মহাভারত:বিরাটপর্ব-০২৬-০৩০

২৬. কর্ণের আত্মশ্লাঘা
দুর্য্যোধন দুর্ম্মতির শুনিয়া বচন।
কহিতে লাগিল তবে বীর বৈকর্ত্তন।।
মলিন বদন কেন দেখি সব রথী।
আচার্য্যের বাক্যে বুঝি ছন্ন হৈল মতি।।
না জানহ ইতিমধ্যে আছে কর্ণবীর।
কার শক্তি মোর আগে যুদ্ধে হবে স্থির।।
কিম্বা জামদগ্ন্য রাম কিম্বা বজ্রপাণি।
কিম্বা বাসুদেব সহ আসুক ফাল্গুনি।।
বধিব সবারে আমি একা ভুজবলে।
সমুদ্র-লহরী যথা রক্ষা করে কূলে।।
ভাগ্যে যদি থাকে তবে হইবে কিরীটি।
প্রথমে বানরধ্বজ ফেলাইব কাটি।।
খণ্ড খণ্ড করি দিব শ্বেত চারি হয়।
দশমিক মম অস্ত্রে হবে অস্ত্রময়।।
বিজয় ধনুক মম বিখ্যাত সবার।
দিব্য অস্ত্র দিল মোরে রাম গুণাধার।।
পাণ্ডব কারণ সদা দুঃখী দুর্য্যোধন।
সে দুঃখ মিত্রের আজি করিব খণ্ডন।।
কাটিয়া পার্থের মুণ্ড অগ্রে দিব ডালি।
নিষ্কণ্টকে রাজ্য ভুঞ্জ নাহি শত্রু বলি।।
একেশ্বর আজি আমি করিব সমর।
সবে যাহ গাভী লয়ে হস্তিনা নগর।।
কিম্বা ‍যুদ্ধ দেখ সবে অন্তরে থাকিয়া।
সূর্য্য আচ্ছাদিব আজি বাণ বরষিয়া।।
২৭. কৃপাচার্য্যের বক্তৃতা
কর্ণবাক্য শুনি কৃপাচার্য্য বলে বাণী।
যতেক করহ তেজ সব আমি জানি।।
মুখে মাত্র বল, কিন্তু শক্তি নাই কাজে।
শরতের মেঘ যথা নিষ্ফল গরজে।।
পণ্ডিতে কহিতে হেন মনে করে লাজ।
কি কর্ম্ম করিয়া এত কহ সভামাঝ।।
অজ্ঞান বাতুল যথা কর্ম্মে ক্ষম নহে।
ভাল মন্দ নাহি, মুখে যাহা আসে কহে।।
একেশ্বর যুদ্ধ ইচ্ছ অর্জ্জুনের সনে।
অসম্ভব কথা কহ শুনিনু শ্রবণে।।
যে পার্থ একাকী জিনে এ তিন ভুবন।
খাণ্ডব দহিয়া কৈল অগ্নির তর্পণ।।
চতুর্দ্দশ ভুবনেতে বলী যদুগণ।
বলে ভদ্রা হরি নিল একাকী অর্জ্জুন।।
একেশ্বর চিত্রসেনে জিনিয়া সমরে।
দুর্য্যোধনে মুক্ত কৈল অরণ্য ভিতরে।।
নিবাতকবচ কালকেয় মহাতেজা।
মারি নিষ্কণ্টক করি দিল দেবরাজা।।
পাঞ্চাল দেশেতে পাঞ্চালীর স্বয়ম্বরে।
জিনিলেক লক্ষ লক্ষ রাজা একেশ্বরে।।
একেশ্বর হেন জনে জিনিবারে ‍চাহ।
যেই মূর্খ নাহি জানে তার আগে কহ।।
গলে শিলা বান্ধি চাহ জলনিধি তরি।
গারুড়ি না জানি সর্প মুখে হাত ভরি।।
ত্রয়োদশ বর্ষ সবে নিয়ম পালিল।
পাইয়া শত্রুর ঘ্রাণ হেথায় আসিল।।
মেঘ হৈতে মুক্ত যেন হইল মিহির।
তাদৃশ আসিল দেখ পার্থ মহাবীর।।
একেশ্বর কেবা আছে এ তিন ভুবনে।
যুদ্ধে জয় করিবেক পাণ্ডব অর্জ্জুনে।।
ভীষ্ম দ্রোণ তুমি আমি দ্রৌণি দুর্য্যোধন।
ছয়জন যুদ্ধে যদি পারি কদাচন।।
মহাক্রোধে কৃপাচার্য্যে বহে ঘন শ্বাস।
অগ্নি হেন জ্বলে না কহিল অন্য ভাষ।।
২৮. অশ্বত্থামা কর্ত্তৃক কর্ণকে র্ভৎসনা
মাতুলের বচনান্তে অশ্বত্থামা বলে।
শরীর জ্বলিছে সূর্য্যপুত্র-বাক্যজালে।।
গবী নাহি লই, নাহি করি কোন কার্য্য।
সীমান্ত না হই, নাহি যাই নিজ রাজ্য।।
এতেক যে গর্ব্ব করে রাধার নন্দন।
কোন্ কর্ম্ম করি বলে, না জানি কারণ।।
বহু শাস্ত্র শুনিয়াছি কথা পুরাতন।
ক্ষিতিমধ্যে হইয়াছে বহু রাজগণ।।
মায়াদ্যূত বলে কেহ নাহি ভুঞ্জে ক্ষিতি।
তুমি যথা পররাজ্যে হইলে নৃপতি।।
ইন্দ্রপ্রস্থে রাজা হৈলে কোন্ যুদ্ধে জিনি।
কোন্ তেজে ধরিয়া আনিলে যাজ্ঞসেনী।।
জিনিলে কি যুধিষ্ঠিরে ভীম ধনঞ্জয়ে।
কিম্বা যুদ্ধে জিনিয়াছ মাদ্রীর তনয়ে।।
চারি জাতি বিধি ভূমে করিল সৃজন।
যে ‍যাহার জাতিধর্ম্ম করিবে পালন।।
পড়িবে পড়াবে, যজ্ঞ করিবে ব্রাহ্মণ।
বাহুবলে ক্ষত্রিয়েরা করিবে শাসন।।
কৃষি করিবেক বৈশ্য বাণিজ্য ব্যাপার।
ব্রাহ্মণে সেবিবে শূদ্র, নীতি বিধাতার।।
অশক্ত বৃত্তিতে নিজ অধর্ম্ম আচারী।
ইতর জনের প্রায় করিয়া চাতুরী।।
ইহাতে পৌরুষ এত শোনা নাহি যায়।
ধর্ম্মবন্ত পাণ্ডুপুত্র ক্ষমিল তোমায়।।
তোমারে আচার্য্য-বাক্য সহিবে কেমনে।
চন্দনেতে প্রীতি কোথা শীত-ভীত জনে।।
স্ত্রীধর্ম্মে আছিলা কৃষ্ণা একবস্ত্র পরি।
সভামধ্যে বিবসনা কৈলে কেশে ধরি।।
কোন্ পরাক্রমে তুমি কৈলে হেন কর্ম্ম।
পৃথিবীতে খ্যাত আছে তব ক্ষত্রধর্ম্ম।।
ধর্ম্মশাস্ত্র সত্য যদি, সত্য আছে ক্ষিতি।
ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠির হবে ক্ষিতিপতি।।
যে সভায় সভাসদ্ রাধার নন্দন।
তথায় কিরূপে হবে আচার্য্য শোভন।।
তিন লোক মধ্যে বসে যত যত জন।
অর্জ্জুন অজেয়, হেন কহে মুনিগণ।।
বাসুদেব সব পরাক্রমে মহাতেজা।
কোন্ জন আছয়ে, না করে তার পূজা।।
ধর্ম্মবিজ্ঞ জন হেন কহে শাস্ত্রমত।
পুত্রে স্নেহ যথা হয়, শিষ্যে সেইমত।।
সে কারণে আচার্য্যের পাণ্ডুপুত্রে প্রীত।
গুপ্ত কথা নহে ইহা জগতে বিদিত।।
পার্থ সহ আচার্য্যের দ্বন্দ্বে কোন্ কার্য্য।
পাশা খেলিবার পূর্ব্বে বৈল কি আচার্য্য।।
ইন্দ্রপ্রস্থ নিলে পূর্ব্বে যেই যুদ্ধে জিনে।
সেই যুদ্ধ বিধান না কর আজি কেনে।।
এই ত আছয়ে তব মাতুল শকুনি।
তাহার সহায় নিলে জিনিতে অবনী।।
সে পাশায় প্রতিকার মরণ বিহিত।
অর্জ্জুন দিবেক আজি ফল সমুচিত।।
ক্রোধেতে আচার্য্য-পুত্র কাঁপে থর থর।
কাশী কহে, রক্ষ তুমি দেব দামোদর।।
২৯. দ্রোণের সহিত কর্ণের বাগবিতণ্ডা
ও ভীষ্ম কর্ত্তৃক সান্ত্বনা
এইরূপে দুই মুখে শুনি কটূত্তর।
ক্রোধমুখে কহে তবে কর্ণ ধনুর্দ্ধর।।
জানিয়াছি আমি তোমা সবাকার মতি।
ভয়েতে পাণ্ডবগণে করহ ভকতি।।
উদর পূরিয়া ভোজ্য খাইবারে পার।
যুদ্ধকাল দেখি এবে সমরেতে ডর।।
যাহ বা থাকহ তুমি, যেই লয় মন।
সহজে ভিক্ষুক তুমি, জাতিতে ব্রাহ্মণ।।
ভিক্ষাজীবী সনে দ্বন্দ্ব কোন্ প্রয়োজন।
যথা যাও তথা হবে উদর ভরণ।।
যজ্ঞ নিমন্ত্রণে পিণ্ডজীবী যেই জন।
তাহার সহিত দ্বন্দ্বে কোন্ প্রয়োজন।।
যাহ তুমি যথা ইচ্ছা, কেহ নাহি রাখে।
মম পরাক্রম আজি দেখিবেক লোকে।।
কর্ণের এতেক বাক্য দ্রোণ গুরু শুনি।
ক্রোধে কম্পে অঙ্গ, নেত্রে নির্গত আগুনি।।
বুঝিয়া বিষম কার্য গঙ্গার নন্দন।
কৃতাঞ্জলি করি বলে দ্রোণেরে বচন।।
মোরে দেখি ক্ষম এবে গুরু মহাশয়।
মূর্খ জন জানি তাপ খণ্ডাহ হৃদয়।।
সাধু সুপণ্ডিত হইবেক যেই জনে।
অজ্ঞানের অপরাধ নাহি শুনে কাণে।।
চন্দ্র সূর্য্য তেজ যথা সর্ব্বত্র সমান।
সেইরূপ ব্রাহ্মণের সর্ব্বে সমজ্ঞান।।
ক্ষমহ আচার্য্য-পুত্র, ক্রোধকাল নয়।
শত্রু উপস্থিত হৈল, যুদ্ধের সময়।।
ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ বলি সর্ব্বলোকে জানে।
দুর্য্যোধনে অন্ধ বলি জানহ এক্ষণে।।
সাক্ষাতে গাণ্ডীব ধনু শুনেছি টঙ্কার।
তথাপিহ বলে রাজা অন্য কেহ আর।।
পশুমাত্রে ঘ্রাণে জানে নিজ বৈরিগণে।
পশুর সদৃশ জ্ঞান নাহি দুর্য্যোধনে।।
আরেরে দুর্ম্মতিগণ আচার্য্যে নিন্দহ।
অহঙ্কারে ছন্ন হয়ে কিছু না দেখহ।।
এক সূর্য্য তেজ অঙ্গে সহনে না যায়।
তোমার আছয়ে শত্রু পঞ্চ সূর্য্যপ্রায়।।
উদয় হইল আসি পঞ্চ বিকর্ত্তন।
কিমতে না কবে ইহা জ্ঞানবন্ত জন।।
এত বলি গঙ্গাপুত্র দ্রোণে নমস্করি।
সান্ত্বাইলা পিতা পুত্রে বহু স্তব করি।।
তবে দুর্য্যোধন বহু বিনয় বচনে।
করযোড়ে দাণ্ডাইল গুরু-বিদ্যমানে।।
ক্ষমহ আচার্য্য, অপরাধ করিলাম।
অজ্ঞান হইয়া আমি তোমা নিন্দিলাম।।
দ্রোণ বলে, তব প্রতি নাহি করি ক্রোধ।
পূর্ব্বেই ভীষ্মের বাক্যে হয়েছে প্রবোধ।।
তবে দ্রোণ চাহি বলে যত বীরগণে।
উপায় করহ শীঘ্র উপস্থিত রণে।।
এক কাজে আসিলাম হৈল অন্য কাজ।
দৃঢ়মতে থাক যেন নহে পাছু লাজ।।
শুনি দুর্য্যোধন জিজ্ঞাসিল পিতামহে।
এই যদি ধনঞ্জয় সর্ব্বলোকে কহে।।
ত্রয়োদ্শ বর্ষ তবে নিয়ম করিল।
না হইতে পূর্ণ যদি আসি দেখা দিল।।
ইহার বিধান কেন না কর আপনে।
এয়োদশ বর্ষ পুনঃ যাবে সবে বনে।।
ভীষ্ম বলে, পূর্ণ হৈল বর্ষ ত্রয়োদশ।
অধিক হইল আর দিন সপ্তদশ।।
দ্বিপক্ষেতে মাস, পক্ষ পঞ্চদশ দিনে।
দ্বাদশ মাসেতে হয় বৎসর প্রমাণে।।
এমত নিয়মে হয় বৎসর বঞ্চিল।
তবু সপ্তদশ দিন অধিক হইল।।
পঞ্চবর্ষে দুই মাস অধিক যে হয়।
তাহা সহ পূর্ব্বে নাহি করিলে নির্ণয়।।
নিয়ম করিয়াছিল তাহা গোঁয়াইল।
সময় পাইয়া আসি উদয় হইল।।
একে ত পাণ্ডুর পুত্র সবে ধর্ম্মবন্ত।
তার জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির গুণে নাহি অন্ত।।
অনন্ত দুষ্করকর্ম্ম দয়াশীল লোকে।
মৃত্যু ইচ্ছে, তবু মিথ্যা নাহি কহে মুখে।।
নিশ্চয় অর্জ্জুন এই, জন নরপতি।
ইহার উপায় রাজা কর শীঘ্রগতি।।
পৃথিবী দলিতে পার্থ পারে একেশ্বরে।
কি ছার কৌরব তার সহিতে সমরে।।
সে কারণে কহি তোমা শুন দুয্যোধন।
এখন করহ প্রীতি যদি লয় মন।।
দুর্য্যোধন বলে, হেন না কহিও আর।
জীয়ন্তে পাণ্ডব সহ কি প্রীতি আমার।।
নাহি ভাগ দিব আমি, যুদ্ধ মোর পণ।
ইহা জানি সমুচিত করহ আপন।।
শুনি ভীষ্ম দিব্য ব্যূহ করিল রচন।
যোদ্ধাগণে বিচারিয়া ‍রাখে স্থানে স্থান।।
মধ্যেতে রহিল দ্রৌণি, দ্রোণ সব্য-ভিতে।
কৃপাচার্য্য আচার্য্যের রহিল বামেতে।।
দ্রোণরথ-রক্ষী হৈল বহু মহারথী।
বিকর্ণ সৌবল আর বীর বিবিংশতি।।
সর্ব্বসৈন্য-অগ্রে সূতপুত্র মহাবল।
পাছু রহিলেন ভীষ্ম রক্ষা হেতু দল।।
মধ্যেতে করিয়া গবী রাজা দুর্য্যোধন।
চতুর্দ্দিকে সাবধানে রহে সৈন্যগণ।।
দৃঢ় অস্ত্রধারী রক্ষী রহে ব্যূহমুখে।
চন্দ্রাকার ব্যূহ রচে দুর্ভেদ ত্রিলোকে।।
পীযূষ-পয়োধি সম বিরাটপর্ব্ব-কথা।
বেদব্যাস বিরচিত অপরূপ গাথা।।
ব্যাস-পদে নহি, কৃষ্ণ-পদে অভিলাষ।
পয়ার প্রবন্ধে রচে কাশীরাম দাস।।
৩০. ব্রাহ্মণ মাহাত্ম্য
প্রণমহ দ্বিজ, পদ-সরসিজ,
সৃজন পালন নাশা।
সর্ব্বত্র সুখদ, মহিমা যে পদ,
অধোক্ষজ বক্ষে ভূষা।।
যে পদ-সলিল, যেই সাধু পিল,
তরিল দুঃখ পিপাসা।।
অবনী অবধি, যতেক তীর্থাদি,
যে পদে সবার বাসা।।
ভবার্ণব প্লব, যে পদ পল্লব,
লক্ষ্মী-বশকারি ধূলি।।
আয়ুর্যশঃপ্রদ, অজয় সম্পদ,
পাইতে যাহারে বলি।।
বর্ণিতে কি শক্য, দুর্নিবার বাক্য,
পুণ্ডরীকাক্ষাদি জনে।
বজ্রে করে চূর, ভস্মের অঙ্কুর,
তিনপুর ভয় মানে।।
ইন্দ্র যাঁর বাক্যে, হৈল সহস্রাক্ষে,
সকল ভক্ষ হুতাশ।
যে বাক্যে ভার্গবী, ত্যজি স্বর্গদেবী,
সিন্ধুজলে কৈলা বাস।।
অপ্রমিত তেজ, অজিত বংশজ,
ইঙ্গিতে করিল ধ্বংস।
বিন্ধ্য হৈল ক্ষুদ্র, শুষিল সমুদ্র,
দহিল সগরবংশ।।
ভজ সাধুচেতা, ত্যজ সর্ব্বকথা,
খণ্ডিবে দণ্ডীর পাশী।
জীবনে মরণে, ব্রাহ্মণ-চরণে,
শরণ লইল কাশী।।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র