মহাভারত:শান্তিপর্ব-০৩৬-০৪০

৩৬. অষ্টমীর ব্রত মাহাত্ম্যে সুবাহ রাজার উপাখ্যান
ভীষ্ম বলিলেন শুন পাণ্ডুর নন্দন।
আর কিছু ব্রতকথা শুন দিয়া মন।।
অষ্টমী নামেতে ব্রত পার্ব্বতী সেবনে।
জন্ময়ে অক্ষয় পুণ্য বেদেতে বাখানে।।
আশ্বিনের শুক্লপক্ষে অষ্টমীর দিনে।
শিবদুর্গা আরাধনা করে যেই জনে।।
সর্ব্বদুঃখে তরে সেই নাহিক সংশয়।
ইতিহাস কথা কহি শুন ধর্ম্মরায়।।
কহিলেন পূর্ব্বে যাহা ব্যাস মুনিবর।
শুনিয়া বিস্মিত মম হইল অন্তর।।
সেই কথা কহি রাজা কর অবগতি।
সুবাহু নামেতে এক ছিল নরপতি।।
মহাধর্ম্মশীল রাজা ধর্ম্ম কর্ম্মে রত।
ব্রাহ্মণেরে নানা দান দেন অবিরত।।
বিচিত্র আরাম এক করিয়া রচন।
বিপ্রে পূজে দিয়া মাল্য অগুরু চন্দন।।
এইমত বহুদিন পূজিল ব্রাহ্মণে।
দৈববশে কতকালে ‍পিতৃশ্রাদ্ধ দিনে।।
কোটি কোটি ব্রাহ্মণ করিল নিমন্ত্রণ।
দিব্য ভোগে সবাকারে করিল তোষণ।।
যথোচিত দক্ষিণা দিলেন দ্বিজগণে।
আশীর্ব্বাদ করি সবে গেল নিজ স্থানে।।
অন্তঃপুরে যায় রাজা ভোজন কারণ।
হেনকালে দেখ এক দৈবের ঘটন।।
সেইকালে এক দ্বিজ সুদেব নামেতে।
যাচঞা করিল আসি রাজার সাক্ষাতে।।
যথোচিত দান মোরে দেহ নরবর।
কালবশে হৈল রাজা ক্রোধিত অন্তর।।
কালে যাহা করে তাহা কে খণ্ডিতে পারে।
অন্ন বস্ত্র আদি নানা দিল ব্রাহ্মণেরে।।
তাহা পেয়ে সত্বরে চলিল নিজ ঘরে।
ক্রোধচিত্তে নৃপতি চলিল অন্তঃপুরে।।
এই হেতু মহাপাপ ফলিল রাজনে।
কতদিনে নৃপতি দেখিল পুষ্পবনে।।
প্রতিদিন আসি পুষ্প গন্ধর্ব্বের হরয়।
ক্রোধচিত্ত নরবর পুষ্প নাহি পায়।।
ভাবিয়া ভূপতি তবে রক্ষক রাখিল।
কোন্ জন তুলে পুষ্প লক্ষিতে নারিল।।
মনুষ্যের শক্তি নহে জানিল কারণে।
আপনি রহিল রাজা কুসুম রক্ষণে।।
পুষ্প তুলিবারে এল গন্ধর্ব্বের পতি।
পুষ্পবনে অন্নবৃষ্টি বরষয়ে অতি।।
অন্নবৃষ্টি দেখি হল সচিন্তিত মন।
সেই রাত্রি রহিলেক জানিতে কারণ।।
প্রাতঃকালে নৃপতি দেখিল গন্ধর্ব্বেরে।
নিকটে আসিয়া রাজা জিজ্ঞাসিল তারে।।
কি নাম ধরহ তুমি কোথায় বসতি।
কোন্ হেতু ইস পুষ্প তোল নিতি নিতি।।
আমারে সম্ভ্রম কিছু নাহি তোর মনে।
আজি সে উচিত শাস্তি পাবে মম স্থানে।।
গন্ধর্ব্ব বলিল মম স্বর্গেতে বসতি।
পুষ্পধর নাম মম বিদ্যাধর জাতি।।
সুবেশ করিবে যত বিদ্যাধরীগণ।
এই হেতু পুষ্প আমি করি যে হরণ।।
আজি হৈতে মিত্র তুমি হইলে আমার।
কোন্ কার্য্য সাধি দিব কহত তোমার।।
কিন্তু এক সবিস্ময় হৈল মম মনে।
নিত্য নিত্য পুষ্প হরি আসিয়া কাননে।।
এক অপরূপ বড় দেখি হে রাজন।
কালি হৈতে অন্ন কেন হয় বরিষণ।।
এখনও অন্নবৃষ্টি হয় এই বনে।
রাত্রি বঞ্চিলাম আমি জানিতে কারণে।।
হেতু যদি জান রাজা কহিবে আমারে।
এত শুনি নরপতি কহিছে তাহারে।।
কোথা অন্নবৃষ্টি হয় ‍না পাই দেখিতে।
মিথ্যা কথা বলি কেন ভাণ্ডও আমাতে।।
বিদ্যাধর বলে মিথ্যা হইবে কেমনে।
দিব্যচক্ষু দিব তুমি দেখহ নয়নে।।
এত শুনি দিব্যচক্ষে চায় নরনাথ।
অন্ন বরিষণ দেখে করি দৃষ্টিপাত।।
পূর্ব্বের কারণ তা হইল স্মরণ।
গন্ধর্ব্ব চাহিয়া বলে শুন বিবরণ।।
এককালে দৈবে আমি পিতৃশ্রাদ্ধ দিনে।
অন্ন বস্ত্র আদি দান দিলাম ব্রাহ্মণে।।
সেই হৈতে অন্নবৃষ্টি হয়ত কাননে।
যাহা দিই পাই তাহা এ নহে এড়ানে।।
তারপর বিদ্যাধর শুনহ এক্ষনে।
যে কালেতে ব্রাহ্মণেরে দিনু অন্নাদান।।
এ পাপে নরক হৈতে নাহিক এড়ান।
এক নিবেদন করি শুনহ আমার।।
এ পাপে যেমতে তরি কহিবা প্রকার।
এত শুনি বিদ্যাধর গেল সুরপুরে।।
কহিল রাজার কথা ইন্দ্রের গোচরে।
শুনিয়া হাসিয়া ইন্দ্র বলিল বচন।।
যত পুণ্য করিল সে না হয় কথন।
পুণ্যফলে স্বর্গেতে আসিবে মতিমান।।
তার তরে আগে হৈতে করেছি উদ্যান।
সুবর্ণ প্রাচীর দেখ সুবর্ণের ঘর।
সুরর্ণ পালঙ্ক শয্যা দেখ মনোহর।।
পুরীর সম্মূখে গিরি দেখ বিদ্যমান।
ভক্ষণ সামগ্রা দেখ অদ্ভুত বিধান।।
এত শুনি বিদ্যাধর হেতু জিজ্ঞাসিল।
রাজভোগে হেন দ্রব্য কি হেতু হইল।।
ইন্দ্র বলে কহি শুন পূর্ব্বের কাহিনী।
মহাপাপ অর্জ্জিল সুবাহু নৃপিমণি।।
পিতৃশ্রাদ্ধ দিনে এক ক্ষুধার্ত্ত ব্রাহ্মণে।
অন্নদান করিলেন অত্যন্ত যতনে।।
এক গুণ দিলে হেথা হয় সপ্তগুণ।
অন্নদান হেতু এই শুনহ নিপুণ।।
যাহা দেয় তাহা ভুঞ্জে নাহিক এড়ান।
তার ভক্ষ্য হেতু যে রাখিনু মতিমান।।
কিন্তু আর এক কথা শুন বিদ্যাধর।
যখন ব্রাহ্মণে দান দিল নরবর।।
ক্রোধ করি অন্নদান দিলেন ব্রাহ্মণে।
সে পাপ ভূঞ্জিতে হবে যমের সদনে।।
এত শুনি বিস্মিত হইল বিদ্যাধর।
করযোড়ে কহে পুনঃ ইন্দ্রের গোচর।।
সুবাহুর সঙ্গে মম মিত্রতা হইল।
বিনয় করিয়া রাজা আমারে কহিল।।
এই পাপ ভোগ তুমি খণ্ডাবে আমার।
তাহার অগ্রেতে আমি কৈনু অঙ্গীকার।।
হেন পাপ ভোগ সখা ভুঞ্জিবে আপনে।
সাক্ষাতে কেমনে আমি দেখিব নয়নে।।
ইহার প্রকার মোরে বল মহাশয়।
ইথে মুক্ত নরপতি কোন্ মতে হয়।।
ইন্দ্র বলিলেন তার আছয়ে উপায়।
শীঘ্রগতি গিয়া তুমি কহিবে রাঙ্গয়।।
অষ্টমীর উপবাস পার্ব্বতী সেবন।
রাজার নগরে করি থাকে যেই জন।।
তার অঙ্গ সেই দিন পরশ করিবে।
স্নান করি ব্রতী হয়ে তপ আরম্ভিবে।।
কাটিয়া অঙ্গের মাংস রাখিবে রুধিরে।
শিব দুর্গা আরাধিবে এক সন্বৎসরে।।
বৎসর হইলে পূর্ণ ব্রত সাঙ্গ করি।
বেদবিজ্ঞ দ্বিজগণে আনিবে আদরি।।
অন্নদান ভুমিদান দিবে দ্বিজগণে।
আজ্ঞা লয়ে পশ্চাতে সে করিবে পারণে।।
তবে তার এই পাপ হইবে খণ্ডন।
এত শুনি গন্ধর্ব্ব হইল হৃষ্টমন।।
কহিল এ সব গিয়া রাজার গোচরে।
শুনি নরপতি তবে ভ্রমিল নগরে।।
অষ্টমীর উপবাসী কারে না দেখিল।
অনেক ভ্রমিয়া রাজা চিন্তিত হইল।।
নগরের নারী এক ছিল বেশ্যাঘরে।
স্ত্রী পুরুষে কোন্দল করিছে বহুতরে।।
নিরাহারে আছে তারা অষ্টমী দিবস।
তার অঙ্গ দিয়া রাজা করিল পরশ।।
ব্রতী হয়ে সম্বৎসর পার্ব্বতী পূজিল।
মহাপাপ ভোগ হৈতে ভূপতি তরিল।।
দান ধ্যান বহুতর করিল রাজন।
অন্তে তনু ত্যজি গেল বৈকুণ্ঠ ভুবন।।
শোক দূর করি রাজা স্থির কর মন।
স্বধর্ম্মেতে রাজধর্ম্ম করহ পালন।।
অষ্টমীর ব্রত কথা শুনে যেই জন।
সর্ব্ব দুঃখে তরে সেই ব্যাসের বচন।।
মহাভারতের কথা অমৃত লহরী।
কাশী কহে শুনিলে তরয়ে তরবারি।।
৩৭. বিষ্ণুর প্রদক্ষিণ প্রস্তাবে বৃহস্পতি ও ইন্দ্রের সংবাদ
এতেক শুনিয়া কথা ধর্ম্ম নৃপবর।
পুনরপি জিজ্ঞাসেন করি যোড়কর।।
প্রদক্ষিণ করে যেই দেব নারায়ণে।
প্রণিপাত আর স্তব করে দৃঢ়মনে।।
তাহার কি পুণ্যফল কহ মহাশয়।
চিত্তের সন্দেহ মম ঘুচাও নিশ্চয়।।
ভীষ্ম বলিলেন ভাল জিজ্ঞাসা তোমার।
গোবিন্দেরে প্রণাম যে করে অনিবার।।
তাহার পুণ্যের কথা কে কহিতে পারে।
পূর্ব্বের কাহিনী রাজা কহিব তোমারে।।
ব্রহ্মার প্রপৌত্র জীব অঙ্গিরাকুমার।
দেবের পরম গুরু বিখ্যাত সংসার।।
শক্রের নগরে তার আলয় নির্ম্মাণ।
কাঞ্চনে পূর্ণিত পুর নানা ভোগবান।।
লীলারূপে তাহাতে প্রকাশে দামোদর।
তার মধ্যে দিব্য এক মন্দির সুন্দর।।
প্রাতঃসন্ধ্যাকালে তবে গুরু বৃহস্পতি।
প্রদক্ষিণ করিয়া কৃষ্ণেরে করে স্তুতি।।
এইরূপে নিত্য নিত্য করয়ে বন্দন।
একদিন গেল ইন্দ্র গুরুর ভবন।।
প্রদক্ষিণ করি গুরুদেব জনার্দ্দনে।
দণ্ডবৎ প্রণিপাত করে হৃষ্টমনে।।
চক্রাবর্ত্তে সপ্তবার মন্দির ফিরিয়া।
প্রণাম করেন কৃষ্ণ প্রদক্ষিণ হৈয়া।।
হেনকালে আসি ইন্দ্র গুরুর সাক্ষাৎ।
বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করে করি প্রণিপাত।।
নানাবিধ ভক্তি কৃষ্ণে কহে পুনিগণ।
স্তুতিপূজা ধ্যান আদি অর্চ্চন বন্দন।।
এ সব ছাড়িয়া তুমি প্রদক্ষিণ করি।
দণ্ডবৎ প্রণাম করিয়া পূজ হরি।।
ইহার কি ফল হয় কহিবা আমারে।
এত শুনি বৃহস্পতি কহিল তাহারে।।
সম্যক প্রকারে ফল কহিতে না জানি।
অবধান কহি শুন পূর্ব্বের কাহিনী।।
ধ্যান অবশেষে তবে প্রদক্ষিণ হৈয়া।
প্রণিপাত করিলেন শিরে হাত দিয়া।।
দেখিয়া বিস্ময় মম হইল অন্তরে।
ইহার বৃত্তান্ত জিজ্ঞাসিলাম তাঁহারে।।
কৃপা করি ব্রহ্মা কহিলেন যে আমারে।
সেই কথা শুন ইন্দ্র কহি যে তোমারে।।
পূর্ব্বে সত্যযুগে দ্বিজ সুদেব নামেতে।
দুষ্টাচার পাপবুদ্ধি আছিল জগতে।।
বেশ্যাপরায়ণ লুব্ধ পাপী দুরাচার।
নিরন্তর পরদ্রব্য করে অপহার।।
তার কর্ম্ম দেখি সবে ধিক্কার জন্মিল।
নগর হইতে তারে বাহির করিল।।
মহাবনে প্রবেশিল সেইত ব্রাহ্মণ।
নর্ম্মদার তীরে আসি দিল দরশন।।
তথায় দেখিল তপ করে এক মুনি।
তারে বিড়ম্বনা কৈল তত্ত্ব নাহি জানি।।
শকুনি পতগ পাখা করেতে আছিল।
সেই পাখা মুনির জটায় নিয়োজিল।।
হাস্য পরিহাস করি অনেক কহিল।
ময়ূরের পুচ্ছ তার শিরে আরোপিল।।
অতি সুশোভন দেখি জটার উপর।
দেখি তবে হৈল মুনি সক্রোধ অন্তর।।
না জানি আমারে দুষ্ট কর বিড়ম্বন।
ইহার উচিত শাপ দিব এইক্ষণ।।
শকুনি পতগ পাখা মম শিরে দিলে।
হইয়া গৃধিনী পক্ষী জন্মহ ভুতলে।।
এত শুনি তবে দ্বিজ বলিল বচন।
স্মৃতি ভঙ্গ মোর যেন না হয় কখন।।
এত শুনি দুঃখচিত্ত হৈল তপোধন।
সেইক্ষণে পঞ্চত্ব পাইল সে ব্রাহ্মণ।।
শরীর ত্যাজিয়া দ্বিজ গৃধ্ররূপ হৈল।
নিবাস করিয়া সেই বনেতে রহিল।।
এইরূপে কত দিনে আছয়ে বনেতে।
এক দিন ব্যাধ তারে দেখে আচম্বিতে।।
আকর্ণ পুরিয়া বাণ পক্ষীরে মারিল।
অত্যল্প সঘনে পক্ষী যায় পলাইয়া।।
পাছে পাছে ব্যাধপুত্র চলিল ধাইয়া।
কত দূরে গিয়া পক্ষী নির্জীব হইয়ে।।
উড়িয়া পড়িল পক্ষী দেবালয়ে গিয়ে।
ধেয়ে গিয়া ব্যাধ সেই পক্ষীরে ধরিল।।
প্রদক্ষিণ করি শীঘ্র শরীর ত্যাজিল।
সাতবার প্রদক্ষিণ দেবালয় করি।
পঞ্চত্ব পাইল পক্ষী দিব্যমূর্ত্তি ধরি।।
বিষ্ণুপুরে প্রবেশিল বিমানে চড়িয়ে।
নিজ গৃহে গেল ব্যাধ মরা পক্ষী লয়ে।।
পাইল নির্ম্মল মূর্ত্তি দেব নারায়ণে।
প্রদক্ষিণ মহিমা কে কহিবারে জানে।।
ব্রহ্মার বচনে আমি মানিনু সংশয়।
সেই হতে প্রদক্ষিণ করি দেবালয়।।
দণ্ডবৎ প্রণাম করিল বহু স্তুতি।
জানাই তোমারে ইন্দ্র পূর্ব্বের ভারতী।।
ভীষ্ম কন অবধান করহ রাজন।
এত শুনি সবিন্ময় সহস্রলোচন।।
সেই হৈতে হৈল ইন্দ্র প্রদক্ষিণে রত।
কহিনু তোমারে রাজা পূরাণের মত।।
মহাভারতের কথা অমৃতের ধার।
শুনিলে পবিত্র হয় জন্ম নাহি আর।।
ব্যাসের বচন, ইথে নাহিক সংশয়।
শান্তিপর্ব্ব-কথা কাশীদাস বিরচয়।।
৩৮. সাধুসঙ্গ প্রসংসা উপলক্ষে উতঙ্ক উপাখ্যান
বলেন বৈশস্পায়ন শুন জন্মেজয়।
এতেক শনিয়া তবে ধর্ম্মের তনয়।।
মায়া মোহ তেয়াগিয়া হলেন সুস্থির।
পুনরপি ভীষ্মে জিজ্ঞাসেন যুধিষ্ঠির।।
কিরূপে এ ঘোর মায়া ত্যজে জ্ঞানিজন।
কিরূপে জনম সেই করয়ে খণ্ডন।।
কিরূপে সাধুসঙ্গ করয়ে জীবগণ।
সংসারের মায়াজাল করয়ে খণ্ডন।।
সাধুসঙ্গ করি কিবা ভক্তি পায় নর।
ইহার বৃত্তান্ত কহ ওহে কুরুবর।।
ভীষ্ম বলিলেন ভাল জিজ্ঞাস রাজন।
ঈশ্বরের মায়া খণ্ডে আছে কোন্ জন।।
সকলের আত্মা হন এক ভগবান।
কারো শত্রু মিত্র নহে কারে ভিন্ন জ্ঞান।।
মায়ার প্রভাবে সব অখিল মোহয়।
জ্ঞানিজন মায়াজাল জ্ঞানেতে ছেদয়।।
জ্ঞানরূপ ভগবান মায়ার নিদান।
কহিব তাঁহার কথা শুন মতিমান।।
ঈশ্বর তাঁহার কথা শুন মতিমান।
ঈশ্বর মায়ার বিমোহিত চরাচর।।
মায়া অবলিম্বি অবস্থিত দামোদর।
মায়াতে হইয়া বন্দী রহে মূঢ়জন।।
মম ঘর মম বাড়ী মম পরিজন।
এ সব সম্পত্তি মম, মম ভ্রাতৃগণ।।
এ সব চিন্তিত হয় মায়ার কারণ।
মায়ার প্রভাবে কাম বাড়ে অতিশয়।।
চুরি হিংসা পরিবাদ ক্রোধ লজ্জা ভয়।
কখন মরিব বলি চিত্তে নাহি করে।।
মায়াজালে বদ্ধ হয়ে ভ্রময়ে সংসারে।
ঈশ্বর লিখিত সব না জানে অজ্ঞানে।।
আমার আমার করি মরে অকারণে।
পুত্র মিত্র ভার্য্যা কেহ সঙ্গে সাথী নয়।।
মরিলে সন্বন্ধ নাহি কারো সাথে রয়।
হরিনাম হরিগুণ শ্রবণ কীর্ত্তন।।
মায়াতে হইয়া বদ্ধ না করে স্মরণ।
এইরূপে ঈশ্বরের মায়ার বিধান।।
তরিবে ইহাতে যেই হয় মতিমান।
গৃহধর্ম্ম করিয়া করিবে সাধুসঙ্গ।।
হরিনাম হরিগুণ কীর্ত্তন প্রসঙ্গ।
সাধুমুখে কৃষ্ণজ্ঞান অস্ত্র করে ধরি।।
মায়ার বন্ধন কাই, ত্বরা করি।
জ্ঞানে বা অজ্ঞানে করে সাধু দরশন।।
ঈশ্বরের মায়া তরে সেই মহাজন।
অজ্ঞানে বা জ্ঞানে করে অমৃত ভোজন।।
তথাপি অমর হবে বেদের বচন।।
পূর্ব্ব ইতিহাস কথা কহিব ইহাতে।
সাবধান হয়ে রাজা শুন একচিতে।।
কলিক নামেতে ব্যাধ ছিল শান্তিপুরে।
বহু পাপ দুরাচার করিল সংসারে।।
চুরি হিংসা পরদ্রোহী বেশ্যাপরায়ণ।
পরদ্রব্য লোভ লুব্ধ করে অনুক্ষণ।।
গো ব্রাহ্মণ মিত্র হিংসা করে সর্ব্বক্ষণ।
তাহার পাপের কথা না হয় কথন।।
অনুক্ষণ পরদ্রব্যে অপহার করে।
একদিন গেল ব্যাধ সৌরভ নগরে।।
নগর ভিতর গিয়া পশিল সত্বর।
বিচিত্র কাননে আছে দিব্য সরোবর।।
তথা গিয়া কলিক হইল উপনীত।
দেবালয় সেই স্থানে দেখে আচন্বিত।।
নানাধাতু বিরচিত বিচিত্র গঠন।
উপরেতে শুশোভন কলস কাঞ্চন।।
দেখিয়া হইল ব্যাধ আনন্দিত মন।
মন্দির নিকটে তবে করিল গমন।।
দেখিল ব্রাহ্মণ এক আছয়ে বসিয়া।
জিজ্ঞাসিল কহ দ্বিজ আছ কি লাগিয়া।।
উতঙ্ক নামেতে দ্বিজ সর্ব্ব গুণান্বিত।
বেদশাস্ত্রে বিজ্ঞ সাধু সর্ব্বত্র বিদিত।।
নানাবিধ অলঙ্কার স্বর্ণ পাত্রাসন।
শীলারূপী মূর্ত্তি তথা দেব জনার্দ্দন।।
পূজার সামগ্রী নানা সুবর্ণ রচিত।
দেখি আনন্দিত ব্যাধ হৃদয়ে চিন্তিত।।
ভাবিলেন নিশাযোগে এই ব্রাহ্মণেরে।
মারিয়া লইয়া যাব দ্রব্য নিজ ঘরে।।
এতেক ভাবিয়া মনে নিশ্চয় করিল।
মন্দির সমীপে বনে গোপনে রহিল।।
দিন অবসান নিশা হইল তথাতে।
হাতে খড়গ এল ব্যাধ মুনিরে মারিতে।।
বুকে জানু দিয়া তবে ধরে সেইক্ষণ।
খড়গ ঊর্দ্ধ করি হানিবার কৈল মন।।
খড়গ হস্তে দেখি মুনি বলয়ে ব্যাধেরে।
কি হেতু আমারে তুমি চাহ মারিবারে।।
একাকী দেখি যে তোমা নিষ্পাপ ভক্ষণ।
তবে কোন হেতু বুদ্ধি দেখি কুলক্ষণ।।
অহিংসা পরম ধর্ম্ম বেদেতে বাখানে।
সাধু নাহি হিংসা করে অহিংসক জনে।।
কালেতে কুবুদ্ধি যদি ঘটে কদাচিত।
তথাপিও হিত করে না করে অহিত।।
কালরূপী ভগবান এক সনাতন।
সুবুদ্ধি কুবুদ্ধি তিনি করেন সৃজন।।
সেই হেতু তোমারে দেখি যে কুলক্ষণ।
প্রায় বুঝি কুবুদ্ধি দিলেন নারায়ণ।।
অখিলপতির মায়া অখিলে মোহময়।
ঈশ্বরের মায়াজাল কেহ না বুঝয়।।
মায়াতে করিয়া বদ্ধ যত জীবগণে।
কালীরূপী জনার্দ্দন ভ্রমেণ ভুবনে।।
পুত্র মিত্র সকল বান্ধব পরিজন।
ভৃত্য আদি ধন জন এ সব কারণ।।
ব্যস্ত হয়ে করে লোক নানা পর্য্যটন।
নানা দুঃখ পেয়ে করে নিত্য উপার্জ্জন।।
নানা ভোগ দুঃখ পেয়ে পোষে পরিবারে।
মোর ঘর দ্বার বলি অকারণে মরে।।
মরিলে সন্বন্ধ নাহি, না বুঝে পামর।
একা হয়ে জন্মে জীব যায় একেশ্বর।।
পুত্র মিত্র পরিবার না যায় সঙ্গেতে।
আপনা না ভাবে জীব ঈশ্বর মায়াতে।।
সাধু সঙ্গ বিবর্জ্জিত লুব্ধক হইয়া।
না জানে ঈশ্বর মায়া তত্ত্ব না বুঝিয়া।।
যাঁর নাম গুণের প্রভাব অবর্ণিত।
কেবা সে বুঝিবে তত্ত্ব নাহি জানে।।
মনুষ্য হইয়া কেবা জানিবে কেমনে।
জ্ঞানরূপী ভগবান ব্রহ্মাণ্ড ঈশ্বর।।
জ্ঞানে মাত্র জানে জ্ঞানী জ্ঞানের অপর।
চরণারবিন্দ তাঁর যে, করয়ে সার।
আপনাকে দিয়া প্রভু বশ হন তার।।
যে জন পদারবিন্দ চিন্তে নিরন্তর।
দুঃসহ সঙ্কটে তারে ‍রাখেন শ্রীধর।।
যাঁর নাম স্মরণে অশেষ পাপ হরে।
পাপী হয়ে তত পাপ করিতে না পারে।।
বহু ক্লেশে লোক ধন করে উপার্জ্জন।
ধন দিয়া পোষয়ে বান্ধব পরিজন।।
ঈশ্বরের কর্ম্মে কিছু নাহি করে ব্যয়।
অধর্ম্মের সঙ্গে অসৎ পাত্রেতে মজয়।।
পরলোকে কি হইবে চিত্তে নাহি ধরে।
ঈশ্বরের নাম গুণ স্মরণ না করে।।
অন্তঃকালে হয় তার নরকে বসতি।
আপনাকে না জানে দারুণ মোহ মতি।।
মোহমদে মাতিয়া করয়ে অহঙ্কার।
সাধুজন নিন্দা করে দুষ্ট ব্যবহার।।
গো ব্রাহ্মণ হিংসা করে হিংসে সাধুজন।
অধোগতি হয় তার নরকে গমন।।
এইরূপে শাস্ত্রকথা অনেক কহিল।
শুনিয়া কলিক মনে বিষ্ময় মানিল।।
সাধু পরশন মাত্রে পাপ দূরে গেল।
করযোড় করি তবে উতঙ্কে কহিল।।
অপরাধ কৈনু মুনি ক্ষম মহাশয়।
তোমার পরশে মম পাপ হৈল ক্ষয়।।
নমো নমঃ তোমার চরণে নমস্কার।
যাহার প্রসাদে তরি এ ভব সংসার।।
পূর্ব্বজন্মে যত কৈনু পুণ্য উপার্জ্জন।
এই জন্মে তত পাপ না হয় গণন।।
পাপ দূরে গেল মম তোমার পরশে।
জন্মিল যে নিত্যানন্দ ভক্তি হৃষীকেশে।।
তুমি হে পরম গুরু হইলা আমার।
তোমার প্রসাদে হইলাম ভবপার।।
নমো নমো নারায়ণ অনাদি নিদান।
জয় জগন্নাথ নাম পতিত পাবন।।
সাধু সমাগম মাত্রে দুর্ব্বুদ্ধি খণ্ডিল।
তোমার চরণে দেব ভক্তি উপজিল।।
এইরূপে বহু স্তুতি কৈল নারায়ণে।
হৃদয়ে ভাবিয়া ‍যুক্তি করিলেক মনে।।
এ দেহ রাখিয়া আর নাহি প্রয়োজন।
পুনরপি পাপে পাছে ধায় মম মন।।
ত্রিগুণে জন্মিল দেহ ক্ষণেক চঞ্চল।
সে কারণে এ দেহ রাখিয়া নাহি ফল।।
এতেক ভাবিয়া ব্যাধ নিন্দে আপনাকে।
হে বিধি আমাকে রাখিলেন কোন্ পাকে।।
আমার সমান নাহি পাপী দুরাচার।
কেমনে পৃথিবী ভার সহয়ে আমার।।
আমার যতেক পাপ আছে বল কার।
এইক্ষণে আয়ুক্ষয় হউক আমার।।
অন্তরে ভাবিতে অগ্নি উঠিল নয়নে।
অতি শীঘ্র পঞ্চত্ব হইল সেইক্ষণে।।
ব্যস্ত হয়ে উতঙ্ক উঠিল সেইক্ষণ।
বিষ্ণুপাদোদক অঙ্গে করেন সেচন।।
বিষ্ণুপাদোদক স্পর্শে সাধু সমাগমে।
সর্ব্ব পাপ খণ্ডিল জানিল অনুক্রমে।।
প্রদক্ষিণ করিয়া উতঙ্কে করে স্তুতি।
দিব্য রথ পাঠাইয়া দেন জগৎপতি।।
চতুর্ভূজ দিব্য মূর্ত্তি হৈল সেইক্ষণে।
প্রভু অনুক্রমে গেল বৈকুণ্ঠ ভুবনে।।
দেখিয়া উতঙ্ক হৈল সবিস্ময় মতি।
নানাবিধ প্রকারে অনেক কৈল স্তুতি।।
তুষ্ট হয়ে নারায়ণ দেন দরশন।
বর দিয়া যান কৃষ্ণ আপন ভুবন।।
কহিনু তোমারে রাজা ধর্ম্মের কুমার।
ঈশ্বরের মায়া বুঝে শক্তি আছে কার।।
মহাভারতের কথা অমৃতের সার।
কাশীদাস দবে কহে রচিয়া পয়ার।।
৩৯. ব্যাধের প্রতি উতঙ্ক মুনির উপদেশ ও শ্রীকৃষ্ণের স্তব
এতেক শুনিয়া কথা ধর্ম্ম নরমণি।
পুনরপি জিজ্ঞাসিল করি যোড়পাণি।।
উতঙ্ক কিরূপে কৃষ্ণে করিল স্তবন।
কোন্ মুর্ত্তি ধরি কৃষ্ণ দেন দরশন।।
কি বর দিলেন কৃষ্ণ তুষ্ট হয়ে তায়।
কহিবে সকল কথা বিশেষে আমায়।।
ভীষ্ম কন অবধান করহ রাজন।
মহামুনি উতঙ্ক বিখ্যাত তপোধন।।
শিশুকাল হৈতে কৃষ্ণ পরিচর্য্যা করে।
বেদশাস্ত্র নিষ্ঠাশীল সর্ব্বগুণ ধরে।।
পাইল পরম গতি শ্রীকৃষ্ণে দেখিয়া।
করিল গোবিন্দে স্তুতি প্রণত হইয়া।।
জয় জয় নারায়ণ জগৎ কারণ।
জয় জগন্নাথ প্রভু ব্রহ্ম সনাতন।।
নমো কূর্ম্ম অবতার মন্দারধারক।
নমো ভৃগুপতি রাম ক্ষন্ত্র কুলান্তক।।
নমো রাম অবতার রাবণনাশন।
বলিমদহর নমো নমস্তে বামন।।
নমো ধন্বন্তরীকায় অমৃতধারক।
নমো যজ্ঞকায় হিরণ্যাক্ষ বিদারক।।
নমস্তে মোহিনীরূপ অসুরমোহন।
নমস্তে নৃসিংহ মাহদৈত্যবিনাশন।।
নমো রামকৃষ্ণরূপ গোকুল বিহার।
নমো নমো জয় জয় বুদ্ধ অবতার।।
ভবিষ্যৎ অবতার নমঃ কল্কিরূপ।
নমো হরি অবতার নমো বিশ্বরূপ।।
নমো শ্রীসচ্চিদানন্দ বিশ্বপরায়ণ।
নমো নমো জগৎপতি ব্রহ্ম সনাতন।।
তুমি ইন্দ্র তুমি যম তুমি পশুপতি।
ত্রিজগৎ নাথ তুমি ত্রিজগৎপতি।।
তুমি সূর্য্য বরুণ স্বরূপ কলেবর।
কুবের শমন তুমি জগৎ ঈশ্বর।।
তোমার মায়ার বদ্ধ সব চরাচর।
ত্রিগুণ ঈশ্বর তুমি প্রকৃতির পর।।
অনন্ত তোমার রূপ গুণ জাতিহীন।
গুণেতে বর্জ্জিত তুমি গুণেতে প্রবীণ।।
জ্ঞানের স্বরূপ তুমি তুমি মায়াধর।
নির্ম্মায়া নির্ম্মোহ তুমি মায়ার ঈশ্বর।।
তোমা বিনা আর কিছু নাহিক সংসার।
আত্মারূপে সর্ব্বভূতে করহ বিহার।।
অন্তরীক্ষ নাভি তব, পাতাল চরণ।
মস্তক আকাশ তব অরুণ লোচন।।
দশদিক স্তোত্র তব, শশী বামেক্ষণ।
তোমার শরীরে ব্যপ্ত চরাচরগণ।।
শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম শার্ঙ্গ আদি ধারী।
নানা অলঙ্কারে তনু ভূষিত মুরারী।।
পীতবাস পরিধান রাজীবলোচন।
বনমালা বিভূষিত গরুড়বাহন।।
ত্রিভঙ্গ ললিতরূপ বেশ মনোহর।
নব দল বিকসিত শ্যম কলেবর।।
দেখিয়া উতঙ্ক মুনি হইল ব্যাকুল।
আনন্দ অশ্রুতে ভাসে অঙ্গের দুকূল।।
দণ্ডবৎ হইয়া পড়িল ভূমিতলে।
দেখিয়া উতঙ্কে কৃষ্ণ করিলেন কোলে।।
আলিঙ্গন দিয়া মিষ্ট কহেন বচন।
তব মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হৌক তপোধন।।
একান্ত ভকতি করি আমারে যে ভজে।
অনুক্ষণ থাকি তার হৃদয়ের মাঝে।।
মনোমত যেই মাগে দেই আমি তারে।
সে কারণে শুন দ্বিজ কহি যে তোমাকে।।
যেই বর তব ইচ্ছা মাগ মম স্থানে।
অদেয় হইলে তবু দিব এইক্ষণে।।
এত শুনি কহে দ্বিজ করি যোড়পাণি।
অবধান নিবেদন শুন চক্রপাণি।।
নষ্কাম ভকত আমি বরে নাহি কাজ।
যদি বর দিবে তবে দেহ দেবরাজ।।
কর্ম্মদোষে জন্ম মম যথা তথা হয়।
একান্ত ভকতি যেন তব পদে রয়।।
কীট জন্ম হব কিম্বা মনুষ্য কিন্নরে।
গন্ধর্ব্ব চারণ আদি যত চরাচরে।।
পর্ব্বত স্থাবর আদি ভূত প্রেতগণ।
যথাতথা জন্ম হয় অদৃষ্ট কারণ।।
অকারণে কর মোরে মায়াতে মোহিত।
নির্ম্মায়া হইয় আমি মায়া বিবর্জ্জিত।।
তোমার মায়াতে বদ্ধ যত চরাচর।
কেবল বর্জ্জিত মায়া তোমার কিঙ্কর।।
ঈশ্বরের মায়াতত্ত্ব কি বুঝিতে পারি।
মায়া বিবর্জ্জিত বর দেহ শ্রীমুরারী।।
এত বলি করে দণ্ডবৎ প্রণিপাত।
দলেন তাহারে জ্ঞান ভক্তি জগন্নাথ।।
পুনরপি উতঙ্কে বলেন শ্রীনিবাস।
সর্ব্বত্র মঙ্গল হবে পুরিবেক আশ।।
নরনারায়ণ স্থানে করহ গমন।
তপ যোগ সাধি কর মম আরাধন।।
নর নারায়ণ স্থানে লহ উপদেশ।
একান্ত আমারে ভক্তি করিলে বিশেষ।।
অন্তেরে আমারে তুমি পাইবে নিশ্চয়।
এত বলি স্বস্থানে গেলেন কৃপাময়।।
অতঃপর চলে মুনি করিয়া প্রণাম।
নর-নারায়ণ যথা বদরিকাশ্রম।।
তত্ত্ব উপদেশ লয়ে ভজিল শ্রীহরি।
অন্তকালে তনু ত্যজি গেল বিষ্ণুপুরী।।
কহিলাম তোমারে যে পুরাণ কথন।
ঈশ্বর নির্ণয় তত্ত্ব জানে কোন্ জন।।
পৃথিবীর রেণু যদি গণিবারে পারি।
কলসীতে ভরি যদি সমুদ্রের বারি।।
আকাশের তারা যদি পারি যে গণিতে।
ঈশ্বরের তত্ত্ব তবু না পারি কহিতে।।
করেন করান তিনি আপনি ঈশ্বর।
অন্য দিয়া অন্য বৃত্তি হরেন শ্রীধর।।
অন্য দিয়া অন্য জনে সংহারেন হরি।
তাঁহার প্রসঙ্গ মায়া বুঝিতে না পারি।।
পিতা মাতা পুত্র বন্ধু কেহ কার নয়।
মরিলে সন্বন্ধ নাহি বুঝ মহাশয়।।
একা হয়ে আসে জীব একা হয়ে চলে।
আমার আমার বলি মরয়ে বিফলে।।
সে কারণে কহি শুন ধর্ম্মের নন্দন।
চিত্তে কৃষ্ণ রাখি শোক কর নিবারণ।।
এত বলি গঙ্গাপুত্র নিঃশব্দ হইল।
ধ্যানযোগে কৃষ্ণ মনে ধরিয়া রহিল।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীদাস কহে সদা শুনে পুণ্যবান।।
৪০. ভীষ্ম কর্ত্তৃক ভক্ত-মাহাত্ম্য কীর্ত্তন
ধৃতরাষ্ট্রে সান্ত্বাইয়া বলে ভীষ্ম বীর।
হরি ভজ হরি চিন্ত মন কর স্থির।।
অসার সংসার এই কেহ কারো নয়।
দিন কথো রহি যেন পথ পরিচয়।।
তোমারে কহিনু আমি যত হিতবাণী।
না শুনিল তব পুত্র না শুন আপনি।।
এখন আমার বাক্য শুন একমনে।
যোগকথা কহি শুন বেদের বচনে।।
পরলোক চিন্তা কর ভব তরিবার।
ভাবহ গোবন্দ-পদ সংসারের সার।।
বিদুরে চাহিয়া বলে শান্তনু-নন্দনে।
সর্ব্ব ধর্ম্ম জান তুমি ধর্ম্মে বিচক্ষণ।।
মোর বংশ উদ্ধারিতে তব জন্ম হৈল।
তুমি সে পরম সাধু শ্রীকৃষ্ণ জানিল।।
আপনি করিলা তুমি সর্ব্ব সমাধান।
বুঝাইলে সর্ব্বজনে দিয়া দিব্যজ্ঞান।।
যতেক পূর্ব্বের কথা তুমি সব জান।
ব্যাস আদি কহিলেন তাহা কৈল আন।।
জগতজীবন কৃষ্ণ তাঁর সেবা করি।
সফল জীবন ক্ষত্তা তব বশ হরি।।
প্রীত হয়ে কৃষ্ণচন্দ্র তব খুদ খায়।
পূর্ব্বে যে কহিনু আমি সেই অভিপ্রায়।।
এক বিপ্র ভক্ত ছিল পরম দুঃখিত।
শুনহ তাহার কথা হয়ে একাচিত।।
যেই মতে তার বশ ছিলা নারায়ণ।
একদিন বৈকুণ্ঠেতে দেব ভগবান।।
সভাতে বসিয়া প্রভু সঙ্গে পঞ্চজন।
ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব শুক নারদ তপোধন।।
সবে মেলি বসিয়াছে আনন্দিত মনে।
কুতূহলে চাহি নানা কথা আলাপনে।।
হেনকালে মায়া তারে কৈল ভগবান।
বুঝিয়া প্রভুর মন কৈল অনুমান।।
বুঝিয়া বলেন তবে দেব মহেশ্বরে।
করয়ে অনেক স্তুতি দেব বিশ্বেশ্বরে।।
তোমার যতেক ভক্ত নিজ নিজ ক্রমে।
ত্রৈলোক্যে বসতি করে তোমার নিয়মে।।
তোমার একান্ত যত আছয়ে সংসারে।
ভক্তের মহিমা কিছু দেখাও আমারে।।
এতেক বচন যদি কৈলা মহেশ্বর।
হাসিয়া বলেন তবে দেব গদাধর।।
ভক্তের মহিমা কিছু দেখাব তোমারে।
দীনহীন মোর ভক্ত আছয়ে সংসারে।।
অন্ন-বস্ত্রহীন যত মোর ভক্তগণ।
সংযোগ কেমন তার নাহি কদাচন।।
এ সুখ সম্পদ আমি নাহি দিব তারে।
লইয়া তিলক মালা ভ্রময়ে সংসারে।।
সংসারে বিষম দুঃখ হয় যে বন্ধন।
ইহাতে করয়ে যেই আমার ভবন।।
আমারে না ছাড়ে যেবা মহাদুঃখ পেয়ে।
উদ্ধারিয়া লই তারে মুক্তিপদ দিয়ে।।
আমার যতেক ভক্ত আছয়ে সংসারে।
ভক্তের মহিমা এই কহিনু তোমারে।।
করযোড় করি পুনঃ কহে মহেশ্বরে।
ভক্তের মহিমা কিছু দেখাবে আমারে।।
গোবিন্দ বলেন, শুন দেব মহাশয়।
ভক্তের মহিমা কিছু দেখাব তোমায়।।
ব্রাহ্মণের মূর্ত্তি তবে ধরি পঞ্চজন।
বৈকুণ্ঠ ছাড়িয়া তবে যান বৃন্দাবন।।
মায়াধারী হৈলা তাঁরা পাঁচটী ব্রাহ্মণ।
বিপ্রমূর্ত্তি ধরিয়া চলিলা পঞ্চজন।।
বৈকুণ্ঠ হইতে সবে আইল বৃন্দাবন।
মায়াধারী হইয়া আইল পঞ্চজন।।
হেনকালে বেলা হৈল তৃতীয় প্রহর।
ক্ষুধায় তৃষ্ণায় শ্রান্ত হৈল কলেবর।।
মহাদেব বলেন, শুনহ নরহরি।
শ্রান্ত বড় হইলাম, চলিতে না পারি।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, এবে শুনহ বচন।
শীঘ্রগতি চলহ নিকট বৃন্দাবন।।
তবে সে চলিলা সবে হৈয়া মহাসুখ।
কতদূরে বৃক্ষ এক দেখিল সম্মুখ।।
শ্রান্ত হৈয়া বৃক্ষতলে বসে পঞ্চজন।
আসিয়া মিলিল এক গ্রামের ব্রাহ্মণ।।
শ্রান্তযুক্ত পঞ্চজন ব্রাহ্মণ দেখিয়া।
স্তুতি করি বলে দ্বিজ অঞ্জলি করিয়া।।
বৈষ্ণব তোমরা বট হও পঞ্চজন।
শ্রান্ত হৈয়া দেখি কোথা করিছ গমন।।
কৃপায় অতিথি যদি হও মোর ঘরে।
সবংশে রাখিব মোরা মস্তক উপরে।।
ঠাকুর বলেন, বিপ্র শুনহ বচন।
শান্ত নামে মুনি এই বৈসে বৃন্দাবন।।
শান্ত মুনি মোসবারে কৈল নিমন্ত্রণ।
তার ঘরে অতিথি হইব পঞ্চজন।।
দ্বিজ বলে, শুন শুন ব্রাহ্মণ ঠাকুর।
হেন বুঝি উপবাস হবে তার ঘর।।
শান্তমুনি আছে বৃন্দাবনের বাহিরে।
ঘর দ্বার নাহি তার থাকে কুঁড়ে ঘরে।।
কুঁড়ে বান্ধি পিতাপুত্রে দুইজনে রহে।
কোন দিন ভিক্ষা মিলে, কোন দিনে নহে।।
অদ্য ভক্ষ্য নাহি তার বৃক্ষতলে রয়।
আজি উপবাস তথা থাকিবে নিশ্চয়।।
এত শুনি ব্রাহ্মণে বলিলা নারায়ণ।
অবশ্য যাইব আজি তাহার সদন।।
তবে যদি লঙ্ঘন করিব তথাকারে।
যে হউক সে হউক মোরা যাব তার ঘরে।।
এত বলি বিদায় করিল সে ব্রাহ্মণ।
তবে প্রভু শিবে চাহি বলেন বচন।।
তোমার সেবক হয় ব্রজপুর-রাজা।
নানামত প্রকারে তোমারে করে পূজা।।
আজি চল অতিথি হইব তার ঘরে।
পশ্চাতে মিলিব শান্তপন মুনিবরে।।
ব্রাহ্মণ মূরতি ধরি হয়ে পঞ্চজন।
রাজার দুয়ারে উত্তরিলা ততক্ষণ।।
বারে বারে দ্বারী বহু কহিল রাজারে।
কদাচিত ব্রজরাজ না পুছে দ্বিজেরে।।
সমস্ত দিবস গেল সন্ধ্যাকাল হৈল।
মহাক্রোধে শঙ্কর জটায় হাত দিল।।
শান্ত করাইয়া কৃষ্ণ লইয়া চলিলা।
তবে সেই মুনি গৃহে আসি উত্তরিলা।।
বৃক্ষতলে কুঁড়েতে বসিয়া মুনিবর।
একা বসি হরিনাম জপে নিরন্তর।।
হেনকালে উপনীত হৈলা পঞ্চজন।
ব্রাহ্মণ দেখিয়া কৈল চরণ বন্দন।।
শ্রান্তযুক্ত পঞ্চজন দেখিয়া ব্রাহ্মণ।
তাহা দেখি সচিন্তিত হৈলা তপোধন।।
কহিতে লাগিল পঞ্চজন বিদ্যমান।
শ্রান্তযুক্ত দেখি কোথা করিছ গমন।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, মুনি শুনহ বচন।
তোমার অতিথি মোরা হই পঞ্চজন।।
আজি যে তোমার এথা বিশ্রাম করিব।
প্রভাতে উঠিয়া মোরা চলিলা যাইব।।
এত শুনি শান্তপন অতি ব্যস্ত হৈয়া।
বসিতে আসন দিলা ত্বরিত করিয়া।।
কমণ্ডলু-জলে পদ প্রাক্ষলন কৈল।
পাদোদক লৈয়া কিছু ভক্ষণ করিল।।
মনে মনে মুনিবর চিন্তিলা শ্রীহরি।
ঘরে কিছু নাহি যে অতিথিসেবা করি।।
ভিক্ষা লৈয়া পুত্র যদি আইসে তৎকাল।
তবে সে অতিথিসেবা হইবে সফল।।
যাবত পুত্রের নাহি হৈবে আগমন।
এই সঙ্গে থাকি গিয়া কৃষ্ণ আলাপন।।
ক্ষুধা তুষ্ণা করি যেন নাহি হয় মন।
সদাই ভাবয়ে দ্বিজ পুত্রের কারণ।।
এত ভাবি বসিলেন অতিথির সঙ্গে।
কৃষ্ণাবেশে আমোদিত হইলা তরঙ্গে।।
আমোদিত হৈয়া দিবানিশি নাহি জানি।
আইল মুনির পুত্র হইল রজনী।।
আসিয়া দ্বারেতে সেই অতিথি দেখিয়া।
মুনিরে ডাকিল পুত্র ইঙ্গিত করিয়া।।
পুত্রকে দেখিয়া মুনি উঠিল সত্বর।
পুত্রের নিকটে মুনি কহেন উত্তর।।
মুনি বলে, কি আনিলে কহত আমারে।
ব্রাহ্মণ অতিথি পঞ্চজন মোর ঘরে।।
এত শুনি মুনি-পুত্র সচিন্তিত হই।
আছুক ভিক্ষার কাজ জল নাহি পাই।।
না জানি আমারে আজি বিধি বিড়ম্বিল।
বৃন্দাবন বেড়াইয়া ভিক্ষা না মিলিল।।
এত শুনি শান্তপন নিশ্বাস ছাড়িল।
এত দিনে মোর বুঝি সর্ব্বনাশ হৈল।।
হেন কিছু নাহি দ্রব্য হাতে করি লৈবা।
বাঞ্ছা হৈল আজি করি অতিথির সেবা।।
ব্রাহ্মণ অতিথি যদি লঙ্ঘন-থাকিবে।
যত ধর্ম্ম পুণ্য মোর সব নষ্ট হৈবে।।
ব্রাহ্মণ বৈষ্ণব যদি থাকে উপবাসী।
জন্মে জন্মে বাড়ে পাপ বড় ভয় বাসি।।
কি করিব কোথা যাব কি হবে উপায়।
কিমতে আমার ধর্ম্ম আজি রক্ষা পায়।।
শুনিয়া মুনির পুত্র বলে, শুন মুনি।
অল্প পাপে বহু পুণ্য হয় হেন জানি।।
এমত যুকতি মোরে করিতে যুয়ায়।
কি কর্ম্ম করিব এবে কহ মহাশয়।।
পুনঃ বলে, বৈষ্ণব যদি থাকয়ে লঙ্ঘনে।
হইবে অধিক পাপ না যায় খণ্ডনে।।
অল্প পাপ করিয়া বিস্তর পাপে তরি।
অতিথি লাগিয়া চল করি গিয়া চুরি।।
মুনি বলে, চুরি করি আনিব যাহার।
ব্রাহ্মণ বৈষ্ণবে খাবে এ ধর্ম্ম তাহার।।
পুত্র বলে, অতিথি লঙ্ঘনে রবে ঘরে।
অল্প পাপে বহু পাপ হইবে তোমারে।।
মুনি বলে, শুন পুত্র আমি শান্ত মুনি।
বৃন্দাবনে থাকি আমি সর্ব্বলোকে জানি।।
অতিথি লাগিয়া যদি চুরি করি আনি।
সেই কথা লোকে যদি হয় জানাজানি।।
সত্য মিথ্যা না জানিবে ঘুষিবে সংসার।
সকল মহিমা নষ্ট হইবে আমার।।
এত শুনি মুনিপুত্র বলে বুঝাইয়া।
আনি দিব বহু দ্রব্য হাতেতে করিয়া।।
সিন্দ কাটি প্রবেশ করিব আমি ঘরে।
খড়্গ লৈয়া থাক তুমি সিন্দের দুয়ারে।।
মুনি ত পুত্রের কথা ভাবে মনে মনে।
পুত্র নষ্ট হইবেক অতিথি কারণে।।
মুনিপুত্র বলে, পিতা কিছু না ভাবিবে।
ধর্ম্মরক্ষা হেতু লোক এমত করিবে।।
মুণ্ড কাটি লৈয়া তুমি করিবে গমন।
স্কন্ধ দেখি চিনিতে নারিবে কোন জনে।।
মুনি বলে, হেন কর্ম্ম করিব কেমনে।
শুন পিতা পুত্র জন্ম কিসের কারণে।।
পিতামাতার ধর্ম্ম রক্ষা করে যেই জন।
সংসারে এসব জনে সাধুর গণন।।
এখন তোমার যদি ধর্ম্ম নষ্ট হয়।
আমি পুত্র থাকি তবে কি করি উপায়।।
পুত্র হৈয়া মাতা-পিতার ধর্ম্ম রক্ষা করে।
পুত্রধর্ম্ম সুবিখ্যাত আছয়ে সংসারে।।
চল শীঘ্র তথাকারে দ্রব্য লয়ে আসি।
অতিথি সেবিব আজি থাকি উপবাসী।।
চুরি ত করিয়া যদি আপনারা খাই।
তবে সে অধর্ম্ম হয় জানি সর্ব্বদাই।।
নহে ত অতিথিসেবা করিব লঙ্ঘন।
সর্ব্ব ধর্ম্ম নষ্ট হবে নরকে গমন।।
এতেক শুনিয়া মুনি পুত্রের বচন।
চুরি করিবারে গেলেন শ্রীবৃন্দাবন।।
দ্বিতীয় প্রহর যবে অন্ধকার রাতি।
বৃন্দাবনবাসী যত হইল নিশুতি।।
সিন্দ কাটি মুনিপুত্র প্রবেশিল ঘরে।
খড়্গ হাতে মুনি রহে সিন্দের দুয়ারে।।
যে চাহি অতিথি হেতু সামগ্রী লইয়া।
শান্ত ‍মুনি তবে সব আনি দিল লৈয়া।।
মুনি-পুত্র বলে, তাত বলিয়ে তোমারে।
সামগ্রী লইয়া সব যাইতে সত্বরে।।
তবে শান্ত মুনি সেই সামগ্রী লইয়া।
শীঘ্র করি আইলেক কুঁড়েতে রাখিয়া।।
মুনি-পুত্র বলে, পিতা নিশি হৈল শেষ।
তাম্বূল লাগিয়া তবে করিব প্রবেশ।।
তাম্বূল চাহিয়া ফিরে ঘরের ভিতরে।
শীঘ্র যাইতে মুনি পুত্র আছাড়িয়া পড়ে।।
হুড় হুড় দুড় দুড় শব্দ করে ঘরে।
কি কি করি গৃহস্থেরা উঠিল সত্বরে।।
মুনি-পুত্র মুণ্ড দিল সিন্দের দুয়ারে।
শীঘ্রতর আসি মুনি খড়্গ নিল করে।।
মুণ্ডকাটিতে মুনি না হইল ব্যথা।
স্বহস্তে কাটিয়া নিল নিজ পুত্র মাথা।।
মুণ্ড লয়ে মুনিবর মুণ্ড রাখে লুকাইয়া।
কুঁড়ের ভিতরে মুণ্ড রাখে লুকাইয়া।।
স্কন্ধ আছে মুণ্ড নাহি ইহার কারণ।
ডাকাতি হইল বলি হইল ঘোষণ।।
রাজভয়ে স্কন্ধ লয়ে রাখে গিয়া জলে।
হেথায় সামগ্রী লৈয়া মুনি কুতূহলে।।
দিলেন হরির হাতে সামগ্রী লইয়া।
রন্ধন করিলা হরি আনন্দিত হৈয়া।।
রন্ধন করিয়া তবে দেব জগন্নাথ।
আপনি করিলা হরি তবে সাত পাত।।
ব্রাহ্মণের তরে তবে বলে নারায়ণ।
পুত্রসহ আইস বিপ্র করিতে ভোজন।।
পশ্চাতে খাইব, বিপ্র বলেন বচন।
অগ্রেতে তোমরা সবে করহ ভোজন।।
কৃষ্ণ বলে, দেখ শিব ব্রাক্ষণের তরে।
পুত্র কাটি বিপ্র অতিথিসেবা করে।।
রজনী প্রভাত হৈল অরুণ উদয়।
অতিথি উঠিয়া বসে পঞ্চ মহাশয়।।
জলতীরে গিয়া তবে প্রাতঃক্রিয়া কৈল।
শান্তপন মুনি ঘরে আসিয়া বসিল।।
মুনিকে কহিলা তবে দেব গদাধর।
কোথা গেল তব পুত্র ডাকহ সত্বর।।
মুনি বলে, তোমরা করহ আগমন।
ডাকিলে না পাব আমি তার অন্বেষণ।।
নারায়ণ বলে, মুনি শুনহ বচন।
তাহার অপেক্ষা করি আছি পঞ্চজন।।
সে যদি আসিয়া মোরে বিদায় করিব।
তবে অন্য স্থানে মোরা আজি সে যাইব।।
এতেক শুনিয়া মুনি করে নিবেদন।
না থাকিবা, কোন স্থানে করহ গমন।।
এতেক জঞ্জাল তবে কোন্ প্রয়োজন।
বিদায় হইয়া পঞ্চ করহ গমন।।
মহাদেব বলে, কৃষ্ণ করি নিবেদন।
মুনিকে লইয়া সঙ্গে চল নারায়ণ।।
তবে শান্ত মুনি সঙ্গে গেলা ততক্ষণ।
একত্র হইয়া যান ছয়টি ব্রাহ্মণ।।
কৃষ্ণ সঙ্গে যায় মুনি হরি হরি বলে।
ধীরে ধীরে যান বিপ্র যমুনার কূলে।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, বিপ্র শুনহ বচন।
এই স্থানে কর সবে আহ্নিক তর্পণ।।
এত বলি নামিলেন সেই নদীজলে।
মৃতস্কন্ধ আসি লাগে মুনিবর-কোলে।।
শান্তমুনি ত্রাসযুক্ত স্কন্ধকে দেখিয়া।
পুনরপি স্নান করে স্থানান্তরে গিয়া।।
প্রভু বলে মুনিবর কি দেখিলে জলে।
মুনি বলে, মৃতস্কন্ধ লাগে মোর কোলে।।
প্রভু বলে, মুনিবর শুনহ বচন।
চিনিতে না পার তুমি মৃত কোন জন।।
মুনি বলে মৃতস্কন্ধ চিনিব কিমতে।
কত মৃতস্কন্ধ ভাসে নদীর জলেতে।।
এতেক শুনিয়া কৃষ্ণ মুনির উত্তর।
আপনি তুলিলা স্কন্ধ হাতের উপর।।
কৃষ্ণ বলে, শুন মুনি কহি যে তোমারে।
যেই মুণ্ড রাখিয়াছ কুঁড়ের ভিতরে।।
সেই মুণ্ড শীঘ্র তুমি আন মুনিবর।
স্কন্ধে মুণ্ড জীয়াইব তোমার কোঙর।।
এত শুনি মুনিবর বিস্ময় হইল।
শীঘ্রগতি মুনিবর কুঁড়ে ঘরে গেল ।।
পিপীলিকা কৃমি মাংস কৈল খানি খানি।
হাত দিয়া শীঘ্র চালাইল শান্তমুনি।।
ঢাকিয়া লইয়া মুণ্ড শান্ত মুনিবর।
শীঘ্রগতি লৈয়া দিল কৃষ্ণের গোচর।।
স্কন্ধে মুণ্ড একত্র করিয়া গদাধর।
পদ্মহস্ত দিলা হরি তাহার উপর।।
মুনিপুত্র বাঁচিয়া উঠিল ততক্ষণ।
তবে কৃপা কৈল প্রভু দেব নারায়ণ।।
শিব ব্রহ্মা শুকদেব নারদ মুনিবর।
বুঝিয়া প্রভুর কর্ম্ম করিলা উত্তর।।
উৎপত্তি প্রলয় স্থিতি তুমি সে কারণ।
জয় জয় শব্দ হৈল এ তিন ভুবন।।
মুনিপুত্র জিয়াইল দেখি বিদ্যমান।
ভক্তের মহিমা কৈলা দেব ভগবান।।
এইকালে হরি কিছু বলেন শিবেরে।
ভক্তের মহিমা এই দেখহ সংসারে।।
এতেক আমার নামে খায় ভিক্ষা করি।
পুত্রমুণ্ড কাটিয়া অতিথি সেবা করি।।
যে জন অতিথি সেবে একান্ত হইয়া।
উদ্ধারিয়া লই তারে মুক্তিপদ দিয়া।।
আমার নামেতে যুক্ত হয় যেই জন।
যমদণ্ড কখন না পায় সেই জন।।
অতিথি বৈষ্ণব গুরু কিছু ভেদ নাই।
ভজিলে সুস্থির হৈয়া দুর্গতি এড়ায়।।
এত বলি নিজ মূর্ত্তি হৈলা পঞ্চজন।
শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম কিরীট ভূষণ।।
পিতা-পুত্রে শান্ত মুনি দরশন পাইয়া।
স্তবন করয়ে দুঁহে একান্ত হইয়া।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, মুনি শীঘ্র যাহ ঘরে।
পুত্রভাবে কৃপা আমি করিব তোমারে।।
করহ অতিথিসেবা দিয়া নানা ধন।
বাড়িবে তোমার যশ থাক বৃন্দাবন।।
কতদিন কর গিয়া অতিথি-সেবন।
তবেত বৈকুণ্ঠপুরে করিবে গমন।।
একেত প্রভুর আজ্ঞা পাইয়া দুজনে।
কান্দিয়া পড়িল পঞ্চজনের চরণে।।
আলিঙ্গন দিয়া বহু আশিস্ করিলা।
আশ্বাস করিয়া সবে ঘরে পাঠাইলা।।
মুনিকে বিদায় করি প্রভু ভগবান।
ব্রহ্মা শিব গেলা তবে আপনার স্থান।।
লক্ষ্মীর সহিত হরি বসি সিংহাসনে।
শুকদেব নারদ রহিলা বিদ্যমানে।।
হেথা শান্তমুনি গেলা কুঁড়ের নিকটে।
কুঁড়ে না দেখিয়া মুনি ভাবিল সঙ্কটে।।
চৌদিকে বেড়ান মুনি কুঁড়ে নাহি পান।
কুঁড়ে ভাঙ্গি অট্টালিকা হয়েছে নির্ম্মাণ।।
মুনিপুত্র বলে, পিতা শুনহ বচন।
যেই কথা কহিলেন প্রভু জনার্দ্দন।।
নির্ম্মাণ করিলা গোঁসাই এই সব পুরে।
অতিথির সেবা তুমি করহ সত্বরে।।
পুত্রের বচনে মুনি পুরী প্রবেশিল।
নানারত্ন মণি মুক্তা নয়নে দেখিল।।
বস্ত্র অলঙ্কার সব আছে রাশি রাশি।
অতিথিসেবার দ্রব্য সব পায় বসি।।
নানা রত্ন পায় ঘরে নাহি তার সীমা।
এই ত জানহ ভক্তজনের মহিমা।।
আনন্দিত হৈল তবে ব্রাহ্মণ-ব্রাক্ষণী।
নানা পুষ্প তুলসীতে পূজে চক্রপাণি।।
হরিভক্ত হৈলে তার কত হয় লাভ।
হরিকথা শুন সবে কৃষ্ণে কর ভাব।।
হরির চরণ বিনে গতি নাহি আর।
হেন হরি বশ কর সংসারের সার।।
হেন হরি ক্ষত্তা-গৃহে খুদ-কণা খায়।
দুর্য্যোধন রাজা পানে ফিরিয়া না চায়।।
তোমারে বলি যে আমি শুনহ বিদুর।
তব বশ হৈল সেই ত্রিদশ-ঠাকুর।।
তোমার সমান আর ভাগ্য আছে কার।
পাইলে বিদুর তুমি সংসারের সার।।
যুধিষ্ঠিরে বিদুর তুমি করেছে আপনি।
মিথ্যা শোকে অসন্তোষ আছে নৃপমণি।।
কহ তুমি নৃপতিরে যোগের বচন।
বৃথা শোক করে যার সখা নারায়ণ।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাহার শকতি ইহা করে পরিমাণ।।
ইহার বিস্তার কহে নাহি হেন জন।
করিলা সুধন্য সত্যবতীর নন্দন।।
বিস্তারিতে ক্ষম ইথে নাহি অন্য জন।
কহিতে না পারে কেহ বাহুল্য কারণ।।
মহাভারতের কথা কহিলেন ব্যাস।
অন্যের শকতি নাহি করিতে প্রকাশ।।
মস্তকে বন্দিয়া দ্বিজগণ-পদরজ।
কহে কাশীদাস গদাধর-দাসাগ্রজ।।
 

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র