ধৃতরাষ্ট্র


ধৃতরাষ্ট্র :পুরুবংশে শান্তুনু নামে কে রাজা ছিলেন। তিনি গঙ্গাকে বিবাহ করার ফলে তাঁর গর্ভে দেবব্রত নামে এক সন্তানের জন্ম হয়। তিনিই পরে ভীষ্ম নামে পরিচিতি লাভ করেন। রাজা শান্তুনু পরে দাসরাজ কন্যা সত্যবতীকে বিবাহ করেন। এ সত্যবতী হতে শান্তুনুর চিত্রঙ্গদা ও বিচিত্রবীর্য নামে দুই পুত্রের জন্ম হয়। জ্যেষ্ঠ পুত্র ভীষ্ম কাশীরাজের কন্যা অম্বিকা ও অম্বালিকা এর সহি বিচিত্রবির্যের বিবাহ দেন। কিন্তু বিবাহের সাত বছরের মাথায় বিচিত্রবীর্য মৃত্যুবরণ করেন। বংশ রক্ষায় মাতা সত্যবতী চিন্তিত হয়ে পড়েন। ভীষ্মকে ভ্রাতৃবধু গর্ভে পুত্র জন্মদানের জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু ভীষ্ম তার প্রতিজ্ঞার কারণে তা করতে অপরাগতা প্রকাশ করেন। পরিশেষে সত্যবতী তার কানীন পত্র ব্যাসদেবকে স্মরণ করেন। মাতার অনুরোধে ব্যাসদেব অম্বিকার গর্ভে ধৃতরাষ্ট্রের জন্ম দেন (ব্যাসদেবের ভয়ংকর রূপ দর্শনে অম্বিকা ভয়ে চোখ বন্ধ করেন বিধায় অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের জন্ম হয়)। তারপর অম্বালিকার গর্ভে পান্ডুর জন্ম দেন (ব্যাসদেবের ভয়ংকর রূপ দর্শনে অম্বিকার মুখমন্ডল পান্ডুর বর্ণ ধারণ করে বিধায় তার নাম হয় পান্ডু)। ব্যাসদেবের পুর্বেকার রূপ দর্শনে ভীত হয়ে অম্বিকা নিজে না গিয়ে তার এক সুন্দরী দাসী ব্যাসদেবে নিকট প্রেরণ করেন। দাসী গর্ভে ব্যাসদেবের বিদুর নামে এক ধর্মপরায়ণ পুত্র জন্ম গ্রহণ করে।

ধৃতরাষ্ট অন্ধ বিধায় পান্ডু হস্তিনাপুরের রাজা হন। ধৃতরাষ্ট্রের শরীবে শত হস্তির শক্তি বিরাজ করতো। গান্ধাররাজ সুবলের কন্যা গান্ধারীর সাথে তার বিবাহ হয়। স্বামীর অন্ধত্বের বেদনা অনুধাবন করে গান্ধারীর তার চোখে সর্বদা বস্ত্রখন্ড বেঁধে রাখতেন। ব্যাসদেব গান্ধারীকে শত পুত্র লাভের বর দেন। কিন্তু গান্ধারী গর্ভ সঞ্চার দুই বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও সন্তান না হওয়ায় ধৃতরাষ্ট্রে অজান্তে তিনি গর্ভপাত করেন। তাতে এক লৌহকঠিন মাংস পিন্ডের প্রসব হয়। ব্যাসদেবে পরামর্শে সেই মাংশ পিন্ড শীতল জলে রেখে তা হতে একশত ভ্রুণ পৃথক করে ঘৃত কলসে রাখা হয়। এক বছর একটি কলসে দূর্যোধনের জন্ম হয় এবং অপরাপর কলসে দু:শাসন, বিকর্ণ ও চিত্রসেনসহ ৯৯ জন পুত্র এবং দু:শলা নামে এক কন্যার জন্ম হয়। তাছাড়া এক বৈশ্য নারীর গর্ভে ধৃতরাষ্ট্রে যুযুৎসু নামে এক ধর্ম পরায়ণ পুত্রের জন্ম হয়। দুর্যোধনের জন্মের পর রাজ্যে অশুভ লক্ষ্মণ দেখা দিতে থাকে। তখন সকলে তাকে পরিত্যাগ করতে বলেন কিন্তু পুত্র স্নেহে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র তা করেননি। কুরু নামে এক পূর্বাপর রাজারা নামানুসারে কুরু বংশের উৎপত্তি এবং ধৃতরাষ্ট্রের সন্তানরা কৌরব নামে পরিচিত। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যুযুৎসু ব্যতীত কুরুবংশের সকল পুত্রের মৃত্যু হয়।

পুান্ডুর পুত্ররা পান্ডব নামে পরিচিত। পান্ডুর মৃত্যুর পর ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে হস্তিনাপুরের যুবরাজ ঘোষণা করেন। পান্ডবদের শ্রীবৃদ্ধিতে দূর্যোধনের মনে ঈর্ষার সৃষ্টি হয়। দূর্যোধনের পরামর্শে ধৃতরাষ্ট পান্ডবদের বরানাবতে পাঠান। সেখানে দূর্যোধন জতুগৃহে পান্ডবদের হত্যা করার ষঢ়যন্ত্র করেন। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। পান্ডবদের দ্রৌপদীকে লাভের সংবাদ এভাবে ধৃতরাষ্ট্রে কানে পৌছায় যেন দূর্যোধন দ্রৌপদীকে লাভ করেছেন কিন্তু যখন জানতে পারেন তখন তিনি সন্তুষ্টির ভাব দেখান। দূর্যোধন ও কর্ণ পান্ডবদের উন্নতি দেখে তাদের শক্তিক্ষয় করার জন্য পরামর্শ দিলে ধৃতরাষ্ট্র সে বিষয়ে ভীষ্ম ও দ্রোণ আর বিদূরের সাথে পরামর্শ করে তিনি এ বিষয়ে সিদ্ধান দেবন। পরামর্শের জন্য ভীষ্ম, দ্রোন ও বিদূরকে ডেকে পাঠানো হলো। কর্ণের বিরোধীতা সত্ত্বেও ধৃতরাষ্ট্র ভীষ্ম ও বিদূরের পরামর্শ মেনে নিলেন। তাদেরকে অর্ধেক রাজ্য ও খান্ডবপ্রস্থে রাজধানী স্থাপনের অনুমতি দিলেন। তারপর পান্ডবরা অনেক দেশ জয় করে প্রচুর ধনরত্নে সমৃদ্ধ হন। রাজসূয় যজ্ঞ করে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেন। পান্ডবদের বিপুল ভৈব সম্পদ দর্শনে দূর্যোধন ঈর্ষান্বিত হন এবং শকুনীর পরামর্শে দ্যুতক্রীড়ার ফাঁদে আটকিয়ে যুধিষ্ঠিরকে সর্বশান্ত করার পরিকল্পনা করেন। পুত্রস্নেহে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র ধর্মকে আঁকড়ে ধরে থাকার চেষ্টা করেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত অধর্মের কাছে হার মানেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও দ্যুতক্রীড়ার অনুমতি দেন। শকুনীর ছলনায় দ্যুতক্রীড়া যুধিষ্ঠির পরাজিত হন। এমনকি দ্রৌপদীকে পণ ধরেও হারেন। ধৃতরাষ্ট্র সন্তুষ্ট হলেও দ্যুতসভায়

ঘটনার পরম্পরা আঁচ করতে পেরে রাজা ধৃতরাষ্ট্র বিচলিত হয়ে পড়েন এবং দ্রৌপদী ও পঞ্জপান্ডবদের মুক্তির আদেশ দেন। দ্বিতীয়বারও ধৃতরাষ্ট্র দ্যুতক্রীড়ার অনুমতি দেন। যুধিষ্ঠির দ্যুতক্রীড়ায় পরাজিত হন এবং ১২ বছর বনবাস ও এক বছর অজ্ঞাতবাসে যাত্রা করেন। অস্থির চিত্ত ধৃতরাষ্ট্র বিদূরকে পুনরায় পরামর্শের জন্য ডাকেন। বিদূর বলেন দূর্যোধনের উচিৎ পান্ডবদের সাথে মিলেমিলে থাকা। আর তা না হলে তাকে নিগৃহীত করে পান্ডবদের রাজ্য দান করা। বিদূরের এ পরামর্শে ধৃতরাষ্ট্র অখুশী হয়ে বিদূরকে তিরস্কার করলেন। বিদূর পান্ডবদের নিকট উপস্থিত হলে ধৃতরাষ্ট্র অনুতপ্ত হয়ে পুনরায় সঞ্জয়ের মাধ্যমে বিদূরকে ফিরিয়ে আনেন। এমন কি ব্যাসদেবের পরামর্শও ধৃতরাষ্ট উপেক্ষা করেন। বনবাস ও অজ্ঞাতবাস সময় শেষ হলে পান্ডবরা ফিরে এসে রাজ্য প্রত্যার্পনের প্রার্থনা করেন। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র রাজ্য প্রত্যার্পনের বদলে সঞ্জয়কে দিয়ে শান্তির প্রস্তাব পাঠন। সঞ্জয়কে পান্ডবরা তাদের হৃত রাজ্য ফেরতের জন্য প্রস্তাব দেন। ধৃতরাষ্ট্র দূর্যোধনকে সন্ধি স্থাপনের জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু দূর্যোধন ও কর্ণ নিজের শক্তি মত্তার অহংকারের কারণে সবই ব্যর্থ হয়। ধৃতরাষ্ট্র দূর্যোধনকে অনেক উপদেশ দেন। কিন্তু সবই অগ্রাহ্য করেন দূর্যোধন। শ্রীকৃষ্ণও সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে কৌরব সভায় যান। কিন্তু দূর্যোধনের অনমনীয় মনোভাবের জন্য তাও ভেস্তে যায়। শেষে মাতা গান্ধারীও দূর্যোধনকে পান্ডবদের সাথে শান্তি স্থাপনের জন্য চেষ্টা করেন। কিন্তু সে চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। ফলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়।

সঞ্জয় দিব্য চক্ষু প্রাপ্ত হয়ে যুদ্ধের সংবাদ ধৃতরাষ্ট্রকে অবহিত করতেন। যুদ্ধ শেষ। শত পুত্রের মৃত্যু ধুতরাষ্ট্রকে শোকাগ্রস্থ করে ফেলে। গান্ধারী সংবাদ পেয়ে হস্তিনাপুর হতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ময়দানে যান। যুধিষ্ঠিরাদিও তাকে অনুগমন করেন। ধৃতরাষ্ট্র মনে মনে দ্বেষ পোষণ করে ভীমের সাথে আঙ্গিনের জন্য অগ্রসর হলে কৃষ্ণ তার মনোভাব বুঝতে পেরে পূর্বেএ একটি লোহার ভীমের মূর্তি তৈরী করে রেখেছিলন। ধৃতরাষ্ট্র তাকেই ভীম মনে করে শত হস্তির শক্তি প্রয়োগ করলে মূর্তিটি চূর্ণবিচূর্ন হয়ে যায়। পরে তার ভুল বুঝতে পেরে ভীমের জন্য বিলাপ করতে থাকেন। তখন শ্রীকৃষ্ণ ভীমসহ সকলকে ধৃতরাষ্ট্রে সমীপে নিয়ে আসেন।

ভীমের অপমান ও বিরোধীতা সহ্য করতে না পেরে ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারীসহ বনবাসে যাত্রা করেন। তাঁরা গঙ্গা নদীর তীরে শতয়ুপ মুনির আশ্রমের নিকট বনবাসী হয়ে বাস করতে থাকেন। ধৃতরাষ্ট্র নিজের যজ্ঞাগ্নিতে জীবন বির্সজন দিয়ে পরমগতি পেয়েছেন।

ধৃতরাষ্ট্র অস্থির চিত্ত সম্পন্ন একজন মানুষ। কোন কিছুই তিনি স্থিরভাবে চিন্তা করতে পারেন না। সবকির্ছ ভাসা ভাসা চিন্তা করেন। সূক্ষ্মচিন্তা না করে স্থূল চিন্তা করেন। তারমধ্যে নীচতাও বিদ্যমান আবার উদারতাও আছে। দূর্যোধন এবং শকুনী তাঁর বুদ্ধিকে সব সময় বিভ্রান্ত করতো। ফলে তিনি কোন কিছুই সিদ্ধান্ত দিতে পারতেন। দ্যুতসভায় বিদূর ধৃতরাষ্ট্রকে বলেন,“ মহারাজ, দূর্যোধনের জয়ে আপনি খুশী হয়েছেন। কিন্তু এ জয় থেকেই যুদ্ধ আর লোকক্ষয় হবে।” ধৃতরাষ্ট্র বিদূরকে বলেন.“দুর্যোধন তার সম্মুখে এলেই তার বুদ্ধির বিভ্রাট ঘটে। ফলে তিনি ন্যায় বিচারে অসমর্থ হন।” ধৃতরাষ্ট্রের ধর্মবুদ্ধি যখন জাগ্রত হয় তখন তিনি দূর্যোধনকে শাসন করেন, ধমন দেন। আবার লোপ পেলে পুত্রের পক্ষাবলম্বন করেন। আবার সংকটে আবর্তিত হলে বিদূরের কাছে সমাধানের জন্য পরামর্শ চান। পরামর্শ তার মনপুত না হলে বিদূরকে তিরস্কারও করেন। পান্ডবরা বনবাস থেকে ফিরে এলে ভীষ্ম, দ্রোণ ও বিদূরের সাথে পরামর্শ করে পান্ডবদের রাজ্য প্রত্যার্পনের পক্ষেই ছিলেন তিনি। কিন্তু দূর্যোধনের অহংকার, ঈর্ষা, নিজের শক্তির প্রতি অগাধ বিশ্বাসই সূচাগ্র ভূমি প্রত্যার্পনে সবেচেয়ে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। যখন শ্রীকৃষ্ণ সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে হস্তিনাপুরে আসেন তখন ধৃতরাষ্ট্র রাজকীয় সম্মানসহ বিভিন্ন উপটৌকন প্রদান করে শ্রীকৃষ্ণকে খুশী করার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। বনবাসে গমনকালে ধৃতরাষ্ট্র কুরুজাঙ্গলের প্রজাগণের সম্মুখে এক আবেগঘন বক্তব্য প্রদান করেন। প্রজাগণ তা শ্রবণ করে আবেগ আপ্লুত, বাষ্পরুদ্ধ ও অশ্রুসিক্ত হন। এখানে ধৃতরাষ্ট্রে চরিত্রের উল্লেখ্যযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। জীবনের অন্তিম সময়ে তিনি যুধিষ্ঠিরকে পুত্রতুল্য জ্ঞান করলেন।
সূত্র : মহাভারত ও বিভিন্ন পৌরানিক উপাখ্যান

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র