মহাভারত-আদিপর্ব-৭২-৭৬

৭২. দ্রোণ সমীপে অস্ত্রশিক্ষা 
হেতু একলব্যের আগমন
তবে একদিন তথা দ্রোণ-গুরু-স্থানে।
আইল নিষাদ এক শিক্ষার কারণে।।
হিরণ্যধনুর পুত্র একলব্য নাম।
দ্রোণের চরণে আসি করিল প্রণাম।।
যোড়হাত করি বলে বিনয় বচন।
শিক্ষা হেতু আইলাম তোমার সদন।।
দ্রোণ বলিলেন তুই হোস্ নীচ জাতি।
তোরে শিক্ষা করাইলে হইবে অখ্যাতি।।
অনেক বিনয়ে বলে নিষাদ-নন্দন।
তথাপি তাহারে না করান অধ্যয়ন।।
দ্রোণাচার্য্য-মুখে বাক্য নিষ্ঠুর শুনিল।
দণ্ডবৎ করিয়া অরণ্যে প্রবেশিল।।
নিষাদের বেশ ত্যাজি হৈল ব্রহ্মচারী।
জটা-বল্ক-পরিধান, ফল-মূলাহারী।।
মৃত্তিকার দ্রোণ মূর্ত্তি করিয়া রচন।
নানা পুষ্প দিয়া তাঁর করয়ে পূজন।।
নিরন্তর একলব্য হাতে ধনুঃশর।
সর্ব্ব অস্ত্র শিখি হৈল মহা ধনুর্দ্ধর।।
তবে কতদিন পরে কৌরব-নন্দন।
সেই বনে গেল সবে মৃগয়া কারণ।।
কেহ রথে, কেহ গজে, কেহ তুরঙ্গমে।
সঙ্গেতে চলিল পরিবার ক্রমে ক্রমে।।
মৃগয়া-নিপুণ গুণী লইয়া সংহতি।
মহাবনে প্রবেশ করিল শীঘ্রগতি।।
মৃগয়া করিছে যত রাজার কোঙর।
হেনকালে এক পাণ্ডবের অনুচর।।
করিয়া কুক্কুর সঙ্গে যায় পাছে পাছে।
উত্তরিল যথায় নিষাদপুত্র আছে।।
মৃত্তিকা-পুত্তলি আগে করি যোড়কর।
বসিয়াছে ব্রহ্মচারী হাতে ধনুঃশর।।
শব্দ করে কুক্কুর দেখিয়া ব্রহ্মচারী।
চারিভিতে ভ্রমে তারে প্রদক্ষিণ করি।।
কুক্কুরের শব্দে তার ভাঙ্গিল যে ধ্যান।
ক্রোধে কুক্কুরের মুখে মারে স্তব্ধবাণ।।
না মরিল কুক্কুর না হৈল মুখে ঘা।
অলক্ষিতে কুক্কুরের রুধিলেক রা।।
কুক্কুর নিঃশব্দে ধায় মুখে স্তব্ধশর।
কতক্ষণে গেল তবে কুমার-গোচর।।
কুক্কুরের মুখে শর আশ্চর্য্য দেখিয়া।
জিজ্ঞাসিল অনুচরে বিস্ময় হইয়া।।
এ হেন অদ্ভুতকর্ম্ম কভু নাহি শুনি।
বহুবিদ্যা জানি হেন বিদ্যা নাহি জানি।।
লজ্জায় মলিন হৈল যত ভ্রাতৃগণ।
চল যাই দেখিব বিন্ধিল কোন্ জন।।
অনুচরে লৈয়া গেল যথা ব্রহ্মচরী।
দেখিল বসিয়া আছে ধনুঃশর ধরি।।
জিজ্ঞাসিল, হও তুমি কোন্ মহাজন।
কার স্থানে এ বিদ্যা করিলা অধ্যায়ন।।
ব্রহ্মচারী বলে, মম একলব্য নাম।
দ্রোণ-গুরুস্থানে অস্ত্র-শিক্ষা করিলাম।।
শুনিয়া বিস্ময় মানে যতেক কুমার।
অর্জ্জুন শুনিয়া চিন্তা করেন অপার।।
মৃগয়া সম্বরি তবে যত ভ্রাতৃগণ।
দ্রোণস্থানে করিলেন সব নিবেদন।।
বিনয়ে কহেন পার্থ বিরস-বদন।
আমারে নিগ্রহ কর বুঝিনু এখন।।
পূর্ব্বেতে আমার কাছে কৈলা অঙ্গীকার।
তব সম প্রিয় শিষ্য নাহিক আমার।।
তোমার সদৃশ বিদ্যা নাহি দিব কারে।
এখন ছলনা প্রভু করিলা আমারে।।
পৃথিবীতে যেই বিদ্যা অগোচরে নরে।
হেন বিদ্যা শিখাইলে নিষাদ-কুমারে।।
অর্জ্জুনের বাক্যে দ্রোণ মানিয়া বিস্ময়।
ক্ষণেক নিঃশব্দে চিন্তা করেন হৃদয়।।
অর্জ্জুনেরে বলেন, সে আছে কোন্ স্থানে।
শীঘ্রগতি চল তথা যাব দুইজনে।।
দ্রোণ আর অর্জ্জুন করিলেন গমন।
দ্রোণে দেখি ধীরে উঠি নিষাদ-নন্দন।।
দূরে থাকি ভূমে লুটি প্রণাম করিল।
কৃতাঞ্জলি হইয়া অগ্রেতে দাণ্ডাইল।।
নিষাদ-নন্দন বলে মধুর বচন।
আজ্ঞা কর গুরু, হেথা কোন্ প্রয়োজন।।
দ্রোণ বলিলেন, যদি তুমি শিষ্য হও।
তবে গুরুদক্ষিণা আমারে আজি দাও।।
একলব্য বলে প্রভু মম ভাগ্যবশে।
কৃপা করি আপনি আইলা মোর পাশে।।
এ দ্রব্য সে দ্রব্য নাহি করিব বিচার।
সকল দ্রব্যেতে হয় গুরু-অধিকার।।
যে কিছু মাগিবা প্রভু সকলি তোমার।
আজ্ঞা কর গুরু করিলাম অঙ্গীকার।।
দ্রোণ বলিলেন, যদি সন্তোষ করিবে।
দক্ষিণ হস্তের বৃদ্ধ অঙ্গুলিটা দিবে।।
গুরুর আজ্ঞায় সে বিলম্ব না করিল।
ততক্ষণে কাটিয়া অঙ্গুলি গোটা দিল।।
তুষ্ট হইলেন দ্রোণ আর ধনঞ্জয়।
পার্থ জানিলেন, গুরু আমারে সদয়।।
তাহার কঠোর কর্ম্ম দেখি দুইজন।
প্রশংসা করিয়া দেশে করিলা গমন।।
মহাভারতের কথা সুধার সাগর।
কাশীরাম দাস কহে শুনে সাধু নর।।
৭৩.দ্রোণ কর্ত্তৃক পাণ্ডব ও
 ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের অস্ত্র-পরীক্ষা গ্রহণভ
তবে কত দিনে দ্রোণ বিদ্যা পরীক্ষিতে।
রচিয়া কাষ্ঠের পক্ষী রাখেন বৃক্ষেতে।।
একে একে ডাকিলেন সব শিষ্যগণে।
আইলেন যুধিষ্ঠির আগে সেইক্ষণে।।
ধনুঃশর দিয়া দ্রোণ যুধিষ্ঠির-করে।
ভাস-পক্ষী দেখাইয়া কহেন তাঁহারে।।
ঐ দেখ ভাস-পক্ষী বৃক্ষের উপর।
উহারে করিয়া লক্ষ্য রাখ ধনুঃশর।।
যেক্ষণে আমার আজ্ঞা হইবে বাহির।
সেইক্ষণে কাটিবা উহার তুমি শির।।
এত শুনি ধনুঃশর যুড়ি যুধিষ্ঠির।
ভাস-পক্ষী পানে দৃষ্টি করিলেন স্থির।।
ডাকিয়া বলেন দ্রোণ কুন্তীর কুমারে।
কোন্ কোন্ জনে তুমি পাও দেখিবারে।।
ধর্ম্ম বলিলেন, ভাস দেখি বৃক্ষোপর।
ভূমিতে তোমারে দেখি আর সহোদর।।
এত শুনি দ্রোণ তারে অনেক নিন্দিয়া।
ছাড় ছাড় বলি ধনু নিলেন কাড়িয়া।।
দুর্য্যোধন শত ভাই, বীর বৃকোদর।
একে একে সবারে দিলেন ধনুঃশর।।
যেইরূপ কহিলেন ধর্ম্মের নন্দন।
সেইমত কহিল সকল ভ্রাতৃগণ।।
সবাকারে বহুনিন্দা করি দ্রোণ-বীর।
ধনু লৈয়া ঠেলা মারি করেন বাহির।।
ধনুঃশর দেন গুরু অর্জ্জুনের হাতে।
বৃক্ষ ভাস দেখাইয়া কহেন অগ্রেতে।।
নির্গত হইবামাত্র মম মুখে বাণী।
নিঃশব্দে কাটিবা বাপু ধনুঃশর হানি।।
গুরুবাক্যে তখনি টানিয়া ধনুর্গুণ।
পক্ষীপ্রতি দৃষ্টি করি রহেন অর্জ্জুন।।
কতক্ষণে থাকি দ্রোণ বলেন অর্জ্জুনে।
কোন্ কোন্ জন তুমি দেখহ নয়নে।।
অর্জ্জুন বলেন, আমি অন্য নাহি দেখি।
বৃক্ষ উপরেতে দেখিবারে পাই পাখী।।
হৃষ্ট হইয়া দ্রোণ পুনঃ বলেন বচন।
কিরূপ ভাসের অঙ্গ কর নিরীক্ষণ।।
অর্জ্জুন বলেন, আর ভাস নাহি দেখি।
কেবল দেখি যে মুণ্ড সহ দুই আঁখি।।
দ্রোণ বলিলেন, অগ্রে কাট পক্ষী-শির।
না স্ফূরিত গুরুবাক্য কাটে পার্থবীর।।
দ্রোণাচার্য্য নিরখিয়া হরিষত মন।
আলিঙ্গিয়া পুনঃ পুনঃ করেন চুম্বন।।
প্রশংসা করেন দ্রোণ অর্জ্জুনে অপার।
দেখি চমৎকার হৈল সকল কুমার।।
তবে এক দিন দ্রোণ যান গঙ্গাস্নানে।
সঙ্গেতে করিয়া লইলেন শিষ্যগণে।।
জলে নামিলেন গুরু, শিষ্যগণ তটে।
কুম্বীর ধরিল তাঁরে দশন বিকটে।।
শক্তিসত্বে মুক্ত নাহি হইয়া আপনে।
ডাক দিয়া বলিলেন সব শিষ্যগণে।।
আমারে কুম্ভীর ধরি লৈয়া যায় জলে।
এই ডুবাইল, রাখ আমারে সকলে।।
দ্রোণের বচনে সবে হৈল চমৎকার।
আস্তে-ব্যাস্তে লৈয়া যায় অস্ত্র যে যাহার।।
দ্রোণের মুখেতে তবে নাহি সরে বাণী।
অলক্ষিতে পঞ্চ বাণ মারিল ফাল্গুনী।।
খণ্ড খণ্ড হইল কুম্ভীর-কলেবর।
মরিল কুম্ভীর, ভাসে জলের উপর।।
জল হৈতে উঠি দ্রোণ ধরিয়া অর্জ্জুনে।
বার বার তুষিল চুম্বন-আলিঙ্গনে।।
তুষিয়া দিলেন অস্ত্র নাম ব্রহ্মশির।
অস্ত্র দিয়া বলিলেন দ্রোণ মহাবীর।।
এই অস্ত্র প্রহারিবা দেবতা রাক্ষসে।
কদাচিত অস্ত্র নাহি ছাড়িবা মানুষে।।
দেখিয়া গুরুর এত অর্জ্জুনে সম্মান।
ক্রোধে দুর্য্যোধন চিন্তে মরণ-সমান।।
হেনমতে দ্রোণাচার্য্য সব শিষ্যগণে।
নানা-বিদ্যা শিক্ষা করাইলেন যতনে।।
রথ-আরোহণে দৃঢ় হন যুধিষ্ঠির।
গদায় কুশল দুর্য্যোধন ভীম-বীর।।
তুরঙ্গে নকুল হৈল, সহদেব কুন্ত।
হেনমতে হইলেন সবে বিদ্যাবন্ত।।
ইন্দ্রের নন্দন হৈল ইন্দ্রের সমান।
সকল বিদ্যায় পূর্ণ হৈল বাখান।।  
রথ গজ অশ্ব ভূমি সর্ব্বত্র অভ্যাস।
ধনুঃ ভড়গ গদা আদি সর্ব্বত্র প্রকাশ।।
মহাভারতের কথা অমৃতের ধার।
ভক্তিতে শুনিলে তরে ভব-পারাবার।।
৭৪. ধৃতরাষ্ট্রের আদেশে রাজপুত্রগণের
 অস্ত্র-শিক্ষার পরীক্ষা
সর্ব্ব শিষ্যগণ যবে হইল প্রখর।
দ্রোণ বলিলেন যথা অন্ধ নৃপবর।।
ভীষ্ম কৃপাচার্য্য আদি যত ক্ষত্রগণ।
সবার কহেন ভরদ্বাজের নন্দন।।
বিদ্যায় পরাগ হৈল সকল কুমার।
সাক্ষাতে পরীক্ষা কর বিদ্যা সবাকার।।
এত শুনি ধৃতরাষ্ট্র আনন্দিত মন।
বিদুরে ডাকিয়া আজ্ঞা করেন তখন।।
রঙ্গভূমি সুসজ্জ করহ শীঘ্রগতি।
যেইরূপ আচার্য্য করহ শীঘ্রগতি।।
যেইরূপ আচার্য্য কহেন মহামতি।
রাজ-আজ্ঞা পাইয়া বিদুর ততক্ষণে।।
আদেশ করেন যত অনুচরগণে।।
ক্ষেত্র এক প্রশস্ত চৌদিকেতে সোসর।
রঙ্গভূমি বিরচিল তাহার ভিতর।।
চতুর্দ্দিকে নির্ম্মাইল উচ্চগৃহগণ।
নানারত্নে গৃহ সব করিল মণ্ডন।।
রাজগণ বসিবারে তাহার উপর।
বিচিত্র পালঙ্ক শয্যা রাখিল বিস্তর।।
রাজ-নারীগণ হেতু কৈল ভিন্ন স্থল।
ভূমি হৈতে তাহা অতি করিল উচল।।
হেন মতে রঙ্গভূমি করিয়া নির্ম্মাণ।
বিদুর জানাইলেন ধৃতরাষ্ট্র স্থান।।
শুভদিন করিয়া চলিল সর্ব্বজন।
অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র আর গঙ্গার নন্দন।।
বাহ্লীক চলিলসহ পুত্র সোমদত্ত।
আর যত রাজগণ আইল প্রমত্ত।।
গান্ধারী সুবল-সুতা কুন্তী আদি করি।
আইল সকল যত অন্তঃপুর-নারী।।
রথ-গজ-অশ্বপৃষ্ঠে মঞ্চের উপরে।
শতপুর করিয়া বসিল দেখিবারে।।
নানাবাদ্য বাজে, শব্দে কর্ণে লাগে তালি।
প্রলয়কালেতে যেন সিন্ধুর কল্লোলি।।
হেনকালে আইলেন আচার্য্য মহাশয়।
তারা মধ্যে হৈল যেন চন্দ্রের উদয়।।
শুক্লবাস শুক্লকেশ শুক্লপুষ্প মালে।
সর্ব্বাঙ্গে লেপিত শুক্ল মলয়জ ভালে।।
পুত্র সহ গুরু দাণ্ডাইলা সভামাঝে।
আজ্ঞা কৈল আসিবারে পাণ্ডব-অগ্রজে।।
সভাতে প্রবেশ করিলেন যুধিষ্ঠির।
বিকচ-পঙ্কজ-মুখ নির্ম্মল শরীর।।
টঙ্কারিয়া ধনুর্গুণ সন্ধি দিব্য শর।
মহাশব্দে প্রহারিল লোকে ভয়ঙ্কর।।
এক অস্ত্রে বহু অস্ত্র করেন সৃজন।
বায়ব্য অনল আদি বহু অস্ত্রগণ।।
ধন্য ধন্য করি সবে করিল বাখান।
সবে বলে, কেহ নাহি ইহার সমান।।
নিবর্ত্তিয়া যুধিষ্ঠিরে দ্রোণ তপোধন।
আজ্ঞা করিলেন, এস ভীম দুর্য্যোধন।।
গদা হাতে এল তবে দুই মহাবীর।
মল্লবেশে রঙ্গমাটি -ভূষিত শরীর।।
মাথায় মুকুট, পরিধান বীর ধড়া।
দুই ভিতে দোঁহে যেন পর্ব্বতের চূড়া।।
গদা হাতে করি ভ্রমে করিয়া মণ্ডলী।
দোঁহার হুঙ্কার শব্দে কর্ণে লাগে তালি।।
দুই মত্ত গজ যেন শুণ্ডে জড়াজড়ি।
চরণে চরণে, মুণ্ডে মুণ্ডে তাড়াতাড়ি।।
দোঁহার দেখিয়া কর্ম্ম লোকে ভয়ঙ্কর।
পরস্পরে কথা হয় সভার ভিতর।।
কেহ বলে, মহাবলী বীর বৃকোদর।
কেহ বলে, ভীম হৈতে বলী কুরুবর।।
হেনমতে দুই পক্ষ হইল সভায়।
উঠিল প্রবল-শব্দ কথায় কথায়।।
ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারী পাণ্ডবগণ-মাতা।
তিন জনে বিদুর কহেন সব কথা।।
বুঝিয়া লোকের মর্ম্ম দ্রোণ মহাশয়।
আজ্ঞা করিলেন দোঁহে নিবৃত্ত যে হয়।।
মধ্যে গিয়া দাঁড়াইল গুরুর নন্দন।
নিবৃত্ত হইল দোঁহে ভীম দুর্য্যোধন।।
তবে আজ্ঞা কৈল গুরু অর্জ্জুনে আসিতে।
আইলেন ধনঞ্জয় ধনুঃশর হাতে।।
নব-জলধর-প্রায় অঙ্গের বরণ।
পূর্ণ-শশধর মুখে, রাজীব লোচন।।
দেখিয়া মোহিত হৈল যত সভাজন।
কেহ বলে, আইলেন কুন্তীর নন্দন।।
কেহ বলে, পাণ্ডুপুত্র পাণ্ডব মধ্যম।
কেহ বলে, কুরুশ্রেষ্ঠ রিপুগণ-যম।।
বীর-ধর্ম্মশীল সাধু সর্ব্বলোকে বলে।
ইহা সম বীর্য্যবন্ত নাহি ভূমণ্ডলে।।
এইমত কথাবার্ত্তা হয় যে সভাতে।
ধন্য ধন্য বলি শব্দ হৈল আচম্বিতে।।
শব্দ শুনি ধৃতরাষ্ট্র বিদুরে পুছিল।
কি হেতু এমত শব্দ সভাতে উঠিল।।
বিদুর বলেন, রাজা আইল অর্জ্জুন।
সভাসদ্ সকলে প্রশংসে তার গুণ।।
ধৃতরাষ্ট্র শুনি প্রশংসিলেন বিস্তর।
কুরু-বংশে ভাগ্য মম এমত কুমার।।
ধন্য কুন্তী হেন পুত্র গর্ভে জন্মাইল।
যাহার মহিমা যশ সভাতে পূরিল।।
কুন্তীদেবী শুনি আনন্দিত হৈল মন।
স্তনযুগে ঝরে দুগ্ধ, সজল নয়ন।।
তবে পার্থ মহাবীর সভামধ্যে গিয়া।
সভাতে পূরেন শব্দ ধনু টঙ্কারিয়া।।
মারিল অনল-অস্ত্র হইল অনল।
অগ্নি পরশিল গিয়া গগন-মণ্ডল।।
দেখিয়া সকল লোক মানিল বিস্ময়।
চতুর্দ্দিকে দেখে সব, হৈল অগ্নিময়।।
যুড়িয়া বরুণ-বাণ কুন্তীর কুমার।
নিবর্ত্তিল অগ্নিবৃষ্টি, বর্ষে জলাধার।।
বায়ু অস্ত্রে নিবারিল জল-বরিষণ।
আকাশ-অস্ত্রেতে বায়ু করেন বারণ।।
সন্ধিয়া পর্ব্বত-অস্ত্রে করি গিরিবর।
পর্ব্বত করেন চূর্ণ মারি বজ্রশর।।
ভূমি-অস্ত্রে নির্ম্মাণ করেন ভূমণ্ডল।
সিন্ধু-অস্ত্রে জল পূর্ণ করেন সকল।।
অন্তর্দ্ধান-অস্ত্র মারি লুকাইল নিজে।
কোথায় আছেন, কেহ নাহি পায় খুঁজে।।
কভু রথে ধনঞ্জয়, কভু ভূমিপরে।
বাদিয়ার বাজি যেন চক্ষে ধাঁ ধাঁ করে।।
হেনমতে নানাবিদ্যা অর্জ্জুন প্রকাশে।
ধন্য ধন্য বলি সর্ব্ব সভাসদে ভাষে।।
নিবর্ত্তিয়া সব বিদ্যা ইন্দ্রের নন্দন।
বাহুস্ফোটে করিলেন বজ্রের নিঃস্বন।।
সেই শব্দে সবার কর্ণেতে লাগে তালি।
গুরু-আগে রহিলেন করি কৃতাঞ্জলি।।
মহাভারতের কথা অমৃত-অর্ণবে।
পাঁচালী-প্রবন্ধে কহে কাশীরাম দেবে।।
৭৫. অর্জ্জুনের ধনুর্ব্বেদ শিক্ষা
 দর্শন করিয়া রঙ্গস্থলে কর্ণের প্রবেশ
অর্জ্জুনের বিদ্যা যদি হৈল সমাধান।
রঙ্গভূমি মধ্যে কর্ণ হৈল আগুয়ান।।
শত দল বর্ণ জিনি অঙ্গের বরণ।
শ্রবণ পরশে দিব্য পঙ্কজ-নয়ন।।
শ্রবণে কুণ্ডল-যুগ দীপ্ত দিনকর।
অভেদ্য কবচে-আবরিত কলেবর।।
দুই দিকে দুই তূণ বামে ধরে ধনু।
আজানু-লম্বিত ভুজ আনন্দিত তনু।।
অবহেলে অবজ্ঞা করিয়ে সর্ব্বজনে।
কহেন কর্ণ, এ ক্রীড়া নাহি লাগে মনে।।
কর্ণের বচন শুনি লোকে চমৎকার।
কেহ বলে, এই হবে দেবের কুমার।।
কেহ বলে, এই বীর পরম-সুন্দর।
অপ্সরা কিন্নর কিম্বা দেব পুরন্দর।।
অথবা গন্ধর্ব্ব কিবা, না জানি নির্ণয়।
আচম্বিতে কোথা হতে আইল দুর্জ্জয়।।
দেখিবারে তরে লোক করে হুড়াহুড়ি।
ঠেলাঠেলি একের উপরে আর পড়ি।।
কেহ বলে, এই বীর হরে বৈশ্বানর।
আচম্বিতে সমুদিত যেন দিবাকর।।
তবে কর্ণ মহাবীর সূর্য্যের নন্দন।
অর্জ্জুনে চাহিয়া বলে করিয়া গর্জ্জন।।
যতেক করিলা তুমি সভার ভিতর।
তাহা হৈতে বিদ্যা আমি জানি বহুতর।।
দেখিয়া আমার বিদ্যা হইবে বিস্ময়।
অসংখ্য আমার বিদ্যা, সংখ্যা নাহি হয়।।
এত শুনি সর্ব্বলোক বিস্মিত-বদন।
দুর্য্যোধন শুনি হৈল আনন্দিত-মন।।
বিরস বদন হইল বীর ধনঞ্জয়।
এত শুনি আজ্ঞা দেন দ্রোণ মহাশয়।।
কোন্ বিদ্যা জানহ সভার আগে কহ।
শুনি কর্ণ মহাবীর ঘুচায় সন্দেহ।।
প্রকাশিল নানা অস্ত্র লোকে অগোচর।
করিয়াছিলেন যত পার্থ ধনুর্দ্ধর।।
দেখিয়া সবার মনে বিস্ময় জন্মিল।
দুর্য্যোধন নিরখিয়া প্রফুল্ল হইল।।
ভ্রাতৃগণ মধ্যে বসি ছিল দুর্য্যোধন।
অতি শীঘ্র উঠিয়া করিল আলিঙ্গন।।
ধন্য ধন্য বীর তুমি, ছিলা কোন্ দেশে।
হেথায় আইলা তুমি মম ভাগ্যবশে।।
ক্ষিতিমধ্যে যত ভোগ আছয়ে আমার।
আজি হৈতে সে সকলে দিনু অধিকার।।
কর্ণ বলে, সত্য আমি করি অঙ্গীকার।
আজি হৈতে সদা আমি হইনু তোমার।।
কেবল আছয়ে এই এক নিবেদন।
অর্জ্জুনের সঙ্গে ইচ্ছা করিবারে রণ।।
এতেক বলিল যদি কর্ণ মহাবীর।
ক্রোধে ধনঞ্জয় অতি কম্পিত শরীর।।
অর্জ্জুন বলিল, তোরে কে ডাকিল হেথা।
কে বা বলে তোমারে সভায় কহ কথা।।
অনাহূত আসি দ্বন্দ্ব করিস্ সভায়।
ইহার উচিত ফল পাবি রে ত্বরায়।।
নাহি জিজ্ঞাসিতে যেবা বলয়ে বচন।
আপনি আসিয়া খায় বিনা নিমন্ত্রণ।।
ঘোর নরকেতে গতি পায় সেই জন।
সেই গতি মম স্থানে পাইবি এখন।।
কর্ণ বলে, ধনঞ্জয় গর্ব্ব পরিহার।
সভাতে সকল লোক, জিনি অস্ত্রধর।।
বীর্য্যেতে অধিক যেই তারে বলি রাজা।
ধর্ম্মবন্ত লোক বীর্য্য বন্তে করে পূজা।।
হীন-লোক-প্রায় কেন দেহ গলাগালি।
অস্ত্রে অস্ত্রে দ্বন্দ্ব কর, তবে জানি বলী।।
মম সঙ্গে রণে জিন, তবে জানি বীর।
দ্রোণ-গুরু অগ্রেতে কাটিব তোর শির।।
এতেক শুনিয়া দ্রোণ ঘূর্ণিত নয়ন।
আজ্ঞা দেন অর্জ্জুনেরে কর গিয়া রণ।।
এত শুনি সুসজ্জ হইয়া ধনঞ্জয়।
ধনুর্গুণ টঙ্কারিয়া করেন প্রলয়।।
স্বপক্ষ হইল পৃষ্ঠে চারি সহোদর।
কৃপাচার্য্য দ্রোণাচার্য্য ভীষ্ম বীরবর।।
আগু হৈল কর্ণ বীর হাতে ধনুঃশর।
সপক্ষ হইল কুরু শত সহোদর।।
আর যত মহারথী যোদ্ধা লক্ষ লক্ষ।
কেহ পাণ্ডবের পক্ষ কেহ কুরু-পক্ষ।।
পুত্রস্নেহে গগনে আগত পুরন্দর।
অর্জ্জুনে করিল ছায়া যত জলধর।।
কর্ণভিতে যত তাপ করেন তপন।
সুসজ্জ হইল সবে করিবারে রণ।।
সকুঞ্জল বীর কর্ণ দেখি বিদ্যমানে।
কুন্তীদেবী চিনিলেন আপন নন্দনে।।
পুত্রে পুত্রে বিবাদ দেখিয়া কুন্তী দেবী।
ঘন ঘন মূর্চ্ছা যায় মহাতাপ লাগি।।
হেনকালে কৃপাচার্য্য বলিল ডাকিয়া।
সর্ব্বলোকে শুনে, কহে কর্ণেরে চাহিয়া।।
এই পার্থ বীর হয় পৃথার নন্দন।
কুরু মহাবংশে জন্ম, বিখ্যাত ভুবন।।
তোমার সহিত আজি করিবেক রণ।
তুমি কহ, কোন্ বংশ কাহার নন্দন।।
জ্ঞাত হৈলে দোঁহাকার করাইব রণ।
সমবংশ হৈলে যুদ্ধ হয় সুশোভন।।
নাহি অভিমান সম জয় পরাজয়।
রাজপুত্র ইতর-লোকেতে যুদ্ধ নয়।।
কেবা তব মাতা পিতা কহ বীরবর।
বল শুনি কোন্ রাজ্যে তুমি অধীশ্বর।।
এতেক শুনিয়া কর্ণ কৃপের বচন।
হেটমুণ্ড হৈল বীর বিরস বদন।।
না দিল উত্তর কিছু কর্ণ মহাবল।
বৃন্ত হৈতে ছিন্ন যেন কমলের দল।।
কৃপেরে চাহিয়া বলে রাজা দুর্য্যোধন।
ত্রিবিধ প্রকারে রাজা শাস্ত্রের বচন।।
সহজে বংশজ আর লোকে যারে পূজে।
সবা হৈতে যেই জন বীর্য্যবন্ত তেজে।।
যেই জন জানে সৈন্য-চালন-সন্ধান।
তাঁর সনে রণ সাজে, আছে এ বিধান।।
রাজা হৈলে পার্থ যদি করিবেক রণ।
আজি আমি কর্ণে রাজা করিব এখন।।
অঙ্গদেশে কর্ণ আজি হবে দণ্ডধর।
এত বলি আজ্ঞা দিল ডাকি অনুচর।।
অভিষেক দ্রব্য আনাইল ততক্ষণে।
বসাইল কর্ণ বীরে কনক-আসনে।।
শিরেতে ধরিল ছত্র রতনে মণ্ডিত।
রাজগণে চামর ঢুলায় চারিভিত।।
কনক-অঞ্জলি শিরে ফেলিল নিছিয়া।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ রহেন বিস্মিত হৈয়া।।
তবে কর্ণ মহাবীর প্রসন্ন বদন।
দুর্য্যোধন প্রতি বলে হৈয়া হৃষ্টমন।।
অঙ্গদেশে দিলে মোরে তুমি রাজা করি।
যে আজ্ঞা করিবে তাহা প্রাণপণ করি।।
দুর্য্যোধন বলে, অন্যে নাহি প্রয়োজন।
হইবে আমার সখা এই মম মন।।
অচল সৌহৃদ্য-ইচ্ছা তোমার সহিতে।
এই মম বাঞ্ছা, আজ্ঞা কর তুমি মিতে।।
কর্ণ বলে, সখা মম সুদৃঢ় বচন।
পরম-স্নেহেতে দোঁহে করে আলিঙ্গন।।
হেনকালে অধিরত জাতিতে সারথি।
লোকমুখে শুনি, পুত্র হৈল নরপতি।।
বয়সে অত্যন্ত বৃদ্ধ চলে যষ্টিভরে।
উঠিতে পড়িতে বুড়া যায় দেখিবারে।।
বৃদ্ধ দেখি সব লোক ছাড়ি দিল পথ।
সভামধ্যে প্রবেশ করিল অধিরথ।।
অধিরথে দেখি কর্ণ শশব্যস্তে উঠি।
প্রণাম করিল শির ভূমিতলে লুঠি।।
কর্ণ প্রণমিল অধিরথের চরণে।
দেখিয়া বিস্ময় মানিলেক সভাজনে।।
পাণ্ডব জানিল, কর্ণ সূতের নন্দন।
উপহাস করি ভীম বলিল বচন।।
ওহে কর্ণ, তুমি অধিরথের নন্দন।
এতক্ষণ না জানি এ সব বিবরণ।।
অর্জ্জুন সহিত রণে তুমি শক্তিমন্ত।
এখন সে জানিলাম তোর আদি অন্ত।।
সভাতে সম্ভবে কার্য্য কর জাতিমত।
হাতেতে প্রবোধ-বাড়ি চালা গিয়া রথ।।
আরে নরাধম তোর কিমত যোগ্যতা।
অঙ্গদেশে রাজা হও, এ অদ্ভুত কথা।।
যজ্ঞের নিকট যদি শুনি কভু যায়।
যজ্ঞের বিভাগ হবি কুক্কুরে কি পায়।।
ভীমমুখে শুনি কর্ণ কাঁপয়ে অধর।
নিশ্বাস ছাড়িয়া কর্ণ চাহে দিনকর।।
সারথিই হই, কিংবা সারথি-তনয়।
যাহাই হই না আমি, দুঃখ তাহে নয়।।
কোন্ কুলে জন্মলাভ দৈব দেন করে।
পুরুষত্ব কিন্তু মোর মুষ্টির ভিতরে।।
এত শুনি মহাক্রুদ্ধ হৈল দুর্য্যোধন।
অগ্র হৈয়া বলে দম্ভে মেঘের গর্জ্জন।।
সখা করিলাম কর্ণে সভার ভিতর।
এ কথা কহিতে যোগ্য নহে বৃকোদর।।
সখা করিলাম কর্ণে সভার ভিতর।
এ কথা কহিতে যোগ্য নহে বৃকোদর।।
শ্রেষ্ঠ বলি ক্ষত্র-ধর্ম্মে বলিষ্ঠ যে জন।
শূর বা নদীর অন্ত পায় কোন্ জন।।
জল হৈতে শীতল যে না শুনি শ্রবণে।
তাহাতে জন্মিলে অগ্নি দহে ত্রিভুবনে।।
দধীচির হাড়েতে বজ্রের হৈল জন্ম।
দৈত্যের দনুজ দল করে শূরকর্ম্ম।।
কার্ত্তিকের জন্ম কেহ দৃঢ় নাহি জানে।
কেহ বলে শিব হৈতে, কেহ না আগুনে।।
গঙ্গার নন্দন কেহ বলে কৃত্তিকার।
জন্মের নিয়ম নাই পূজ্য সবাকার।।
বিপ্র হৈতে ক্ষত্র-জন্ম সর্ব্বলোকে জানি।
ক্ষত্র হৈয়া বিপ্র হৈল বিশ্বামিত্র মুনি।।
কলসে জন্মিল দ্রোণ, কৃপ শরবনে।
বশিষ্ঠ বেশ্যার পুত্র কেবা নাহি জানে।।
তোমা সবাকার জন্ম জানি ভালমতে।
তুমি নিন্দা কর মিত্রে আমার অগ্রেতে।।
কর্ণেরে কিমত বলি লয় তোর মনে।
ক্ষিতিমধ্যে আছে কেহ এমত লক্ষণে।।
সকুণ্ডল-কবচ যাহার কলেবর।
তোর চিত্তে লয় অধিরথের কোঙর।।
প্রত্যক্ষ দেখহ কর্ণ সম দিবাকরে।
ব্যাঘ্র কভু জন্ম লয় মৃগীর উদরে।।
সকল পৃথিবী শোভে কর্ণে অধিকার।
কর্ণ রাজা হৈল অঙ্গদেশ কোন্ ছার।।
কর্ণ-বাহু-বীর্য্যে সবে করিবেক পূজা।
আমা সহ অনুগত হবে সর্ব্ব রাজা।।
এতেক কহিল সভামধ্যে দুর্য্যোধন।
হাহাকার শব্দ হৈল সভাতে তখন।।
কেহ বলে, ভেদাভেদ হৈল ভ্রাতৃগণ।
কেহ বলে, দ্বন্দ্ব আর নহে নিবারণ।।
কেহ বলে, কুরুকুল আজি হৈল অস্ত।
কেহ বলে, পাণ্ডুকুল মজিল সমস্ত।।
অস্ত গেল দিবাকর, রজনী প্রবেশে।
রাজগণ চলি গেল যার যেই দেশে।।
কর্ণ-হস্ত ধরিয়া চলিল দুর্য্যোধন।
পশ্চাতে চলিল সমুদয় ভ্রাতৃগণ।।
পঞ্চ ভাই পাণ্ডব চলেন নিজস্থান।
আগে পাছে পরিবার করিল প্রয়াণ।।
হরষিতা কুন্তী-দেবী জানিয়া কারণ।
অঙ্গদেশে রাজা হৈল আমার নন্দন।।
দুর্য্যোধন হরষিত, হইল নির্ভয়।
নিরবধি কম্প হৈত দেখি ধনঞ্জয়।।
ত্যজিল অর্জ্জুন-ভয় কর্ণেরে পাইয়া।
যুধিষ্ঠির ভীত অতি কর্ণেরে দেখিয়া।।
কর্ণ সম বীর নাহি আর যে সংসারে।
এই ভয় সদা জাগে ধর্ম্মের অন্তরে।।
আদিপর্ব্ব ভারত ব্যাসের বিরচিত।
কাশীরাম দাস কহে রচিয়া সঙ্গীত।।
৭৬. দ্রোণাচার্য্যের দক্ষিণা প্রার্থনা
তবে কতদিনে দ্রোণ শিষ্যগণ প্রতি।
আমারে দক্ষিণা দেহ, বলেন সুমতি।।
দ্রোণ বলিলেন, শুন পার্থ দুর্য্যোধন।
রত্ন আদি ধনে মম নাহি প্রয়োজন।।
পাঞ্চাল-ঈশ্বর খ্যাত দ্রুপদ ভূপতি।
রণমধ্যে তারে আন বান্ধিয়া সম্প্রতি।।
বিশেষ প্রতিজ্ঞা কৈল কুন্তীর নন্দন।
পূর্ব্বে সত্য কৈলা না করিতে অধ্যায়ন।।
যেমতে পারহ আন করিয়া বন্ধন।
আমার দক্ষিণা এই, শুন শিষ্যগণ।।
এতেক শুনিয়া যুধিষ্ঠির দুর্য্যোধন।
বলিলেন সৈন্যগণে সাজিতে তখন।।
রথ গজ অশ্ব সাজে পদাতি বহুল।
সাজ সাজ বলি ধ্বনি হৈইল তুমুল।।
সৈন্যগণ সাজিল দেখিয়া ধনঞ্জয়।
এক রথে চড়ি যায় নির্ভয়-হৃদয়।।
করপুটে জ্যেষ্ঠেরে করেন নিবেদন।
তুমি তথাকারে যাবে কিসের কারণ।।
আমা হৈতে কর্ম্ম যদি না হয় সাধন।
তবে প্রভু পাঠাইও অন্য কোন জন।।
এতেক বলিয়া পার্থ হইয়া সত্বর।
প্রবেশ করেন ক্ষণে পাঞ্চাল-নগর।।
দ্রুপদ পাইল অর্জ্জুনের সমাচার।
আজ্ঞা কৈল আপনার সৈন্য সাজিবার।।
দ্রুপদ চিন্তিত অতি না জানি কারণ।
অর্জ্জুনের আগমন কোন্ প্রয়োজন।।
মন্ত্রী পাঠাইয়া দিল অর্জ্জুন গোচর।
মন্ত্রী বলে, অর্জ্জুনে করিয়া যোড়কর।।
কহ কুরুবর তব কেন আগমন।
আজ্ঞা কর, কোন কর্ম্ম করিব সাধন।।
রাজার মন্দিরে চল, লহ রাজপূজা।
তোমা দরশনে বড় ইচ্ছা করে রাজা।।
অর্জ্জুন বলেন, সব হবে ব্যবহার।
রাজারে জানাও এই সংবাদ আমার।।
অতিথির যত পূজা পাইলাম আমি।
কেবল আমারে আসি যুদ্ধ দেহ তুমি।।
সসৈন্যে আসিতে বল সংগ্রামের স্থলে।
নহিলে অনিষ্ট বড় হইবে পাঞ্চালে।।
কহিলেন মন্ত্রী গিয়া রাজার গোচর।
শুনি ক্রোধে কম্পিত দ্রুপদ নৃপবর।।
ক্ষত্র হৈয়া হেন বাক্য সহে কার প্রাণে।
চতুরঙ্গ-দলে রাজা আসে ততক্ষণে।।
অশ্ব গজ রথ আর না যায় গণনে।
সসৈন্যে বেড়িল গিয়া পাণ্ডুর নন্দনে।।
বসিয়া আছেন পার্থ নিঃশঙ্ক হৃদয়।
নানা অস্ত্র বরিষণ করে সৈন্যচয়।।
অস্ত্র-বরিষণ দেখি উঠেন অর্জ্জুন।
আকর্ণ পূরিয়া টঙ্কারিল ধনুর্গুণ।।
দ্রোণের চরণ ভাবি এড়েন যে শর।
মুহূর্ত্তেকে আচ্ছাদিল দেব দিবাকর।।
আষাঢ় শ্রাবণে যেন নবজলধর।
বৃষ্টিধারা পড়ে তথা সৈন্যের উপর।।
রথী কাটা গেল যদি পলায় সারথি।
দশন কাটিল পলাইয়া যায় হাতী।।
পলায় তুরঙ্গ, কাটা গেল আসোয়ার।
পদাতি পলায়, হাত কাটা গেল যার।।
পলাইল যত জন পাইল সে প্রাণ।
আর যত সৈন্য রণে হইল নিধন।।
হত সৈন্য হ্ইয়া পলায় নরপতি।
পাছু থাকি ডাকিয়া বলেন পার্থ কৃতী।।
নির্ভয় হইয়া রাজা বাহুড় দ্রুপদ।
আমার নিকটে তোর নাহিক আপদ।।
প্রাণে ভয় পেয়ে যেই ভঙ্গ দেয় রণে।
নিশ্চয় লইব ধরি, না যায় খণ্ডনে।।
বাহুড়িল নরপতি অর্জ্জুন-বচনে।
হইল দারুণ যুদ্ধ দ্রুপদ-অর্জ্জুনে।।
মন্ত্র পড়ি দিব্য-অস্ত্র ছাড়েন অর্জ্জুন।
কাটিলেন তখনি তাহার ধনুর্গুণ।।
ধনু কাটা গেল, রাজা লাগিল চিন্তিতে।
ধরিলেন অর্জ্জুন তাহারে দুই হাতে।।
নিজ রথে চড়াইয়া করেন গমন।
হেনকালে সম্মুখে আইল দুর্য্যোধন।।
চতুরঙ্গ দলে আসে কৌরব-ঈশ্বর।
দ্রুপদে দেখিল পার্থ-রথের উপর।।
দুর্য্যোধন বলে, পার্থ নহিল শোভন।
গুরু-আজ্ঞা দ্রুপদেরে করিতে বন্ধন।।
এত বলি আপনি উঠিল দুর্য্যোধন।
হস্তপদ দ্রুপদের করিল বন্ধন।।
ভূমে চালাইয়া নিল করে কেশ ধরি।
সেইমত উত্তরিল দ্রোণ-বরাবরি।।
ফেলাইল দ্রুপদেরে দ্রোণের চরণে।
দ্রুপদে দেখিয়া দ্রোণ বলেন তখনে।।
এবে গব্বী, দ্রুপদ কোথা তব সিংহাসন।
কোথা রাজছত্র কোথা প্রজা অগণন।।
কোথায় ধন জন রাজ-আভরণ।
এবে দেখি পরিয়াছ শৃঙ্খল ভূষণ।।
পুনরপি হাসিয়া বলেন গুরু দ্রোণ।
স্থির হও ভয় নাই আমার সদন।।
জাতিতে ব্রাহ্মণ আমি ক্ষণমাত্র ক্রোধ।
বিশেষ বাল্যের সখা চিত্তে উপরোধ।।
পূর্ব্বের বচন সখা হয় কি স্মরণ।
সেবকে বলিলা দিতে একটি ভোজন।।
এখন সমান হইলাম দুইজন।
এবে সখা বলিবা কি আমারে রাজন।।
বাল্যকালে করিয়াছিলা যে অঙ্গীকার।
আমি রাজা হৈলে রাজ্য অর্দ্ধেক তোমার।।
পালিতে নারিলা তুমি আপন বচন।
এবে সব রাজ্য হৈল আমার শাসন।।
তুমি না পালিলা, আমি চাই পালিবারে।
অর্দ্ধেক পাঞ্চাল রাজ্য দিলাম তোমারে।।
গঙ্গার দক্ষিণ তীর কর অধিকার।
উত্তর তটের রাজ্য সকলি আমার।।
অর্দ্ধা-অর্দ্ধি রাজ্য এই দোঁহার সমান।
পুনঃ সখা হবে যদি, হও যত্নবান।।
এত শুনি বলিল দ্রুপদ নৃপবর।
পরম মহৎ তুমি জগৎ ভিতর।।
যে আজ্ঞা করিলা তাহা স্বীকার আমার।
তুমি হও সখা, আমি হইনু তোমার।।
দ্রোণ কহিলেন, তবে ঘুচুক বন্ধন।
মুক্ত হয়ে যাও তুমি দ্রুপদ রাজন।।
সহজে ক্ষত্রিয় জাতি, ক্ষমা নাহি মনে।
দেশে নাহি গেল রাজা অতি অভিমানে।।
মাকন্দীনগরে বৈসে ভাগীরথী-তীরে।
তথায় রহিল দুঃখ ভাবিয়া অন্তরে।।
দ্রোণেরে জিনিব আমি কেমন উপায়।
কুরুকুল আদি শিষ্য যাহার সহায়।।
বলেতে নহিব শক্ত দ্রোণের সংহতি।
এই মনে চিন্তে সদা দ্রুপদ-ভূপতি।।
ধৃতরাষ্ট্র-পুত্র দুষ্টমতি দুর্য্যোধন।
আমারে সভাতে নিল করিয়া বন্ধন।।
দ্রোণ দুর্য্যোধন দুই বধের কারণ।
যজ্ঞ করিবারে দ্বিজ কৈল নিয়োজন।।
দ্বিজবাক্য মন্ত্র বিনা নাহিক উপায়।
এত ভাবি যজ্ঞ করে পাঞ্চালের রায়।।
অর্দ্ধেক পাঞ্চাল ভাগীরথীর দক্ষিণে।
তার অধিকারী হৈল দ্রুপদ রাজনে।।
অহিচ্ছত্র নামে ভূমি গঙ্গার উত্তর।
অর্দ্ধেক পাঞ্চালে দ্রোণ হইলা ঈশ্বর।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
একমনে শুনিলে বাড়য়ে দিব্যজ্ঞান।।
 

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র