৬৭. ভীমের বিষপান মুনি বলিলেন, রাজা শুন তদন্তরে। পুত্র সহ কুন্তীদেবী রহে অন্তঃপুরে।। কৌরব পাণ্ডব ভাই পঞ্চোত্তর শত। বেদ-শাস্ত্র অধ্যয়নে সবে পরাগত।। বালকের ক্রীড়া যত আছয়ে সংসারে। ক্রীড়ায় উত্তম সবে সদা ক্রীড়া করে।। ক্রীড়ারসে বলে শ্রেষ্ঠ পঞ্চ সহোদর। সবার অধিক বলে বীর বৃকোদর।। মহা-বলবন্ত ভীম দেখি যম যেন। তাহার সদৃশ নাহি ভাই একজন।। ধাইতে পবন সম, সিংহ সম হাঁকে। আস্ফালন গজ সম, মেঘ সম ডাকে।। যেই দিক দিয়া ভীম বেগে যায় চলি। দশ বিশ বৃক্ষে ফেলে ভুজাস্ফালে ঠেলি।। ক্রোধে সব সহোদরে ধরি একেবারে। অবহেলে বৃকোদর শরীর ঝাঁকারে।। কতদূরে পড়ে সবে অচেতন হৈয়া। পৃষ্ঠে গায় নাসিকায় রক্ত যায় বৈয়া।। দুই হস্তে ধরে বীর সবাকার কর। চক্রাকার করিয়া ভ্রমায় বৃকোদর।। প্রাণ যায় বলি সবে পরিত্রাহি ডাকে। মৃতকল্প সব দেখি তবে ভীম রাখে।। জলমধ্যে ক্রীড়া যবে করে ভ্রাতৃগণ। একেবারে ধরে ভীম দশ দশ জন।। ডুবায় জলেন নীচে চাপি দুই কাঁখে। মৃতকল্প করি ছাড়ে প্রাণমাত্র রাখে।। ভয়েতে না যায় কেহ ভীমের নিকটে। জলেতে দেখিলে ভীমে সবে থাকে তটে।। ফলহেতু উঠে সবে বৃক্ষের উপরে। তলে থাকি বৃক্ষে ভীম চরণ প্রহারে।। চরণের ঘায় বৃক্ষ করে থর থর। ফল সহ পড়ে তাহা ভূতল উপর।। বালক-কালেতে ভীম মহা-পরাক্রম। ভীমেরে বালকগণ দেখে যেন যম।। দুর্য্যোধন দেখি হৈল পরম চিন্তিত। বালক-কালেতে বল ধরে অপ্রমিত।। বয়োধিক হইলে হইবে মহবল। ইহার জীয়ন্তে নাই আমার কুশল।। হৃদে চিন্তি দুর্য্যোধন করিল বিচার। ভীমেরে মারিব, হেন যুক্তি করে সার।। ভীমে মারি চারি ভায়ে রাখিব বান্ধিয়া। তবে ত ভুঞ্জিব রাজ্য নিষ্কণ্টক হৈয়া।। ৬৮. কৃপাচার্য্যের জন্ম-বিবরণ মুনিবরে কহে পরীক্ষিতের কুমার। বিস্তারিয়া কহ মোরে, ঘুচুক আঁধার।। তদন্তর কি করিল পাণ্ডবের স্বামী। তব মুখে শুনিয়া কৃতার্থ হই আমি।। মুনি বলে, শুন রাজা পাণ্ডব-চরিত্র। যাহার শ্রবণে হয় জগত পবিত্র।। তব কত দিনে ভীষ্ম গঙ্গার নন্দন। অস্ত্র-শিক্ষা হেতু নিয়োজিল পৌত্রগণ।। সর্ব্বশাস্ত্রে বিশারদ কৃপাচার্য্য নাম। শরদ্বান্ ঋষি-পুত্র হস্তিনাতে ধাম।। পঞ্চোত্তর শত ভাই কৌরব-পাণ্ডব। কৃপাচার্য্য ধনুর্ব্বেদদ শিখাইল সব।। জন্মেজয় বলে, কহ শুনি মহাশয়। ক্ষত্রধর্ম্ম কৈল কেন ব্রাহ্মণ-তনয়।। মুনি বলে, নৃপতি করহ অবধান। গৌতম ঋষির পুত্র নাম শরদ্বান্।। শরদ্বান্ নাম হৈল শর সহ জন্ম। ধনুর্ব্বেদ রত হৈল ত্যজি দ্বিজকর্ম্ম।। বেদশাস্ত্র না পড়িল ধনুর্ব্বেদে মন। তপোবন মধ্যে তপ করে অনুক্ষণ।। তাঁর তপ দেখিয়া সশঙ্ক শতক্রুতু। সৃজিলেন উপায় সে তপোভঙ্গ হেতু।। জানপদী দেবকন্যা দিল পাঠাইয়া। যথ তপ করে, তথা উত্তরিল গিয়া।। কন্য দেখি শরদ্বান্, হৈল হত ধৈর্য্য। ধনুঃশর খসিত স্খলিত হৈল বীর্য্য।। স্খলিত হইতে মুনি হৈল সচেতন। সে বন ত্যজিয়া মুনি গেল অন্য বন।। যাইতে ঋষির বীর্য্য পড়িল ভূতলে। দুই ঠাঁই হইয়া পড়িল সেই স্থলে।। তপস্বী ঋষির বীর্য্য কভু নষ্ট নয়। হইল একটি কন্যা, অন্যটি তনয়।। শান্তনু-নৃপতি গেল মৃগয়া কারণে। ভ্রমিতে ভ্রমিতে গেল সেই তপোবনে।। অনাথ যুগল-শিশু দেখি অনুচরে। আস্তে ব্যস্তে জানাইল রাজার গোচরে।। শুনিয়া গেলেন রাজা ভাবি চমৎকার। দেখে রোদন করে কুমারী কুমার।। ধনুঃশর আছে আর আছে কৃষ্ণচর্ম্ম। অনুমানে জানিলেন ঋষির এ কর্ম্ম।। গৃহে আনি দোঁহারে যে করেন পালন। কতদিনে আসে শরদ্বান্ তপোধন।। শরদ্বান্ বলে, রাজা তুমি ধর্ম্মময়। কৃপায় পালিলে সেই তনয়া তনয়।। সে কারণে নাম রাখিলাম দোঁহাকার। কৃপ কৃপী বলি হেন ঘোষয়ে সংসার।। তবে শরদ্বান্ মুনি আপন নন্দনে। নানা অস্ত্রবিদ্যা শিখাইল দিনে দিনে।। ধনুর্ব্বেদে কৃপ সব নাহিক মানুষে। অল্পকালে আচার্য্য বলিয়া লোকে ঘোষে।। কুরুবংশ-যদুবংশ-অন্ধ-বৃষ্ণি বংশে। আর যত রাজগণ বৈসে নানা দেশে।। সবে ধনুর্ব্বেদ শিক্ষা করে কৃপ-স্থানে। কৃপগুরু বলি নাম ব্যাপিল ভুবনে।। পরে ভীষ্ম মহাবীর চিন্তিলেন মনে। বিশেষ কি মতে শিক্ষা হবে পৌত্রগণে।। মহাভারতের কথা অমৃত-সমান। কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।। ৬৯. দ্রোণাচার্য্যের জন্ম-বিবরণ রাজা বলিলেন, মুনি কর অবধান। কার পুত্র দ্রোণাচার্য্য, কোথা অবস্থান।। ধনুর্ব্বেদ শিখাইল তাঁরে কোন্ জন। কুরু-দেশে গুরু হইলেন কি কারণ।। ব্যাস-শিষ্য মুনিবর সর্ব্ব-শাস্ত্র-জ্ঞানী। কহিতে লাগিল দ্রোণাচার্য্যের কাহিনী।। ভরদ্বাজ মহামুনি খ্যাত ভূমণ্ডলে। একদিন স্নানার্থ গেলেন গঙ্গাজলে।। অন্তরীক্ষে চ’লি যায় ঘৃতাচী অপ্সরা। পরমা সুন্দরী হয় অপ্সরাতে বরা।। দক্ষিণ-পবনে তার উড়িল বসন। মুনি তার অঙ্গ করিলেন দরশন।। দেখিয়া তাঁহার চিত্তে জন্মিল উদ্বেগ। পঞ্চশর-শরের অধিকতর বেগ।। নাহি হেন জন, যারে না মোহে কামিনী। স্খলিত হইল রেত, চিন্তাম্বিত মুনি।। সম্মুখে দেখিয়া দ্রোণী রাখিলেন তায়। দ্রোণী-মধ্যে পুত্র জন্ম হইল ত্বরায়।। পুত্র দেখি ভরদ্বাজ হরিষ-অন্তর। পুত্র লৈয়া গেলেন সে আপনার ঘর।। দ্রোণীতে জন্মিল পুত্র তেঁই দ্রোণ আখ্যা। বেদ-বিদ্যা সর্ব্ব-শাস্ত্র করালেন শিক্ষা।। ছিলেন পৃষত-নামে পাঞ্চাল রাজন। দ্রুপদ বলিয়া নাম তাঁহার নন্দন।। ভরদ্বাজ-মুনির আশ্রমে সদা যায়। সমান-বয়স দ্রোণ সহিত খেলায়।। এক ঠাঞি দুই জন করে অধ্যয়ন। ক্রীড়া করে এক ঠাঁই ভোজন-শয়ন।। তিলেক না রহে দোঁহে না হইলে দেখা। পরস্পর হইলে দোঁহার দোঁহে সখা। তবে কত দিনে রাজা পৃষত মরিল। পাঞ্চাল-দেশেতে রাজা দ্রুপদ হইল।। স্বর্গেতে গেলেন ভরদ্বাজ তপোধন। তপস্যা করিতে দ্রোণ যান তপোবন।। কতদিনে দ্রোণাচার্য্য পিতৃ-আজ্ঞা মানি। বিবাহ করেন কৃপাচার্য্যের ভগিনী।। পরমা-সুন্দরী কন্যা ব্রতে অনুরতা। যজ্ঞ-হোম তপে নিষ্ঠা সতী পতিব্রতা।। যজ্ঞ-তপ-ফলে তাঁর হইলে নন্দন। জন্মমাত্র পুত্র করিলেক অশ্বের গর্জ্জন।। হেনকালে আচম্বিতে হৈল শূন্যবাণী। জন্মমাত্র পুত্র করিলেক অশ্বধ্বনি।। অশ্বত্থামা নাম তার হবে সে কারণে। দীর্ঘজীবী হবে, আর পূর্ণ সর্ব্বগুণে।। পুত্রে দেখি দ্রোণাচার্য্য আনন্দিত মন। নানা বিদ্যা তারে করালেন অধ্যয়ণ।। তবে কত দিনে দ্রোণ করেন শ্রবণ। জমদগ্নি-সুতের দানের বিবরণ।। নানা রত্ন ধন বিপ্রে দিতেছেন দান। পৃথিবীতে শব্দ হৈল দানের বাখান।। মহেন্দ্র-পর্ব্বত মধ্যে রামের নিলয়। তথায় গেলেন ভরদ্বাজের তনয়।। দ্রোণে জিজ্ঞাসেন জমদগ্নির নন্দন। কোথা হৈতে আইলেন, কোন প্রয়োজন।। দ্রোণ বলিলেন, মোর দ্রোণাচার্য্য নাম। জনক আমার ভরদ্বাজ গুণধাম।। বহুদান কর তুমি, শুনি লোকমুখে। বার্তা পেয়ে আইলাম তোমার সম্মুখে।। পূর্ণ করি ধন দিবা আমারে হে রাম। সকুটুম্ব মোর যেন পুরে মনস্কাম।। শুনিয়া বলেন জমদগ্নির নন্দন। সব ধন দিয়া আমি এই যাই বন।। হেনকালে এলে তুমি ব্রাহ্মণ-কুমার। কোন্ দ্রব্য দিয়া তুষ্টি করিব তোমার।। পৃথিবীর মধ্যে মম নাহি অধিকার। কশ্যপে দিলাম আমি সকল সংসার।। আছে মাত্র প্ত্রাণ আর ধনুঃশর তূণ। যাহা ইচ্ছা মম স্থানে মাগি লহ দ্রোণ।। দ্রোণাচার্য্য মাগিলেন তবে ধনুর্ব্বাণ। মন্ত্র সহ অস্ত্র দেন ভৃগুর সন্তান।। ধনুর্ব্বেদে নিপুণ হইয়া দ্রোণাচার্য্য। পরে চলিলেন তিনি দ্রুপদের রাজ্য।। অত্যন্ত দরিদ্র দ্রোণ, না মাগেন কারে। পুত্রের দেখিয়া কষ্ট ভাবেন অন্তরে।। বালক কালের সখা দ্রুপদ রাজন। তাঁর স্থানে গেলে হবে দারিদ্র-ভঞ্জন।। এত ভাবি গেল দ্রোণ পাঞ্চাল-ভঞ্জন।। এত ভাবি গেল দ্রোণ পাঞ্চাল-নগর। উত্তরেন যথায় দ্রুপদ নরবর।। পিন্ধন মলিন জীর্ণ কৃষ্ণবর্ণ দুঃখে।। রাজারে বলেন দ্রোণ, শুন মহারাজ। আমি তব সখা, হেথা আসিয়াছি আজ।। এত শুনি নরপতি কটাক্ষেতে চায়। নয়ন লোহিত-বর্ণ, কহে কম্পকায়।। কোথায় দ্বিজ তুমি দরিদ্র ভিক্ষুক। অজ্ঞান বাতুল কিবা হইবা দুর্ম্মুখ।। আমি মহারাজ হই পাঞ্চাল-ঈশ্বর। কোন্ লাজে সখা বল সভার ভিতর।। ধনীর নির্ধন সখা কভু না যুয়ায়। সুর-নরলোকে কভু সখ্য নাহি হয়।। কোথা সখ্য হইয়াছে নৃপতি ভিক্ষুকেক। সমানে সমানে সখ্য হয় অতি সুখে।। উত্তমে অধমে সখ্যে হয় অতি সুখ। অধমে উত্তমে দ্বন্দ্ব সেইরূপ দুঃখ।। কোথা হৈতে এলে তুমি দরিদ্র এখানে। দেখেছি কি না দেখেছি, নাহি পড়ে মনে।। এতেক শুনিয়া তাঁর নিষ্ঠুর উত্তর। অভিমানে দ্রোণের কম্পিত কলেবর।। মুহূর্ত্তেক স্তব্ধ হৈয়া রহিলেন দ্রোণ। ক্রোধে নেত্রদ্বয় করে অগ্নি বরিষণ।। পুনশ্চ না দেখিলেন রাজার বদন। না বলিয়া কারে কিছু করিলা গমন।। শ্যালক-আলয়ে যান হস্তিনা-নগর। দ্রোণে দেখি কৃপাচার্য্য হরিষ-অন্তর।। দারা পুত্র সহ দ্রোণ থাকেন তথায়। হেনমতে গুপ্তবেশে কত দিন যায়।। মহাভারতের কথা অমৃত-সিঞ্চিত। পাঁচালী-প্রবন্ধে কাশীরাম বিরচিত।। ৭০. কুরু-পাণ্ডবের বাল্যক্রীড়া এক দিন তথা যত কুরুপুত্রগণ। নগর বাহিরে ক্রীড়া করে সর্ব্বজন।। এক গোটা লৌহ ভাঁটা ভূমিতে ফেলিয়া। হাতে দণ্ড করি তাহা যায় গড়াইয়া।। হেন লৌহ-ভাঁটা তবে দৈব নির্ব্বন্ধনে। নিরুদক কূপ মধ্যে পড়িল তাড়নে।। কূপেতে পড়িল দেখি সকল কুমার। তাহা তুলিবারে যত্ন করিল অপার।। কিছু কিছুতেই কৃতকার্য্য না হইল। হতাশ হইয়া সবে ভাবিতে লাগিল।। লজ্জিত হইল সবে মলিন বদন। হেনকালে আইলেন দ্রোণ তপোধন।। শুক্লবেশ শুক্লবস্ত্র স্বন্ধেতে উত্তরী। শ্যামল দেহের বর্ণ, গতি মত্তকরী।। শিশুগণে দেখি দ্রোণ বিরস বদন। জিজ্ঞাসেন মনোদুঃখ কিসের কারণ।। এতেক শুনিয়া বলে যতেক কুমার। ধিক্ ক্ষত্রকূলে জন্ম আমা সবাকার।। ধিক্ প্রাণ, ধিক্ ধনু, ধিক অধ্যয়ন। ভাঁটা উদ্ধারিতে শক্ত নহি কোন জন।। হের দেখ জলহীন কূপের ভিতরে। পড়িয়াছে লৌহ-ভাঁটা পাই দেখিবারে।। এত শুনি দ্রোণাচার্য্য বলেন হাসিয়া। কূপ হৈতে ভাঁটা দেখ দেই উদ্ধারিয়া।। এই ইষিকার তেজে করিব উদ্ধার। ভোজ্য দিয়া তুষ্ট তবে করিবা আমার। একবাক্য হৈয়া সবে কর অঙ্গীকার। অবশ্য উদ্ধারি দিব লৌহ-ভাঁটা যার।। এত শুনি যুধিষ্ঠির ধর্ম্মের নন্দন। দ্রোণাচার্য্য প্রতি বলে বুঝিয়া কারণ।। কূপ হৈতে ভাঁটা পার করিতে উদ্ধার। কি ভোজ্য ভোজনে তবে, সকলি তোমার।। কৃপাচার্য্য সহিত ভুঞ্জহ নানা সুখ। এত শুনি দ্রোণাচার্য্য পরম কৌতুক।। দ্রোণ বলিলেন, সবে থাক স্থির-রূপে। এইত অঙ্গুরী আমি ফেলি এই কূপে।। অঙ্গুরী তুলিব আর উদ্ধারিব ভাঁটা। এত বলি লইলেন ইষিকা একটা।। মন্ত্র পড়ি দ্রোণচার্য্য ইষিকা মারিল। মন্ত্রতেজে লৌহ-ভাঁটা সকল ভেদিল।। পুনঃ পুনঃ তথিপর মারেন অপার। ইষিকা ইষিকা যুড়ি হৈল দীর্ঘাকার।। ইষিকার মূল তবে দ্রোণ ধরি করে। আকাশে তুলেন ভাঁটা উঠিল উপরে।। আশ্চর্য্য হইয়া সবে মানিল বিস্ময়। তবে ধনুর্ব্বাণ লয়ে দ্রোণ মহাশয়।। মন্ত্র পড়ি অঙ্গুরী উপরে বাণাঘাতে। শর সহ অঙ্গুরী উঠিল আসি হাতে।। দেখিয়া দুষ্কর কর্ম্ম সকল কুমার। জিজ্ঞাসিল দ্বিজবরে করি পরিহার।। কোথা হৈতে এলে দ্বিজ, কোথায় নিবাস। কি কারণে আগমন, করহ প্রকাশ।। অদ্ভুত তোমার কর্ম্ম লোকে অনুপাম। কহ শুনি দ্বিজবর কিবা তব নাম।। আজ্ঞা কর দ্বিজবর, যেই লয় মন। যে আজ্ঞা করিবা, তাহা করিব পালন।। এতেক বচন যদি শিশুগণ কৈল। শুনিয়া সন্তুষ্ট দ্বিজশ্রেষ্ট যে হইল।। দ্রোণ বলে, শুন সবে আমার উত্তর। মম সমাচার কহ ভীষ্মের গোচর।। রূপ গুণ আমার কহিবা তাঁর স্থান। আপনি জানিয়া ভীষ্ম করিবে বিধান।। এত শুনি শীঘ্রগতি যতেক কুমার। পিতামহ-আগে কহে সব সমাচার।। বৃদ্ধ এক দ্বিজবর শ্যামবর্ণ ধরে। তাঁহার যতেক গুণ অদ্ভুত সংসারে।। নাম ধাম করিলাম জিজ্ঞাসা তাঁহারে। কহিলেন তোমার গোচর করিবারে।। এত শুনি গঙ্গাপুত্র ভাবিয়া হৃদয়। জানিলেন এতাদৃশ অন্য কেহ নয়। দ্রোণাচার্য্য বিনা অন্য কেহ নাহি জানে। আইলেন দ্রোণ, জানিলাম এ বিধানে।। কুরুবংশ-যোগ্য গুরু মিলে এতদিনে। দ্রো-অনুসারে ভীষ্ম চলিল আপনে।। দ্রোণে দেখি প্রণমিল গঙ্গার নন্দন। আশীর্ব্বাদ করি দ্রোণ, দেন আলিঙ্গণ।। ভীষ্ম বলিলেন, কহ আপন-কল্যাণ। বড় ভাগ্যে কুরুবংশে দ্রোণ-অধিষ্ঠান।। এতেক শুনিয়া ভরদ্বাজের নন্দন। কহিতে লাগিল সব আত্ম-বিবরণ।। তপোবনে থাকি বহু করি তপঃক্লেশ। ফলমূলাহারী ধরি জটা-বল্ক-বেশ।। এইরূপে বহুদিন থাকি তপোবন। হেনকালে পিতৃবাক্য হইল স্মরণ।। বংশ-হেতু কতদিনে পিতৃ-আজ্ঞা পেয়ে। গৌতমী কৃপের ভগ্নী করিলাম বিয়ে।। জন্মিল তাহার গর্ভে একটি নন্দন। অশ্বত্থামা নাম তার দিল দেবগণ।। কতদিনে ক্রীড়া-কাল পাইল কুমার। শিশুগণ-সঙ্গে সদা করয়ে বিহার।। আচম্বিতে একদিন আইল ধাইয়া। আমার অগ্রেতে কহে কান্দিয়া কান্দিয়া।। গবীদুগ্ধ পান করে সকল বালক। সেই মত দুগ্ধ দেহ আমারে জনক।। অনেক রোদন করি মাগিল নন্দন। দুগ্ধ হেতু করিলাম বহু পর্য্যটন।। গবীর কারণে ভ্রমিলাম বহু স্থান। সত্যশীল কেহ না করিল গবীদান।। নাহি চাহিলাম কোন অধমের স্থান। গবী না পাইয়া গৃহে করিনু প্রস্থান।। গৃহে আসি দেখিলাম বালকের দল। আনিয়াছে পাত্রভরি পিটালির জল।। পিটালির জলে সবে দুগ্ধ বলি দিল। আনন্দিত হৈয়া শিশু তাহা পান কৈল।। সকল বালকগণ নৃত্য করে রঙ্গে। অশ্বত্থামা নাচিতে লাগিল শিশু সঙ্গে।। ইহা দেখি শিশুগণ বলাবলি করে। যার পুত্র পিষ্টোদক পিয়ে হর্ষভরে।। দুগ্ধপান কৈনু বলি নাচিছে সঘনে। ধিক্ ধিক্ শত ধিক্ ধনহীন দ্রোণে।। শিশুগণ উপহাস তাহারে করিল। পুনরপি আসি পুত্র আমারে কহিল।। পুত্রের বচন শুনি চিত্তে হৈল তাপ। জননী শুনিয়া বহু করিল বিলাপ।। বহুমতে বিলাপিয়া ভাবি মনে মনে। আপন কর্ম্মের ফল না হয় খণ্ডনে।। ধিক্ তপ ধিক্ জন্ম ধিক্ পরিবার। ধিক্ ধ্যান জ্ঞান মোর, ধিক্ কলেবর।। ধিক্ ধিক্ শতধিক আমার জীবনে। পৃথিবীতে গৃহবাসী ধিক্-ধনহীনে।। এতেক ভাবিয়া পূর্ব্ব হইল স্মরণ। বালক কালেতে সখা পৃষত-নন্দন।। অত্যন্ত সৌহৃদ ছিল তাহার সহিত। পাঞ্চালে গেলাম ভাবি পূর্ব্বের পিরীত।। সখা বলি সম্ভাষ করিনু দ্রুপদেরে। দেখিয়া অনেক নিন্দা করিল আমারে।। কোথায় দরিদ্র তুমি, আমি নৃপমণি। তব সনে সখ্য কবে, আমি নাহি জানি।। পুনঃ পুনঃ কত বলে নিষ্ঠুর বচন। সেবকে বলিল, দেহ একটি ভোজন।। এতেক নিষ্ঠুর বাক্য শুনিয়া তাহার। ক্ষণেক বিলম্ব তথা না করিনু আর।। ভেদিলেম মর্ম্ম মম তাহার বচনে। এ প্রতিজ্ঞা করিলাম তথির কারণে।। আইলাম প্রতিজ্ঞা করিয়া নিজ চিতে। প্রতিকার করিবে তাহার ভবিষ্যতে।। সেই হেতু আইলাম হস্তিনা-নগর। কি করিব প্রীতে তব, কহ নৃপবর।। ভীষ্ম বলিলেন, ভাগ্য বড়ই আমার। অতএব হেথায় করিলা আগুসার।। এই কুরু-জাঙ্গল কৌরব-অধিকার। রাজ্য অর্থ পরিবার সব আপনার।। পৌত্রগণে সমর্পি তোমার বিদ্যমান। কৃপায় সবারে কর অস্ত্র শিক্ষা দান।। এত বলি ভীষ্ম তবে পূজি বহুতর। রহিবারে দিলেন রত্নমণ্ডিত ঘর।। মহাভারতের কথা অমৃত-সমান। কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।। ৭১. দ্রোণের নিকট অর্জ্জুনের প্রতিজ্ঞা এবং পাণ্ডব ও ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের অস্ত্রশিক্ষা তবে দ্রোণাচার্য্য সব রাজপুত্র লৈয়া। কহিতে লাগিল সবে একান্তে বসিয়া।। অস্ত্রবিদ্যা সবারে করাব অধ্যয়ন। শিক্ষা করি মম বাক্য করিবা পালন।। আমার যে বাঞ্ছা বলি শুন সব শিষ্য। সত্য কর, তোমরা তা করিবে অবশ্য।। দ্রোণের বচন শুনি যত শিষ্যগণ। নিঃশব্দ হইল সবে, না কহে বচন।। অর্জ্জুন বলেন, করি সত্য অঙ্গীকার। করিব পালন, হয় যে আজ্ঞা তোমার।। অর্জ্জুন-বচনে দ্রোণ হরিষ- অন্তর। আলিঙ্গিয়া চুম্ব দিল মস্তক-উপর।। একান্তে বলেন দ্রোণ করি অঙ্গীকার। শিষ্য না করিব কারো সদৃশ তোমার।। তবে দ্রোণাচার্য্য লৈয়া যত শিষ্যগণ। সর্ব্বদা করান নানা অস্ত্র-অধ্যয়ণ।। অস্ত্রশিক্ষা করে কুরু-পাণ্ডব-কুমার। রাজ্যে রাজ্যে গেল দ্রোণ-গুরু সমাচার।। যত রাজপুত্রগণ শিক্ষার কারণ। হস্তিনানগরে সবে করিল গমন।। বৃষিবংশ-যদুবংশ-তনু ভোজ আদি। আর যত রাজগণ সাগর অবধি।। কর্ণ মহাবীর অধিরথের নন্দন। সদা দুর্য্যোধনের সে অনুগত জন।। সেও অস্ত্র দ্রোণ-স্থানে করে অধ্যয়ন। হেন মতে বহুশিষ্য হইল ঘটন।। শিক্ষা হেতু শিষ্যগণ থাকে নিরন্তর। নিজ পুত্রে পড়াইতে নাহি অবসর।। সবারে কহেন দ্রোণ কপট করিয়া। গঙ্গাজল আনন কমণ্ডলুতে করিয়া। কমণ্ডলু লয়ে যত রাজপুত্রগণ। জল আনিবারে সবে করিল গমন।। একান্তে পাইয়া দ্রোণ পুত্রে শিক্ষা দেন। গুরুর এ কৌশল বুঝিলেন অর্জ্জুন।। বরুণ নামেতে অস্ত্র ধনুকে জুড়িয়া। কমণ্ডলু লৈয়া দিল জলেতে পূরিয়া।। জল আনিবারে যায় সব শিষ্যগণ। অশ্বত্থামা অর্জ্জুন করেন অধ্যয়ণ।। অহর্নিশি পার্থের নাহিক অবসর। নাহি নিদ্রা শ্রম সদা হাতে ধনুঃশর।। নিরবধি গুরুপদে করেন সেবন। কৃতাঞ্জলি, সদা স্তুতি, বিনয় বচন।। পার্থের সৌজন্য দেখি দ্রোণ বড় প্রীত। বহুবিদ্যা অর্জ্জুনে দিলেন অপ্রমিত।। আদিপর্ব্ব ভারত বিচিত্র উপাখ্যান। কাশীরাম কহে সাধু সদা করে পান।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon