৭৬. অস্ত্রশিক্ষা করিয়া অর্জ্জুনেরপুনর্ব্বার মর্ত্ত্যে আগমনকার্য্যসিদ্ধি জানি তবে সারথি মাতলি।বায়ুবেগে রথ চালাইল মহাবলী।।নানা কাব্য কথায় হরিষ দুই জন।মুহূর্ত্তেকে গেল তবে ইন্দ্রের ভুবন।।অর্জ্জুনের আগমনে ইন্দ্রের আনন্দ।সঙ্গেতে করিয়া যত দেবতার বৃন্দ।।আগুসরি নিজে ইন্দ্র যান কত পথ।হেনকালে উত্তরিল অর্জ্জুনের রথ।।নিকটে দেখিয়া পার্থ শচীর ঈশ্বরে।রথ হৈতে ভূমিতলে নামিয়া সত্বরে।।প্রণাম করিলা পার্থ ইন্দ্রের চরণে।সম্ভাষ করেন সবে যত দেবগণে।।দেব পুনন্দর আদি হরিষে বিভোল।প্রেমাবেশে কহিলেন পার্থে দিয়া কোল।।ধন্য ধন্য পুত্র তুমি, ধন্য তব শিক্ষা।ধন্য তারে, যেই জন তোমা দিল দীক্ষা।।জানিনু তোমাতে ধন্য ভোজরাজ সুতা।তোমা হেন পুত্র হেতু আমি ধন্য পিতা।।তোমা হৈতে নাশ হৈল আমার অরিষ্ট।এত দিনে পরিপূর্ণ হইল অভীষ্ট।।এত বলি কুতূহলী দেব পুরন্দর।দিলেন যুগল তূণ আর দিব্য শর।।মস্তকে কিরীট দিল কর্ণেতে কুণ্ডল।দশ নাম নিরূপণ করে আখণ্ডল।।আছিল অর্জ্জুন নাম দ্বিতীয় ফাল্গুনি।নক্ষত্রানুসারে নাম রাখিল জননী।।খাণ্ডব দহিলে যবে আমা সবে জিনি।সেইকালে জিষ্ণু নাম দিয়াছি আপনি।।আমা হৈতে কিরীট পাইলে সুশোভন।এই হেতু কিরীটি কহিবে সর্ব্বজন।।করিছে রথের শোভা শ্বেত চারি হয়।লোকে শ্বেতবাহন বলিয়া তোমা কয়।।দিবেন বীভৎস নাম গোবিন্দ আপনি।যথায় যাহ তথা আইস যুদ্ধ জিনি।।এই হেতু তব নাম হইল বিজয়।বর্ণভেদে সবে যেন কৃষ্ণ নাম কয়।।উভয় হস্তেতে তব সমান সন্ধান।সব্যসাচী নাম তেঁই করি অনুমান।।ধনঞ্জয় নাম পেলে ধনপতি জিনি।যোগের সাধন এই সর্ব্বলোকে জানি।।কাম্য করি দশ নাম নরে যদি জপে।অশুভ বিনাশ হয়, তরে সর্ব্ব পাপে।।হেনমতে আনন্দে রহিল সর্ব্বজন।প্রভাতে উঠিয়া তবে সহস্রলোচন।।মাতলিরে ডাকি আজ্ঞা দিল মহামতি।সুসজ্জ করিয়া রথ আন শীঘ্রগতি।।আজ্ঞামাত্র আনিল সারথি বিচক্ষণ।বিচিত্র সাজন, গতি নর্ত্তক খঞ্জন।।অমর ঈশ্বর তবে অর্জ্জুনে ডাকিল।মধুর সম্ভাষ করি কহিতে লাগিল।।শুন পুত্র বিলম্বেতে নাহি প্রয়োজন।শীঘ্রগতি ভেট গিয়া ধর্ম্মের নন্দন।।নানাবিধ বিভূষণে করি পুরষ্কার।কোলে করি চুম্বিলেন পার্থে বারে বার।।অর্জ্জুন পড়িল তবে ইন্দ্রের চরণে।প্রণাম করিয়া দাণ্ডাইল বিধ্যমানে।।করযোড়ে কহে পার্থ সকরুণ ভাষে।তোমার আজ্ঞায় যাই ধর্ম্মরাজ পাশে।।তোমার চরণে মম এই নিবেদন।আপনি জানহ যত কৈল দুষ্টগণ।।তা সবারে দিব আমি সমুচিত ফল।কৃপা করি তুমি পিতা রবে অনুবল।।ইন্দ্র বলে, যা বলিলে বৎস ধনঞ্জয়।যথা তুমি তথা আমি, জানিও নিশ্চয়।।মনের বাসনা পূর্ণ হইবে তোমার।ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠির ধর্ম্ম অবতার।।বসুমতী পতি যোগ্য সেই সে ভাজন।কালেতে উচিত ফল পাবে দুর্য্যোধন।।এতেক শুনিয়া পার্থ হরষিত মন।অমরাবতীতে বাস করে যত জন।।বিদায় সবার কাছে করিয়া গ্রহণ।রথে আরোহিয়া যান পুলকিত মন।।পথেতে কৌতুক নানা কথার আবেশে।কতক্ষণে উপনীত ভারত প্রদেশে।।এইমতে যাইতে মাতলি ধনঞ্জয়।দেখিলেন কত দূরে গিরি হিমালয়।।পরে যথা ধর্ম্ম, গন্ধমাদন পর্ব্বত।মুহূর্ত্তেকে উত্তরিল অর্জ্জুনের রথ।।চিন্তায় ব্যাকুল চিত্ত ধর্ম্ম নৃপবর।অর্জ্জুনে দেখিয়া হৈল প্রফুল্ল অন্তর।।ভূমে নামিলেন পার্থ ত্যজি ইন্দ্র রথ।যুধিষ্ঠির চরণে হৈলেন দণ্ডবৎ।।অর্জ্জুনে করিয়া বক্ষে ধর্ম্মের নন্দন।মহা হরষেতে হইলেন নিমগন।।পূর্ণচন্দ্র শোভা দেখি হর্ষে জলনিধি।দরিদ্র পাইল যেন মহারত্ন নিধি।।ধর্ম্ম আনন্দাশ্রুজলে পার্থ করি স্নান।ভীমের চরণে নতি করেন বিধান।।আলিঙ্গন করি দুই মাদ্রীর নন্দনে।দ্রৌপদীরে তুষিলেন মধুর বচনে।।শুনিয়া লোমশ মুনি ধৌম্য পুরোহিত।শীঘ্রগতি তথা আসি হন উপনীত।।সম্ভ্রমে উঠিয়া পার্থ পড়েন চরণে।প্রশংসিয়া আশীর্ব্বাদ কৈল দুই জনে।।হেনমতে মহানন্দে বসে সর্ব্ব জন।কৌতুক বিধানে যত কথোপকথন।।ভারত-পঙ্কজ-রবি মহামুনি ব্যাস।পাঁচালি প্রবন্ধে রচিলেন তাঁর দাস।।৭৭. যুধিষ্ঠিরের নিকট অর্জ্জুনেরঅস্ত্রলাভ বৃত্তান্ত কথনমধুর সম্ভাষে তবে ধর্ম্ম নরপতি।সবিনয়ে কহিলেন মাতলিব প্রতি।।তোমার সমান বন্ধু নাহি কোন জন।দেবেন্দ্রে কহিবে তুমি মম নিবেদন।।রাজপুত্র হয়ে মম সমান দুঃখেতে।আমার না লয় মনে, আছে পৃথিবীতে।।সহায় সম্পদ মাত্র তাঁহার চরণ।আপনি কহিবে মোর, এই নিবেদন।।মাতলি চলিল তবে ত্বরিত গমনে।ধর্ম্ম কহিছেন পার্থে মধুর বচনে।।কহ ভাই, এবে নিজ শুভ সমাচার।যে কর্ম্ম করিলে, তাহা লোকে চমৎকার।।শুনিতে উৎসুক বড় আছে মম মন।ক্রমে ক্রমে কহ ভাই সব বিবরণ।।শুনিয়া লোমশ ধৌম্য দেন অনুমতি।কহিতে লাগিল পার্থ সবাকার প্রতি।।বিদায় হইয়া গিয়া সবার চরণে।চলিতে উত্তর মুখে প্রবেশিয়া বনে।।তপস্যার অনুসারে হইয়া বিকল।হিমালয়ে দেখিলাম অতি রম্য স্থল।।দেখিয়া বনের শোভা করিতে ভ্রমণ।দিলেন জটিল বেশে ইন্দ্র দরশন।।ছল করি কহিলেন যত ছল কথা।কদাচিত ভাবিত না হইবে সর্ব্বথা।।দিলেন প্রকাশ্যরূপে পাছে পরিচয়।আমি ইন্দ্র, বর মাগ বীর ধনঞ্জয়।।শুনি কহিলাম মম এই নিবেদন।প্রসন্ন হইলে যদি দেহ অস্ত্রগণ।।ইন্দ্র বলিলেন, অস্ত্র পাইবে পশ্চাৎ।তপস্যায় আগে তুষ্ট কর বিশ্বনাথ।।শুনিয়া ইন্দ্রের কথা হরিষ মানসে।আরম্ভ করিনু তপ হরের উদ্দেশে।।পর্ণাহার, ফলাহার, আহার ত্যজিয়া।ঊর্দ্ধপদে অধোমুখে বৎসর ব্যাপিয়া।।হেনমতে তুষ্ট করিলাম আশুতোষ।আসিলেন শিব তবে কিরাতের বেশে।।শিকার শূকর এক ধেয়ে যায় আগে।পশ্চাৎ কিরাত বীর আসিতেছে বেগে।।অসমর্থ দেখি তারে শ্রান্ত কলেবর।ধনু ধরি অস্ত্র মারি বধিনু শূকর।।দেখিয়া কিরাত হৈল ক্রোধপরায়ণ।ছলেতে নিন্দিয়া বহু মাগিলেন রণ।।ক্রোধে করিলাম যত অস্ত্রেতে প্রহার।গিলিল ধনুক সহ সে অস্ত্র আমার।।তবে মল্লযুদ্ধ করিলাম প্রাণপণে।তুষ্ট হয়ে পরিচয় দিলেন সেক্ষণে।।মন্ত্র সহ দিলেন সে অস্ত্র পাশুপত।এ তিন ভুবনে যার অতুল মহত্ত্ব।।বর দিয়া সদানন্দ করিলা গমন।ইন্দ্র জানিলেন এইসব বিবরণ।।রথ পাঠাইল তবে শচীর ঈশ্বর।আমারে নিলেন স্বর্গে করিয়া আদর।।নানা নৃত্য গীত বাদ্যে হর্ষ কুতূহলে।সভায় বসিয়া দেখি অমর সকলে।।দেখি নৃত্য করিতেছে কৌতুকে অপ্সরী।আছিল তাহার মাঝে ঊর্ব্বশী সুন্দরী।।তারে দেখি পূর্ব্ব কথা হইল স্মরণ।ঈষৎ হাসিয়া আমি করি নিরীক্ষণ।।তাহাতে সঙ্কেত বুঝি আনন্দ বিশেষে।ইন্দ্রের আদেশে সেই আসে মম পাশে।।দেখিয়া অন্তরে বড় হইল বিস্ময়।পূর্ব্ব পিতামহ মাতা এই নারী হয়।।প্রণাম করিয়া তবে করি নিবেদন।কহ গো জননি নিশাগমন কারণ।।অন্যভাবে আসিয়া শুনিল বিপরীত।কহিতে লাগিল তবে হইয়া দুঃখিত।।যেইক্ষণে দেখিয়াছি তোমার বদন।সেইক্ষণে হরিল মম অন্তর মন।।সে কারণে আসিলাম ঘোর নিশাকালে।এ হেন কুৎসিত ভাষা কি হেতু কহিলে।।না করিলে আশা পূর্ণ পুরুষের কাজ।ক্লীব হয়ে থাক তুমি স্ত্রীগণেরে মাঝ।।এত বলি নিজ ঘরে চলিল দুঃখিত।পুরন্দর শুনি পাছে হৈলেন লজ্জিত।।ঊর্ব্বশীরে আজ্ঞা দিল সহস্রলোচন।করহ অর্জ্জুনে শীঘ্র শাপ বিমোচন।।উর্ব্বশী কহিল, শাপ খণ্ডন না যায়।ক্লীব হবে বৎসরেক অজ্ঞাত সময়।।উপকার হইবে অজ্ঞাতবাস যবে।স্বস্তি স্বস্তি উচ্চারণ করে ইন্দ্র তবে।।তারপর দেবরাজ কত দিনান্তর।তব স্থানে পাঠান লোমশ মুনিবর।।তবে ইন্দ্র করিলেন অস্ত্র সমর্পণ।সেমত দিলেন আর যত দেবগণ।।যক্ষ রক্ষ গন্ধর্ব্বাদি সবে করি দয়া।অস্ত্র সহ শিখাইল সবে নিজ মায়া।।হেনমতে নিজ কার্য্য করিনু সাধন।দেখিয়া আনন্দমতি সহস্রলোচন।।আছিল দুরন্ত দৈত্য অমর বিবাদী।কালকেয় নিবাতকবচ দৈত্য আদি।।স্নেহের কারণ ইন্দ্র কিছু না কহিল।নগর ভ্রমণ হেতু ছলে পাঠাইল।।একে একে দেখিলাম অমর নিলয়।সঞ্জীবনীপুরী যথা ব্রহ্মার আলয়।।দেখিয়া তাঁহার পুরী করিতে গমন।মাতলি আনিল রথ যথা দৈত্যগণ।।নগর প্রাচীর ঘর পুষ্পের উদ্যান।জিনিয়া অমরাবতী পুরীর নির্ম্মাণ।।দেখিয়া বিস্ময় বড় হইল আমার।পূর্ব্বে না দেখিয়াছিনু হেন চমৎকার।।মাতলি সারথি ছিল অতি বিচক্ষণ।জিজ্ঞাসিতে কহিলেক সব বিবরণ।।পিতৃবৈরী জানি তবে করিনু বিরোধ।ধাইল দানব দুষ্ট করি মহাক্রোধ।।অপ্রমেয় বল ধরে, অগণিত সেনা।সমুদ্র সদৃশ্য তাহা, কে করে গণনা।।নানা অস্ত্র ধরি আসে সর্ব্ব দৈত্যগণে।দ্বিতীয় প্রহর যুদ্ধ কর প্রাণপণে।।সন্ধান করিনু পাছে অস্ত্র পাশুপত।ভস্ম হয়ে উড়ে যায় দুষ্ট দৈত্য যত।।কার্য্যসিদ্ধি জানি তবে প্রফুল্ল হৃদয়।আইলাম পুনঃ সুখে ইন্দ্রের আলয়।।শুনিয়া সানন্দমতি অমর প্রধান।অগ্রসর হয়ে বহু করিল সম্মান।।দিল দিব্য কিরীট কুণ্ডল মনোহর।অক্ষয় যুগল তৃণ পূর্ণ দিব্য শর।।আশ্বাস করিয়া কহিলেন এই কথা।যেই আমি সেই তুমি, জানহ সর্ব্বথা।।যেমতে আমার শত্রু করিলে নিধন।সেইমত মরিবেক তব শত্রুগণ।।আমা হৈতে তব কার্য্য হইবেক যেই।শুনিলে করিব, মম অঙ্গীকার এই।।মাতলি সহিত তবে পাঠাইয়া দিল।পূর্ব্বের বৃত্তান্ত শুন, যথা যে হইল।।কেবল ভরসামাত্র তোমার চরণ।মুহূর্ত্তেকে বিনাশিতে পারি ত্রিভুবন।।শত কর্ণ আসে যদি, দুর্য্যোধন শত।স্বপক্ষ করিয়া সাথে দিক্পাল যত।।কেবল তোমার মাত্র চরণ প্রসাদে।ক্ষুদ্র জন্তু সম জ্ঞানে বধিব নির্ব্বাদে।।অর্জ্জুনের মুখে শুনি এতেক বচন।যুধিষ্ঠির কহিলেন করি আলিঙ্গন।।এ তিন ভুবনে তব অদ্ভুত চরিত্র।আমার ভারত বংশ করিলে পবিত্র।।শত্রুরূপ গভীর সাগর হৈতে পার।সহায় সম্পদ মম তুমি কর্ণধার।।এই সব রহস্যে হরিষ মনোরথে।রহিলেন পঞ্চ ভাই গন্ধমাদনেতে।।মহাভারতের কথা অমৃত সমান।কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।৭৮. যুধিষ্ঠিরের নিকট ইন্দ্রাদিদেবগণের আগমনঅমরলোকেতে হেথা দেব পুরন্দর।মাতলির মুখে শুনি ধর্ম্মের উত্তর।।মনেতে মানিয়া সুখ হরিষ বিধানে।শীঘ্রগতি ডাকিলেন যত দেবগণে।।ইন্দ্র আহবানে সবে আসে শীঘ্রগতি।কহিতে লাগিল ইন্দ্র সবাকার প্রতি।।পরম বান্ধব তুল্য রাজ যুধিষ্ঠির।বিক্রমে বিশাল যার ভাই পার্থবীর।।নিঃশঙ্ক করিল দেবে একাকী অর্জ্জুন।কোটিকল্পে শোধ না হয় তার ঋণ।।হেন জনে সমাদর করিতে উচিত।কি যুক্তি সবার, এই মম বিবেচিত।।গন্ধমাদনেতে আছে ভাই পঞ্চ জন।চল সবে ধর্ম্মে গিয়া করি দরশন।।শুনিয়া সম্মত হৈল যত দেবগণ।মাতলিবে কহে রথ করিতে সাজন।।পাইয়া ইন্দ্রের আজ্ঞা মাতলি সারথি।দ্রুতগতি রথস্জ্জা করে মহামতি।।আহবান করিয়া নিল যতেক অমর।কৌতুকে বসিল রথোপরি পুরন্দর।।শীঘ্র করি সারথি সে চালাইল রথ।মুহূর্ত্তে উত্তরে গন্ধমাদন পর্ব্বত।।কানননিবাসী যথা পঞ্চ সহোদর।উপনীত হন তথা দেব পুরন্দর।।ইন্দ্রে দেখি মহানন্দে উঠি ধর্ম্মপতি।চরণে ধরিয়া বহু করিলা প্রণতি।।সহিত আছিল যত আর দেবগণ।একে একে সবাকারে করেন বন্দন।।পাদ্য অর্ঘ্য আসনে পূজিয়া বিধিমতে।করযোড়ে কহিলেন দেব শচীনাথে।।পূর্ব্ব পিতামহ তপ করিলা দুল্লর্ভ।সে কারণে আজি মম এতেক বৈভব।।এখন জানিনু আমি নহি হীনতপা।তুমি হেন জন আসি যারে কৈলে কৃপা।।যজ্ঞ জপ তপ আর ব্রত আচরণ।এ সব করিয়া নাহি পায় দরশন।।আমার ভাগ্যের আজি নাহিক অবধি।পাইলাম গৃহে বসি হেন রত্নানিধি।।এত শুনি কহে তবে দেব পুরন্দর।কহিলে যে কিছু সত্য, ধর্ম্ম নৃপবর।।আপনাকে নাহি জান, তুমি স্বয়ং ধর্ম্ম।পৃথিবী করিল ধন্য তোমার সুকর্ম্ম।।তুমি রাজা হৈতে ধন্য অবনীমণ্ডল।অনুগত আর যত অনুজ সকল।।তোমা সবাকার গুণ করিয়া কীর্ত্তন।অশেষ পাপেতে মুক্ত হয় পাপিগণ।।তবে যে কহিলে, কষ্ট পাইলে কাননে।বিধির বিধান নাহি লঙ্ঘে সাধুজনে।।ধর্ম্ম অবতার তুমি ধর্ম্ম-আচরণ।কিন্তু না করিহ রাজা ধর্ম্মেতে হেলন।।ভীমার্জ্জুন দেখ এই অনুজ তোমার।অনায়াসে খণ্ডাইবে পৃথিবীর ভার।।আমা আদি যতেক অমর সমুদয়।একা পার্থ সবাকারে করিল নির্ভয়।।শত্রুভয় তুমি কিছু না করিহ মনে।ভীমার্জ্জুন বধিবেক কর্ণ দুর্য্যোধনে।।ইত্যাদি অনেক কথা কহি পুরন্দর।যুধিষ্ঠিরে কহিলেন, মাগ ইষ্টবর।।ধর্ম্মপুত্র বলে, মম এই নিবেদন।ধর্ম্মে বিচলিত যেন নহে মম মন।।শুনিয়া কহেন হাসি সহস্রলোচন।ধর্ম্মে মতি রহিবে তোমার অনুক্ষণ।।হেনমতে শান্ত করি রাজা যুধিষ্ঠিরে।দেবরাজ ইন্দ্র গেল আপনার পুরে।।মহাভারতের কথা সুধার আকর।ইহা বিনা পুণ্যকথা নাহি কিছু আর।।৭৯. যুধিষ্ঠিরের ভ্রাতৃগণসহকাম্যকবনে যাত্রাস্বর্গে গেল সুরপতি, হইয়া সানন্দমতি,যুধিষ্ঠির পঞ্চ সহোদর।আপনার ভাগ্য জানি, সফল করিয়া মানি,আনন্দ বিধানে পরস্পর।।তবে ধর্ম্ম নরপতি, লোমশ ধৌম্যের প্রতি,কহিলেন করি যোড়কর।আজ্ঞা কর মাহশয়, যে কর্ম্ম করিতে হয়,কহিলেন করি যোড়কর।আজ্ঞা কর মহাশয়, যে কর্ম্ম করিতে হয়,তাহা কহ, করি অতঃপর।।বসতি কোথায় করি, কর আজ্ঞা শিরে ধরি,তথাকারে করিব গমন।কহিল লোমশ তবে, কাশ্যবনে চল সবে,সার যুক্তি, লয় মম মন।।ধৌম্য বলে কহ যত, সকলি মনের মত,যুধিষ্ঠির মানিল সকল।শুনিয়া ধর্ম্মের সেতু, গমন স্বচ্ছন্দ হেতু,ঘটোৎকচে স্মরণ করিল।।সত্যশীল ধর্ম্মমণি, হিড়িম্বা নন্দন জানি,শীঘ্রগতি হৈল উপনীত।সবারে প্রণাম করে, দাঁড়াইল যোড়করে,দেখি রাজা আনন্দে পূরিত।।তবে ঘটোৎকচ কয়, আজ্ঞা কর মহাশয়,কি কারণে করিলা স্মরণ।ধর্ম্ম কন শুন কথা, কাম্যক কানন যথা,লয়ে চল করিব গমন।।শুনি ভীম অঙ্গজনু, বাড়াইল নিজ তনু,করিলেক বিস্তার যোজন।তবে ধর্ম্ম নরপতি, সবান্ধবে শীঘ্রগতি,করিলেন স্কন্ধে আরোহণ।।ভীমের নন্দন ধীর, পরাক্রমে মহাবীর,অনায়াসে করিল গমন।নাহি মনে কিছু ভ্রম, তিলেক নাহিক শ্রম,উত্তরিল কাম্যক কানন।।মৃগ পশু বিহঙ্গম, বনস্থলে পূর্ণতম,বৃক্ষগণ শোভে বনফুলে।কৌতুক বিধানে তবে, আশ্রম করেন সবে,পুণ্যতীর্থ প্রভাসের কূলে।।সবার আনন্দ মন, বনে গিয়া ভীমার্জ্জুন,মৃগয়া করিয়া নিত্য আনি।কেবল সূর্য্যের বরে, ভুঞ্জায় সবার তরে,রন্ধন করিয়া যাজ্ঞসেনী।।এমন সানন্দ মনে, বসতি করেন বনে,কৃষ্ণা সহ পঞ্চ সহোদর।একদিন নিশাশেষে, আসিয়া ধর্ম্মের পাশে,কহিছে লোমশ মুনিবর।।শুন ধর্ম্ম নরপতি, যাইব অমরাবতী,তুষ্ট হয়ে করহ বিদায়।শুনি ভাই পঞ্চ জনে, আসিয়া রিবস মনে,পড়িল প্রণাম করি পায়।।লোচন-সলিলে রাজা, বিধিমতে করি পূজা,বহু স্তুতি করিলেন শেষে।কহিয়া সবার স্থানে, পরম সন্তোষ মনে,মহামুনি গেল স্বর্গবাসে।।ধর্ম্ম আগমন শুনি, আইল যতেক মুনি,ক্রমে ক্রমে যত বন্ধুজন।বনেতে ধর্ম্মের সভা, উপমা তাহার কিবা,হস্তিনা হইল কাম্যবন।।বলরাম জগন্নাথ, যতেক যাদব সাথ,গেলেন ধর্ম্মের অন্বেষণে।যত পরিবার সঙ্গে, আনন্দ প্রসঙ্গ রঙ্গে,উপনীত রম্য কাম্যবনে।।কৃষ্ণ আগমন শুনি, যুধিষ্ঠির নৃপমণি,অমৃতে সিঞ্চিল কলেবর।সানন্দ মন্দির পুর, আগুসরি কত দূর,সবান্ধবে পঞ্চ সহোদর।।বহুদিন অদর্শনে, নমস্কার আলিঙ্গনে,আশীর্ব্বাদ সুমঙ্গল ধ্বনি।বসেন কৌতুক মতি, রাম কৃষ্ণ ধর্ম্মপতি,সবান্ধবে আর যত মুনি।।বলরাম নারায়ণ, সম্বোধিয়া পঞ্চ জন,জিজ্ঞাসেন কুশল বারতা।শুনিয়া কহেন ধম্ম, হইল যতেক কম্ম,পূর্ব্বের বৃত্তান্ত সব কথা।।শুনি রাম যদুপতি, আনন্দে প্রসন্ন মতি,প্রশংসা করেন পার্থবীরে।তবে তারা কতক্ষণে, চলিলেন সর্ব্বজনে,স্নান হেতু প্রভাসের তীরে।।জলক্রীড়া করি সবে, আসিয়া আশ্রমে তবে,ভোজন করেন পরিতোষে।যথাসুখে আচমন, করি শেষে সর্ব্ব জন,বসিলেন হরিষ মানসে।।হেনকালে যদুবীর, সম্বোধিয়া যুধিষ্ঠির,কহিলেন সুমধুর বাণী।তোমার ভাগ্যের কথা, এমনি করিল ধাতা,বনেতে হস্তিনা তুল্য মানি।।যতেক দেখহ কর্ম্ম, সকলের সার ধর্ম্ম,ধর্ম্মবলে ধর্ম্মী অন্ত।।ইহা জানি ধর্ম্মরাজ, সাধিবে আপন কাজ,সত্যে নাহি হবে বিচলিত।পূর্ব্বে মহাজন যত, সবাকার এক পথ,কেহ নাহি করিল অনীত।।সত্য জান মহাশয়, তোমার এ দুঃখ নয়,বহু দুঃখে দুঃখী দুর্য্যোধন।বিপুল বৈভব যত, নিশার স্বপন মত,অল্পদিনে হইবে নিধন।।কৃষ্ণের বচন শুনি, সত্য সত্য যত মুনি,কহিল ধর্ম্মের সন্নিধানে।নিশ্চিত জানিও তুমি, ভবিস্য কহিনু আমি,অল্পদিনে ক্ষয় দুর্য্যোধনে।।আশীর্ব্বাদ করি তবে, যথাস্থানে গেল সবে,বন্ধুগণ লইয়া বিদায়।আশ্বাসিয়া সর্ব্বজনে, গেল সবে নিজ স্থানে,দুঃখিত অন্তর ধর্ম্মরায়।।তবে রাম নারায়ণ, সম্বোধিয়া পঞ্চ জন,চাহিলেন বিদায় বিনয়ে।আজ্ঞা কর ধর্ম্মপতি, যাব তবে দ্বারাবতী,কহ যদি প্রসন্ন হৃদয়ে।।ধর্ম্ম কন মৃদুভাষে, অবশ্য যাইবে দেশে,রাখিবে আমার প্রতি মন।কি আর কহিব আমি, সকল জানহ তুমি,দুই চক্ষু রাম নারায়ণ।।হেন করি সম্বিধান, বিদায় লইয়া যান,রেবতীশ সত্যভামা পতি।রথে চড়ি সবান্ধবে, নানা বাক্য মহোৎসবে,উপনীত যথা দ্বারাবতী।।সবে গেল নিজ ঘর, আছে পঞ্চ সহোদর,কাম্যবন করিয়া আশ্রয়।জপ যজ্ঞ দান ব্রত, নানা ধর্ম্ম অবিরত,করি নিত্য আনন্দ হৃদয়।।বনেতে বিচিত্র কথা, ব্যাসের রচিত গাথা,বর্ণিবারে কাহার শকতি।গীতিচ্ছন্দে অভিলাষ, ভণে কাশীরাম দাস,কৃষ্ণপদে মাগিয়া ভকতি।।৮০.অজগর যুধিষ্ঠির প্রশ্নোত্তরদ্বৈত্যবনে একদিন ঘুরিতে ঘুরিতে।অজগর সর্পে ভীম পাইল দেখিতে।।ভীমের বিলম্ব দেখি রাজা যুধিষ্ঠির।তাঁর অন্বেষণে যান হইয়া অস্থির।।দেখিলেন, অজগর ভীমেরে ধরিয়া।রাখিয়াছে দৃঢ়ভাবে তাঁরে সাপটিয়া।।অজগরে যুধিষ্ঠির কহেন বচন।আমার ভ্রাতার কর বন্ধন মোচন।।সর্প বলে, ছেড়ে দিব ওহে নরবর।যদি তুমি দাও মোর প্রশ্নের উত্তর।।স্বর্গসুখ-ভোগে আমি নহুষ নৃপতি।ঋষিগণ স্কন্ধে চড়ি করিতাম গতি।।ঋষিরা করিত মম শিবিকা বহন।অগস্ত্যের দেহে মম ঠেকিল চরণ।।অগস্ত্যের অভিশাপে আমি যে ভূতলে।অজগর সর্পরূপে রহিনু বিরলে।।পুনশ্চ অগস্ত্য ঋষি দিলা মোরে বর।উদ্ধারিবে সেই, দিবে যে তব উত্তর।।মহারাজ যুধিষ্ঠির পাণ্ডব রাজন।করিয়া দিবেন তব শাপ বিমোচন।।যুধিষ্ঠির কহিলেন প্রশ্ন কর তুমি।যথাজ্ঞানে তাহার উত্তর দিব আমি।।* অজগরের প্রশ্নযথার্থ ব্রাহ্মণ তুমি বলিবে কাহারে।জ্ঞাতব্য বিষয় কিবা বল এ সংসারে।।যুধিষ্ঠিরের উত্তর।সত্য, দান, ক্ষমা, শীল, তপ, দয়া যাঁর।তাঁরেই ব্রাহ্মণ বলি করিবে বিচার।।যাঁহারে জানিলে সুখ দুঃখ নাহি রয়।সুখ-দুঃখ শূন্য যিনি সকল সময়।।সেই এক ব্রহ্ম শুধু জ্ঞাতব্য বিষয়।অপর জ্ঞাতব্য আর নাহি মহাশয়।।* অজগরের প্রশ্নশূদ্রেও সত্যাদি ধর্ম্ম থাকিলে নিহিত।সে জন ব্রাহ্মণ বলি হয় কি বিদিত।।যুধিষ্ঠিরের উত্তর।শূদ্রেও থাকিতে পারে ব্রাহ্মণ-লক্ষণ।ব্রাহ্মণেও শূদ্র-চিহ্ন করি নিরীক্ষণ।।শূদ্রই যে শূদ্র হয় ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণ।এরূপ নিয়ম কিছু না দেখি কখন।।সে ব্রাহ্মণ, যাঁহে দেখি বৈদিক আচার।সেই শূদ্র, যাহে দেখি বিপরীত তার।।* অজগরের প্রশ্ন।প্রশ্ন করিতেছি আমি, ওহে মহামতি।কি কর্ম্ম করিলে হয় জীবের সদগতি।।যুষ্ঠিরের উত্তর।যে জন অহিংসা পর হইয়া সংসারে।সত্য প্রিয় বাক্যে সৎপাত্রে দান করে।।সেই জন স্বর্গলাভ করে সুনিশ্চয়।এই মোর বাক্য কভু অন্যথা না হয়।।* অজগরের প্রশ্ন।মন, বুদ্ধি, দুইটীর কিরূপ লক্ষণ।বুঝাইয়া কহ মোরে ধর্ম্মের নন্দন।।যুধিষ্ঠিরের উত্তর।দেহেরে সহিত মন জন্মলাভ করে।কায্য হতে বুদ্ধি কিন্তু জন্মে এ সংসারে।।মন ত সগুণ, আর বুদ্ধিত নির্গুণ।বলিনু দুয়ের ভেদ, মন দিয়া শুন।।আপনি সুবিদ্ধিমান, তবে কি কারণ।করিলেন ঋষি দেহে চরণ অর্পণ।।সর্প কহে বিদ্যা বুদ্ধি থাকুক না যত।ধন যদি থাকে তার, মোহ জন্মে তত।।ধনমদে মত্ত হয়ে আমিও রাজন্।করিয়াছি অগস্ত্যের দেহে পদার্পণ।।অজগর কহিলেন, হে ধর্ম্ম নন্দন।ভাগ্যে আজি মিলিয়াছে তব দরশন।।আমার প্রশ্নের দিলে উত্তর এখন।এতদিনে হল মোর শাপ বিমোচন।।কাশী কহে, অজগর তব বংশধর।শাপমুক্ত করি তব জুড়াল অন্তর।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon