জয়দ্রথ

জয়দ্রথ : সিন্ধু দেশের রাজা। তাই তাকে সিন্ধরাজ বলা হয়। তার পিতার নাম বৃদ্ধক্ষত্র। ধৃতরাষ্ট্রের কন্যা দু:শলার পতি। তার পুত্রের নাম সুরথ।
কাম্যকবনে অবস্থানরত পাঞ্চালীকে হরণ করে লুকিয়ে রাখার জন্য ভগ্নিপতি জয়দ্রথকে উদ্বুদ্ধ করার মন্ত্রণা দেন। জয়দ্রথের মনে যদিও পঞ্চ-পান্ডবের ভয় ছিল। তথাপি দুর্যোধনের অভয়বাণীতে পাঞ্চালী হরণে রাজি হন। রথ চালিয়ে গভীর কাম্যকবনে প্রবেশ করে নিজেকে অরণ্যের মধ্যে লুকিয়ে রাখলেন। কাম্যক বন। প্রকৃতির অপার সুন্দর্য। চারিদিকে ঘন সবুজের বেষ্ঠনী। রঙ-বেরঙের ফুলে-ফলে ভরপুর কাম্যকবন। বিভিন্ন প্রজাতির পশু-পাখির আবাসস্থল। পাখিকুলের সুমধুর কন্ঠ যেন প্রাণ ছুঁয়ে যায়। অরণ্যের মাঝখান দিয়ে সরু পথ। পান্ডবগণ এ বনেই অবস্থান করছিলেন।

একদিন ভীম-অর্জুন মৃগয়ায় গেলেন। যুধিষ্ঠির, নকুল ও সহদেব গেলেন স্নান করতে। গৃহে একা পাঞ্চালী। গৃহের সম্মুখে রথ রেখে জয়দ্রথ নামলেন। অতিথি মনে করে পাঞ্চালী পা ধোয়ার জন্য জল, কুশাসন দিল। পাঞ্চালী বলেন,“আপনি কোথা হতে এসেছেন। কোথাই বা যাবেন। কেন এ অরণ্যে আসলেন।” জয়দ্রথ বললেন,“ না, তেমন কোন কার্য নেই, ধর্মরাজকে দর্শন করতে এলাম। তো তুমি একা গৃহে। ধর্মরাজ কোথায়? ভীম-অর্জুন কোথায়, মাদ্রী তনয়ই বা কোথায়?” পাঞ্চালী বললেন,“ভীম-অর্জুন মৃগয়ায়, অন্যরা স্নান করতে গেলেন।” জয়দ্রথ চারিকে ভালভাবে অবলোকন করলেন। তারপর জোরপূর্বক পাঞ্চালীকে রথে তুলে হস্তিনাপুরের দিকে রওনা হলেন। পঞ্চালী জয়দ্রথকে তার পরিণাম ভোগ করার জন্য বার বার সর্তক করল। ভীমের শক্তিমত্তার দোহাই দিল। কিন্তু কোন কাজ হলো না। হেনকালে তিন ভ্রাতা যুধিষ্ঠির, নকুল ও সহদেব এসে দেখে গৃহ শূন্য। দূর হতে পাঞ্চালীর ক্রন্দনের স্বর ভেসে আসছে। ক্রন্দের স্বর অনুসরণ করে তিন ভ্রাতা ধনু নিয়ে বের হয়ে পড়ল। তারা দূর হতে দেখল পেল জয়দ্রথ পাঞ্চালীকে নিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ভীম ও অর্জুন মৃগয়া করে যে পথে ফিরছেন সে পথেই জয়দ্রথ পাঞ্চালীকে নিয়ে যাচ্ছে। তারাও পাঞ্চালীর কন্ঠ স্বর শুনে তাকে উদ্ধারের জন্য ছুটে চলল। দূর হতে তারা একটি রথ দেখতে পেল। রথের ধ্বজা দেখে অনুমান করলেন এটি জয়দ্রথের রথ। ভীম অর্জুন রথে চড়ে জয়দ্রথে কাছে গেলেন। ভীম অর্জুনকে দেখে জযদ্রথ পালাতে আরম্ভ করল। কিন্তু ভীম জয়দ্রথকে চুলের মুঠি ধরে পঞ্চালীর কাছে নিয়ে আসেন। ভীমের কথায় পাঞ্চালী জয়দ্রথের মুখে তিন বার লাথি মারেন। ভীম জয়দ্রথকে সারাক্ষণ চড় থাপ্পর মারতে লাগলেন। মারতে মারতে জয়দ্রথকে প্রায় অচেতন করে ফেললেন। তখন যুধিষ্ঠির সেখানে আসলেন। ভীমকে বুঝালেন তিনি আমাদের ভগ্নিপতি। যুধিষ্ঠিরের করুণায় জয়দ্রথ মুক্তি পেল বটে কিন্তু এত অপমান সহ্য করে সে আর হস্তিনাপুরে গেল না। মনে মনে জয়দ্রথ ভাবল এ মুখ আর কৌরবদের দেখাবে না। পান্ডবরা তাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। তাই মনে মনে ভাবল পান্ডবরা ইন্দ্রসম তুল্য। তপোবলে তারা বলীয়ান। তাই ভোলানাথকে কঠোর তপস্যার দ্বারা সন্তুষ্ট করে পান্ডবদের মত তপোবলীয়ান হতে হবে। সে চিন্তা করে জয়দ্রথ হিমালয়ে গিয়ে নিজেকে শুদ্ধ করে কৈলাসপতির তপস্যা আরম্ভ করল। কখনও ফল খেয়ে, কখনও শুধু জল পান করে, কখনও বা না খেয়ে হরের তপস্যা করতে লাগল। গ্রীষ্মকালে চারিদিকে আগুন জ্বালিয়ে তার মাঝখানে বসে দিবা-রাত্র তপস্যা করতে লাগলেন। বর্ষাকালে বৃক্ষতলে বসে মাথায় বর্ষার জল লয়ে, শীতেতে শীতল জলে নিমগ্ন হয়ে তপস্যা করতে থাকেন। মহাক্লেশ সহ্য করে তপস্যা করতে করতে অবশেষে মহাদেব ভক্তের তপস্যায় সাড়া দিলেন।

ত্রিপুরারি বললেন,“তপস্য ত্যাগ কর, বর মাগ।” শ্রবণ মাত্র জয়দ্রথ উঠলেন। দেখলেন তার সম্মুখে এক অপূর্ব ব্রাহ্মণ মূর্তি। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন,“কে তুমি?” মহেশ বললেন,“আমি পঞ্চানন।” তখন রাজা বলেন,“বিশ্ব ভূবনে তোমার যে নিজমূর্তি বিখ্যাত তা কৃপা করে আমাকে দেখাও।” তখন দেবাদিদেব মহাদেব তার সেই বিখ্যাত ভূবন মোহীনি রূপ দেখালেন। কটিতটে ফণিরাজ, পরনে বাঘছাল, শিরে জটা, গলায় নাগ, কেশে চন্দ্র, বামেতে শৃঙ্গ দক্ষিণে ডমরু। মহাদেবের এমনরূপ দেখে অভিভূত জয়দ্রথ। দন্ডবৎ হয়ে হরকে প্রণাম করলেন জয়দ্রথ। মহেশ বললেন,“ তোমার বর প্রার্থনা কর।” তখন জয়দ্রথ হাত জোর করে মহাদেবকে বললেন,“আমি পান্ডবদের পরাজিত করতে চাই।” মহাদেব বললেন,“তুমি অন্য বর প্রার্থনা কর।” জয়দ্রথ বললেন,“অন্য বরে আমার কোন প্রয়োজন নেই।” মহেশ বলেন,“পান্ডবগণ ভূবন জয়ী, তাদেরকে পরাজিত করে এমন শক্তি কার আছে? তুমি অন্য কিছু প্রার্থনা কর।” কিন্তু জয়দ্রথ অন্য বর প্রার্থনা না করায় মহাদেব একটু রুষ্ট হয়ে তার আলয়ে গমন করেন। কিন্তু জয়দ্রথ তার থেকে কঠিন তপস্যা শুরু করেন। পা উপরে তুলে মাথা নীচু করে অনাহারে এক বৎসর এভাবে তপস্যা করে কাটিয়ে দিলেন। জয়দ্রথের এমন কঠোর তপস্যায় হর আর ঠিক থাকতে পারলেন না। তিনি ভক্তের ডাকে আবার চলে এলেন। কিন্তু জয়দ্রথকে কটু ভাষায় তিরস্কারও করলেন,“অর্জুন অজেয় এ তিন ভূবনে।” উপায়ন্তর না দেখে মহাদেব বললেন,“অর্জুনের পুত্র অভিমন্যুকে সমরে বধ হওয়ার বর দিলাম।” বর প্রাপ্ত হয়ে জয়দ্রথ হস্তিনাপুরে গমন করলেন।

জয়দ্রথের বিলম্ব দেখে কৌরবপতি দুর্যোধন চিন্তান্বিত হলেন। অন্যান্য মন্ত্রীগণও ভাবতে লাগল জয়দ্রথ কি ভীমে দ্বারা নিহত হয়েছে বা লজ্জায় অপমানে নিজ রাজ্যে গমন করেছে। ঠিক তখন জয়দ্রথ তথায় প্রবেশ করল। জয়দ্রথকে দেখে সবাই আনন্দিত হলো। জয়দ্রথ কৌরবপতিকে সমস্ত ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করলেন।

দ্রোনপর্বে জয়দ্রথ মহাদেবের কাছ থেকে বর লাভ করে ভীম, সাত্যকি ও ধৃষ্টদ্যুম্নকে পরাজিত করিল। অভিমন্যু যুদ্ধ করতে করতে চক্রব্যুহের মধ্যে প্রবেশ করিল। জয়দ্রথ প্রবেশ পথে পান্ডবপক্ষীয় সব সেনাদের এমনভাবে বাঁধা দিল যে কেহ ব্যুহের মধ্যে প্রবেশ করতে পারল না। ব্যুহের মধ্যে দু:শাসন তনয় গদার আঘাতে অভিমন্যুকে বধ করলেন। অভিমন্যুর মৃত্যুতে অর্জুন মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়লেন। তাকে স্বয়ং কৃষ্ণ ও ব্যাসদেব অনেক সান্তনা দিলেন।

পরের দিন পান্ডব সভায় যুধিষ্ঠির অভিমন্যুর বীরত্বগাথা যুদ্ধের কথা বললেন। কৌরবদের হাজার হাজার সেনা, অশ্ব, গজ ও সারথি বধের কাহিনী তিনি বললেন। পাশাপাশি এও বললেন কিভাবে অন্যায় যুদ্ধে অভিমন্যুকে হত্যা করা হয়েছে। ব্যুহের প্রবেশ পথ রুদ্ধ করে দিলেন জয়দ্রথ। ফলে কোন পান্ডব যোদ্ধা ব্যুহের মধ্যে প্রবেশ করতে পারল না। আর সে কারণেই জয়দ্রথের উপর অর্জুনের সব ক্ষোপ গিয়ে পড়ল। মহাক্রোধে অর্জুন বললেন,“যেহেতু জয়দ্রথের কারণেই আমার পুত্র অভিমন্যুর মৃত্যু হয়েছে সেহেতু আগামীকাল সূর্য অস্ত যাওয়ার পূর্বেই আমি জয়দ্রথকে বধ করব। যদি না পরি তবে দেহ ত্যাগ করব।” অর্জুনের প্রতিজ্ঞা শ্রবণ করা মাত্রই পান্ডবপক্ষীয় সেনাদের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। তারা বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে আনন্দ প্রকাশ করতে লাগল। কিন্তু বাসুদেব কৃষ্ণকে কিছুটা চিন্তান্বিত দেখা গেল। তিনি অর্জুনকে শুধু বললেন,“পার্থ! ক্রোধের বশবর্তী জয়দ্রথকে হত্যার করার প্রতিজ্ঞা তো করলে কিন্তু কিভাবে তাকে হত্যা করবে।” অর্জুন তখন বললেন,“তুমি যার সারথি সেখানে কিসের ভয়।”

ইতোমধ্যে দূতমুখে এ সংবাদ রটে গেল। জয়দ্রথও জানল তার হত্যার কথা। দুর্যোধনের কাছে গিয়ে বলল,“অর্জুন কাল রণে আমাকে হত্যা করবে। আর হত্যা করতে না পারলে সে দেহ ত্যাগ করবে। কিছু একটা উপায় বের কর। তা না হলে নিজ দেশে চলে যাই।” তখন দুর্যোধন জয়দ্রথকে সান্তনা দিলেন। দ্রোণও তাকে অভয় দিয়ে বললেন,“আমি এমন এক ব্যুহ রচনা করে এর মধ্যে তোমাকে লুকিয়ে রাখব। ভূরিশ্রবা, কর্ণ, অম্বত্থামা, শল্য, বৃষসেন ও কৃপ তোমাকে রক্ষা করবেন।”

চতুর্থ দিবসের যুদ্ধ শুরু হলো। দ্রোণ চক্রশকট ব্যুহ রচনা করলেন। ব্যুহের পশ্চাতে পদ্ম নামে এক গর্ভব্যুহ এবং তার মধ্যে এক সূচিব্যুহ নির্মিত হলো। কৃতবর্মা সূচিব্যুহের সম্মুখে এবং বিশাল সেনা বেষ্ঠিত জয়দ্রথ এক পার্শ্বে অবস্থান করলেন। দ্রোণাচার্য চক্রশকটের ব্যুহের মুখে অবস্থান নিলেন। অর্জুন দু:শাসনকে শরবর্ষণে ভীত-সন্ত্রস্থ করলে তিনি দ্রোণাচার্যের কাছে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। অর্জুনও দু:শাসনের সেনা ধ্বংস করে দ্রোণাচার্যের কাছে গিয়ে পৌছলেন। অর্জুন দ্রোণাচার্যের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হলো। তখন কৃষ্ণের পরামর্শে অর্জুন দ্রোণাচার্যকে ছেড়ে জয়দ্রথের দিকে অগ্রসর হলেন। অর্জুনকে কৃতবর্মা বাঁধা দিতে লাগলেন। অর্জুনের শরাঘাতে অনেক রাজন্যবর্গ নিহত হলেন। অনেক সেনা নিহত দেখে দুর্যোধন দ্রোণাচার্যের শরনাপন্ন হলেন এবং জয়দ্রথকে রক্ষা করতে অনুরোধ করলেন।

এদিকে সূর্য অস্তের আর বেশী দেরী নেই। দুর্যোধন, কর্ণ, বৃষসেন, শল্য, অশ্বত্থামা, কৃপ ও স্বয়ং জয়দ্রথ অর্জুনের সাথে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হলেন। কৃষ্ণ দেখলেন এ ছয়জন মহারথ জয়দ্রথকে রক্ষা করছেন। এদের পরাজিত না করে জয়দ্রথকে হত্যা করা সম্ভব নয়। তখন বাসুদেব কৃষ্ণ ছলনার আশ্রয় নিলেন। যোগবলে সূর্যকে আবৃত করলেন। তখন জয়দ্রথ ঊর্ধ্বমুখ করে সূর্য দেখতে পেলেন না। কৃষ্ণের পরামর্শে অর্জুন ওষ্ঠপ্রান্ত লেহন করে এক মন্ত্রসিদ্ধ ব্রজতুল্য বাণ নিক্ষেপ করলেন। সেই বাণ অতিদ্রুত বেগে গিয়ে জয়দ্রথের মুন্ড ছেদন করে আকাশে উঠল। অর্জুনের আরও কয়েকটি বান সে মুন্ডকে উড়িয়ে নিয়ে জয়দ্রথের পিতার ক্রোড়ে আছড়ে পড়ল। সাথে সাথে বৃদ্ধক্ষত্রের মস্তকও শতধা বিদীর্ণ হলো।

সূত্র : মহাভারত ও বিভিন্ন পৌরানিক গ্রন্থ।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র