০৬.মৃত পতি পুত্রাদি দর্শনে গান্ধারী প্রভৃতি স্ত্রীগণেরবিলাপ ও শ্রীকৃষ্ণের প্রতি গান্ধারীর অনুযোগজন্মেজয় কহিলেন শুন মহামুনি।গান্ধারী কি কহিলেন কহ তাহা শুনি।।কেমনে ধরিল প্রাণ শত পুত্রশোকে।ক্রোধ করি কোন্ কথা কহিল কৃষ্ণকে।।পূর্ণব্রক্ষ্ম অবতার দেব নারায়ণ।জানিয়া শাপিল দেবী কিসের কারণ।।এই ত আশ্চর্য্য অতি মম মনে লয়।বিস্তারিয়া সেই কথা কহ মহাশয়।।কহেন বৈশস্মায়ন শুনহ রাজন।একচিত্ত হয়ে শুন ভারত কথন।।কৃষ্ণের প্রবোধ বাক্য মনেতে বুঝিয়া।উঠিয়া বসিল দেবী চেতন পাইয়া।।কহে কিছু কৃষ্ণকে গান্ধারী প্রতিব্রতা।বিচিত্র বীর্য্যের বধূ রাজার বনিতা।।দেখ কৃষ্ণ একশত পুত্র মহাবল।ভীমের গদার ঘাতে মরিল সকল।।দেখ কৃষ্ণ বধূগণ উচ্চৈঃস্বরে কান্দে।দেখিতে না পায় যারে কভূ সূর্য্যে চান্দে।।শিরীষ কুসুম জিনি সুকোমল তনু।দেখিয়া যাহার রূপ রথ রাখে ভানু।।হেম বধূগণ দেখ আসে কুরুক্ষেত্রে।ছিন্নকেশ মত্তবেশ দেখ তুমি নেত্রে।।এই দেখ নৃত্য করে পতিহীনা বধূ।মুখ অতি শুশোভন অকলঙ্ক বিধু।।এই দেখ গান করে নারী পতিহীনা।কন্ঠশব্দ শুনি যেন নারদের বীনা।।পতিহীনা কত নারী বীরবেশ ধরি।ওই দেখ নৃত্য করে হাতে অস্ত্র ধরি।।হে কৃষ্ণ দেখহ মম পুত্রের দুর্গতি।যাহার মস্তক ছিল সুবর্ণের ছাতি।।নানা আভরণে যার তনু সুশোভন।সে তনু ধূলায় ওই দেখনারায়ণ।।সহজে কাতর বড় মায়ের পরাণ।সুপুত্র কুপুত্র দুই মায়ের সমান।।এতকালে এত শোক সহিতে না পারি।বুঝাইবা আমারে কিরূপে হে মুরারী।।পুত্রশোক শেল সব বাজিছে হৃদয়।দেখাবার ছৈলে দেখাতাম মহাশয়।।সংসারের মধ্যে শোক আছয়ে যতেক।পুত্রশোক তুল্য শোক নাহি তার এক।।গভীধারী হয়ে যেই করেছে পালন।সেই সে বুঝিতে পারে পুত্রের মরণ।।এ শোক সহিতে কেবা আছয়ে সংসারে।বিবরিয়া বাসুদেব কহ দেখি মোরে।।সহিতে না পারি আমি হৃদয়ের তাপ।ভাবিতে উঠয়ে মনে মহা মনস্তাপ।।মাহবলবন্ত মম শতেক নন্দন।কি দিয়া আমারে বুঝাইবা নারায়ণ।।মহারাজ দুর্য্যোধন লোটায় ভূতলে।চরণ পূজিত যার নৃপতিমন্ডলে।।ময়ুরের পাখে যার চামর ব্যঞ্জন।কুক্কুর শৃগাল তারে করয়ে ভক্ষণ।।দেখিতে না পারি আমি এ সব যন্ত্রণা।শকুনি দিলেক যুক্তি খাইয়া আপনা।।যাত্রাকালে পুত্র মোরে জিজ্ঞাসিল জয়।যে কথা কহিনু তাহা শুন মহাশয়।।যথা ধর্ম্ম তথা কৃষ্ণ জয় সেইখানে।এই কথা আমি কহিলাম দুর্য্যোধনে।।না শুনিল মম বাক্য করি অনাদর।রাখিল ক্ষত্রিয় ধর্ম্ম করিয়া সমর।।কাতর না হৈল রণে আমার নন্দন।সমর করিয়া সবে ত্যজিল জীবন।।হৃদয়ে রহিল কিন্তু বড় এক ব্যথা।সংগ্রামে আইল দুর্য্যোধনের বনিতা।।এই দুঃখ নারায়ণ না পারি সহিতে।ওই দেখ বধূগণ আম্রশাখা হাতে।।আর এক নিবেদন শুন অন্তর্য্যামী।দুর্য্যোধন না মানিল হিত উপদেশ।।তাহার উচিত ফল পাইল বিশেষ।শকুনি আমার ভাই বড় দুরাচার।তাহার বুদ্ধিতে হৈল বংশের সংহার।।মরিলেক শত পুত্র বংশের সংহতি।বৃদ্ধকালে রাজার হইবে কিবা গতি।।পান্ডুর নন্দন রাজ্য লবে আপনার।পুত্র নাহি কেবা আর যোগাবে আহার।।জলাঞ্জলি দিতে কেহ নাহি পিতৃগণে।এইহেতু ত্রুন্দন করি যে রাত্র দিনে।।এত বলি গান্ধারী হইল অচেতন।করুণা সাগর কৃষ্ণ করেন সান্ত্বন।।কৌরব বনিতা কান্দে পতি পুত্রশোকে।তা দেখিয়া পান্ডব আছয়ে অধোমুখে।।মৃতপুত্র কোলে করি করয়ে বিলাপ।যুধিষ্ঠির রাজার বাড়িল মনস্তাপ।।এমন সময়ে আসি দ্রৌপদী সুন্দরী।পুত্রশোকে কান্দে শিরে করাঘাত করি।।বিরাটনন্দিনী কান্দে শোকে অচেতনা।তাহা দেখি পাইলেন অর্জ্জুন বেদনা।।উত্তরা ধরিয়া অভিমন্যুর চরণ।লাভ ভয় ত্যাগ করি যুড়িল ক্রন্দন।।উত্তরা বলিল মোরে বিধি প্রতিকূল।হেনজন মরে যার গোবিন্দ মাতুল।।ধনঞ্জয় পিতা যায় হেন জন মরে।এ বড় দারুণ শোক রহিল অন্তরে।।মোহেতে আকুল বড় রাজা যুধিষ্ঠির।বিলাপিয়া ভূমেতে পড়িল ভীমবীর।।শোকেতে অর্জ্জুন বীর করেন রোদন।বিলপিয়া কান্দে দুই মাদ্রীর নন্দন।।কুন্তী যাজ্ঞসেনী দোঁহে শোকে অচেতনা।মহা শোক সিন্দু মাঝে পড়ে সর্ব্বজনা।।ফুকারিয়া কুন্তীদেবী না পারে কান্দিতে।হইল অন্তরে দগ্ধ কর্ণের শোকেতে।বিলপিয়া উত্তরা যে যায় গড়াগড়ি।প্রাণনাথ কোথা ওহে গেলে মোরে ছাড়ি।।গোবিন্দ তোমার মামা পিতা ধনঞ্জয়।আহা মরি কোথা গেলে অর্জ্জুন তনয়।।অস্থির পান্ডবগণে দেখি নারায়ণ।সান্ত্বনা করেন কহি মধুর বচন।।কুরুক্ষেত্রে উঠিল ক্রন্দন কোলাহল।অশ্রুতে প্লাবিত হৈল সংগ্রামের স্থল।।না হয় শোকের অন্ত পুনঃ পুনঃ বাড়ে।হা নাথ বলিয়া পতিহীনা ডাক ছাড়ে।।পড়িয়া গান্ধারী আছে অচেতনা শোকে।দুর্য্যোধন বিনা অন্য শব্দ নাহি মুখে।।কি বলিব ওহে কৃষ্ণ মুকুন্দ মুরারী।আজি হৈতে শূণ্য হৈল হস্তিনানগরী।।না ধরিল আমার বচন দুর্য্যোধন।তাহার কারণে শত পুত্রের নিধন।।শান্তনু তনয় কত বুঝাইল নীত।দ্রোণ কত বুঝাইল শাস্ত্রের বিহিত।।বিদুর কহিল কত বিবিধ প্রকারে।না শুনিল কদাচিত গুরু অহঙ্কারে।।না শুনিল কার কথা যুদ্ধ কৈল পণ।সকল জীবের গতি তুমি নারায়ন।।শুনিয়াছি আমি সব সঞ্জয়ের মুখে।আর কত অনুযোগ কহিব তোমাকে।।কহিতে কহিতে ক্রোধ হৈল অতিশয়।পুনরপি শোক ত্যাজি গোবিন্দেরে কয়।।ওহে কৃষ্ণ জনার্দ্দন দৈবকীকুমার।তোমা হৈতে হৈল মম বংশের সংহার।।অনর্থের মূল তুমি দেব নারায়ণ।কর্ম্ম দেখাইয়া কর দোষ প্রক্ষালন।।তোমাতে সংহার হয় মিলয় তোমাতে।জীবের কারণ আর নাহি তোমা হৈতে।।সকল তোমার মায়া তুমি সে প্রধান।গুণ দোষ ধর্ম্মধর্ম্ম তুমি ভগবান।।থাকিয়া প্রাণীর ঘটে যে বলাও যারে।প্রাণী করে সেই কর্ম্ম দোষ কেন তারে।।অসাধুর মত কোথা ধর্ম্মের বাসনা।সাধুব্যক্তি তব পদ করয়ে ভাবআ।।সাধুযত প্রশংসা করয়ে চক্রপানি।সংসারে যতেক দেখি তার মূল তুমি।।অতএব, কহি নাথ কর অবধান।করাইলে কৌরব পান্ডবেতে সংগ্রাম।।ভেদ জন্মাইলে তুমি ওহে নরপতি।না পারি কহিতে দেব তোমার প্রকৃতি।।কৌরব পান্ডব তব উভয় সমান।তাহে ভেদ যুক্তি নহে শুন ভগবান।।ধর্ম্ম আত্না যুধিষ্ঠির কিছু নাহি জানে।সংগ্রামে প্রবৃত্ত ধর্ম্ম তোমার সন্ধানে।।হিংসার নাহিক লেশ ধর্ম্মের শরীরে।ভেদ জন্মাইলে তুমি কহিয়া তাহারে।।যদি বিসন্বাদ হৈল ভাই দুইজনে।তোমার উচিত নহে উপস্থিতি রণে।।তারে বন্ধু বলি সব করায় সমতা।তুমি শিখাইয়া দিলে বিবাদের কথা।।কহিতে তোমার কথা দুঃখ উঠে মনে।সমান সন্বন্ধ তব কুরু পান্ডুসনে।।বরণ করিতে তোমা গেল দুর্য্যোধন।পালঙ্কে আছিলা তুমি করিয়া শয়ন।।জাগিয়া আছিলা তুমি দেখি দুর্য্যোধনে।কপটে মুদিয়া আঁখি নিদ্রা গেলে কেনে।।পশ্চাতে অর্জ্জুন আসে সে কথা শুনিয়া।উঠিয়া বসিলে মায়া নিদ্রা উপেক্ষিয়া।।নারায়নী সেনা দিলা আমার নন্দনে।ছলিতে অর্জ্জুন বাক্য শুনিলা প্রথমে।।সারথি হইলে তুমি অর্জ্জুনের রথে।সমান সম্বন্ধ আর রহিল কিমতে।।তবে সে হইত ব্যক্ত সমান সম্বন্ধ।তোমাতে উচিত নহে শুন কৃষ্ণচন্দ্র।।তারপর এক কথা শুনহ অচ্যুত।করিলে দারুণ কর্ম্ম শুনিতে অদ্ভুত।।মধ্যস্থ হইয়া যবে গিয়াছিলে তুমি।চাহিলে সে পঞ্চ গ্রাম শ্রুত আছি আমি।।না দিলেক মম পুত্র কি ভাবিয়া মনে।আসিয়া কহিলে তুমি পান্ডব নন্দনে।।সদাচারী পান্ডুপুত্র রাজ্য নাহি মনে।তাহে তুমি ভেদ করি কহিলা বচনে।।আপনি দিলেন ভেদ কৌরব পান্ডবে।নহে তুমি প্রবৃত্ত হইলে কেন তবে।।সে কালে আপন ঘরে যেতে যদি তুমি।সম স্নেহ বলি তবে জানিতাম আমি।।যুদ্ধ যুক্তি দিলা তুমি পান্ডুর কুমারে।প্রবঞ্চনা করি কৃষ্ণ ভান্ডিলা আমারে।।সব জানিলাম তুমি অনর্থের মুল।করিলা বিনাশ তুমি যত কুরুকুল।।কহিতে তোমার মর্ম্ম বিদরয়ে প্রাণ।তবে কেন বল তুমি উভয় সমান।।আমি সব শুনিয়াছি সঞ্জয়ের মুখে।না কহিলে স্বাস্থ্য নাহি জানাই তোমাকে।।কি কহিতে পারি আমি তোমার সম্মূখ।উচিত কহিতে পাছে মনে ভাব দুঃখ।।সুখ দুঃখ কহিবেক সবাকার স্থান।আর কিছু কহি তাহা শুন ভগবান।।অনাদি পুরুষ তুমি দেব ভগবান।বিশ্বেশ্বর হও তুমি পুরুষ প্রধান।।সবাকার মূল তুমি দেব জগন্নাথ।সহজে অবলা আমি কি কব সাক্ষাৎ।।কর্ণের আছিলা শক্তি অর্জ্জুন নিধনে।তাহা দিয়া বিনাশিলে ভীমের নন্দনে।।যুধিষ্ঠির সহ যুক্তি করি যদুপতি।যুদ্ধেতে প্রবৃত্ত করাইলা তুমি রাতি।।ভীমসুত ঘটোৎকচ মায়াযুদ্ধ কৈল।ক্রোধে কর্ণ সেই অস্ত্র ভৈমীরে মারিল।।ওহে কৃষ্ণ এ সকল তোমার মন্ত্রণা।কর্ম্ম সব মূল বলি প্রবোধিলা আমা।।তোমার যতেক কর্ম্ম না পারি কহিতে।কুরু পন্ডু সম মিল বলহ সভাতে।।চক্রুব্যুহ দ্রোণাচার্য্য করিল রচন।চক্রব্যূহ যুদ্ধ মাত্র জানয়ে অর্জ্জুন।।আর কেহ নাহি জানে পান্ডব সভাতে।অভিমন্যু শুনেছিল থাকিয়া গর্ভেতে।।অভিমন্যু বধ কথা শুনিয়া অর্জ্জুন।জয়দ্রথে নাশ হেতু করিল সে পণ।।সঞ্জয়ের মুখে আমি শুনিয়াছি সব।উপকার যত তুমি করেছ মাধব।।মহাভারতের কথা অমৃত অর্ণবে।পাঁচালী প্রবন্ধে কহে কাশীরাম দেবে।।০৭. শ্রীকৃষ্ণের প্রতি গান্ধারীর শাপকুরুকুল বিনাশিলা বসুদেব সুত।কহিতে অনল উঠে কি কব অচ্যুত।।পুত্রশোকে কলেবর জ্বলিছে আমার।বল দেখি হেন শোক হয়েছে কাহার।।শুন কৃষ্ণ আজি শাপ দিব হে তোমারে।তবে পুত্রশোক মোর ঘুচিবে অন্তরে।।অলঙ্ঘ্য আমার বাক্য না হবে লঙ্ঘন।জ্ঞাতিগণ হৈতে কৃষ্ণ হইনু নিধন।।পুত্রগণ শোকে আমি যত পাই তাপ।তুমি এ যন্ত্রণা পাবে দিলাম এ শাপ।।মম বধুগণ যেন করিছে ক্রন্দন।এইমত কান্দিবেক তব বধূগণ।।তুমি যেন ভেদকৈলা কুরু পান্ডবেতে।যদুবংশ তেন হবে আমার শাপেতে।।কৌরবের বংশ যেন হইল সংহার।শুন কৃষ্ণ এই মত হইবে তোমার।।গোবিন্দেরে শাপ দিল কুপিয়া গান্ধারী।শুনি কম্পমান হৈল ধর্ম্ম অধিকারী।।অন্তর্য্যামী হরি জানিলেন এ কারণ।সতীর অলঙ্ঘ্য বাক্য না হবে লঙ্ঘন।।আমি জন্মিলাম ভূমি ভার নিবারণে।পৃথিবীর ভার যে ঘুচিল এত দিনে।।ঈষৎ হাসিয়া কৃষ্ণ বলেন বচন।মম জ্ঞাতি মারিতে পারয়ে কোনজন।।উঠহ গান্ধারী, নাহি করহ ক্রন্দন।শাপ দিলা তথাপি না কর সন্বরণ।।দুর্য্যোধন দোষে হৈল বংশের নিধন।না জানিয়া আমারে শাপিলা অকারণ।।আমি যদি দোষে থাকি ফলিবেক শাপ।আপনার দোষে আমি পাব নমস্তাপ।।এতেক বলিয়া মায়া করি নারায়ণ।পুত্রশোকে গান্ধারীকে করেন মোচন।।মহাভারতের কথা অমৃত সমান।কাশীরাম দাস কহে শুনে পুন্যবান।।০৮. যুধিষ্ঠিরাদি কর্ত্তৃক মৃত স্বজনগণের শরীর সৎকারকৃষ্ণের বচনে ধৃতরাষ্ট্র নরপতি।যুধিষ্ঠিরে ডাকিয়া বলিছে মহামতি।।মন দিয়া শুন পুত্র আমার বচন।কুরুক্ষেত্র যুদ্ধেতে মরিল যত জন।।রাজ রাজ্যেশ্বর রাজা কুমার রাজার।গণনা করিতে নারি কতেক হাজার।।সুহৃদ বান্ধব কার নাহি সহোদর।সবাকার প্রেতকর্ম্ম করহ সত্বর।।অগ্নি কার্য্য সবাকার করহ এখন।নিমন্ত্রিয়া যতেক আনিল দুর্য্যেধন।তব আমন্ত্রণে এল যত যত রাজ।না করিলে প্রেতকার্য্য হইবেক লাজ।।শ্রীধৌম্য সঞ্জয় আর বিদুর সুমতি।ইন্দ্রসেন ধর্ম্মসেন যুযুৎসু প্রভৃতি।।ইহারা সকলে যাক তোমার সহিত।করুক অন্ত্যেষ্টি কর্ম্ম যে যার উচিত।।কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধে যত এসেছিল প্রাণী।সবার সৎকার কর ধর্ম্ম নৃপমণি।।ধৃতরাষ্ট্র আজ্ঞা পেয়ে ধর্ম্মের নন্দন।চিতাধূমে অন্ধকার করিল গগণ।।যুযুৎসু দিলেন অগ্নি রাজার আজ্ঞায়।ভীমার্জ্জুন যুধিষ্ঠির আছেন সহায়।।জ্ঞাতিগণে অগ্নি দিল ধর্ম্মের নন্দন।চিতাধূমে অন্ধকার হইল গগন।।অপর যতেক রাজা মৃত কুরুক্ষেত্রে।যুযুৎসু দিলেন অগ্নি রাজ আজ্ঞ মাত্রে।।অষ্টাদশ অক্ষৌহিনী হইল দাহন।অনুমৃতা হইল যতেক নারীগণ।।বিষাদ পাইয়া ধর্ম্ম করেন রোদন।প্রবোধ করেন তাঁরে শ্রীমধুসূদন।।অপূর্ব্ব কৃষ্ণের লীলা কে বুঝিতে পারে।এ তিন ভূবন আছে যাঁহার শরীরে।।বিশ্বাস করয়ে লোক এ সব বচনে।বিশ্বরূপ যশোদা দেখিল বিদ্যমানে।।চারি ভাই সঙ্গে লয়ে পান্ডুর কুমার।গেলেন তর্পণ স্নান হেতু যত আর।।গঙ্গায় চলিল সব গোবিন্দ সংহতি।পঞ্চ পান্ডবাদি ধৃতরাষ্ট্র নরপতি।।গান্ধারী প্রভৃতি আর যতেক রমনী।।স্নান আদি কৈল সবে জাহ্ববীর জলে।ধৌম্য পুরোহিত মন্ত্র পড়ায় সকলে।।দুর্য্যোধন আদি করি শত সহোদর।সবার তর্পন করিলেন নৃপবর।।আর যত রাজগণ সংগ্রামে মরিল।একেয এক সবাকার তর্পন করিল।।ক্ষত্র মত নিত্যকর্ম্ম ছিল পূর্ব্বাপর।সেইমত করিল পান্ডুর সহোদর।।স্ত্রীপুরুষ কৈল যত পারত্রিক কর্ম্ম।যেমন বিধান ছিল শাস্ত্রমত ধর্ম্ম ।।হেনকালে কুন্তীদেবী গিয়া সেইখানে।যুধিষ্ঠিরে কহিলেন মধুর বচনে।।কর্ণ মহাবীর হয় আমার নন্দন।সুতপুত্র বলি যারে বলিলা বচন।।কন্যাকালে জন্ম হয় আমার উদরে।সূর্য্যের ঔরসে জন্ম জানাই তোমারে।।অসময় বলি তায়ে করি বিসর্জ্জন।মঞ্জুষা করিয়া ভাসাইলাম তখন।।তবে সুত পেয়ে তারে করিল পালন।প্রসিদ্ধ হইল সেই রাধার নন্দন।।বলবান দেখি দুর্য্যোধন নিল তারে।পূর্ব্বের বৃত্তান্ত এই জানাই তোমারে।।মায়ের বচন শুনি রাজা যুধিষ্ঠির।বরিষয়ে দুই ধারে নয়নের নীর।।বিষাদ করিয়া ধর্ম্ম করেন রোদন।প্রবোধ করেন তাঁরে শ্রীমধুসূদন।।যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসেন কুন্তীরে তখন।পুনশ্চ কহিল কর্ণ জন্ম বিবরণ।।দুর্ব্বাসার মন্ত্র পায় যেমত প্রকারে।কহিল সকল কথা রাজা যুধিষ্ঠিরে।।এতেক শুনিয়া ধর্ম্ম মায়ের বচন।মলিন বদনে পুনঃ করেন রোদন।।এতদিনে হেন কথা কহিলে জননী।কর্ণ মম সহোদর এতদিনে শুনি।।ভ্রাতৃবধ করি আমি পাপিষ্ঠ চন্ডাল।কর্ণ মম সহোদর বিক্রমে বিশাল।।হাহাকার করিয়া কান্দয়ে পঞ্চজন।পুনশ্চ প্রবোধ দেন দৈবকীনন্দন।।তবে যুধিষ্ঠির রাজা শোকেতে জর্জ্জর।যোড়হাতে কহিলেন জননী গোচর।।শুনগো জননী আমি করি নিবেদন।জানিলে না হত কভু কর্ণের নিধন।।গুপ্ত করি রাখিলে না কহিলে আমারে।বৃথা বধ করিলাম জ্যেষ্ঠ সহোদরে।।এ সকল কথা যদি কহিতে জননী।তবে কেন বিনাশিব কর্ণ মহাজ্ঞানী।।তবে কেন বিনাশিব রাজা দুর্য্যেধন।দুঃশাসন দুর্ম্মুখাদি ভাই শত জন।।তবে কেন ভীষ্ম বীর ঈদৃশ হইবে।অভিমন্যু পুত্র কেন রণেতে পড়িবে।।তবে কেন হইবেক দ্রোণের নিধন।পূর্ব্বেতে এ সব যদি কহিতে বচন।।দৈবে কর্ণ রাজা ছিল হস্তীনানগরে।দুর্য্যোধন তার বাক্য অন্যথা না করে।।কর্ণ- আজ্ঞাকারী ছিল যত কুরুগণ।যুদ্ধ না হইত মাতা জানিলে এমন।।জ্যেষ্ঠ ভাই পিতৃ তুল্য সর্ব্বশাস্ত্রে বলে।এ কলঙ্ক রাখিলাম আপনার কুলে।।এ বড় দারুণ শোক রহিল অন্তরে।এতদিনে হেন কথা কহিলে আমারে।।মা হইয়া পুত্র প্রতি এমত তোমার।শুন গো জননী তাপ বাড়িল অপার।।শাপ দিব আমি বড় দুঃখ পাই মনে।গুপ্ত কথা না থাকিবে নারীর বদনে।।নারীর উদরে কভূ কথা না রহিবে।অতি গুপ্ত কথা হৈলে প্রকাশ হইবে।।এত বলি যুধিষ্ঠির অতি শোকাকুল।পুনঃ প্রবোধেন কৃষ্ণ হয়ে অনুকূল।।কৃষ্ণবাক্যে প্রীত পেয়ে পান্ডুর নন্দন।শাস্ত্রমত করিলেন কর্ণের তর্পণ।।ঘটোৎকচ রাক্ষসের করেন তর্পন।পুনঃ স্নান করি কূলে উঠেন তখন।।কূলে রহিলেন ধর্ম্ম হইয়া অসুখী।ভীমার্জ্জুন সহদেব কেহ নহে সুখী।।গান্ধারী পুত্রের শোকে বিস্তর কান্দিল।পতিহীনা নারীগণ যত সঙ্গে ছিল।।শান্ত করি যুধিষ্ঠির আনেন শিবিরে।ধৃতরাষ্ট্র প্রভৃতি রহিল অনাহারে।।শিবিরে রহিল সবে বিষাদিত মনে।গান্ধারী পুত্রের শোকে কান্দে রাত্রিদিনে।।অনাহারে তিন রাত্রি করিল বঞ্চন।নিশিযোগে ফলাহার কৈল সর্ব্বজন।।আজি তিন দিন হৈল পুত্র নাহি দেখি।কোথা দুর্য্যোধন কোথা দুম্মুখ ধানুকী।।গান্ধারী কৃষ্ণেরে কন করিয়া রোদন।আজি শূন্য হৈল মম সকল ভুবন।।কোথা গেল দুর্য্যোধন কহ যদুমণি।অকারণে প্রাণ ধরি আমি অভাগিনী।।সকল সংসার শূন্য পুত্রের বিহনে।শুন কৃষ্ণ কত দুঃখ উঠে মম মনে।।শতপুত্র আমার যেমন শশধর।কি হইল কোথা গেল কহ যদুবর।।সে হেন সুন্দর মুখ অনলে পুড়িল।নানা আভরণ অঙ্গে কেবা কাড়ি নিল।।অগুরু চন্দনে লিপ্ত ছিল নিরন্তরে।কেমনে অনল দিলা এমন শরীরে।।স্বপ্নবৎ দেখি এই সকল সংসার।কহ কোথা গেল মম শতেক কুমার।।সুবর্ণ রচিত পুরী নিল কোন্ জন।কহ কৃষ্ণ কোথা গেল আমার নন্দন।।সকুন্ডল কনক শরীর সুকুমার।দুঃশাসন আদি পুত্র কোথা সে আমার।।শোক দুঃখ ভয়ে আমি হৈলাম উম্মনা।কোথা শত বধূ মোর খঞ্জননয়না।।স্মরণ করিতে মম বিদরে পরাণ।হস্তিনা হইল শূন্য শুন ভগবান।।এ বড় অন্তরে দুঃখ নহিল আমার।বৃদ্ধকালে কোন গতি হইবে আমার।।মরিলে পুত্রের হাতে না পাব আগুন।ইহা ভাবি আরো দুঃখ বাড়ে চতুগুন।।কি বুঝিয়া এত তাপ দিলেন আমারে।শুন হে করুণাময় নিবেদি তোমারে।।এক জ্বালা আগেতে না জানি গদাধর।পুত্রশোকে আমার দহিছে কলেবর।।ওহে ভীমসেন শুন আমার বচন।আর বিষ তোমারে না দিবে দুর্য্যোধন।।আর কেবা জতুগৃহ করিবে নির্ম্মাণ।ঘুচাইল সব ভয় প্রভু ভগবান।।শুকুনি আমার ভাই গেল কোথাকারে।আর কে মন্ত্রণা দিবে আমার পুত্রেরে।।ওহে যুধিষ্ঠির তব হৈল শুভ দশা।আর কে তোমার সঙ্গে খেলাইবে পাশা।।গান্ধারের নাথ কোথা দুরাত্মা শকুনি।তোমা সবাকার ভয় ঘুচিল এখনি।।এত বলি গান্ধারী পড়িল ভূমিতলে।যুধিষ্ঠির ধরি তুলিলেন সেইকালে।।সান্ত্বনা করেন কৃষ্ণ বিবিধ প্রকারে।নানাবিধ শাস্ত্র কথা বুঝাইল তাঁরে।।শুন গো গান্ধারী শুন পূর্ব্ব বিবরণ।ভুমিষ্ঠ হইল যবে রাজা দুর্য্যোধন।।এ শোকে সে সব কথা নহেত বিধান।বিদ্যুর কহিল যত সকলি প্রমাণ।।দুর্য্যোধন শোকেতে ক্রন্দন কর বৃথা।অনিত্য সংসার এই আমি আছি কোথা।।অদ্য বা পক্ষান্তে হয় অবশ্য মরণ।শুন গো গান্ধারী শোক কর অকারণ।।বিস্ময় পান্ডব কথা অমৃত লহরী।শুনিলে অধর্ম্ম খন্ডে পরলোকে তরি।।শুন শুন ওহে ভাই হয়ে একমন।কাশীরাম দাস কহে ভারত কথন।।০৯. শ্রীকৃষ্ণ, ব্যাস ও নারদের নানা উপদেশে যুধিষ্ঠিরাদির হস্তিনায় গমনবলেন বৈশস্পায়ন শুনহ রাজন।যুধিষ্ঠিরে তখন কহেন নারায়ন।।অঙ্গীকার তথাপি না করেন রাজন।পুনশ্চ কহেন কৃষ্ণ মধুর বচন।।শুন ওহে ধর্ম্মরাজ ক্ষমা দেহ মনে।হস্তিনানগরে চল আমার বচনে।।পৃথিবী পালহ রাজা সিংহাসনে বসি।ধর্ম্মের নন্দন তুমি হবে রাজ্যবাসী।।যে দুঃখ পাইলে তুমি বেড়াইয়া বনে।সে সকল কথা কেন নাহি কর মনে।।রজঃস্বলা দ্রৌপদীর কেশেতে ধরিল।সভামধ্যে দুঃশাসন বাটিতি আনিল।।দ্রৌপদীরে উরু দেখাইল দুর্য্যোধন।তাহা সব পাসরিলে ধর্ম্মের নন্দন।।তথাপি এতেক ভয় বুঝিতে না পারি।বিলম্ব না কর, চল হস্তিনানগরী।।এত যদি কহিলেন দৈবকী নন্দন।দিলেন পান্ডব জ্যৈষ্ঠ উত্তর বচন ।।দুর্য্যোধন পাইল আপন কর্ম্মফল।আমাকে উচিত নহে ভকবৎসল।।রাজ্যভোগ কখন নাহিক মম মনে।নিরবধি পড়ে মনে ভাই দুর্য্যোধনে।।যুক্তি নহে সে সকল বচন শুনিতে।ভীমার্জ্জুন লয়ে তুমি যাহ হস্তিনাতে।।গোবিন্দ বলেন শুন পান্ডুর নন্দন।পুনঃ পুনঃ মম বাক্য না কর লঙ্ঘন।।তোমাকে না শোভে হেন দিতে অনুমতি।তুমি রাজা হৈলে আমি পাইব পীরিতি।।এমত কৃষ্ণের লীলা কেহ নাহি জানে।অনুমতি দেন ধর্ম্ম কৃষ্ণের বচনে।।হস্তিনা যাইব চল দেব গদাধর।শুনি আনন্দিত হল বীর বৃকোদর।।যুধিষ্ঠির রাজা হইবেন হস্তিনার।শুনি আনন্দিত হয় মাদ্রির কুমার।।অর্জ্জুন প্রফুল্ল হন ধর্ম্মের বচনে।ত্বরা করিলেন সবে হস্তিনা গমনে।।হেনকালে ধৃতরাষ্ট্র করেন ক্রন্দন।কোথায় ছাড়িয়া যাই পুত্র দুর্য্যোধন।।দুঃশাসন দুম্মুর্খ প্রভৃতি যত জন।স্মরিয়া আমাকে লহ শুন বাছাধন।।দেশেতে দেখিব গিয়া আমি কার মুখ।পান্ডব নিলেক রাজ্য ধন জন সুখ।।সকরুণে হেন কথা কহিল রাজন।শুনি যুধিষ্ঠির হইলেন অচেতন।।পড়িল ভূমিতে ধর্ম্ম হইয়া মুর্চ্ছিত।কৃষ্ণার্জ্জুন সহদেব দেখি হৈল ভীত।।তুলিয়া রাজাকে বসাইলেন শ্রীহরি।বসিয়া কহেন রাজা কৃতাঞ্জলি করি।।কি আর প্রবোধ দেহ ওহে দেব হরি।জ্যেষ্ঠতাত শোক আর সহিতে না পারি।।কেমনে এ সব কথা শনিব শ্রবনে।শুন কৃষ্ণ কার্য্য নাহি মম রাজ্যধনে।।দ্রোপদী মরিবে পঞ্চপুত্র বিবর্জ্জিতা।অভিমন্যু শোকে কান্দে বিরাট দুহিতা।।করি প্রাণ ত্যাগ প্রায়শ্চিত্ত যে ইহার।আর কিছু নাহি বল দৈবকী কুমার।।ধৃতরাষ্ট্র বিরাটদি দ্রুপদ রাজন।রাজ্য হেতু নাশিলাম শুন নারায়ণ।।পৃথিবীতে আছিল যতেক নরপতি।মম হেতু সবাকার হইল দুর্গতি।।কেন পাপ আশা আমি বাড়ইনু মনে।নাশ হৈল কুরুকুল আমার কারণে।।রাজ্যলুব্ধ হয়ে আমি হইনু দুরন্ত।ভীষ্ম হেন পিতামহ করিলাম অন্ত।।অর্জ্জুনের বাণে পিতামহ ম্রিয়মান।শিখন্ডী সম্মূখে গিয়া কৈল অপমান।।রথ হৈতে যখন পড়িল ভীষ্মবীর।আকাশ হইতে যেন খসিল মিহির।।পুষিয়া পালিয়া মোরে শিখাইল নীত।হেন পিতামহে মারি না হয় উচিত।।কহিতে অধিক দুঃখ উঠে নারায়ণ।রাজ্যে কার্য্য নাহি মম পুনঃ যাব বন।।তবে ব্যাস প্রবোধ দিলেন নরবরে।শুন ধর্ম্ম, শোক কেন ভাবহ অন্তরে।।আমি যাহা কহি তাহা শুন মন করি।গতজীবে শোক কৈলে বাড়ে যত বৈরী।।যথায় সংযোগম তথা বিয়োগ অবশ্য।সলিলের বিন্ব যেন সংসার রহস্য।।জন্মিলে মরণ যেন অবশ্যই লোক।জন্ম মৃত্যু দেহ ধরি না করিহ শোক।।এ সব ঈশ্বর লীলা শুন নরপতি।সেই সে বুঝিতে পারে কৃষ্ণে যার মতি।।ইহাতে বিবাদ কেন শুনহ রাজন।পুনঃ পুনঃ আপনি কহেন নারায়ন।।এত বলি কহিলেন বহু ইতিহাস।যুধিষ্ঠিরে প্রবোধ দিলেন মুনি ব্যাস।।সংসার প্রসঙ্গে সেই কথা মুনিগণে।সনকেরে সিজ্ঞাসা করিল তপোবনে।।শুনিল মুনিয়া যাহা সনেকের স্থানে।সে কথা কহেন ব্যাস ধর্ম্মের নন্দনে।।অনিত্য শরীর ভাই শুন সর্ব্বজন।নানামত ব্যাধি হেতু প্রাণীর নিধন।।বিধাতা লিখিল যারে যেমন প্রকারে।খন্ডন না হয় সেই জনমিলে মরে।।আপনার কর্ম্ম হেতু মরয়ে আপনি।চিরজীবী কেহ নহে শুন নৃপমণি।।প্রথম বয়সে কেহ, কেহ মধ্যকালে।শেষকাল সরে কেহ বার্দ্ধক্য হইলে।।বড় ছোট নাহি জানি মরে সর্ব্বজন।কর্ম্ম অনুরূপ জান পান্ডুর নন্দন।।অস্ত্রাঘাতে মরে কেহ জলেতে ডুবিয়া।আস্ত্রাঘাতী হয় কেহ গরল খাইয়া।।সর্পাঘাতে মরে কেহ গরল খাইয়া।সর্পাঘাতে মরে কেহ মরে সান্নিপাতে।শার্দ্দুল ভক্ষনে কেহ মাতঙ্গ হইতে।।যাহার যেমত কর্ম্ম তার সেই গতি।হেতু মাত্র মৃত্যু হয় শুন নরপতি।।মহাধনবান রাজা নানা ভোগ করে।শুন যুধিষ্ঠির সেই কাল পেলে মরে।।ভিক্ষা মাগি যেই জন খায় নিতি নিতি।কাল প্রাপ্তে সে ও মরে শুন নরপতি।।নানা শাস্ত্র বিচারিয়া করয়ে বিচার।ভোগ হৈলে অন্তে মৃত্যু হয় যে তাহার।।অতি দুঃখী মরে চিরজীবী কেহ নয়।শুন যুধিষ্ঠির এই সর্ব্ব শাস্ত্রে কয়।।এ সব ঈশ্বর আজ্ঞা কালে মরে প্রাণী।তুমি জ্ঞানবান কত বুঝাইব আমি।।নিত্য শত স্বর্ণ কেহ দ্বিজে দেয় দান।কালে তার মৃত্যু হয় না হয় এড়ান।।কোন কোন জন নিত্য নিত্য পাপ করে।শুন নরপতি সে ও কাল পেলে মরে।।কিন্তু ধর্ম্ম পথে প্রাণী করিবে যতন।কদাচিত পাপ পথে নাহি দিবে মন।।ধর্ম্ম কর্ম্ম আচরিতে বেদের বিধান।এ সব ঈশ্বর লীলা শুন সাবধান।।আমার কৌতুক দেখ সকল সংসার।কালেতে হরিবে সব ধর্ম্মের কুমার।।শীত গ্রীষ্ম বর্ষা যথা হয় পরিবর্ত্ত।সেইমত দুঃখ সুখ কালের বিবর্ত্ত।।শুন যুধিষ্ঠির কেহ কারে নাহি মানে।অগাধ সলিলে মৎস্য থাকয়ে বন্ধনে।।বনে চরে মৃগ, কারে না করে হিংসন।দেখহ ঈশ্বর লীলী তাহার মরণ।।ঔষধে না করে ত্রাণ জানাই তোমারে।কর্ম্মক্ষয় হৈলে প্রাণী অকস্মাৎ মরে।।ছাওয়াল অকর্ম্মা থাকে বাক্য না সরে।ভোগ না সমপ্তি হৈতে কেন সেই মরে।।ইথে কি তোমার, শোক কেন কর বৃথা।মনে বিচারিয়া দেখ তব পিতা কোথা।।কোথা সে মান্ধাতা পৃথিদিলেক দ্বিজেরে।যযাতি নহুষ কোথা শিবি নরবরে।।হরিশচন্দ্র রুক্মাঈদ ধর্ম্মশীল দাতা।কালেতে মরিল তাহা বল আছে কোথা।।দুইখানি কাষ্ঠ স্রোতে একএ মিলিন।পুনশ্চ বিচ্ছেদ হয় কে কোথায় রয়।।সেই মত জানিবা বান্ধব সমাগম।জ্ঞানবান লোকে তাহা না করয়ে ভ্রম।।নারীগণ গীতবাদ্য করে অনুক্ষণ।লজ্জাহীন হয়ে শেষে করয়ে ক্রন্দন।।পিতৃ মাতৃ দেখহ যতেক পরিবার।মনে বিচারিয়া দেখে কেহ নহে কার।।কত জন্ম মরণ, নির্ণয় নাহি জানি।জননী রমনী হয়, রমনী জননী।।পুত্র হয়ে পিতা হয়, পিতা হয় পুত্র।অদ্ভুত ঈশ্বর লীলা কর্ম্ম মাত্র সূত্র।।পথিক সহিত যেন পরিচয় পথে।সেইমত দিন কত থাকে এক সাথে।।তাহাতে বিচ্ছেদ হয় নিজকর্ম্ম গুণে।শোক ত্যাজ যুধিষ্ঠির কিবা ভাব মনে।।কালে আসে কালে যায় কেহ নাহি দেখে।কোথা হতে আসে প্রাণী কোথা গিয়া থাকে।।ক্ষণেক সংযোগ হয় সদা বিভিন্নতা।শুন যুধিষ্ঠির তুমি শোক কর বৃথা।।কোথা আছিলাম পূর্ব্বে কোথা চলি যাব।কে বুঝে ঈশ্বর লীলা কাহাকে কহিব।।কুম্ভকার চক্রে যেন দিবানিশি ভ্রমে।সেইমত জানিহ বান্ধব সমাগমে।।ভাস্করের গতায়াতে দিন হয় ক্ষয়।সংসার কর্ম্মেতে থেকে তৈন্য হারায়।।জন্ম জরা মরণ দেখিতে সদা হয়।তথাপি লোকের মনে নাহি হয় ভয়।।যখন জন্ময়ে লোক এইত সংসারে।তখন আইসে প্রাণী যম অধিকারে।।রসিক জনাতে যেন সেবে মহারস।জরা জীর্ণসুখে থাকে নহে মৃত্যুবশ।।ধ্যানে নিরবধি থাকে তপস্বীর সনে।শুন যুধিষ্ঠির তারে হরে লয় যমে।।আপনার শরীর রাখিতে নাহি পারি।কি লাগিয়া পর লাগি শোক করে মরি।।এত সব তত্ত্ব কথা সনক কহিল।অস্র নামে ব্রাক্ষ্মণের সন্দেহ ভাঙ্গিল।।শোক ত্যজ যুধিষ্ঠির শুন নরপতি।মহাসুখে ভুঞ্জ সসাগরা বসুমতী।।ব্যাসের বচন শুনি ধর্ম্ম নৃপবর।মৌনেতে রহেন কিছু না দেন উত্তর।।কৃষ্ণেরে কহেন তবে বীর ধনঞ্জয়।কত ক্লেশ পান রাজা কহিতে সংশয়।।জ্ঞাতিবধ পাপে মগ্ন রাজা যুধিষ্ঠির।বিশেষ আকুল বড় ভীম মহাবীর।।কেমনে পাইবে রাজ্য কহ ভগবান।বৃথা করিলাম তবে এতক সংগ্রাম।।আপনি নিশ্চয় কহ রাজা যুধিষ্ঠিরে।তবে রাজ্য পাই প্রভু জানাই তোমারে।।দেশান্তরী হয়েছিনু রাজ্যের কারণে।স্মরিয়া সে সব কথা দুঃখ উঠে মনে।।বিরাট নগরে বঞ্চিলাম বৎসরেক।হীনকর্ম্ম করিলাম কহিব কতেক।।হেন রাজ্য ত্যাজিতে চাহেন যুধিষ্ঠির।আপনি বুঝাও ও পুনঃ শুন যদুবীর।।রাজ্য হেতু জ্ঞাতিগণ হইল বিনাশ।যুধিষ্ঠিরে আপনি বুঝাও শ্রীনিবাস।।বিক্রম করেছি যত শুনহ শ্রীহরি।বুঝাও ধর্ম্মেরে তুমি মায়া দূর করি।।সকল তোমার সাধ্য শুন নারায়ণ।রাজ্য লাগি করিলাম যত পরাক্রম।।রাজ্য করিবারে প্রভু বড় ইচ্ছা হয়।আপনি বিশেষ তাহা জান মহাশয়।।রাজ্য ধন নাহি চান ধর্ম্ম নৃপমণি।আমাকে চাহিয়া, নৃপে বুঝাও আপনি।।অর্জ্জুনের বাক্য শুনি উঠেন গোবিন্দ।নয়ন প্রসন্ন যেন বিকচারবিন্দ।।ভক্তি করি কাছে গিয়া বসেন আপনি।যুধিষ্ঠির হাতে ধরি কহেন তখনি।।শোক ত্যাজ মহারাজ শান্ত কর মন।কেন নাহি শুন রাজা ব্যাসের বচন।।যে সব মরিল রণে জ্ঞাতি বন্ধুজন।শোক কৈলে পাবে হেন না হয় রাজন।।সেব্যমান উদ্বেগে কলহ কন্ডু বাড়ে।শোকে মন দিল রাজা লক্ষী তারে ছাড়ে।।আপনি নারদ পুনঃ সঞ্জয়ে কহিল।তবেত সঞ্জয় রাজা শোক পাসরিল।।হিতকথা কহিলেন ব্যাস মুনিবর।তাহাতে আপনি কেন না দেহ উত্তর।।এতেক কহেন যদি কমললোচন।কিছু না কহেন তবে ধর্ম্মের নন্দন।।পুনঃ ব্যাস মুনি তাঁরে বুঝান বিস্তর।মৌনভাবে রাজা তাঁরে না দেন উত্তর।।কহিল নারদ মুনি নানা উপদেশ।না করিবা শোক রাজা কহিনু বিশেষ।।জ্ঞাতিবধ বলি নাহি ভয় কর চিতে।শোক নিবারিয়া রাজা চল হস্তিনাতে।।শ্রাদ্ধ শান্তি কর দুর্য্যোধন আদি করি।দূর কর মৃত্যুশোক হও দন্ডধারী।।ধর্ম্মকথা নিরবধি করহ শ্রণ।তবে শোকহীন হবে শান্ত কর মন।।গঙ্গা হৈতে জাত ভীষ্ম শান্তনু তনয়।তাঁর দরশনে পাপ হইবেক ক্ষয়।।মহাবলবান ভীষ্ম শান্তনু নন্দন।তাঁর দরশনে পাপ হবে বিমোচন।।শ্রবণ করিতে বেদ অভ্যাস করিল।ব্রক্ষ্মার তনয় হৈতে সুশিক্ষা পাইল।।মার্কন্ডেয় মুনি হৈতে ধর্ম্মের নন্দন।পরশুরাম হৈতে পাইল অস্ত্রগণ।।ত্রিভুবনে প্রতিষ্ঠিত তাঁহার সম্পদ।সাক্ষাৎ ব্রক্ষ্মার যিনি ছিল সভাসদ।।মহাধর্ম্মশীল ভীষ্ম মহাতেজোময়।তিনি সব ঘুচাবেন তোমার সংশয়।।তাঁর দরশনে দূর হবে অমঙ্গল।শুনিলে জ্ঞানের কথা হইবে নির্ম্মল।।শোক ত্যজ মহারাজ শান্ত কর মন।হস্তিনাতে কর গিয়া প্রজার পালন।।অনাথ ব্রাক্ষ্মণ সব চাহেন তোমাকে।তোমার কারণে নিত্য কাঁদে প্রজালোকে।।অবশেষে যত আছে পৃথিবীর পতি।উপাসা হেতু আছে শুন নরপতি।।এত শুনি যুধিষ্ঠির করেন সম্মতি।হস্তিনায় যাইতে দিলেন অনুমতি।।ধৃতরাষ্ট্র অগ্রে করি পান্ডুর নন্দন।হস্তিনাপুরীতে শীঘ্র করেন গমন।।দিব্যরথে চড়িলেন পান্ডবের পতি।তাহাতে সারথি হৈল ভীম মহামতি।।কৃষ্ণার্জ্জুন রথেতে চলেন দুইজন।সহদেব নকুল রথেতে আরোহণ।।ধৃতরাষ্ট্র নরপতি চাপিল বিমানে।সঞ্জয় যুযুৎসু আদি চলে সব জনে।।কুন্তী ও গান্ধারী আদি চলে সব জনে।।কুন্তী ও গান্ধারী আদি নারীগণ যত।হস্তিনা গমনে সবে চাপিলেক রথ।।শোকেতে গান্ধারী দেবী নেউটিয়া চায়।দুর্য্যোধন বলিদেবী কান্দে উভরায়।।থাক্ কুরুক্ষেত্রে মম শতেক নন্দন।আমি অভাগিনী যাই আপন ভবন।।দারুণ বিধাতা এত করিল আমাকে।কোথায় ত্যাজিয়া আমি যাই সে সবাকে।সাতকিচাপিল রথে হরষিত চিতে।কোলাহল করিয়া চলেন হস্তিনাতে।।ভীম করে সিংহনাদ পেয়ে মনে প্রীত।তাহা দেখি গান্ধারীর হৃদয় দুঃখিত।।শীঘ্রগতি দ্বারী গেল হস্তিনানগরে।ধর্ম্ম আগমন জানাইল সবাকারে।।দূতমুখে সন্বাদ পাইল পাত্রগণ।সবে মেলি করে তবে নগর সাজন।।চান্দোয়া চামর আনি টাঙ্গাইল পথে।প্রবাল মুকুতাদাম শোভে চারিভিতে।।বান্ধিল তোরণ সব বড় উচ্চ করি।কদলী রোপণ করিলেক সারি সারি।।পুষ্পমালা বনমালা নগরে নগরে।সুবর্ণের ঘট শোভে দুয়ারে দুয়ারে।।রাজমার্গ সুসংষ্কার করিল যতনে।সুবাসিত কৈল পথ অগুরু চন্দনে।।হস্তিনানগরে যত আছয়ে ব্রাক্ষ্মণ।ধর্ম্ম আগমণ শুনি আনন্দিত মন।।আনন্দেতে নানা বাদ্য সবে বাজাইল।শুভক্ষণে র্ধম্মরাজ পুরে প্রবেশিল।।বিজয় পান্ডব কথা অমৃত লহরী।কাহার শকতি ইহা বর্ণিবারে পারি।।অবহেলে শুনে যেন সকল সংসার।কাশীরাম দাস কহে রচিয়া পয়ার।।অপূর্ব্ব ভারত কথা পুরাণ প্রধান।এতদূরে নারীপর্ব্ব হৈল সমাধান।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon