ভগদত্ত



ভগদত্ত:মহাভারতের কাহিনীতে খুব একটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র না হলেও তিনি ছিলেন একজন মহারথ এবং প্রাগজ্যোতিষের রাজা। তার পিতার নাম নরকাসুর ও তার জন্ম হয়েছিল বাষ্কাল নাম এক অসুরের অঙ্গ থেকে। ধর্মরাজ ইন্দ্রের সাথে ছিল ঘনিষ্ট সম্পর্ক। রাজা দুর্যোধন ও পাঞ্চালরাজ ধৃষ্টদ্যুম্ন এর শ্বশুর। হস্তিনাপুর রাজ্যের সাথে তার আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে প্রথম পরাজিত রাজা ছিলেন ভগদত্ত। যুদ্ধেক্ষেত্রে হাতি পরিচালনায় ছিল তার অসামান্য দক্ষতা ও কৌশল। তার হাতির নাম সুপ্রতীক। একে তো হস্তিনাপুরের সাথে তার আত্মীয়তার সম্পর্ক দ্বিতীয়ত: অপমান। তাই তাকে পান্ডবদের পক্ষাবম্বলন করতে বাধ্য করে। কৃষ্ণের সাথে তার পিতার শত্রুতা সত্ত্বেও, দুর্যোধনের প্রতি আনুগত্যের কারণে ভগদত্ত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন।

দ্বাদশ দিবসের যুদ্ধ। দেবরাজ ইন্দ্র যে হস্তীতে চড়ে দৈত্যদানব সংহার করেছিলেন সে হস্তীর বংশধরের পিঠে চড়ে প্রাগজ্যোতিষের রাজা ভগদত্ত বৃকোদর বা ভীমসেনের প্রতি ধাবিত হলেন। ভগদত্তের হস্তী সুপ্রতীক ভীমের রথকে চূর্ণ করে ফেলল। ভীমসেন অঞ্জলিকা বেধ বিদ্যা আয়ত্ত ছিল বলে পলায়ন না করে হস্তীর কলেবরে বিলীন হয়ে ইহাকে আঘাত করতে লাগলেন। আর সুপ্রতীক কুলাল চক্রের ন্যায় আচরণ করতে লাগলেন। তখন ভীমসেন হস্তীর গাত্র হতে বহির্গত হলেন। ভগদত্তের হস্তী সুযোগ বুঝে ভীমসেনকে তার প্রাণনাশের চেষ্টা করেন। বিপদ বুঝে ভীমসেন আবারও হস্তীর গাত্রে বিলীন হলেন। সুযোগ বুঝে ভীমসেন হস্তীর গাত্র হতে বাহির হয়ে অতিদ্রুত গমন করেন। উপস্থিত সৈন্যগন মনে করলেন ভীমসেন মাতঙ্গ কর্তৃক নিহত হয়েছেন।

এ দিকে ভীমসেন নিহত হয়েছে মনে করে যুধিষ্ঠীর ধৃষ্টদ্যূম্নসহ ভগদত্তের অভিমুখে যাত্রা করলেন। তারপর ভগদত্তের প্রতি অসংখ্য সুতীক্ষ্ণ শর নিক্ষেপ করতে লাগলেন। ভগদত্ত অঙ্কুশ দ্বারা সেই সকল শর ধ্বংস করতে লাগলেন। গজ সুপ্রতীকের আক্রমনে পান্ডব ও পাঞ্চালসৈন্যগণ পলায়ন করতে লাগল। সে সময় মহারাজ দশার্ণাধিপতিও ভগদত্তের হাতে নিহত হন। গজরাজ সাত্যকির রথ চূর্ণ করলে তিনিও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করেন। মহাবীর অভিমন্যু, দ্রৌপদীপুত্রগণ, চেকিতান, ধৃষ্টকেতু ও যুযুৎসু শরে ভগদত্তের হস্তীকে বিদ্ধ করতে লাগল। গোপাল অরণ্যমধ্যে দন্ডঘাতে যেরুপ পশুগণকে তাড়না করে, সেরূপ মহাবীর ভগদত্ত পান্ডব সৈন্যগণকে বার বার তাড়না করতে লাগল এবং তারা পলায়ন করতে লাগল। পলায়নকালে মাতঙ্গের শব্দ ও সৈন্যগণের কোলাহল শ্রবণ করে অর্জুন বুঝতে পারলেন এটি ভগদত্তের যুদ্ধের ময়দানে সেনা সংহার করার ভয়ংকর নিনাদ। তখন অর্জুন বাসুদেবকে বললেন,” বাসুদেব! মহারাজ, ভগদত্ত কুঞ্জরযান বিশারদ ও ইন্দ্রের সমান। এ সসাগড়ায় তিনি কুঞ্জরযোধীগণের প্রধান। তার মাতঙ্গের মত মাতঙ্গও নেই। তার মাতঙ্গ কৃতবর্মা, জিতক্লম, অস্ত্রাঘাত ও অগ্নিস্পর্শ সহিষ্ণু। সে আজ সমস্ত পান্ডব সৈন্যকে সংহার করবে। আমি আপনি ছাড়া কেহ আর একে নিবারণ করতে সক্ষম নয়। সুতরাং ভগদত্তের অভিমুখে রথ চালনা করুন।” কিন্তু পথিমধ্যে ত্রিগর্ত্তদেশীয় দশ হাজার যোদ্ধ, চার হাজার নারায়ণী সেনা ও চৌদ্দ হাজার সংশপ্তক সেনা তাকে যুদ্ধে আহ্বান করল। একদিকে ভগদত্ত পান্ডব সৈন্যদের সংহার করছে। অন্যদিকে সংশপ্তকগণ তাকে যুদ্ধে আহ্বান করছে। অর্জুন উভয় সংকটে পড়লেন। তিনি কি এ স্থান ত্যাগ করে যুধিষ্ঠীরের নিকট গমন করবেন নাকি নাকি সংশপ্তকদের সংগে যুদ্ধ করবেন। অবশেষে অর্জুন সংশপ্তদের সংহার করার সিদ্ধান্ত নিলেন। অর্জুনকে দুদিক থেকে আক্রমন করে তাকে বধ করার এ কৌশলটি দুর্যোধন ও কর্ণ আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্ত তাদের কৌশল ব্যর্থ হলো। সংশপ্তক ও অর্জুনের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ শুরু হলো। সংশপ্তকদের শরজালে চতুর্দিক এমনভাবে আচ্ছ্ন্ন হলো যে কুয়াশার মত কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। এদিকে সংশপ্তকদের পরাক্রম দর্শনে বাসুদেব মুগ্ধ ও ঘর্মাক্ত হওয়া মাত্রই ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করে অসংখ্য সংশপ্তকদের সংহার করে ভগদত্তের দিকে রথ নিয়ে যাওয়ার জন্য বাসুদেবকে বললেন।

তারপরভগদত্তের দিকে যাওয়ার সময় ত্রিগর্ত্তাধিপতি সুশর্ম্ম ও তার পাঁচ ভাইকে যমালয়ে পাঠান। অর্জুনের শরে কৌরব সেনাগণ সংহার হতে দেখে ভগদত্ত অর্জুনের প্রতি রোষ্ট হন এবং অর্জুনের দিকে ধাবিত হন। মহাবীর ভগদত্ত মাতঙ্গের উপর হতে ইন্দ্রের ন্যায় অর্জুনের প্রতি শরবর্ষণ করতে লাগলেন। মহান ধনুর্ধর অর্জুনও ভগদত্তের নিক্ষিপ্ত শর মাঝপথে শরজাল দ্বারা ধ্বংস করে তার প্রতি বাণ নিক্ষেপ করতে লাগলেন। অর্জুন ও কেশবের প্রতি বহুবিধ শর নিক্ষেপ করে তাদের হত্যা করার জন্য হস্তী সুপ্রতীককে সঞ্চালন করলেন। মহামতি বাসুদেব কালান্তক যমের মত ভগদত্তের হস্তীকে অগ্রসর হতে দেখে কৃষ্ণ দ্রুত দক্ষিণ দিকে রথ সরিয়ে নিলেন। ঐ সুযোগে পার্থ ইচ্ছে করলে ঐ হস্তীসহ ভগদত্তকে হত্যা করতে পারতেন কিন্তু যুদ্ধের নীতি স্মরণ করে অর্জুন তাকে হত্যা করতে ইচ্ছে করলেন না। কিন্তু ভগদত্ত গজস্কন্দ হতে অর্জুন ও বাসুদের প্রতি অনবরত শর নিক্ষেপ করতে লাগলেন। সমর বিশারদ ভগদত্ত অর্জুনের উপর চতুর্দশ অতি তীব্র “তোমর” নিক্ষেপ করলে অর্জুন তা প্রতিহত করেন। ভগদত্ত কেবশের প্রতি লৌহময় সুবর্ণদন্ডভূষিত শক্তি প্রয়োগ করলে রণবিশারদ অর্জুন ঐ শক্তিকে দ্বি-খন্ডিত করেন। ভগদত্তের শরসমূহ অর্জুনের কিরীটকে কিছুটা স্থানচূত্য করলে পার্থ তা ঠিক করে ভগদত্তকে বললেন.” হে প্রাগজ্যোতিষেশ্বর! সবকিছু উত্তমরূপে অবলোকন করে লও।” মহারথ ভগদত্ত পার্থের বাক্যে অতিশয় রোষ্ট হলেন এবং অর্জুন ও বাসুদের প্রতি অতি ভয়াবহ শরাসন নিক্ষেপ করলেন। পার্থ অতি দ্রুত শরাসন ও তূণীর ছেদন করে দ্বিসপ্ততি শরে ভগদত্তের সমুদয় স্থান বিদ্ধ করেন। এতে ভগদত্ত প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে মন্ত্রপূত অস্ত্র “বৈষ্ণবাঙ্কশ” ধনঞ্জয়ের বক্ষে নিক্ষেপ করলে, মহাত্মা বাসুদেব পার্থকে রক্ষা করার নিমিত্তে ঐ সর্বঘাতী ”বৈষ্ণবাস্ত্র” নিজের বক্ষে ধারণ করেন। বৈষ্ণবাস্ত্র বৈজয়ন্তী মালা হয়ে বাসুদেবের বক্ষে স্থান পেল। তখন অর্জুন দু:খিত হয়ে বললেন,” বাসুদেব! আপনি বলেছিলেন যুদ্ধ করবেন না কিন্তু আপনি আপনার কথা রাখেননি। আমি তো অসমর্থ নই।” তখন মহাত্মা বাসুদেব বললেন,” পার্থ! শোন তোমাকে একটি গুহ্য কথা বলি। হে পার্থ! আমি লোকের হিতসাধন ও পরিত্রাণের জন্য নিজেকে চার মূর্তিতে বিভক্ত করেছি । আমার এক মূর্তি পৃথিবীমন্ডলে তপস্যা, দ্বিতীয় মূর্তি জগতের সাধু ও অসাধু কর্ম অবলোকন, তৃতীয় মূর্তি মর্ত্যলোকে আশ্রয় করে মানব কার্য সাধন এবং চতুর্থ মূর্তি সহস্র বৎসর শয়ন করে নিদ্রিত থাকে। হাজার বছর পর নিদ্রান্তে আমি যোগ্য ব্যক্তিদের বর প্রদান করি। সে সময় পৃথিবীর প্রার্থনায় আমি তার পুত্র নরককে “বৈষ্ণবাস্ত্র” প্রদান করি। প্রাগজ্যোতিষরাজ ভগদত্ত নরকাসুরের নিকট হতে এ অস্ত্র প্রাপ্ত হয়েছেন। জগতে সকলেই এ অস্ত্রের বধ্য। তাই তোমাকে রক্ষা করার জন্য আমি “বৈষ্ণবাস্ত্র” গ্রহণ” করে মাল্যে পরিণত করি। এখন তুমি ভগদত্তকে বিনাশ কর।” তারপর অর্জুন “নারাচ” অস্ত্র নিক্ষেপ করে সুপ্রতীকে হত্যা করার পর অর্ধচন্দ্র বাণে ভগদত্তকে হত্যা করলেন।

ভগদত্ত একজন মহারথ, যুদ্ধ বিশারদ, কুঞ্জর চালনায় বিশেষজ্ঞ। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি একাই পান্ডব ও পাঞ্চাল সৈনিকদের বিনাশ করেছিলেন। ভগদত্তের কুঞ্জরের শব্দ শ্রবণ করে অর্জুন শংকিত হলেন কারণ তিনি জানতেন তিনি ছাড়া ভগদত্তকে কেহ সংহার করতে পারবে না। সে বিবেচনায় বলা যায় ভগদত্ত প্রকৃত অর্থেই একজন মহাবীর ছিলেন। ভগদত্ত কর্তৃক নিক্ষিপ্ত “বৈষ্ণবাস্ত্র” স্বয়ং বাসুদেব বুকে ধারণ করে অর্জুনকে রক্ষা করেছিলেন।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

সনাতন ধর্মে কি পশুবলী’র বিধান আছে?

মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র