০১. বৈশস্পায়নের প্রতি জন্মেজয়ের প্রশ্নজন্মেজয় বলিলেন শুন মহাশয়।কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুনি ঘুচিল সংশয়।।একাদশ অক্ষৌহিনী সমরে পড়িল।তিন জন মাত্র তাহে রক্ষা যে পাইল।।পরে কি হইল মুনি বলহ আমারে।আদ্যোপান্ত যত কথা জিজ্ঞাসি তোমারে।।কি করিল শুনি ধৃতরাষ্ট্র পুত্রশোকে।সান্ত্বনা করিল কহ কোন্ কোন্ লোকে।।দুর্য্যোধন হেন পুত্র মরিল যাহার।কেমনে শোকেতে প্রাণ রহিল তাহার।।গান্ধারী কিমতে বাঁচিলেন পুত্রশোকে।বিবরিয়া সেই সব বলহ আমাকে।।মৃত তনু কোনমতে হইল সৎকার।কুরুক্ষেত্রে হৈল যত ক্ষত্রিয় সংহার।।মুনি বলে শুন রাজা সে সব কথন।যে কর্ম্ম করিল শোকে কৌরবনন্দন।।সঞ্জয় কহিল ধৃতরাষ্ট্র নৃপবরে।সেই সব বিবরণ কহিব তোমারে।।০২. শতপুত্র নাশে ধৃতরাষ্ট্রের খেদও তাঁহার সান্ত্বনাদুর্য্যোধন-মৃত্যুকথা, সঞ্জয় কহিল তথা,ধৃতরাষ্ট্র শুনিল প্রভাতে।যেন হৈল বজ্রাঘাত, আকাশের চন্দ্রপাত,কর্ণ যেন রুদ্ধ হৈল বাতে।।সকল পৃথিবীপতি, দুর্য্যোধন মহামতি,বলে ইন্দ্র না হয় সোসর।হেন পুত্র যার মরে, সে কেমনে প্রাণ ধরে,শোকেতে হইল জর জর।।পুত্রশোকে নরপতি, বিহবল পড়িল ক্ষিতি,নয়নে ঝরয়ে জলধার।বায়ুভগ্ন যেন তরু, শোক হৈল অতি গুরু,পড়িয়া করয়ে হাহাকার।।একশত পুত্র আর, মরিলেক পরিবার,সঞ্জয় কহিল নৃপবরে।হা পুত্র হা পুত্র করি, পড়ে কুরু অধিকারী,বজ্রাপাত পড়ে যেন শিরে।।বিধি কৈল হেন দশা, মনে ছিল যত আশা,দূর হৈল দৈবের ঘটন।শতপুত্র বিনাশিল, একজন না রহিল,শ্রাদ্ধ শান্তি করিতে তপূণ।।হাহা পুত্র দুর্য্যোধন, কোথা গেল দুঃশাসন,শোকে মম না রহে শরীর।আমারে সঞ্জয় কহ, কোথা তার পিতামহ,কোথা গেল দ্রোণ মহাবীর।।কোথা কর্ণ মহীশুর, রিপু দপূ করি দূর,কোথা গেল শকুনি দুম্মতি।কুমন্ত্রণা দিল মোরে, সে কারণে পুত্র মরে,না শুনিল সুহৃদ ভারতী।।আর্ত্তনাদ করি বীর, ভুমেতে লোটায় শির,হাহা পুত্র দুর্য্যোধন করি।পড়ি আছে রাজ্যপাট, মানিক মন্দির খাট,কি হইল কুরু অধিকারী।।বৃদ্ধকালে পুত্রশোক, পড়িল অমাত্যলোক,মরিল সুহৃদ বন্ধুজন।করপুটে ভিক্ষা করি, হইল যে দেশান্তরী,পৃথিবী করিব পর্য্যটন।।আগার ললাট তটে, এ লিখন ছিল বটে,কুরুকুল হইবে আঁধার।সকল পৃথিবী শাসি, ভুঞ্জিয়া বিভবরাশি,পরিচর্য্যা করিব কাহার।।হইলাম অতি দীন, যেন পক্ষী পক্ষহীন,জরাতে হারাই রাজ্যসুখ।নয়নবিহীন তনু, যেন তেজোহীন ভানু,কেমনে সহিব এত দুঃখ।।আমারে সে হিত কাম, প্রবোধ দিলেন রাম,তাহা আমি না ধরিনু মনে।ভূপতি সভাতে আসি, কহিল নারদ ঋষি,তাঁর বাক্য না শুনিনু কাণে।।ভীষ্মদেব কুরুগুরু, মহামন্ত্রী কল্পতরু,হিতকথা কহিল বিস্তর।না শুনি তাহার বোল, বিপদেদিলাম কোল,হাতে হাতে ফল পাই তার ।।দুর্য্যোধন বধ ধ্বনি, দুঃশাসন মৃত্যুবাণী,কর্ণ বধ কর্ণে নাহি সয়।হৈল দ্রোণ বিনাশন, দগ্ধ হয় মম মন,মোর বাক্য গুনহ সঞ্জয়।।পূর্ব্বে করিয়াছি পাপ, সে কারণে পাইতাপ,বিচারিয়া বল তুমি মোরে।আপনার কর্ম্মভোগ, সুত বন্ধু এ বিয়োগ,কর্ম্মবন্ধে ভোগ সবে করে।।শুনহ সঞ্জয় তুমি, ইহা নাহি জানি আমি,কখন ভীষ্মের পরাজয়।সেজনে অর্জ্জুন মারে, একথা কহিব কারে,মনে বড় জন্মিল বিস্ময়।।যাঁর সঙ্গে ভৃগুরাম. করি রণ অবিশ্রাম,প্রশংসা করিয়া গেল ঘরে।তাঁহার হইল নাশ, শুনি মনে পাই ত্রাস,সঞ্জয় কহিল আসি মোরে।।দ্রোণ মহাবলবান, পৃথিবী না ধরে টান,তাঁহারে মারিল ধনঞ্জয়।এ বড় আশ্চর্য্য কথা, কাটিল কর্ণের মাথা,অর্জ্জুন করিল কুরুক্ষয়।।আমা হেন দুঃখী জন, নাহি দেখি ত্রিভুবন,আমার মরণ সমুচিত।শীঘ্র মোরে লহ রণে, দেখাও পান্ডবগণে,আমি সবে মারিব নিশ্চিত।।যুড়িয়া ধনুকে বাণ, ভীমের বধিব প্রাণ,পুত্রশোক সহিতে না পারি।অর্জ্জুনের কাটি মাথা, ঘুচাইব মনোব্যথা,ধর্ম্মে দিব হস্তিনানগরী।।রাজার বচন শুনি, সঞ্জয় মনেতে গণি,যোড়হাতে করে নিবেদন।শুন শুন মহারাজ, সকলি বিধির কাজ,বুঝিয়া না বুঝ কি কারণ।।তোমার সমান গুনী, পৃথিবীতে নাহি শুনি,সংসারেতে তোমার আখ্যান।বৃদ্ধ হৈতে বৃদ্ধোত্তম, নাহি কেহ তোমা সম,শোকে কেন হও হতজ্ঞান।।নরপতি পুন্যবান, সঞ্জয় তাহার নাম,পুত্রশোকে ছিল সে পীড়িত।নারদের উপদেশ, পাইলেন সবিশেষ,তাহে তাঁর হৈল সুস্থ চিত।।আপনি সে সব কথা, অবশ্য আছেন জ্ঞাতা,তবে কেন শোকে দেহ মতি।জীবন মরণ যোগ, সুখ দুঃখে ভোগাভোগ,কর্ম্মফলে হয় সে সঙ্গতি।।সহজে দুর্ম্মতি জন, রাজা হয়ে দুর্য্যোধন,সাধুজন বচন না শুনে।দুঃশাসন মহাবীর, শকুনি পাপেতে ধীর,বুদ্ধি দিল কৌরব নন্দনে।।কর্ণ বলিলেন যত, তাহে মাত্র অভিরত,কার বোল না শুনিল কাণে।ভীষ্মদেব বুঝাইল, কর্ণে তাহা না শুনিল,গান্ধাবীর বাক্য নাহি শুনে।।গুরুজন বলে যত. উপহাস করে তত,এ জনের কেমনে কল্যাণ।দ্রোণ কৃপ বিধিমতে, বুঝাইল বিদ্যুরেতে,প্রবোধ দিলেন ভৃগুরাম।।পান্ডবে মাগিল গ্রাম, আসিলেন ঘনশ্রাম,নীতি বুঝাইল নারায়ণ।অসম্মত দুর্য্যেধন, কেবল মাগেন রণ,কেন নাহি ত্যজিবে জীবন।।না শুনে ব্যাসের বাণী, অহঙ্কার মনে গণি,ধর্ম্মপত্র পরিহরি দূরে।আপনি মধ্যস্থ হৈলা, কত তারে বুঝাইলা,দৈবে যাবে শমনের পুরে।।পাশা খেলাইল যবে, শকুনি কহিল তবে,সর্ব্ব ধন হারিল পান্ডব।কিংজিতং কিজিতং বলি, হইলা যে কুতুহলী,কেন তাহা না ভাব কৌরব।।ক্ষিতির করিয়া ক্ষয়, শত্রুর বাড়ালে জয়,পুত্রগণ মরিল অকালে।তুমি কেন শোক কর, আমার বচন ধর,কি কারণ লোটাও ভূতলে।জানিয়া করিলা পাপ, শেষে পাও মনস্তাপ,অনুশোচ না কর তাহাতে।আপনার কর্ম্ম যত, ফল হয় অনুগত,বিজ্ঞজন মুগ্ধ হন তাতে।।জ্বলন্ত অনশ কেন, বসনে বাঁধিয়া আন,সে অগ্নিতে দহিবে শরীর।এ সব আপন দোষে, কহি রাজা তব পাশে,তাহে দোষ নাহিক বিধির।।পুত্র তব মহাবলী, সুহৃদ বচন ঠেলি,রাজ্যলোভ করিল দুর্জ্জয়।।পূর্ব্বাপর না ভাবিল, অগ্নিতে পতঙ্গ হৈল,তাহাতে হইল বংশক্ষয়।।সঞ্জয়ের বাক্য শুনি, স্তব্ধ হৈয়া নৃপমনি,অতি দীর্ঘ ছাড়িল নিশ্বাস।বিদুর পন্ডিত গুরু, উপদেশে কল্পতরু,নৃপতিরে করিল আশ্বাস।।উঠ উঠ মহারাজ, সকলি বিধির কাজ,সবার মরণ মাত্র গতি।যত দিন নিয়ত যার, সেই দিন মৃত্যু তার,তাহা নাহি ঘুচে মহামতি।।মহা মহা বীর মরে, নিত্য যায় যমঘরে,মৃত্যু বশ সব চরাচর।সকল সংহারে কাল, নাহি তার কালাকাল,অনুশোচ করহ অন্তর।।পূর্ব্ব কথা মনে কর, শুন ওহে নৃপবর,শকুনি খেলিল যবে পাশা।সেই অনর্থের মূল, বিনাশিল কুরুকুল,হাসি তুমি করিলা জিজ্ঞাসা।।পাসরিলা সেই বানী, শুন অন্ধ নৃপমনি,সে কথা নাহিক তব মনে।এখনি ভাবহ শোক, নিন্দিবেক সর্ব্বলোক,এই দশা হইল এক্ষণে।।ক্ষত্রিয় নিধর করি, সম্মূখ সমরে মরি,সবে গেল বৈকুন্ঠ ভবনে।এখন ত্যজহ শোক, আমার বচন রাখ,দুঃখ ভাব কিসের কারণে।।জীর্ণ বস্ত্র পরিহরি, যেন নব বস্ত্র পরি,তেমতি শরীর পরিবর্ত্ত।কেহ মরে গর্ভবাসে, কেহ মরে দশমাসে,ক্ষিতিস্পর্শে হইয়া নিবর্ত্ত ।।কেহ মরে বাল্যকালে, সকলি কর্ম্মের ফলে,কেহ কারে মারিতে না পারে।আমার বচন শুনি, শান্ত হও নৃপমণি,শোক আর না কর অন্তরে।।বিদুরের বাক্য শুনি, স্তব্ধ হইল নৃপমনি,কিন্তু শোকে দহয়ে শরীর।না শুনে বচন হিত, ধরিতে না পারে চিত,ধৈর্য্যাকে ধরিতে নারে বীর।।তবে আসি ব্যাস মুনি, বিদুর সঞ্জয় গুনী,আর যত সুহৃদ সকলে।শীতল সলিল সেচি, তালের বিউনী বিচি,চেতন করান মহীপালে।।সন্বিত পাইয়া পুনঃ শোক করি চতুগুণ,কহে ধিক্ মনুষ্য জনমে।পাই এত দুঃখ সব, পুত্রশোকে পরাভব,ছার তনু নাহি যার কেনে।।শত পুত্র বিনাশিল, একজন না রহিল,শ্রাদ্ধ শান্তি করিতে তপূণ।অনিত্য এ সব দেহ, চিরজীবী নহে কেহ,প্রাণ রাখি কিসের কারণ।।ধৃতরাষ্ট্র নরপতি, বিলাপ করয়ে অতি,পুত্রশোক সহিতে না পারে।ভাবয়ে বান্ধব শোক, ক্ষণে ভাবে পরলোক,নির্ণয় করিতে কিছু নারে।।হাহাপুত্র দুর্য্যোধন, কোথা গেল দুঃশাসন,দুর্ম্মূখ প্রভৃতি শত পুত্র।ধরিতে না পারি হিয়া, লহ মোরে উদ্ধারিয়া,শোকেতে দহিছে মোর গাত্র।।ভারতের পুন্যকথা, শুনিলে ঘুচয়ে ব্যথা,কলির কলুষ হয় নাশ।গোবিন্দ চরণে মন, সমর্পিয়া অনুক্ষণ,বিরচিল কাশীরাম দাস।।০৩. ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি ব্যাসের হিতোপদেশবিষাদ করয়ে নরপতি পুত্রশোকে।রাজারে বেড়িয়া কান্দে যত পুরলোকে।।তবে ব্যাস কহিলেন শুন নৃপবর।গত জীব হেতু তুমি শোক কেন কর।।আর শোক না করিহ গুনহ রাজন।মন দিয়া শুন দুর্য্যোধনের কথন।।একদা গেলাম আমি ব্রাক্ষার সভায়।নারদাদি মুনিগণ আছিল তথায়।।হেনকালে পৃথিবী করিল নিবেদন।পরিত্রাণ আমারে করহ পদ্মাসন।।হরি করিলেন যত দানব সংহার।ক্ষন্দ্রকুলে তাহারা জন্মিল পুনর্ব্বার।।পৃথিবীর বাক্য শুনি দেব প্রজাপতি।আশ্বাস করিয়া তাঁরে কহিল ভারতী।।ধৃতরাষ্ট্র তনয় নৃপতি দুর্য্যোধন।কুরুবংশে জন্মিবে সে বড়ই দুর্জ্জন।।সে তোমার খন্ডাইবে ভার গুরুতর।শুন বসুমতী তুমি আমার উত্তর।।শুনিয়া কাশ্যপী স্ততি অনেক করিলা।যোড়হাত করি পুনঃ কহিতে লাগিলা।।কেমন প্রকারে মোর ঘুচিবেক ভার।কহ পিতামহ তার করিয়া বিস্তার।।ব্রক্ষ্মা কন কুরু পান্ডু ভাই দুইজন।চন্দ্রবংশে উৎপন্ন হইবে বিচক্ষণ।।পান্ডুর তনয় পঞ্চজন তুল্য দেব।ধর্ম্ম ভীম অর্জ্জুন নকুল সহদেব।।ধৃতরাষ্ট্র নৃপতির হইবে নন্দন।দুর্য্যোধন দুঃশাসন আদি শত জন।।রাজ্য হেতু বিবাদ হইবে দুইজনে।পান্ডুর নন্দন যুধিষ্ঠির রাজা সনে।।আপনি সহায় কৃষ্ণ হবেন তাঁহার।কুরুক্ষেত্রে হইবেক ঘোর মহামার।।কুরুক্ষেত্রে ক্ষভ্র যত সংহার হইবে।শুন বসুমতী তব ভার না থাকিবে।।যাহ যাহ বসুমতী আপনার স্থান।দুর্য্যেধন হেতু তব হবে পরিত্রাণ।।এত বলি পৃথিবীরে করিল বিদায়।এই সব কারণ যে জানিনু তথায়।।সেই দুর্য্যোধন হৈল তোমার তনয়।কলি প্রবেশের অগ্রে শুন মহাশয়।।মহামহীপাল হৈল মহা ক্রোধশালী।গান্ধারী উদরে জন্মে সাক্ষাৎ যে কলি।।সবে হৈল মহা ক্রোধশালী।গান্ধারী উদরে জন্মে সাক্ষাৎ যে কলি।।সবে হৈল দুর্নিবার শত সহোদর।কর্ণ হৈল সখা তার শকুনি বর্ব্বর।।ক্ষন্ত্রিয় বিনাশ হেতু অনর্থ অঙ্কুর।শুন মহারাজ সব শোক কার দূর।।কৌরব পান্ডবে হৈল ঘোরতর রণ।কুরুক্ষেত্রে সর্ব্বজন হইল নিধন।।এই পূর্ব্ব কথা আমি জানাই তোমারে।এত বলি ব্যাসদেব বুঝান তাঁহারে।।হেনকালে সঞ্জয় করিয়া যোড়হাত।করি এক নিবেদন শুন নরনাথ।।নানাদেশ হইতে অনেক নরপতি।অভ্যর্থিয়া আনিলেক তোমার সন্ততি।।সবান্ধদে কুরুক্ষেত্রে হইল নিধন।তা সবার প্রেতকর্ম্ম করহ রাজন।।সঞ্জয়ের বাক্যে রাজা নিশ্বাস ছাড়িল।মৃতবৎ হয়ে রাজা ধরণী পড়িল।।বিস্তর প্রবোধ তারে দেয় বার বার।রথসজ্জা করে কুরুক্ষেত্রে যাইবার।।ধৃতরাষ্ট্র আপনি কহিল বিদুরেরে।স্ত্রীগণে আনহ শীঘ্র গিয়া অন্তঃপুরে।।এত বলি ধৃতরাষ্ট্র রথেতে চাপিল।স্ত্রীগণে আনিতে তব বিদ্যুর চলিল।।বিদ্যুর বলিল শুন গান্ধার নন্দিনী।কুরুক্ষেত্রে যাত্রা করিলেন নৃপমণি।।ভীষ্ম দ্রোণাচার্য্য আর কর্ণ মহাজন।শত ভাই দুর্য্যোধন ত্যজিল জীবন।।একাদশ অক্ষৌহিনী ত্যজিল পরাণ।প্রেতকর্ম্ম হেতু রাজা করিল প্রস্থান।।পুত্রশোক শুনি দেবী হইল বিমনা।অন্তঃপুরে কান্দি উঠে ছিল যত জনা।।অন্দরে উঠিল ক্রন্দনের কোলাহল।হার ছিঁড়ে বস্ত্র ছিঁড়ে লোটায় ভুতল।।কপালে কঙ্কণাঘাত শুনি গন্ডগোল।প্রলয়কালেতে যেন জলের কল্লোল।।বিদুর বলেন ইহা উচিত না হয়।কুরুক্ষেত্রে চল সবে রাজার আজ্ঞায়।।বিদুরের বাক্য শুনি গান্ধারী তখন।বধূগণ সঙ্গে করে রথ আরোহণ।।ঘরে ঘরে মহাশব্দ উঠিল ক্রন্দন।বাল বৃদ্ধ তরুণ কান্দয়ে সর্ব্বজন।।দেবগণ নাহি দেখে যে সব সুন্দরী।রণস্থলে যায় তারা একবস্ত্র পরি।।সাধারণ জন সব দেখয়ে সবাকে।এড়াইতে নারে কেহ দৈবের বিপাকে।।সমান সকল দিন নাহি যায় কার।দেখিয়া শুনিয়া লোক না করে বিচার।।হ্রাস বৃদ্ধি কৌতুকাদি সৃজে নারয়ণ।দেখিয়া না মানে তাহা অতি মূঢ়জন।।একবস্ত্র পরিল রাজার পাটেশ্বরী।পুত্রগণ শোকে মুক্ত হইল কবরী।।শত শত দাসীগণ যার সেবা করে।সে জন পড়িয়া কান্দে ভূমির উপরে।।গলাগলি করি কান্দে যতেক সতিনী।আহা মরি কোথা গেল কুরু নৃপমণি।।কেহ দুগ্ধপোষ্য শিশু ফেলাইয়া দূরে।হা নাথ হা নাথ বলি কাঁদে উচ্চৈঃস্বরে।।মুক্তকেশে কান্দে কেহ শ্বশুরের আগে।যোড়হাত করি দেহ স্বামীদান মাগে।।কেহ বলে রাজ্য দেহ পান্ডব নন্দনে।কেহ বলে কৃষ্ণ আসে তোমা বিদ্যমানে।।কেহ বলে মিথ্যা কথা নাহিক সংগ্রাম।কৌরব পান্ডবে প্রীতি হল পরিণাম।।মিথ্যা কথা কেহ কহিল রাজার গোচরে।কুশলে আছয়ে কুরু সংগ্রাম ভিতরে।।এত বলি নারীগণে করয়ে করুণা।তা শুনি রাজার মনে লাগিল বেদনা।।চারিভিতে বেড়িয়া কাঁদে ঘত নারী।নগরে বাহির হৈল কুরু অধিকারী।।গান্ধারী চাপিল রথে যত বধূ সঙ্গে।শোকাকুল সকলেতে বস্ত্র নাহি অঙ্গে।।বিচার নাহিক আর শোকে অচেতনা।হতপতি নারীগণ হইল উন্মনা।।পরিল বসন কেহ করিয়া যতন।অঙ্গেতে তুলিয়া দিল নানা আভরণ।।চরণে নূপুর পরে দোসারী মুকুতা।সিন্দূর পরিল কেহ করি পূর্ণ সিথাঁ।।চন্দনের বিন্দু তার চারিদিকে দিল।সুন্দর অলকা তাহে বেষ্টিত করিল।।তাম্বুল ভক্ষণ করি নানা গীত গায়।চরণে ণূপুর কেহ করি নাচিয়া বেড়ায়।।কেহ অসিচর্ম্ম করে বীরবেশ ধরি।ধেয়ে যায় কুরুক্ষেত্রে প্রতি অনুসরি।।মুক্তকেশা আম্রশাখা লয়ে কত জনা।কেহ পথে পড়ে, কেহ শোকে অচেতনা।।অনেক চলিল নারী পতি পুত্র শোকে।প্রবোধ করিতে তারে নারে কোন লোকে।।হস্তিনা হইল শূণ্য কেহ না রহিল।রাজার সঙ্গেতে রাজবধূগণ চলিল।।প্রথম বয়সে কেহ দেখিতে উত্তমা।মুক্তকেশে খায় যেন সোণার প্রতিমা।।হেনমতে কুরুক্ষেত্রে যায় নরপতি।সঙ্গেতে নাহিক রথ সৈন্য ঘোড়া হাতী।।যুবতী সমূহ সঙ্গে চলিল রাজন।শূন্য হৈতে কৌতুক দেখয়ে দেবগণ।।শোকাকুল হয়ে পথে যায় নরপতি।হেনকালে অশ্বথামা কৃপ মহামতি।।কৃতবর্ম্মা সহ পথে হৈল দরশন।নিরখিয়া রাজাকে আইল তিনজন।।পরিচয় নৃপতিকে দিল আপনার।ধৃতরাষ্ট্র বলে তবে কহ সমাচার।।কৃতাঞ্জলি হয়ে বলে সেই তিনজন।অবধানে শুন রাজা সব বিবরণ।।মুখে না আইসে বাক্য কহিতে ডরাই।কহিবার যোগ্য নহে মনে দুঃখ পাই।।শুন কহি মহারাজ সব সমাচার।কুরুক্ষেত্রে হৈল যত ক্ষত্রিয় সংহার।।একাদশ অক্ষৌহিনী সকলি মরিল।অশ্বথামা কৃতবর্ম্মা কৃপ এড়াইল।।দৈবে না হইল তিন জনার মরণ।শত ভাই সহিত পড়িল দুর্য্যোধন।।করিল দুষ্কর কর্ম্ম ভীম দুরাচার।একেলা মারিল তব শতেক কুমার।।গুনহ গান্ধারী দেবী করি নিবেদন।ভীম করিলেক কুরুবংশের নিধন।।যত কর্ম্ম করিলেক দুর্য্যোধন বীর।যত কর্ম্ম করিলেক দুঃশাসন ধীর।।শতপুত্র তোমার করিল যত কর্ম্ম।যেমন আছিল মাতা ক্ষত্রিয়ের ধর্ম্ম্।।পরাক্রম করিয়া পড়িল ঘোর রণে।সুরপুরী গেল সবে চাপিয়া বিমানে।।শোক পরিহর দেবি না কর বিলাপ।দুর্য্যোধন প্রাণপনে করিল প্রতাপ।।অন্যায় করিয়া ভীম ভাঙ্গিলেক উরু।সেই ক্রোধে করিলাম মোরা কর্ম্ম গুরু।।সবান্ধবে পাঞ্চালেরে করিনু সংহার।বধিলাম দ্রৌপদীর পঞ্চটী কুমার।।পান্ডবের রণে অবশেষে সপ্তজন।শ্রীকৃষ্ণ সাত্যকি পঞ্চ পান্ডুর নন্দন।।শুনহ সকল কথা না করিহ ভয়।অবিলম্বে কুরুক্ষেত্রে চল মহাশয়।।আজ্ঞা দেহ আমরা আপন স্থানে যাই।কুরুক্ষেত্রে আছয়ে পান্ডব পঞ্চভাই।।এত বলি রাজার লইল অনুমতি।প্রদক্ষিণ করিয়া চলিল শীঘ্রগতি।।হস্তিনাপুরেতে গেল কৃপ মহাশয়।কৃতবর্ম্মা চলি গেল আপন আলয়।।ব্যাসের আশ্রমে গেল দ্রোণের নন্দন।কুরুক্ষেত্রে গেল হেথা অন্ধক রাজনে।।ধৃতরাষ্ট্র আইল শুনিয়া পঞ্চভাই।শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে যুক্তি করেন সবাই।।যুধিষ্ঠির বলিলেন শুন যদুনাথ।কুরুক্ষেত্রে আইলেন দেখ জ্যেষ্ঠতাত।।কিমতে তাঁহাতে আমি মুখ দেখাইব।জিজ্ঞাসিলে সমাচার কি কথা কহিব।।গান্ধারীর ক্রোধে আর নাহিক নিস্তার।কি উপায় করি কৃষ্ণ বল এইবার।।সতীর অবার্থ বাক্য শুন নারায়ন।আজি প্রাণ হারাইব ভাই পঞ্চজন।।বৃথা যুদ্ধ করিলাম বৃথা পরাক্রম।বৃথা গুরুহত্যা আর জ্ঞাতির নিধন।।বৃথা বধিলাম পুত্র সৃহৃদ বান্ধব।বৃথা যুদ্ধ করিলাম শুন শ্রীমাধব।।আজি গান্ধারীর ক্রোধে নাহিক নিস্তার।অপান্ডব হইবেক সকল সংসার।।শুন কৃষ্ণ তোমারে করি নিবেদন।প্রাণ লয়ে পলাউক ভাই চারিজন।।ভীমার্জ্জুন সহদেব নকুল কুমার।পলাইয়া প্রাণ রক্ষা করুক এবার।।আমি যাব ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারী গোচরে।শাপ দিয়া ভস্মরাশি করুন আমারে।।আমার জীবনে আর নাহি প্রয়োজন।লোকের সাক্ষাতে নাহি দেখাব বদন।।যুধিষ্ঠির বচন শুনিয়া চক্রপানি।বলিলেন তাঁরে তবে সুমধুর বাণী।।শুন রাজা ভয় তুমি কর কি কারণে।রাখিতে মারিতে কেহ নাহি আমা বিনে।।সবাকার আত্মা আমি পুরুষ প্রধান।আমা বিনা রাখিতে মারিতে নারে আন।।সবে মেলি চলি যাব নৃপতির স্থানে।দূর কর ভয় তুমি আমার বচনে।।গান্ধারী না দিবে শাপ আমি ইহা জানি।হরষিত চিত্তে তুমি চল নৃপমণি।।কৃষ্ণের বচন শুনি রাজা যুধিষ্ঠির।হাসিয়া বলেন তবে শুন যদুবীর।।তোমার আজ্ঞাতে তবে সবে চলি যাব।শীঘ্রগতি চলহ বিলম্ব না করিব।।অনুমতি দিল কৃষ্ণ রাজার বচনে।হরষিত চলে সবে রাজ সম্ভাষণে।।পঞ্চ ভাই কৃষ্ণ সহ যান দ্রুতগতি।রাজার চরণে সবে করিল প্রণতি।।আমি যুধিষ্ঠির বলি পরিচয় দিতে।রথ হৈতে ধৃতরাষ্ট্র নামিল ভূমিতে।।মহাভারতের কথা অমৃত সমান।কাশীরাম দাস কহে শুনে পুন্যবান।।০৪. ধৃতরাষ্ট্র কর্ত্তৃক লৌহ-ভীম চূর্ণ করণসঞ্জয় রাজারে ধরি বসায় আসনে।বসিলেন পঞ্চভাই রাজ বিদ্যমানে।।সাত্যকি সহিত কৃষ্ণ বসেন আপনি।হেনকালে বলে ধৃতরাষ্ট্র নৃপমণি।।কোথা ভীম আইসহ দিব আলিঙ্গন।তুমি মম ঘুচাইলে পিন্ড প্রয়োজন।।ঊরু ভাঙ্গি মারিলেক নৃপতি দুর্য্যোধনে।একে একে সংহারিলে শতেক নন্দনে।।শুনিয়া আমার হৈল হরিষ বিষাদ।এস আলিঙ্গন দিয়া করিব প্রসাদ।।এতেক বলিয়া রাজা বাড়াইল হাত।নৃপতির অভিপ্রায় জানি রমানাথ।।আছিল লোহার ভীম দিলেন গোচরে।ধৃতরাষ্ট্র নৃপতির আনন্দ অন্তরে।।ধরিয়া লোহার ভীম চাপিল কোলেতে।অযুত হস্তীর বল রাজার দেহেতে।।ভাঙ্গিল লোহার ভীম মহাশব্দ শুনি।চুর্ণ হয়ে পৃথিবীতে পড়িল তখনি।।কপটে কান্দয়ে রাজা হৃদয়ে উল্লাস।মনেতে জানিল ভীম হইল বিনাশ।।পুত্রশোকে নরপতি না শুনয়ে কাণে।ভীম মরিলেক বলি হরষিত মনে।।নৃপতির দশা তবে দেখ নারায়ণ।হাসিয়া বলেন সুধা মধুর বচন।।শুন বৃদ্ধ নরপতি না কান্দহ আর।কুশলে আছেন ভীম পান্ডুর কুমার।।তোমার জন্মিবে ক্রোধ ইহা অনুমাণি।গঠিত লোহার ভীম দিনু নৃপমণি।।বিষাদ না কর তুমি শান্ত কর মন।ভীমেরে মারিলে নাহি পাবে দুর্য্যোধন।।আর কেন অপযশ রাখিবা ঘুষিতে।শুদ্ধচিত্ত হও রাজা জানাই তোমাতে।।আপনি কহিলা পূর্ব্বে শুনহ রাজন।আপন তনয় যেন পান্ডুর তেমন।।তবে কেন হেন কর্ম্ম করিলা রাজন।বুঝিলাম খল কভু নহে শুদ্ধ মন।।কোন অংশে পান্ডবের নাহি অপরাধ।আপনি করিলা তুমি নিজ কর্ম্ম বাদ।।ভীমে বিষ খাওয়াল রাজা দুর্য্যোধন।জতুগৃহে রাখিলেন পান্ডুর নন্দন।।তবে শকুনিরে আজ্ঞা দিল নরপতি।পাশা খেলাইল যুধিষ্ঠিরে সংহতি।।প্রতিজ্ঞা করিয়া ধর্ম্ম সর্ব্বস্ব হারিল।দুঃশাসন দ্রৌপদীর চুলেতে ধরিল।।আপনি অনীতি করিলেক দুর্য্যোধন।জয়দ্রথে দিয়া করে দ্রৌপদী হরণ।।তথাপিও পান্ডবের ক্রোধ না জন্মিল।তবে দুর্য্যোধন দুর্ব্বাসারে পাঠাইল।।আপনি সকল জান তুমি মহাশয়।কিছু দোষ নাহি করে পান্ডুর তনয়।।অন্যায় করিল যুদ্ধ তোমার নন্দন।অভিমন্যু বেড়িয়া মারিল সপ্তজন।।পশ্চাতে পান্ডব পরাক্রম প্রকাশিল।প্রতিজ্ঞা কারণে সর্ব্ব কৌরবে মারিল।।বেদশাস্ত্র জান তুমি আগম পুরাণ।সজ্ঞান নাহিক কেহ তোমার সমান।।আপনি জানহ পান্ডবের যত দোষ।তবে কি লাগিয়া কর এ সব আক্রোশ।।ভীষ্ম দ্রোণ বিদ্যুর যতেক বুঝাইল।দুষ্টমতি দুর্য্যোধন বাক্য না শুনিল।।অধিক সকল গুণে হয় পঞ্চ ভাই।আপনি সকল জান কি হেতু বুঝাই।।জানিয়া না জান তুমি সকল উহার।কি কারণে নাহি বুঝ উচিত বিচার।।কেবল পুত্রেরে চাহি কর অপকর্ম্ম।ভীমেরে মারিয়া কেন বিনাশিবে ধর্ম্ম ।।কি দোষ করিল ভীম বলহ রাজন।না বুঝিয়া কেন কর হেন আচরণ।।কদাচিত পান্ডবেরে ক্রোধ না করিহ।অধর্ম্ম হইবে মম বচন পালহ।।কৃষ্ণের বচন শুনি অন্ধ নরপতি।পান্ডবে আলিঙ্গিল হইয়া হৃষ্টমতি।।গান্ধারীর মন আছে শাপিব পান্ডবে।হেনকালে বলিলেন বাসুদেব তবে।।শুন দেবী পাসরিলে তুমি পূর্ব্বকথা।সতীর বচন কভু না হয় অন্যথা।।যাত্রাকালে তোমা জিজ্ঞাসিল দুর্য্যোধন।কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধেতে জিনিবে কোনজন।।পান্ডবের সঙ্গে যাই যুদ্ধ করিবারে।জয় পরাজয় কার বলহ আমারে।।তবে সত্য কথা তুমি কহিলে তখন।যথা ধর্ম্ম তথা জয় শুন দুর্য্যোধন।।তোমার বচন যদি অন্যথা হইবে।তবে কেন চন্দ্র সূর্য্য আকাশে রহিবে।।সে সব বচন সত্য মম মনে লয়।অতএব যুদ্ধ জিনে পান্ডুর তনয়।।ত্যজহ সকল ক্রোধ আমার বচনে।পুত্র ভাব কর পঞ্চ পান্ডুর নন্দনে।।এত যদি বাসুদেব কহিলেন বাণী।যোড়হাতে বলিলেন অন্ধ রাজরানী।।যত কিছু মহাশয় বলিলে বচন।বেদের সমান তাহা করিনু গ্রহন।।কিন্তু হৃদয়ের তাপ সহিতে না পারি।একশত পুত্র মোর গেল যমপুরী।।ত্যাজিলাম সব ক্রোধ তোমার বচনে।পুত্র সম স্নেহ হৈল পান্ডুর নন্দনে।।০৫. গান্ধারী প্রভৃতি স্ত্রীগণের যুদ্ধস্থলে গমনও স্ব স্ব পতি পুত্রের মৃতদেহ দর্শনে খেদমহাভয় উপজিল দেখি রণস্থল।শকুনি গৃধিনী শিবা করে কোলাহল।।হাতে মুন্ড করিয়া নাচয়ে ভূতগণ।কুক্কুর করিছে মাংস শোণিত ভক্ষণ।।রক্তের কর্দ্দমে শীঘ্র চলিতে না পারে।শোকাকুলা নারীগণ যায় ধীরে ধীরে।।কেহ কেহ না পাইয়া পতি দরশন।ভূমিতে পড়িয়া তারা করয়ে ক্রন্দন।।ভ্রময়ে সমরস্থলে যত করুনারী।শিবা শ্বান পক্ষিগণে ভয় নাহি করি।।অনেক যতনে কেহ নিজ পতি পায়।স্কন্ধে মুন্ড যোড়া দিতে মহাব্যগ্র হয়।।দুই হস্তে ধরে কেহ পতির চরণ।বিলাপয়ে মুখে মুখ করিয়া মিলন।।পাসরিলে পূর্ব্বকার প্রেমরস যত।হাস্য পরিহাস তাহা স্মরাইব কত।।সমর করিতে গেলে কেমন কুক্ষণে।পুনঃ না হইল দেখা অভাগিনী সনে।।হেনমতে পতি লয়ে অনেক সুন্দরী।বিলাপ করয়ে সবে নানামত করি।।তা দেখি গান্ধারী প্রাণ ধরিতে না পারে।পতিশোকে বধূগণ প্রাণ ধরিতে না পারে।পতিশোকে বধূগণ কান্দে উচ্চৈঃস্বরে।।রণভূমি দেখি দেবী অতি ভয়ঙ্কর।কপালে কঙ্কণ মারি কান্দিল বিস্তর।।হেন কেহ নাহি তথা প্রবোধ করিতে।সবে শোকে অচেতন পড়িয়া ভূমিতে।।কেবা কোথা পড়িয়াছে নাহিক উদ্দেশ।রণভূমি দেখি দেবী লাগে ভরাবেশ।।মড়ার উপরে মড়া লেখা নাহি তার।গান্ধারী দেখিয়া চিত্তে লাগে চমৎকার।।গজবাজী পড়িয়াছে রথ বহুতর।নানা অলঙ্কার বস্ত্র শস্ত্র মনোহর।।মাথার মুকুট পড়িয়াছে রণভূমে।মকর কুন্ডল পড়িয়াছে নানাক্রমে।।ধ্বজছত্র চামর পড়েছে রণস্থলে।ডাকিনী যোগিনীগণ করে নানা কেলী।।স্বামী পুত্র পৌত্র আর বন্ধু সহোদর।পড়িয়া আছয়ে যত মৃত কলেবর।।দুর্য্যোধন অন্বেষণে বুলয়ে গান্ধারী।কতদূরে দেখে হত কুরু অধিকারী।।ধূলায় পড়িয়া আছে রাজা দুর্য্যোধন।গান্ধারী দেখিল সঙ্গে লৈয়া বধূগণ।।পুনঃ দরশনে দেবী অজ্ঞান হইল।গান্ধারী মরিল বলি সকলে ভাবিল।।পঞ্চ পান্ডবেতে তাঁরে তুলিয়া ধরিল।শ্রীকৃষ্ণ সাত্যকি আদি বহু প্রবোধিল।।সন্বিত পাইয়া তবে গান্ধার তনয়া।চাহিয়া কৃষ্ণেরে বলে শোকাকুল হৈয়া।।দেখ কৃষ্ণ পড়িয়াছে রাজা দুর্য্যোধন।সঙ্গেতে নাহিক কেন কর্ণ দুঃশাসন।।শকুনি সঙ্গেতে কেন না দেখি রাজার।কোথা ভীষ্ম মহাশয় শান্তনুকুমার।।কোথঅ দ্রোণাচার্য্য কোথা কৃপ মহাশয়।একেলা পড়িয়া কেন আমার তনয়।।কোথা সে কুন্ডল কোথা মণি মুক্তাস্রজ।কোথা গেল হস্তী ঘোড়া কোথা বথধ্বজ।।একাদশ অক্ষৌহিণী যার সঙ্গে যায়।হেন রাজা দুয্যোর্ধন ধূলাতে লুটায়।।সুবর্ণের খাটে যার সতত শয়ন।হেন তনু ধূলার উপরে নারায়ন।।জাতি যূতী পুষ্প আর চাঁপা নাগেশ্বর।বকুল মালতী আর মল্লিকা সুন্দর।।এ সকল পুষ্পে পুত্র থাকিতে শুইয়া।হেন তনু লোটে ভুমে দেখহ চাহিয়া।।অগুরু চন্দন গন্ধ কুঙ্কুম কস্তরী।লেপন করিতে সদা অঙ্গের উপরি।।শোণিতে সে তনু আজি হইল শোভন।আহা মরি কোথা গেল রাজা দুর্য্যোধন।ত্যজহ আলস্য কেন না দেহ উত্তর।যুদ্ধ হেতু তোমারে ডাকিছে বৃকোদর।।উঠ পুত্র ত্যজ নিদ্রা অস্ত্র লহ হাতে।গদাযুদ্ধ কর গিয়া ভীমের সহিতে।।কৃষ্ণার্জ্জুন ডাকিছেন যুদ্ধের কারণ।প্রত্যুত্তর নাহি কেন দেহ দুর্য্যোধন।।এত বলি গান্ধারী হইল অচেতন।প্রিয়ভাষে কৃষ্ণচন্দ্র করেন সান্ত্বন।।শোক না করিও দেবি শুন হিতবানী।সকল দৈবের খেলা জানহ আপনি।।দেব দ্বিজ গুরু নিন্দা এ সব কুকর্ম্ম।বেদে বুঝাইল ইহা না করিলে ধর্ম্ম্।।দুষ্কর্ম্ম দুঃসহ ত্যজি থাকিলে সুপথে।ইহা সুখভোগী অন্তে যায় যে স্বর্গেতে।।না জানিয়া কুকর্ম্ম করয়ে যেই জন।পরিনামে দুঃখ পায় বেদের বচন।।অহঙ্কারে অধর্ম্ম করয়ে নিরন্তর।অবশেষে কর্ম্ম তার হয়ত দুষ্কর।।না শুনে সুজন বাক্য মত্ত অহঙ্কারে।অবশেষে সেইজন যায় ছারেখারে।।কিন্তু এ সকল ঘটে নিজ কর্ম্মগুণে।শোক দূর কর দেবি কান্দ কি কারণে।।শুভাশুভ কর্ম্ম যত বিধির ঘটন।ভোগ বিনা ক্ষয় নহে শাস্ত্রের লিখন।।কালে আসি জন্মে পাপী কালেতেই মরে।কালবশ এই সব জানাই তোমারে।।না কর দেবনা তুমি শুন নৃপজায়া।বুঝিতে না পারে কেহ বিধাতার মায়া।।বিজয় পান্ডব কথা অমৃত লহরী।শুনিলে অধর্ম্ম খন্ডে পরলোকে তরি।।কিছুমাত্র বলি আমি রচিয়া পয়ার।অবহেলে শুনে সেই তরয়ে সংসার।।কাশীরাম দাসের সদাই এই মন।নিরবধি রচে মহাভারত কথন।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon