মহাভারত:উদ্যোগপর্ব-০০৬-০১০

০৬. ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি বিদুরের নীতি উপদেশ
কহেন বৈশম্পায়ন, শুনহ রাজন।
সভা হৈতে উঠি যদি গেল দুর্য্যোধন।।
কারো বাক্য না শুনিল কুরু কুলাঙ্গার।
অধোমুখ হৈয়া তথা রহে দণ্ড চার।।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ আদি যত সভাজন।
সভা হৈতে উঠি সবে চলিল তখন।।
অদৃষ্ট মানিয়া সবে গেল নিজ স্থান।
বিদুর বলেন, ধৃতরাষ্ট্র বিদ্যমান।।
কুলক্ষয় হেতু দুর্য্যোধনের বিধান।
উত্তর বচনে তাহা হইল প্রমাণ।।
অর্দ্ধ রাজ্য ছাড়ি দেহ পাণ্ডুর নন্দনে।
নতুবা তোমার রাজ্য রহিবে কেমনে।।
আপনার হিত যদি রাঞ্ছন রাজন।
পাণ্ডবের সঙ্গে কর সম্প্রীতে মিলন।।
পূর্ব্বের কাহিনী কিছু কহিব তোমারে।
কত শত রাজা হয়েছিল এ সংসারে।।
আছিল উত্তানপাদ ধর্ম্ম-অবতার।
সপ্তদ্বীপা পৃথিবীতে যাঁর অধিকার।।
ইন্দ্রের সম্পদ তুল্য যাঁহার গণন।
জলবিম্ব প্রায় সব দেখিল রাজন।।
হিংসা হেন বস্তু তাঁর না জন্মিল মনে।
সকল ছাড়িয়া রাজা প্রবেশিল বনে।।
তপোযোগে আরাধিয়া পায় দিব্যগতি।
তাঁর পুত্র হৈল ধ্রুব জগতে সুকৃতি।।
যাঁহার মহিমা যশে পূরিল সংসার।
মহাধর্ম্মশীল ছিল ধর্ম্ম-অবতার।।
তদন্তরে সূর্য্যবংশে রঘুরাজা ছিল।
যাঁর যশ মহিমায় ভুবন ভরিল।।
অপার মহিমা যাঁর দিতে ‍নারে সীমা।
শৈত্যগুণে চন্দ্র যেন, ক্ষমাগুণে ক্ষমা।।
অতুল সম্পদ ভোগ করিল জগতে।
হিংসা হেন বস্তু কভু না করিল চিতে।।
এইরূপে কত রাজা চন্দ্র সূর্য্য কুলে।
নানা দান নানা যজ্ঞ করিল সকলে।।
তব পুত্র দুর্য্যোধন হয়েছে যেমন।
পৃথিবীতে হেন নাহি জন্মে কোন জন।।
কপটী হিংসক ক্রূর মহা দুষ্টমতি।
ইহার কারণে রাজা হইবে দুর্গতি।।
কুলক্ষয় হইবেক, লোকে উপহাস।
কুযশ ঘোষণা হবে, কলঙ্ক প্রকাশ।।
সে কারণে নরপতি মুন সাবধানে।
দ্বন্দ্ব না করিহ রাজা পাণ্ডবের সনে।।
ভীমের বিক্রম তুমি শুনিয়াছ কাণে।
যুদ্ধেতে করিল জয় যক্ষ রক্ষগণে।।
হিড়িম্ব কির্ম্মীর আর বক নিশাচর।
বাহুবলে সংহারিল কত বীরবর।।
মত্ত দশ সহস্র মাতঙ্গ বল ধরে।
গদাধারী মধ্যে সেই অজেয় সংসারে।।
ভীম ক্রুদ্ধ হৈলে বল রক্ষা হবে কার।
মুহূর্ত্তেকে সবাকারে করিবে সংহার।।
অর্জ্জুনের প্রতাপ যে অতুল ভুবনে।
বাহুযুদ্ধে পরাভব করে পঞ্চাননে।।
স্নেহ করি ইন্দ্র যারে স্বর্গ লয়ে গেল।
নানা অস্ত্র শস্ত্র বিদ্যা শিক্ষা করাইল।।
নিবাতকবচ কালকেয় দৈত্যগণ।
দেবের অবধ্য রিপু, প্রতাপে তপন।।
সবারে মারিয়া সন্তোষিল দেবগণে।
কোন্ বীর যুঝিবেক অর্জ্জুনের সনে।।
উত্তর গোগৃহ কথা শুনেছ শ্রবণে।
একেশ্বর ধনঞ্জয় সবাকারে জিনে।।
পরকার্য্য হেতু কারে না মারিল প্রাণে।
তথাপিহ জ্ঞান না জন্মিল দুর্য্যোধনে।।
আপনার মৃত্যু বুঝি বাঞ্ছিল আপনে।
পাণ্ডবের সহ দ্বন্দ্ব ইচ্ছা করে মনে।।
এখন যে হিত কহি, শুনহ রাজন।
দূত পাঠাইয়া দেহ বিরাট ভবন।।
সম্প্রীতে এখানে আন পাণ্ডুর কুমার।
সেই ইন্দ্রপ্রস্থে পুনঃ দেহ অধিকার।।
এ কর্ম্ম উচিত তব, দেখি হে রাজন।
দ্বন্দ্ব হৈলে হইবেক সবার নিধন।।
ধৃতরাষ্ট্র বলে, ভাই কহিলে প্রমাণ।
সম্প্রীতি করিয়া আন পাণ্ডুর নন্দন।।
যেই সত্য করেছিল পাণ্ডুর কুমার।
ধর্ম্মবলে তাহে ভাই হৈলে তারা পার।।
আপন বিভাগ রাজ্য পাইতে উচিত।
দুর্য্যোধনে তুমি গিয়া বুঝাবে সুনীত।।
অন্ধ দেখি দুর্য্যোধন আমারে না মানে।
ধর্ম্মনীতি-শাস্ত্র তুমি বুঝাই আপনে।।
বিদুর বলিল, আমি কি বুঝাব নীত।
মম বাক্য নাহি শুনে বুঝে বিপরীত।।
পাশাকালে কহিলাম যে সব বিধান।
না শুনিল মম বাক্য করি অল্পজ্ঞান।।
এখন কহিয়া মম কিবা প্রয়োজন।
কহিবেক তাহা, যাহে লয় তার মন।।
বিদুর এতেক বলি বসে অধোমুখে।
ধৌম্য পুরোহিত তবে কহিল রাজাকে।।
মহামত্ত দুর্য্যোধনে আমি ভাল জানি।
সম্প্রীতে পাণ্ডবে নাহি দিবে রাজধানী।।
পূর্ব্বে যথা বলি বিরোচনের কুমার।
বাহুবলে পরাজিল সকল সংসার।।
সম্পদে হইয়া মত্ত না মানিল কারে।
জ্ঞাতি-বন্ধুজনে হিংসা করে অহঙ্কারে।।
বলিরে বান্ধিয়া হরি পাতালে রাখিয়া।
ইন্দ্রেরে ইন্দ্রত্ব পুনঃ দিলেন ডাকিয়া।।
সেই হরি পাণ্ডবের সহায় আপনি।
তাহার প্রসাদে প্রাপ্ত হবে রাজধানী।।
এত শুনি জিজ্ঞাসিল অম্বিকা-নন্দন।
কহ শুনি মুনিবর ইহার কারণ।।
কি কারণে বলি দ্বেষ কৈলা সুরগণে।
ইন্দ্রসহ বিবাদ বা করে কি কারণে।।
ধৌম্য বলে, সেই কথা কহিতে বিস্তার।
সংক্ষেপে কহিব কিন্তু, শুন সারোদ্ধার।।
উদ্যোগপর্ব্বের কথা অমৃত-সমান।
পাণ্ডবের উপাখ্যান অদ্ভূত কথন।।
শুনিলে অধর্ম্ম খণ্ডে, হরে ভবভয়।
পয়ার প্রবন্ধে কাশীরাম দাস কয়।।
০৭. বলি বামনোপাখ্যান
তবে ধৌম্য কহে, শুন অন্বিকা-নন্দন।
কহিব অপূর্ব্ব কথা, করহ শ্রবণ।।
আদি দৈত্য হিরণ্যকশিপু হিরণ্যাক্ষ।
মহাবলী প্রতাপে পাবক-সমকক্ষ।।
দিতির গর্ভেতে জাত কশ্যপ-ঔরসে।
জগতের মধ্যে দুষ্ট হইল বিশেষে।।
হিরণ্যকশিপু পুত্র বিখ্যাত জগতে।
সর্ব্ব শাস্ত্র বিচক্ষণ প্রহ্লাদ নামেতে।।
তার পুত্র বিরোচন বিখ্যাত ভুবন।
যারে বিড়ম্বিল আসি অদিতি নন্দন।।
ব্রাহ্মণরূপেতে আসি দান মাগি নিল।
সেইক্ষণে বিরোচন নিজ অঙ্গ দিল।।
ব্রাহ্মণের হেতু ত্যজে আপনার প্রাণ।
তাহার নন্দন হৈল বলি মতিমান।।
প্রতাপে প্রচণ্ড বলি, দেবের দুর্জ্জয়।
বাহুবলে স্বর্গ মর্ত্ত্য করিলেক জয়।।
জানিলেক শুক্র-গুরু স্থানে উপদেশে।
ছল করি দেবরাজ বাপেরে বিনাশে।।
পিতৃবৈরী হয় ইন্দ্র, শুনিয়া শ্রবণে।
সেইক্ষণে ডাকি আজ্ঞা দিল দৈত্যগণে।।
চতুরঙ্গ সৈন্য সহ সাজিল ত্বরিত।
ইন্দ্রের নগরে গিয়া হৈল উপনীত।।
বিবিধ বাদ্যের শব্দে পুরিল গগন।
দৈত্য-সৈন্য ব্যাপিলেক ইন্দ্রের ভব।।
শুনি দেবরাজ ক্রোধে লয়ে সৈন্যচয়।
বলির সহিত রণ করিল প্রলয়।।
দোঁহে বলবন্ত, দোঁহে সংগ্রামে প্রচণ্ড।
নানা অস্ত্র বৃষ্টি করে যেন যমদণ্ড।।
শেল শূল শক্তি জাঠি ভুসুণ্ডী মুদগর।
পরশু পট্টিশ গদা বিশাল তোমর।।
রুদ্র পশুপতি নানারূপ সব বাণ।
ইন্দ্রজাল ব্রহ্মজাল অস্ত্র খরশান।।
শিলীমুখ সূচীমুখ রুদ্রমুখ ক্ষুর।
পরস্পরে দুই জন বরিষে প্রচুর।।
যেন প্রলয়ের কালে মজাইতে সৃষ্টি।
দেবতা অসুরগণ করে বাণবৃষ্টি।।
বলিরে চাহিয়া ইন্দ্র বলে ক্রোধমন।
মোর হস্তে আজি তোর হইবে নিধন।।
এই দেখ অস্ত্র মোর ঘোর দরশন।
ইহার প্রহারে তোরে করিব নিধন।।
এত বলি ইন্দ্র অস্ত্র যুড়িল ধনুকে।
ক্ষণে অগ্নিবৃষ্টি হয় ধনুকের মুখে।।
শূণ্যেতে আইসে অস্ত্র উল্কার সমান।
অর্দ্ধচন্দ্র বাণে বলি করে দুইখান।।
অস্ত্র ব্যর্থ দেখি ইন্দ্র মনে পেয়ে লাজ।
শক্তি অস্ত্র হানে তার হৃদয়ের মাঝ।।
দুই বাণে বলি তাহা করে দুই খণ্ড।
বাহুবলে মায়াবলে বিন্ধিল প্রচণ্ড।।
সেই অস্ত্রাঘাতে ইন্দ্র হইল মূর্চ্ছিত।
মাতলি বাহুড়ি রথ পলায় ত্বরিত।।
কতক্ষণে দেবরাজ হন সচেতন।
মাতলিরে নিন্দা করি বলিল বচন।।
সম্মুখ সংগ্রাম মধ্যে বাহুড়িলি রথ।
পলাইয়া গেলি যেন নাহি দেখি পথ।।
মাতলি বলিল, মোরে নিন্দ অকারণ।
অবধান কর এই শাস্ত্র নিরূপণ।।
রথী মূর্চ্ছা দেখি রথ বাহুড়ে সারথি।
যুদ্ধশাস্ত্রে যোদ্ধাগণ কহে হেন নীতি।।
ইন্দ্র বলে, শীঘ্র তুমি বাহুড়াহ রথ।
বলিরে দেখাব আমি শমনের পথ।।
আজ্ঞামাত্রে রথ পুনঃ চালায় মাতলি।
হাতেতে পরিঘ নিল ইন্দ্র মহাবলী।।
পরিঘ এড়িল ইন্দ্র উপরে বলির।
মুকুট কুণ্ডল সহ কাটিলেন শির।।
রথ হৈতে ভুমে পড়ে বলি মহাবীর।
রুধিরে আবৃত তার সমস্ত শরীর।।
হাহাকার শব্দ করে যত সৈন্যগণ।
পলাইল সকলে, না রহে একজন।।
তবে দৈত্য সমবেত হয়ে কত জনে।
কান্ধে করি বলিরাজে নিল সেইক্ষণে।।
ক্ষীরসিন্ধু তীরে গেল সবে শুক্রস্থান।
মন্ত্রবলে শুক্র তারে দিল প্রাণদান।।
গুরুর প্রসাদে বলি পাইল জীবন।
বিধিমতে করে বলি গুরু আরাধন।।
গুরু আরাধিয়া বলি পায় দিব্যবর।
করিলেক শিক্ষা ব্রহ্ম-মন্ত্র ষড়ক্ষর।।
মহামন্ত্র পেয়ে তবে বিচারিল মনে।
অমর অজেয় আমি হব ত্রিভুবনে।।
এতেক ভাবিয়া বলি সত্বরে চলিল।
হিমালয় গিরিপরে তপ আরম্ভিল।।
করিল কঠোর তপ লোকে ভয়ঙ্কর।
পবন ভক্ষিয়া রহে সহস্র বৎসর।।
তপে তুষ্ট হয়ে বিধি অর্পিবারে বর।
আসিলেন বলি পাশে হংসের উপর।।
ডাকিয়া বলিরে কন দেব প্রজাপতি।
তপঃসিন্ধ হৈলে তুমি, শুন দৈত্যপতি।।
তোমার তপেতে তুষ্ট হইলাম আমি।
যেই বর মনে লয়, মাগি লহ তুমি।।
যদি বা দুষ্কর হয় সংসার ভিতর।
অঙ্গীকার করিলাম, দিব সেই বর।।
শুনিয়া কহিল বলি করিয়া প্রণতি।
বর দিবে যদি মোরে সৃষ্টি অধিপতি।।
অজেয় অমর হই ভুবন মণ্ডলে।
ত্রিভুবন রহে যেন মোর করতলে।।
স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতালেতে আছে যত জন।
কারো হাতে নাহি হবে আমার মরণ।।
মনোমত বর দিয়া যান প্রজাপতি।
তপোযোগ করি বলি করিল আরতি।।
শুভকাল সমুদিত ক্রমে হৈল তার।
সসৈন্যে সাজিয়া বলি গেল পুনর্ব্বার।।
ইন্দ্রের সহিত পুনঃ আরম্ভিল রণ।
দোঁহাকার রণকথা না হয় বর্ণন।।
গুরু আরাধিয়া বলি মহাবল ধরে।
যুদ্ধে পরাভব করে অদিতি-কুমারে।।
পবন শমন রুদ্র বরুণ তপন।
ইত্যাদি তেত্রিশ কোটি যত দেবগণ।।
যুদ্ধে পরাভব বলি করিল সবারে।
পলাইয়া দেবগণ গেল স্থানান্তরে।।
দেবের সকল কর্ম্ম লইল অসুরে।
নররূপে দেবগণ ভ্রমে মহীপরে।।
শুক্র গুরু আসি তবে উপদেশ দিল।
শত অশ্বমেধ বলি আরম্ভ করিল।।
মহাযজ্ঞ আরম্ভিল দৈত্যের ঈশ্বর।
নররূপে ভূমে রহে অমর নিকর।।
অদিতি পুত্রের দুঃখ হৃদয়ে চিন্তিল।
দেবের দেবত্ব জিনি বলি দৈত্য নিল।।
পুনরপি কোন রূপে নিজ রাজ্য পায়।
চিন্তিল অদিতি তবে না দেখি উপায়।।
মহাভারতের কথা সুধার লহরী।
সাধুগণ নিরন্তর শুনে কর্ণ ভরি।।
০৮. অদিতির তপস্যা ও বিষ্ণুর স্তব
হৃদে বিচারিল তবে দেবের জননী।
উপায় না দেখি আর বিনা চক্রপাণি।।
সংসারের হর্ত্তা কর্ত্তা দেব নারায়ণ।
বিশ্বস্রষ্টা পোষ্টা তিনি সংহার কারণ।।
তাঁহা বিনা এ বিপদে কে করিবে ত্রাণ।
তিনি ভক্তজনে কৃপা করেন প্রদান।।
বিনা তপে তুষ্ট নহিবেন ভগবান।
ভাবিয়া ক্ষীরোদকূলে করিল প্রস্থান।।
করিল কঠোর তপ দেবের জননী।
তিন দিনে খায় তবে তিনাঞ্জলি ‍ানি।।
অনন্তরে মাস মধ্যে খায় একবার।
তারপরে দেবমাতা থাকে অনাহার।।
ধ্যান অবলম্ব হেতু করে নিরূপণ।
ঊর্দ্ধদৃষ্টি রহে, মাত্র পবন অশন।।
তপেতে তাপিত হৈল এ তিন ভুবন।
দেখিয়া চিন্তিত হইলেন পদ্মাসন।।
দেবগণে ডাকি বলিলেন পিতামহ।
তপ পরীক্ষিতে শীঘ্র সকলেতে যাহ।।
ব্রহ্মার আজ্ঞায় ইন্দ্র আদি দেবগণ।
মায়ের সাক্ষাতে গেল পরীক্ষা কারণ।।
ইন্দ্র বলে, শুন মাতা মম নিবেদন।
আত্মাকে এতেক কষ্ট দেহ কি কারণ।।
আমা সবাকার দুঃখ অদৃষ্টে লিখন।
শুভকাল হৈলে দুঃখ হবে বিমোচন।।
অশুভ সময়ে কর্ম্ম ফল নাহি ধরে।
বেদের নিয়ম হেন শাস্ত্রের বিচারে।।
এক্ষণে অশুভকাল হইল আমার।
সে কারণে এত দুঃখ না হয় অনিবার।।
অদৃষ্টে থাকিলে দুঃখ না হয় খণ্ডন।
সে কারণে শুন মাতা মম নিবেদন।।
আত্মাকে এতেকক্লেশ দেহ কি কারণ।
তপ ত্যাগ করি মাতা স্থির কর মন।।
মাতৃহীন তনয়ের নাহি সুখলেশ।
সদাই দুঃখিত সেই, পায় নানা ক্লেশ।।
ধর্ম্মহীন জনে যেন ব্যর্থ উপার্জ্জন।
ভক্তিহীন জ্ঞানিজন যেন অকারণ।।
শ্রদ্ধাহীন শ্রাদ্ধ যেন, বীজহীন মন্ত্র।
শাস্ত্রহীন গুরু যেন, যোগহীন তন্ত্র।।
সে কারণে নিবেদন শুনহ জননী।
আপনার আত্মা রক্ষা করহ আপনি।।
তোমার প্রসাদে মাতা শুভ কাল হৈলে।
দৈত্যগণেরে মোরা জিনিব অবহেলে।।
এতেক বলিল যদি দেব সুরপতি।
ধ্যান ভঙ্গ করি মাতা চাহে ক্রোধমতি।।
নয়ন শ্রবণ হৈতে অগ্নি বহিরায়।
ভয় পেয়ে দেবগণ পলাইয়া যায়।।
ব্রহ্মার সাক্ষাতে গিয়া করে নিবেদন।
শুনি ব্রহ্মা চলিলেন সহ দেবগণ।।
ক্ষীরোদের কূলে গিয়া স্তুতি করিলেন।
তুষ্ট হয়ে নারায়ণ দর্শন দিলেন।।
নব জলধর জিনি অঙ্গের বরণ।
পীতবাস পরিধান রাজীবলোচন।।
আজানুলম্বিত বনমালা বিভূষিত।
নূপুর কঙ্কণ হার মুক্তা বিরাজিত।।
দিব্যমূর্ত্তি পুরোভাগে দেখি নারায়ণে।
করিলেন স্তুতি প্রণিপাত দেবগণে।।
স্তুতিবশে সুপ্রসন্ন হয়ে জগৎপতি।
দেবগণ প্রতি কহে মধুর ভারতী।।
শীঘ্র হবে তোমাদের দুঃখ বিমোচন।
যাহ নিজ স্থানে চলি যত দেবগণ।।
এত বলি, অন্তর্হিত হন নারায়ণ।
যথাস্থানে গেল ইন্দ্র আদি দেবগণ।।
অদিতি তপেতে তপ্ত এ তিন ভুবন।
প্রত্যক্ষ হইয়া হরি দেন দরশন।।
সজল জলদ যেন অঙ্গের বরণ।
কোটি শশী জিনি মুখ, রাজীবলোচন।।
কোকনদ কর পদ, অধর অতুল।
খগরাজ জিনি নাসা যেন তিলফুল।।
কাঞ্চন বরণ জিনি অম্বর শোভন।
আজানুলম্বিত বনমালা বিভূষণ।।
শ্রবণে কুণ্ডল দোলে, অতি শোভা করে।
দেখিয়া মানিল দেবী বিস্ময় অন্তরে।।
সাক্ষাতে দেখিয়া সেই কমললোচনে।
দণ্ডবৎ প্রণমিল ভক্তিযুত মনে।।
করযোড়ে স্তুতি তবে করিল বিস্তর।
জয় জয় নারায়ণ, দেব দামোদর।।
শিষ্টের পালক, নমো দুষ্ট বিনাশন।
নমো হয়গ্রীব মধুকৈটভ-মর্দ্দন।।
নমো আদি অবতার, মৎস্য কলেবর।
নমো কূর্ম্ম অবতার, নমস্তে ভূধর।।
নমস্তে বরাহরূপ মোহিনী আকৃতি।
অবতার শিরোমণি নমো জগৎপতি।।
তুমি ইন্দ্র, তুমি চন্দ্র, তুমি বৈশ্বানর।
আকাশ পাতাল তুমি দেব গদাধর।।
অন্তরীক্ষ নাভি তব, পাতাল চরণ।
পৃথিবী তোমার কটি, অস্থি গিরিগণ।।
তোমার বিভূতি এই সকল সংসার।
আত্মরূপে সর্ব্বস্থানে করিছ বিহার।।
পুরুষপ্রধান তুমি আদি নারায়ণ।
বিষম সঙ্কটে দেব করহ তারণ।।
এইরূপে স্তুতি করে দেবের জননী।
প্রসন্ন হইয়া কহিলেন চক্রপাণি।।
তোমার স্তবেতে তুষ্ট হইলাম আমি।
মনোনীত বর দিব, মাগি লহ তুমি।।
যদি বা অসাধ্য হয় ভুবন ভিতরে।
অঙ্গীকার করিলাম দিব তা তোমারে।।
ভক্ত যাহা বাঞ্ছা করে মম সন্নিধান।
দেই তারে, অবশ্য না করি আমি আন।।
ভকত-বৎসল আমি ভক্তের কারণে।
আত্মদান দিয়া তুষি সেই ভক্তজনে।।
সতী সাধ্বী গুণবতী বড় ভাগ্যবতী।
করিলে কঠোর তপ আমাতে ভকতি।।
সে কারণ বশ আমি হলেম তোমার।
বর ইচ্ছা আছে যদি, মাগ সারোদ্ধার।।
এত শুনি কহিলেন দেবের জননী।
যদি বর দিবে তবে দেব চক্রপাণি।।
নিষ্কন্টক করি দেহ মম পুত্রগণে।
ইন্দ্রের ইন্দ্রত্ব নিল অসুর দারুণে।।
ধরিয়া মানবরূপ মম পুত্রগণ।
সঙ্গোপনে মহীতলে করিছে ভ্রমণ।।
গুরু আরাধিয়া বলি মহাবল ধরে।
আমার তনয়গণে জিনিল সমরে।।
পুত্রদের কষ্ট আমি দেখিতে নারিনু।
তপস্যা করিয়া তাই তোমা আরাধিনু।।
দেহ মম পুত্রগণে নিজ অধিকার।
অসুরের অহঙ্কার করহ সংহার।।
দৈত্যারি পুণ্ডরীকাক্ষ শ্রীমধুসূদন।
এই বর আজ্ঞা মোরে কর নারায়ণ।।
এত শুনি শ্রীগোবিন্দ করে অঙ্গীকার।
তোমার গর্ভেতে আমি হব অবতার।।
ধরিয়া বামনরূপ ছলিব বলিরে।
তব পুত্রগণ পাবে নিজ অধিকারে।।
রাখিব অদ্ভূত কীর্ত্তি যাইব ধরণী।
এত শুনি কহে পুনঃ কশ্যপ রমণী।।
উপহার কর প্রভু হেন লয় মনে।
আমার গর্ভেতে তুমি জন্মিবে কেমনে।।
অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড তব এক লোমকূপে।
তোমার গর্ভেতে আমি ধরিব কিরূপে।।
যাঁর তত্ত্ব যোগিগণ না পায় উদ্দেশে।
সকল সংসার মুগ্ধ যাঁর মায়াবশে।।
তাঁহারে কিরূপে আমি করিব ধারণ।
হেন বুঝি উপহাস কর নারায়ণ।।
হাসিয়া কহেন হরি, উপহাস কেনে।
ভিন্ন ভাবে নাহি ভাবি আমি ভক্তজনে।।
ভক্তজন সবে পারে আমারে ধরিতে।
তুমি সতী সাধ্বী ভক্তি সাধিলে আমাতে।।
সে কারণে তব গর্ভে হব অবতার।
নিজালয়ে এবে ‍তুমি কর আগুসার।।
এত বলি নিজ স্থানে যান নারায়ণ।
প্রণমিয়া দেবমাতা করিল গমন।।
স্বামীরে কহিল দেবী এ সব কাহিনী।
শুনি হৃষ্ট হইল কশ্যপ মহামুনি।।
তবে কত দিন পরে দেব দামোদর।
করিলেন সুপবিত্র অদিতি-উদর।।
দিব্যরূপ ধরে তবে দেবের জননী।
দেখিয়া বিস্ময়াপন্ন হইলেন মুনি।।
জন্মিবেন নারায়ণ জানিয়া নিশ্চয়।
নানা স্তুতি করিলেন ঋষি মহাশয়।।
নমো নমো নারায়ণ অখিল পালক।
নমো যজ্ঞকায় হিরণ্যাক্ষ-বিনাশক।।
নমস্তে নৃসিংহরূপী দৈত্য বিনাশন।
নমো সর্ব্বময় নমো জগৎপালন।।
জগৎ নায়ক নমো নমো জগৎপতি।
নমো কূর্ম্ম অবতার মোহিনী আকৃতি।।
নমো যোগপরায়ণ নমো যোগরূপ।
নমো যোগপরায়ণ নমো যোগরূপ।
নমো জগৎপাতা তুমি, সবাকার ভূপ।।
নমো জগৎকর্ত্তা তুমি, নমো নারায়ণ।
সর্ব্বভূতে আত্মারূপে তোমার ভ্রমণ।।
তুমি সৃজ, তুমি পাল, করহ সংহার।
তোমার বিভূতি দেব সকল সংসার।।
শিষ্টের পালন কর, দুষ্টের সংহার।
সে কারণে মম ঘরে হৈলে অবতার।।
নমস্তে বামনরূপ আদি সনাতন।
এইরূপে স্তুতি করিলেন তপোধন।।
স্তুতিবশে সুপ্রসন্ন হয়ে পীতবাস।
কশ্যপের পুত্ররূপে হলেন প্রকাশ।।
অদিতির গর্ভে জন্ম লইলেন হরি।
সম্বরি বিরাট দেহ খর্ব্বমূর্ত্তি ধরি।।
জন্মমাত্র কহিলেন পিতারে কুমার।
ঝটিতে আমার কর ব্রাহ্মণ-সংস্কার।।
শুনিয়া কশ্যপ মুনি শুভক্ষণ ধরি।
আপন পুত্রেরে তবে দিলেন উত্তরী।।
কশ্যপেরে কহিলেন দেব নারায়ণ।
মহাযজ্ঞ করে বিরোচনের নন্দন।।
অসংখ্য অসংখ্য ধন দ্বিজে করে ‍দান।
সে কারণে তথা আমি করিব প্রয়াণ।।
মাগিয়া আনিব দান বলি দৈত্যেশ্বরে।
এত বলি চলিলেন বলির দুয়ারে।।
বলি রাজা যজ্ঞ করে বসি যজ্ঞস্থলে।
দ্বারে দেখি বামনেরে শুক্র গুরু বলে।।
অবধান কর বলি, বলিব বিশেষ।
এই যে বামন আসে বালকের বেশ।।
অদিতির গর্ভে জন্ম বিষ্ণু অবতার।
তোমারে ছলিতে করিয়াছে আগুসার।।
যে কিছু মাগিবে দান, না দিবে ইহারে।
এত শুনি বলি দৈত্য কহিলেন তাঁরে।।
না বুঝিয়া গুরু হেন কহ অকারণ।
স্বয়ং নারায়ণ যদি এই যে বামন।।
যাঁহার উদ্দেশে যজ্ঞ করি চিরকাল।
তিনি যদি ইনি, তবে কি ভাগ্য বিশাল।।
ব্রহ্মা আদি দেব যাঁর পূজয়ে চরণ।
উদ্দেশে মাগয়ে বর যত দেবগণ।।
সেই প্রভু আসে যদি আমার আলয়।
তবে গুরু অতিগুরু মম ভাগ্যোদয়।।
যে কিছু মাগিবে দান, দিব তা নিশ্চয়।
ইহাতে বিরোধী কেন হও মহাশয়।।
ধর্ম্মকর্ম্মে বাধা দেও, অতি অনুচিত।
এত শুনি শুক্র গুরু হলেন দুঃখিত।।
শাপ দিল বলি দৈত্যে অতি ক্রোধভরে।
মম বাক্য না শুনিলে ধন-অহঙ্কারে।।
এই শাপে লক্ষ্মীভ্রষ্ট হবে এইক্ষণে।
এত বলি শুক্র গুরু গেল ক্রুদ্ধমনে।।
হেনকালে উপনীত হৈল নারায়ণ।
বামন আকৃতি রূপ অরুণ বরণ।।
দেখি যজ্ঞ হোতাগণ মানিল বিস্ময়।
উঠে করযোড়ে বিরোচনের তনয়।।
প্রণাম করিয়া দিল বসিতে আসন।
সভামধ্যে দ্বিজশিশু বসেন বামন।।
অপরূপ রূপধারী কশ্যাপ কুমার।
দেখি লোমাঞ্চিত বলি, সানন্দ অপার।।
কৃতাঞ্জলি করি স্তুতি করে মতিমান।
আজি যে সফল মম যাগ যজ্ঞ দান।।
আজি যে সফল জন্ম হইল আমার।
নারায়ণ আসিলেন আমার আগার।।
চাহ যাহা দিব তাহা, না হবে অন্যথা।
ত্রিভুবন চাহ যদি অর্পিব সর্ব্বথা।।
শুনিয়া কহেন হাসি কপট বামন।
বহু দানে আমার কি আছে প্রয়োজন।।
ব্রাহ্মণ-বালক আমি তপস্যা তৎপর।
গ্রামে ভূমে আমার কি কাজ দৈত্যেশ্বর।।
ধ্যানে তপে জপে মম যায় অনুক্ষণ।
মুনিকুলে জন্ম মোর, শুনহ রাজন।।
অরণ্যনিবাসী আমি ফলমূলাহারী।
সে কারণে কহি, শুন দৈত্য অধিকারী।।
যদি দিবে তুমি দান করিয়াছ মনে।
তিন পদ ভূমি দেহ মাপিয়া চরণে।।
তপ করিবারে চাহি বসিয়া তাহাতে।
ইহা ভিন্ন অন্য কিছু না চাহি তোমাতে।।
ভূমিদান সম ফল নাহি ত্রিভুবনে।
ভূমিদানের মাহাত্ম্য শুন নৃপমণে।।
সুঘোষ নামেতে এক আছিল ব্রাহ্মণ।
সৌভরি নগরবাসী দরিদ্র-লক্ষণ।।
ধনার্থে করিল বহু রাজ্য পর্য্যটন।
না মিলিল ধন তার অদৃষ্ট কারণ।।
ছয় পত্নী পুত্র পৌত্র বহু পরিজন।
উপার্জ্জক সেই মাত্র একাকী ব্রাহ্মণ।।
নিরন্তর ভিক্ষা মাগি আনয়ে ব্রাহ্মণ।
ভ্রমণ ব্যতীত নহে উদর ভরণ।।
এক দিন দ্বিজবর ভিক্ষায় না গেল।
আলস্য করিয়া নিজ গৃহেতে রহিল।।
অন্ন হেতু কান্দে তার যত শিশুগণ।
শুনিয়া হৃদয়ে তাপ পাইল ব্রাহ্মণ।।
আপনারে নিন্দা করি অনেক কহিল।
নিরর্থক জন্ম মোর জগতে হইল।।
ধনহীন মনুষ্যের জন্ম অকারণ।
মনুষ্যের মধ্যে কেহ না করে গণন।।
চণ্ডাল যবন আদি যত নীচ জাতি।
ধনাঢ্য হইলে পায় সর্ব্বত্র সুখ্যাতি।।
ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র যত জন।
ধনহীন হৈলে কেহ না করে গণন।।
ভার্য্যা পুত্র অরি হয়, মিত্র না আদরে।
ধনহীন হৈলে কিছু করিবারে নারে।।
এইমত চিন্তা করি কাতর ব্রাহ্মণ।
নগর ত্যজিয়া গেল লয়ে পরিজন।।
অবন্তী-নগরে বিপ্র করিল বসতি।
বৃত্তি দিয়া বিপ্রবরে স্থাপিল নৃপতি।।
সেই পুণ্যফলে অবন্তীর নরপতি।
দুই কল্প ইন্দ্র সহ করিল বসতি।।
সে কারণে অবধান কর দৈত্যেশ্বর।
ত্রিভুবনে নাহি ভূমি-দানের উপর।।
তিন পদ ভূমিমাত্র দান মাগি আমি।
ইহা দিয়া মোরে রাজা সন্তোষহ তুমি।।
বলি বলে, বামন হে বুঝি বল বাণী।
ত্রিপদে তোমার তৃপ্তি, তাহা নাহি মানি।।
এই দান দিতে মম চিত্তে নাহি আসে।
সংসারেতে অপযশ ঘুষিবে বিশেষে।।
অপযশ হৈতে মৃত্যু শ্রেষ্ঠমধ্যে গণি।
সে কারণে অবধান কর দ্বিজমণি।।
নগর চত্বর গ্রাম যাহা ইচ্ছা মনে।
সকল মাগিয়া দান লহ মম স্থানে।।
এত শুনি হাসি পুনঃ বলেন বামন।
ইহাতে আমার কিছু নাহি প্রয়োজন।।
অঙ্গীকার করি বলি কহে অনুচরে।
ভৃঙ্গারে ভরিয়া জল আনহ সত্বরে।।
হাতে জল করি বলি দান দিতে যায়।
দেখি দৈত্যগুরু তবে চিন্তিল উপায়।।
বজ্রকীটরূপে গুরু প্রবেশে ভৃঙ্গারে।
নল রুদ্ধ করে, জল যেন না নিঃসরে।।
ভৃঙ্গার ঢালিলা জল নাহি পড়ে হাতে।
দেখি বলি দৈত্যেশ্বর পড়িল লজ্জাতে।।
এ সকল তত্ত্ব জানিলেন নারায়ণ।
বলি প্রতি কহিলেন, শুনহ রাজন।।
ভৃঙ্গারের দ্বার মুক্ত কর কুশাঘাতে।
এত শুনি হাতে কুশ লইলা ত্বরিতে।।
বজ্রসম হৈল কুশ ঈশ্বর কৃপাতে।
নির্ঘাত বাজিল ভার্গবের চক্ষুপথে।।
দৈবের নির্ব্বন্ধ কভু না হয় খণ্ডন।
এক চক্ষু অন্ধ তার হৈল সেইক্ষণ।।
কাতর ভার্গবমুনি গেল নিজ স্থান।
বলি দৈত্য বামনেরে দিল ভূমিদান।।
দান পেয়ে হরি তবে নিজমূর্ত্তি ধরে।
মহাভয়ঙ্কর মূর্ত্তি হৈল কলেবরে।।
দেখিতে দেখিতে অঙ্গ বাড়ে ক্রমে ক্রমে।
মুহূর্ত্তেকে তনু গিয়ে ঠেকিলেক ব্যোমে।।
ত্রিভুবন যুড়ি তনু হইল বিস্তার।
জল স্থল সব স্থান হৈল একাকার।।
পৃথিবী সহিত হরি সকল নগর।
এক পায়ে ব্যাপিলেন দেব দামোদর।।
সপ্ত স্বর্গ ব্যাপিলেন আর এক পায়।
আর পা রাখিতে স্থল নাহিক কোথায়।।
ডাক দিয়া বলিরাজে বলে বনমালী।
চাহিলাম তব স্থানে তিন পদ স্থলী।।
দুই জদ ভূমিমাত্র পাইলাম আমি।
আর পদ রাখি কোথা, স্থান দেহ তুমি।।
এত শুনি বলে বিরোচনের নন্দন।
অঙ্গীকার পূর্ণ মম কর নারায়ণ।।
আমার মস্তকে পদ দেহ জগৎপতি।
নরক হইতে মোরে কর অব্যাহতি।।
এত শুনি ধন্যবাদ দিয়া নারায়ণ।
বলির মস্তকোপরি দিলেন চরণ।।
নানাবিধ মতে বলি পূজিল চরণ।
গরুড়েরে আজ্ঞা করিলেন নারায়ণ।।
বলিরে পাতালে লয়ে বান্ধে সেইক্ষণ।
সাধু সাধু ধন্যবাদ করে দেবগণ।।
ইন্দ্র আদি দেবগণ আসিয়া হরিষে।
হরিকে করিল স্তুতি অশেষ বিশেষে।।
ইন্দ্রেরে ইন্দ্রত্ব দিয়া দেব ভগবান।
অন্তর্হিত হয়ে যান আপনার স্থান।।
যাহা জিজ্ঞাসিলে রাজা কহিনু তোমারে।
সেইরূপ দুর্য্যোধন অহঙ্কার করে।।
ধনমদে মত্ত হয়ে নাহি মানে কারে।
না শুনে কাহার বাক্য, মত্ত অহঙ্কারে।।
অচিরেতে যুদ্ধে ক্ষয় হবে কুরুকূল।
কুরুকুল প্রতি দেখি বিধি প্রতিকূল।।
দুর্য্যোধন পাপে বংশ হইবেক ক্ষয়।
জানিহ নিশ্চয় এই শুন মহাশয়।।
ইহা বলি উঠিয়া সে ধৌম্য তপোধন।
পাণ্ডব সভাতে উত্তরিল সেইক্ষণ।।
ধৌম্যে দেখি আস্তে ব্যস্তে পঞ্চ সহোদর।
বসিতে দিলেন দিব্য সিংহাসনোপর।।
পাদ্য অর্ঘ্য দিয়া পূজি জিজ্ঞাসেন বাণী।
একে একে সব কথা কহে ধৌম্যমুনি।।
তোমার কারণে রাজা সকলে বুঝাল।
কারো বাক্য দুর্য্যোধন কর্ণে না শুনিল।।
অহঙ্কার করি আরো বলে কুবচন।
বিনা যুদ্ধে রাজ্য নাহি দিব কদাচন।।
যত শক্তি আছে তার কহিবে পাণ্ডবে।
লইবারে ধন রাজ্য জিনিয়া কৌরবে।।
এত শুনি পঞ্চ ভাই কহেন বচন।
কুলক্ষয় হেতু বিধি করিল সৃজন।।
মহাযুদ্ধে হইবেক, কুলের সংহার।
শুনিয়া চিন্তিত অতি ধর্ম্মের কুমার।।
মহাভারতের কথা অমৃত লহরী।
শুনিলে অধর্ম্ম খণ্ডে, তরে ভবতরি।।
ব্যাসের বচন ইথে নাহিক সংশয়।
পয়ার প্রবন্ধে কাশীরাম দাস কয়।।
০৯. ধৃতরাষ্ট্র কৃর্ত্তৃক পাণ্ডবগণের নিকটে সঞ্জয়কে প্রেরণ
জন্মেজয় জিজ্ঞাসিল কহ মুনিরাজ।
অতঃপর কি করিল অন্ধ-মহারাজ।।
মুনি বলে, নরপতি শুন একমনে।
কারো বাক্য দুর্য্যোধন না শুনিল কাণে।।
তাহাতে বিরক্ত হয়ে অন্ধ নৃপবর।
সঞ্জয়ের প্রতি তবে কহেন সত্বর।।
দেখিলে সঞ্জয় দুর্য্যোধনের দুষ্টতা।
না শুনিল না মানিল মহতের কথা।।
সে কারণে যাহ তুমি বিরাট-নগর।
মম আশীর্ব্বাদ দেহ পাণ্ডব গোচর।।
একে একে পঞ্চ জনে করিবে কল্যাণ।
বিনয় প্রণয় করি হয়ে সাবধান।।
দ্রৌপদীরে আশীর্ব্বাদ কহিবে আমার।
দৈবগতি দেখ এই সকল সংসার।।
দৈবে যাহা করে, তাহা কে খণ্ডিতে পারে।
পরম সুবুদ্ধি জ্ঞান দৈবে নষ্ট করে।।
সে কারণে মন্দবুদ্ধি হৈল দুর্য্যোধনে।
কপট করিয়া তোমা পাঠাইল বনে।।
রাজপুত্রী হয়ে তুমি রাজার মহিষী।
পাইলে অনেক কষ্ট অরণ্যে নিবসি।।
নানা দুঃখ পেয়ে তুমি করিলে যাপন।
সে সব স্মরিয়া সদা পোড়ে মম মন।।
দৈবের ঘটনে এত হৈল বিসম্বাদ।
মোরে দেখি কৌরবের ক্ষম অপরাধ।।
সতী সাধ্বী গুণবতী তুমি পতিব্রতা।
লক্ষ্মী-অবতার তুমি ধর্ম্ম-অনুরতা।।
এইরূপে দ্রৌপদীরে কহিবে বিনয়।
কদাচ আমার প্রতি ক্রোধ নাহি হয়।।
কহিবে পাণ্ডবগণে কাল অনুক্রমি।
পাইলে অনেক কষ্ট বনে বনে ভ্রমি।।
ত্রয়োদশ বর্ষাবধি তোমা পঞ্চ বিনে।
দহিছে আমার আত্মা চিন্তার আগুনে।।
তাপিত আমার মন, শান্ত নাহি হয়।
কাষ্ঠ ঘরষণে যথা হয় অগ্নিময়।।
অন্ন নাহি রুচে মম, নাহি রুচে নীর।
তোমা সবা বিচ্ছেদেতে চিত্ত নহে স্থির।।
নয়নে নাহিক নিদ্রা, ভোজনে না সুখ।
তোমা সবাকার দুঃখে বিদরিছে বুক।।
গান্ধারী সুবলসুতা তোমা সবা বিনে।
করে খেদ, বহে নীর সদাই নয়নে।।
বিদুর বাহ্লীক আর সোমদত্ত বীর।
তোমা সবা অভাবেতে সর্ব্বদা অস্থির।।
নগর-নিবাসী চারি জাতি প্রজাগণ।
তোমা সবা না দেখিয়া নিরানন্দ মন।।
হস্তিনার লোক যত দুঃখী রাত্রিদিন।
সদা দীন ক্ষীণ হেন জলহীন মীন।।
তোমার বিহনে রাজ্য শোভা নাহি পায়।
ফলহীন বৃক্ষ যেন জন্ম বৃথা যায়।।
জলহীন নদী যেন পদ্মহীন সর।
চন্দ্রহীন রাত্রি যেন ধর্ম্মহীন নর।।
জ্ঞানহীন জন যেন বীজহীন মন্ত্র।
বেদহীন বিপ্র যেন যোগহীন তন্ত্র।।
তোমা সবা বিহনেতে তথা প্রজাগণ।
এইরূপে বিনয়েতে কহিবে বচন।।
নানাবিধ অলঙ্কার দিব্য বস্ত্র লয়ে।
শীঘ্রগতি যাও পাণ্ডুপুত্রে দেখ গিয়ে।।
দ্রুতগামী অশ্ব রথে করি সংযোজন।
শুভলগ্ন তিথি আজি, করহ গমন।।
সঞ্জয় এতেক শুনি উঠি সেইক্ষণ।
যুড়ি খচরের রথ পবন-গমন।।
বিরাট নগর মধ্যে পাণ্ডুর কুমার।
সভা করি বসিয়াছে দেব অবতার।।
সঞ্জয় এ হেন কালে হন উপনীত।
দেখিয়া বিরাট তারে জিজ্ঞাসিল হিত।।
দিব্য রত্ন-সিংহাসন দিলেন বসিতে।
পাণ্ডবে সম্ভাষি দূত বসিল সভাতে।।
কহেন সঞ্জয় প্রতি ভাই পঞ্চজন।
সবার কুশল বার্ত্তা কহ বিবরণ।।
ধৃতরাষ্ট্র দ্রোণ ভীষ্ম বাহ্লীক নৃপতি।
জননী আমার কুন্তী গান্ধারী প্রভৃতি।।
এয়োদশ বর্ষকাল নাহি দরশন।
কেবা মরে, কেবা জীয়ে না জানি কারণ।।
কোথা হৈতে এই স্থানে তব আগমন।
জ্যেষ্ঠতাত পাঠাইল, এই লয় মন।।
কি কহিয়া পাঠাইল অম্বিকা-নন্দন।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ আর যত সভাজন।।
কি কহিল কর্ণ বীর রাধার কুমার।
দুর্য্যোধন কি বলে শকুনি দুরাচার।।
উভয় কুলের হিত সবে কি চিন্তিল।
সম্প্রীতি করিতে বুঝি তোমা পাঠাইল।।
যেই সত্য করিলাম তোমার অগ্রেতে।
তাহাত হইনু মুক্ত ধর্ম্মের কৃপাতে।।
সর্ব্বধর্ম্ম মূল হরি ব্রহ্ম সনাতন।
তাঁহার কৃপায় হৈল সঙ্কটে তারণ।।
এত দুঃখ পেয়ে তবু রাখিলাম ধর্ম্ম।
সবে সুখে আছেন, সবার মূল কর্ম্ম।।
সমুচিত ভাগ যেই হয়ত আমার।
তাহা ছাড়ি দিতে করিয়াছে কি বিচার।।
আমারে বিভাগ দিতে কৌরব কি চাহে।
সম্প্রীতে না দিবে, কিম্বা মজিবে কলহে।।
কহত সঞ্জয় তুমি সব বিবরণ।
সঞ্জয় শুনিয়া তবে করে নিবেদন।।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ আর বাহ্লীক নৃপতি।
সম্প্রীতি করিতে সবে দিল অনুমতি।।
কারো বাক্য না শুনিল কৌরব দুর্ম্মতি।
অনেক সান্ত্বনা করে অন্ধ নরপতি।।
ভীষ্ম মুখে শুনি তোমা সবার উদয়।
আনন্দিত সকলের হইল হৃদয়।।
চারি জাতি নগরেতে যত প্রজাগণ।
বার্ত্তা পেয়ে হৃষ্টচিত্ত হৈল সর্ব্বজন।।
মৃতের শরীরে যেন ‍পাইল জীবন।
তোমা সবা সমাচারে যত প্রজাগণ।।
সুহৃদ অমাত্য জ্ঞাতি যত বন্ধুজন।
সদা হাহাকার শব্দে করিত রোদন।।
ডাকিত পাণ্ডব বলি সদা ঊর্দ্ধমুখে।
তোমা সবা না দেখিয়া অন্ধ ছিল ‍দুঃখে।।
আত্মার বিহনে যথা না রহে জীবন।
তোমা সবা বিরহেতে তথা সর্ব্বজন।।
এয়োদশ বর্ষাবধি যত প্রজাগণ।
সুখলেশ নাহি কার জীয়ন্তে মরণ।।
এবে সমাচার শুনি তোমা সবাকার।
দেখিতে উদ্বেগচিত্ত, আনন্দ অপার।।
তোমা পঞ্চ ভাই যবে গেলে বনবাসে।
বিনা মেঘে নগরেতে রুধির বরিষে।।
দিবসে ডাকয়ে শিবা অতি কুলক্ষণ।
উল্কাপাত আদি শব্দ হয় ঘনে ঘন।।
সেইক্ষণে ধূমকেতু প্রকাশে আকাশে।
অশ্ব হস্তী পশুগণ কান্দে চারিপাশে।।
এই অলক্ষণ দেখি বলে জ্ঞানী জন।
কুলক্ষয় হৈল রাজা তোমার কারণ।।
অতি কুলক্ষণ রাজা দেখি শাস্ত্রমতে।
এখন উপায় কর, যদি লয় চিতে।।
দিনে দিনে অলক্ষণ দেখ নৃপমণি।
পৃথিবী হরিল শস্য, মেঘে অল্প পানি।।
সে কারণে নরপতি মম বাক্য ধর।
আপন কুলের হিত যদি বাঞ্ছা কর।।
বাহুড়িয়া আন পঞ্চ পাণ্ডুর কুমার।
সেই ইন্দ্রপ্রস্থে পুনঃ দেহ অধিকার।।
তবে সে মঙ্গল হয় প্রজার কল্যাণ।
এরূপে পূর্ব্বেতে কহে যত জ্ঞানবান।।
পুত্রবশ ধৃতরাষ্ট্র শুনি না শুনিল।
সেই কাল আসি রাজা উপস্থিত হৈল।।
উত্তর গোগৃহে যুদ্ধে যত কুরুগণে।
অপমান করিলেক ধনঞ্জয় রণে।।
ভগ্নদণ্ড হয়ে আসে কৌরবের পতি।
ভীষ্ম দ্রোণ ধৃতরাষ্ট্র বুঝাইল নীতি।।
অনেক দৃষ্টান্ত দিয়া কহিল বচন।
কারো বাক্য না শুনিল রাজা দুর্য্যোধন।।
পরে ধৌম্য পুরোহিত তোমার আদেশে।
শাস্ত্র উপদেশ কহি বুঝাল বিশেষে।।
অনাদর করি তাহা না শুনিল কানে।
শুনিয়া থাকিবে তাহা ধৌম্যের সদনে।।
কারো কথা দুর্য্যোধন যবে না শুনিল।
আমারে ডাকিয়া অন্ধরাজ পাঠাইল।।
এই রত্ন ধন দিল বস্ত্র অলঙ্কার।
পুনঃ পুনঃ বহু কথা কহে বার বার।।
কহিব সে সব কথা শুনহ রাজন।
এয়োদশ বর্ষ তব না ছিল মিলন।।
পাইলে অনেক কষ্ট ভ্রমি বনে বন।
সে সকল মনে নাহি কর কদাচন।।
কপটী কুমন্ত্রী কর্ণ আর দুঃশাসন।
সৌবল শকুনি আর রাজা দুর্য্যোধন।।
তা সবার কপটেতে হৈল সর্ব্বনাশ।
তোমা সবে বনে গেলে, আমরা নিরাশ।।
অন্ধ দেখি দুর্য্যোধন আমারে না মানে।
যতেক কহি যে আমি, না শুনে শ্রবণে।।
আমার বচন সেই নাহি লয় মনে।
কর্ণ দুঃশাসন বাক্য শুধুমাত্র শুনে।।
কালেতে কুবুদ্ধি হয়, কে করিবে আন।
ইত্যাদি বলিল ধৃতরাষ্ট্র বর্ত্তমান।।
দুর্য্যোধন রাজ্য ছাড়ি দিতে নাহি চায়।
যেই চিত্তে আসে, তাহা কর ধর্ম্মরায়।।
ইহা শুনি পুনরাপি কহে পঞ্চ জন।
কহ শুনি কি বলিল রাজা দুর্য্যোধন।।
কি বলিল কর্ণবীর রাধার নন্দন।
সত্য করি বল তাহা, শুনি দিয়া মন।।
সঞ্জয় কহিছে, শুন পাণ্ডুর কুমার।
কহিল নিষ্ঠুর দুর্য্যোধন দুরাচার।।
বিনা যুদ্ধে রাজ্য নাহি আমি দিব তারে।
কোন্ শক্তি তার, মোরে জিনিবারে পারে।।
মহা মহা বীরগণ আমার সহায়।
মুহূর্ত্তেকে পাণ্ডবেরা হবে পরাজয়।।
সত্য সত্য সুনিশ্চয় করি যুদ্ধপণ।
এইরূপে কহে কথা রাজা দুর্য্যোধন।।
রাধেয় করিয়া দম্ভ কহিল বিস্তর।
কার শক্তি মোর সঙ্গে করিবে সমর।।
যেবা ধনঞ্জয় আছে সংগ্রামে প্রখর।
প্রথমে যুদ্ধেতে তারে মারিব সত্বর।।
তারে মারি চারি জনে রাখিব বান্ধিয়া।
নিষ্কন্টকে রাজ্য কর নির্ভয় হইয়া।।
এইরূপে কহিলেন রাধেয় দুর্ম্মতি।
চিত্তে যাহা আসে তাহা কর নরপতি।।
নিশ্চয় হইবে রণ নহে নিবারণ।
বুঝিয়া করহ কার্য্য ভাই পঞ্চ জন।।
পৃথিবীতে বসে যত রাজরাজেশ্বর।
যুদ্ধ হেতু বরিবারে পাঠাইল চর।।
নানা অস্ত্র শস্ত্র রথ সামগ্রী বিস্তর।
দুর্য্যোধন আদেশেতে করে অনুচর।।
শুনিয়া সঞ্জয়-বাক্য ধর্ম্মের নন্দন।
ক্রোধেতে কম্পিত অঙ্গ অরুণ-লোচন।।
যাহত সঞ্জয় পুনঃ মম দূত হয়ে।
যাহা কহি, কৌরবেরে কহিবে বুঝায়ে।।
ধৃতরাষ্ট্র জ্যেষ্ঠতাত, তাঁর উপরোধ।
সে কারণে পূর্ব্ব হৈতে না করিনু ক্রোধ।।
সেই হেতু এত দিন রহিল জীবন।
আপনার মৃত্যু বুঝি চাহিছে এখন।।
পূর্ব্বে যেই সত্য ছিল মুক্ত হই তাহে।
তবে কেন রাজ্য মম নাহি দিতে চাহে।।
মৃত্যু শ্রেয়ঃ সে বুঝিল, বুঝি অনুমানে।
সে কারণে যুদ্ধ করিবার ইচ্ছা মনে।।
অল্পকার্য্যে জ্ঞাতিবধে নাহি প্রয়োজন।
আপনার মান রক্ষা কর দুর্য্যোধন।।
সমুচিত ভাগ যেই শাস্ত্র নিরূপণে।
তাহা দিয়া বশ কর আমা পঞ্চ জনে।।
নহিলে প্রলয় বড় হবে কুলক্ষয়।
এইরূপে কৌরবেরে কহিও নিশ্চয়।।
তবে ভীমসেন কহে ক্রোধ করি মনে।
বলিও আমার বার্ত্তা কৌরব রাজনে।।
হিমাদ্রি ত্যজয়ে ধৈর্য্য সূর্য্য না প্রকাশে।
অনল শীতল হয়, সপ্ত সিন্ধু শোষে।।
নক্ষত্র সহিত শশী ত্যজয়ে আকাশ।
পূর্ণিমার চন্দ্র যদি না হয় প্রকাশ।।
যোগী যোগ ত্যজে, ধর্ম্ম ত্যজে ধর্ম্মিজন।
গায়ত্রী বিহীন হয় ব্রাহ্মণ-নন্দন।।
তথাপি প্রতিজ্ঞা মম না হবে খণ্ডন।
ঊরু ভাঙ্গি দুর্য্যোধনে করিব নিধন।।
প্রতিজ্ঞা করেছি পূবের্ব সভা বিদ্যমানে।
এখন সঞ্জয় কহিলাম তব স্থানে।।
দুর্য্যোধন লয় যদি ধর্ম্মের শরণ।
যতেক প্রতিজ্ঞা মম সব অকারণ।।
মোর হাতে সব ভাই রক্ষা পাবে তবে।
এই কথা বুঝাইয়া কহিবে কৌরবে।।
অবশ্য আমার হাতে হইবে নিধন।
যত দুঃখ ‍পাইলাম আছে যে স্মরণ।।
এই সব দুঃখে অঙ্গ হতেছে দহন।
সেই সব দুঃখভরে সদা পোড়ে মন।।
সভামধ্যে দ্রৌপদীর অপমান কৈল।
দেখিয়া অন্ধের মুখ সকলি সহিল।।
সেই সব অগ্নিপ্রায় জ্বলিছে অন্তরে।
ধর্ম্ম আজ্ঞা দিলে যেত শমনের ঘরে।।
রাজ্য ভাগ ছাড়ি দিতে বলিও আমারে।
নতুবা সবংশে নিজে যাবে ছারখারে।।
এরূপে কহিবে তুমি রাজা দুর্য্যোধনে।
দুঃশাসন কর্ণিআদি যত কুরুগণে।।
এত বলি নিবর্ত্তিল পবন-তনয়।
বলেন সঞ্জয় প্রতি তবে ধনঞ্জয়।।
কহিবে অন্ধেরে তুমি মম নমস্কার।
তোমা বিদ্যমান দুঃখ পাইনু অপার।।
কৌরবের পতি তুমি, কৌরবের গতি।
তোমা বিনা কুরুকুলে নাহি অব্যাহতি।।
আমার বিভাগ রাজ্য দেহ অবিকল।
অল্প হেতু জ্ঞাতিবধে নাহি কোন ফল।।
তুমি যদি আজ্ঞা কর আমারে রাজন।
আপনার রাজ্য গিয়া লই এইক্ষণ।।
তবে যদি দ্বন্দ্ব করে মূর্খ দুর্য্যোধন।
আমি দ্বন্দ্ব কদাচ না করিব রাজন।।
সমর করিলে তবু প্রাণে না মারিব।
আজ্ঞা কর যদি, তারে বান্ধিয়া রাখিব।।
বলিকে বান্ধিয়া যথা ইন্দ্র রাজ্য করে।
তব হিত হেতু রাজা কহি যে তোমারে।।
এইমত যদি নাহি কর কদাচিত।
তব হিত হেতু রাজা কহি যে তোমারে।।
এইমত যদি নাহি কর কদাচিত।
বংশের সহিত তবে মজিবে নিশ্চিত।।
এইরূপে মম কথা কহিবে অন্ধেরে।
না শুনিলে পুনরপি কহিবে তাঁহারে।।
বাতাপি পক্ষীর কথা শুনেছি কথন।
সেইরূপ ধৃতরাষ্ট্র তব আচরণ।।
মুখেতে সৌজন্য কথা অন্তরেতে আর।
তোমার কপটে বংশ হৈবে ছারখার।।
এই শুনি ধনঞ্জয়ে জিজ্ঞাসে সঞ্জয়।
বাতাপি পক্ষীর কথা কহ মহাশয়।।
পক্ষিযোনি হয় হিংসা কৈল কি কারণ।
শুনিবারে ইচ্ছা হয়, কহ বিবরণ।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।
১০. বাতাপি পক্ষীর ইতিহাস
অর্জ্জুন কহেন, শুন পূর্ব্বের কাহিনী।
তপস্যা করিতে যবে গেল খগমণি।।
করিয়া কঠোর তপ বিষ্ণু আরাধিল।
মনোনীত বর পেয়ে নিবর্ত্তি আসিল।।
ঋষ্যমূক পর্ব্বতেতে আসে খগেশ্বর।
ঋষ্য নামে রাজা সেই গিরির ঈশ্বর।।
তার ভার্য্যা রূপবতী পরমা সুন্দরী।
সদা স্বামীসেবা করে পুত্র বাঞ্ছা করি।।
কতদিনে অপুত্রক মরে নরপতি।
স্বামীশোক শোকাকুলা ভার্য্যা গুণবতী।।
একাকিনী বনমধ্যে করেন ক্রন্দন।
ক্রন্দনের শব্দ শুনি বিনতা-নন্দন।।
কামরূপী বিহঙ্গম নানা মায়া জানে।
ধরিয়া মনুষ্যরূপ গেল তার স্থানে।।
দিব্যরূপে হইলেন দেবের লক্ষণ।
দেখি কামিনীর রূপ মোহে সেইক্ষণ।।
দৈব্যের নিবর্বন্ধ কভু না যায় খণ্ডন।
দেখিয়া কন্যার রূপ বিনতা-নন্দন।।
মদন মোহন বাণে হয়ে জর জর।
কন্যারে কহিল তবে বিনয় উত্তর।।
একাকী রোদন কর কিসের কারণ।
কার কন্যা তুমি, তব পতি কোন্ জন।।
নিজ পরিচয় মোরে কহ সুবদনি।
এত শুনি কহে কন্যা যুড়ি দুই পাণি।।
যক্ষবংশে জন্ম মম বিখ্যাত ভুবনে।
ঋষ্য নামে রাজা ছিল এইত কাননে।।
পুত্রবাঞ্ছা করি তপ করিল রাজন।
পুত্র না হইল, তাঁর হইল মরণ।।
রাজা হয়ে রাজ্য রাখে, বংশে কেহ নাই।
দুঃখানলে পুড়ে মন, কাঁদি আমি তাই।।
গরুড় কহিল, শোক না কর অন্তরে।
আজি জন্মাইব পুত্র তোমার উদরে।।
তোমাকে দেখিয়া মন মজিল আমার।
কামানলে দহে অঙ্গ করহ উদ্ধার।।
এত শুনি কহে কন্যা করি যোড়পাণি।
কৃপা যদি কৈলে তবে শুন খগমণি।।
শত পুত্র দান দেহ তোমার ঔরসে।
মহাবলবন্ত যেন হয়ত বিশেষে।।
কন্যার বচনে খগ অঙ্গীকার কৈল।
দ্বাদশ বৎসর ক্রীড়া আনন্দে করিল।।
কতদিনে ঋতুযোগে হৈল গর্ভবতী।
এককালে শত ডিম্ব প্রসবিলা সতী।।
সুশীলা নামেতে তার আছিল সতিনী।
সেবাবশে পরিতুষ্ট হয়ে খগমণি।।
স্বধর্ম্ম বুঝিয়া তারে করিল রমণ।
ঋতুযোগে গর্ভবতী হৈল সেইক্ষণ।।
দুইগুটি ডিম্ব সেই কন্যা প্রসবিল।
কত দিনে ডিম্ব দুটি ফুটিয়া উঠিল।।
সুশীলার গর্ভে হৈল যুগল নন্দন।
একজন অন্ধ হৈল দৈব নিবন্ধন।।
অন্ধক বলিয়া নাম রাখিল তাহার।
মহাবলবন্ত হৈল দ্বিতীয় কুমার।।
মনষ্যের প্রায়, যেন পক্ষীর আকৃতি।
জটায়ু তাহার নাম রাখে খগপতি।।
রূপবতী পুত্র হৈল মহাবলধর।
তেজঃপুঞ্জ সুগঠন পরম সুন্দর।।
প্রধান পুত্রের নাম রাখিল কুবল।
তারে ‍রাজা করিল গরুড় মহাবল।।
ছত্রদণ্ড দিয়া তারে স্থাপিলা রাজ্যেতে।
কত দিনে গেল পক্ষী সুমেরু পর্ব্বতে।।
পবনের সহ তথা বিবাদ হইল।
বহুকাল খগেশ্বর তথায় রহিল।।
হেথা সব নাগগণ পেয়ে অবসর।
ঋষ্যমূক পর্ব্বতেতে আসিয়া সত্বর।।
কুবল পক্ষীর রাজা, গরুর কোঙর।
তার সঙ্গে যুদ্ধ হৈল শতেক বৎসর।।
শত ভাই সহ তারে করিল সংহার।
দেখিয়া অন্ধক পক্ষী করিল বিচার।।
ভ্রাতৃসহ নিল নাগগণের শরণ।
অভয় তাহারে দিল যত নাগগণ।।
অন্ধকেরে রাজা করি স্থাপিয়া রাজ্যেতে।
স্বগণ সহিত নাগ গেল পাতালেতে।।
কতদিনে খগেশ্বর আসিল তথায়।
পুত্রগণ মৃত্যু শুনি ক্রোধে কম্পকায়।।
সেই দোষে মারে বীর বহু নাগগণে।
ব্রহ্মা আসি শান্ত কৈল বিনতা-নন্দনে।।
জটায়ু ধার্ম্মিক হৈল তপস্বী আচার।
তাহার ঔরসে হৈল ‍যুগল কুমার।।
শুক সারি নাম ‍রাখে পক্ষীর প্রধান।
পরম সুন্দর হৈল মহাবলবান।।
অন্ধক-ঔরসে হৈল সহস্র কুমার।
মহাবলবন্ত হৈল, পক্ষীর আকার।।
প্রথম পুত্রের নাম বাতাপি রাখিল।
শুভক্ষণ দেখি তারে রাজ্যপথ দিল।।
মহাবলবন্ত হৈল পক্ষীর প্রধান।
গরুড়-বংশের কথা অদ্ভূত আখ্যান।।
কোটি কোটি পক্ষী জন্মে তাহার ঔরসে।
সব জ্ঞাতিগণে পালে ধর্ম্ম-উপদেশে।।
অন্তরে কপট তার, কেহ নাহি জানে।
মহাবুদ্ধিমন্ত বলি সবে তারে মানে।।
চিন্তিয়া বাতাপি পক্ষী বলে মহাবলী।
সব নাগগণ সঙ্গে করিয়া মিতালি।।
তাহার আশ্বাসে মুগ্ধ নাগরাজ-বংশে।
নিরন্তর বলে ছলে পক্ষিগণে-হিংসে।।
শুক-সারি দুই ভাই ছিল বুদ্ধিমন্ত।
জানিল বাতালি পক্ষী জ্ঞাতিগণ অন্ত।।
এতেক চিন্তিয়া দোঁহে সত্বরে চলিল।
হিমাদ্রির তটে গিয়া তব আরম্ভিল।।
করিয়া কঠোর তপ পূজি পঞ্চাননে।
মনোনীত বর পেয়ে ভাই দুই জনে।।
আসিয়া সকল শত্রু করিল বিনাশ।
কহিলাম তোমারে এ পক্ষী ইতিহাস।।
সেইরূপ ধৃতরাষ্ট্র করে আচরণ।
মুহূর্ত্তেকে সবংশেতে হইবে নিধন।।
অহিংসকে হিংসে যেই, দৈবে তারে হিংসে।
তার দোষে বাতি দিতে না থাকিবে বংশে।।
সঞ্জয় এতেক শুনি হৈল হৃষ্টমন।
কহিতে লাগিল পরে অন্য সর্ব্ব জন।।
সহদেবও নকুল বিরাট নৃপতি।
শিখণ্ডী, দ্রুপদ, ধৃষ্টদ্যুন্ন মহামতি।।
কহিবে অন্ধেরে আমা সবা নিবেদন।
সম্প্রীতে ছাড়িয়া রাজ্য দেহ তা রাজন।।
সম্প্রীতে না দিলে দুঃখ পাইবে পশ্চাতে।
সবংশে মজিবে রাজা, কহিনু নিশ্চিতে।।
এরূপে কহিল তথা যত বীরগণ।
সবারে সম্ভাষি তবে সূতের নন্দন।।
মেলানি মাগিয়া ধর্ম্মে আরাহিয়া রথে।
গিয়া সব নিবেদিল অন্ধের সাক্ষাতে।।
শুনিয়া নৃপতি নাহি নহে ভাল মন্দ।
চিত্তেতে আকুল হয়ে সদা ভাবে অন্ধ।।
নমো প্রভু নীলমণি বনমালাধারী।
নমো ব্রহ্ম-অবতার দারুরূপ হরি।।
দারুরূপে পূর্ণব্রহ্ম নীলাচলে বাস।
তাঁহার চরণ চিন্তি কহে কাশীদাস।।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র