৪১. সভাজন প্রতি বিকর্ণের উত্তরদ্রৌপদী যতেক কহে, কেহ নাহি শুনে।ভীষ্মবীর প্রত্যুত্তর দেন কতক্ষণে।।কহিতে না পারি আমি ইহার বিধান।ধর্ম্ম সূক্ষ্ম বিচারিয়া কহিতে প্রমাণ।।অন্য দ্রব্যে অন্যের নাহিক অধিকার।দ্রব্য মধ্যে গণ্য হয় ভার্য্যা কিবা আর।।আপনা হারিল আগে ধর্ম্মের নন্দন।পশ্চাৎ হারিলা কৃষ্ণা, জানে সর্ব্বজন।।দ্রুপদ নন্দিনী পঞ্চ পাণ্ডবের নারী।একা যুধিষ্ঠির তাহে নহে অধিকারী।।রাজ্যদেশ ধন জন সব যদি যায়।যুধিষ্ঠির-মুখে নাহি মিথ্যা বাহিরায়।।হারিল বলিয়া মুখে বলিয়াছে বাণী।কি কহি ইহার বিধি, কিছু নাহি জানি।।এত বলি নিঃশব্দে রহেন ভীষ্ম ধীর।যুধিষ্ঠিরে চাহি বলে বৃকোদর বীর।।ওহে মহারাজ! কভু দেখেছ নয়নে।আপন ভার্য্যাকে হারে, বল কোন্ জন।।কপটী জুয়ারী যদি হয় কোন জন।তা সবার থাকিলে ইতর নারীগণ।।সে সব নারীরে তারা নাহি করে পণ।তুমি মহারাজ কর্ম্ম করিলা যেমন।।রাজ্য দেশ ধন জন হারিলা যতেক।ইহাতে তোমারে ক্রোধ না করি তিলেক।।আমা সহ সকল তোমার অধিকার।এই সে হৃদয়ে তাপ সম্বরিতে নারি।।পাশায় করিলা পণ কৃষ্ণা হেন নারী।তব কৃত কর্ম্ম রাজা দেখহ নয়নে।।দ্রৌপদীরে পরিহাস করে হীনজনে।।এই হেতু তোমারে জন্মিল বড় ক্রোধ।ক্ষুদ্র লোক কহে ভাষা, নাহি কিছু বোধ।।ধনঞ্জয় বলে, ভাই কি কথা কহিলে।নৃপে হেন ভাষা নাহি কহ কোন কালে।।আজি কেন কটূত্তর বলিলে রাজায়।তব মুখে হেন বাক্য কভু না বেরয়।।পরম পণ্ডিত তুমি ধর্ম্মজ্ঞ যে গণি।শত্রুর কপটে ছন্ন হৈলে হেন জানি।।সদাই শত্রুর ভাই এই যে কামনা।ভাই ভাই বিচ্ছেদ হউক পঞ্চ জনা।।শত্রুর কামনা পূর্ণ কর কি কারণ।জ্যেষ্ঠ-শ্রেষ্ঠ মহারাজে না কর নিন্দন।।রাজারে বলিলে হেন কি দোষ দেখিয়া।দ্যূত আরম্ভিল শত্রু কপটে ডাকিয়া।।আপন ইচ্ছায় রাজা না খেলেন দ্যূত।ডাকিলে না খেলিলে হবেন ধর্ম্মচ্যুত।।ভীম বলে, ধনঞ্জয় না বলিহ আর।হীনজন প্রভুত্ব না পারি সহিবার।।হরি বিনা অন্য চিত্ত নাহিক আমার।দুই ভুজ কাটিয়া ফেলিব আপনার।।ক্ষুদ্রের প্রভুত্ব দেখিতেছি যে নয়নে।তবে ভুজ রাখি আর কোন্ প্রয়োজনে।।যাহ সহদেব শীঘ্র অগ্নি আন গিয়া।অগ্নি-মধ্যে দুই ভুজ ফেলিব কাটিয়া।।এইরূপে পঞ্চ ভাই তাপিত অন্তর।দুঃখের অনলে দহে সর্ব্ব কলেবর।।বিকর্ণ নামেতে ধৃতরাষ্ট্রের তনয়।পাণ্ডবের দুঃখ দেখি দুঃখিত হৃদয়।।বিশেষে কৃষ্ণার ক্লেশ নারিল সহিতে।সভাজন চাহি বীর লাগিল কহিতে।।সভামধ্যে আছে বড় বড় রাজগণে।দ্রৌপদীর প্রত্যুত্তর নাহি দাও কেনে।।পুনঃ পুনঃ দ্রৌপদী যে কহিছে সভায়।সভাসদ লোকে হেন বুঝিতে যুয়ায়।।সভায় থাকিয়া যদি বিচার না করে।সহস্র-বৎসর পচে নরক-ভিতরে।।এই ভীষ্ম ধৃতরাষ্ট্র বিদুর সুমতি।কুরুকুলে হর্ত্তা কর্ত্তা এই তিন কৃতী।।এ তিন জনেরে নারি করিতে হেলন।তোমরা উত্তর নাহি দাও কি কারণ।।এই দ্রোণাচার্য্য কৃপ শ্রেষ্ঠ দ্বিজকুলে।ক্ষত্রকুলে আচার্য্য যে খ্যাত ভূমণ্ডলে।।তোমরা সকলে ভয় করহ কাহারে।উত্তর না দাও কেন দ্রৌপদীর তরে।।আর যে আছয়ে বহু বহু রাজগণ।বুঝিয়া উত্তর নাহি দাও কি কারণ।।পুনঃ পুনঃ দ্রৌপদী কহিল বার বার।যার যেই চিত্তে আসে, করহ বিচার।।এই মতে পুনঃপুনঃ বিকর্ণ কহিল।একজন সভাস্থলে উত্তর না দিল।।কাহার মুখেতে নাহি পাইয়া উত্তর।ক্রোধভরে বিকর্ণ কচালে করে কর।।নিশ্বাস ছাড়িয়া পুনঃ কহে সভাজনে।উত্তর না দেহ সবে কিসের কারণে।।তোমরা যে কেহ কিছু না দিলা উত্তর।আমি কিছু কহি শুন সব নরবর।।চারি ধর্ম্ম নৃপতির হয়েছে বিধান।মৃগয়া দেবন দান প্রজার পালন।।এই যে নৃপতি ধর্ম্ম দেবনে পশিল।ইচ্ছাসুখে নহে, সবে কপটে ডাকিল।।যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীরে নাহি কর পণ।কপটেতে কহিলেন সুবল নন্দন।।আগে নরপতি আপনাকে হারিয়েছে।কৃষ্ণার উপর কিবা প্রভুপণ আছে।।বিশেষে সমান কৃষ্ণা এ পঞ্চ জনার।একা ধর্ম্ম-নৃপতির নাহি অধিকার।।সে কারণে দ্রৌপদী পাশায় নাহি জিত।তোমরা কি বল, আমি কহি সে উচিত।।বিকর্ণ-বচন শুনি যত সভাজন।সাধু সাধু বলি সবে বলয়ে বচন।।বিকর্ণ-বচন শুনি কর্ণে ক্রোধ হৈল।দুর্য্যোধনে চাহি তবে কহিতে লাগিল।।অনেক বিচার বুদ্ধি দেখি যে ইহায়।অগ্নি কাষ্ঠে জন্মিয়া সংহার করে তায়।।সেই মত অগ্নিরূপে এই তব কুলে।হেন অপরূপ কহিলেক সভাস্থলে।।এ সভায় যত লোক কিছু নাহি জানে।কেহ না কহিল, এ কহিল সে কারণে।।সবে জানে, কৃষ্ণা জিতা হইয়াছে পণে।বুঝিয়া উত্তর নাহি দেয় কোন জনে।।বালক হইয়া সভা মধ্যেতে আইল।বৃদ্ধের সমান নীতি-বচন কহিল।।কি জানহ ধর্ম্ম তুমি, কি জান বিচার।কৃষ্ণা জিতা নহে যে, সে কেমন প্রকার।।যুধিষ্ঠির যখন সর্ব্বস্ব কৈল পণ।জিনিল পাশায় তাহা সুবল-নন্দন।।সর্ব্বস্বের বাহির কি দ্রৌপদী সুন্দরী।বিশেষ কহিল যবে গান্ধারাধিকারী।।দ্রৌপদীর পণ কর বলিয়া বলিল।শুনিয়া পাণ্ডব কেন নিবৃত্ত না হৈল।।আর যে কহিলা কৃষ্ণা একবস্ত্রা হয়।সভামধ্যে ইহারে আনিতে না যুয়ায়।।বহু ভর্ত্তা যার, তার কিবা ভয় লাজ।তাহার কিসের লজ্জা আসিতে সমাজ।।যতেক সংসার এই বিধাতা সৃজিল।ভার্য্যার একই স্বামী নিয়ম করিল।।দুই স্বামী হৈলে বলি তারে দ্বিচারিণী।পঞ্চ স্বামী হৈলে পরে বেশ্যামধ্যে গণি।।সভায় আসিবে বেশ্যা লাজ তার কিসে।এমত বিচার মম মনেতে আইসে।।দুর্য্যোধন বলে, এই শিশু অল্পমতি।কি জানে বিচার-তত্ত্ব ধর্ম্ম-সূক্ষ্ম-গতি।।তবে আজ্ঞা করিল নৃপতি দুঃশাসন।পাণ্ডবগণের আন বস্ত্র আভরণ।।দ্রৌপদীর বস্ত্র আর যত অলঙ্কার।ঝটিতে আনিয়া দেহ অগ্রেতে আমার।।এত শুনি ততক্ষণে পঞ্চ সহোদর।বস্ত্র অলঙ্কার ফেলি দিলেন সত্বর।।একবস্ত্র পরিহিতা দ্রৌপদী সুন্দরী।দুঃশাসন টানিতেছে বসনেতে ধরি।।ছাড় ছাড় বলি কৃষ্ণা ঘন ডাক ছাড়ে।সভামধ্যে ধরি তর অঙ্গ-বস্ত্র কাড়ে।।সঙ্কটে পড়িয়া দেবী না দেখি উপায়।আকুল হইয়া কৃষ্ণা স্মরে যদুরায়।।ঝরঝর ঝরে অশ্রুজল দুনয়নে।কাতরেতে কৃষ্ণা ডাকে দেব নারায়ণে।।৪২. দুঃশাসন কর্ত্তৃক দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণও দ্রৌপদী কর্ত্তৃক শ্রীকৃষ্ণের স্তুতিওহে প্রভু কৃপাসিন্ধু, অনাথ-জনের বন্ধু,অখিলের বিপদ-ভঞ্জন।এ সব সভার মাঝ, ইথে নিবারিতে লাজ,তোমা বিনা নাহি অন্য জন।।যে প্রভু পালিতে সৃষ্ট, সংহার করিতে দুষ্ট,পুনঃ পুনঃ হও অবতার।তাঁহার চরণ-ছায়া, স্মরিয়া সঁপিনু কায়া,অনাথের কর প্রতিকার।।বিষ-অগ্নি খরক্রোধ, ভুজঙ্গ দন্তীর পদে,যেই প্রভু রাখিলা প্রহ্লাদে।তাঁহার চরণ-যুগে, দ্রৌপদী শরণ মাগে,রক্ষা কর বিষম প্রমাদে।।যাঁহার উজ্জ্বল চক্র, কাটিয়া মস্তক নক্র,নিস্তার করিল গজরাজ।বল করে দুরাশয়ে, শরণ নিলাম ভয়ে,তাঁহার চরণ-পদ্ম মাঝ।।যেই প্রভু ঈষদক্ষে, কৃপায় সংসার রক্ষে,নাচয়ে যে ফণাধর-মুণ্ডে।তাঁহার চরণ রঙ্গ, স্মরিয়া সঁপিনু অঙ্গ,রাখ প্রভু দুষ্ট কুরুদণ্ডে।।যে পবু কপটে ছলি, পাতালে লইল বলি,নির্ভয় করিলা শচীপতি।তাঁহার ত্রিপাদ-পদ্ম, ত্রিপথগামিনী সদ্ম,তাহা বিনা নাহি মোর গতি।।পরশি যে পদধূলা, অনেক কালের শিলা,দিব্যরূপ অহল্যা পাইল।জলনিধি করি বন্ধ, বিনাশিলে দশস্কন্ধ,দ্রৌপদী শরণ তাঁর নিল।।যে প্রভু পর্ব্বত ধরি, গোকুলে গোপের নারী,রক্ষা কৈল ইন্দ্রের বিবাদে।বেদশাস্ত্র লোকে খ্যাত, পতি-পুত্রগণ-নাথ,পাণ্ডুবধূ রাখহ প্রমাদে।।যাঁহার সৃজন সৃষ্টি, সংসারে যাঁহার দৃষ্টি,মোর দুঃখ কেন নাহি দেখ।বলিষ্ঠ দুর্জ্জন জনে, স্মরণ করিলে শুনে,এ সঙ্কটে কেন নাহি রাখ।।নৃসিংহ বামন হরি, বিষ্ণু সুদর্শন-ধারী,মুকুন্দ মুরারি মধুহারী।নারায়ণ বিষ্ণু রাম, ইত্যাদি যতেক নাম,ঘন ডাকে দ্রুপদ-কুমারী।।দ্রৌপদী আকুল জানি, অস্থির সে চক্রপাণি,যাঁর নাম আপদভঞ্জন।ধর্ম্মরূপে জগৎপতি, রাখিতে এলেন সতী,সত্যধর্ম্ম করিতে পালন।।আকাশ-মার্গেতে রয়ে, বিবিধ বসন লৈয়ে,দ্রৌপদীরে সঘনে যোগায়।যত দুঃশাসন কাড়ে, ততেক বসন বাড়ে,আচ্ছাদন করি সর্ব্ব-গায়।।লোহিত পিঙ্গল পীত, নীল শ্বেত বিরচিত,নানা-চিত্র-বিচিত্র বসনে।বিবিধ বর্ণের শাড়ী, দুঃশাসন ফেলে কাড়ি,পুঞ্জ পুঞ্জ হৈল স্থানে স্থানে।।পর্ব্বত-প্রমাণ বাস, দেখি লোকে লাগে ত্রাস,চমৎকার হইল সভাতে।কভু নাহি দেখি শুনি, সভাজন বল বাণী,ধন্য ধন্য দ্রুপদ-দুহিতে।।ধন্য গর্গ মহামুনি, নিস্তার করিতে প্রাণী,বাছিয়া থুইল কৃষ্ণ-নাম।যে নাম লইলে তুণ্ডে, বিবিধ দুর্গতি খণ্ডে,হেলে লভে স্ববাঞ্ছিত কাম।।নরেতে যে নাম ধরি, ভবসিন্ধু যায় তরি,খণ্ডে মৃত্যুপতি দণ্ড দায়।ক্ষণেক যে নাম ধরি, ভবসিন্ধু যায় তরি,খণ্ডে মৃত্যুপতি দণ্ড দায়।ক্ষণেক যে নাম জপি, অশেষ পাপের পাপী,সকল ধর্ম্মের ফল পায়।।ভারত-অমৃত-কথা, ব্যাস বিরচিত গাথা,অবহেলে যেই জন শুনে।দুস্তর সংসারে তরি, যায় সেই স্বর্গপুরী,কাশীরাম দাস বিরচনে।।৪৩. দুঃশাসনের রক্তপাণে ভীমের প্রতিজ্ঞাঅদ্ভুত দেখিয়া সভাজন হৈল স্তব্ধ।সাধু সাধু দ্রৌপদী, চৌদিকে হৈল শব্দ।।পূর্ব্বে কভু নাহি শুনি না দেখি নয়নে।দুর্য্যোধনে বহু নিন্দা করে সভাজনে।।ভ্রাতৃগণ মধ্যে বসি ছিল বৃকোদর।মহানাদে গর্জ্জিত উঠে সভার ভিতর।।অধরোষ্ঠ কম্পয়ে, কম্পয়ে কর পদ।ঘূর্ণিত নয়ন-যুগ যেন কোকনদ।।সভাশব্দ নিবারিয়া কহে সর্ব্বজনে।মোর বাক্য শুন যত আছ রাজগণে।।সত্য করি কহি আমি সবার অগ্রেতে।যাহা করি, তাহা যদি না পারি করিতে।।পিতৃ পিতামহ গতি না পান কখনে।এই কুরু কুলাধম দুষ্ট দুঃশাসনে।।রণমধ্যে ধরি বক্ষ করিব বিদার।করিব শোণিত পান করি অঙ্গীকার।।শুনিয়া সভার লোক হইল কম্পিত।প্রশংসিল সভাজন বুঝিয়া বিহিত।।তবে দুঃশাসন বড় হইল লজ্জিত।পুঞ্জ পুঞ্জ বস্ত্র দেখি হইল বিস্মিত।।পরিশ্রান্ত হৈয়া শেষে বসে ভূমিতলে।মলিন বদন হৈল যত কুরুবলে।।যত সাধুগণ সবে করয়ে রোদন।ধিক্ ধৃতরাষ্ট্র! নিন্দা করে সর্ব্বজন।।আপনিও অন্ধ, অন্ধ পুত্র জন্মাইল।কুরুবংশে এমন কখন না হইল।।তবে ত বিদুর নিবারিয়া সর্ব্বজনে।সভাজনে চাহিয়া বলেন ততক্ষণে।।এ সভার মধ্যে আছে যত রাজগণ।বুঝি এক বাক্য নাহি বল কি কারণ।।ভয়ার্ত্ত হইয়া যদি আসে সভামাঝে।সভাজনে চাহিয়ে তাহার ন্যায় বুঝে।।সভাতে থাকিয়া যেই বিচার না করে।সে অধর্ম্মী-জন যায় নরক ভিতরে।।৪৪. বিদুর কর্ত্তৃক বিরোচন ওসুধম্বা ব্রাহ্মণের প্রসঙ্গ কথনবিদুর কহেন, শুন পূর্বব বিবরণ।প্রহ্লাদ দৈত্যের পুত্র নাম বিরোচন।।অঙ্গিরা-ঋষির পুত্র সুধম্বা নামেতে।দুই জনে কোন্দল হইল আচম্বিতে।।বিরোচন বলে, নাহি রাজার সমান।সুধম্বা বলেন, দ্বিজ সবার প্রধান।।এই হেতু কোন্দল করিল দুই জন।ক্রুদ্ধ হৈয়ে পণ করিলেন ততক্ষণ।।যে জন হারিবে, তার লইব পরাণ।চল সাধুজন স্থানে, জিজ্ঞাসি বিধান।।বিরোচন বলে, জিজ্ঞাসিব কার স্থানে।দ্বিজ বলে, চল তব বাপের সদনে।।দুই জনে এই যুক্তি করিয়া তখন।শীঘ্রগতি চলি গেল যথায় রাজন।।সুধম্বা বলিল, শুন দৈত্যের প্রধান।মোর সহ দ্বন্দ্ব কৈল তোমার সন্তান।।পণ কৈল যে হারিবে, লইবে পরাণ।সত্য করি কহ তুমি ইহার বিধান।।দ্বিজপুত্রে রাজপুত্রে শ্রেষ্ঠ কোন্ জন।শুনিয়া বিস্ময় মানে প্রহ্লাদের মন।।চিত্ত কৈল, সত্য কৈলে হারিবে কুমার।কেমনে কহিব মিথ্যা নরক দুর্ব্বার।।এত চিন্তি জিজ্ঞাসিল কশ্যপের স্থান।কহ মুনিবর মোরে ইহার বিধান।।অসুর সুরের ধর্ম্ম তোমার গোচর।কেমনে হইবে শ্রেয়ঃ বলহ উত্তর।।কশ্যপ বলেন, যেই বিষণ্ণ হইয়া।মহাতাপে সভামধ্যে পড়য়ে আসিয়া।।সভামধ্যে থাকে যেই সাধু মহাজন।ন্যায় করি তার তাপ করে নিবারণ।।সভায় থাকিয়া যেই না করে বিচার।নরক হইতে তার নহিক নিস্তার।।যে পক্ষে অন্যায় করে, হয় সেই গতি।ইহলোকে মহাদুঃখ পায় নিতি নিতি।।হৃদয়ের শেল তার কদাচ না টুটে।অর্থশোক পুত্রশোক অবিলম্বে ঘটে।।অধর্ম্মীর পক্ষ হৈয়ে কহে যেই জন।তার দুই পাদ পাপ সে করে গ্রহণ।।অধর্ম্মী জানিয়া যেই নিন্দা নাহি করে।এক পাদ পাপ তার শরীরেতে ধরে।।সাক্ষী হৈয়ে যেই জন পক্ষ হৈয়ে কয়।শতেক পুরুষ সহ নরকে পড়য়।।কশ্যপের স্থানে শুনি এতেক বিধান।পুত্রমুখ চাহি বলে দৈত্যের প্রধান।।তারে শ্রেষ্ঠ বলি, যারে করি যে বন্দন।তেঁই তোমা হতে শ্রেষ্ঠ সুধন্বা ব্রাহ্মণ।।আমার হইতে শ্রেষ্ঠ অঙ্গিরারে গণি।তব মাতা হৈতে শ্রেষ্ঠা ইহার জননী।।পুত্রে এত বলিয়া সুধম্বা প্রতি কয়।তোমার অধীন আজি বিরোচন হয়।।মারহ রাখহ তুমি, যেই তব মন।যাহা ইচ্ছা কর, নাহি করি নিবারণ।।এত শুনি হৃষ্ট হৈয়ে বলে তপোধন।দ্বিগুণ লভুক আয়ু তোমার নন্দন।।কখনই তাপ নাই সত্যবাদী জনে।সে কারণে তব পুত্র বাড়ুক কল্যাণে।।এত বলি সুধম্বা আপন গৃহে গেল।সভাজন চাহি ক্ষত্তা এতেক বলিল।।তথাপি উত্তর নাহি দিল কোন জন।দুঃশাসনে বলে তবে সূর্য্যের নন্দন।।আনহ ধরিয়া দাসী কার মুখ চাহ।সভামধ্যে আনি পরে গৃহে লৈয়ে যাহ।।শুনিয়া দ্রৌপদী দেবী কাঁপে থরথরে।স্বামিগণ পানে চাহে কান্দি উচ্চৈঃস্বরে।।অধোমুখে রয়েছেন ভাই পঞ্চ জনে।দ্রৌপদী যতেক ডাকে শুনিয়া না শুনে।।স্বামিগণ অধোমুখে দেখি যাজ্ঞসেনী।সভাজনে চাহি বলে শিরে কর হানি।।পূর্ব্বেতে উত্তম কর্ম্ম আমার না ছিল।এই হেতু বিধাতা আমারে দুঃখ দিল।।পূর্ব্বে পিতৃগৃহে মম স্বয়ম্বর-কালে।আমারে দেখিয়াছিল নৃপতি সকলে।।আর কভু আমারে না দেখে অন্য জনে।আজি পুনঃ সভাজন দেখিল নয়নে।।চন্দ্র সূর্য্যা নিরখিলে যারা ক্রোধ করে।আমার এ দুর্গতি সে সবার গোচরে।।যত গুরুজনে আমি করি নমস্কার।একবাক্য বল সবে করিয়া বিচার।।দ্রুপদ-নন্দিনী আমি পাণ্ডব-গৃহিণী।সখা মম যাদবেন্দ্র গদা-চক্রপাণি।।কুরুকুলে শ্রেষ্ঠ সবর্ণা মহিষী।কহিতেছে সবে মোরে হইবারে দাসী।।আজ্ঞা কর আমারে যে ইহার বিধানে।আর ক্লেশ নাহি সহে আমার পরাণে।।শুনিয়া উত্তর দেন গঙ্গার নন্দন।পুনঃ পুনঃ কল্যাণী জিজ্ঞাস কি কারণ।।দ্রোণ আদি বৃদ্ধ যত আছেন সভায়।কাহার জীবন নাহি, সবে মৃতপ্রায়।।মৃতজনে জিজ্ঞাসিলে কি পাবে উত্তর।ধর্ম্ম বিনা সখা নাহি, ধর্ম্মাশ্রয় কর।।বহু কষ্টযুত নহে ধার্ম্মিক যে জন।ধর্ম্মবলে করে সব শত্রুর নিধন।।দাসীযোগ্যা অযোগ্যা যে পুছিলা বিধান।কহি আমি, শুন দেবি! মোর অনুমান।।তুমি দাসী হৈবে, যুধিষ্ঠিরের স্বীকার।যুধিষ্ঠিরে জিজ্ঞাসহ ইহার বিচার।।জিতা কি অজিতা তুমি, কহিবা আপনে।নির্ণয় করিতে ইহা নারে অন্য জনে।।সভাপর্ব্বে সুধারস পাশার নির্ণয়।ব্যাস-বিরচিত গীত কাশীদাস কয়।।৪৫. দ্রৌপদীর অপমানে ভীমের ক্রোধসভামধ্যে যাজ্ঞসেনী করেন ক্রন্দন।কেশে ধরি দুঃশাসন টানে ঘনে ঘন।।হাসিয়া দ্রৌপদী প্রতি বলে দুর্য্যোধন।কেন অকারণে কৃষ্ণা করহ রোদন।।তোর স্বামী যুধিষ্ঠির হারিলেক তোরে।পুনঃ পুনঃ কিবা আর জিজ্ঞাস সবারে।।অনুমানে বুঝি, তোর এই মনে লয়।একা যুধিষ্ঠির তোর অধিকারী নয়।।জানাউক চারি স্বামী সম্মুখে সবার।তোমাপর ধর্ম্মের নাহিক অধিকার।।মিথ্যাবাদী যুধিষ্ঠির, কহুক চারিজন।এইক্ষণে হয় তবে তোমার মোচন।।নতুবা কহুক নিজে ধর্ম্মের কুমার।কৃষ্ণার উপরে মোর নাহি অধিকার।।এত যদি বলিল নৃপতি দুর্য্যোধন।ভাল ভাল বলিয়া কহিল সভাজন।।শুনিবারে রাজগণ আছে কুতূহলে।কি বলে ধর্ম্মের পুত্র, ভীম কিবা বলে।।কিবা বলে ধনঞ্জয়, মাদ্রীর নন্দন।পঞ্চজন-মুখ সবে করে নিরীক্ষণ।।নিঃশব্দে নৃপতিগণ একৃদষ্টে চায়।কহিতে লাগিল ভীম চাহিয়া সভায়।।চন্দনে লেপিত ভুজ তুলি সভামাঝে।কহিতে লাগিল যেন কেশরী গরজে।।এই রাজা যুধিষ্ঠির পাণ্ডরের প্রতি।পাণ্ডবগণের নাহি ইহা বিনা গতি।।ইনি যদি নহিবেন পাণ্ডব-ঈশ্বর।এতক্ষণ কভু বাঁচে কৌরব পামর।।ওরে দুষ্টগণ, তব হেন লয় মতি।এতেক সহিতে পারে কাহার শকতি।।যুধিষ্ঠির মহারাজ হারিলা আপনা।ঈশ্বর হইল দাস, দাসী কি গণনা।।যুধিষ্ঠিরে জিত হৈয়ে জিনিলা সবারে।কাহার শকতি ইহা খণ্ডিবারে পারে।।আর কহি শুন দুষ্ট কৌরব সকল।আমি জীতে তো সবার নাহিক মঙ্গল।।যেইক্ষণে ধর্ম্মরাজে বসালি ভূতলে।যেইক্ষণে ধরিলি দ্রুপদ-সুতা-চুলে।।সেইক্ষণে আয়ুঃশেষ তোমা সবাকার।কুটি কুটি করি সবে করিব সংহার।।হের দেখ যমদণ্ড মোর দুই ভুজে।শচীপতি না জীয়ে পড়িলে ইথি মাঝে।।পর্ব্বত করি যে চূর্ণ, তোমা গণি কিসে।নির্ম্মূল করিতে পারি চক্ষুর নিমিষে।।ধর্ম্মপাশে বদ্ধ এই ধর্ম্মের নন্দন।তেঁই মূঢ়মতিগণ জীয়ে এতক্ষণ।।আর তাহে পুনঃ পুনঃ অর্জ্জুন নিবারে।এখনি দেখাই যদি রাজা আজ্ঞা করে।।সিংহ যেন ক্ষুদ্র মৃগে করয়ে সংহার।বিনাশিব ধৃতরাষ্ট্রের শতেক কুমার।।কহিত কহিতে ভীম ক্রোধে কম্পকায়।নয়নে সঘনে অগ্নিকণা বাহিরায়।।ভীষ্ম দ্রোণ বিদুরাদি মৃদু বলে বাণী।সকল সম্ভবে তোমা, ক্ষম বীরমণি।।ভারতের পুণ্যকথা অমৃত লহরী।শুনিলে অধর্ম্ম খণ্ডে, ভবসিন্ধু তরি।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon