ভীমসেন

ভীমসেন :পান্ডুর ক্ষেত্রজ তৃতীয় পুত্র। যুধিষ্ঠিরকে লাভ করার পর পান্ডু এক মহাবলবান পুত্র লাভের আশায় কুন্তিকে তার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। কুন্তি মন্ত্রবলে বায়ুকে আহ্বান করে বলেন তাকে এক বলশালী পুত্র দেয়ার জন্য। কুন্তির প্রার্থনায় তার গর্ভে শতহস্তির শক্তি সম এক পুত্রের জন্ম হয়। দাঁড়ি গোফ ছিল না বলে কর্ণ তাকে মাকুন্দ বলে তামশা করতেন। বাল্যকাল হতে ভীমের সহিত দূর্যোধনাদির ক্রীড়া, কৌতুক ও ঝগড়া সর্বদাই হতো। ভীমের অত্যধিক শারীরিক শক্তি দূর্যোধনাদির পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ভীমের শক্তির কাছে তারা সব সময় হার মানত।

বাল্যকালে দুর্যোধনাদি জলক্রীড়ার ছলে ভীমকে বিষমিশ্রিত মিষ্টান্ন ভোজনের পর অজ্ঞান ভীমকে জলে নিক্ষেপ করেন। নাগরাজ বাসুকীর কৃপায় তিনি আটটি রসায়ন-কুন্ড পান করে অযুত হস্তীর শক্তি সঞ্চয় করে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। গুরুদ্রোণের দক্ষিণাস্বরূপ পাঞ্চাল রাজ্যে বিজয়ে ভীমের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। জতুগৃহে পান্ডবদের পুড়িয়ে হত্যা করার ষঢ়যন্ত্র বিদূরের সাবধান বাণী অনুধাবন করতে পেরে দূর্যোধনের চক্রান্ত নিষ্ফল হয়। ভীম মাতা কুন্তিকে স্কন্ধে তুলে, নকুল ও সহদেবকে ক্রোড়ে তুলে, যুধিষ্ঠির ও অর্জুনের হাত ধরে মহাবেগে গঙ্গা তীরে উপস্থিত হন। নৌকাযোগে তারা গঙ্গা পার হয়ে এক অরণ্যে প্রবেশ করেন। তথায় ভীম জাগ্রত থেকে সকলে নিদ্রা যান। হিড়িম্বার সহায়তার ভ্রাতা হিড়িম্বকে হত্যা করে ভীম হিড়িম্বাকে বিবাহ করেন।

তারপর পান্ডবরা একচক্রা নগরে এক ব্রাহ্মণের গৃহে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সে নগরে বক নামে এক রাক্ষস বাস করতো। সে নগর রক্ষার জন্য পালাক্রমে মানুষ ভক্ষণ করতো। ঘটনাক্রমে সেদিন ব্রাহ্মণের পালা ছিল, পরিবারের মধ্যে ক্রন্দের রোল উঠলে কুন্তি তা অবগত হয়ে ভীমকে বকের কাছে প্রেরণ করেন। ভীম ব্রাহ্মণের বেশ ধরে বককে হত্যা করে একচক্রাবাসীকে রক্ষা করেন। এখানেই পান্ডবরা দৌপদীর স্বয়ংবরের কথা জানতে পারেন।

পান্ডবরা ইন্দ্রপ্রস্থে তাদের রাজধনী স্থাপন করেন। মহর্ষি নারদের পরামর্শে যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞোর আয়োজন করেন। মগধরাজ জরাসন্ধ রাজসূয় যজ্ঞ বিঘ্ন ঘটাতে পারে জেনে ভীম ও অর্জুন নিয়ে মগধে উপস্থিত হন। সেখানে ১৪ দিন মল্ল যুদ্ধের পর ভীম জরাসন্ধের দু পা ধরে তার শরীর দ্বিধাবিভক্ত করে তাকে হত্যা করেন।

রাজসূয় যজ্ঞ আরম্ভ করার পূর্বে ধনরত্ন সংগ্রহের জন্য পান্ডবগণ দিগ্বিজয়ে বের হন। ভীম পূর্বদিকে পাঞ্চাল, বিদেহ, দশার্ণ, চেদি, কোশল, অযোধ্যা প্রভৃতি রাজ্য জয় করে ধনরত্ন সংগ্রহ করে ইন্দ্রপ্রস্থে আগমন করেন।

হস্তিনাপুরের দুর্যোধনের দ্যুতসভায় শকুনির ছলনায় যুধিষ্ঠির সর্বশান্ত হন। সবশেষে শকুনির তিরস্কারে দ্রৌপদীকে দ্যূতক্রীড়ায় পণ রেখে তাকেও হারান। অক্ষক্রীড়ার পণ অনুযায়ী নিজেরাও শকুনি কর্তৃক বিজিত হন। দুর্যোধনের আদেশে ভ্রাতা দু:শাসন দ্রৌপদীকে চুলের মুঠি ধরে টেনে হিঁচড়ে দ্যুত সভায় নিয়ে আসেন। মহাবীর কর্ণের ইঙ্গিতেই দু:শাসন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করতে উদ্যত হন। দ্রৌপদীর কাতর প্রার্থনায় বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ তার অন্তরঙ্গা শক্তির প্রভাবে শত শত কাপড় দিয়ে দ্রৌপদীকে আবৃত করে রাখেন। দু:শাসন হাজার চেষ্টা করেও দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করতে পারেনি। দুর্যোধন দ্রৌপদীকে বাম উরু দেখিয়ে অপমান করেন। তখন ভীম তার বাম উরু ভাঙ্গার এবং দু:শাসনের রক্ত পান করার প্রতিজ্ঞা করেন।

কাম্যকবনে বাস করার সময় বকের ভ্রাতা নিধনের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য কির্মীর রাক্ষস পান্ডবদের আক্রমন করলে ভীম তাকে হত্যা করেন। স্থূল বুদ্ধির জন্য ভীম যুধিষ্ঠিরকে অল্প ধর্ম ত্যাগ করে অকপটতার দ্বারা শক্র জয়ের পরামর্শ দেন কিন্তু যুধিষ্ঠিরের যুক্তির কাছে ভীম নত স্বীকার করে। বদরিকাশ্রমে বাসকালে একবার গঙ্গায় পদ্ম ভাসতে দেখে সে রকম আর অনেক পদ্ম আনার জন্য দ্রৌপদী ভীমে বলেন। ভীম সে পদ্ম আনার জন্য গন্ধমাদন পর্বতে যান। সেখানে হুমানের সহিত সাক্ষাৎ হয়। হুনমানের সহায়তার কুবেরের ভবনের এক নদী থেকে কুবেরদের পরাস্ত করে পদ্ম নিয়ে আসেন। জটাসুর নামে এক রাক্ষস পান্ডবদের সাথে ব্রাহ্মণ বেশে বাস করতো। ভীম একদিন মৃগায় গেলে জটাসুর পান্ডাবদের অস্ত্রশস্ত্রসহ যুধিষ্ঠির, নকুল, সহদেব ও দ্রৌপদীকে হরণ করে। ভীম মৃগয়া হতে ফির জটাসুরকে বধ করে। বনবাসের একাদশ বছরে যখন পান্ডবরা যমুনার উৎপত্তিস্থলের নিকট বিশাখয়ুপবনে বাসকালে অগস্ত্য মুনি শাপে অজগররূপী নহুষ ভীমকে বেষ্টন করে ভক্ষণ করতে উদ্যত হন। তখন যুধিষ্ঠির বিভিন্ন অমঙ্গলসূচক লক্ষ্মণ দেখে ভীমের সন্ধানে বের হন। বিশাখয়ুপবনে গিয়ে দেখেন অজগর ভীমকে বেষ্টন করে আছে তখন ‍যুধিষ্ঠির ভীমকে ছেড়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্ত অজগরের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ভীমকে মুক্ত করেন। একবার কাম্যক বনে বাসকালে জয়দ্রথ দ্রৌপদীকে হরণ তরলে ভীম ও অন্যান্য পান্ডব মিলে জয়দ্রথকে লাঞ্চিত করে এবং ভীম তাকে মাথ্যা ন্যাড়া করে দেন। একদিন কোন এক পর্ব উপলক্ষে সুদেষ্ণা দ্রৌপদীকে কীচকের ভবনে প্রেরণ করলে কীচক দ্রৌপদীকে স্পর্শ করেন। দ্রৌপদী কীচকে সজোরে ধাক্কা মেরে বিরাটের রাজ সভায় উপস্থিত হন। সাথে সাথে কীচকও সভায় উপস্থিত হয়ে দ্রৌপদীর কেশাকর্ষণ করে পদাঘাত করেন। কিন্তু বিরাট কীচকের ভয়ে ও পান্ডবদের পরিচয় প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ভয়ে নিরবতা পালন করেন। দ্রৌপদী এ অপমানের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ভীমকে অনুপ্রাণিত করেন এবং ভীম কীচককে হত্যা করেন। কীচকের মৃতদেহ শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার সময় কীচকের ভ্রাতৃদ্বয় দ্রৌপদীকে দেখে জোরপূর্বক শ্মশানে নিয়ে একই চিতায় দগ্ধ করার জন্য। দ্রৌপদী পান্ডবদের ছদ্মনামে চিৎকার করে ডাকতে থাকলে ভীম সে ডাক শুনে শ্মশানে উপস্থিত হয়ে সমূলে বৃক্ষ উৎপাটন করে কীচক ভ্রাতৃদ্বয়কে বধ করেন। কীচকের হত্যার প্রতিশোধ নিতে ত্রিগর্তরাজ সুশর্মা দুর্যোধনের সহায়তার বিরাট রাজার গো-ধন হরণ করে বিরাটকে বন্ধী করেন। তখন যুধিষ্ঠিরের নির্দেশে ভীম সুশর্মাকে পরাজিত করে বিরাট ও তার গো-ধন উদ্ধার করেন। কুরুক্ষেত্রের প্রথম দিনের যুদ্ধ ভীমকে অগ্রবর্তী করে পান্ডব সেনারা ধাবিত হলো। দ্বিতীয় দিনের যুদ্ধে ভীমের হাতে কলিঙ্গরাজ শ্রুতায়ু ও তার দুই পুত্র সৈন্যসহ নিহত হন। ষষ্ঠ দিনে দ্রোণাচার্য ও দুর্যোধনের সহিত ভীষণ যুদ্ধ হলো। ভীমের শরাঘাতে দুর্যোধনের ধনু ছিন্ন হলো, সারথি আহত হলো, চার অশ্ব নিহত হলো এবং দুর্যোধন নিজে শরাঘাতে মূর্ছিত হলেন। চতুর্দশ দিনে ভীমের সাথে দ্রোণাচার্যের তুমুল যুদ্ধ হয়। ভীমের গদাঘাতের দ্রোণের সারথি আহত হন ও রথ বিনষ্ট হয়। ভীমে সাথে দুর্যোধনের ভ্রাতা বিন্দ, অনুবিন্দ, সুবর্মা ও সুদর্শন যুদ্ধ করতে এসে নিহত হন। এভাবে ভীম দুর্যোধনের একত্রিম জন ভ্রাতাকে বধ করেন। কর্ণের সাথে ভীমের যুদ্ধ হয়। কর্ণে শরাঘাতে ভীম মূর্ছিত হন। মাতা কুন্তির বাক্য স্মরণ করে কর্ণ ভীমকে হত্যা করলেন না। সপ্তদশ দিনে ভীমের সহিত দু:শাসনের তুমুল যুদ্ধ হয় এবং শেষতক দু:শাসনকে নিহত করে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করলেন।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ। একদিন অশ্বত্থামা কৃপাচার্য ও কৃতবর্মার সহায়তায় পান্ডব শিবিরে প্রবেশ করে দ্রৌপদীর পাঁচপুত্রসহ পান্ডব সেনাদের হত্যা করেন। পুত্রদের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের নিকট এসে প্রায়োপবেশনে প্রাণত্যাগ করতে কৃতসংকল্প হন। যুধিষ্ঠির তাকে ধৈর্য ধরতে বলেন। দ্রৌপদী বলেন অশ্বত্থামাকে হত্যা করে তার মাথার মণি এনে দিলেই তবেই তার শোক সংবরণ হবে। তখন পান্ডব ও কৃষ্ণ অশ্বত্থামার ব্রহ্মশির অস্ত্রের কথা স্মরণ করে তাকে অনুসরণ করেন এবং তাকে হত্যা করে মাথার মণি নিয়ে আসেন।

যুধিষ্ঠির ভীমকে হস্তিনাপুরের যুবরাজ ঘোষণা করেন এবং দুর্যোধনের প্রাসাদ দান করেন। মহাপ্রস্থানের সময় ভীমও অতি ভোজন ও আত্ন প্রসংসার জন্য পতিত হন। দ্রৌপদীর গর্ভে ভীমের সুতসোম নামে এক পুত্র হয়। তাছাড়া হিড়িম্বার গর্ভেও ঘটোৎকচ নামে এক পুত্র হয়।

মহাভারতের কাহিনীতে প্রতিশোধ নেয়ার প্রবণতা কমে-বেশী সকলের চরিত্রেই আছে। বিশেষ করে ভীমের চরিত্রে বেশী। গদা চালনায় ভীম অদ্বিতীয়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভীমের ভূমিকা অসামান্য। তিনি একাই ধৃতরাষ্ট্রের শত পুত্র নিধন করেন। ভীমের দৈহিক আকৃতি ছিল বিরাট এবং দেহে ছিল অপরিমিত শক্তি। বাহুবল, বৃষস্কন্ধ, উন্নতবক্ষ ও অযুত হস্তীর ন্যায় বলশলী ছিলেন তিনি। ভীম ভোজন রসিক ছিলেন। অত্যধিক খাবার খেতে পারতেন। এর জন্য তার আরেক নাম বৃকোদর(বৃক নামক অগ্নি যার উদরে অবস্থিত)। ভীমের দেহও স্থূলকায় এবং বুদ্ধিও স্থুল। ভ্রাতাদের মাঝে ভীম যখন কথা বলতেন তখন সকল ভ্রাতাই হেসে উঠতেন। ধৃতরাষ্ট্রসহ দুর্যোধনাদি পান্ডবদের সাথে যে আচরণ করেছে ভীম তা কখনও ভুলতে পারেনি। ভীমের গঞ্জনা সহ্য করতে না পেরে ধৃতরাষ্ট্র বনবাসী হন।
সূত্র : মহাভারত ও বিভিন্ন পৌরানিক উপাখ্যান

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র