মহাভারত:আদিপর্ব ১০২-১০৬

১০২.অর্জ্জুনের সহিত দ্রৌপদীর কুম্ভকার-গৃহে গমন
মুনি বলে, অবধান কর জন্মেজয়।
জিনিয়া সকল সৈন্য ভীম ধনঞ্জয়।।
সমস্ত দিবস হৈল, হৈল সন্ধ্যাকাল।
ধীরে ধীরে গেলেন ভার্গব-কর্ম্মশাল।।
দোঁহার পশ্চাৎ চলে দ্রুপদ-নন্দিনী।
মত্তহস্তী পাছে যেন চলিল হস্তিনী।।
চতুর্দ্দিকে বেষ্টিত যতেক দ্বিজগণ।
কেমনে বাহির হৈব চিন্তে দুইজন।।
কৃতাঞ্জলি হইয়া বলয়ে দ্বিজগণে।
বিদায় মাগি যে আজি সবাকার স্থানে।।
অর্জ্জুনের বাক্য শুনি বলে দ্বিজগণ।
এমত অপ্রিয় দ্বিজ বল কি কারণ।।
তোমা দোঁহা সঙ্গ না ছাড়িব কদাচন।
নাহি জানি কি করিবে যত ক্ষত্রগণ।।
নিশাকালে তোমা দোঁহে নিঃসখা দেখিয়া।
দোঁহে মারি দ্রৌপদীরে লইবে কাড়িয়া।।
দোঁহারে বেড়িয়া সবে থাকি চতুর্ভিতে।
যাবৎ না শুনি, ক্ষত্র নাহি এ দেশেতে।।
পার্থ বলে সে ভয় না কর দ্বিজগণ।
আজি যাহ, কালি সবে করিব মিলন।।
অনেক প্রকারে পুনঃপুনঃ বুঝাইল।
তথাপিহ দ্বিজগণ সঙ্গ না ছাড়িল।।
দ্বিজগণ মধ্যে ছিল ধৌম্য তপোধন।
ডাকিয়া নিভৃতে কহে সব দ্বিজগণ।।
কোথাকারে যাহ সবে এ দোঁহা সংহতি।
চিনিলে কি এই দোঁহে, হয় কোন্ জাতি।।
কিবা দৈত্য, কিবা দেব, রাক্ষস কিন্নর।
কাহার তনয় দোঁহে, কোন্ দেশে ঘর।।
ইহার সংহতি তবে কোন্ প্রয়োজন।
যথা ইচ্ছা তথাকারে করুক গমন।।
ধৌম্য-বাক্য শুনি সবে ভয় হৈল মনে।
দোঁহাকার সংহতি ছাড়িল দ্বিজগণে।।
দ্বিজগণ মধ্যে বীর ধৃষ্টদ্যুন্ন ছিল।
ভগিনীর মমত্ব কদাচ না ছাড়িল।।
গুপ্তবেশে পাশে পাছে চলিল সংহতি।
মেঘে ঘোর অন্ধকার কৃষ্ণপক্ষ রাতি।।
হেনকালে যুধিষ্ঠির সঙ্গে দুই ভাই।
যাইতে ভার্গব-গৃহে মিলেন তথাই।।
একা কুম্ভকার-গৃহে ভোজের নন্দিনী।
সমস্ত দিবস গেল হইল রজনী।।
না দেখিয়া পুত্রগণে কান্দেন ব্যাকুলে।
ক্ষণে উঠে, ক্ষণে বৈসে, ভাসে অশ্রুজলে।।
ভিক্ষার সময় গেল হইল রজনী।
এতক্ষণ না আইল, কি হেতু না জানি।।
চতুর্দ্দিকে শুনি যে সৈন্যের কোলাহল।
মার মার বিপ্রগণে ডাকিছে সকল।।
অনুক্ষণ দ্বন্দ্ব বিনা ভীম নাহি জানে।
আজি বুঝি বিরোধ করিল কার সনে।।
এই হেতু, দ্বিজে কিবা মারে ক্ষত্রগণ।
বহু বিলাপিয়া কুন্তী করেন রোদন।।
হেনকালে উত্তরিল পঞ্চ সহোদর।
হৃষ্টচিত্তে মায়েরে ডাকিছে বৃকোদর।।
আজি মাতা সমস্ত দিন দুঃখ পাইলা।
উপবাসে মহাক্লেশে দিন গোঙাইলা।।
অনেক কলহ আজি হইল জননী।
সে কারণে হৈল মাতা এতেক রজনী।।
রাত্রিতে মিলিল ভিক্ষা, দেখ আসি মাতা।
কুন্তী বলে বাটিয়া লহ রে পঞ্চ ভ্রাতা।।
তোমা সবাকার বাক্য কর্ণে শুনি সুধা।
আনন্দ-সমুদ্রে ডুবি গেল মম ক্ষুধা।।
আয়রে সোণার চাঁদ, অরে বাছাধন।
নিকটে এস রে, দেখি সবার বদন।।
এত বলি শীঘ্র কুন্তী হইয়া বাহির।
একে একে চুম্ব দিল সবাকার শির।।
সবার পশ্চাৎ দেখি দ্রুপদ নন্দিনী।
পূর্ণ-শশধর-মুখী-গজেন্দ্র গামিনী।।
তাঁরে দেখি কুন্তী দেখি সবার পশ্চাতে।
ভীম বলে, জননী এ দ্রুপদ-দুহিতা।।
একচক্রা, নগরে শুনিলা যার কথা।
ইহার কারণে বহু বিরোধ হইল।
তোমার প্রসাধে জয় সর্ব্বত্র জন্মিল।।
এই ভিক্ষা হেতু মাতা হইল রজনী।
শুনিয়া বিস্ময় হৈলা ভোজের নন্দিনী।।
কুন্তী বলিলেন তবে শুন পঞ্চ ভাই।
কহিলাম কি কথা, অগ্রেতে জানি নাই।।
কেন হেন বৈলে পুত্র, কি কর্ক্ম করিলা।
কন্যারে পাইয়া কেন ভিক্ষা যে বলিলা।।
ভিক্ষা জানি বলি বাঁটি লও পঞ্চজন।
কিমতে মায়ের বাক্য করিবা লঙ্ঘন।।
তদন্তরে দ্রৌপদীরে কুন্তী ধরি হাতে।
যুধিষ্ঠির আগে কহে কান্দিতে কান্দিতে।।
সর্ব্ব ধর্ম্মাধর্ম্ম পুত্র তোমার গোচর।
শুনিয়াছ আমি করিলাম যে উত্তর।।
পুত্র হয়ে মোর বাক্য লঙ্ঘিবা কি মতে।
না লঙ্ঘিলে বিপরীত হইবে শুনিতে।।
যেমতে লঙ্ঘন নাহি হয় মম বাণী।
ধর্ম্মচ্যুত নাহি হয় দ্রুপদ-নন্দিনী।।
বুঝিয়া বিধান তার করহ আপনি।
এত বলি কান্দে দেবী চক্ষে বহে পানি।।
মায়ের বচনে শুনি ধর্ম্মের নন্দন।
ব্যাসের বচন পূর্ব্ব হইল স্মরণ।।
একচক্রা নগরে বলিলা ব্যাস মুনি।
পূর্ব্বে দ্বিজকন্যারে, কহিলা শূলপানি।।
পঞ্চ স্বামী হবে তোর না হয় খণ্ডন।
সেই কন্যা কৃষ্ণা নামে জন্মিলা এখন।।
তেঁই কহে মায়ে ধর্ম্ম আশ্বাস বচন।
তোমার বচন মাতা নহিবে লঙ্ঘন।।
অর্জ্জুনের চিত্ত তবে বুঝিবার তরে।
অর্জ্জুনেরে কহিলেন ধর্ম্ম নৃপবরে।।
বড় কর্ম্ম করিলা, পাইলা বহু কষ্ট।
লক্ষ্য বিন্ধি লক্ষ্য রাজা করিলা হে ভ্রষ্ট।।
বহু কষ্টে প্রাপ্ত হৈলে দ্রুপদ-নন্দিনী।
শুভকর্ম্মে বিলম্ব না কর ভাল মানি।।
ডাকাইয়া আনিয়া ধৌম্যাদি দ্বিজগণ।
বিভা আজি কর ভাই করি শুভক্ষণ।।
কৃতাঞ্জলি হইয়া কহেন ধনঞ্জয়।
অবিহিত কি হেতু বলহ মহাশয়।।
লোকে বেদে নিন্দে যেই কর্ম্ম দুরাচার।
বিবাহ তোমার আগে হইবে আমার।।
প্রথমে তোমার হবে, ভীম তার পাছে।
তদন্তরে আমার শাস্ত্রেতে হেন আছে।।
পার্থ-বাক্য শুনি ধর্ম্ম হয়ে হৃষ্টমন।
শিরে চুম্ব দিয়া করিলেন আলিঙ্গন।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
শুনিলে অধর্ম্ম খণ্ডে, বৈকুণ্ঠে প্রয়াণ।।
১০৩.কুন্তীর নিকটে রাম ও কৃষ্ণের আগমন
ধর্ম্ম চক্রশালে যবে করেন প্রবেশ।
হেনকালে আইলেন রাম হৃষীকেশ।।
প্রণাম করিয়া দোঁহে কুন্তীর চরণে।
আপনার পরিচয় দেন দুইজন।।
শুনি শূরসেন-সুতা দোঁহে করি কোলে।
দোঁহারে করান স্নান নয়নের জলে।।
কোথা ছিলি তাত মোর অনাথের নড়ি।
হাপুতির পুত তোরা দরিদ্রের কড়ি।।
দ্বাদশ বৎসর আমি মুখ নাহি দেখি।
অনুক্ষণ কান্দিয়া দুর্ব্বল হৈল আঁখি।।
আজিকার রাত্রি মোর হৈল সুপ্রভাত।
দ্বাদশ বর্ষের কষ্ট আজি গেল তাত।।
কহ তাত সবার কুশল সমাচার।
তোমার মায়ের আর আমার ভ্রাতার।।
দ্বাদশ বৎসর হৈল, নাহি দেখি শুনি।
কেবা মরে, কেবা জীয়ে, কিছুই না জানি।।
নাহি জানি তোমার এতেক নিষ্ঠুরতা।
না জানি যে এতেক নির্দ্দয় তোর পিতা।।
গহন কাননে ভ্রমি আর কত দেশ।
দ্বাদশ বৎসর কেহ না করে উদ্দেশ।।
কৃষ্ণ কহিলেন, দেবী ত্যজ মনস্তাপ।
না ভুঞ্জিলে না খণ্ডে পূর্ব্বের মহাপাপ।।
গৃহদাহে মরিলা, শুনিয়া এই কথা।
সাতদিন অন্ন জল না ছুঁলেন পিতা।।
আমারে পাঠাইলেন বুঝিতে কারণ।
বিদুরের স্থানে শুনিলাম বিবরণ।।
দ্বাদশ বৎসর কষ্ট অরণ্যে পাইলে।
তোমা স্মরি তাত ভাসিছেন অশ্রুজলে।।
কিন্তু কি করিব বল বিধির লিখন।
কেহ নাহি পারে যাহা করিতে লঙ্ঘন।।
শোক না করিহ দেবী, দুঃখ হৈল শেষ।
কালি কিম্বা পরশ্ব চলহ নিজ দেশ।।
কুন্তীরে প্রণাম করি যান ধর্ম্ম-পাশ।
করপুটে প্রণমিয়া করেন সম্ভাষ।।
শীঘ্র উঠি ধর্ম্মসুত করি অলিঙ্গন।
দোঁহাকার অশ্রুজলে ভাসেন দুজন।।
স্নেহভাবে দোঁহারে না ছাড়ে দুইজন।
বহুক্ষণে দোঁহা মুখে না সরে বচন।।
তবে পঞ্চ ভাই রাম কৃষ্ণে সম্বোধিয়া।
যতেক পূর্ব্বের কষ্ট কহেন বসিয়া।।
কহেন সকল কথা ধর্ম্মের নন্দন।
জতুগৃহ যে প্রকারে হইল দাহন।।
বিদুরের মন্ত্রণাতে যেমতে উদ্ধার।
রাক্ষসের মুখে রক্ষা হৈল যে প্রকার।।
বনে, বনে, দেশে দেশে, তপস্বীর বেশ।
দ্বাদশ বৎসর যত পাইলেন ক্লেশ।।
একে একে কহেন সকল বিবরণ।
শুনি আশ্বাসিয়া বলে দেবকী-নন্দন।।
দুষ্ট ধৃতরাষ্ট্র, নষ্ট তার পুত্রগণ।
সমুচিত ফল তারা পাইবে এখন।।
যদি প্রীতে বাঁটিয়া না দেয় রাজ্যভার।
সকলে মিলিয়া তারে করিব সংহার।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন , তবে দামোদরে।
কি মতে জানিলা মোরা কুম্ভকার ঘরে।।
কৃষ্ণ বলেন, যে যুদ্ধ কৈল তব ভাই।
মনুষ্য করিতে পারে ক্ষিতিমাঝে নাই।।
বিনা ভীমার্জ্জুন অন্যে করিতে না পারে।
সন্ধানে জানিনু তেঁই আছ এই ঘরে।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন, আজি সুপ্রভাত।
তাই আজি নয়নে দেখিনু জগন্নাথ।।
একমাত্র বড় ভয় হতেছে অন্তরে।
সবে জ্ঞাত হৈল, আজি কুম্ভকার ঘরে।।
বিশেষ তোমার হইয়াছ আগমন।
এ সকল বার্ত্তা পাছে শুনে দুর্য্যোধন।।
গোবিন্দ বলেন, রাজা ভয় কর কারে।
শত দুর্য্যোধন তোমা কি করিতে পারে।।
তিন লোক সহায় করিয়া যদি আসে।
মুহূর্ত্তেকে বিনাশিব চক্ষুর নিমিষে।।
সপ্তবংশ সহ আমি যাজ্ঞসেন সখা।
সবারে করিবে জয় ভীমার্জ্জুন একা।।
যুধিষ্ঠির কহেন, যে তাহারে না গণি।
জ্যেষ্ঠভাত ধৃতরাষ্ট্রে বড় ভয় মানি।।
আজিকার রজনী বঞ্চিব এই দেশে।
যেই চিত্তে লয়, কালি করিব দিবসে।।
এত বলি মেলানি করিল দুই জনে।
বিদায় হইয়া যান রাম নারায়ণে।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।
১০৪. দ্রুপদ রাজার খেদ এবং ধৃষ্টদ্যুন্নের প্রবোধ বাক্য
ধৃষ্টদ্যুন্ন মহাবীর দ্রুপদ নন্দন।
গুপ্তবেশে দেখিল সকল বিবরণ।।
যবে কৃষ্ণা লইয়া আইলা কুন্তীর তনয়।
গুপ্তবেশে ভগ্নী-মোহে ধৃষ্টদ্যুম্ন রয়।।
সকল বৃত্তান্ত বীর দেখিল নয়নে।
পিতারে জানাতে গেল ত্বরিত গমনে।।
হেথা যাজ্ঞসেন রাজা যাজ্ঞসেনী-শোকে।
ভূমে গড়াগড়ি দিয়া কান্দে অধোমুখে।।
রাজারে বেড়িয়া কান্দে যত মন্ত্রিগণ।
পুত্রগণ কান্দে আর অন্তঃপুর জন।।
হেনকালে ধৃষ্টদ্যুন্ন উত্তরিল তথা।
রাজা বলে, একা দেখি কৃষ্ণা মম কোথা।।
হরি হরি বিধি মোর কৈল হেন গতি।
অবহেলে হারাইনু কৃষ্ণা গুণবতী।।
কহ পুত্র কৃষ্ণার কুশল সমাচার।
কি হইল লক্ষ্যবেদ্ধা ব্রাহ্মণ-কুমার।।
একা দ্বিজে বেড়েছিল যত রাজগণ।
কহ পুত্র সংগ্রামে জিনিল কোন্ জন।।
সর্ব্বনাশ করিলেন ব্যাস মুনিবর।
তাঁর বাক্যে কৃষ্ণার করিনু স্বয়ম্বর।।
ধনুর্ব্বাণ দিল লক্ষ্য করিয়া নির্ম্মাণ।
বলিলেন, পার্থ বিনা না পারিবে আন্।।
মম কর্ম্মদোষে মুনি-বাক্য মিথ্যা হৈল।
কালে বিপরীত ফল আমাতে ফলিল।।
কহ বাপু, কৃষ্ণা রাখি আইলা কোথায়।
কৃষ্ণা ছাড়ি কোন্ মুখে আইলা হেথায়।।
হা কৃষ্ণা হা কৃষ্ণা মম প্রাণের তনয়া।
এত বলি পড়ে রাজা মূর্চ্ছাগত হৈয়া।।
ধৃষ্টদ্যুন্ন বলে, আর না কান্দ রাজন।
সকল মঙ্গল রাজা ত্যজ দুঃখমন।।
ব্যাসের বচন রাজা কভু মিথ্যা নয়।
তোমার মানস পূর্ণ হইল নিশ্চয়।।
শুনি কহ কহ, বলি উঠিল রাজন।
কিমতে হইল সত্য ব্যাসের বচন।।
ধৃষ্টদ্যুন্ন বলে, অবধানে শুন পিতা।
কহনে না যায় সেই ব্রাহ্মণের কথা।।
শতপুর করিয়া বেড়িল রাজগণ।
সবারে জিনিল সেই একক ব্রাহ্মণ।।
সহায় হইল তার এক দ্বিজ আর।
সুরাসুর মানুষে সদৃশ নাই তার।।
হাতে বৃক্ষ হানে যেন বজ্র-হস্তে ইন্দ্র।
ভঙ্গ দিয়া পলাইল যতেক নরেন্দ্র।।
এইমত যুদ্ধে তাত, হইল রজনী।
দুইজন সঙ্গে চলি গেল যাজ্ঞসেনী।।
এ দোঁহার সহ তাত আর তিনজন।
পথেতে যাইতে হৈল সবার মিলন।।
ভার্গবের কর্ম্মশালে আশ্রয়ে আছিল।
পঞ্চজন মিলিয়া তথায় চলি গেল।।
নারী এক ছিল তাহে পরমা সুন্দরী।
তাঁর রূপে বিনা দীপে ঘর আলো করি।।
জননী হইবে তার বুঝিনু কথায়।
তিন ভাই কৃষ্ণা সহ রাখিয়া তথায়।।
তত রাত্রে গেল দোঁহে ভিক্ষার কারণ।
ভিক্ষা করি আনি দিল করিতে রন্ধন।।
রন্ধন করিল কৃষ্ণা চক্ষুর নিমিষে।
মাতা তার সাদরে বলিল প্রিয়ভাষে।।
আশে পাশে ডাকিয়া আইস পুত্রগণ।
উপবাসী অতিথি থাকয়ে কোন্ জন।।
অতিথিরে দিয়া যেই অবশেষ থাকে।
দুই ভাগ করি কৃষ্ণা বাঁটহ তাহাকে।।
এক ভাগ করি কৃষ্ণা বাঁটহ তাহাকে।।
এক ভাগ দাও বাপু ইহার গোচর।
আর এত ভাগ কৃষ্ণা পঞ্চ ভাগ কর।।
চারি ভাগ দেহ এই চারি বিদ্যমানে।
এক ভাগ দ্রৌপদী করহ দুই স্থানে।।
তুমি অর্দ্ধ লহ মোরে দেহ অর্দ্ধ আনি।
সেই মত বাঁটিয়া দিলেক যাজ্ঞসেনী।।
এত যদি পুনঃ পুনঃ কহিল জননী।
ক্রোধ করি দুষ্ট দ্বিজ কহে কটুবাণী।।
এত রাত্রে অতিথিরে পাইব কোথায়।
ভুঞ্জিয়া থাকিবে কিম্বা থাকিবে নিদ্রায়।।
আজিকার ভিক্ষা মাতা সমধিক নহে।
বিশেষ যুদ্ধের শ্রমে পেটে অগ্নি দহে।।
আজিকার দিনে মাতা অতিথি রহুক।
ভয়েতে জননী বলে, তাহাই হউক।।
পুনঃ বলে, অতিথির ভাগ দেহ মোরে।
কালি প্রাতে যত ইচ্ছা, দিও অতিথিরে।।
দেহ দেহ বলি পুনঃ ডাকিল জননী।
সেইরূপ বাঁটিল দিলেন যাজ্ঞসেনী।।
গ্রাস দুই তিনে সেই সকলি খাইল।
মণ্ড আন মণ্ড আন, বলি ডাক দিল।।
না পাইয়া মণ্ড ক্রোধে কটাক্ষেতে চায়।
মোর মনে দ্রৌপদীরে মারিলেক প্রায়।।
মণ্ড না পাইয়া মনে জন্মে মহাক্রোধ।
ক্ষুধানলে তনু জ্বলে না মানে প্রবোধ।।
মাতা বলে, তাত আজিকার দোষ খণ্ড।
নূতন রন্ধনী, আজি না রাখিল মণ্ড।।
মায়ের বচনে বহুমতে শান্ত হৈল।
ভোজন শেষেতে তবে আচমন কৈল।।
ভোজন করিয়া চাহে শয়ন করিতে।
সবার কনিষ্ঠে বলে শয্যা পাতি দিতে।।
সাবার উপরে শয্যা করিল মাতার।
পঞ্চ ভাইয়ের শয্যা পদনীচে তাঁর।।
সবার চরণতলে কৃষ্ণা শয্যা পাতি।
হৃষ্ট হৈয়া শুইল দ্রৌপদি গুণবতী।।
শুইয়া সে সব তারা করিল তখন।
তাহে জানিলাম ছদ্ম না হয় ব্রাহ্মণ।।
মহাভারতের কথা সুধার সাগর।
কাশীদাস কহে, সদা শুনে সাধু নর।।
১০৫.দ্রুপদ-রাজপুরে পাণ্ডবদিগকে আনয়ন
শুনিয়া দ্রুপদ রাজা আনন্দিত মনে।
উঠি বসি রাত্রি পোহাইল জাগরণে।।
পূর্ব্বভিতে দেখি রাজা অরুণ-উদয়।
পুরোহিত-দ্বিজে কহে করিয়া বিনয়।।
কুম্ভকার-শালে তুমি যাহ শীঘ্রগতি।
পরিচয় লহ, তারা হয় কোন্ জাতি।।
রাজার পাইয়া আজ্ঞা চলিল ব্রাহ্মণ।
ব্রাহ্মণে দেখিয়া প্রণমিল পঞ্চজন।।
যুধিষ্ঠিরে চাহিয়া বলয়ে দ্বিজমণি।
সত্যশীল শ্রেষ্ঠ তুমি, বুঝি অনুমানি।।
যাহা জিজ্ঞাসিব নাহি করিবা ভণ্ডন।
পরিচয় হচ্ছে তোমা দ্রুপদ-রাজন।।
দ্রুপদ-রাজার এই মানস আছিল।
দ্রৌপদী কুমারী তাঁর যে দিনে জন্মিল।।
কুরুবংশে পাণ্ডুরাজা সখা প্রিয়তর।
তাঁর পুত্রে কন্যা দিব, চিন্তিল অন্তর।।
গৃহদাহে মাতা সহ মৈল পঞ্চ ভাই।
সবে এই কথা কহে, প্রত্যয় না যাই।।
ব্যাস সহ যুক্তি করি লক্ষ্য কৈল পণ।
বিনা পার্থ বিন্ধিতে নারিবে অন্য জন।।
এই হেতু মনে বড় আছয়ে সন্দেহ।
কে তুমি, কাহার পুত্র, পচিয় দেহ।।
ধর্ম্ম কহে, পরিচয়ে কোন্ প্রয়োজন।
জাতির নির্ণয় নাহি লক্ষ্য কৈলে পণ।।
সেই পণে এই কন্যা আনিল জিনিয়া।
এক্ষণে কি কাজ জাতি বর্ণ জিজ্ঞাসিয়া।।
পুরোহিত বলে, তাহা কে লঙ্ঘিতে পারে।
পরিচয় দিয়া প্রীত করহ রাজারে।।
যুধিষ্ঠির বলে, গিয়া কহ নৃপবরে।
হীনজাতি জন কি বিন্ধিতে লক্ষ্য পারে।।
শুনি পুরোহিত গিয়া দ্রুপদে কহিল।
পরিচয় না পাইয়া নৃপতি চিন্তিল।।
পুত্রগণ সহ তবে বিচার করিয়া।
ছয়খান রথ তবে দিল পাঠাইয়া।।
পুত্রে পাঠাইল আগুসরি লইবারে।
রথ লইয়া ধৃষ্টদ্যুন্ন গেল তথাকারে।।
চিহ্ন জানিবারে পথে থুইল রাজন।
পাশাক্রীড়া বেদবিদ্যা পুরাণ পঠন।।
ধান্য যব নানা শস্য রাখে দুই ভিতে।
ধনুকাটি নানা অস্ত্র তূণের সহিতে।।
নট নটী নৃত্য করে, বন্দীগণে গান।
চারিভিতে সুসজ্জিত অশ্ব গজ যান।।
রথ লৈয়া ধৃষ্টদ্যুম্ন গেল শীঘ্রগতি।
সবিনয়ে বলে তবে ধর্ম্মরাজ প্রতি।।
পাঠাইল নরপতি পরম আদরে।
কৃষ্ণা সহ পঞ্চ ভাই চল তথাকারে।।
ধর্ম্মরাজ শুনিয়া বিলম্ব না করিয়া।
পঞ্চ ভাই পঞ্চ রথে চড়িলেক গিয়া।।
এক রথে কৃষ্ণা সহ ভোজের নন্দিনী।
বাজিল বিবিধ বাধ্য সুমঙ্গল ধ্বনি।।
দুই ভিতে নানারত্ন থুইল রাজন।
কারু ভিতে না চাহিল ভাই পঞ্চ জন।।
বিচারে জানিল যত পাত্র মিত্রগণে।
সামান্য নয় এই ভাই পঞ্চজনে।।
তাঁহাদের কর্ম্ম দেখি সবার বিস্ময়।
লোকে বলে ছদ্ম দ্বিজ মনুষ্য এ নয়।।
যথায় দ্রুপদ ভূপ রত্ন-সিংহাসনে।
বেষ্টিত হইয়া যত পাত্র মিত্রগণে।।
তথা আসি উপস্থিত ভাই পঞ্চজন।
উঠিয়া আপনি রাজা কৈল সম্ভাষণ।।
কুন্তী সহ দ্রৌপদীরে অন্তঃপুরে নিল।
নারীগণ হুলুধ্বনি করিতে লাগিল।।
মহাভারতের কথা শ্রবণে মঙ্গল।
কাশীরাম কহে, লভে ভারতের ফল।।
১০৬.যুধিষ্ঠিরকে দ্রুপদের পরিচয় জিজ্ঞাসা
বসিল দ্রুপদ রাজা পুত্রের সহিত।
পাত্রমিত্রগণ আর দ্বিজ পুরোহিত।।
পঞ্চজন-মুখচন্দ্র করি নিরীক্ষণ।
হরষিত হৈয়া রাজা বলেন বচন।।
কে তোমরা, কোথা বাস, কহ সত্যবাণী।
কেবা জনক, কেবা হয় তব জননী।।
মনুষ্য লোকের প্রায় নাহি লয় মনে।
আকৃতি প্রকৃতি দেবতুল্য পঞ্চজনে।।
রূপে পঞ্চজনের না দেখি শ্রেষ্ঠাশ্রেষ্ঠ।
সবার সমান রূপ, জ্যেষ্ঠ কি কনিষ্ঠ।।
কিবা ইন্দু ইন্দ্র কাম অশ্বিনীকুমার।
ইহা মধ্যে হবে, চিত্তে লয়েছে আমার।।
আর যত ধর্ম্মকর্ম্ম সত্য সম নহে।
মিথ্যা সম পাপ নাহি সর্ব্বশাস্ত্রে কহে।।
সর্ব্ব ধর্ম্মাধর্ম্ম তোমা সবার গোচর।
কহ সত্য খণ্ডুক মনের মতান্তর।।
এত শুনি বলেন, ধার্ম্মিক যুধিষ্ঠির।
সজল জলদ যেন বচন গম্ভীর।।
আমরা যে পঞ্চ ভাই পাণ্ডুর নন্দন।
আমি যুধিষ্ঠির, এই দোঁহে ভীমার্জ্জুন।।
এ নকুল সহদেব, জানহ নৃপতি।
অন্তঃপুরে মাতা কুন্তী সহিত পার্ষতী।।
এত শুনি নরপতি হইল উল্লাস।
আপনা পাসরে, মুখে নাহি সরে ভাষ।।
কদম্বকুসুম সম কলেবর ফুলে।
বসন ভূষণ তিতে নয়নের জলে।।
শীঘ্রগতি উঠি রাজা করি আলিঙ্গন।
একে একে সম্ভাষিল ভাই পঞ্চজন।।
রাজা বলে, পূর্ব্বভাগ্য আমার যে ছিল।
সেই ফলে মনের কামনা পূর্ণ হৈল।।
কহ শুনি তাত সেই সব বিবরণ।
গৃহদাহে মৈল বলি কহে সর্ব্বজন।।
যুধিষ্ঠির বলেন, সে গৃহদাহ নয়।
জৌগৃহ করিল পুরোচন পাপাশয়।।
বিদুরের মন্ত্রণায় তরিনু তাহাতে।
শুনিয়া দ্রুপদ রাজা বলে ক্রোধচিতে।।
এত বড় নির্দ্দয় সে অন্ধ-মহারাজ।
নাহি ধর্ম্মভয়, নাহি লোকভয়-লাজ।।
ধর্ম্মেতে রাখিল তোমা সে সব সঙ্কটে।
মজিবেক পাপিগণ আপন কপটে।।
গৃহদাহে মৈল বলি, কহে সর্ব্বজন।
জৌগৃহ করিল বলি শুনি যে এখন।।
এ সকল কষ্ট চিত্তে না ভাবিহ আর।
মম ধন রাজ্য বাপু সকলি তোমার।।
তবে কতক্ষণান্তরে বলয়ে বচন।
বিবাহ করহ পার্থ করি শুভক্ষণ।।
শুনিয়া করয়ে মানা ধর্ম্মের কুমার।
রাজা বলে, যাহা ইচ্ছা বিচার তোমার।।
তুমি কিম্বা বৃকোদর কিম্বা ধনঞ্জয়।
কিম্বা দুই জন এই মাদ্রীর তনয়।।
যুধিষ্ঠির বাক্য শুনি বিস্মিত নৃপতি।
অধোমুখ হৈয়া তবে নিরীক্ষয়ে ক্ষিতি।।
কুন্তীপুত্র শ্রেষ্ঠ তুমি ধর্ম্ম-অবতার।
তুমি হেন বল, আমি কি বলিব আর।।
বহু পতি ধরে সতী কভু নাহি শুনি।
হেন শাস্ত্র বেদে শাস্ত্রে নাহি আছে জানি।।
পূর্ব্বে সাধুগণ সব যাহা নাহি করে।
ধার্ম্মিক সাধুজন যাহা নাহি আচরে।।
এমত অপূর্ব্ব কথা কভু নাহি শুনি।
ইতরের প্রায় কেন কহ হেন বাণী।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন, এ কথা প্রমাণ।
পূর্ব্ব সাধুগণ পথ কে করিবে আন।।
লোকে বেদে যাহা কহে জানিহ রাজন।
গুরুজন বাক্য কভু না করি লঙ্ঘন।।
লোকমত কর্ম্ম রাজা করিব সর্ব্বথা।
কিন্তু গুরুজন-বাক্যে না করি অন্যথা।।
লোকমধ্যে গুরুশ্রেষ্ঠ গুরুতে জননী।
মাতৃবাক্য কেমনে লঙ্ঘিব নৃপমণি।।
মাতা মম গরুদেব ইষ্টদেব জানি।
মাতার বচন আমি দেবতুল্য মানি।।
মাতার বচন লঙ্ঘে যেই দুরাচার।
যতেক সুকৃতি কর্ম্ম নিষ্ফল তাহার।।
যুধিষ্ঠির-বাক্য শুনি বিস্মিত দ্রুপদ।
অধোমুখ হয়ে বৈসে গণিয়া বিপদ।।
কতক্ষণে উত্তর করিল নরপতি।
নারিনু এ বিধি দিতে কি আছে শকতি।।
তুমি আর ধৃষ্টদ্যুম্ন পুরোহিত সহ।
এ কথা বিচার করি আমারে সে কহ।।
মহাভারতের কথা সুধা-সিন্ধুসম।
কাশীদাস রচিল ছন্দেতে অনুপম।।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র