শ্রীমদ্ভগবত গীতা ষষ্ঠ অধ্যায়

ষষ্ঠ অধ্যায়-ধ্যান যোগ

|শ্রীভগবানুবাচ|
অনাশ্রিতঃ কর্মফলং কার্যং কর্ম করোতি য: |
স সন্ন্যাসী চ যোগী চ ন নিরগ্নির্ন চাক্রিয়ঃ || ১ ||
অর্থ: পরমেশ্বর ভগবান বললেন- যিনি অগ্নিহোত্রাদি কর্ম ত্যাগ করেছেন এবং দৈহিক চেষ্টাশূন্য তিনি সন্ন্যাসী বা যোগী নন। যিনি কর্মফলের প্রতি আসক্ত না হয়ে তাঁর কর্তব্য কর্ম করেন, তিনিই যথার্থ সন্ন্যাসী বা যোগী।
যং সন্ন্যাসমিতি প্রাহুর্যোগং তং বিদ্ধি পান্ডব |
ন হ্যসংন্যস্তসংকল্পো যোগী ভবতি কশ্চন || ২ ||
অর্থ: হে পান্ডব! যাকে সন্ন্যাস বলা যায়, তাকেই যোগ বলা যায়, কারণ ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের বাসনা ত্যাগ না করলে কখনই যোগী হওয়া যায় না।
আরুরুক্ষোর্মুনের্যোগং কর্ম কারণমুচ্যতে |
যোগারূঢ়স্য তস্যৈব শমঃ কারণমুচ্যতে || ৩ ||
অর্থ: অষ্টাঙ্গযোগ অনুষ্ঠানে যারা নবীন, তাদের পক্ষে কর্ম অনুষ্ঠান করাই উৎকৃষ্ট সাধন, আর যাঁরা ইতিমধ্যেই যোগারুঢ় হয়েছেন, তাঁদের পক্ষে সমস্ত কর্ম থেকে নিবৃত্তিই উৎকৃষ্ট সাধন।
যদা হি নেন্দ্রিয়ার্থেষু ন কর্মস্বনুষজ্জতে |
সর্বসংকল্পসন্ন্যাসী য়োগারূঢস্তদোচ্যতে || ৪ ||
অর্থ: যখন যোগী জড় সুখভোগের সমস্ত সংকল্প ত্যাগ করে ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষয়ে এবং সকাম কর্মের প্রতি আসক্তি রহিত হন, তখন তাঁকেই যোগারুঢ় বলা হয়।
উদ্ধরেদাত্মনাত্মানং নাত্মানমবসাদয়েৎ |
আত্মৈব হ্যাত্মনো বন্ধুরাত্মৈব রিপুরাত্মনঃ || ৫ ||
অর্থ: মানুষের কর্তব্য তার মনের দ্বারা নিজেকে জড় জগতের বন্ধন থেকে উদ্ধার করা, মনের দ্ধারা আত্মাকে অধ:পতিত করা কখনই উচিত নয়। মনই জীবের অবস্থা ভেদে বন্ধু ও শত্রু হয়ে থাকে।
বন্ধুরাত্মাত্মনস্তস্য যেনাত্মৈবাত্মনা জিতঃ |
অনাত্মনস্তু শত্রুত্বে বর্তেতাত্মৈব শত্রুবৎ || ৬ ||
অর্থ: যিনি তাঁর মনকে জয় করেছেন, তাঁর মন তাঁর পরম বন্ধু, কিন্তু যিনি তা করতে অক্ষম, তাঁর মনই তাঁর পরম শত্রু।
জিতাত্মনঃ প্রশান্তস্য্ পরমাত্মা সমাহিতঃ |
শীতোষ্ণসুখদুঃখেষু তথা মানাপমানয়োঃ || ৭ ||
অর্থ: জিতেন্দ্রিয় ও প্রশান্তচিত্ত ব্যক্তি পরমাত্নাকে উপলদ্ধি করতে পেরেছেন। তাঁর কাছে শীত ও উষ্ণ, সুখ ও দু:খ এবং সম্মান ও অপমান সবই সমান।
জ্ঞানবিজ্ঞানতৃপ্তাত্মা কূটস্থো বিজিতেন্দ্রিয়ঃ |
যুক্ত ইত্যুচ্যতে যোগী সমলোষ্ট্রাশ্মকাঞ্চনঃ || ৮ ||
অর্থ: যে যোগী শাস্ত্রজ্ঞান ও তত্ত্ব অনুভূতিতে পরিতৃপ্ত, যিনি চিন্ময় স্তরে অধিষ্ঠিত ও জিতেন্দ্রিয় এবং যিনি মৃৎখন্ড, প্রস্তর ও সুবর্ণে সমদর্শী, তিনি যোগারুঢ় বলে কথিত হন।
সুহৃন্মিত্রার্যুদাসীনমধ্যস্থদ্বেষ্যবন্ধুষু |
সাধুষ্বপি চ পাপেষু সমবুদ্ধির্বিশিষ্যতে || ৯ ||
অর্থ: যিনি সুহৃদ, মিত্র, শত্রু, উদাসীন, মধ্যস্থ, মৎসর, বন্ধু, ধার্মিক ও পাপাচারী- সকলের প্রতি সমবুদ্ধি, তিনিই শ্রেষ্ঠতা লাভ করেন।
যোগী যুঞ্জীত সততমাত্মানং রহসি স্থিতঃ |
একাকী যতচিত্তাত্মা নিরাশীরপরিগ্রহঃ || ১০ ||
অর্থ: যোগারুঢ় ব্যক্তি সর্বদা পরব্রহ্মে সম্পর্কযুক্ত হয়ে তাঁর দেহ, মন ও নিজেকে নিয়োজিত করবেন, তিনি একাকী নির্জন স্থানে বসবাস করবেন এবং সর্বদা সতর্কভাবে তাঁর মনকে বশীভূত করবেন। তিনি বাসনামুক্ত ও পরিগ্রহ রহিত হবেন।
শুচৌ দেশে প্রতিষ্ঠাপ্য স্থিরমাসনমাত্মনঃ |
নাত্যুচ্ছ্রিতং নাতিনীচং চৈলাজিনকুশোত্তরম্ || ১১ ||
তত্রৈকাগ্রং মনঃ কৃত্বা যতচিত্তেন্দ্রিয়ক্রিয়: |
উপবিশ্যাসনে যুঞ্জ্যাদ্ যোগমাত্মবিশুদ্ধয়ে || ১২ ||
অর্থ: যোগ অভ্যাসের নিয়ম এই যে, কুশাসনের উপর মৃগচর্মের আসন, তার উপরে বস্ত্রাসন রেখে অত্যন্ত উচ্চ বা অত্যন্ত নীচ না করে, সেই আসন পবিত্র স্থানে স্থাপন করে তাতে আসীন হবেন। সেখানে উপবিষ্ট হয়ে চিত্ত, ইন্দ্রিয় ও ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রিত করে চিত্ত শুদ্ধির জন্য মনকে একাগ্র করে যোগ অভ্যাস করবেন।
সমং কায়শিরোগ্রীবং ধারয়ন্নচলং স্থিরঃ |
সংপ্রেক্ষ্য নাসিকাগ্রং স্বং দিশশ্চানবলোকয়ন্ || ১৩ ||
প্রশান্তাত্মা বিগতভীর্ব্রহ্মচারিব্রতে স্থিতঃ |
মনঃ সংযম্য মচ্চিত্তো য়ুক্ত আসীত মত্পরঃ || ১৪ ||
অর্থ: শরীর, মস্তক ও গ্রীবাকে সমানভাবে রেখে অন্য দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ না করে, নাসিকার অগ্রভাগে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে প্রশান্তাত্মা, ভয়শূন্য ও ব্রহ্মচর্যব্রতে স্থিত পুরুষ মনকে সমস্ত জড় বিষয় থেকে প্রত্যাহার করে, আমাকে জীবনের চরম লক্ষ্যরুপে স্থির করে হৃদয়ে আমার ধ্যানপূর্বক যোগ অভ্যাস করবেন।
য়ুঞ্জন্নেবং সদাত্মানং যোগী নিয়তমানসঃ |
শান্তিং নির্বাণপরমাং মৎসংস্থামধিগচ্ছতি || ১৫ ||
অর্থ: এভাবেই দেহ, মন ও কার্যকলাপ সংযত করার অভ্যাসের ফলে যোগীর জড় বন্ধন মুক্ত হয় এবং তিনি তখন আমার ধাম প্রাপ্ত হন।
নাত্যশ্নতস্তু যোগোহস্তি ন চৈকান্তমনশ্নতঃ |
ন চাতিস্বপ্নশীলস্য জাগ্রতো নৈব চার্জুন || ১৬ ||
অর্থ: অধিক ভোজনকারী, নিতান্ত অনাহারী, অধিক নিদ্রাপ্রিয় ও নিদ্রাশূন্য ব্যক্তির যোগী হওয়া সম্ভব নয়।
যুক্তাহারবিহারস্য যুক্তচেষ্টস্য কর্মসু |
যুক্তস্বপ্নাববোধস্য যোগো ভবতি দুঃখহা || ১৭ ||
অর্থ: যিনি পরিমিত আহার, ও বিহার করেন, পরিমিত প্রয়াস করেন, যাঁর নিদ্রা ও জাগরণ নিয়মিত, তিনিই যোগ অভ্যাসের দ্বারা সমস্ত জড়-জাগতিক দু:খের নিবৃত্তি সাধন করতে পারেন।
যদা বিনিয়তং চিত্তমাত্মন্যেবাবতিষ্ঠতে |
নিঃস্পৃহঃ সর্বকামেভ্যো যুক্ত ইত্যুচ্যতে তদা || ১৮ ||
অর্থ: যোগী যখন অনুশীলনের দ্বারা চিত্তবৃত্তির নিরোধ করেন এবং সমস্ত জড় কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত হয়ে আত্মাতে অবস্থান করেন, তখন তিনি যোগযুক্ত হয়েছেন বলে বলা হয়।
যথা দীপো নিবাতস্থো নেঙ্গতে সোপমা স্মৃতা |
যোগিনো যতচিত্তস্য যুঞ্জতো যোগমাত্মনঃ || ১৯ ||
অর্থ: বায়ুশূন্য স্থানে দীপশিখা যেমন প্রকম্পিত হয় না, চিত্তবৃত্তির নিরোধ অভ্যাসকারী যোগীর চিত্তও তেমনইভাবে অবিচলিত থাকে।
যত্রোপরমতে চিত্তং নিরুদ্ধং যোগসেবয়া |
যত্র চৈবাত্মনাত্মানং পশ্যন্নাত্মনি তুষ্যতি || ২০ ||
সুখমাত্যন্তিকং যত্তদ্ বুদ্ধিগ্রাহ্যমতীন্দ্রিয়ম্ |
বেত্তি যত্র ন চৈবায়ং স্থিতশ্চলতি তত্ত্বতঃ || ২১ ||
যং লব্ধ্বা চাপরং লাভং মন্যতে নাধিকং ততঃ |
যস্মিন্ স্থিতো ন দুঃখেন গুরুণাপি বিচাল্যতে || ২২ ||
তং বিদ্যাদ্দুঃখসংযোগবিয়োগং যোগসংজ্ঞিতম্।
স নিশ্চয়েন যোক্তব্যে যোগোহনির্বিণ্ণচেতসা || ২৩ ||
অর্থ: যোগ অভ্যাসের ফলে যে অবস্থায় চিত্ত সম্পূর্ণরুপে জড় বিষয় থেকে প্রত্যাহৃত হয়, সেই অবস্থাকে যোগসমাধি বলা হয়। এই অবস্থায শুদ্ধ:করণ দ্বারা আত্মাকে উপলদ্বি করে যোগী আত্মাতেই পরম আনন্দ আস্বাদন করেন। সেই আনন্দময় অবস্থায় অপ্রাকৃত ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অপ্রাকৃত সুখ অনুভুত হয়। এই পারমার্থিক চেতনায় অবস্থিত হলে যোগী আর আত্ম-তত্ত্বজ্ঞান থেকে বিচলিত হয় না এবং তখন আর অন্য কোন কিছু লাভই এর থেকে অধিক বলে মনে হয় না। এই অবস্থায় স্থিত হলে চরম বিপর্যয়েও চিত্ত বিচলিত হয় না। জড় জগতের সংযোগ-জনিত সমস্ত দু:খ-দুর্দশা থেকে এটিই হচ্ছে প্রকৃত মুক্তি।
সংকল্পপ্রভবান্ কামাংস্ত্যক্ত্বা সর্বানশেষতঃ |
মনসৈবেন্দ্রিয়গ্রামং বিনিয়ম্য সমন্ততঃ || ২৪ ||
অর্থ: অবিচলিত অধ্যবসায় ও বিশ্বাস সহকারে এই যোগ অনুশীলন করা উচিত। সংকল্পজাত সমস্ত কামনা সম্পূর্ণরুপে ত্যাগ করে মনের দ্বারা ইন্দ্রিয়গুলিকে সব দিক থেকে নিয়ন্ত্রিত করা কর্তব্য।
শনৈঃ শনৈরুপরমেদ্ বুদ্ধা ধৃতিগৃহীতয়া |
আত্মসংস্থং মনঃ কৃত্বা ন কিঞ্চিদপি চিন্তয়েৎ || ২৫ ||
অর্থ: ধৈর্যযুক্ত বুদ্ধির দ্বারা মনকে ধীরে ধীরে আত্মাতে স্থির করে এবং অন্য কোন কিছুই চিন্তা না করে সমাধিস্থ হতে হয়।
যতো যতো নিশ্চলতি মনশ্চঞ্চলমস্থিরম্ |
ততস্ততো নিয়ম্যৈতদাত্মন্যেব বশং নয়েত || ২৬ ||
অর্থ: চঞ্চল ও অস্থির মন যে যে বিষয়ে ধাবিত হয়, সেই সেই বিষয় থেকে নিবৃত্ত করে আত্মার বশে আনতে হয়।
প্রশান্তমনসং হ্যেনং যোগিনং সুখমুত্তমম্ |
উপৈতি শান্তরজসং ব্রহ্মভূতমকল্মষম্ || ২৭ ||
অর্থ: ব্রহ্মভাব-সম্পন্ন, প্রশান্ত চিত্ত, রজোগুন প্রশমিত ও নিষ্পাপ হয়ে যাঁর মন আমাতে নিবিষ্ট হয়েছে, তিনিই পরম সুখ প্রাপ্ত হন।
যুঞ্জন্নেবং সদাত্মানং যোগী বিগতকল্মষঃ |
সুখেন ব্রহ্মসংস্পর্শমত্যন্তং সুখমশ্নুতে || ২৮ ||
অর্থ: এভাবেই আত্মসংযমী যোগী জড় জগতের সমস্ত কলুষ থেকে মুক্ত হয়ে ব্রহ্ম-সংস্পর্শরুপ পরম সুখ আস্বাদন করেন।
সর্বভূতস্থমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনি |
ঈক্ষতে যোগয়ুক্তাত্মা সর্বত্র সমদর্শনঃ || ২৯ ||
অর্থ: প্রকৃত যোগী সর্বভূতে আমাকে দর্শন করেন এবং আমাতে সব কিছু দর্শন করেন। যোগযুক্ত আত্মা সর্বত্রই আমাকে দর্শন করেন।
যো মাং পশ্যতি সর্বত্র সর্বং চ ময়ি পশ্যতি |
তস্যাহং ন প্রণশ্যামি স চ মে ন প্রণশ্যতি || ৩০ ||
অর্থ: যিনি সর্বত্র আমাকে দর্শন করেন এবং আমাতেই সমস্ত বস্তু দর্শন করেন, আমি কখনও তাঁর দৃষ্টির অগোচর হই না এবং তিনিও আমার দৃষ্টির অগোচর হন না।
সর্বভূতস্থিতং যো মাং ভজত্যেকত্বমাস্থিতঃ |
সর্বথা বর্তমানোহপি স যোগী ময়ি বর্ততে || ৩১ ||
অর্থ: যে যোগী সর্বভূতে স্থিত পরমাত্মা রুপে আমাকে জেনে আমার ভজনা করেন, তিনি সর্ব অবস্থাতেই আমাতে অবস্থান করেন।
আত্মৌপম্যেন সর্বত্র সমং পশ্যতি যোহর্জুন |
সুখং বা যদি বা দুঃখং স যোগী পরমো মতঃ || ৩২ ||
অর্থ: হে অর্জুন! যিনি সমস্ত জীবের সুখ ও দু:খকে নিজের সুখ ও দু:খের অনুরুপ সমানভাবে দর্শন করেন, আমার মতে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী।
|অর্জুন উবাচ|
যোহয়ং যোগস্ত্বয়া প্রোক্তঃ সাম্যেন মধুসূদন |
এতস্যাহং ন পশ্যামি চঞ্চলত্বাৎ স্থিতিং স্থিরাম্ || ৩৩ ||
অর্থ: অর্জুন বললেন- হে মধুসূদন! তুমি সর্বত্র সমদর্শনরুপ যে যোগ উপদেশ করলে, মনের চঞ্চল স্বভাববশত আমি তার স্থায়ী স্থিতি দেখতে পাচ্ছি না।
চঞ্চলং হি মনঃ কৃষ্ণ প্রমাথি বলবদ্দৃঢ়ম্ |
তস্যাহং নিগ্রহং মন্যে বায়োরিব সুদুষ্করম্ || ৩৪ ||
অর্থ: হে কৃষ্ণ! মন অত্যন্ত চঞ্চল, শরীর ও ইন্দ্রিয় আদির বিক্ষেপ উৎপাদক, দুর্দমনীয় এবং অত্যন্ত বলবান, তাই তাকে নিগ্রং করা বায়ুকে বশীভূত করার থেকেও অধিকতর কঠিন বলে আমি মনে করি।
|শ্রীভগবানুবাচ|
অসংশয়ং মহাবাহো মনো দুর্নিগ্রহং চলম্ |
অভ্যাসেন তু কৌন্তেয় বৈরাগ্যেণ চ গৃহ্যতে || ৩৫ ||
অর্থ: পরমেশ্বর ভগবান বললেন- হে মহাবাহো! মন যে দুর্দমনীয় ও চঞ্চল তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু হে কৌন্তেয়! ক্রমশ অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা মনকে বশীভূত করা যায়।
অসংযতাত্মনা যোগো দুষ্প্রাপ ইতি মে মতিঃ |
বশ্যাত্মনা তু যততা শক্যোহবাপ্তুমুপায়তঃ || ৩৬ ||
অর্থ: অসংযত চিত্ত ব্যক্তির পক্ষে আত্ম-উপলদ্ধি দুষ্প্রাপ। কিন্তু যার মন সংযত এবং যিনি যথার্থ উপায় অবলম্বন করে মনকে বশ করতে চেষ্টা করেন, তিনি অবশ্যই সিদ্ধি লাভ করেন। সেটিই আমার অভিমত।
|অর্জুন উবাচ|
অযতিঃ শ্রদ্ধয়োপেতো যোগাচ্চলিতমানসঃ |
অপ্রাপ্য যোগসংসিদ্ধিং কাং গতিং কৃষ্ণ গচ্ছতি || ৩৭ ||
অর্থ: অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন- হে কৃষ্ণ! যিনি প্রথমে শ্রদ্ধা সহকারে যোগে যুক্ত থেকে পরে চিত্তচাঞ্চল্য হেতু ভ্রষ্ট হয়ে যোগে সিদ্ধি লাভ করতে না পারেন, তবে সেই ব্যর্থ যোগীর কি গতি লাভ হয়?
কচ্চিন্নোভয়বিভ্রষ্টশ্ছিন্নাভ্রমিব নশ্যতি |
অপ্রতিষ্ঠো মহাবাহো বিমূঢ়ো ব্রহ্মণঃ পথি || ৩৮ ||
অর্থ: হে মহাবাহো! কর্ম ও যোগ হতে ভ্রষ্ট ব্যক্তি ব্রহ্ম লাভের পথ থেকে বিমূঢ় হয়ে যে আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে, সে কি ছিন্ন মেঘের মতো একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে?
এতন্মে সংশয়ং কৃষ্ণ ছেত্তুমর্হস্যশেষতঃ |
ত্বদন্য: সংশয়স্যাস্য ছেত্তা ন হ্যুপপদ্যতে || ৩৯ ||
অর্থ: হে কৃষ্ণ! তুমিই কেবল আমার এই সংশয় দূর করতে সমর্থ। কারণ, তুমি ছাড়া আর কেউই আমার এই সংশয় দূর করতে পারবে না।
|শ্রীভগবানুবাচ|
পার্থ নৈবেহ নামুত্র বিনাশস্তস্য বিদ্যতে |
ন হি কল্যাণকৃৎ কশ্চিদ্ দুর্গতিং তাত গচ্ছতি || ৪০ ||
অর্থ: পরমেশ্বর ভগবান বললেন- হে পার্থ! শুভানুষ্ঠানকারী পরমার্থবিদের ইহলোকে ও পরলোকে কোন দুর্গতি হয় না। তার কারণ, কল্যাণকারীর কখনও অধোগতি হয় না।
প্রাপ্য পুণ্যকৃতাং লোকানুষিত্বা শাশ্বতীঃ সমাঃ |
শুচীনাং শ্রীমতাং গেহে যোগভ্রষ্টোহভিজায়তে || ৪১ ||
অর্থ: যোগভ্রষ্ট ব্যক্তি পুণ্যবানদের প্রাপ্য স্বর্গাদি লোকসমুহে বহুকাল বাস করে সদাচারী ব্রাহ্মণদের গৃহে অথবা শ্রীমান ধনী বণিকদের গৃহে জন্ম গ্রহণ করেন।
অথবা যোগিনামেব কুলে ভবতি ধীমতাম্ |
এতদ্ধি দুর্লভতরং লোকে জন্ম যদীদৃশম্ || ৪২ ||
অর্থ: অথবা যোগভ্রষ্ট পুরুষ জ্ঞানবান যোগীগণের বংশে জন্মগ্রহণ করেন। এই প্রকার জন্ম এই এই জগতে অবশ্যই অত্যন্ত দুর্লভ।
তত্র তং বুদ্ধিসংযোগং লভতে পৌর্বদেহিকম্ |
যততে চ ততো ভূয়ঃ সংসিদ্ধৌ কুরুনন্দন || ৪৩ ||
অর্থ: হে কুরুনন্দন! সেই প্রকার জন্মগ্রহণ করার ফলে তিনি পুনরায় তাঁর পূর্ব জন্মকৃত পারমার্থিক চেতনার বুদ্ধিসংযোগ লাভ করে সিদ্ধি লাভের জন্য পুনরায় যত্নবান হন।
পূর্বাভ্যাসেন তেনৈব হ্রিয়তে হ্যবশোহপি সঃ |
জিজ্ঞাসুরপি যোগস্য শব্দব্রহ্মাতিবর্ততে || ৪৪ ||
অর্থ: তিনি অবশ হয়েই পূর্বজন্মজাত সংস্কারবশত: যোগমার্গে আকৃষ্ট হন। যোগের স্বরুপ জানতে ইচ্ছুক হয়ে যোগমার্গে প্রবৃত্ত যোগভ্রষ্ট ব্যক্তিও বেদোক্ত কর্মানুষ্ঠানের ফল অতিক্রম করেন।
প্রযত্নাদ্ যতমানস্তু যোগী সংশুদ্ধকিল্বিষঃ |
অনেকজন্মসংসিদ্ধস্ততো যাতি পরাং গতিম্ || ৪৫ ||
অর্থ: যোগী ইহজন্মে পূর্বজন্মকৃত যত্ন অপেক্ষা অধিকতর যত্ন করে পাপ মুক্ত হয়ে পূর্ব পূর্ব জন্মের সঞ্চিত সংস্কার দ্বারা সিদ্ধি লাভ করে পরম গতি লাভ করেন।
তপস্বিভ্যোধিকো যোগী জ্ঞানিভ্যোহপি মতোহধিকঃ |
কর্মিভ্যশ্চাধিকো যোগী তস্মাদ‌যোগী ভবার্জুন || ৪৬ ||
অর্থ: যোগী তপস্বিগণের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, জ্ঞানিগণ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ, কর্মিগণ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ, এই আমার অভিমত। সুতরাং হে অর্জুন! তুমি যোগী হও।
যোগিনামপি সর্বেষাং মদগতেনান্তরাত্মনা |
শ্রদ্ধাবান্ ভজতে যো মাং স মে য়ুক্ততমো মতঃ || ৪৭ ||
অর্থ: যিনি শ্রদ্ধা সহকারে মদ্গত চিত্তে আমার ভজনা করেন, তিনিই সবচেয়ে অন্তরঙ্গভাবে আমার সঙ্গে যুক্ত এবং তিনিই সমস্ত যোগীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। সেটিই আমার অভিমত।
ইতি-শ্রীমদ্ভগবতগীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ের ভক্তিবেদান্ত তাৎপর্য সমাপ্ত।।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র