শ্রীমদ্ভগবতগীতার চতুর্দশ অধ্যায়ের সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

পরমেশ্বর ভগবান বললেন- পুনরায় আমি তোমাকে সমস্ত জ্ঞানের মধ্যে সর্বোত্তম জ্ঞান সম্বন্ধে বলব, যা জেনে মুনিগণ এই জড় জগৎ থেকে পরম সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। এই জ্ঞান আশ্রয় করলে জীব অমার পরা প্রকৃতি লাভ করে। তখন আর সে সৃষ্টির সময়ে জন্ম গ্রহণ করে না এবং প্রলয়কালেও ব্যথিত হয় না। হে কৌন্তেয়! সকল যোনিতে যে সকল মূর্তি প্রকাশিত হয়, ব্রহ্মরুপী যোনিই তাদের জননী স্বরুপা এবং আমি তাদের বীজ প্রদানকারী পিতা। হে মহাবাহো! জড়া প্রকৃতি থেকে জাত সত্ত্ব, রজ: ও তম-এই তিনটি গুণ এই দেহের মধ্যে অবস্থিত অব্যয় জীবকে আবদ্ধ করে। হে নিষ্পাপ! এই তিনটি গুণের মধ্যে সত্ত্বগুণ নির্মল হওয়ার ফলে প্রকাশকারী ও পাপশূন্য এবং সুখ ও জ্ঞানের সঙ্গের দ্বারা জীবকে আবদ্ধ করে। হে কৌন্তেয়! রজোগুণ অনুরাগাত্মক এবং তা তৃষ্ণা ও আসক্তি থেকে উৎপন্ন বলে জানবে এবং সেই রজোগুণই জীবকে সকাম কর্মের আসক্তির দ্বারা অবদ্ধ করে। হে ভারত! অজ্ঞানজনিত তমোগুণকে সমস্ত জীবের মোহনকারী বলে জানবে। সেই তমোগুণ প্রমাদ, আলস্য ও নিদ্রার দ্বারা জীবকে আবদ্ধ করে। হে ভারত! সত্ত্বগুণ জীবকে সুখে আবদ্ধ করে, রজোগুণ জীবকে সকাম কর্মে আবদ্ধ করে এবং তমোগুণ প্রমাদে আবদ্ধ করে। হে ভারত! রজ ও তমোগুণকে পরাভূত করে সত্ত্বগুণ প্রবল হয়, সত্ত্ব ও তমোগুণকে পরাভূত করে রজোগুণ প্রবল হয় এবং সেভাবেই সত্ত্ব ও রজোগুণকে পরাভূত করে তমোগুণ প্রবল হয়। যখন এই দেহের সব কয়টি দ্বারে জ্ঞানের প্রকাশ হয়, তখন সত্ত্বগুণ বর্ধিত হয়েছে বলে জানবে। হে ভরতশ্রেষ্ঠ! রজোগুণ বর্ধিত হলে লোভ, প্রবৃত্তি, কর্মে উদ্যম ও দুর্দমনীয় স্পৃহা বৃদ্ধি পায়। হে কুরুনন্দন! তমোগুণ বর্ধিত হলে অজ্ঞান-অন্ধকার, নিষ্ক্রয়তা, প্রমাদ ও মোহ উৎপন্ন হয়। যখন সত্ত্বগুণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত কালে দেহধারী জীব দেহত্যাগ করেন, তখন তিনি মহর্ষিদের নির্মল উচ্চতর লোকসমুহ লাভ করেন। রজোগুণে মৃত্যু হলে কর্মাসক্ত মনুষ্যকুলে জন্ম হয়, তেমনই তমোগুণে মৃত্যু হলে পশুযোনিতে জন্ম হয়। সুকৃতি-সম্পন্ন সাত্ত্বিক কর্মের ফলকে নির্মল , রাজসিক কর্মের ফলকে দু:খ এবং তামসিক কর্মের ফলকে অজ্ঞান বা অচেতন বলা হয়। সত্ত্বগুণ থেকে জ্ঞান, রজোগুণ থেকে লোভ এবং তমোগুণ থেকে অজ্ঞান, প্রমাদ ও মোহ উৎপন্ন হয়। সত্ত্বগুণ-সম্পন্ন ব্যক্তিগণ উর্ধ্বে উচ্চতর লোকে গমন করে, রজোগুণ-সম্পন্ন ব্যক্তিগণ মধ্যে নরলোকে অবস্থান করে এবং জঘন্য গুণসম্পন্ন তামসিক ব্যক্তিগণ অধধপতিত হয়ে নরকে গমন করে। জীব যখন দর্শন করেন যে, প্রকৃতির গুণসমুহ ব্যতীত কর্মে অন্য কোন কর্তা নেই এবং জানতে পারেন যে, পরমেশ্বর ভগবান এই সমস্ত গুণের অতীত, তখন তিনি আমার পরা প্রকৃতি লাভ করেন। দেহধারী জীব এই তিন গুণ অতিক্রম করে জন্ম , মৃত্যু, জরা ও দু:খ থেকে বিমুক্ত হয়ে অমৃত ভোগ করেন। অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন- হে প্রভু! যিনি এই তিন গুণের অতীত, তিনি কি কি লক্ষ্মণ দ্বারা জ্ঞাত হন? তাঁর আচরণ কি রকম? এবং তিনি কিভাবে এই তিন গুণ অতিক্রম করেন? পরমেশ্বর ভগবান বললেন- হে পান্ডব! যিনি প্রকাশ, প্রবৃত্তি ও মোহ আর্বিভূত হলে দ্বেষ করেন না এবং সেগুলি নিবৃত্ত হলেও আকাঙক্ষা করেন না, যিনি উদাসীনের মতো অবস্থিত থেকে গুণসমুহের দ্বারা বিচলিত হন না, কিন্তু গুণসমুহ স্বীয় কার্যে প্রবৃক্ত হয়, এভাবেই জেনে অবস্থান করেন এবং তার দ্বারা চ্ঞ্চলতা প্রাপ্ত হন না, যিনি আত্মস্বরুপে অবস্থিত এবং সুখ ও দু:খে সম-ভাবাপন্ন, যিনি মাটির ঢেলা , পাথর ও স্বর্ণে সমদৃষ্টি-সম্পন্ন, যিনি প্রিয় ও অপ্রিয় বিষয়ে সম-ভাবাপন্ন, যিনি ধৈর্যশীল এবং নিন্দা, স্তুতি, মান ও অপমানে সম-ভাবাপন্ন, যিনি শক্র ও মিত্র উভয়ের প্রতি সমভাব-সম্পন্ন এবং যিনি সমস্ত কর্মোদ্যম পরিত্যাগী- তিনিই গুণাতীত বলে কথিত হন। যিনি ঐকান্তিক ভক্তিযোগ সহকারে আমার সেবা করেন, তিনি প্রকৃতির সমস্ত গুণকে অতিক্রম করে ব্রহ্মভূত স্তরে উন্নীত হন। আমিই নির্বিশেষ ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা বা আশ্রয়। অব্যয় অমৃতের, শাশ্বত ধর্মের এবং ঐকান্তিক সুখের আমিই আশ্রয়।
ইতি: শ্রীমদ্ভগবতগীতার চতুর্দশ অধ্যায়ের বঙ্গানুবাদ সমাপ্ত

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র