০১. যুধিষ্ঠিরের উদ্বেগ ওব্যাসদেবের উপদেশ প্রদানজিজ্ঞাসেন জন্মেজয় কহ তপোধন।কি কি কর্ম্ম করিলেন পিতামহগণ।।মুনি বলে শুন তবে শ্রীজনমেজয়।রাজ্যে রাজা হইলেন ধর্ম্মের তনয়।।কিন্তু উপরোধে রাজ্য নিয়া যুধিষ্ঠির।প্রজাগণ পালন করেন ধর্ম্মবীর।।রামের পালনে যেন অযোধ্যার প্রজা।সেইমত প্রজার পালক মহাতেজা।।রাজ্যভোগ যুধিষ্ঠির না চাহেন মনে।সদাই থাকেন ধর্ম্ম বিরস বদনে।।ভীমার্জ্জুন সহদেব নকুল সুমতি।লইয়া করেন যুক্তি ধর্ম্ম নরপতি।।শুনহ অর্জ্জুন তুমি আমার বচন।স্থির নহে চিত্ত মম কিসের কারণ।।রাজ্য ধন দেখিয়া আমার নহে প্রীত।সতত চঞ্চল চিত্ত সদা হয় ভীত।।কি বুদ্ধি করিব আমি জিজ্ঞাসিব কায়।সর্ব্বদা ব্যাকুল চিত্ত না দেখি উপায়।।না হেরি নয়নে মোর কৃষ্ণ কালাচাঁদে।চঞ্চল চকোর চিত্ত প্রাণ সদা কাঁদে।।দ্বারকানগরে তিনি গেলেন সম্প্রতি।কে আর করিবে দয়া পাণ্ডবের প্রতি।।অতএব উঠে চিত্তে অনেক জঞ্জাল।সর্ব্ব শূন্য দেখি সখে না হেরি গোপাল।।অর্জ্জুন কৃষ্ণ তুমি করিলে স্মরণ।যুধিষ্ঠির স্থির হইলেন সেই বোলে।।ব্যাসদেব তথা আইলেন হেনকালে।তাঁরে দেখি উঠিলেন ধর্ম্মের নন্দন।।ভূমিষ্ঠ হইয়া তাঁর বন্দেন চরণ।আশীর্ব্বাদ করিলেন রাজা যুধিষ্ঠিরে।।জানিয়া সকল তত্ত্ব জিজ্ঞাসেন তাঁরে।কহ রাজা কি কারণে বিরস বদন।।তোমায় দেখিয়া মম বিচলিত মন।অকৌরবা পৃথিবী করিলে বাহুবলে।।তোমা সম রাজা নাহি এ মহীমগুলে।অনুজ অর্জ্জুন তব ভীম মহাবলী।।আর তাহে সহায় আপনি বনমালী।তোমা বিষাদিত আমি দেখি কি কারণ।।এত যদি কহিলেন ব্যাস তপোধন।বিনয়ে কহেন তবে ধর্ম্মের নন্দন।।শুন মুনি আমারে না করিও প্রশংসা।বড়ই নিন্দিত আমি মন্দ মম দশা।।লোভের কারণে ধর্ম্মপথ পরিহরি।করিলাম অন্যায় যে কহিতে না পারি।।পিতামহ ভীষ্মেরে করিলাম সংহার।আমার সমান কোন পাপী আছে আর।।গুরু দ্রোণাচার্য্য তিনি হয়েন ব্রাহ্মণ।নাশ করিলাম তাঁরে শুন তপোধন।।সহাদর কর্ণবীরে অর্পিনু শমনে।বধিলাম শত ভ্রাতৃ সহ দুর্য্যোধনে।।আর যত সুহৃদ বান্ধবগণ ছিল।রাজ্যলোভে আমা হৈতে যমদ্বারে গেল।।অভিমন্যু দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্রগণ।রাজ্য হেতু নাশিলাম শুন তপোধন।।এমন নিন্দিত কর্ম্ম কেহ নাহি করে।না বুঝিয়া মহামুনি প্রশংস আমারে।।ব্যাস বলিলেন শুন ধর্ম্মের নন্দন।শুনিলাম আমি যত তোমার কথন।।জ্ঞাতি গুরু ভ্রাতৃ বন্ধু মারিয়াছ তুমি।কিন্তু ক্ষন্ত্রিয়র ধর্ম্ম শুন নৃপমণি।।ব্রাহ্মণ ক্ষন্ত্রিয় বৈশ্য আর শূদ্র জাতি।এ সব ব্রহ্মার দেহে হৈল উৎপত্তি।।যথাযোগ্য ধর্ম্মে নিয়োজিল চারিজনে।সংগ্রাম ক্ষত্রিয় ধর্ম্ম লিখিত পুরাণে।।তুমি বল নিন্দা কর্ম্ম করিলাম আমি।কিন্তু ইহা স্মরণেতে মুক্ত হয় প্রাণী।।যুধিষ্ঠির পুনশ্ছ কহেন মতিমান।শুন প্রভু ক্ষন্ত্রধর্ম্ম কহিলা প্রমাণ।।জ্ঞাতিবধ পাপে মম কাঁদিতেছে প্রাণ।কি করিব কহ মুনি ইহার বিধান।।কি কর্ম্ম করিলে পাপ যাইবেক দূরে।অনুকূল হয়ে মুনি কহিবে আমারে।।কোন্ মন্ত্র জপিব করিব কোন্ ধ্যান।কোন্ যজ্ঞ করি কহ মুনি মতিমান।।দ্রোণ জিজ্ঞাসিল করি আমাতে বিশ্বাস।শুনি মুনি তাঁরে আমি কহি মিথ্যা ভাষ।।কিমতে এ সব পাপে পাব পরিত্রাণ।এ নহে ক্ষত্রিয় ধর্ম্ম শুন মতিমান।।ব্যাস বলিলেন রাজা দুঃখ ভাব কেনে।ক্ষন্ত্রিয় প্রধান ধর্ম্ম বিদিত পুরাণে।।যুধিষ্ঠির বলিলেন শুন মহাশয়।পুণ্যকর্ম্ম ব্যতিরেকে পাপ নহে ক্ষয়।।জ্ঞাতিবধে পাপভয় হয় নিরন্তর।কি উপায় করিব বলহ মুনিবর।।তবে ব্যাস কহিলেন শুনহ রাজন।অশ্বমেধ যজ্ঞ কর ধর্ম্মের নন্দন।।অশ্বমেধ যজ্ঞে হয় পাপের বিনাশ।মন দিয়া শুন রাজা কহি ইতিহাস।।মহাবীর ছিল জমদগ্নির কুমার।নিঃক্ষত্রা করিল ক্ষিতি তিন সপ্তবার।।পিতায় আজ্ঞায় তেঁই বধিল জননী।বনপর্ব্বে সেই কথা শুনিয়াছ তুমি।।অশ্বমেধ যজ্ঞে তাঁর পাপ গেল দূরে।এ সব শাস্ত্রের কথা কহি যে তোমারে।।ত্রেতাযুগে প্রভু হইলেন অবতার।আপনি শ্রীধাম দশরথের কুমার।।পালিতে পিতার সত্য চলিলেন বনে।বনে ভ্রমিলেন সতী লক্ষণের সনে।।আদ্যোপান্ত রামায়ণ শুনিয়াছ তুমি।অশ্বমেধ করিলেন শ্রীরাম আপনি।।আর অশ্বমেধ করিলেন পুরন্দর।ব্রহ্মবধ পাপে মুক্ত তাঁর কলেবর।।তুমিও করহ রঙ্গ অশ্বমেধ ক্রতু।জ্ঞতিবধ মহাপাপ এড়াবার হেতু।।এত যদি কহিলেন ব্যাস তপোধন।যোড়হস্তে বলিলেন ধর্ম্মের নন্দন।।অশ্বমেধে পাপ দূর কহলা আপনি।যজ্ঞ কৈল যত জন শুনিলাম আমি।।তা সবার সম নহে আমার ক্ষমতা।শুন মহামুনি ইহা না হয় সর্ব্বথা।।নির্দ্ধন নৃপতি আমি নাহি এত ধন।কিমতে হইবে মুনি যজ্ঞ সমাপন।।দুর্য্যোধন বিবাদেতে অর্থ হৈল ক্ষয়।কিমতে হইবে যজ্ঞ মুনি মহাশয়।।অশ্বমেধ হবে হেন না দেখি উপায়।বিবরিয়া মহামুনি কহিবা আমায়।।ফলহীন বৃক্ষ যেন ত্যজে পক্ষিগণ।অর্থহীন পুরুষেরে ছাড়ে সর্ব্বজন।।ধনহীন পুরুষের ধর্ম্ম নাহি হয়।ধন হৈতে ধর্ম্ম হয় মুনিগণ কয়।।হেন ধন নাহি মম কিসে হবে যজ্ঞ।কিমতে তরিব পাপে কহ মহাবিজ্ঞ।।ব্যাস বলিলেন শুন ধর্ম্মের নন্দন।কার্য্যে কর্ম্মে বদ্ধ হৈলে ধনে প্রয়োজন।।তবে ধনে ধর্ম্ম হয় ইথে নাহি আন।শুন রাজা কহি তোমা ধনের সন্ধান।।মরুত নামেতে এক ছিল নরবর।তার যজ্ঞ কথা কহি তোমার গোচর।।অশ্বমেধ করিল মরুত নরপতি।অদ্যপি তাঁহার যশ ঘোষে বসুমতী।।বিংশতি সহস্র বিপ্রে যজ্ঞেতে বরিল।সুবর্ণ আসন সব দ্বিজগণে দিল।।স্বর্ণ বাটি স্বর্ণ থালা স্বর্ণময় ঝারি।কাঞ্চন নির্ম্মাণ পাত্রে অন্নজল পূরি।।হেনমতে মরুত ব্রাহ্মণ সেবা করে।প্রত্যহ নূতন পাত্র দিল দ্বিজবরে।।হেনমতে যজ্ঞ কৈল শতেক বৎসর।মরুত সমান ধনী নাহি নৃপবর।।বহু ধন নিতে না পারিয়া দ্বিজগণ।হিমালয় পার্শ্বেতে রাখিল সর্ব্বধন।।তথা হৈত সেই ধন আনহ সত্বর।অশ্বমেধ হইবেক শুন নৃপবর।।ব্যাসের বচন শুনি ধর্ম্মের নন্দন।যোড়হস্ত করিয়া করিল নিবেদন।।শুন মহাশয় আমি যজ্ঞ না করিব।সে ধন ব্রহ্মস্ব, আমি কেমনে আনিব।।পাপ বিনাশিতে চাহি যজ্ঞ করিবারে।আনিতে বিপ্রের ধন বল কি প্রকারে।।শুন মহামতি মম যজ্ঞে নাহি কায।শুনিলে হাসিবে সব নৃপতি সমাজ।।ব্রহ্মস্বতে বংশ রক্ষা হইবে কেমনে।কিমতে সে দ্রব্য আমি করিব গ্রহণে।।হাসিয়া বলেন ব্যাস শুনহ রাজন।দোষ নাহি নৃপতি আনিতে সেই ধন।।সে ধন ব্রাহ্মণগণ করিলেন ত্যাগ।ইথে দোষ না পরশে শুন মহাভাগ।।ভয় না করিহ তুমি ধর্ম্মের তনয়।অগ্নি জল পৃথিবী, এ ধন কার নয়।।শত শত রাজা পূর্ব্বে পৃথিবীতে ছিল।অনন্তরে কত কত আরো রাজা হৈল।।বাহুবরে পৃথিবীর করিল পালন।নানা যজ্ঞ করিলেক পেয়ে নানা ধন।।সেই ধন জল অগ্নি হ্রাস নাহি হয়।ইথে কেন কর ভয় ধর্ম্মের তনয়।।পূর্ব্বেতে দেবতাসুর ছিল দুই ভাই।এ ধন ধরণী যত অসুরেতে পাই।।তবে দেব, অসুরে মারিল বাহুবলে।এই ধন নিতে আজ্ঞা কৈল কুতূহলে।।সাবর্ণি নামেতে হৈল সূর্য্যের নন্দন।পৃথিবী পাইল রাজা তপের কারণ।।বশ করি বসুমতী পালিলেক প্রজা।হেনমতে সূর্য্যবংশে হৈল কত রাজা।।তা সবার দান যজ্ঞ বিদিত সংসারে।এ সব তপের তেজ জানাই তোমারে।।হরিশ্চন্দ্র মহারাজ খ্যাত ত্রিভুবনে।সকল পৃথিবী দান দিলেন ব্রাহ্মণে।।ব্রহ্মস্ব হইল তবে যেই বসুমতী।তবে কেন লইবেক ক্ষত্র নরপতি।।ব্রহ্মস্ব বলিয়া তার ভয় নাহি ছিল।ইহার কারণে কেবা রাজ্য না করিল।।তবে বিরোচন সুত বলি হৈল রাজা।ব্রাহ্মণেরে সপ্তদ্বীপ দিয়া করে পূজা।।আপনি পাতালে গেল না পাইয়া স্থান।দুষ্ট দেখি তারে বিড়ম্বিল ভগবান।।তবে যমদগ্নিসুত ভৃগু বংশপতি।শুনেছ তাঁহার কথা ধর্ম্ম নরপতি।।পৃথিবী জিনিয়া তিনি আনন্দিত মনে।পৃথিবী দিলেন দান মরীচি নন্দনে।।কশ্যপ পাইল তবে সব বসুমতী।আপন নন্দনে দিল করিয়া পীরিতি।।ধন ধরা অগ্নি জল ইহা কারো নয়।শুন যুধিষ্ঠির রাজা শাস্ত্রে হেন কয়।।পৃথিবী পালিয়া তার হয় নানা ধন।ভয় না করিহ তুমি ধর্ম্মের নন্দন।।সে ধন আনিয়া রাজা যজ্ঞ কর সুখে।ইথে দোষ নাহি আমি কহিনু তোমাকে।।আনন্দ পাইয়া রাজা ব্যাসের বচনে।পুনরপি জিজ্ঞাসেন আনন্দিত মনে।।হইল ধনের তত্ত্ব শুন মহামুনি।যজ্ঞ হেতু অশ্ববর কোথা পাব শুনি।।মুনি বলে অশ্ব আছে যুবনাশ্বপুরে।আনিতে করহ যত্ন সেই অশ্ববরে।।যজ্ঞ হেতু অশ্ব পালিতেছে নরপতি।শত কোটি সেনা আছে তাহার সংহতি।।যতনে পালয়ে অশ্ব যজ্ঞ নাহি করে।সেই ঘোড়া আন রাজা জানাই তোমারে।।পরাজিয়া যুবনাশ্বে হয় আন তুমি।তবে যজ্ঞ সিদ্ধি হবে কহিলাম আমি।।যুধিষ্ঠির বলিলেন শুন দিয়া মন।হয় হেতু হবে সে রাজার সঙ্গে রণ।।কে আর করিবে যুদ্ধ নৃপতির সাথে।মহারাজ যুবনাশ্ব খ্যাত পৃথিবীতে।।ব্যাস বলিলেন রাজা চিন্তা কর কেনে।হয় আনিবারে আজ্ঞা কর ভীমসেনে।।বক হিড়িম্বক আর কির্ম্মীর দুর্ব্বার।কৈলাস মর্দ্দিয়া কৈল যক্ষের সংহার।।কীচকে মারিল বীর বিরাটনরে।শত ভাই দুর্য্যোধনে বধিল সমরে।।ভীম হৈতে হবে তোমা সিদ্ধ প্রয়োজন।ভীম আনিবেক ঘোড়া করিয়া যতন।।আমি জানি ভীমের অসাধ্য নহে কর্ম্ম ।হয় হেতু চিন্তা না করিহ তুমি ধর্ম্ম্।।যুধিষ্ঠির বলেন করহ অবধান।বড় দুঃখী আছে ভীম করিয়া সংগ্রাম।।জর্জ্জর ভীমের দেহ কৌরবের বাণে।তুরঙ্গ আনিতে তারে কহিব কেমনে।।বৃষকেতু মেঘবর্ণ দুই ত বালক।বিশেষ বাপের শোকে দহিছে পাবক।।কিমতে বলিব তারে তুরঙ্গ আনিতে।শুন মহামুনি বড় ভয় পাই চিতে।।এত যদি বলিলেন ধর্ম্ম নৃপবর।তাহা শুনি আনন্দিত বীর বৃকোদর।।ভীম বলে মহারাজ করহ শ্রবণ।তুরগ আনিতে কহিলেন তপোধন।।আনিব তুরগ আমি এ নহে আশ্চর্য্য।পরাজিব যুবনাশ্বে কত বড় কার্য্য।।ধন আনিবারে তুমি পাঠাও অর্জ্জুনে।আমি আনি গিয়া অশ্ব জিনিয়া রাজনে।।একেশ্বর যাব আমি ভদ্রাবতীপুরে।আনিব যজ্ঞের অশ্ব জিনিয়া রাজারে।।সবান্ধবে রাজারে পাঠাব যমঘরে।অবশ্য আনিব ঘোড়া কারে ভীম ডরে।।ইহা ভিন্ন আর নাহি আমার বিশ্রাম।শতেক বৎসর পারি করিতে সংগ্রাম।।কহিলেন যুধিষ্ঠির ভীমের বচনে।একাকী দুর্গমে তুমিযাইবে কেমনে।।বৃষকেতু বদন চাহেন যুধিষ্ঠির।রাজার ইঙ্গিতে তার পুলক শরীর।।যোড়হাতে কহিলেক ধর্ম্মের গোচরে।ভীম সঙ্গে যাই আমি আজ্ঞা দেহ মোরে।।যুধিষ্ঠির বলেন শুনহ প্রিয়তর।আছিল তোমার পিতা মহা ধনুর্দ্ধর।।অর্জ্জুন বধিল তারে করিয়া বিক্রম।তার বধে আমি পাইয়াছি মনোভ্রম।।পরিচয় নাহি ছিল কর্ণের সংহতি।সবাই বলিল তারে রাধার সন্ততি।।সূতপুত্র বলি তারে বলে সর্ব্বজনে।না চিনিয়া সহোদর বধিলাম রণে।।বিনাশিল কর্ণবীর অর্জ্জুন দুর্জ্জয়।চাহিতে তোমার মুখ মনে পাই ভয়।।বৃষকেতু বলে শুন পাণ্ডুর ঈশ্বর।ক্ষত্রিয়প্রধান ধর্ম্ম করিতে সমর।।বিপক্ষ হইল পিতা ত্যজি সহোদর।কৌরব সহিত কৈল মন্ত্রণা বিস্তর।।দ্রৌপদীরে উপহাসি হিংসিল তোমারে।সেই পাপে মম পিতা গেল যমঘরে।।আজ্ঞা দেহ যাব আমি খুড়ার সংহতি।আনিব যজ্ঞের ঘোড়া শুন নরপতি।।বৃষকেতু কথা শুনি ভীম হরষিত।আলিঙ্গন দিল তবে মনের বাঞ্ছিত।।তবে ঘটোৎকচ সুত মেঘবর্ণ নাম।যুধিষ্ঠির অগ্রে কহে করিয়া প্রণাম।।যদি আজ্ঞা কর তুমি ধর্ম্ম নরপতি।পিতামহ সঙ্গে যাব পুরী ভদ্রাবতী।।আনিব তুরঙ্গ আমি শুনহ রাজন।অন্তরীক্ষে গতি মম ধর্ম্মের নন্দন।।বুঝিতে আমার মায়া অমর না পারে।আনিব তুরঙ্গ আমি হস্তিনানগরে।।বৃষকেতু পিতামহে করিবে সমর।ঘোড়াকে আনিব আমি শুন নরবর।।এত যদি মেঘবর্ণ বলিল বচন।অনুমতি করিলেন ধর্ম্মের নন্দন।।যাও পুত্র ঘোড়ারে আনহ বাহুবলে।মম আশীর্ব্বাদে ঘোড়া আনিবে কুশলে।।তিনজন মিলিয়া করিবে মহারণ।তবে সে জিনিবে তারে শুনহ নন্দন।।সাজিলেন তিন বীর তুরঙ্গ আনিতে।ব্যাস কহিলেন কথা রাজার সাক্ষাতে।।অর্জ্জুনে পাঠাও রাজা আনিবারে ধন।তবে সে কহিব আমি যজ্ঞ বিবরণ।।মুনি বাক্যে অর্জ্জুনে কহেন নরপতি।আজ্ঞা পেয়ে পার্থ রথে যান শীঘ্রগতি।।হিমালয় পার্শ্বে যান পাণ্ডুর নন্দন।রথেতে তুলিয়া আনিলেন সব ধন।।ধন দেখি যুধিষ্ঠির সানন্দ বিস্তর।জিজ্ঞাসা করেন পুনঃ মুনির গোচর।।যজ্ঞ-বিবরণ তবে কহ মহামুনি।আয়োজন কত চাহি কহ দেখি শুনি।।কতেক ব্রাহ্মণ যজ্ঞে করিব বরণ।সে সকল কথা শীঘ্র কহ তপোধন।গব্য হব্য কত চাহি কহ মহামুনি।ঘোড়ার কিমত রূপ, কহ দেখি শুনি।।আদ্যেপান্ত যজ্ঞ কথা জানাও আমারে।স্থির নহে চিত্ত মম, কহিনু তোমারে।।ব্যাস বলিলেন, শুন ধর্ম্মের নন্দন।অশ্বমেধ যজ্ঞ কৈলে স্থির হবে মন।যজ্ঞ বিবরণ রাজা কহি যে তোমারে।আদ্যোপান্ত অন্ন জল দিবে সবাকারে।।বিংশতি সহস্র বিপ্রে যজ্ঞেতে বরিবে।নানা আভরণ দিয়া সবারে তুষিবে।।লক্ষ কুম্ভ ঘৃত নিত্য ঢালিবে আগুনে।করিবে দেবতা পূজা কুসুম চন্দনে।।পাঁচ কুম্ভ ঘৃত এক ব্রাহ্মণে ঢালিবে।হেনমতে লক্ষ কুম্ভ প্রতি দন দিবে।।ঘোড়ার লক্ষণ শুন ধর্ম্ম নরপতি।চন্দ্রিমা জিনিয়া ঘোড়া দেহের মুরতি।।পীতপুচ্ছ শ্যামবর্ণ অশ্ব মনোহর।সর্ব্ব সুলক্ষণ হয় শুন নরবর।।ভূষিত করিবে ঘোড়া দিয়া আভরণ।আপনার নাম তাহে করিবে লিখন।।জয়পত্র আশ্বভালে করিয়া বন্ধন।আপনার নাম তাহে করিবে লিখন।।তাহাতে লিখিবে পত্র যেই ঘোড়া ধরে।নিজ বাহুবলে আমি জিনিব তাহারে।।তুরঙ্গ ছাড়িয়া মধু পূর্ণিমা দিবসে।পৃথিবী ভ্রমিবে ঘোড়া মনের হরিষে।।আপনি থাকিবে যজ্ঞে তুমি হয়ে ব্রতী।অসিপত্র ব্রত আচরিবে মহামতি।।যুধিষ্ঠির বলেন যে করি নিবেদন।অসিপত্র ব্রতের বলহ বিবরণ।।অসিপত্র ব্রত সেই কেমন প্রকারে।কি নিয়মে থাকে তাহা বলহ আমারে।।ব্যাস বলিলেন রাজা কর অবগতি।অসিপত্র ব্রত কথা শুন নরপতি।।যাবৎ না আসে ঘোড়া নিবৃত্ত হইয়া।থাকিবে সে একাসনে দ্রৌপদী লইয়া।।তার মাঝে খড়গ এক খোবে নরপতি।কদাচিত অন্য মত না করিবে তথি।।মদন আবেশে যদি মজে তার মন।সেই খড়েগ কাটিয়া ফেলিবে সেইক্ষণ।।সেই ব্রত কর রাজা আমার বচনে।তোমা বিনা করিতে নারিবে অন্যজনে।।শুনিয়া কহেন রাজা ধর্ম্মের নন্দন।আচরিতে না পারিল সহস্রলোচন।।হেন ব্রত আচরিব আমি কোন্ মতে।শুন মহামুনি বড় ভয় পাই চিতে।।ব্যাস কন তোমার সহায় নারায়ণ।তোমার অসাধ্য ইহা নহেত রাজন্ ।।এত বলি ব্যাস চলিলেন নিকেতনে।কৃষ্ণেরে করেন স্তব রাজা দৃঢ়মনে।।মহাভারতের কথা অমৃত সমান।কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।০২. যুধিষ্ঠিরের নিকট কৃষ্ণের আগমনহা কৃষ্ণ দ্বারকানাথ যাদব-নন্দন।মথুরেশ হৃষীকেশ ত্রাতা জনার্দ্দন।।এই নাম যুধিষ্ঠির স্মরণ করিতে।করুণাসাগর তথা আসিল ত্বরিতে।।একেশ্বর আসিলেন কমললোচন।যুধিষ্ঠির-দ্বারে আসি দিলা দরশন।।এই দেখ ভক্তের অধীন যদুরায়।শিব ব্রহ্মা ধ্যানে যাঁরে দেখিতে না পায়।।অনাহারে অহর্নিশি যত মুনিগণ।সমাধিযোগেতে ভাবে যেই নারায়ণ।।দেখিতে না পায় যাঁরে নানা ক্লেশ করি।যুধিষ্ঠির-স্মরণে আসেন সেই হরি।।দ্বারী গিয়া জানাইল ধর্ম্মের গোচরে।শুন রাজা হৃষীকেশ আসিলেন দ্বারে।।শুনি হরষিত হয়ে পাণ্ডুর নন্দন।আগুসারি আনিবারে করেন গমন।।দ্রৌপদী সহিত রাজা ভ্রাতৃগণ লয়ে।ত্বরিত গেলেন রাজা আনন্দিত হয়ে।।যুধিষ্ঠিরে প্রণমেন দেব নারায়ণ।হরষিত হয়ে রাজা দেন আলিঙ্গন।।সবা সনে সম্ভাষণ করি যদুপতি।সভাতে বসেন আসি কৃষ্ণ মহামতি।।ভীমার্জ্জুন সহদেব নকুল কুমার।বৃষকেতু আদি যত বসিল অপার।।সভা সুশোভিত করিলেন নারায়ণ।দ্বিতীয় প্রহর রাত্রে কৃষ্ণ আগমন।।শুন রাজা জন্মেজয় কহি যে তোমারে।পাণ্ডব সমান কেহ নাহিক সংসারে।।দ্বিতীয় প্রহর রাত্রে আসিলেন হরি।পাণ্ডবের কত ভাগ্য বলিতে না পারি।।তবে রাজা যুধিষ্ঠির করি যোড়হাত।নিবেদন কৈল, শুন দেব জগন্নাথ।।অভিষেক করি মোরে দিলে সিংহাসন।তোমার আজ্ঞায় করি প্রজার পালন।।কিন্তু মম চিত্ত স্থির না হয় শ্রীহরি।অন্তরে উদ্বেগ উঠে, বলিতে না পারি।।জ্ঞাতি গুরু নাশিলাম সংগ্রাম ভিতরে।সে কারণে সুখ মোর নাহিক অন্তরে।।বিষাদিত হয়ে আমি মনে মনে গণি।হেনকালে আসিলেন ব্যাস মহামুনি।।যত দুঃখ নিবেদন করিলাম আমি।কহিলেন অশ্বমেধ যজ্ঞ কর তুমি।।বলিলাম নিঃস্ব আমি, করিব কেমনে।ধনের সন্ধান মুনি কহিলা যতনে।।অর্জ্জুন আনিবে ধন হিমালয় হতে।উপদেশ করিলেন তুরঙ্গ আনিতে।।যুবনাশ্ব-পুরে আছে অশ্ব মনোহর।ভীম আনিবেক ঘোড়া করিয়া সমর।।প্রতিজ্ঞা করিল তবে সভা বিদ্যমানে।বৃষকেতু মেঘবর্ণ আর ভীমসেনে।।তবে যজ্ঞ বিবরণ কহিলেন মুনি।অসিপত্র-ব্রত শুনি মনে ভয় গণি।।সে কারণে স্তুতি আমি করিনু তোমারে।ত্বরায় আসিলে কৃষ্ণ আমার গোচরে।।পাণ্ডবে আছয়ে কৃপা শুন যদুরায়।যজ্ঞসিদ্ধি হেতু আমি জিজ্ঞাসি তোমায়।।পারি কি না পারি আমি যজ্ঞ করিবারে।বিচারিয়া কৃষ্ণচন্দ্র বলহ আমারে।।শুনিয়া বলেন হাসি দেব নারায়ণ।জলগ গম্ভীর স্বরে মধুর বচন।।শুন রাজা যুধিষ্ঠির আমার ভারতী।ঘোটক আনিবে ভীম নহে হেন কৃতী।।যুবনাশ্ব মহারাজ মহাবলবান।তার সঙ্গে যুদ্ধ করা সঙ্কটের স্থান।।সংগ্রামে জিনিতে না পারিবে বৃকোদর।ভীম হৈতে কর্ম্ম সিদ্ধি নহে নৃপবর।।অপকর্ম্মান্বিত ভীম সর্ব্বলোকে জানে।কামাতুর হয়ে মজে রাক্ষসীর সনে।।রাক্ষস আকার তার, রাক্ষস আচার।মনুষ্যের রক্ত খায়, রাক্ষস আহার।।কোন গুণ নাহি দেখি ভীমের শরীরে।হেন জনে বল তুমি অশ্ব আনিবারে।।ভীম হৈতে না হইবে সিদ্ধ প্রয়োজন।নিশ্চয় জানিহ ইহা ধর্ম্মের নন্দন।।ক্রেতাযুগে যজ্ঞ করিলেন রঘুনাথ।ব্রহ্মবধ করেছিলা পূর্ব্বে তাঁর তাত।।নিয়োজিল লক্ষ্মণেরে অশ্ব রাখিবারে।আনন্দে ভ্রময়ে ঘোড়া পৃথিবী ভিতরে।।অক্ষৌহিণী সঙ্গে করি সুমিত্রা-নন্দন।অশ্ব লয়ে করিলেক পৃথিবী ভ্রমণ।।দৈবযোগে গেল ঘোড়া বিষ্ণুপদীপুরে।লব কুশ দুই ভাই ধরিল ঘোড়ারে।।আনিতে নারিল ঘোড়া সুমিত্রা-নন্দন।আপনি গেলেন তথা কমললোচন।।শ্রীরাম আনেন অশ্ব, যজ্ঞ সাঙ্গ হয়।এই সব কথা রাজা জানিহ নিশ্চয়।।এত যদি কহিলেন দেব গদাধর।তাহা শুনি কহিতে লাগিল বৃকোদর।।নিবেদন করি শুন দেব নারায়ণ।কহিলে আমারে তুমি গর্ব্বিত বচন।।তুমি যদি বল, আমি কি করিতে পারি।কিন্তু আপনার ছিদ্র নাহি জান হরি।।ডাগর উদর মম দেখ নারায়ণ।তোমার উদরে কৃষ্ণ এ তিন ভুবন।।আমা সম কামাতুর না দেখ আপনি।ষোল শত অষ্ট হয় তোমার রমণী।।তাহা লয়ে ক্রীড়া কর দিবস রজনী।আমা কিসে কামাতুর বল গুণমণি।।নিন্দিলে আমার আছে রাক্ষসী বনিতা।তোমার গৃহেতে আছে ভল্লুক-দুহিতা।।আপনা না জানি কৃষ্ণ নিন্দহ অন্যেরে।কত কীর্ত্তি রাখিয়াছ গোকুল নগরে।।পাসরিলে সেই কথা রাধার জীবন।আমায় নিন্দিয়া কহ কুৎসিত বচন।।ভয় নাহি করি আমি যুবনাশ্ব বীরে।তুরঙ্গ আনিব আমি জিনিয়া তাহারে।।তুমি যারে প্রসন্ন আছহ যদুরায়।ইন্দ্রে পরাজিতে পারি, এবা কোন্ দায়।।আমা সবাকার নাথ তুমি নারায়ণ।সত্য বলি এই কথা বলে সর্ব্বজন।।আমার অসাধ্য নাহি এই চরাচরে।শুন কৃষ্ণ কহিলাম তোমার গোচরে।।ভীমের বচনে তুষ্ট হয়ে নারায়ণ।যুধিষ্ঠিরে কহিলেন মধুর বচন।।অশ্বমেধ যজ্ঞ সিদ্ধ হইবে তোমার।অসিপত্র আচরিবে ধর্ম্মের কুমার।।অন্য মত না হইবে, বলিলাম আমি।তুরঙ্গ আনিবে ভীম, স্থির জেন তুমি।।কৃষ্ণের বচনে হরষিত যুধিষ্ঠির।পুনরপি কহিতে লাগিল ভীম বীর।।শুনহ অর্জ্জুন বীর আমার বচন।সতত করিবে তুমি রাজার রক্ষণ।।পালিহ হস্তিনাপুরী রাজার সহিতে।তিনজন যাই মোরা তুরঙ্গ আনিতে।।এতেক কহিল যদি পবন-কুমার।শুনিয়া অর্জ্জুন তাহা করেন স্বীকার।।যুধিষ্ঠির-পদে ভীম করিল প্রণাম।আশীর্ব্বাদ দেন তারে ধর্ম্ম গুণধাম।।যাহ ভীম, অশ্ব তুমি আনহ ত্বরিতে।বিলম্ব না কর ভাই, ইহা রাখ চিতে।।ইহা শুনি ভীম বীর চলিল সত্বরে।বৃষকেতু মেঘবর্ণ লইয়া দোঁহারে।।বিজয় পাণ্ডব-কথা অমৃতলহরী।কাশী কহে, শুনিলে তরয়ে ভববারি।।০৩. অশ্ব আনিতে ভীম,বৃষকেতু ও মেঘবর্ণের যাত্রাশ্রীজনমেজয় বলে, কহ মহামুনি।অপূর্ব্ব কাহিনী আমি তোমা হৈতে শুনি।।কেমনে আনিল অশ্ব বীর বৃকোদর।বিবরিয়া সেই কথা কহ মুনিবর।।যত কথা শুনি মুনি তত বাড়ে সুখ।অমৃত করিতে পান কে হয় বিমুখ।।বলেন বৈশম্পায়ন, শুন জন্মেজয়।ভীম আনিবারে গেল অশ্বমেধ হয়।।বৃষকেতু মেঘবর্ণে করিয়া সংহতি।গোবর্দ্ধন গিরিপরে গেল শীঘ্রগতি।।সেই গোবর্দ্ধন গিরি সহস্র শিখর।তাহে আরোহণ কৈল তিন বীরবর।।পর্ব্বতে বসিল বীর হরষিত হয়ে।দেখিল রাজার পুরী দুরেতে থাকিয়ে।।সুবর্ণে রচিত পুরী মুণিমুক্তাময়।পুরী দরশনে ভীম মানিল বিস্ময়।।ভীম বলে, বৃষকেতু শুনহ বচন।জিনিয়া কনকলঙ্কা পুরীর গঠন।।মনোহর রাজপুরী অতি অনুপম।কতেক বসতি পুরে, নাহিক নিয়ম।।পুরীর বাহিরে দেখি রম্য সরোবর।সলিলে করিছে শোভা কমল নিকর।।নানা বৃক্ষ পুষ্প শোভে সরোবর পাশে।চম্পক মালতী যূথী মল্লিকা বিকাশে।।মধুলোভে অলিগণ ভ্রমিয়া বেড়ায়।দেখহ কোকিলগণ কুহুস্বরে গায়।।কলকণ্ঠ-বিহঙ্গম নানা শব্দ করে।মনোহর উপবন সরোবর-তীরে।।ওই দেখ বিটপীর তলে দিব্য ছায়।বনিতা বসিয়া তথা নানা গীত গায়।।কাঁখে হেমকুম্ভ করি যতেক অবলা।সরোবর-তীরে আসে যেন চন্দ্রকলা।।গন্ধর্ব্ব কিন্নর যেন দেবের রমণী।ঊর্ব্বশী জিনিয়া রূপ হেন মনে গণি।।এক আসে, এক যায় সরোবর-তীরে।দৃষ্টি করি বৃষকেতু দেখহ অন্তরে।।অমর-নগর জিনি যুবনাশ্ব-পুরী।প্রবেশিব কোন্ পথে মনে ভয় করি।।গড়ের প্রাচীর দুই যোজন বিস্তার।ভয় লাগে দেখিয়া রাজার সিংহদ্বার।।রক্ষক সকল দেখ নানা অস্ত্র হাতে।অগম্য রাজার পুরী যাইব কিমতে।।পুরীর ভিতরে আছে অশ্ব মনোহর।কেমনে আনিব ঘোড়া বড়ই দুষ্কর।।ভীমের বচন শুনি কর্ণের নন্দন।যোড়হাত করি ভীম করে নিবেদন।।রাজপুরী মনোহর, অতি অনুপাম।অমর-নগর জিনি পুরী যে সুঠাম।।প্রবেশিতে না পারিব যুবনাশ্ব-পুরে।আসিবে যজ্ঞের ঘোড়া এই সরোবরে।।আসিবে অনেক সৈন্য ঘোড়ার সংহতি।ধরিয়া লইব ঘোড়া করিয়া শকতি।।ভীম বলে, বৃষকেতু কহিলে প্রমাণ।নিতান্ত ধরিতে ঘোড়া করহ সন্ধান।।তুরঙ্গ ধরিলে যুদ্ধ হইবে বিস্তর।কি কর্ম্ম করিব বল কর্ণের কোঙর।।বৃষকেতু বলে, আমি করিব সমর।আমা নিবারিতে পারে, নাহি হেন নর।।তবে মেঘবর্ণ বলে, শুন পিতামহ।ধরিয়া আনিব ঘোড়া যদি আজ্ঞা দেহ।।অশ্ব লয়ে থাকিব যে পর্ব্বত উপরে।তোমরা প্রবৃত্ত দোঁহে হইবে সমরে।।মেঘবর্ণ-বাক্য শুনি ভীম হৈল প্রীত।পর্ব্বতে রহিল সবে হয়ে হরষিত।।শিখরে বসিয়ে তিনে করে নিরীক্ষণ।জলপান করিতে আইল অশ্বগণ।।অযুত অযুত ঘোড়া সরোবরে আইল।আপনার সুখে ঘোড়া জলপান কৈল।।জলপান করিয়া চলিল অশ্বগণ।তাহে না দেখিল অশ্ব সর্ব্ব সুলক্ষণ।।শ্যামবর্ণ পীত পুচ্ছ তাহে না দেখিয়ে।পর্ব্বতে আছেন তিন পথপানে চেয়ে।।ভীম বলে, বৃষকেতু হেন লয় মনে।অন্তঃপুরে আছে ঘোড়া না এল এখানে।।বাহির না করে ঘোড়া, ইহা জান স্থির।আইল অনেক ঘোড়া, খাইবারে নীর।।কোন্ কর্ম্মে করিলাম প্রতিজ্ঞা করিয়া।হস্তিনাতে যাব আমি কি বোল বলিয়া।।অব্যর্থ প্রতিজ্ঞা মম, সর্ব্বলোকে জানে।ঘোড়া না পাইয়া মোর দুঃখ বাড়ে মনে।।বৃষকেতু বলে, খুড়া শুন অবধানে।এখনি আসিবে অশ্ব দেখ জলপানে।।শ্রীকৃষ্ণ দিলেন আজ্ঞা তুরঙ্গ আনিতে।কার্য্যসিদ্ধি হবে, কেন দুঃখ কর চিতে।।ঐ শুন নগরেতে বিবিধ বাদ্যধ্বনি।ঢাক ঢোল বাজে আর বরাক খঞ্জনী।।খমক ঠমক বাজে মৃদঙ্গ ঝাঁঝরি।বরঙ্গ মাধুরী বাজে বিশাল ধুধুরি।।জয়ঢাক বীরঢাক কাংস্য করতাল।দগড়ি দগড় বাজে দামামা বিশাল।।কোলাহল শুনি বড় গড়ের ভিতরে।অভিপ্রায় বুঝি ঘোড়া আসে সরোবরে।।রাজার গমনে যেন বাজে বাদ্যচয়।শুন খুড়া জলপানে আসে সেই হয়।।একদৃষ্টি করি তুমি চাহ হয় পানে।শব্দ কোলাহলে কিছু নাহি শুনি কাণে।।আগে পাছে গজ বাজী কত শোভা করে।সর্ব্বসুলক্ষণ ঘোড়া দেখহ মাঝারে।।চামর চাঁদোয়া দেখ ঘোড়ার দু-পাশে।পদধূলি উঠিল যে দেখহ আকাশে।।অশ্ব দেখি ভীম বীর আনন্দিত মনে।ঘটোৎকচ-সুতে আজ্ঞা দিল সেইক্ষণে।।মেঘবর্ণ বলে, তুমি দেখ না বসিয়া।সৈন্যের মাঝারে ঘোড়া আনিব ধরিয়া।।এত বলি মেঘবর্ণ হইল বিদায়।চন্দ্রকে ধরিতে যেন রাহুগ্রহ ধায়।।মহাভারতের কথা সুধার সুসার।কাশী কহে, শুন যদি হৈবে ভবপার।।০৪. যুবনাশ্ব রাজার অশ্বহরণমেঘবর্ণ মহাবলী, হয়ে মহা কুতুহলী,প্রণমিল ভীমের চরণে।ভীম বড় কুতুহলে, তাহারে করিল কোলে,আশীর্ব্বাদে হরষিত মনে।।প্রণমিয়া কর্ণসুতে, মেঘবর্ণ আনন্দেতে,অন্তরীক্ষে করিল গমন।প্রকাশি রাক্ষস মায়া, দূর কৈল রবিছায়া,অন্ধকারে না চলে নয়ন।।আকাশে খেচর সব, করে মহাকলরব,বরিষে মুষলধারে জল।প্রচণ্ড মারুত বয়, ঘোর শীলাবৃষ্টি হয়,পূর্ণিত হইল ধরাতল।।বাত হৈল অতি গুরু, ভাঙ্গিল যতেক তরু,পত্র পুষ্প পড়িল ভূতলে।তাহা দেখি নৃপসেনা, হইলেক অন্যমনা,অশ্বনিতে না পারিল শালে।।মারুতি রুধিল বাট, ত্রাসিত রাজার ঠাট,পরস্পর কহে নানা কথা।কিবা হৈল দুরদৃষ্ট, অকস্মাৎ জলবৃষ্ট,মায়া কৈল কেমন দেবতা।।মনে উপজিল ভয়, এ কর্ম্ম অন্যের নয়,ঘোড়া নিতে আসে পুরন্দর।শ্যামবর্ণ পীতপুচ্ছে, হেন অশ্ব কোথা আছে,শিলাঘাতে শরীর জর্জ্জর।।নৃপসেনা হেনমতে, বিষাদ করিয়া চিতে,অন্ধকারে না দেখি নয়নে।চান্দোয়া চামর কোথা, খণ্ডখণ্ড হৈল ছাতা,করি দন্ত খসি পড়ে ভূমে।।মেঘবর্ণ হেনকালে, ঘোটক লইয়া কোলে,লয়ে গেল পর্ব্বত উপরে।বৃষকেতু বৃকোদর, আনন্দিত বহুতর,আলিঙ্গন করিল তাহারে।।ভারতের পুণ্যকথা, শুনিলে ঘুচয়ে ব্যথা,কলির কলুষ বিনাশন।সেবি কৃষ্ণ পদাম্বুজ, কহে কুষ্ণ দাসানুজ,কৃষ্ণপদে থাকে যেন মন।।০৫. বৃষকেত ও যুবনাশ্বের যুদ্ধরাক্ষসের মায়া যত, সব দূর হৈল।শিলাবৃষ্টি বরিষণ ঝড় কোথা গেল।।দূর হৈল অন্ধকার, সুপ্রকাশ ভানু।পরস্পর নিরীক্ষয়ে নিজ নিজ তনু।।কেহ বলে, আরে ভাই অনর্থ হইল।রাজার যজ্ঞের ঘোড়া কেবা লয়ে গেল।।কেহ বলে, অশ্বেকে ধরিয়া একজন।দেখিনু আকাশপথে করিল গমন।।কি বলিয়া যাব মোরা নৃপ সন্নিধানে।ঘোড়া না দেখিয়া রাজা বধিবেক প্রাণে।।গন্ধর্ব্ব কিন্নর কেবা ঘোড়া নিল হরি।ধেয়ে যায় নৃপসৈন্য হাতে ধনু ধরি।।আকাশপথেতে কেহ করে নিরীক্ষণ।কেহ বলে, ঘোড়া নিল সহস্রলোচন।।কোলাহল করি সৈন্য ধাইল পর্ব্বতে।আগু হৈল ভীমসেন ধনুর্ব্বাণ হাতে।।মেঘবর্ণ বলে, শুন পিতামহ বীর।ঘোড়া লয়ে যাই চলি হস্তিনা নগর।।অগোচরে যাই, যুদ্ধ নাহি প্রয়োজন।তত্ত্ব নাহি পায় যেন নৃপ সৈন্যগণ।।ভীম বলে, মেঘবর্ণ কি কর বিচার।শুনিলে হাসিবে কৃষ্ণ সংসারের সার।।উপহাস করিবেন মোরে ধনঞ্জয়।চুরি করি বৃকোদর আনিলেক হয়।।এ সব নিন্দিত কর্ম্ম আমি না করিব।বাহুবলে নৃপসৈন্য আমি পরাজিব।।বক হিড়িম্বক মারি কির্ম্মীর দুর্ব্বার।শত ভাই কীচকেরে করিনু সংহার।।বিনাশ করিনু শত ভাই দুর্য্যোধনে।অশ্ব লুকাইয়া লব, এ বল কেমনে।।অপযশ থাকিবেক অবনী-মণ্ডলে।পাণ্ডবের সখা কৃষ্ণ সর্ব্বলোকে বলে।।ইহা যদি বলিলেন বীর বৃকোদর।ঘটোৎকচ-সুত বলে যুড়ি দুই কর।।ঘোড়া লয়ে তোমরা থাকহ দুই জন।আজ্ঞা কর যাই আমি করিবারে রণ।।এত বলি ভীমসেনে করিয়া প্রণাম।মেঘবর্ণ বীর যায় করিতে সংগ্রাম।।উপাড়ি পাথরখণ্ড নিল বাম হাতে।সিংহনাদ করি যায় সংগ্রাম করিতে।।এড়িল পাথরখান দিয়া হুহুঙ্কার।পাথর চাপনে হৈল সৈন্যের সংহার।।চারি শত সেনাপতি গেল যমঘরে।দুই শত হস্তী মরে শিলার প্রহারে।।গাছ শিলা আঘাতে পড়িল সেনাচয়।একলা করিছে যুদ্ধ রাক্ষস দুর্জ্জয়।।পরস্পর নৃপসেনা মনে বিচারিল।সঙ্কট সংগ্রাম দেখি রণে ভঙ্গ দিল।।ঊর্দ্ধশ্বাসে ধেয়ে গেল পুরীর ভিতরে।যোড়হাতে বার্ত্তা কহে নৃপতি গোচরে।।শুন রাজা, ঘোড়া নিল সহস্রলোচন।শিলাবৃষ্টি ঘোরতর কৈল বরিষণ।।অন্ধকার কেহ নাহি চিনে আত্ম-পর।ধরিয়া যজ্ঞের ঘোড়া নিল পুরন্দর।।ঘোড়া লয়ে পর্ব্বতে গেলেন সুরপতি।কুবের বরুণ যম আছেন সংহতি।।তাঁর সহ যুদ্ধ করিলাম প্রাণপণে।শরীর জর্জ্জর হৈল দেবতার বাণে।।গজ বাজী পড়িল বিস্তর সেনাগণ।পলাইনু প্রাণ লয়ে পরিহরি রণ।।শুনিয়া কুপিল যুবনাশ্ব নৃপবর।সাজ সাজ বলি ঘন ডাকে নরেশ্বর।।নৃপআজ্ঞা পাইয়া যতেক সেনাগণ।হরিষেতে গেল সবে করিবারে রণ।।গজ বাজী বিমানেতে আরোহণ করি।পদাতিকগণ যায় হাতে খড়্গ ধরি।।ধনুর্ব্বাণ লয়ে হাতে সাজে যত জন।কোলাহল করি যায় নৃপ সেনাগণ।।যুঝিতে চলিল যুবনাশ্ব মহাবল।ভুজঙ্গনাথের ফণা করে টলমল।।আপনি নৃপতি এল যুদ্ধ করিবারে।বৃষকেতু কহে কথা ভীমের গোচরে।।আজ্ঞা কর, খুড়া আমি করি গিয়া রণ।আজি যুবনাশ্বে আমি করিব নিধন।।অনুমতি দিল ভীম বৃষকেতু বীরে।কর্ণের নন্দন যায় হাতে ধনু ধরে।।আকর্ণ পূরিয়া বীর টঙ্কারিল ধনু।সিংহনাদে কম্পমান নৃপতির তনু।।সিংহনাদে নৃপতির মন উচাটন।ডাক দিয়া বলে রাজা, শুন সেনাগণ।।একেশ্বর আসে মোর সৈন্যের ভিতরে।অসীম সাহস বীর শঙ্কা নাহি করে।।কিবা ইন্দ্রদেব কিবা শমন পবন।মানুষের রূপে এল করিবারে রণ।।সাহস করিয়া সবে কর গিয়া রণ।নৃপাদেশে সাহস করিল সেনাগণ।।মার মার শব্দে সবে আরম্ভিল রণ।নানা অস্ত্র বরিষয়ে না হয় গণন।।রাজপুত্র সুবেগ সে বড় বীরবর।করিপৃষ্ঠে আসে সেই করিতে সমর।।হংসব্যূহ করি সেই আরম্ভিল রণ।ব্যূহ ভেদি বৃষকেতু মারে সেনাগণ।।একত্র হইয়া যত নৃপতির সেনা।বাণবৃষ্টি করে সবে, নাহিক গণনা।।বৃষকেতু-শিরে পড়ে লক্ষ লক্ষ বাণ।তথাপি সে নহে ভীত হেন বলবান্।।কাতর হইল বীর বাণের প্রহারে।তাহা দেখি ভীম বীর কুপিল অন্তরে।।ভীম বলে, মেঘবর্ণ শুনহ বচন।একা গেল বৃষকেতু করিবারে রণ।।পর্ব্বতে থাকহ তুমি ঘোটক লইয়া।যুদ্ধ করিবারে আমি যাইব সাজিয়া।।এত বলি ভীমসেন করিল গমন।বৃষকেতু সম্মুখে আইল সেইক্ষণ।।ভীমে দেখি বৃষকেতু হরিষ অন্তরে।যোড়হাত করি বীর নিবেদন করে।।আপনি আসিলে কেন সংগ্রাম ভিতর।আমি যুদ্ধ জিনিতে পারিব একেশ্বর।।ভীম বলে, নৃপতির বহুতর সেনা।দরশনে আমি বড় হইনু উন্মানা।।একলা করিছ যুদ্ধ, ভয় করি মনে।বিনাশিব নৃপসেনা মোরা দুই জনে।।এত বলি দুই জনে করেন সন্ধান।ঈষৎ হাসিয়া এড়ে শত শত বাণ।।বৃষকেতু দেখিয়া বলিছে নৃপবর।কাহার তনয় তুমি মহাধনুর্দ্ধর।।কি নাম তোমার হে, আসিলে কি কারণ।পরিচয় দেহ আগে তোমরা দুজন।।যুবনাশ্ব-বচনেতে বৃষকেতু বীর।পরিচয় দিল নৃপে প্রফুল্ল শরীর।।রবির তনয় কর্ণ জানে এ জগতে।জনম হইল তাঁর কুন্তীর গর্ভেতে।।কর্ণের তনয় আমি নাম বৃষকেতু।তুরঙ্গ লইনু যুধিষ্ঠির-যজ্ঞ-হেতু।।তাহা শুনি যুবনাশ্ব আনন্দিত মন।ধন্য ধন্য মহাবীর কর্ণের নন্দন।।এ নহে উচিত, শুন কর্ণের নন্দন।আমার বচনে কর রথে আরোহণ।।তবে সে করিব দুই জনে ঘোর রণ।এত শুনি ডাকি বলে কর্ণের নন্দন।।শুন রাজা মম রথে নাহি কোন কাজ।তুমি রথে যুদ্ধ কর, শুন মহারাজ।।বৃষকেতু-বাক্য রাজা দুঃখিত অন্তরে।রথ ত্যজি নামিলেন ধরণী উপরে।।দোঁহে যুদ্ধে বিশারদ, কেহ নহে ঊন।দোঁহে দোঁহাকার কাটি পাড়ে ধনুর্গুণ।।পুনরপি ধনুক লইল দুই জন।বাণ বরষিয়ে দোঁহে ছাইল গগন।।বাণে বাণে দোঁহে কৈল অনেক সংগ্রাম।কেহ কারো ঊন নহে, দোঁহে অনুপাম।।তবে যুবনাশ্ব রাজা ক্রোধযুক্ত হয়ে।অগ্নিবাণ এড়িলেক আকর্ণ পূরিয়ে।।এড়িল বরুণ বাণ কর্ণের তনয়।নির্ব্বাণ হইল অগ্নি, নাহি আর ভয়।।বায়ু-অস্ত্র নরপতি এড়িলেক রণে।পর্ব্বতাস্ত্রে নিবারয় কর্ণের নন্দনে।।সর্পবাণ যুবনাশ্ব কৈল অবতার।গরুড়াস্ত্রে কর্ণসুত করিল সংহার।।হেনমতে দোঁহে কৈল অনেক সংগ্রাম।বাণের উপরে বাণ করেন সন্ধান।।তবে বৃষকেতু বীর কর্ণের নন্দন।কোপযুক্ত হয়ে করে বাণ বরিষণ।।নিবারয়ে যুবনাশ্ব ধনুঃশর হাতে।তাহা দেখি ভীমসেন দুঃখ ভাবে চিতে।।তবে যুবনাশ্ব রাজা মারে দশ বাণ।বৃষকেতু উপরে সে করিয়া সন্ধান।।মহাকোপে ভীমসেন গদা নিল হাতে।গজ বাজী রথ মারিলেন যূথে যূথে।।ভীম-গদাঘাতে সেনা হইল চঞ্চল।রণে ভঙ্গ দেয় সবে করি কোলাহল।।সৈন্যভঙ্গ দেখি বীর সুবেগ আইল।ভীমের সহিত আসি যুদ্ধ আরম্ভিল।।বুভুক্ষিত সিংহ যেন গজেন্দ্র পাইল।গদা হাতে ভীমসেন রণে প্রবেশিল।।তা দেখি সুবেগ বীর গদা নিল হাতে।আরম্ভিল গদাযুদ্ধ ভীমের সহিতে।।সুবেগ মারিল গদা ভীমের উপরে।গদাঘাতে ভীমসেন সিংহনাদ করে।।সুবেগ উপরে ভীম করে গদাঘাত।হাহাকার করে সৈন্য, সুবেগ নিপাত।।চৈতন্য পাইল নৃপসুত কতক্ষণে।পুনঃ গদাযুদ্ধ করে বৃকোদর সনে।।যুবনাশ্ব সনে যুঝে কর্ণের নন্দন।দোঁহে মহাধনুর্দ্ধর করে মহারণ।।এড়িল পঞ্চাশ বাণ বীর বৃষকেতু।যুবনাশ্ব নৃপতির বিনাশের হেতু।।অচেতন মহারাজ পড়িল ভূমিতে।তাহা দেখি বৃষকেতু দুঃখ পায় চিতে।।ধনুর্ব্বাণ ভূমে রাখি কর্ণের নন্দন।যোড়হাতে নারায়ণে করেন স্তবন।।পাণ্ডবে প্রসন্ন যদি হও চক্রপাণি।তবে যুবনাশ্ব রাজা বাঁচিবে এখনি।।যদি কিছু কর্ণের থাকয়ে পুণ্যফল।নৃপতিরে তবে রক্ষ ভকতবৎসল।।এত বলি বৃষকেতু মাগিলেন বর।চৈতন্য পাইয়া রাজা উঠিল সত্বর।।নৃপতি চৈতন্য পায় হরষিত সেনা।মহাকোলাহল করি বাজায় বাজনা।।যুবনাশ্ব বলে, শুন কর্ণের তনয়।তুমি মেরা পিতা সম, আমি ত তনয়।।বাপের সমান তুমি হও মহামতি।বৃকোদর সনে মোর করাহ পীরিতি।।আর যুদ্ধে কাজ নাই কর্ণের নন্দন।আমি লইলাম এবে পাণ্ডব-শরণ।।মারিয়া জীবন দিলে কি আশ্চর্য্য কথা।মহাধর্ম্মবন্ত ছিল কর্ণ তব পিতা।।তেমতি দেখিনু ধর্ম্ম তোমার শরীরে।আমা লৈয়া চল তুমি ভীমের গোচরে।।ভীম-সুবেগের যুদ্ধ অপূর্ব্ব-কথন।গদাযুদ্ধে বিশারদ রাজার নন্দন।।বাহুবলে ভীম তারে তুলিল উপরে।আছাড়িয়া ফেলিলেক নৃপতি-কুমারে।।নৃপতি-নন্দন তাহে ভয় না পাইল।সিংহনাদ করি পুনঃ গদা হাতে নিল।।পুত্রের বিক্রম দেখি সুখী নরপতি।ডাক দিয়া কহে রাজা আনন্দিত মতি।।শুন পুত্র যুদ্ধে আর নাহি প্রয়োজন।প্রাণপণে লইলাম পাণ্ডব-শরণ।।সংগ্রাম ত্যাজহ পুত্র আমার বচনে।যুদ্ধযোগ্য নহ তুমি ভীমসেন সনে।।ভীমের বিক্রম আমি করেছি শ্রবণ।পাণ্ডবের সহায় আপনি নারায়ণ।।পরাজয় পাণ্ডবের নাহি ত্রিভুবনে।সংগ্রাম ত্যজহ পুত্র আমার বচনে।।বাপের বচন শুনি সুবেগ কুমার।আনন্দিত হইয়া ত্যজিল মহামার।।তবে বৃষকেতু বলে ভীমের সাক্ষাতে।যুবনাশ্ব-পরিবার ভজিল তোমাতে।।এই দেখ নৃপতি মাগিল পরাজয়।অভয় প্রসাদ দেহ পাণ্ডুর তনয়।।বৃষকেতু বচনেতে ভীম মহাবলী।ত্যজিল সংগ্রাম হইয়া কুতূহলী।।তবে রাজা যুবনাশ্ব আনন্দ পাইয়া।ভীমেরে প্রণাম কৈল সাষ্টাঙ্গ হইয়া।।রাজারে তুষিল ভীম আলিঙ্গন দানে।সুবেগ প্রণাম কৈল ভীমের চরণে।।বৃষকেতু সহিত করিয়া সম্ভাষণ।যোড়হাতে যুবনাশ্ব করে নিবেদন।।নিবেদন করি শুন ভীম মহাশয়।আজি যে হইল মম তপের উদয়।।পূর্ব্বপুণ্য মানিলাম তব দরশনে।পবিত্র হইল পুরী তব আগমনে।।ধন্য ধন্য বৃষকেতু কর্ণের কুমার।নয়নে দেখিনু আজি চরণ তোমার।।কতেক আমার ভাগ্য বলিতে না পারি।পবিত্র হইল আজি ভদ্রাবতীপুরী।।আমার পুরেতে তুমি চল এইক্ষণে।ঘোড়া লয়ে যাব আমি ধর্ম্ম বিদ্যমানে।।অনুমতি দিল ভীম রাজার বচনে।প্রীতি পেয়ে যুবনাশ্ব গেল নিকেতনে।।সুবেগে রাখিয়া এল বৃকোদর সনে।ঘরে গিয়া নৃপতি ডাকিল পাত্রগণে।।পূর্ব্বে সুরাসুর বলি ছিল অনুমান।তাহা নহে, আসে ভীম পাণ্ডুর সন্তান।।অন্তঃপুরে গিয়া কহে প্রভাবতী স্থান।বৃষকেতু সহ পাণ্ডবের আগমন।।মঙ্গল সামগ্রী শীঘ্র কর প্রভাবতী।মম পুরে আসিবেন ভীম মহামতি।।পাণ্ডুর তনয় তাঁরা ভাই পঞ্চজন।যুধিষ্ঠির ভীমার্জ্জুন কুন্তীর নন্দন।।সহদেব নকুল দোঁহে মাদ্রীর তনয়।কৃষ্ণ হেতু পাণ্ডবের নাহি পরাজয়।।যুদ্ধ-বিবরণ যত সকলি কহিল।তাহা শুনি রাজরাণী অদ্ভুত মানিল।।মঙ্গলায়োজন সবে করিল হরিষে।মেঘবর্ণ এল তথা বৃকোদর পাশে।।ঘোড়া লয়ে ঘটোৎকচ-সুত মহাবলী।দাণ্ডাইলা ভীম পাশে হয়ে কৃতাঞ্জলি।।গজপৃষ্ঠে চাপিলেন ভীম কর্ণসুত।ভদ্রাবতী-পুরে যান আনন্দ বহুত।।আগে যায় মেঘবর্ণ অশ্বরশ্মি ধরি।পিছে সেনাগণ যায় সিংহনাদ করি।।মহাভারতের কথা সুধার ভাণ্ডার।কাশীরাম দাস কহে, রচিয়া পয়ার।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon