১৩৭. যাদবগণের অর্জ্জুনের পশ্চাদ্ধাবন গদ শাম্ব চারুদেষ্ণ সাত্যকি সারণ। চালাইয়া দিল রথ পবন-গমন।। না পলাও, শুন পার্থ ডাকে যদুগণ। শুনিয়া দারুক প্রতি বলয়ে অর্জ্জুন।। ফিরাও দারুক রথ ডাকে ক্ষত্রগণে। না দিয়া প্রবোধ তারে যাইব কেমনে।। দারুক বলিল, পার্থ কহ কি অদ্ভুত। গোবিন্দ অধিক দেখি গোবিন্দের সুত।। অপ্রমিত পরাক্রম ত্রৈলোক্যে অজেয়। দেখ পাছে আসে যেন সমুদ্র-প্রলয়।। ইহা সব সহ যুদ্ধ না হয় উচিত। সময় বুঝিয়া যুঝি আছে ক্ষত্রনীত।। এ কর্ম্মে আমার শক্তি নহে কদাচন। পলাইতে যথা চাহ বলহ এক্ষণ।। যথা আজ্ঞা কর রথ লইব সত্বর। ইন্দ্রপ্রস্থে লইব কিম্বা ইন্দ্রের নগর।। কুবের বরুণ যম ইন্দ্রের সদনে। যথায় কহিবা, রথ লইব এক্ষণে।। কেবল না পারি আমি রথ ফিরাইতে। কিমতে করাব যুদ্ধ যাদব সহিতে।। কৃষ্ণপুত্রে প্রহারিবে চড়ি এই রথে। মম শক্তি নহিবে তুরগ চালাইতে।। পার্থ বলে, দারুক এ নহে ব্যবহার। যুদ্ধ হেতু ডাকে বীর পশ্চাতে আমার।। নহে ক্ষত্রধর্ম্ম আমি যাইব ছাড়িয়া। বিশেষ আমার পাছে আইল তাড়িয়া।। হেন অপযশ মম ঘুষিবে ভুবেনে। শৃগালের প্রায় যাব কি কাজ জীবনে।। কৃষ্ণপুত্র অথবা আপনি কৃষ্ণ আইসে। কিম্বা যুধিষ্ঠির ভীম সমরে প্রবেশে।। যুদ্ধ হেতু মোরে যে ডাকিবে ক্ষত্র হৈয়া। যেই হৌক সংগ্রাম করিব বাহুড়িয়া।। নিশ্চয় জানিনু তুমি যদু-কুলহিত। নারিবে সারথি-কর্ম্ম করিতে উচিত।। অবিশ্বাস তোমাতে বিশেষে রণস্থলী। ফেলাহ প্রবোধবাড়ি ছাড় কড়িয়ালী।। চালাইব রথ আমি করিব সমর। এত বলি বাড়ি কড়িয়ালি নিল কর।। পাশ-অস্ত্রে দারুকেরে রাখিয়া বন্ধনে। বান্ধিলেন রথস্তম্ভে আপন দক্ষিণে।। এক পদে কড়িয়ালি আর পদে বাড়ি। ধনুর্গুণ টঙ্কারি রহিলেন বাহুড়ি।। ভদ্রা বলে, মহাবীর এত কষ্ট কেনে। আজ্ঞা কর আমারে চালাই অশ্বগণে।। এই রথে সত্যভামা রুক্মিণীর সঙ্গে। তিনপুর ভ্রমণ করিনু কত রঙ্গে।। স্নেহে মোরে সত্যভামা সঙ্গে করি লয়। সারথি হইয়া আমি চালাতাম হয়।। আমার নৈপুণ্য দেখি দেব দামোদর। ধন্য ধন্য বলি প্রশংসিলা বহুতর।। আজ্ঞা কর, রথ চালাইব কোন্ পথে। এত বলি কড়িযালি বাড়ি নিল হাতে।। চালাইয়া দিল রথ বায়ুবেগে চলে। না দেখিতে গেল রথ আদিত্যমণ্ডলে।। তথা হৈতে চালাইয়া দিল হয়বর। রথের চঞ্চল গতি অতি মনোহর।। বিদ্যুৎবরণী ভদ্রা পার্থ জলধর। বিদ্যুতের প্রায় পশে মেঘের ভিতর।। দৃষ্টিমাত্রে যতেক যাদব বীরগণ। মূর্চ্ছা হৈয়া রথেতে পড়িল সর্ব্বজন।। অনেক মারেন সেনা পার্থ ধনুর্দ্ধর। কোটি কোটি রথী পড়ে, অসংখ্য কুঞ্জর।। রক্তে নদী বহে, সব রক্তেতে সাঁতারে। কাল-রূপ দেখি পার্থে ভঙ্গ দিল ডরে।। কামদেব সারণ বিচারি মনে মন। রামের নিকটে দূত করিল প্রেরণ।। অমৃত-সমান মহাভারতের কথা। শ্রবণে পঠনে ঘুচে পাপ তাপ ব্যথা।। ১৩৮. বলরামের নিকট অর্জ্জুনের রণজয় সংবাদ সসৈন্যে বাহির হইলেন বলরাম। হেনকালে দূত আসি করিল প্রণাম।। ঊর্দ্ধশ্বাসে কহে বার্ত্তা কান্দিতে কান্দিতে। আর রক্ষা নাহি প্রভু অর্জ্জুনের হাতে।। সুভদ্রা চালায় রথ না পাই দেখিতে। কখন আকাশে উঠে, কখন ভূমিতে।। কখন লুকায় মেঘে, ক্ষণে শূন্য মাঝে। নর্ত্তক খঞ্জন প্রায় ঘন ফেরে তেজে।। দক্ষিণ বামেতে রথ বায়ুবেগে ছুটে। ক্ষণে ক্ষণে থাকি সূর্য্যমণ্ডলেতে উঠে।। যুদ্ধ করে পার্থ সব সৈন্যের সম্মুখে। কোন্ ঠাঁই থাকে, তাঁকে কেহ নাহি দেখে।। নানা বর্ণে ধনঞ্জয় অস্ত্রগণ ফেলে। অগ্নি-অস্ত্রে কোথায় পোড়ায় দাবানলে।। কোনখানে বায়ুতে ফেলায় সৈন্যগণ। কোথাও ভুজঙ্গ অস্ত্র করে বরিষণ।। কোনখানে জলবৃষ্টি, শীতে কাঁপে তনু। কোনাখানে শরজালে না দেখি যে ভানু।। সেই সে সবারে মারে, কেহ তারে নারে। যতেক মারিল সৈন্য কে কহিতে পারে।। তার যুদ্ধ দেখিয়া হইল চমৎকার। বার্ত্তা দিতে পাঠাইল যতেক কুমার।। মুষলী বলেন, দূত কহ সত্যকথা। এমত তুরগ রথ পাইল সে কোথা।। দূত বলে, যাদবেন্দ্র কহিবারে ভয়। গোবিন্দের রথোপরে সুগ্রীবাদি হয়।। সারথি দারুক বান্ধা আছে বসি রথে। সুভদ্রা চালায় রথ দেখিনু সাক্ষাতে।। দূতমুখে বলভদ্র শুনি এত কথা। ভূমিতলে বসিলেন হেঁট করি মাথা।। ক্রোধেতে সর্ব্বাঙ্গে পড়য়ে কালঘাম। যদুগণে চাহিয়া বলেন বলরাম।। গোবিন্দ যে করয়ে আমার অপমান। আপন সারথি দিল অশ্ববয় যান।। অর্জ্জুনের কি শক্তি যে হেন কর্ম্ম করে। না বুঝিয়া দোষী আমি করি অর্জ্জুনেরে।। আমার সম্মুখে কহে কপট বচন। কোন্ লাজে লোকে আমি দেখাব বদন।। দুর্য্যোধনে ডাকাইনু বিবাহ কারণ। অধিবাস হেতু বসিয়াছে দ্বিজগণ।। এত বলি অধোমুখে বসিলেন রাম। হেনকালে আইলেন নবঘনশ্যাম।। ভূমে পড়ি বলদেবে করেন প্রণাম। ক্রোদে না চাহেন নারায়ণে বলরাম।। গোবিন্দ বলেন, কেন ক্রোধ কর স্বামী। তব পদে কোন অপরাধ করি আমি।। উগ্রসেন বলে তুমি করিলা কুকর্ম্ম। ভদ্রা নিতে পার্থে বল, নহে এই ধর্ম্ম।। নিজ রথ তুরঙ্গ সারথি দিলা তারে। তোমারে না দিয়া দোষ দিব আর কারে।। গোবিন্দ বলেন, ইহা জানে সর্ব্বজন। সেই রথে চাড়ি পার্থ ভ্রমে অনুক্ষণ।। কিমতে জানিব সে সুভদ্রা লবে হরি। নর-মায়া বুঝিবারে নাহি আমি পারি।। ইথে অকারণে প্রভু আমারে আক্রোশ। ভদ্রা যদি বাহে রথ, দারুকে কি দোষ।। কহ সত্য পুনঃ দূত দারুকের কথা। কিরূপে দারুক আছে অর্জ্জুনের সেথা।। দূত বলে, দারুক আপন বশে নাই। বন্ধন করিয়া তারে রাখিল গোঁসাই।। শ্রীকৃষ্ণ বলেন, শুন যতেক যাদব। এই কথা বুঝহ করিয়া অনুভব।। আদিপর্ব্ব ভারত বিচিত্র উপাখ্যান। কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।। ১৩৯. বলরামের সহিত শ্রীকৃষ্ণের কথোপকথন পুনরপতি কহে দূত করি যোড়হাত। কি কারণে নিঃশব্দে রহিলা যদুনাথ।। আজ্ঞা দেহ, আমি এবে করিব কি কাজ। বার্ত্তা হেতু পাঠাইল কুমার-সমাজ।। কামদেব মহাবীর যাদব-প্রধান। তিন লোক মধ্যে যার অব্যর্থ সন্ধান।। তিল তিল গেল কাটা শর ধনুর্গুণ। এক গুটি নাহি অস্ত্র শূন্য হৈল তূণ।। শাম্ব গদ সারণ যতেক বীর আর। যাদবে অক্ষত তনু নাহিক কাহার।। কাহার নাহিক ধ্বজ, কাহার সারথি। কাহার নাহিক রথ, নাহিক পদাতি।। কাহার নাহিক অস্ত্র, কারো ধনুর্গুণ। সবারে করিল জয় একাকী অর্জ্জুন।। পাঠাইয়া দেহ অস্ত্র রথ অশ্ব আর। আপনি চলহ কিম্বা দৈবকী-কুমার।। মোর বাক্য শুন প্রভু দেখিনু স্বচক্ষে। নারিবে অর্জ্জুনেরে কুমারগণ পক্ষে।। স্নেহেতে অর্জ্জুন নাহি মারে শিশুগণে। সেই হেতু এতক্ষণ জীয়ে সর্ব্বজনে।। গোবিন্দ বলেন, আমি জানি অর্জ্জুনেরে। যুদ্ধে তারে জিনে হেন না দেখি সংসারে।। ইন্দ্র যম কুবের বরুণ পঞ্চানন। অর্জ্জুনে জিনিবে হেন নাহি কোন জন।। কি করিবে তাহারে এ সব শিশুগণে। যা কহিলা সত্য, পার্থ নাহি মারে প্রাণে।। তাহার সহিত দ্বন্দ্ব না হয় উচিত। অর্জ্জুন ত নাহি কিছু করে অবিহিত।। ক্ষত্রিয়ের ধর্ম্ম আছে শাস্ত্রের গোচরে। বলেতে বিবাহ করে প্রশংসা তাহারে।। তাই কহি কিবা দোষ কৈল ধনঞ্জয়। আপন ভগিনী কর্ম্ম দেখ মহাশয়।। অর্জ্জুনে তাহার যদি নাহি ছিল মন। তবে কেন তার অশ্ব চালায় এক্ষণ।। না জানে কি ধনঞ্জয় তোমার মহিমা। এক্ষণে ভাঙ্গিতে পার তাহার গরিমা।। কিন্তু পার্থে জীয়ন্তে না ধরিতে পারিবা। অনেক করিলে শক্তি প্রাণেতে মারিবা।। সুভদ্রা না জীবে তবে, ত্যজিবে জীবন। কহ দেব ইথে হৈবে কি কর্ম্ম সাধন।। এক্ষণে আমার এই মত মহাশয়। সবাকার মত যদি তব আজ্ঞা হয়।। প্রিয়ম্বদ একজন যাক আপনার। প্রিয়বাক্যে ফিরাউক কুন্তীর কুমার।। এক্ষণে আনিয়া তারে করাহ বিবাহ। সংপ্রীতে সুভদ্রা তুমি তারে সমর্পহ।। সকল মঙ্গল হৈবে, লোকেতে সম্মান। মম চিত্তে ইহা বিনা নাহি লয় আন।। কৃষ্ণের এতেক বাক্য শুনি হলধর। ক্রোধ সম্বরিয়া তবে করিলা উত্তর।। আমারে কি আর জিজ্ঞাসহ অকারণ। করহ আপনি, তব যাহা লয় মন।। যাহা চিত্তে করিয়াছ তাহাই হইবে। তুমি যে কহিবা তাহা অন্য কে করিবে।। আপনি সাত্যকি তুমি করহ গমন। আনহ অর্জ্জুনে কহি মধুর বচন।। এত বলি সাত্যকিরে পাঠাইয়া দিল। ততক্ষণে রথে চড়ি সাত্যকি চলিল।। আদিপর্ব্বে ভারত বিচিত্র উপাখ্যান। কাশীদাস কহে, সাধু সদা করে পান।। ১৪০. অভিমানে দুর্য্যোধনের স্বদেশ যাত্রা ও অর্জ্জুনের সহিত সুভদ্রার বিবাহ তবে রাজা দুর্য্যোধন সর্ব্ব সৈন্য লৈয়া। যাদব-সৈন্যের মধ্যে উত্তরিল গিয়া।। শুনিল নিলেন পার্থ সুভদ্রা হরিয়া। মহাক্রোধে দুর্য্যোধন উঠিল গর্জ্জিয়া।। হে কৃপ, হে পিতামহ আচার্য্য বিদুর। সাক্ষাতে দেখহ কর্ম্ম তনয় পাণ্ডুর।। যে কন্যা নিমিত্ত রাম আনিলেন মোরে। দেখহ দুষ্টের কর্ম্ম হরিল তাহারে।। মোর দোষাদোষ সব জ্ঞাত হৈলা সবে। এক্ষণে মারিব, দেখ কে রাখে পাণ্ডবে।। কর্ণ বলে, মহারাজ বসি দেখ তুমি। আজ্ঞা দিলে অর্জ্জুনে বান্ধিয়া আনি আমি।। শুনি আজ্ঞা দিল তারে গান্ধারী-নন্দন। শীঘ্র ধায় কর্ণ বীর লোহিত-লোচন।। বৃকোদর বলে, কোথা যাস্ সূতসুত। অর্জ্জুনে ধরিতে যাস্ বড়ই অদ্ভুত।। সুরাসুর যক্ষ যারে না পারে সমরে। তাহারে ধরিতে যাস্, লজ্জা নাহি করে।। আরে মুখ দুরাচার এত অহঙ্কার। এমত প্রতিজ্ঞা কর অগ্রেতে আমার।। মম হস্তে রহে যদি তোমার জীবন। তবে পার্থ সহ তুমি কর গিয়া রণ।। এত বলি লাফ দিয়া পড়িল ধরণী। গদা ফিরাইয়া যান যেন চক্রপাণি।। বিদুর বলিল, তাত শুন দুর্য্যোধন। পার্থ সহ দ্বন্দ্বে কি তোমার প্রয়োজন।। বরণ করিয়া তোমা আনিল যে জন। তাঁর ঠাঁই আগে গিয়া জিজ্ঞাস কারণ।। সে যেমন কহিবে, করিবে সেই রীত। পার্থ সহ কলহ তোমার অনুচিত।। ভীষ্ম দ্রোণ বলিলেন এই সুবিচার। যে আনিল, তাঁর ঠাঁই জান একবার।। অনেক করিয়া দ্বন্দ্ব করিল বারণ। দ্বারাবতী চলিল নৃপতি দুর্য্যোধন।। হেনকালে উপনীত হইল সাত্যকি। মধুর কোমল ভাষে পার্থে বলে ডাকি।। ক্রোধ ত্যজ ধনঞ্জয়, কি হেতু আক্রোশ। না জানিয়া শিশু সব করিয়াছে দোষ।। তোমার সহিত দ্বন্দ্ব কৈল না জানিয়া। রাম কৃষ্ণ মন্দ বলিলেন তা শুনিয়া।। এ কারণে শীঘ্রগতি পাঠালেন মোরে। প্রবোধিয়া তোমারে বাহুড়ি লইবারে।। একত্র বসিয়া যত বৃঞ্চি-ভোজগণ। সুভদ্রাকে তোমারে করিবে সমর্পণ।। সাত্যকির এতেক বিনয় বাক্য শুনি। ত্যজিয়া সংগ্রাম শান্ত হৈলেন ফাল্গুনি।। দুর্য্যোধন শুনি অভিমানেতে রহিল। সসৈন্যে আপন দেশে বাহুড়ি চলিল।। তবে পার্থ দারুকে করিয়া কৃতাঞ্জলি। সবিনয়ে কহিতে লাগিল মহাবলী।। যথা কৃষ্ণ তথা তুমি ইথে নাহি আন। করিলাম অপরাধ, ক্ষম মতিমান।। দারুক কহিল, পার্থ কৈল বড় কর্ম্ম। বন্ধন এ নহে মম, রক্ষা কৈলে ধর্ম্ম।। তুমি যদি আমারে না করিতে বন্ধন। কোন্ লাজে দেখাতাম রামেরে বদন।। এই মত লহ মোরে সাক্ষাতে তাঁহার। নহিলে রামের ক্রোধ হইবে অপার।। অর্জ্জুন বলেন, ইহা না হয় উচিত। তোমার বন্ধনে কৃষ্ণ হবেন কুপিত।। চিত্তে করিবেন রাম কপট বন্ধন। এত বলি মুক্ত করি দিলেন তখন।। তবে যত যদুগণ সন্তুষ্ট হইয়া। লইল অর্জ্জুন বীরে আদর করিয়া।। ভীষ্ম দ্রোণ কৃপাচার্য্য বিদুর সুমতি। ভূরিশ্রবা সোমদত্ত বাহ্লীক প্রভৃতি।। সর্ব্ব সৈন্য লৈয়া ভীম অর্জ্জুনের আগে। পশ্চাৎ যাদব কাম আদি বীরভাগে।। আগুসারি লইলেন দেব নারায়ণ। হুলাহুলি দিল যত যদুনারীগণ।। রত্নময় আসনে দোঁহারে বসাইয়া। বেদ-অনুসারে তবে করাইল বিয়া।। বসুদেব করিলেন ভদ্রা সম্প্রদান। যতেক যৌতুক দিল নাহি পরিমাণ।। ভারতের পুণ্যকথা শুনে পুণ্যবান। পৃথিবীতে নাহি সুখ ইহার সমান।। ১৪১. খাণ্ডব-বন দাহন তবে কত দিনান্তরে পার্থ নারায়ণ। গ্রীষ্মকালে যান দোঁহে ক্রীড়ার কারণ।। যমুনার জলে গিয়া করেন বিহার। রুক্মিণী সুভদ্রা সঙ্গে বহু পরিবার।। যমুনার কূলে করি উত্তম আলয়। ভক্ষ্য ভোজ্য আনিলেন বহু দ্রব্যচয়।। ক্রীড়ান্তেতে দুই জন বসিল আসনে। হেনকালে বিপ্রবেশে আইল হুতাশনে।। মাথায় ত্রিজটা শোভে পিঙ্গল নয়ন। উত্তপ্ত কাঞ্চন জিনি অঙ্গের বরণ।। কৃষ্ণার্জ্জুন অগ্রে দাঁড়াইল হুতাশন। দোঁহার আশিস্ করি বলয়ে বচন।। যদুকুলশ্রেষ্ঠ আর কুরুকুলসার। ত্রিভুবনে নাহি দেখি সমান দোঁহার।। এই হেতু আসিয়াছি দরিদ্র ব্রাহ্মণ। দুইজন মিলি মোরে করাহ ভোজন।। হাসিয়া কহেন পার্থ, কহ বিচক্ষণ। কোন ভক্ষ্য দিলে তৃপ্ত হইবা এক্ষণ।। ভক্ষ্য হেতু এত চাটু বল কি কারণ। যে কিছু মাগহ ভক্ষ্য দিব এইক্ষণ।। আশ্বাস পাইয়া বলে অগ্নি মহাশয়। আমি অগ্নি, বলি দিল নিজ পরিচয়।। ব্যাধিযুক্ত বহুকাল আমার শরীর। নির্ব্যাধি করহ মোরে পার্থ মহাবীর।। খাণ্ডব বনেতে বহু জীবের আলয়। সেই বন ভক্ষ্য মোরে দেহ ধনঞ্জয়।। সুরাসুর যক্ষ রক্ষ পশু পক্ষিগণ। যতেক আছয়ে তাহে, করাহ ভোজন।। এত শুনি জিজ্ঞাসিল রাজা জন্মেজয়। কহ মুনিরাজ, মম খন্ডাহ বিস্ময়।। কি হেতু হইল ব্যাধিযুক্ত হুতাশন। কিসের কারণে চাহে খাণ্ডব দাহন।। মুনি বলে, শুন নৃপ পূর্ব্বের কাহিনী। সত্যযুগে আছিল শ্বেতকী নৃপমণি।। যজ্ঞ বিনা অন্য কর্ম্ম না জানে কখন। নিরন্তর যজ্ঞ করে লেইয়া ব্রাহ্মণ।। বহুকাল যজ্ঞ রাজা করে হেনমত। সহিতে না পারে কষ্ট দ্বিজগণ যত।। যজ্ঞ ত্যজি দ্বিজগণ করিল গমন। বিনয় করিয়া রাজা বলিল বচন।। পতিত নহি যে আমি, নহি কোন দোষী। কোন হেতু মম যজ্ঞ না করহ ঋষি।। দ্বিজগণ বলে, ভূপ না দূষি তোমারে। শক্তি নাহি মো সবার যজ্ঞ করিবারে।। অপ্রমিত যজ্ঞ তব, নাহি হয় শেষ। সহিতে না পারি আর অগ্নিতাপ ক্লেশ।। নয়ন নিরক্ত হৈল লোমহীন অঙ্গ। শরীর নির্জীব হৈল, সদা অগ্নিসঙ্গ।। দ্বিজগণ-বচন শুনিয়া নরপতি। করিল অনেক বিধ সবিনয় স্তুতি।। দ্বিজগণ বলে, রাজা বল অকারণ। তব যজ্ঞ করে, হেন না দেখি ব্রাহ্মণ।। ত্রিদশ ঈশ্বর শিবে সেবহ রাজন। তাঁহা বিনা যজ্ঞ করে নাহি অন্য জন।। দ্বিজগণ-বাক্যে রাজা তপ আরম্ভিল। অনেক কঠোর করি মহেশে সেবিল।। শিব তুষ্ঠ হইয়া বলেন, মাগ বর। রাজা বলে, কৃপা যদি কৈলা মহেশ্বর।। মম যজ্ঞ করে হেন নাহিক ব্রাহ্মণ। আপনি আমার যজ্ঞ কর পঞ্চানন।। হাসিয়া বলেন শিব, শুন মহারাজ। মম কর্ম্ম নহে যজ্ঞ, ব্রাহ্মণের কাজ।। যজ্ঞফল যাহা চাহ, মাগহ রাজন। শুনিয়া নৃপতি বলে বিনয় বচন।। না করিয়া যজ্ঞ, ফল নহে সুশোভন। যজ্ঞের উপায় কিছু কহ ত্রিলোচন।। মহেশ কহেন তব যজ্ঞে এত মন। মম অংশে আছে এক দুর্ব্বাসা ব্রাহ্মণ।। তাহারে লইয়া যজ্ঞ কর নরবর। যজ্ঞের সামগ্রী গিয়া করহ সত্বর।। দুর্ব্বাসার যোগ্য যজ্ঞ করহ বিধান। যেই মতে রক্ষা পায় দুর্ব্বাসার মান।। শিব-আজ্ঞা পেয়ে রাজা গেল নিজ ঘর। যজ্ঞের সামগ্রী করে দ্বাদশ বৎসর।। সম্পূর্ণ সামগ্রী করি জানাইল হরে। শিব করিলেন আজ্ঞা দুর্ব্বাসা মুনিরে।। শিবের আজ্ঞায় হৈল ক্রোধ তপোধনে। ছিদ্র কিছু পেয়ে আজি নাশিব রাজনে।। এত অহঙ্কার করে শ্বেতকী রাজন। যজ্ঞ হেতু করিল আমারে আবাহন।। মনে ক্রোধ করিয়া চলিল মুনিবর। যজ্ঞ করিবারে গেল সহ দণ্ডধর।। যজ্ঞ আরম্ভিল তবে মহাতপোধন। যখন যে মাগে মুনি যোগায় রাজন।। শ্বেতকী রাজার যজ্ঞ অতুল সংসারে। দুর্ব্বাসা আহুতি দেয় মুষলের ধারে।। দ্বাদশ বৎসর যজ্ঞ কৈল অবিরাম। তিন লোক চমৎকার শুনে যজ্ঞনাম।। সেই হবি খাইয়া হইল মন্দানল। ব্যাধিযুক্ত দেহ অগ্নি হইল দুর্ব্বল।। অগ্নিদেব চলিলেন ব্রহ্মার সদন। ব্রহ্মারে আপন দুঃখ কৈল নিবেদন।। বিরিঞ্চি বলেন, লোভে এ দুঃখ পাইলা। বহু হবি খেয়ে তুমি ব্যাধিযুক্ত হৈলা।। ইহার ঔষধ আছে শুন হুতাশন। খাণ্ডব বনেতে আছে বহু জীবগণ।। যদি পার সেই বনে দগ্ধ করিবারে। তবেত না রবে রোগ তব কলেবরে।। ব্রহ্মার বচন শুনি সুপ্রচণ্ড বেগে। খাণ্ডব বনেতে অগ্নি চলিলেন বেগে।। অতি শীঘ্র উপনীত হয়ে সেইখানে। জ্বলিয়া উঠিল অগ্নি ভীষণ গর্জ্জনে।। খাণ্ডবে আছিল বহু জীবের আলয়। অনল দেখিয়া সবে মানিল বিস্ময়।। কোটি কোটি মত্ত হস্তী সহিত হস্তিনী। নিবাইল অগ্নি শুণ্ডে করি জল আনি।। বড় বড় সর্প সব মহা ভয়ঙ্কর। শত পঞ্চ সপ্ত অষ্ট দশ ফণাধর।। মুখেতে করিয়া জল নিবারে অনল। আর যত আছে জীব যার যত বল।। নিবৃত্ত হইল অগ্নি নারিল দহিতে। বহুবার উপায় করিল হেনমতে।। খাণ্ডব দহিতে শক্ত নহে হুতাশন। ক্রোধ চিত্তে গেল পুনঃ ব্রহ্মার সদন।। বিনয় করিয়া বহু বলে বিরিঞ্চিরে। না হৈল আমার শক্তি বন দহিবারে।। মুহূর্ত্তেক থাকিয়া চিন্তিল মহামতি। না কর হে ভয় অগ্নি স্থির কর মতি।। ব্রহ্মা বলিলেন, আর না দেখি উপায়। স্থির হৈয়া থাক তুমি কাল গতপ্রায়।। ইহার বিধান এক কহি যে তোমায়। সাবধান হয়ে শুন ইহার উপায়।। নর নারায়ণ জন্মিবেন মহীতলে। খাণ্ডব দহিবা দোঁহে সহায় হইলে।। ব্রহ্মার বচনে অগ্নি স্থির করি মন। বহুকাল রোগমুক্ত রহিল তেমন।। হইলে দ্বাপর শেষে দোঁহে অবতার। ব্রহ্মার সদনে অগ্নি গেল পুনর্ব্বার।। ব্রহ্মার পাইয়া আজ্ঞা দেব হুতাশন। অতি শীঘ্র গেল যথা দেব নারায়ণ।। অগ্নির বচনে পার্থ করেন স্বীকার। আশ্বাস পাইয়া অগ্নি বলে আরবার।। সে বন দহিতে বিঘ্ন আছে বহুতর। বনের রক্ষক সদা দেব পুরন্দর।। অর্জ্জুন কহেন, দেবে নাহি মম ভয়। বহু ইন্দ্র আসে, তবু করিব বিজয়।। মম যোগ্য ধনুর্ব্বাণ নাহি হুতাশন। ইন্দ্র সহ যুঝিতে নাহিক অস্ত্রগণ।। অবশ্য বিরোধ হৈবে দেবরাজ সঙ্গ। তার যুদ্ধ-যোগ্য রথ নাহিক তুরঙ্গ।। দেবরাজ ইন্দ্র সহ বিরোধ হইবে। ত্রিজগৎ লোক তার সাহায্য করিবে।। সাহায্য করিতে হৈলে নাহি অস্ত্রগণ। উপায় বিহনে সিদ্ধ নহে কদাচন।। শ্রীকৃষ্ণের বাহুবল সহিবারে পারে। হেন অস্ত্র নাহি তাঁরো হস্তের মাঝারে।। আপনি চিন্তহ তুমি ইহার উপায়। খাণ্ডব দহিতে মোরা হইব সহায়।। এত শুনি ধ্যান করি চিন্তে হুতাশন। সখা বরুণেরে তবে করিল স্মরণ।। অগ্নির স্মরণে আইলেন জলেশ্বর। বরুণে দেখিয়া নিবেদিল বৈশ্বানর।। এমন সময়ে সখা কর উপকার। চন্দ্রদত্ত রথ আছে আলয়ে তোমার।। অক্ষয় যুগল তূণ গাণ্ডীব ধনুক। এ সকল দিলে মম খণ্ডে সব দুখ।। শুনিয়া বরুণ আনি দিল শীঘ্রগতি। আরো আপনার পাশ দেন জলপতি।। সুরাসুরে পূজিত গাণ্ডীব মহাধনু। কপিধ্বজ রথজ্যোতি জিনি চন্দ্র ভানু।। শুল্কবর্ণ চারি অশ্বরথে নিয়োজিত। অক্ষয় যুগল তূণ অস্ত্রে সুশোভিত।। বরুণ আনিয়া দিল অগ্নির বচনে। অগ্নি তাহা সমর্পিল নর-নারায়ণে।। অস্ত্র লভি হরষেতে কুন্তীর নন্দন। প্রদক্ষিণ করি রথে কৈল আরোহণ।। নিজ শক্তি তবে অগ্নি পার্থেরে অর্পিল। যেই শক্তি তেজে অগ্নি দানব দহিল।। কৃষ্ণেরে করিয়া স্তব দেব হুতাশন। কৌমোদকী গদা দিল চক্র সুদর্শন।। এই দুই অস্ত্র দিব্য অতুল সংসারে। তোমা বিনা অন্য জনে শোভা নাহি করে।। দোঁহে রথে চড়িলেন নিজ নিজ সাজে। গোবিন্দ গরুড়ধ্বজে, পার্থ কপিধ্বজে।। শতেক যোজন বন খাণ্ডব বিস্তার। লাগিল অনল উঠে পর্ব্বত আকার।। দুই ভিতে বনের থাকেন দুই জন। নিঃশঙ্কে দহয়ে বন দেব হুতাশন।। প্রলয়ের মেঘ যেন, শুনি গড়াগড়ি। নানাজাতি বৃক্ষ পোড়ে, শুনি বড়বড়ি।। নানাজাতি পশু পোড়ে, নানা পক্ষিগণ। নানাজাতি পুড়িয়া মরয়ে নাগগণ।। প্রাণভয়ে কোন জন পলাইয়া যায়। অস্ত্রেতে কাটিয়া সবে অগ্নিতে ফেলায়।। সিংহনাদ করি বলবন্ত কোন জন। গর্জ্জিয়া বাহির হৈল করিবারে রণ।। কৃষ্ণার্জ্জুন বাণ কাটি ফেলে ততক্ষণ। আনন্দেতে হুতাশন করয়ে ভক্ষণ।। যক্ষ রক্ষ কিন্নর দানব বিদ্যাধর। অনেক পুড়িয়া মরে অরণ্য ভিতর।। ভার্য্যা পুত্র সহ কেহ করে আলিঙ্গন। ব্যাকুল হইয়া কেহ করয়ে রোদন।। শীঘ্রগতি গিয়া কেহ পড়ে জলমাঝে। জলজন্তু সহ ভস্ম হয় অগ্নিতেজে।। জলেতে পুড়িয়া মরে শফরী কচ্ছপ। বনেতে পুড়িয়া মরে বনবাসী সব।। সিংহ ব্যাঘ্র ভল্লুক বরাহ মৃগগণ। মহিষ র্শাদ্দূল খড়্গী, না যায় লিখন।। অসংখ্য কুঞ্জর পোড়ে দীর্ঘ দীর্ঘ দন্ত। জম্বূক শশক নকুলের নাহি অন্ত।। নানাজাতি নাগ পোড়ে গর্জ্জিয়া আগুণে। শত পঞ্চ দশ ফণা ধরে কোন জনে।। পর্ব্বত আকার অঙ্গ, গমনে পবন। নানাজাতি পুড়িয়া মরয়ে পক্ষিগণ।। আকাশে উড়য়ে কেহ পবনেরে তেজে। অর্জ্জুন কাটিয়া বাণে ফেলে অগ্নিমাঝে।। আকুল যতেক জীব করে কলরব। মহাশব্দ হৈল, যেন উথলে অর্ণব।। পর্ব্বত আকার অগ্নি উঠিল আকাশে। স্বর্গবাসী দেবগণ পলায় তরাসে।। ভয়েতে লইল সবে ইন্দ্রের শরণ। দেবরাজে জানাইল খাণ্ডব দাহন।। তোমার পালিত বন দহে হুতাশন। অগ্নির সহায় হৈল নর দুই জন।। এত শুনি কুপিত হইল দেবরাজ। যুঝিবারে চলে লয়ে দেবের সমাজ।। মহাভারতের কথা অমৃত-লহর। কাহার শকতি তাহা বর্ণিবারে পারি।। শ্রুতমাত্র কহি আমি রচিয়া পয়ার। শুনি অবহেলে তরে ভব-পারাপার।। শ্লোকচ্ছন্দে সংস্কৃতে বিরচিল ব্যাস। খাণ্ডব দাহন কথা শ্রবণে উল্লাস।। আদিপর্ব্ব ভারতের শুনে সাধুজনে। পাঁচালী-প্রবন্ধে কাশীরাম দাস ভণে।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon