে কি মুনিবরে, যে কারণে বিবাহ তোমার।। ভ্রাতার বচন শুনি, সলজ্জিতা সুবদনী, কহিতে লাগিলা অধোমুখে। যতেক কহিলে তুমি, সব তত্ত্ব জানি আমি, বিচারিয়া কহিনু মুনিকে।। মুনি যবে যায় ছাড়ি, চরণ-যুগলে পড়ি, বংশ হেতু কৈনু নিবেদন। সদয় হইয়া মুনি, অস্তি অস্তি বলে বাণী, এই গর্ভে হইবে নন্দন।। তোমার যতেক ভ্রাতৃ, আমার যতেক পিতৃ, দুই কুল করিবে উদ্ধার। এতেক বলিয়া মোরে, মুনি গেল দেশান্তরে, নিবারিয়া ক্রন্দন আমার।। ত্যজ ভাই মনস্তাপ, নিস্তারিতে মাতৃশাপ, কভু নাহি মিথ্যা কহে মুনি। জরৎকারী ইহা বলে, যেন সুধাবৃষ্টি হলে, আনন্দেতে নাচে সব ফণী।। উল্লসিত নাগরাজা, ভগিনীর করে পূজা, নানা রত্নে করিল ভূষিত। দিব্য বস্ত্র অলঙ্কার, বহু ভক্ষ্য উপহার, সেবায় যতেক নিয়োজিত।। তবে ভুজঙ্গম-পতি, পুছে জরৎকারী প্রতি, কহ তুমি ইহার কারণ। কহ সত্য জরৎকারী, কি দোষ তোমার হেরি, মুনিরাজ ছাড়ি গেল বন।। আমি তাঁরে ভাল জানি, বড় উগ্র সেই মুনি, বিনা দোষে ত্যজিয়াছে তোমা। তথাপি কি দেখি দোষ, করিলেক এত রোষ, একা গৃহে ছাড়ি গেল রামা।। জরৎকারী বলে ভাই, শুন তবে বলি তাই, আজিকার দিন অবসানে। শির দিয়া মোর উরে, নিদ্রা গেল মুনিবরে, অস্ত গেল তপন গগনে।। সন্ধ্যাভঙ্গ হয় মুনি, মনে আমি ভয় গণি, জাগরণে পাছে ক্রোধ করে। সন্ধ্যাহীন যেই দ্বিজ, মন্ত্রহীন যেন বীজ, তে কারণে জাগালাম তাঁরে।। জাগি রক্তমুখ কোপে, দেখিয়া হৃদয় কাঁপে, বলে মোরে অবজ্ঞা করিলি। আমি সন্ধ্যা না করিতে, সন্ধ্যা যাবে কোনমতে, সন্ধ্যারে ডাকিল ইহা বলি।। সন্ধ্যা মনে ভয় পাই, বলে আমি যাই নাই, আছি যে তোমার উপরোধে। সন্ধ্যার বচন শুনি, ত্যাগ করি গেল মুনি, এইমত মম অপরাধে।। মুনির বচন শুনি, বিস্ময় মানিল ফণী, ভগিনীরে তোষে মৃদুভাষে। ভাল হৈল গেল দ্বিজ, দুঃখ না ভাবিহ নিজ, থাক গৃহে পরম সন্তোষে।। সহস্রেক সহোদর, আর যত অনুচর, সহস্রেক বধূর সহিত। সেবিবে তোমার পায়, সর্ব্বদা ঈশ্বরী প্রায়, মোর গৃহে থাক অচিন্তিত।। এত বলি ফণিবর, ডাকি সব সহোদর, নিয়োজিল তাহার সেবনে। হেনমতে জরৎকারী, সর্ব্বদুঃক পরিহরি, রহিলেন ভ্রাতার ভবনে।। গর্ভ বাড়ে অহর্নিশি, শুক্লপক্ষে যেন শশী, প্রসবিল সময় সংযোগে। পরম সুন্দর কায়, শিশু পূর্ণশশী প্রায়, দেখি আনন্দিত সব নাগে।। রূপে গুণে অনুপাম, আস্তিক থুইল নাম, গর্ভকালে কহি গেল পিতা। শৈশব হইতে সুত, সকল গুণেতে যুত, বেদ বিদ্যা ব্রতে পারগতা।। আস্তিকের জন্মকথা, অপূর্ব্ব ভারত-গাথা, শুনিলে অধর্ম্ম হয় নাশ। কমলাকান্তের সুত, হেতু সুজনের প্রীত, বিরচিল কাশীরাম দাস।। ০২৭. উপমন্যু ও আরুণির উপাখ্যান সৌতি বলে, অপূর্ব্ব শুনহ মুনিগণ। কহিব বিচিত্র কথা পুরাণ-বচন।। অবন্তীনগরে দ্বিজ নাম শান্তিপন। তাঁর স্থানে শিষ্যগণ করে অধ্যয়ন।। এক শিষ্যে দ্বিজ গাভী কৈল সমর্পণ। গুরু-আজ্ঞা পেয়ে তারে করেন রক্ষণ।। কতদিনে বলে গুরু, কহ শিষ্যবর। বড় পুষ্ট দেখি যে তোমার কলেবর।। কিবা খাও কোথা পাও কহ সত্যবাণী। শুনিয়া বলেন শিষ্য করি যোড়পাণি।। গাভী দোহনান্তে যবে পিয়ে বৎসগণ। পশ্চাতে খাই যে আমি করিয়া দোহন।। গুরু বলে, এতদিনে সব জানা গেল। এই হেতু বৎসগণ দুর্ব্বল হইল।। আর কভু তুমি না করিহ হেন কাজ। গাভী দুহি খাও তুমি নাহি ভয় লাজ।। গুরু-আজ্ঞা শুনি দ্বিজ গেল গাভী লৈয়া। কতদিনে পুনঃ বিপ্র কহিল ডাকিয়া।। উচিত কহিলে শিষ্য না হইও রুষ্ট। পুনশ্চ তোমারে বড় দেখি হৃষ্টপুষ্ট।। গাভী-দুগ্ধ পুনঃ বুঝি তুমি কর পান। শিষ্য বলে, গোসাঞি করহ অবধান।। যেই দিন হৈতে তুমি করিলা বারণ। ভিক্ষা করি নিত্য করি উদর পূরণ।। গুরু বলে, ভিক্ষা করি পূরহ উদরে। এবে ভিক্ষা করি সব আনি দিও মোরে।। এত শুনি গাভী লৈয়া গেল শিষ্যবর। পুনঃ জিজ্ঞাসিল কত দিবস অন্তর।। কহ শিষ্য, বড় পুষ্ট দেখি তব কায়। কি খাইয়া আছ তুমি বলহ আমায়।। শিষ্য বলে, গাভী রাখি অরণ্য-ভিতর। রক্ষক রাখিয়া আমি যাই যে নগর।। দিবসেত যত ভিক্ষা, দিই তব ঘরে। সন্ধ্যাতে মাগিয়া ভিক্ষা ভরি যে উদরে।। হাসিয়া বলেন গরু, এ কোন্ বিচার। শ্রেষ্ঠ ভিক্ষা রাত্রে তুমি কর আপনার।। রাত্রিদিবা যত পাও, আনি দিবে মোরে। এত শুনি গাভী লৈয়া গেল বন ঘোরে।। ক্ষুধায় আকুল তনু ভ্রমে বনে-বন। অর্কের কোমল পত্র করয়ে ভক্ষণ।। নয়ন হইল অন্ধ শীর্ণ হৈল কায়। দেখিতে না পায়, তবু গোধন চরায়।। ভ্রমিতে ভ্রমিতে দেখ দৈবের লিখন। নিরুদক-কূপ-মধ্য পড়িল ব্রাহ্মণ।। সমস্ত দিবস গেল, হৈল সন্ধ্যাকাল। গৃহেতে আইল যত গোধনের পাল।। শিষ্যে না দেখিয়া গুরু দুঃখিত অন্তর। অন্বেষণে গেল দ্বিজ অরণ্য-ভিতর।। কোথা গেলে উপমন্যু! ডাকে দ্বিজবর। উপমন্যু বলে, চক্ষে না পাই দেখিতে।। অর্কপত্র খাইয়া নয়ন অন্ধ হৈল। শুনিয়া আশ্চর্য্য তবে উপদেশ কৈল।। দেব-বৈদ্য অশ্বিনীকুমার দুইজন। শীঘ্র কর দ্বিজবর তাঁদের স্মরণ।। এত শুনি দ্বিজ বহু স্তবন করিল। ততক্ষণে দুই চক্ষু নির্ম্মল হইল।। কূপ হৈতে উঠিয়া ধরিলা গুরুপাদ। সন্তুষ্ট হইয়া গুরু কৈল আশীর্ব্বাদ।। চারি বেদ, ষাট্ শাস্ত্র, জানহ সকলে। যাহ দ্বিজ নিজ গৃহে পরম কুশলে।। আজ্ঞা পেয়ে গেল দ্বিজ আহ্লাদিত মনে। সর্ব্বশাস্ত্রে জ্ঞান হৈল গুরুর বচনে।। আরুণি-নামেতে শিষ্য ছিল অন্য জন। ডাকি তারে গুরু আজ্ঞা কৈল ততক্ষণ।। ধান্য-ক্ষেত্রে জল সব যাইছে বহিয়া। যত্ন করি আলি বাঁধি জল রাখ গিয়া।। আজ্ঞামাত্র আরুণি যে করিল গমন। আলি বাঁধিবারে বহু করিল যতন।। দন্তেতে খুঁড়িয়া মাটি বাঁধালেতে ফেলে। রাখিতে না পারে মাটি, অতি বেগ জলে।। পুনঃ পুনঃ শিষ্যবর করিল যতন। না পারিল ক্ষেত্রজল করিতে বন্ধন।। জল বহি যায়, গুরু পাছে ক্রোধ করে। আপনি শুইল শিষ্য বাঁধাল উপরে।। সমস্ত দিবস গেল, হইল রজনী। না আইল শিষ্য, গুরু চলিল আপনি।। ক্ষেত্র মধ্যে গিয়া ডাক দিল দ্বিজবর। শিষ্য বলে, শুয়ে আছি বাঁধের উপর।। বহু যত্ন করিলাম, না রহে বন্ধন। আপনি শুলাম বাঁধে তাহার কারণ।। শুনিয়া বলিল গুরু, এস হে উঠিয়া। শীঘ্র আসি গুরু পায় প্রণমিল গিয়া।। শিষ্যেরে দেখিয়া গুরু আনন্দিত মন। সঙ্গে করি নিজ গৃহে করিল গমন।। আশিস্ করিয়া গুরু করিল কল্যাণ। চারি বেদ, ষট্ শাস্ত্রে হৌক্ তব জ্ঞান।। এত বলি বিদায় করিল দ্বিজবর। প্রণাম করিয়া শিষ্য গেল নিজ ঘর।। সুধার সমান মহাভারতের কথা। যে জন শুনে তার নাশয়ে দুঃখ ব্যথা।। আরুণি শিষ্যের সে অপূর্ব্ব উপাখ্যান। কাশী কহে শুনিলে জন্ময়ে দিব্য জ্ঞান।। ০২৮. উতঙ্কের উপাখ্যান উতঙ্ক তৃতীয় শিষ্য পড়ে গুরু-স্থানে। একদিন যায় গুরু যজ্ঞ-নিমন্ত্রণে।। উতঙ্কে বলিল গুরু থাক তুমি ঘরে। কিছু নষ্ট নাহি হয় রাখিবা গোচরে।। এত বলি গেল গুরু, যথা যজ্ঞস্থান। কতদিনে গুরুপত্নী কৈল ঋতু-স্নান।। উতঙ্কে ডাকিয়া তবে ব্রাহ্মণী বলিল। তোমারে সমর্পি গৃহ তব গুরু গেল।। কোন দ্রব্য নষ্ট যেন নহে কদাচন। ঋতু নষ্ট হয় তুমি করহ রক্ষণ।। শুনিয়া বিস্ময়-চিত্ত হইল উতঙ্ক। উদ্বিগ্ন বসিয়া ভাবে হৃদয়ে আতঙ্ক।। কি করিব, কি হইবে ইহার উপায়। গৃহরক্ষা হেতু গুরু রাখিলা আমায়।। ঋতুরক্ষা-কর্ম্ম এই না হয় আমার। পরদার মহাপাপ, তাহে গুরুদার।। এত চিন্তি ব্রাহ্মণীর না রাখে অনুরোধ। নৈরাশ হইয়া ব্রাহ্মণীর হৈল ক্রোধ।। প্রকাশ ভয়ে ক্রোধ না করিল প্রকাশ। কিছুকাল পরে বেদ আইল নিজ বাস।। উতঙ্কের তাপ ব্রাহ্মণীর মনে জাগে। একান্তে ব্রাহ্মণী কহে ব্রাহ্মণের আগে।। দিবে গুরু-দক্ষিণা উতঙ্ক যেইক্ষণে। পাঠাইবা তাহাকে আমার সন্নিধানে।। না জানিল দ্বিজ এ সকল বিবরণ। সযতনে শিষ্য করেছে গৃহের রক্ষণ।। শিষ্য প্রতি বেদ গুরু তুষ্ট অতি হন। তুষ্ট হয়ে উতঙ্কে বলিল ততক্ষণ।। যাহ শিষ্য সর্ব্বশাস্ত্র হও তুমি জ্ঞাত। শুনিয়া উতঙ্ক কহে করি যোড়-হাত।। আজ্ঞা কর গোঁসাই দক্ষিণা কিছু দিব। গুরু বলে, তব পাশ কিছু না মাগিব।। দেহ তবে তব গুরুপত্নী যাহা মাগে। এত শুনি গেল শিষ্য গুরুপত্নী আগে।। দক্ষিণা যাচয়ে শিষ্য করি যোড়পাণি। হৃদয়ে চিন্তিয়া তবে বলিল ব্রাহ্মণী।। পৌষ্য নৃপ মহিষীর শ্রবণ-কুণ্ডল। আনি দিলে পাই তব দক্ষিণা সকল।। সপ্তদিন ভিতরে আনিয়া দিবে মোরে। না আনিলে দিব শাপ কহিলাম তোরে।। এত শুনি উতঙ্ক গুরুরে নিবেদিল। যাও হে নির্ব্বিঘ্নে দ্বিজ, গুরু আজ্ঞা দিল।। গুরুকে প্রণাম করি উতঙ্ক চলিল। কতদূরে পথে এক বৃষভ দেখিল।। পুরীষ ত্যজিয়া বৃষ আছে দাঁড়াইয়া। উতঙ্কে দেখিয়া বৃষ বলিল ডাকিয়া।। হের দেখ মল মোর উতঙ্ক ব্রাহ্মণ। হইবে তোমার শ্রেয় করহ ভক্ষণ।। উতঙ্ক বলিল, হেন নহে কদাচান। অসম্মান মোরে কেন কর অকারণ।। বৃষ বলে, অসম্মান নহে দ্বিজবর। তোমার গুরুর দিব্য, খাও এ গোবর।। গুরু-দিব্য শুনি দ্বিজ চিন্তিয়া বিস্তর। গোবর ভক্ষণ করি চলিল সত্বর।। তথা হৈতে চলি গেল পৌষ্য-নৃপ-ঘর। মাগিল কুণ্ডল-যুগ্ম নৃপতি-গোচর।। নৃপ পাঠাইল দ্বিজে রাণীর সদনে। কর্ণ হৈতে কুণ্ডল দিলেন ততক্ষণে।। কর্ণ হৈতে কুণ্ডল কাটিয়া দিল রাণী। পাইয়া কুণ্ডল চলি গেল দ্বিজমণি।। যেইক্ষণে দ্বিজ হাতে কুণ্ডল পাইল। যেইক্ষণে তক্ষক তাহার সঙ্গ নিল।। পরশ করিতে দ্বিজে নাহিক শকতি। পাছে পাছে যায় ধরি সন্ন্যাসী-মূরতি।। কত পথে উতঙ্ক দেখিয়া সরোবর। স্নানেতে নামিল বস্ত্র থুইয়া উপর।। বসন-ভিতরে-দ্বিজ কুণ্ডল থুইল। ছিদ্র প্রাপ্তে তক্ষক কুণ্ডল হরে নিল।। উতঙ্ক দেখয়ে থাকি জলের ভিতরে। সন্ন্যাসী কুণ্ডল লৈয়া পশিল বিবরে।। ত্যজিয়া সে স্নান দ্বিজ ধায় মুক্তচুল। বিবরের দ্বারে দেখে, না পশে আঙ্গুল।। উপায় না দেখি মুনি বিষাদিত-মন। নখেতে বিবর-দ্বার করয়ে খনন।। এ সকল বৃত্তান্ত জানিল পুরন্দর। ব্রাহ্মণের দুঃখে দুঃখী হইল অন্তর।। সেই রন্ধ্রে নিজ বজ্র কৈল নিয়োজন। বিবরের দ্বার মুক্ত হৈল ততক্ষণ।। পাতালে উতঙ্ক গিয়া প্রবেশ করিল। কতই অদ্ভুত দৃশ্য সেখানে দেখিল।। চন্দ্র-সূর্য্য-গতায়াত গ্রহ তারাগণ। মাস বর্ষ ষড়-ঋতু সবার সদন।। অনেক ভ্রমিল দ্বিজ পাতাল-ভিতরে। না দেখিয়া সন্ন্যাসীরে চিন্তিত অন্তরে।। হেনকালে অশ্বরূপে বলে বৈশ্বানর। হে উতঙ্ক-ব্রাহ্মণ আমার বাক্য ধর।। গুরু-জ্ঞানে মোরে তুমি করহ বিশ্বাস। শ্রেয় হবে, মোর গুহ্যে করহ বাতাস।। গুরু-নাম শুনি দ্বিজ বিলম্ব না কৈল। কিছু না পাইয়া মুখে গুহ্যে ফুঁক দিল।। গুহ্যে ফুঁক দিত ধূম বাহিরিল মুখে। ধূমময় সকলি করিল নাগলোকে।। প্রলয়ের প্রায় হৈল ঘোর অন্ধকার। বিস্ময় হইয়া নাগ কৈল হাহাকার।। বাসুকি প্রভৃতি যত শ্রেষ্ঠ নাগগণ। কি হেতু হইল ধূম জিজ্ঞাসে কারণ।। চর-মুখে বৃত্তান্ত পাইয়া ততক্ষণ। তক্ষকে আনিয়া বহু করিল গঞ্জন।। দেহ শীঘ্র কুণ্ডল, ব্রাহ্মণ হোক্ সুখী। এত বলি দ্বিজে তুষ্ট করিলা বাসুকি।। কুণ্ডল পাইয়া দ্বিজ গেল অশ্ব-স্থানে। পৃষ্ঠে করি অশ্ব-লয়ে থুইল ব্রাহ্মণে।। সপ্তদিন পূর্ণে আসি গুরুর গৃহেতে। দেখে গুরুপত্নী ক্রোধে আছে জল হাতে।। মুখেতে নির্গত হৈতেছিল শাপবাণী। হেনকালে উতঙ্ক দিলেন যুগ্মমণি।। কুণ্ডল পাইয়া হৃষ্ট ব্রাহ্মণী হইল। উতঙ্ক সকল কথা গুরুকে কহিল।। গুরু কহে, যেই বৃষ দিলেন গোবর। বৃষ নহে অমৃত দিলেন পুরন্দর।। সন্ন্যাসীর বেশে যেই লইল কুণ্ডল। তক্ষক বিবরদ্বারে গেল রসাতল।। অশ্বরূপে যে তোমার কৈল উপকার। অশ্ব নহে, অগ্নি ইষ্ট সহজে আমার।। এত শুনি উতঙ্কের মনে হৈল তাপ। বিনাদোষে দুঃখ মোরে দিল দুষ্ট সাপ।। তার সমুচিত ফল আমি দিব তারে। এত বলি বিদায় মাগিল দ্বিজবরে।। গুরু প্রদক্ষিণ করি করিল গমন। যথা রাজা জন্মেজয়, চলিল ব্রাহ্মণ।। ব্রাহ্মণে দেখিয়া রাজা করিল বন্দন। জিজ্ঞাসিল দ্বিজবরে কেন আগমন।। দ্বিজ বলে, নৃপতি করহ কোন্ কর্ম্ম। পিতৃবৈরী না শাসিলে নহে পুত্রধর্ম্ম।। চণ্ডাল তক্ষক-নাগ বড় দুরাচার। দংশিল তোমার বাপে বিখ্যাত সংসার।। তাহার উচিত রাজা করিতে যুয়ায়। সর্পকুল বিনাশিতে করহ উপায়।। উতঙ্ক-বচন শুনি রাজা জন্মেজয়। মন্ত্রিগণে জিজ্ঞাসিল মানিয়া বিস্ময়।। কহ সত্য মন্ত্রিগণ ইহার কারণ। তক্ষক-দংশনে হৈল পিতার মরণ।। ব্রহ্মশাপে মরিলেক পিতা, হেন জানি। তক্ষক এমন কৈল, কভু নাহি শুনি।। রাজার এমন বাক্য শুনি মন্ত্রিগণ। কহিতে লাগিল তবে কথা পূরাতন।। মহাভারতের কথা সুধার লহরী। কিবা যে শকতি বর্ণিবারে তাহা পারি।। উতঙ্ক মুনির কথা শ্রবণে অমৃত। কাশীরাম কহে সাধু পিয়ে অনুব্রত।। ০২৯. জন্মেজয়ের সর্পযজ্ঞের মন্ত্রণা মন্ত্রিগণ বলে, রাজা কর অবধান। প্রতাপে তোমার পিতা পাবক-সমান।। মৃগয়া কারণে রাজা ভ্রমে বনে-বন। একদিন হৈল তথা দৈব-নিবন্ধন।। বিন্ধিয়া হরিণ, রাজা পাছে পাছে ধায়। আচম্বিতে দ্বিজে এক দেখিল তথায়।। ক্ষুধায় আকুল রাজা জিজ্ঞাসিল তাঁরে। মৌনে ছিল মুনি, কিছু না কহে রাজারে।। দৈবে এক মৃত-সর্প নৃপতি দেখিল। ক্রোধে লয়ে মুনি-গলে জড়াইয়া দিল।। অনন্তর নরবর স্বরাজ্যে আসিল। কিছু না বলিল মুনি, মৌনেতে রহিল।। শৃঙ্গী-নামে ঋষিপুত্র শুনি ক্রোধে শাপে। সপ্তম দিবসে নৃপে দংশিবেক সাপে।। পুত্র শাপ দিল, পিতা দুঃখিত হইয়া। রাজারে জানায় তবে দূত পাঠাইয়া।। বার্ত্তা পেয়ে করিলেক ভূপতি উপায়। সপ্তম-দিবস-কথা কহি শুন রায়।। কাশ্যপ নমেতে মুনি সর্পমন্ত্রে গুণী। রাজারে দংশিবে সর্প লোকমুখে শুনি।। বাঁচাতে আসিতেছিল হস্তিনা-নগরে। পথে দেখা পাইল তক্ষক বিষধরে।। নিজ নিজ গুণ পরীক্ষিতে দুইজনে। ভস্ম হৈয়া গেল বৃক্ষ তক্ষক-দংশনে।। কাশ্যপের মন্ত্রে বৃক্ষ পুনশ্চ জন্মিল। তক্ষক দেখিয়া মনে বিস্ময় মানিল।। আপন মাথার মণি লয়ে ফণিবর। ফিরাইল দ্বিজে দিয়া করি সমাদর।। ধন পেয়ে দরিদ্র ব্রাহ্মণ বাহুড়িল। কপটে তক্ষক আসি রাজারে দংশিল।। এত শুনি নৃপ জিজ্ঞাসিল আরবার। সত্য কহ, শুনিয়া করিব প্রতিকার।। কাশ্যপে তক্ষকে কথা হইল যখন। এ সকল বার্ত্তা শুনিলেক কোন্ জন।। মন্ত্রিগন বলে, সর্প যে বৃক্ষ দংশিল। কাষ্ঠ হেতু সেই বৃক্ষে এক দ্বিজ ছিল।। বৃক্ষের সহিত সেই ভস্ম যে হইল। পুনঃ বৃক্ষ সহ দ্বিজ জীবন লভিল।। দেখিল শুনিল যত কহিল নগরে। এত শুনি নৃপতি কচালে করে করে।। সঘনে নিঃশ্বাস ছাড়ে, করয়ে ক্রন্দন। গদগদ ভাষে রাজা বলেন বচন।। মন্ত্রবিদ্ কাশ্যপের আশ্চর্য্য ক্ষমতা। নিশ্চয় বাঁচিত পিতা, না হৈত অন্যথা।। দারুণ তক্ষক সর্প তারে ফিরাইল। তক্ষক আমার বৈরী, এবে জানা গেল।। বিপ্রের বচনে আসি করিল দংশন। কাশ্যপেরে ফিরাইল কিসের কারণ।। ধন দিয়া করে লোক পর-উপকার। ধন দিয়া মোর বাপে করিল সংহার।। পুনর্ব্বার রাজা কহে, শুন মন্ত্রিগণ। সত্য কহিলেক যত উতঙ্ক ব্রাহ্মণ।। উতঙ্কের প্রিয়কার্য্য করিতে সাধন। নিশ্চয় করিব পিতৃবৈরী-নির্য্যাতন।। নাশিব নাগের কুল প্রতিজ্ঞা আমার। পিতৃ-কার্য্য সাধি হৈব পিতৃঋণে পার।। এত বলি পুরোহিত আর দ্বিজগণে। আহবান করিয়া রাজা কহেন যতনে।। সর্প বিনাশিতে চেষ্টা হইল আমার। সবংশে সকল নাগ করিব সংহার।। বিষজালে যেমন পুড়িল মোর বাপ। সেইরূপে অগ্নিতে পোড়াব যত সাপ।। বিপ্রগণ বলে, রাজা আছয়ে উপায়। সর্প সংহারিতে যজ্ঞ কর কুরুরায়।। তোমার নামেতে মন্ত্র আছে পুরাণেতে। তোমা বিনা নাহি হবে অন্যের সাধ্যেতে।। এত শুনি নরপতি আনন্দিত-মন। আজ্ঞা দিল মন্ত্রিগণে যজ্ঞের কারণ।। পাইয়া রাজার আজ্ঞা যত মন্ত্রিগণ। যজ্ঞের যতেক দ্রব্য আনিল তখন।। দেশ-দেশান্তর হৈতে আনিল যতনে। সর্প-যজ্ঞ হেতু যা কহিল মুনিগণে।। সংকল্প করিল রাজা শাস্ত্রের বিধান। শিল্পকার যজ্ঞস্থান করিল নির্ম্মাণ।। যজ্ঞকুণ্ড করিল সে শিল্পী বিচক্ষণ। রাজারে ভবিষ্য কথা কৈল নিবেদন।। দেখিলাম রাজা যজ্ঞ পূর্ণ না হইবে। ব্রাহ্মণ হইতে যজ্ঞে বিঘ্ন যে ঘটিবে।। শুনি নরপতি তবে বলে দ্বারিগণে। যজ্ঞকালে আসিতে না দিবে কোনজনে।। মহাভারতের কথা অমৃত-সমান। কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান্।। ০৩০. জন্মেজয়ের সর্পযজ্ঞ ঘৃত বস্ত্র যব ধান্য কাষ্ঠ রাশি রাশি। আনাইল রাজা যজ্ঞে হয়ে অভিলাষী।। হোতা চণ্ডভার্গব নামেতে দ্বিজবর। সদাচার-ব্রতী দ্বিজ আইল বিস্তর।। ঋষি সে নারদ ব্যাস মার্কণ্ড পিঙ্গল। উদ্দালক শৌনক আইল যে দেবল।। বিপ্রগণ বেদমন্ত্রে অনল জ্বালিল। লইয়া নাগের নাম যজ্ঞাহুতি দিল।। পর্ব্বত-প্রমাণ অগ্নি দেখি লাগে ভয়। সর্পগণ আসি কুণ্ডে পুড়ি ভস্ম হয়।। আকাশে থাকিয়া যেন মেঘে বৃষ্টি করে। বৃষ্টিধারাবৎ পড়ে অগ্নির উপরে।। হাহাকার শব্দ হৈল নাগের নগরে। প্রলয়-সমুদ্র-শব্দে কান্দে উচ্চৈঃস্বরে।। আপন ইচ্ছায় উঠে আকাশ উপরে। নানাবর্ণ নাগ পড়ে কুণ্ডের ভিতরে।। কেহ অশ্ব, কেহ উষ্ট্র, কেহ হস্তী প্রায়। কেহ কৃষ্ণ, কেহ পীত, কেহ সিতকায়।। জলমধ্যে গর্ত্তমধ্যে কোটরে প্রবেশে। মন্ত্রে টানি বান্ধি আনে যজ্ঞের প্রদেশে।। একশত, দুইশত, পঞ্চশত শির। পর্ব্বত জিনিয়া কারো বিপুল শরীর।। মস্তকে লাঙ্গুল ফিরে, জিহ্বা লড়বড়ি। কাতর হইয়া কেহ যায় গড়াগড়ি।। সঘনে নিশ্বাস ছাড়ে হইয়া কাতর। মহানাদে পড়ে সবে অনল-ভিতর।। দুর্গন্ধ হইল যত পূরিল সংসার। অদ্ভুত দেখিয়া সবে হৈল চমৎকার।। যখন প্রতিজ্ঞা কৈল রাজা জন্মেজয়। ইন্দ্র স্থানে ভয়ে নিল তক্ষক আশ্রয়।। কহিল বৃত্তান্ত সব যজ্ঞের কারণ। জন্মেজয়-যজ্ঞে করে সর্পের নিধন।। প্রাণভয়ে শরণ লইল সুরেশ্বরে। শুনিয়া অভয় তারে দিল পুরন্দরে।। নির্ভয় হইয়া তথা তক্ষক রহিল। এখানে নাগের কুল নির্ম্মূল হইল।। যজ্ঞে ভস্ম হয় যত নাগের সমাজ। চমকিত হইল বাসুকি নাগরাজ।। ভয়েতে কম্পিত তনু, মূর্চ্ছা ঘনে-ঘন। ভগিনীরে ত্বরিতে করিল নিবেদন।। দেখহ ভগিনি! সব নাগের সংহার। নিশ্চয় নিকট মৃত্যু দেখি যে আমার।। নাগবংশ-রক্ষা হেতু তোমার নন্দনে। কহিয়া রাখহ শেষ আছে যত জনে।। মায়ের শাপেতে যেই চিত্তে ছিল ভয়। সেইকালে হৈল এই নাগের প্রলয়।। ভ্রাতারে আকুল দেখি কান্দিয়া নাগিনী। পুত্রেরে ডাকিয়া কহে সকরুণ বাণী।। ভ্রাতৃগণে আমার হইল মাতৃশাপ। সেই হেতু আমার পাইল তোর বাপ।। মম ভ্রাতৃগণ হয় মাতুল তোমার। এ মহা-প্রলয়ে প্রাণ রাখহ সবার।। আস্তিক বলিল, মাতা কান্দ কি কারণে। যে আজ্ঞা করিবা তাহা পালিব এক্ষণে।। জরৎকারী বলে, যজ্ঞ করে জন্মেজয়। মন্ত্র-বলে সকল ভুজঙ্গ করে ক্ষয়।। মজিল মাতুল-বংশ, করহ উদ্ধার। তোমা বিনা রাখে হেন কেহ নাহি আর।। আস্তিক বলিল, মাতা না কর বিষাদ। এখনি খণ্ডিব আমি নাগের প্রমাদ।। বাসুকিরে বল তুমি হইতে নির্ভয়। এখনি করিব ত্রাণ, নাহিক সংশয়।। মাতুলে নির্ভয় করি চলিল ত্বরিত। জন্মেজয়-যজ্ঞস্থানে হৈল উপনীত।। প্রবেশ করিতে দ্বারী নাহি দেয় তারে। ক্রোধেতে আস্তিক কহে, কম্পে ওষ্ঠাধরে।। ব্রাহ্মণে হেলন কর মূঢ় দুরাচার। নাহি জান, এই হেতু হইবে সংহার।। আস্তিকের ক্রোধ দেখি দ্বারী কম্পমান। দ্বার ছাড়ি প্রণমিল হয়ে সাবধান।। তথা হৈতে আস্তিক গেলেন যজ্ঞস্থান। বেদধ্বনি করি সভা কৈল কম্পমান।। সভার ব্রাহ্মণগণে করিল বন্দন। নৃপতিরে বলে তবে আশিস্-বচন।। মহাভারতের কথা অমৃত-লহরী। কাশীরাম কহে, সাধু পিয়ে কর্ণ-ভরি।। ০৩১. যজ্ঞস্থলে আস্তিকের আগমন আইল আস্তিক মুনি, করি মহা-বেদধ্বনি, নৃপতির করিল কল্যাণ। ধন্য রাজা চন্দ্রবংশ, হেন পুত্র অবতংস, ক্ষত্রমধ্যে না দেখি সমান।। দেখেছি শুনেছি কত, যজ্ঞ হৈল যত যত, কারে দিব ইহার তুলনা। যজ্ঞ কৈল ইন্দ্র যম, কুবের বরুণ সোম, আর যত না যায় গণনা।। যুধিষ্ঠির পাণ্ডুপতি, বাসুদেব মহামতি, শ্বেতবাহু নহুষ যযাতি। মান্ধাতা মরুত্ত-ভূপ, নানাযুগে প্রতিরূপ, দিলীপ সগর দাশরথি।। ইক্ষবাকু ভরত অজ, রঘু শিবি শিখিধ্বজ, নানা যজ্ঞ করিল বহুল। কেহ শত, কেহ ত্রিশ, কেহ দশ, কেহ বিশ, এই যজ্ঞ নহে সমতুল।। পুত্র সহ ব্যাস-ঋষি, যাহার সভায় বসি, যজ্ঞ-হেতু শিষ্যগণ লৈয়া। সাক্ষাৎ হইয়া যায়, বৈশ্বানর হবি খায়, শিখা যায় প্রদক্ষিণ হৈয়া।। ধন্য শ্রীজনমেজয়, নাহি হবে, নাহি হয়, তুলনা নাহিক ভূমণ্ডলে। ধর্ম্মে যেন যুধিষ্ঠির, ধনুর্ব্বেদে রঘুবীর, কীর্ত্তি ভগীরথ সমতুলে।। তেজে সূর্য্য-সম-প্রভ, রূপে যেন কামদেব, ব্রতাচারী ভীষ্মের সমান। ধর্ম্মেতে বাল্মীকি মুনি, ক্ষমাতে বশিষ্ঠ গণি, বিভবেতে যেন মরুত্বান্।। আস্তিক-বচন শুনি, জন্মেজয় নৃপমণি, মন্ত্রিগণে বলেন বচন। বালক দ্বিজের সুত, কথা কহে বৃদ্ধমত, যত যত পূর্ব্ব পুরাতন।। যাহা মাগে দিব আমি, গবাশ্ব কাঞ্চন ভূমি, এ দ্বিজের পূরাইব আশ। মাগ শিশু যেই মনে, মনোনীত মম স্থানে, এত বলি করিল আশ্বাস।। এত শুনি হোতৃগণ, নৃপে করে নিবেদন, নহে এই দানের সময়। যজ্ঞ পূর্ণ নাহি করি, তক্ষক সে পিতৃ-অরি, যাবৎ অনলে ভস্ম নয়।। শুনি রাজা বলে দ্বিজে, রাখিয়াছ কোন্ কাজে, অদ্যাপি সে তক্ষক ভীষণ। বলে দ্বিজ নৃপমণি, তক্ষক প্রমাদ গণি, দেবরাজে লয়েছে শরণ।। শুনিয়া নৃপতি কোপে, দশনে অধর চাপে, বলিল যতেক দ্বিজগণে। ইন্দ্র রাখে মোর অরি, তাহারে সহিত করি, তক্ষকেরে লও হুতাশনে।। ভূপতির আজ্ঞা পেয়ে, স্রুবদণ্ড হাতে লয়ে, দ্বিজগণ মন্ত্র উচ্চারিল। বিপ্রের মন্ত্রের তেজে, সঙ্গে লয়ে নাগরাজে, দেবরাজ আকাশে আসিল।। অপ্সরা অপ্সর যত, বাদ্য-গীতে সবে রত, মন্ত্রপাশে হইয়া বন্ধিত। কমলাকান্তের সুত, হেতু সুজনের প্রীত, কাশীরাম দাস বিরচিত।। ০৩২. আস্তিক কর্ত্তৃক সর্পযজ্ঞ নিবারণ শূণ্য-মণ্ডলেতে শুনি নৃত্য-গীত-নাদ। যত যজ্ঞ-হোতৃগণ গণিল প্রমাদ।। ভূপতির ক্রোধ-বাক্যে কৈনু কোন্ কাজ। সর্ব্বনাশ হৈল আজি, মরে দেবরাজ।। এত চিন্তি হোতৃগণ করিল বিচার। ইন্দ্রে ছাড়ি তক্ষকে আকর্ষে আরবার।। তক্ষক-পন্নগে ইন্দ্র উত্তরীয়ে ভরি। শরণ-রক্ষণ-হেতু আছে কান্ধে করি।। রাখিতে নারিল ইন্দ্র করিয়া যতন। মন্ত্রবলে ছাড়াইল ইন্দ্রের বন্ধন।। আইসে তক্ষক নাগ করিয়া গর্জ্জন। সঘনে নির্গত ঘোর নিশ্বাস-পবন।। ঘূর্ণ্যমান বায়ু যেন ফিরয়ে আকাশে। অবশ হইয়া নাগ অন্তরীক্ষে আসে।। মাতুল অনলে পোড়ে আস্তিক জানিল। অন্তরীক্ষে তিষ্ঠ তিষ্ঠ, আস্তিক বলিল।। শূণ্যেতে রহিল সর্প আস্তিকের বোলে। তক্ষক সঘনে কাঁপে ব্রহ্ম-মন্ত্র-বলে।। আস্তিক বলিল, রাজা হও কৃপাবান। আজ্ঞা কর ভূপতি! মাগি যে আমি দান।। রাজা বলে, দ্বিজ-শিশু বৈসহ সভায়। যা মাগিবে দিব আমি, বলেছি তোমায়।। পিতৃবৈরী সংহারিয়া করি যজ্ঞপূর্ণ। তোমার বাসনা যাহা পূরাইব তূর্ণ।। আস্তিক বলিল, যদি তক্ষকে নাশিবে। তবে তুমি কিবা আর মোরে দান দিবে।। আস্তিকের বাক্য শুনি মানি চমৎকার। রাজা বলে, যাহা চাহি দিব আমি আর।। আস্তিক বলিল, রাজা কর অবধান। ইহা বিনা তোমারে না মাগি অন্য দান।। রাজা বলে, দ্বিজ হেন না বলিহ আর। মোর পিতৃবৈরী সে তক্ষক দুরাচার।। তার হেতু মৈল দেখ ভুজঙ্গ সকল। তারে না মারিলে যত সকলি বিফল।। তাহার নিধনে তুমি না হও বাধক। অন্য যাহা ইচ্ছা মোরে মাগহ বালক।। আস্তিক বলিল, রাজা তুমি সুপণ্ডিত। তোমারে বুঝাবে অন্যে না হয় উচিত।। আয়ু শেষে যমে নিল তোমার জনকে। অকারণে অপরাধী করহ তক্ষকে।। অসংখ্য ভুজঙ্গগণ করিলা সংহার। অহিংসক জনে মার, নহে সুবিচার।। দ্বিতীয় ইন্দ্রের সভা দেখি যে তোমার। নিষেধ না করে কেহ জীবের সংহার।। আস্তিক বলিল যদি এতেক বচন। রাজারে বলিল তবে যত সভাজন।। আপনি বলিলা ব্যাস ডাকিয়া রাজারে। প্রবোধ করহ ভূপ, দ্বিজের কুমারে।। নিবৃত্ত করহ যজ্ঞ, সবে বলে ডাকি। ব্রাহ্মণ-বালকে রাজা না কর অসুখী।। নিবৃত্ত নিবৃত্ত, বলি হৈল মহাধ্বনি। নিষেধ করিল যজ্ঞ ভূপতি আপনি।। সর্পযজ্ঞ নরেন্দ্র করিল নিবারণ। আস্তিকের পূজা কৈল দিয়া বহু ধন।। নানা ধান পেয়ে তুষ্ট হয়ে দ্বিজগণ। নিজ নিজ দেশে সব করিল গমন।। আস্তিকে বলিল রাজা করিয়া মেলানি। অশ্বমেধকালেতে আসিবে দ্বিজমণি।। তবে ত আস্তিক গেল আপনার ঘর। কহিল বৃত্তান্ত মাতা মাতুল-গোচর।। শুনিয়া বাসুকি নাগ হৈল আনন্দিত। নাগলোকে উৎসব হইল অপ্রমিত।। যতেক আছিল নাগ একত্র হইয়া। পূজা কৈল আস্তিকের বহু রত্ন দিয়া।। পুনর্জ্জন্ম-দাতা তুমি নাহিক সংশয়। বর দিব, মাগ তুমি যেই মনে লয়।। আস্তিক বলিল, যদি মোরে দিবে বর। এই বর মাগি আমি সবার গোচর।। প্রতি সন্ধ্যাকালে যেই মোর নাম লবে। নাগগণ হৈতে তার ভয় নাহি রবে।। আমার চরিত্র যেই করিবে শ্রবণ। নাগ হৈতে কভু ভীত না হৈবে সে জন।। এ সব নিয়ম যেই করিবে লঙ্ঘন। সত্য কর তবে তার নিশ্চয় মরণ।। ফাটিবেক শির যেন শিরীষের ফল। আস্তিকের বাক্য যেই করিবে নিষ্ফল।। প্রতিজ্ঞা করিনু সবে, বলে নাগগণে। নিকটে না যাব কেহ তোমার স্মরণে।। আদিপর্ব্বে ভারতের দিব্য উপাখ্যান। কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।। ০৩৩. জন্মেজয়ের ধর্ম্ম-হিংসা সৌতি বলে, তবে পরীক্ষিতের নন্দন। ডাকিয়া আনিল যত পাত্র-মিত্রগণ।। সবারে বলিল রাজা করিয়া বিলাপ। দূর না হইল মম হৃদয়ের তাপ।। আপনার চিত্তে আমি করিনু বিচার। দ্বিজ বিনা শত্রু মোর কেহ নহে আর।। ধর্ম্মশীল তাত মোর জগতে বিখ্যাত। বিনা অপরাধে শাপ পেলেন নির্ঘাত।। পিতৃবৈরী বিনাশিতে বহু চেষ্টা ছিল। তাহে পুনঃ দ্বিজ আসি বাধক হইল।। শাপেতে মরিল পরীক্ষিত নরবর। মারিতে রাখিল পুনঃ তক্ষক পামর।। মোর রাজ্যে বসিয়া এতেক অহঙ্কার। দ্বিজের কুরীতি অঙ্গে সহ্য নহে আর।। ক্রোধানলে মোর অঙ্গ হতেছে দহন। হেন মনে হয়, সব মারিব ব্রাহ্মণ।। পূর্ব্বে কার্ত্তবীর্য্য করিলেন দ্বিজ-ধ্বংস। উদর চিরিয়া মারিলেন ভৃগুবংশ।। সেইমত দ্বিজ সব করিব সংহার। যাহা হৌক, এই সত্য বচন আমার।। নৃপতির বাক্য শুনি সবে স্তব্ধ হৈল। পাত্র-মিত্রগণ তাহে উত্তর না দিল।। রাজা বলে, কেহ কেন না দেহ উত্তর। মন্ত্রিগণ বলে, শুন নৃপতি-প্রবর।। বিষম বুঝিয়া বাক্য না আসে মুখেতে। কে দিবে এ যুক্তি রাজা বিপ্র-বিনাশিতে।। কহিলা যে কার্ত্তবীর্য্য মারিল ব্রাহ্মণ। তার সমুচিত দণ্ড বিখ্যাত ভুবন।। সেই ভৃগুকুলে জাত রাম ভগবান্। ক্ষত্রিয়-শোণিতে ক্ষিতি করাইল স্নান।। ক্ষত্র বলি পৃথিবীতে না রহিল আর। ব্রাহ্মণ-ঔরসে পুনঃ হইল সঞ্চার।। বচনে সৃজন যাঁর, বচনে পালন। ক্ষণেকেতে করে ভস্ম যাঁহার বচন।। অগ্নি সূর্য্য কালসর্পে আছে প্রতিকার। ব্রাহ্মণের ক্রোধে রাজা নাহিক নিস্তার।। এক যুক্তি চিত্তেতে আইসে নৃপমণি। উপায় করিয়া বিপ্র-বীর্য্য কর হানি।। কুশোদকে বিপ্রের পবিত্র হয় অঙ্গ। কুশ-বিনা হইবেক কর্ম্ম-অঙ্গ ভঙ্গ।। কুশের অভাবে, দ্বিজ হবে তেজোহীন। পশ্চাৎ করিব দগ্ধ ধর্ম্মে হৈলে ক্ষীণ।। রাজা বলে, ভাল যুক্তি কৈলে সর্ব্বজন। এমতে নাশিব দ্বিজ, নিল মম মন।। এত বলি নরপতি দূতগণে আনে। আজ্ঞা করি ডাকিয়া আনিল কোড়াগণে।। কহে নৃপ, কোড়াগণ, চতুর্দ্দিকে যাহ। পৃথিবীর যত কুশ উপাড়ি ফেলহ।। মন্ত্রিগণ বলে, রাজা এ নহে বিচার। রাজা নষ্ট করে কুশ, ঘুষিবে সংসার।। না উপাড়ি মরিবেক করিব উপায়। ঘৃত দুগ্ধ গুড় মধু আনি দেহ তায়।। এই সব দ্রব্য ঢালিবেক কুশমূলে। স্বাদে পিপীলিকা গিয়া খাইবে সকলে।। পিপীলিকা কুশমূল কাটিয়া ফেলিবে। কার্য্যসিদ্ধ হৈবে হিংসা দিল ততক্ষণ। চারিদিকে চলিল যতেক দূতগণ।। রাজ্যে রাজ্যে বার্ত্তা কৈল যত অনুচরে। মারিল সকল কুশ দেশ-দেশান্তরে।। মস্তকে বন্দিয়া ব্রাক্ষণের পদরজ। কহে কাশীরাম দাস গদাধরাগ্রজ।। ০৩৪. জন্মেজয়ের নিকট ব্যাসের আগমন কুশ না মিলিল, দ্বিজ হৈল চমৎকার। স্থানে স্থানে বসি সবে করেন বিচার।। ইহার কারণ যে জানিল ব্যাসমুনি। নৃপতিকে বুঝাবারে আসিলা আপনি।। ব্যাসে দেখি আনন্দিত জন্মেজয় রাজা। পাদ্য-অর্ঘ্য দিয়া তাঁর করে বহু পূজা।। আশীর্ব্বাদ করি মুনি বসিয়া আসনে। নৃপতিকে জিজ্ঞাসিল মধুর-বচনে।। বদরিকাশ্রমে শুনিলাম সমাচার। ব্রাহ্মণের হিংসা কর, কিমত বিচার।। সর্ব্বধর্ম্মে-বিজ্ঞ তুমি পণ্ডিত সুজন। তবে কেন হেন কর্ম্মে প্রবর্ত্তিলা মন।। যাঁর ক্রোধে যদুকুল হইল বিধ্বংস। যাঁর ক্রোধে নষ্ট হয় সগরের বংশ।। যাঁর ক্রোধে কলঙ্কী হইল কলানিধি। যাঁর ক্রোধে লবণ হইল জলনিধি।। যাঁর ক্রোধে অনল হইল সর্ব্বভক্ষ। যারঁ ক্রোধা ভগাঙ্গ হইল সহস্রাক্ষ।। পূর্ব্বেতে যতেক তব পিতামহগণ। যাঁরে সেবি বিজয়ী হইল ত্রিভুবন।। হেন জনে হিংস তুমি কিসের কারণ। শুনিয়া করিল রাজা নিজ নিবেদন।। বিনা অপরাধে বাপে কৈল ভস্মরাশি। পিতৃবৈরী মারিতে বাধক হৈল আসি।। এই হেতু বড় তাপ অন্তরে আমার। নিজ দুঃখ নিবেদিনু অগ্রেতে তোমার।। ব্যাসদেব বলেন, ধৈর্য্য নর নররাজ। ক্রোধে ধর্ম্ম নষ্ট হয়, সিদ্ধ নহে কাজ।। ব্রাহ্মণেরে ক্রোধ রাজা কর অকারণ। ভবিষ্যৎ-খণ্ডন না হয় কদাচন।। তোমার পিতার জন্ম হইল যখন। গণিয়া কহিল যত শাস্ত্রবিদ্ জন।। নানা যজ্ঞ ধর্ম্ম করিবেক অপ্রমিত। ভুজঙ্গ-দংশনে মৃত্যু হইবে নিশ্চিত।। আমার বচনে স্থির হও গুণাধার। পিতা হেতু দুঃখ চিন্তা না করিহ আর।। কে খণ্ডিতে পারে রাজা দৈবের নির্ব্বন্ধ। না বুঝিয়া কেন কর দ্বিজসহ দ্বন্দ্ব।। ব্যাসের মুখেতে শুনি এতেক বচন। জন্মেজয় কুশ-হিংসা কৈল নিবারণ।। মহাভারতের কথা অমৃত-সমান। কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।। ০৩৫. জন্মেজয়ের অশ্বমেধ-যজ্ঞ রাজা বলে অকারণ করিলাম এত। কোটি অহিংসক সর্প করিলাম হত।। এ পাপ-নরক হইতে না দেখি নিস্তার। কহ মুনি! কিমতে ইহাতে পাব পার।। জ্ঞাতি-বধ করি পূর্ব্বে পিতামহগণ। অশ্বমেধ করি পাপে হইলা মোচন।। আমিও করিব সেই অশ্বমেধ-যজ্ঞ। শুনি নিষেধিল ব্যাস সকল শাস্ত্রজ্ঞ।। রাজা বলে, মুনি কেন করহ নিষেধ। পিতৃ পিতামহ মোর কৈল অশ্বমেধ।। অক্ষম জানিয়া বুঝি কর নিবারণ। নিশ্চয় করিব যজ্ঞ, এই মম পণ।। মুনি বলে, ক্ষম তুমি সকল কর্ম্মেতে। অশ্বমেধ নাহি রাজা এ কলি-যুগেতে।। মাংস-শ্রাদ্ধ সন্ন্যাস গোমেধ অশ্বমেধ। এই সব হয় সদা কলিতে নিষেধ।। অবশ্য করিব যজ্ঞ, বলে মহারাজ। মোর বিঘ্ন করিতে কে আছে ক্ষিতিমাঝ।। মুনি বলে, করহ যা তব মনে লয়। কিমতে কহিব আমি, বেদে নাহি কয়।। এত বলি মুনিরাজ হৈল অন্তর্দ্ধান। নৃপতি করিল যত যজ্ঞের বিধান।। যজ্ঞ-অশ্ব নিয়োজিল সেনাপতিগণ। বহুদেশ-দেশান্তর করিল ভ্রমণ।। সম্পূর্ণ-বৎসর অশ্ব পৃথিবী ভ্রমিল। যত রাজগণে বলে জিনিয়া আনিল।। যত মুনি দ্বিজগণ ছিল ভূমণ্ডলে। নিমন্ত্রণ করিয়া আনিল যজ্ঞস্থলে।। বপুষ্টমা-রাণী সহ আছে নৃপবর। অসিপত্র-ব্রত আচরিয়া সম্বৎসর।। হইল বৎসর পূর্ণ চৈত্র-পূর্ণিমাতে। কাটিয়া তুরঙ্গ রাজা ফেলিল অগ্নিতে।। দ্বিজগণ বেদ-শব্দে পূরিল গগন। শূন্য-মণ্ডলেতে থাকি দেখে দেবগণ।। অশ্বমেধ পূর্ণ হয় কলিযুগ-মাঝ। বেদনিন্দা-ভয়েতে কম্পিত দেবরাজ।। কাটামুণ্ড অশ্বের যে আহুতির শেষ। মায়াবলে ইন্দ্র তাহে করিল প্রবেশ।। সভামধ্যে নৃত্য করে তুরঙ্গের মুণ্ড। দেখিয়া আশ্চর্য্য বড় হৈল সভাখণ্ড।। রাণী সহ নৃপতি আছয়ে সভামাঝ। নাচে মুণ্ড, সভাখণ্ড পাইলেক লাজ।। যতেক সভার লোক অধোমুক হৈল। ব্রাহ্মণ-কুমার এক হাসিয়া উঠিল।। পুনঃ পুনঃ তালি মারে, হাসে খল খল। দেখিয়া হইল রাজা জ্বলন্ত অনল।। রাজার সম্মুখে ছিল খড়গ খরশান। দ্বিজপুত্রে কাটিয়া করিল দুইখান।। হাহাকার-শব্দ হৈল যজ্ঞের শালায়। চতুর্দ্দিকে দ্বিজগণ পলাইয়া যায়।। ব্রহ্মঘাতী মহাপাপী এই দুরাচার। দেখিলে হইবে পাপ বদন ইহার।। যত দূর পর্য্যন্ত ইহার অধিকার। তত দূর দ্বিজের বসতি নহে আর।। অশ্বমের-যজ্ঞ-নামে বরিয়া আনিল। ব্রাহ্মণের মাংষ খায়, এবে জানা গেল।। ফেলাই ইহার দ্রব যে আছে যথায়। এত বলি সভা ছাড়ি দ্বিজগণ যায়।। ব্রাহ্মণ-ঘাতার মুখ দেখা অনুচিত। রাজগণ যথা তথা গেল চতুর্ভিত।। দ্বিজ ক্ষত্র বৈশ্য শূদ্র ছিল যত জন। সবে গেল, একমাত্র আছয়ে রাজন।। কাশীরাম দাস কহে পাঁচালীর গাথা। শ্রবণে সুধার ধারা ভারতের কথা।। ০৩৬. ব্যাসের পুনরাগমন ও জন্মেজয়ের প্রতি ভারত শ্রবণের উপদেশ প্রদান অন্তর্য্যামী সর্ব্বজ্ঞ শ্রীবেদব্যাস মুনি। বর্ণনে না যায় যিনি অপ্রমিত গুণী।। সত্যবতী-হৃদয়-নন্দন মুনি ব্যাস। যাঁর মুখ-চন্দ্রে তিন ভুবন প্রকাশ।। যেই মুখ-পঙ্কজ-গলিত-সুধাধার। পানেতে তরিল প্রাণী এ ভব-সংসার।। কনক-পিঙ্গল-জটা বিরাজিত শিরে। কৃষ্ণ -সর-চর্ম্ম পরিধান কলেবরে।। অম্বর সম্বরি যে ভারত বাম কাঁখে। দক্ষিণ বামেতে পাছে মুনি লাখে লাখে।। জানিয়া রাজার কষ্ট সদয়-হৃদয়। উপনীত হৈলেন যেখানে জন্মেজয়।। অধোমুখে আছে রাজা হয়ে শোকাবেশ। ব্যাসে দেখি লজ্জিত হইল সবিশেষ।। মুনি বলে অভিমান ত্যজ নরপতি। মোর বাক্য না শুনিয়া হৈল হেন গতি।। ব্যাসের বচনে রাজা পাইয়া আশ্বাস। চরণে পড়িয়া কহে গদগদ ভাষ।। আমা হেন নিন্দিত নাহিক এ সংসারে। তোমার বচন নাহি শুনি অহঙ্কারে।। তার সমুচিত ফল এবে পাইলাম। দুস্তর-নরক-সিন্ধু মাঝে পড়িলাম।। কৃপা কর মুনিরাজ! পড়িনু চরণে। তোমা বিনা তারে মোরে নাহি অনজনে।। ত্যজিল আমারে ভ্রাতা মন্ত্রী বন্ধুজন। ত্যজিল যতেক দ্বিজ-পুরোহিতগণ।। পাপী বলে কহে মোর নিকটে না আসে। আপনি আইলা কৃপা করি স্নেহবশে।। আজ্ঞা কর মুনিরাজ! কি করি এখন। পাপ-সিন্ধু হৈতে মোরে করহ তারণ।। মুনি বলে, চিত্তে দুঃখ না ভাবিহ আর। হইবে নিষ্পাপ, ধর বচন আমার।। ব্রহ্মবধ-আদি পাপ সব হবে ক্ষয়। অশ্বমেধ-ফল পাবে, নাহিক সংশয়।। এক লক্ষ শ্লোক মহাভারত রচন। শুচি হয়ে একমনে করহ শ্রবণ।। খণ্ডিবেক পাপ-তাপ নাহিক সংশয়। মোর বাক্য ধর পরীক্ষিতের তনয়।। কৃষ্ণবর্ণ চন্দ্রাতপ বান্ধহ উপর। তার তলে ভারত শুনহ নরবর।। মহাভারতের কথা কীর্ত্তন করিতে। কৃষ্ণবর্ণ ত্যজি শুক্ল হইবে নিশ্চিতে।। তব পিতৃ-পিতামহগণের চরিত। বিবিধ অপূর্ব্ব কথা ভারতে গ্রথিত।। মহাপুণ্যপ্রদ তত্ত্ব অতুল সংসারে। করহ শ্রবণ, মুক্ত হবে পাপ-ভারে।। এত শুনি নৃপমণি আনন্দিত মতি। ভক্তিভরে মুনিবরে করিয়া প্রণতি।। বলিলা আমার প্রতি যদি কৃপাবান্ । আপনি শুনিতে তবে ভারত-আখ্যান।। কি হেতু আমার পিতৃ-পিতামহগণ। জ্ঞাতি সহ যুদ্ধ করি হইল নিধন।। আপনি আছিলা দেব সে সব সময়। তবে কেন বিবাদে হইল সব ক্ষয়।। চিরদিন শুনিতে উৎসুক মম মন। কহ মোরে মুনিবর ইহার কারণ।। মুনি বলে, ভারতের কথন বিস্তার। কহিবারে অবসর নাহিক আমার।। মুনিশ্রেষ্ঠ শিষ্যশ্রেষ্ঠ এই তপোধন। ভারতে আমার সম শ্রীবৈশম্পায়ন।। শুনহ ইহার মুখে ভারত-আখ্যান। যে আজ্ঞা বলিয়া রাজা করেন সম্মান।। এত বলি মুনিরাজ গেল নিজ স্থান। অনুমতি দিয়া শিষ্যে বর্ণিতে পুরাণ।। অনন্তর নৃপবর ব্যাসের বচনে। কৃষ্ণবর্ণ চন্দ্রাতপ করে ততক্ষণে।। তার তলে বসে রাজা লয়ে মন্ত্রিগণ। চারি জাতি নগরেতে শ্রেষ্ঠ যত জন।। পূজা করি মুনিবরে নানা উপচারে। বিনয় বচনে ভূপ জিজ্ঞাসেন তাঁরে।। মহাভারতের কথা অমৃত-সমান। কাশীরাম বিরচিল শুনে পুণ্যবান।। ৩৭. মহর্ষি বৈশম্পায়ন প্রমুখাৎ মহারাজ জন্মেজয়ের শ্রীমহাভারত শ্রবণারম্ভ তবে শ্রীজনমেজয়, মুনিরে পাইয়া। জিজ্ঞাসিল পুণ্য কথা বিনয় করিয়া।। জগতে বিখ্যাত যে বৈশম্পায়ন মুনি। কহিতে লাগিল তত্ত্ব ভারত-কাহিনী।। খণ্ডয়ে অশেষ পাপ যাহার শ্রবণে। সকল যজ্ঞের ফল পায় ততক্ষণে।। রাজা হয়ে শুনিলে সর্ব্বত্র হয় জয়। ব্রাহ্মণে শুনিলে যায় নরকের ভয়।। বৈশ্য শূদ্র শুনিলে খণ্ডয়ে সব দুঃখ। অপুত্রক শুনিলে দেখয়ে পুত্র মুখ।। রাজভয় শত্রুভয় পথিভয় আদি। বিবিধ দুর্গতি খণ্ডে আর যত ব্যাধি।। মোক্ষশাস্ত্র বলি যেই ব্যাসের রচিত। সম্পূর্ণ সকল রসে করিল বর্ণিত।। ইহার শ্রবণে যত সুখ লভে নর। তার সম ফল নাহি স্বর্গের উপর।। ইহকালে আয়ুর্যশ, অন্তে স্বর্গে যায়। ধর্ম্ম অর্থ কাম মোক্ষ চতুর্ব্বর্গ পায়।। শুচি হৈয়া মন দিয়া শুনে যেই জন। নাহিক সংশয় ইথে, ব্যাসের বচন।। একলক্ষ শ্লোকে এই ভারত নির্ম্মাণ। নানা ধর্ম্ম চিত্র সুবিচিত্র উপাখ্যান।। ৩৮. বিষ্ণুর পরশুরাম অবতার গ্রহণ : হরি হরি শব্দ করি শুন একচিতে। প্রথমেতে সবাকার রক্ষা যেই মতে।। পৃথিবীর মধ্যে ক্ষত্র হইল অপার। মহামত্ত হৈয়া সবে করে কদাচার।। লোকহিংসা হসিতে না পারি জনার্দ্দন। ভৃগুবংশে হইলেন প্রকাশ তখন।। করেতে কুঠার জমদগ্নির কুমার। নিঃক্ষত্রা করিল ক্ষিতি তিন সম্প বার।। ক্ষত্রবলে ক্ষিতি মধ্যে না রাখিল রাম। মারিল দুগ্ধের শিশু ক্ষত্র যার নাম।। ব্রাহ্মণেরে রাজ্য দিয়া গেল তপোবন। বিপ্রগৃহে প্রবেশিল ক্ষত্রিয় স্ত্রীগণ।। রাজকর্ম্ম বিপ্রগণে সম্ভব না হয়। সে কারণে সমুৎপন্ন ক্ষেত্রজ তনয়।। ক্ষত্র মাতা বিপ্র পিতা হইল কুমার। পুনঃ ক্ষিতিমধ্যে হৈল ক্ষত্রিয় সঞ্চার।। নিষ্পাপ হইল সবে পরম ধার্ম্মিক। ধর্ম্মেতে বাড়িল বংশ, হইল অধিক।। ধর্ম্মেতে করিল সবে প্রজার পালন। রাজ্যে না রহিল আর অকাল মরণ।। নিজ নিজ বৃত্তিতে করেন সবে কর্ম্ম। ব্রাক্ষণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্রে যেই ধর্ম্ম।। পাপের প্রসঙ্গ নাহি, ধর্ম্মেতে তৎপর। সাগর অবধি ক্ষিতি পূর্ণ হৈল নর।। স্বর্গের বৈভব পূর্ণ হৈল ক্ষিতিমাঝ। রাজগণ হইল দ্বিতীয় দেবরাজ।। অনন্তর যতেক দানব-দৈত্যগণ। দেব হৈতে পরাভব হইল যখন।। সুখ-ভোগ্য-স্থান ক্ষিতি দেখি মনোরম। ভোগের কারণে নিল মনুষ্য-জনম।। জন্মিয়া পৃথিবী মধ্যে হইল প্রবল। তপ জপ যজ্ঞ দান হিংসিল সকল।। দানবের ভার ধরা না পারি সহিতে। ব্রহ্মারে জানায় গিয়া বিষাদিত চিতে।। কাতরে কহেন সব বিনয়-বচনে। অবিরল অশ্রুজল ঝরে দু-নয়নে।। ক্ষিতির রোদন দেখি কমল-আসন। পৃথিবীরে কহিলেন প্রবোধ বচন।। না কর ক্রন্দন তুমি, স্থির কর মন। উপায়ে তোমার কার্য্য করিব সাধন।। তোমার উদ্ধারে মিলি সব দেবগণে। নবরূপে জন্মাইব অসুর নিধনে।। এত বলি পৃথিবীরে করিয়া মেলানি। দেবগণে লৈয়া যুক্তি করে পদ্মযোনি।। প্রবল অসুরগণে হৈল ক্ষিতিভার। হরি বিনা কার শক্তি করিতে সংহার।। চল সবে, কহি গিয়া দেব নারায়ণে। এত বলি ব্রহ্মা সহ যত দেবগণে।। ঊর্দ্ধ বাহু করি স্তুতি করে প্রজাপতি। কৃপা কর নারায়ণ অনাথের গতি।। সর্ব্বভূত আত্মা তুমি সবার জীবন। তোমার আজ্ঞায় সৃষ্টি হইল ভুবন।। হেন সৃষ্টি নাশ করে দানব প্রবল। তোমা বিনা রক্ষা নাহি মজিল সকল।। কাতর হইয়া ব্রহ্মা করিলেন স্তুতি। করিলেন অনুজ্ঞা কৃপায় লক্ষ্মীপতি।। তোমার বচনে ব্রহ্মা হৈব অবতার। আপনি খণ্ডিব আমি অবনীর ভার।। নিজ নিজ অংশ লৈয়া যত দেবগণ। সবে জ্ন্ম লও লিয়া গিয়া মনুষ্য ভবন।। এতেক আকাশ বাণী শুনি প্রজাপতি। ততক্ষণে আজ্ঞা দিল দেবগণে প্রতি।। দেবতা গন্ধর্ব্ব আর যত বিদ্যাধরে। সবে জন্ম লহ গিয়া ধরণী ভিতরে।। ব্রহ্মার আদেশ পেয়ে যত দেবগণ। অবনীর মাঝে গিয়া জন্মিলা তখন।। দেবতা মানব দৈত্য একত্র হইল। শুনি জন্মেজয় রাজা মুনিরে কহিল।। কোন্ জন দৈত্য ইথে কেবা দেব নর। সবিশেষে আমারে সব কহ মুনিবর।। ৩৯.দেব-দানবাদির ভূতলে জন্মগহণ : মুনি বলে, শুন পরীক্ষিতের নন্দন। যেমতে হইল শুন সৃষ্টি সংঘটন।। ব্রহ্মার মানস-পুত্র হৈল ছয় জন। মরীচি অঙ্গিরা অত্রি ক্রতু জ্ঞানবান।। পুলহ পুলস্ত নামে আর দুইজন। এই ছয় জন হৈতে জন্মে ত্রিভুবন।। মরীচি ব্রহ্মার পুত্র ত্রিজগতে জ্ঞাত। তাঁর পুত্র হইল কশ্যপ মুনি খ্যাত।। ত্রয়োদশ নিজ কন্যা দক্ষ প্রজাপতি। কশ্যপে করেন দান হয়ে হৃষ্টমতি।। দক্ষের দুহিতাগণ ধরে যেই নাম। একে একে বলি শুন নৃপ গুণধাম।। অদিতি কপিলা দনু কদ্রু মুনি ক্রোধা। দনায়ু সিংহিকা কালা দিতি আর প্রধা।। বিশ্বা আর বিনতা যে তের জন গণি। তের জনে যত জন্মে শুন নৃপমণি।। অদিতির গর্ভে হৈল আদিত্য দ্বাদশ। যাঁহার কিরণে এই প্রকাশে দিবস।। ইন্দ্রি আদি দেবগণ আর বিবস্বান্। ইহারাও কশ্যপের সুত মতিমান্ ।। বিবস্বান্ হইতে হইল সমুদ্ভূত। বৈবস্বত মনু আর যম দুই সুত।। এই বৈবস্বত মনু হৈতে তারপর। জনমিল পৃথিবীতে মানব নিকর।। হিরণ্যকশিপু হৈল দিতির তনয়। দেবের পরম শত্রু, প্রতাপে দুর্জ্জয়।। হিরণ্যকশিপু পুত্র হৈল পঞ্চজন। প্রধান প্রহ্লাদ পুত্র ত্রৈলোক্য পাবন।। তিন পুত্র হৈল তার মহা ধনুর্দ্ধর। বিরোচন কুম্ভ আর নিকুম্ভ সুন্দর।। বিরোচন পুত্র হৈল বলি মহাশয়। তাঁর পুত্র বাণ বীর ভুবনে দুর্জ্জয়।। মহাকাল নাম তার, শিবের কিঙ্কর। সহস্রেক ভুজেতে ভূষিত কলেবর।। দনুর নন্দন হৈল দানব সকল। গণনে চল্লিশ জন বলে মহাবল।। বিপ্রচিত্তি শম্বর পুলোমা অশ্বপতি। এবম্বিধ বহু নামে দানবেতে খ্যাতি।। ইহাদের পুত্র পৌত্র হৈল অগণন। স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতাল ব্যাপিল ত্রিভুবন।। চারি পুত্র জন্ম লয় সিংহিকা উদরে। ক্রূর-কর্ম্মা বলি তারা খ্যাত চরাচরে।। তাহাদের সর্ব্বজ্যেষ্ঠ রাহু নাম ধরে। চক্রে কাটি দুই খণ্ড কৈল চক্রধরে।। দনায়ুর চারি পুত্র হইলেক ক্রমে। বিখ্যাত বিক্ষর বল বীর বৃত্র নামে।। ক্রোধ বিনাশন আদি কালার নন্দন। দেবের অবধ্য তারা বিখ্যাত ভুবন।। বিনতার ছয় পুত্র অরুণ আরুণি। তার্ক্ষ্যারিষ্টনেমি আর গরুড় বারুণি।। সর্ব্বশ্রেষ্ঠ গরুড় সে কেশব-বাহন। পক্ষীর ঈশ্বর হৈল পন্নগ-নাশন।। কদ্রুর নন্দন হৈল অনন্ত বাসুকি। ইত্যাদি কদ্রুর পুত্র সহস্রেক লিখি।। অনুরম্ভা আকীরাদি বিশ্বার দুহিতা। প্রধানা নন্দিনীগণ জগতে বিদিতা।। অলম্বুষা মিশ্রকেশী রম্ভা তিলোত্তমা। সুবাহু সুরতা আদি লোকে অনুপমা।। হাহা হূহূ নামে পুত্র গন্ধর্ব্বের রাজা। কপিলার পুত্রগণে সবে করে পুজা।। ব্রাহ্মণ অমৃত গবী কপিলা-উদরে। কাশ্যপ কপিল জন্মে ক্রোধার উদরে।। মুনির উদরে জন্মে ষোড়শ কুমার। মৌনেয় গন্ধর্ব্ব বলি খ্যাত ত্রিসংসার।। অঙ্গিরা ব্রহ্মার পুত্র, তাঁর তিন সুত। বৃহস্পতি উতত্য সম্বর্ত্ত গুণযুত।। পৌলস্ত্য-মুনির পুত্র বিখ্যাত সংসার। বিশ্বশ্রবা নামে পুত্র সর্ব্বগুণাধার।। কুবেরাদি যক্ষ যত তাঁহার নন্দন। রাক্ষস রাবণ কুম্ভকর্ণ বিভীষণ।। অত্রির নন্দন হৈল অনেক ব্রাহ্মণ। ক্রতুর নন্দন হৈল যজ্ঞের কারণ।। ব্রহ্মার দক্ষিণাঙ্গুষ্ঠে দক্ষ প্রজাপতি। বামাঙ্গুষ্ঠে পঞ্চাশৎ কন্যার উৎপত্তি।। ব্রহ্মার দক্ষিণ হস্তে ধর্ম্ম মহাশয়। দশ কন্যা দক্ষের করিল পরিণয়।। কীর্ত্তি লক্ষ্মী ধৃতি মেধা পুষ্টি শ্রদ্ধা ক্রিয়া। বুদ্ধি লজ্জা মতি, এই দশ ধর্ম্ম-প্রিয়া।। তিন পুত্র ধর্ম্মের, শুনহ সেই নাম। সর্ব্বঘটে স্থিতি তাঁরা, শম হর্স কাম।। কামের বনিতা রতি, শান্তি পতি শম। হর্ষের রমণী নন্দা এই তার ক্রম।। অশ্বিন্যাদি কন্যা সম্পবিংশ দাক্ষায়ণী। বিবাহ-কারণ চন্দ্রে দিল দক্ষ-মুনি।। ব্রহ্মার তনয় মনু বিখ্যাত ভুবন। প্রজাপতি নামে তাঁর জন্মিল নন্দন।। সেই প্রজাপতি-পুত্র বসু অষ্টজন। বসুর নন্দন হৈল দেব হুতাশন।। বিশ্বকর্ম্মা-আদি বহু বসুর কুমার। মৃগ-সিংহ-ব্যাঘ্র-আদি সন্ততি তাঁহার।। যত কহিলাম পূর্ব্ব সৃষ্টির সঞ্চার। প্রত্যক্ষে শুনহ তবে নাম অবতার।। দানব-প্রধান বিপ্রচিত্তি মহাতেজা। জরাসন্ধ নামে হৈল মগধের রাজা।। হিরণ্যকশিপু দৈত্য দিতির কুমার। শিশুপাল নামে জন্মে পৃথিবী মাঝার।। শল্য যে হইল পূর্ব্বে সংহ্লাদ যে ছিল। অনুহ্লাদ আসি মর্ত্ত্যে ধৃষ্টকেতু হৈল।। বাস্কল আসিয়া হৈল ভগদত্ত নাম। কালনেমি হৈল কংস মথুরায় ধাম।। শরভ নামেতে দৈত্য পৌরব হইল। উগ্রসেন নামে গিয়া জনম লইল।। দীর্ঘজিহ্ব নামে দৈত্য হৈল কাশীরাজা। মণিমান্ হৈল বৃত্রাসুর মহাতেজা।। কালকেতু নামে যক্ষ ছিল মৎস্যদেশে। হরিদশ্ব হৈল রুক্মী ভীষ্মক ঔরসে।। কীচক কলিঙ্গ বৃষসেন মহাবলে। কালকেতুগণ আসি জন্মিল ভূতলে।। বৃহস্পতি অংশে হৈল দ্রোণ মহাশয়। বশিষ্ঠের শাপে বসু গঙ্গার তনয়।। রুদ্র অংশে কৃপাচার্য্য অজর অমর। বসু অংশে সাত্যকি দ্রুপদ নৃপবর।। কৃতবর্ম্মা বিরাট গন্ধর্ব্ব অংশে জন্ম। ধর্ম্ম অংশ হৈতে হৈল বিদুরের জন্ম।। সুবাহু গন্ধর্ব্ব ধৃতরাষ্ট্র কুরুপতি। সিদ্ধি ধৃতি মাদ্রী কুন্তী গান্ধারী সে মতি।। ধর্ম্ম অংশে জন্মিলেন যুধিষ্ঠির রাজা। বায়ু অংশে জন্মিলেন ভীম মহাতেজা।। দেবরাজ অংশে জন্ম নিল ধনঞ্জয়। অশ্বিনীকুমার হৈতে মাদ্রীর তনয়।। চন্দ্র আসি হৈল অভিমন্যু মহাবীর। কাম হতে প্রদ্যুন্ন বিখ্যাত যদুবীর।। বসুদেবে দয়া করি দয়াময় হরি। তাঁর গৃহে জন্মিলা গোলোক পরিহরি।। শেষ অংশে জন্ম লৈল রোহিণী নন্দন। দ্রুপদের কুলে জন্মে দ্রৌপদী তখন।। আপনি আসিয়া কলি হৈল দুর্য্যোধন। পৌলস্ত্যের অংশে জন্মে আর ভ্রাতৃগণ।। একাধিক শত পুত্র ধৃতরাষ্ট্র হৈতে। শুনহ সবার নাম, কহিব ক্রমেতে।। সর্ব্ব জ্যেষ্ঠ দুর্য্যোধন, যুযুৎসু তৎপর। দুঃশাসন দুঃসহ দুঃশল বীরবর।। প্রথম দুর্ম্মুখ তথা বিবিংশতি বীর। বিকর্ণ শ্রীজলসন্ধ সুলোচন ধীর।। বিন্দ অনুবিন্দ শ্রীদুর্দ্ধর্ষ সুবাহুক। দুষ্প্রধর্ষ দুর্ম্মর্ষণ দ্বিতীয় দুর্ম্মুখ।। দুষ্কর্ণ আরো যে কর্ণ, চিত্র তারপর। উপচিত্র চিত্রাক্ষ অদ্ভুত নামধর।। চারু চিত্রাঙ্গদ দুর্ম্মদ সে অনন্তর। দুষ্প্রহর্ষ বিবিৎসু বিকট শম আর।। ঊর্ণনাভ পদ্মনাভ নন্দ-নামধর। উপনন্দ সেনাপতি সুষেণ কণ্ডোদর।। মহোদর চিত্রবাহু চিত্রবর্ম্মা ধীর। সবর্ম্মা দুর্ব্বিরোচন আয়োবাহু বীর।। মহাবাহু চিত্রচাপ নামে সুকুণ্ডল। ভীমবেগ, বলাকী, অগ্রজ ভীমবল।। শ্রীভীমবিক্রম উগ্রায়ুধ ভীমশর। কনকায়ু তথা দৃঢ়ায়ুধ তারপর।। দৃঢ়বর্ম্মা দৃঢ়ক্ষত্র সোমকীর্ত্তি বীর। অনূদর জরাসন্ধ দৃঢ়সন্ধ ধীর।। সত্যসন্ধ সহস্রবাক্ উগ্রশ্রবা খ্যাত। উগ্রসেন সেনানী দুর্জ্জয়াপরাজিত।। পণ্ডিতক বিশালাক্ষ দুরাধন বীর। দৃঢ়হস্ত সুহস্তক বাতবেগ ধীর।। সুবর্চ্চা আদিত্যকেতু বহাশী অপর। নাগদত্ত অনুযায়ী নিষঙ্গী তৎপর।। জানহ কবচী দণ্ডী আর দণ্ডধার। ধনুর্গ্রহ উগ্র তথা ভীমরথ আর।। বীর বীরবাহু আলোলুপ নামধেয়। অভয় সে রৌদ্রকর্ম্মা দৃঢ়রথ জ্ঞেয়।। অনাধৃষ্য কুণ্ডভেদী বিরাবী তৎপর। সুদীর্ঘলোচন দীর্ঘবাহু অনন্তর।। মহাবাহু ব্যুঢ়োরু তাহার যে অনুজ। তাহার কনকাঙ্গদ পরেতে কুণ্ডজ।। চিত্রক সে মহারথ হয় যে তৎপর। ইত্যাদি ক্রমেতে এই শত সহোদর।। কনিষ্ঠা সোদরা এক দুঃশলা সুন্দরী। গান্ধারীর গর্ভে জন্ম শতপুত্রোপরি।। বৈশ্যার উদরে ধৃতরাষ্ট্রের ঔরসে। সুধার্ম্মিক যুযুৎসুর জন্ম হৈল শেষে।। জ্যেষ্ঠ অনুক্রমে করিলাম এ রচন। ভারতে যেমন আছে ব্যাসের বচন।। শত এক সুত ধৃতরাষ্ট্রের হইল। দুঃশলারে জয়দ্রথ বিবাহ করিল।। অংশ অবতার কথা প্রত্যক্ষে প্রকাশ। বিরচিল পাঁচালী প্রবন্ধে কাশীদাস।। ৪০.শকুন্তলার উপাখ্যান: মুনিবর বলে, শুন পরীক্ষিৎ-সুত। ভরত-বংশের কথা কথনে অদ্ভুত।। দুষ্মন্ত নামেতে রাজা জগতে বিদিত। তাঁহার মহিমা কথা না হয় বর্ণিত।। সংসারে আসিয়া বসুন্ধরা ভোগ করে। ধর্ম্মেতে পৃথিবী পালে, দুষ্টেরে সংহারে।। মহা পরাক্রান্ত রাজা রূপগুণবন্ত। পৃথিবীতে একচ্ছত্র করিল দুষ্মন্ত।। মৃগরাতে বড় রত মহাধনুর্দ্ধর। মৃগয়া করিতে গেল বনের ভিতর।। হস্তী হয় পদাতিক না যায় গণন। সসৈন্যে বেড়িল রাজা এক মহাবন।। সিংহ ব্যাঘ্র ভল্লুক বরাহ মৃগগণ। অনেক মারিল রাজা না যায় গণন।। যতেক রাজার সৈন্য মারি মৃগচয়। শকটে পূরিল কেহ কান্ধে করি লয়।। কোন কোন জন তথা খায় পুড়াইয়া। তবে এক বনে গেল সে বন ছাড়িয়া।। হিরণ্য নামেতে বন অতি মনোরম। চৈতরথ সমান সে মুনির আশ্রম।। নানাজাতি বৃক্ষ তথা ফুল ফল ধরে। নানাজাতি পক্ষী তথা সদা কেলি করে।। মধুচক্র ডালে ডালে আছে তরুগণে। বায়ুতেজে পুষ্পবৃষ্টি হয় অনুক্ষণে।। নানা পক্ষিগণ তাহে সদা ক্রীড়া করে। ভক্ষকে না করে ভক্ষ্য মুনিরাজ ডরে।। মালিনী নামেতে নদী দেখিয়া নিকটে। মুনিগণ বৈসেন তাহার দুই তটে।। অগ্নিহোত্র ধূম গিয়া পরশে গগন। ব্রহ্মার বদনে যেন বেদ উচ্চারণ।। মুনির আশ্রম বুঝি দুষ্মন্ত নৃপতি। ডাকিয়া বলেন রাজা সৈন্যগণ প্রতি।। মুনি সম্ভাষিয়া আমি না আসি যাবৎ। এইখানে সর্ব্বজন থাকহ তাবৎ।। এত বলি নরপতি পুরোহিত লৈয়া। কণ্বের আশ্রমে রাজা উত্তরিল গিয়া।। প্রবেশ করিল গিয়া মুনি অন্তঃপুর। দেখিল সে কণ্ব নাই, চিন্তে নৃপবর।। হেনকালে শকুন্তলা মুনির নন্দিনী। পাদ্য অর্ঘ্য দিয়া তুষ্ট কৈল নৃপমণি।। দেখিয়া কন্যার রূপ নৃপতি মোহিত। জিজ্জাসিল কন্যা প্রতি হয়ে বিমোহিত।। দুষ্মন্ত নৃপতি আমি শুন সুবদনি। হেথা আইলাম আমি ভেটিবারে মুনি।। কোথায় গেলেন মুনি কহত সুন্দরি। তুমি বা কাহার কন্যা কহ সত্য করি।। কন্যা বলে, গেল পিতা ফলের কারণ। মুহূর্ত্তেক রহ হেথা, আসিবে এখন।। মুনির নন্দিনী আমি, শুন নৃপবর। এত শুনি নরপতি করিল উত্তর।। তোমার সদৃশ রূপ কোথাও না দেখি। মুনিকন্যা সত্য তুমি কহ শশিমুখি।। পরম তপস্বী মুনি ফল মূলাহারী। দারত্যাগী জিতেন্দ্রিয় মহা ব্রহ্মচারী।। তাঁহার তনয়া তুমি হইলা কি মতে। কত সত্য সুবদনি আমার সাক্ষাতে।। কন্যা বলে, শুন মম জন্মের কাহিনী। যেমতে হইনু আমি মুনির নন্দিনী।। বিশ্বামিত্র মুনি জান বিখ্যাত সংসারে। চিরদিন তপস্যা করেন অনাহারে।। তাঁর তপ দেখি কম্পমান পুরন্দর। আমার ইন্দ্রত্ব লবে এই মুনিবর।। সর্ব্ব দেবগণ মিলি ভাবে নিরন্তর। মেনকারে ডাকি বলে দেব পুরন্দর।। রূপে গুণে তব তুল্য নাহি ত্রিভুবনে। মম কার্য্য সিদ্ধ কর আপনার গুণে।। বিশ্বামিত্র তপেতে কম্পিত মম কায়। তাঁর তপ ভঙ্গ কর করিয়া উপায়।। শুনিয়া মেনকা অতি বিষণ্ন বদন। যোড় হাত করি ইন্দ্রে করে নিবেদন।। সংসারে বিখ্যাত বিশ্বামিত্র মহাঋষি। মহাতেজা ক্রোধী সেই পরম তপস্বী।। বশিষ্ঠের শত পুত্র প্রকারে মারিল। ক্ষত্রকুলে জন্মি তবু ব্রাহ্মণ হইল।। কৌশিকী নামেতে নদী আজ্ঞাতে সৃজিল। সহজাঙ্গে ব্যাধি করি পুনর্মুক্ত কৈল।। দ্বিতীয় করিল সৃষ্টি বিখ্যাত জগতে। আপনি করহ ভয় যাঁহার তপেতে।। তাঁর তপ নষ্ট করে হেন কোন্ জন। কর্ম্ম না হইবে, হৈবে আমার মরণ।। অগ্নি সূর্য্য সম তেজ লোচন যুগলে। তাঁহার তপস্যা ভঙ্গ করি কোন্ ছলে।। তোমার বচন আমি লঙ্ঘিবারে নারি। তব কার্য্য সিদ্ধ হৌক, আমি বাঁচি মরি।। কামদেব আর বায়ু দেহ তো সহায়। তবে যেমনেতে হয়, করিব উপায়।। ইন্দ্র আজ্ঞা কৈল সঙ্গে যাহ দুইজন। দেবরাজ আজ্ঞা পেয়ে চলিল তখন।। হেমন্ত পর্ব্বতে বৈসে সেই মুনিবর। মুনি দেখি মেনকার কাঁপির অন্তর।। অতিশয় সুবেশা হইয়া বিদ্যাধরী। মুনির নিকটে ক্রীড়া করে মায়া করি।। হেনকালে বায়ু বহে অতি খরতর। উড়াইয়া বস্ত্র তার ফেলিল অন্তর।। আস্তে ব্যস্তে মেনকা উঠিয়া বস্ত্র ধরে। বিবিধ প্রকারে পবনেরে নিন্দা করে।। এ সকল কৌতুক দেখিল মুনিবর। শরীরেতে ভেদিল কামের পঞ্চশর।। মেনকা ধরিয়া মুনি গেল নিজ দেশ। কামে মত্ত নিত্য করে শৃঙ্গার বিশেষ।। হেনমতে বহুদিন গেল ক্রীড়ারসে। তপ জপ সকল ত্যজিল কামবশে।। একদিন সন্ধ্যাকালে বিশ্বামিত্র মুনি। সন্ধ্যা হেতু বলে শীঘ্র জল দেহ আনি।। শুনিয়া মেনকা হাসি বলিল বচন। এতদিনে ভাল সন্ধ্যা হইল স্মরণ।। এত শুনি মুনি হৈল কুপিত অন্তর। দেখিয়া মেনকা ভয়ে পলায় সত্বর।। হৈয়াছিল যেই গর্ভ মুনির ঔরসে। অরণ্যে প্রসব করি গেল নিজ দেশে।। মুনি তপ নষ্ট করি গেল নিজ স্থানে। আমারে ফেলিয়া গেল নির্জ্জন কাননে।। সিংহ ব্যাঘ্র পশুগণ কেহ না হিংসিল। পক্ষীগণ বেড়িয়া যে আমারে রহিল।। তপস্যা করিতে গেল কণ্ব সেই বনে। অনাথা দেখিয়া তাঁর দয়া হৈল মনে।। গৃহে আমি পালন করিল মুনিবর। তাই আমি তাঁর কন্যা, শুন দণ্ডধর।। শকুন্তে বেড়িয়াছিল নিকুঞ্জ কাননে। শকুন্তলা নাম মুনি রাখে সে কারণে।। মম জন্মকথা এক মুনি জিজ্ঞাসিল। কহিলেন কণ্ব তাঁরে তাহে জানা গেল।। আদিপর্ব্বে দিব্য শকুন্তলা উপাখ্যান। কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।। ৪১. দুষ্মন্ত রাজার সহিত শকুন্তলার বিবাহ: রাজা বলে, কন্যা তুমি পরমা সুন্দরী। রাজযোগ্যা ধনি তুমি হও মোর নারী।। গাছের বাকল ত্যাজি পর পট্টবাস। রত্ন-অলঙ্কার পর যেই অভিলাষ।। এত শুনি লজ্জিতা হইয়া শকুন্তলা। মৃদুভাষে নৃপতিকে কহিতে লাগিলা।। শুন রাজা আমি করিলাম অঙ্গীকার। পিতা আসি সম্প্রদান করিবে আমার।। রাজা বলে, মুনিবর বিলম্বে আসিবে। ক্ষণেক বিলম্ব হৈলে মম মৃত্যু হৈবে।। বেদোক্ত বিবাহ হয় অষ্টম প্রকার। গান্ধর্ব্ব বিবাহ লিখে ক্ষত্রিয় আচার।। আপনি বিবাহ কর যদ্যপি আমারে। মুনির বচনে দোষ না হৈবে তোমারে।। রাজার বিনয় বাক্য শকুন্তলা শুনি। রাজারে বলিল সত্য কর নৃপমণি।। বেদের বিহিত যদি আছে পূর্ব্বাপর। গান্ধর্ব্ব বিবাহ হৈবে শুন নৃপবর।। আমার উদরে যেই জন্মিবে কুমার। সত্য কর তুমি তারে দিবে রাজ্যভার।। কামে মত্ত ভূপতি করিল অঙ্গীকার। গান্ধর্ব্ব বিবাহে হৈল মিলন দোঁহার।। তবে নরপতি বলে কন্যারে চাহিয়া। রাজ্যেতে লইব তোমা লোক পাঠাইয়া।। এত বলি নরপতি করিল গমন। পথে যেতে নরপতি ভাবে মনে মন।। কি বলিবে মুনিরাজ আসি নিজ ঘরে। দুষ্মন্ত নিতান্ত ভীত ভাবিয়া অন্তরে।। সসৈন্যে আপন দেশে গেল নরপতি। কতক্ষণে গৃহে এল মুনি মহামতি।। স্কন্ধ হৈতে ফলভার ভূমিতে থুইল। শকুন্তলা এস বলি মুনি ডাক দিল।। লজ্জায় মলিন কন্যা কন্যা না হৈল বাহির। দেখিয়া বিস্মিত চিত্ত হইল মুনির।। ধ্যানেতে জানিল মুনি যত বিবরণ। হাসিয়া কন্যার প্রতি বলিল বচন।। আমারে হেলন করি কৈলা এই কর্ম্ম। দুষ্মন্ত নৃপতি সহ করিলা অধর্ম্ম।। ক্ষমিলাম তোরে আমি করেছি পালন। না করিহ ভয় চিত্তে, স্থির কর মন।। সবিনয়ে বলে কন্যা যুড়ি দুই কর। করিনু দুষ্কর্ম্ম মোরে ক্ষম মুনিবর।। যোগ্য পাত্র সেই সে দুষ্মন্ত নৃপবর। গান্ধর্ব্ব বিবাহে তারে করিলাম বর।। ক্ষমহ রাজার দোষ আমারে দেখিয়া। এত শুনি মুনিবর বলিল হাসিয়া।। ক্ষমিলাম নৃপতিরে তোমার কারণ। ইচ্ছামত বর তুমি করহ প্রার্থনা।। ইহা শুনি অতি ধীরে শকুন্তলা কয়। বাঞ্ছা যদি বর দিবে পিতা মহাশয়।। প্রসন্ন হইয়া তুমি বর দেহ তবে। অতুল প্রতাপে ধরা শাসুক গৌরবে।। রাজ্যচ্যুত অথবা অধর্ম্ম পরায়ণ। পুরু বংশীয়েরা যেন না হয় কখন।। শকুন্তলা মুখে তবে শুনি এই বাণী। তথাস্তু বলিয়া বর দিলা মহামুনি।। হেনমতে মুনি-গৃহে আছে শকুন্তলা। বিস্মৃত হইলা রাজা রাজভোগে ভোলা।। কতকালে প্রসব হইল শকুন্তলা। পরম সুন্দর পুত্র, শশী ষোলকলা।। দিনে দিনে বাড়ে পুত্র মুনির ভবনে। ছয় বর্ষ পূর্ণ হৈল রাজা নাহি জানে।। মহা পরাক্রান্ত-বীর হৈল শিশুকালে। সিংহ ব্যাঘ্র হস্তী ধরি আনে পালে পালে।। তার পরাক্রম দেখি মুনি চমৎকার। দমনক বলি নাম দিলেন তাহার।। শকুন্তলা সহ মুনি করিল বিচার। যুবরাজ-যোগ্য পুত্র হইল তোমার।। পুত্র সহ যাহ তুমি রাজার আলয়। পিতৃগৃহে কন্যা কভু সম্ভব না হয়।। ধর্ম্মক্ষয় অপযশ হয় কুচরিত্র। পিতৃগৃহে বহু ধর্ম্মেনা হয় পবিত্র।। এত বলি শিষ্য এক দিলেন সংহতি। পুত্র সহ পাঠাইলা যথা নরপতি।। দুষ্মন্ত নৃপতি বৈসে হস্তিনা নগর। শকুন্তলা গেল যথা আছে নৃপবর।। পাত্রমিত্র সহ রাজা আছেন বসিয়া। পুত্র আগে করি তথা উত্তরিল গিয়া।। রাজারে চাহিয়া শকুন্তলা কহে বাণী। এই পুত্র তোমার, দেখহ নৃপমণি।। পূর্ব্বের প্রতিজ্ঞা রাজা করহ স্মরণ। তপোবনে গিয়াছিলে মৃগয়া কারণ।। আপনার সত্য রাজা করহ পালন। পুত্রে কোলে করি রাজা তোষ মম মন।। শুনি সভাসদ-লোক বিস্ময় অন্তর। হাসিয়া দুষ্মন্ত রাজা করিল উত্তর।। কোথাকার তপস্বিনী কাহার নন্দিনী। কোনকালে পরিচয় আমি নাহি জানি।। এত শুনি শকুন্তলা হইলা লজ্জিত। ক্রোধেতে অধর ওষ্ঠ সঘনে কম্পিত।। পুনঃ ক্রোধ সম্বরিয়া বলে শকুন্তলা। পূর্ব্বসত্য পাসরিলা রাজভোগে ভোলা।। কি বাক্য বলিলা রাজা, নাহি ধর্ম্ম ভয়। তুমি হেন মিথ্যা বল, উচিত না হয়।। দৈবে সেই সব কথা কেহ নাহি জানে। আপনি ভাবিয়া রাজা দেখ মনে মনে।। জানিয়া শুনিয়া মিথ্যা কহে যেই জন। সহস্র বৎসর হয় নরকে গমন।। লুকাইয়া যেই জন করে পাপ কর্ম্ম। লোকে না জানিল কিন্তু জানিল যে ধর্ম্ম।। চন্দ্র সূর্য্য বায়ু অগ্নি মহী আর জল। আকাশ শমন ধর্ম্ম জানয়ে সকল।। দিবা রাত্রি সন্ধ্যা প্রাতঃ বালবৃদ্ধ জানে। ধর্ম্মাধর্ম্ম ফল তারে দেয় ত শমনে।। মিথ্যা হেন বল রাজা, কভু ভাল নহে। মিথ্যা হেন পাপ নাহি, সর্ব্বশাস্ত্রে কহে।। পতিব্রতা নারী আমি, না কর হেলন। আমারে নীচের প্রায় না ভাব রাজন।। পুত্ররূপে জন্মে পিতা ভার্য্যার উদরে। শাস্ত্রেতে প্রমাণ আছে জানে চরাচরে।। সে কারণে ভার্য্যারে জননী সমা দেখি। করিলা বিস্তর দোষ আমারে উপেক্ষি।। অর্দ্ধেক শরীর ভার্য্যা, সর্ব্ব শাস্ত্রে লেখে। ভার্য্যা সম বন্ধু রাজা নাহি কোন লোকে।। পরম সহায় হয় পতিব্রতা নারী। যাহার সহায়ে রাজা সর্ব্ব ধর্ম্ম করি।। ভার্য্যা বিনা গৃহ শূন্য অরণ্যের প্রায়। বনে ভার্য্যা সঙ্গে থাকে গৃহস্থ বলায়।। ভার্য্যাহীন লোকে কেহ না করে বিশ্বাস। সর্ব্বদা দুঃখিত সেই সর্ব্বদা উদাস।। ভার্য্যাবন্ত লোক ইহকাল বঞ্চে সুখে। মরণে সংহতি হৈয়া তারে পরলোকে।। স্বামীর জীবনে ভার্য্যা আগে যদি মরে। পথ চাহি থাকে ভার্য্যা স্বামী অনুসারে।। মরিলে স্বামীরে উদ্ধারিয়া লয় স্বর্গে। হেন নীতিশাস্ত্র রাজা কহে সুরবর্গে।। ভার্য্যা বিনা পুত্র করে কাহার শকতি। দেব ঋষি মুনি আদি যত মহামতি।। পুত্রের সমান রাজা নাহিক সংসারে। জন্মমাত্র মুখ দেখি পিতামাতা তরে।। পিণ্ডদান পুত্র তার করয়ে উদ্ধার। হেন নীতি কহে রাজা বেদেতে প্রচার।। চতুষ্পদে গাভী শ্রেষ্ঠ, দ্বিপদে ব্রাহ্মণে। অধ্যায়নে গুরু শ্রেষ্ঠ, পুত্র আলিঙ্গনে।। ধূলায় ধূসর পুত্রে করি আলিঙ্গন। হৃদয়ের সর্ব্বদুঃখ হয় ত খণ্ডন।। হেন পুত্র দাঁড়াইয়া তোমার সম্মুখে। আলিঙ্গন করে রাজা পরম কৌতুকে।। অবজ্ঞা না কর রাজা, নীচ পুত্র নহে। ইহার মহিমা যত মুনিগণ কহে।। শত শত করিবেক অশ্বমেধ যাগ। সসাগরা ধরার লইবে রাজ্যভাগ।। উজ্জ্বল করিবে বংশ এই ত নন্দন। প্রত্যক্ষে দেখহ রাজা দ্বিতীয় তপন।। পিতার হতাশে পুত্র সদা ভাবে দুখ। সে কারণে দেখিতে আইল তব মুখ।। আলিঙ্গন দিয়া তোষ আপন কুমারে। দুঃখ নাহি ত্যজ কিবা রাখহ আমারে।। বিশ্বামিত্র পিতা মোর, মেনকা জননী। প্রসবিয়া বনে গেল থুয়ে একাকিনী।। জননী ত্যজিল পূর্ব্বে, তুমি ত্যজ এবে। তোমারে বলিব কি মরিব এই ভেবে।। নিশ্চয় মরিব আমি, নাহি তাহে দুঃখ। এ পুত্র বিচ্ছেদে মোর বিদরিছে বুক।। শকুন্তলা এত যদি বিনয় করির। শুনিয়া নৃপতি তবে প্রত্যুত্তর দিল।। অকারণে পুনঃ পুনঃ কহ কি আমারে। তোমার বচন শুনি কেবা শ্রদ্ধা করে।। তোমার জনক যদি বিশ্বামিত্র মুনি। মেনকা অপ্সরী হয় তোমার জননী।। বিশ্বামিত্র লোভী বলি জানে ত্রিজগতে। জন্মিয়া ক্ষত্রিয়কুলে গেল বিপ্র-পথে।। মেনকা কেমন নারী কেবা নাহি জানে। মায়ের প্রকৃতি তোর খণ্ডিবে কেমনে।। নিশ্চয় মায়ের মত তোমার প্রকৃতি। এই পুত্র সেই মত, লয় মোর মতি।। মিথ্যা প্রবঞ্চনা করি প্রতার আমারে। যাহ কিম্বা থাক, কেহ না জিজ্ঞাসে তোরে।। শকুন্তলা কহে, রাজা কহ বিপরীত। দেবলোকে নিন্দা কর, নহে ত উচিত।। মেনকা অপ্সরা, তারে পূজে দেবগণে। বিশ্বামিত্র মহাঋষি, কেবা নাহি জানে।। তোমায় আমায় রাজা অনেক অন্তর। সুমেরু সরিষা হতে যত বৃহত্তর।। মম মাতা স্বর্গবাসী, তুমি বৈস ক্ষিতি। স্বর্গে মর্ত্ত্যে সমতুল কর নরপতি।। আমার দেখহ শক্তি আপন নয়নে। এখনি যাইতে পারি যথা ইচ্ছা মনে।। ইন্দ্র যম কুবের ভুবন আদি করি। মুহূর্ত্তেকে চরাচর ভ্রমিবারে পারি।। যত নিন্দা কর, সহি স্বামীর কারণে। আপনা না জান, নিন্দা কর অন্য জনে।। কুরূপ মনুষ্য রাজা নিন্দে সর্ব্বলোকে। যতক্ষণ দর্পণে না নিজ মুখ দেখে।। সত্য সম পুণ্য রাজা নাহিক তুলনা। মিথ্যা হেন পাপ নাহি কহে মুনি জনা।। হেন মিথ্যাবাদী তুমি হইলে নিশ্চয়। তোমার এখানে থাকা উচিত না হয়।। এত বলি শকুন্তলা চলিল সত্বর। হেনকালে শব্দ হয় আকাশ উপর।। সত্য কথা সকলি কহিল শকুন্তলা। শকুন্তলা বাক্য রাজা না করিও হেলা।। সতী পতিব্রতা এই তোমার ক্ষমিল। শকুন্তলা-ক্রোধে তব নাহি হৈবে ভাল।। বংশের তিলক রাজা এই যে নন্দন। আমার বচনে কর রক্ষণ ভরণ।। ভরত বলিয়া নাম রাখহ ইহার। ইহা হৈতে বংশোজ্জ্বল হইবে তোমার।। দুষ্মন্ত নৃপতি শুনে মন্ত্রী পুরোহিত। এতেক আকাশবাণী হৈল আচম্বিত।। রাজা বলে, মন্ত্রিগণ করিলা শ্রবণ। সকলি ত জানি আমি, নহি বিস্মরণ।। জানিয়া না জানি আমি, লোকাচারে ডরি। লোকে বলিবেক এই লোকাচারে ডরি। লোকে বলিবেক এই কোথাকার নারী।। এ কারণে আমি ভাণ্ডিলাম মন্ত্রিগণে। বেশ্যা বলি ইহারে জানিল সর্ব্বজনে।। এত বলি শীঘ্র উঠি দুষ্মন্ত রাজন। শকুন্তলা হস্তে ধরি ফিরান তখন।। মহানন্দে নরপতি পুত্র লৈল কোলে। শত শত চুম্ব দিল বদন কমলে।। শকুন্তলায় করিল রাজ-পাটেশ্বরী। পরম কৌতুকে চিরদিন রাজ্য করি।। কতদিনে বৃদ্ধকালে দুষ্মন্ত রাজন। ভরতের রাজ্যে দিয়া গেল তপোবন।। পৃথিবীতে মহারাজ হইল ভরত। অশ্বমেধ যজ্ঞ আদি করে শত শত।। লক্ষ পদ্ম সুবর্ণ ব্রাহ্মণে দিল দান। দাতা যে নাহিক কেহ ভরত সমান।। সসাগরা পৃথিবী শাসিল ভুজবলে। অদ্যাপি ভারতভূমি ঘোষে ভূমণ্ডলে।। তাঁর বংশে যতজন হইল নরপতি। ভরতের বংশ বলি পাইল সুখ্যাতি।। ভরতের উপাখ্যান যেই নর শুনে। আয়ুর্যশ-পুণ্য তার বাড়ে দিনে দিনে।। আদিপর্ব্ব ভারত রচিল বেদব্যাস। পাঁচালী প্রবন্ধে কহে কাশীরাম দাস।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon