বেদ অধ্যায়নের জন্য অগাধ জ্ঞানের প্রয়োজন

বেদ বাস্তবিক অর্থেই এতই জটিল, এতই গুরুতর যে, যতই সংক্ষেপে বেদের আলোচনা করা হোক না কেন, যতই এক কথায় তা বুঝানোর প্রয়াস করা হোক না কেন, বক্তব্য বা আলোচনা মনের অজান্তেই দীর্ঘায়িত হয়ে যায়। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, বেদ শব্দের অর্থ- জ্ঞান। বেদ কি- এক কথায় তার সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গেলে জ্ঞান ভিন্ন আর অন্য কিছু বরা যায় না। তবে সে জ্ঞান কি ধরণের জ্ঞান, কেমন জ্ঞান, সেটাই বিশেষ অনুসন্ধান করার বিষয়। সে জ্ঞান আয়ত্ব করতে হলে প্রয়োজন প্রজ্ঞা। প্রয়োজন অধ্যবসায়। সে আয়াস- সে প্রযত্ন মানব সাধারণের অধিগম্য নয়। তাই বেদ অধ্যয়নের অনেক প্রতিবন্ধ আরোপ সৃষ্টি করা হয়েছে। বলা হয়েছে-স্ত্রী, শূদ্র ও অব্রাহ্মণ বেদপাঠে অনধিকারী অর্থাৎ তারা বেদ পাঠ করতে পারবে না। জ্ঞানের চর্চা করার অধিকার সকলেরই আছে। সে মোতাবেক স্ত্রী, শূদ্র ও অব্রাহ্মণ কারোও বেদপাঠে কোন শাস্ত্রীয় বাঁধা নেই, ইহা সত্য। কিন্তু তথাপি কেন বেদ অধ্যয়নে স্ত্রী, শূদ্র ও অব্রাহ্মণগণকে বেদ অধ্যয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে? তার বিভিন্ন কারণ আছে। আপনাকে যদি পর্বতশৃঙ্গে আরোহণ করতে হয় প্রথমে সানুদেশে (পাদদেশে) আসতে হবে; তারপরে মধ্যভাগে, পরিশেষে শীর্ষদেশে উঠিবার প্রয়াস করতে হবে। কেহই একেবারে গিরিশৃঙ্গ আরোহণ করতে সমর্থ হয় না। বেদরূপ জ্ঞান লাভ করতে হলেও সেরূপ স্তরে স্তরে অগ্রসর হতে হয়। আচমকা একটি সূক্ত বা ঋক কণ্ঠস্থ করতে পারলেই এবং সেই অংশের একটা যথেচ্ছা অর্থ স্থির করতে পারলেই যে বেদাধ্যায়ন সম্পন্ন হয়, তা কিন্তু নয়। বেদ অধ্যয়ন করতে হলে সর্ব প্রথমে চাই বেদাঙ্গের বিশেষ অভিজ্ঞতা। বেদ অনন্তকাল হতে অভ্রান্ত হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। বেদ অক্ষত অপরিবর্তিতভাবে বিদ্যমান আছে। বেদাঙ্গে অভিজ্ঞ হতে পারলেই তা বোধগম্য হতে পারে। সুতরাং বেদাঙ্গ তত্ত্ব সর্বপ্রথম আয়ত্ত্ব করতে হবে। তারপর বেদ মধ্যে প্রবেশ সহজতর হবে। আর না হলে বেদ মধ্যে প্রবেশ করা সাধ্য আছে? আর একটি বড় কারণ হচ্ছে- বেদের অপব্যবহারের আশঙ্কা। যেমন- যে ব্যক্তি অমূল্য জিনিসের মূল্য বুঝে না, তার নিকট সে জিনিস প্রদান করার কোন হেতু আছে কি? দুগ্ধপোষ্য যেমন শিশু মহামূল্যবান (মনিমানিক্য, হিরাজহরত) বস্তুর মূল্য বুঝে না, হাতের নাগালে পেলে তা গলাধ:করণ করতে চায়। মহামূল্যবান বস্তুও সে দূরে ঠেলে দেয়। কারণ সে বস্তুর সম্পর্কে তার ধারণা নেই। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। তদ্রুপ বেদজ্ঞান বা বেদমর্ম বুঝার যাদের সামর্থ্য নেই তাদেরকে বেদ অধ্যয়ন থেকে বিরত রাখাই উত্তম। বেদ অনধিকার বিষয়ে ব্রাহ্মনগণকে দোষারুপ করা হয় বটে। কিন্তু বিষয়টি তা নয়। অথর্ববেদের একটি মন্ত্রই এর সমাধান দিয়েছে- প্রিয়ং মা কৃণু দেবেষু প্রিয়ং রাজসু মা কৃণু। প্রিয়ং সর্বস্য পশ্যত: উত শূদ্র উতার্য্যৈ।।
অর্থাৎ- হে জগদীশ্বর! দেবদলের মধ্যেই প্রিয় বিধান করিও না, রাজন্যবর্গেই যেন তোমার প্রীতি আবদ্ধ না থাকে; প্রত্যুত সকলের প্রতিই সমভাব প্রীতিদৃষ্টি কর- কি শূদ্রজাতিতে, কি আর্য্যজাতিতে। এখানে ‘দেব’বলতে তপোবিদ্যায় বলীয়ান ব্র ব্রাহ্মণ অর্থাৎ জ্ঞানীকে বুঝানো হয়েছে। ‘রাজ’ বলতে ক্ষুদ্র ভূস্বামী হতে সম্রাট পর্যন্ত বুঝানো হয়েছে। আর ‘আর্য’ বলতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য জাতি বুঝানো হয়েছে। ‘শূদ্র’ অর্থে দাস ও দস্যু (ম্লেচ্ছ যবন জাতি) এ দুজাতিকে বুঝানো হয়েছে। জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ নয় বরং সাম্যভাবের যে পরম বোধ তা স্বয়ং বেদই ঘোষণা করে গিয়েছে। ঋকবেদের(১০ম মন্ডলের ১৯১ সূক্ত ৮ অষ্টক ৮ অধ্যায়ে) এ মন্ত্রে উদাত্ত কন্ঠে ঘোষিত হয়েছে- সংগচ্ছধ্বং সংবদধ্বং সং বো মনাংসিজানতাং। দেবাভাগং যথাপূর্বে সংজানানাহউপাসতে।। সমানো মন্ত্রঃ সমিতিঃ সমানী সমানং সনঃ সহচিত্তমেষাঃ। সমানং মন্ত্রমভিমন্ত্রয়েবঃ সমানে নবোহবিষা জুহোমি।। সমানীবহআকূতিঃ সমানাহৃয়ানিবঃ। সমানমস্তু বো মনোয়থাবঃ সুহাসতি।। অর্থ: “হে বিশ্ববাসী! তোমরা একত্র চল, একত্র বল, তোমাদের মন অভিন্ন হোক, তোমরা বাক্য ও মনে অবিরোধ লাভ করে একত্র তপস্যা ও উপাসনায় প্রবৃত্ত হও। তোমাদের মন্ত্র সমান হোক, তোমাদের সমিতি সমান হোক। তোমাদের চিত্ত ও মন এক হোক, তোমরা সমান মন্ত্রে বিশ্বযজ্ঞে প্রবৃত্ত হও, তোমাদের আকূতি, তোমাদের হৃদয়, তোমাদের চিত্ত এক ও অভিন্ন হোক, তা হলেই তোমরা কল্যাণ লাভ করে হাসিতে পারবে” (চলবে)

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র