অঙ্গরাজ কর্ণ

অঙ্গরাজ কর্ণ কুন্তির পুত্র। তার পিতা সূর্যদেব। তার প্রকৃত নাম বসুষেণ। তিনি ইন্দ্রকে তার অঙ্গ কর্তন করে কবচ ও কুন্ডল দান করেন বলে মর্ত্যলোকে দাতা কর্ণ নামে অভিহিত। একদিন দুর্বাসা মুনি কুন্তির গৃহে আতিথ্য গ্রহণ করেন। কুন্তি মুনিকে সেবা দিয়ে সন্তষ্ট করে তার কাছ থেকে এমন এক মন্ত্র লাভ করেন যে মন্ত্রের প্রভাবে তিনি যে দেবতাকে আহ্বান করবেন তার প্রসাদে তার পুত্র সন্তান লাভ হবে। একদিন কৌতহল বশত: সূর্যবেদকে আহ্বান করলে সূর্যদেবের প্রসাদে তিনি এক পুত্র সন্তান লাভ করেন। সূর্যদেব এও বলেন যে কুন্তি পুত্র সন্তানের জনম দিলেও তার কুমারীত্ব নষ্ট হবে না। সমাজ, ধর্ম ও লোক-লজ্জার ভয়ে কুন্তি শিশুটিকে একটি পাত্রে রেখে নদীতে ভাসিয়ে দিলেন। সূতবংশীয় অধিরথ ও তার স্ত্রী রাধা শিশুটিকে নদীতে পেয়ে নিজ বাড়ীতে নিয়ে আসেন এবং লালন পালন করতে থাকেন। শিশুটির নাম রাখ হয় বসুষেণ।

কর্ণ দ্রোণাচার্যের কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষার জন্য গেলে সূতবংশীয় বলে তাকে অস্ত্রশিক্ষা প্রদাননে অস্বীকৃতি জানান। পরে কর্ণ পরশুরামের কাছে নিজের পরিচয় গোপন করে অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করেন। একদিন গুরুদেব পরশুরাম পাথরে মাথা রেখে শয়ন করছিলেন; কর্ণ গুরুদেবের মাথা তার উরুতে রাখেন। ঠিক এ সময় একটি বিষাক্ত পোকা কর্ণকে কামড় দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে রক্তপাত করে (পোকাটি ছিল ইন্দ্র )। কিন্তু গুরুদেবের নিদ্রাভঙ্গ হবে মনে করে নিজে এক জায়গায় স্থির করে রাখলেন। গুরুদেব নিদ্রাভঙ্গের পর রক্ত দেখে বুঝতে পারেন কর্ণকে পোকা কামড়িয়েছে। তার সহিষ্ণুতা দেখে পরশুরামের সন্দেহ হয়। কারণ ব্রহ্মণের এত সহিষ্ণুতা গুণ নেই। সত্য পরিচয় প্রদানের জন্য কর্ণকে আদেশ দেন। তখন কর্ণ গুরুদেব পরশুরামের কাছে তার আসল পরিচয় প্রদান করেন। কর্ণের পরিচয় পেয়ে গুরুদেব পরশুরাম ক্রুদ্ধ হন এবং তাকে এ বলে অভিশাপ দেন যে, ছলনার আশ্রয় নিয়ে ব্রহ্মাস্ত্র বিদ্যা শিক্ষা করার জন্য প্রয়োগের সময় তার স্মৃতি থেকে বিলুপ্ত হবে ( বিস্মৃত হবে)। অসাবধানতা বশত: এক ব্রাহ্মণের হোম-ধেনু হত্যা করার জন্য ব্রাহ্মণ তাকে অভিশাপ দেন যে, যুদ্ধের সময় তার রথচক্র এক জায়গায় আটকে যাবে এবং তার প্রতিপক্ষ তাকে সেখানে হত্যা করবে। একবার জরাসন্ধের সাথে কর্ণের যুদ্ধ হয়, যুদ্ধে জরাসন্ধ তার যুদ্ধ কৌশল দেখে মুগ্ধ হন এবং তাকে মালিনী নগর দান করেন।

মামা শুকুনির পরেই দুর্যোধনের প্রধান পরামর্শদাতা ছিলেন কর্ণ। জতুগৃহ দাহের পরামর্শ কর্ণই দিয়েছিলেন। দুর্যোধন যখন বৈষ্ণবযজ্ঞ করেন তখন কর্ণ প্রতিজ্ঞা করেন যে, অজুর্নকে হত্যা না করে তিনি জল স্পর্শ করবেন না। আসুরব্রত পালনের সময় যদি কেহ তার কাছে কিছু প্রার্থনা করে তবে তিনি তাহাই দান করবেন। তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার দানের পরীক্ষা নেয়ার জন্য ব্রাহ্মণরূপে তার গৃহে আশ্রয় নিয়ে তার পুত্রের মাংশ খাওয়ার বাসনা ব্যক্ত করেন। কর্ণ তার সন্তানকে হত্যা করে ব্রাহ্মণকে তার মাংশ ভোজন করান। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কর্ণের দানশীলতার প্রমাণ পেয়ে তার সন্তান বৃষকেতুকে জীবন দান করেন। ইন্দ্রও কর্ণের দানশীলতার পরীক্ষা নেয়ার জন্য ব্রাহ্মণরূপে এসে কর্ণের কাছে তার কবচ ও কুন্ডল প্রার্থনা করেন। যদিও পিতা সূর্যদেব তাকে এ বিষয়ে পূর্বেই সর্তক করেছিলেন। কিন্তু প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকায় কর্ণ ইন্দ্রকে তার কবচ ও কুন্ডলী দান করলেন। তবে সূর্যদেবের পরামের্শে কর্ণ ইন্দ্রদেবের কাছে অর্জুনকে বধের জন্য একাগ্নী শক্তি প্রার্থনা করেন। ইন্দ্র তাকে সে শক্তি প্রদান করেন এবং বলেন ঘোর সংকটময় কালে এ শক্তি ব্যবহার করা যাবে এবং শুধু একজনে বধ করা যাবে। ভীমের পুত্র ঘটোৎকচ যুদ্ধের চতুর্দশ দিবসে সংহার মূর্তি ধারণ করলে কর্ণ তার উপর এ শক্তি প্রয়োগ করে ঘটোৎকচকে বধ করেন এবং সাথে সাথে এ শক্তির বিনাশ হয়।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ চলাকালে একদিন কৃষ্ণ কর্ণের সাথে দেখা করেন এবং তার জন্ম সম্পর্কে অবহিত করেন। বিবরণ শ্রবণ করে কর্ণ শ্রীকৃষ্ণের অনুরোধ সবিনয়ে প্রত্যাখান করেন। এ মুর্হুতে কুরুপক্ষ ত্যাগ করে পান্ডবপক্ষে যোগ দেয়া সম্ভব নয়। কারণ দুর্যোধন তার ভরসাই যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। মৃত্যু ভয়ে তিনি বিচলিত নন। তাদের এ কথোপকথন ভ্রাতা যুধিষ্ঠির এর কাছে পোপন রাখার জন্য শ্রীকৃষ্ণকে অনুরোধ করেন। কারণ যুধিষ্ঠির যদি কোনভাবে জানতে পারে যে কর্ণ তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা তাহলে যুধিষ্ঠির কখনই রাজ্য গ্রহণ করবে না। কর্ণ যখন গঙ্গাতীরে জপরত অবস্থায় ছিলেন তথায় কুন্তি উপস্থিত হন। মাতা কুন্তি কর্ণকে যুদ্ধ হতে বিরত এবং রাজ্য গ্রহণের কথা বলেন। সূর্যদেবও মাতা কুন্তির প্রস্তাব মেনে নেয়ার জন্য বলেন। কিন্তু কর্ণ তাও প্রত্যাখান করেন। মাতা কুন্তিকে তার কার্যের জন্য নিন্দা করেন এবং মাতা কুন্তিকে আশ্বস্থ করেন যে অর্জুন ব্যতীত কোন পান্ডবকে তিনি বধ করবেন না। পিতামহ ভীষ্ম শরশয্যায় কর্ণের জন্ম পরিচয় জানার পর কর্ণকে পান্ডবপক্ষ অবলম্বন করার জন্য অনুরোধ করেন। ভীষ্মের প্রস্তাবও তিনি রাখতে পারেননি।

দ্রোণের মৃত্যুর পর কর্ণ কৌরবপক্ষের সেনাপতি হন। যুদ্ধের ষোড়শ দিনে তিনি যুধিষ্ঠির, ভীম, নকুল ও সহদেবকে পরাজিত করেন। মাতা কুন্তির কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকায় তিনি তাদেরকে হত্যা করেননি। পরশুরাম ও ব্রাহ্মণের অভিশাপ থাকায় যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি ব্রহ্মাস্ত্র বিদ্যা প্রয়োগে বিস্মৃত হন। ব্রাহ্মণের অভিশাপে যুদ্ধক্ষেত্রে কর্ণের রথের চাকা ভূমিতে আটকে যায় এবং অর্জুন তখন তাকে অঞ্জলিক বাণে নিহত করেন।

মহাভারতের কাহিনীতে কর্ণ এক বিচিত্র চরিত্র। যুদ্ধ বিদ্যায় অর্জুনের সমকক্ষ। কিন্তু সূতপুত্র বলে নিগৃহীত যা কর্ণকে মানসিকভাবে বিক্ষিপ্ত করে তুলে। সমাজের অন্যায় আচরণ তাকে যুদ্ধংদেহী স্বভাবে পরিণত করে। এ জন্যেই কর্ণ অন্যায় যুদ্ধ জেনেও দুর্যোধনের সাথে মিত্রতা করে। ভাল ও খারাপ উভয়েরই পরামর্শদাতা ছিলেন কর্ণ। পান্ডবদের লাঞ্চনা করার পিছনের তার হাত ছিল। জতুগৃহ দাহে তার পরামর্শ ছিল। দ্রৌপতির বস্ত্রহরণ কালে রাজসভায় কর্ণ মৌন ছিলেন। অর্জুনপুত্র অভিমন্যু বধে অন্যায় যুদ্ধে কর্ণ জড়িত ছিলেন। তার এক হাতে ছিল ধর্ম ও অন্য হাতে ছিল অধর্ম। একদিকে তিনি ছিলেন ধর্মশীল, প্রতিজ্ঞা পালনে একনিষ্ট, মহৎ, নির্লোভ ও দাতা। অপরদিকে আবার ছিলেন খলনায়ক। আত্মাভিমানী, অহঙ্কারী, প্রতিহিংসা পরায়ণ ও পাপ স্বভাবের। এ দুয়ের পরম্পর বিরোধী কর্মের অপূর্ব সমন্বয় কর্ণ চরিত্রকে এক অদ্ভুদ, বৈচিত্র্যময় ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণরূপে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র